প্রথম প্রবাস -৩

০৪.

আমরা টবীর খাওয়ার ঘরে বসে প্রাতরাশ খাচ্ছিলাম। প্রাতরাশ খাওয়ার পরই টবী ও স্মিতা দুজনেই আমাকে ভিক্টোরিয়া স্টেশানে ছাড়তে যাবে। সেখান থেকে কসমস ট্যুরস-এর ট্যুর নিয়ে আমি কন্টিনেন্টে যাব। বারো দিনের জন্যে।

বেশ রোদ উঠেছে আজ। টবীদের বাড়ির নীচে যেখানে গাড়িগুলো পার্ক করানো থাকে সেখানে ও বাগানে বাচ্চারা খেলছে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের গলার চিকন স্বর কাঁচের বন্ধ জানালা পেরিয়েও ওপরে আসছে। টবীর প্রতিবেশী মিস রবসন জিনের বেল-বটস-এর ওপরে রংচটা চামড়ার জার্কিন চাপিয়ে পাইপ ও ব্রাশ দিয়ে গাড়ি ধুচ্ছেন।

আজ শনিবার। অফিস ছুটি। সকলের কিন্তু বড়ো কাজের দিন আজ। স্মিতার আজ ওয়াশিং ডে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে এসে কাপড় কাঁচবে–যদিও ওয়াশিং মেশিনে–তারপর চুল শ্যাম্পু করবে–আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসার সময়ে সপ্তাহের বাজার করে আসবে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস থেকে।

কফির পেয়ালা এগিয়ে দিতে দিতে স্মিতা বলল, ভাসুরঠাকুর, তুমি চলে গেলে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগবে কয়েকদিন।

আমি হেসে বললাম, কয়েকদিনমাত্র। পৃথিবী ছেড়ে কেউ গেলেও কয়েকদিনই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। তারপর সব ঠিক হয়ে যায়। তারপর বললাম, তোমাকে থ্যাঙ্ক ইউ জানাই। তুমিই আমাকে লানডানে সাবালক করেছ, টিউবে চড়তে শিখিয়েছ; ককনী ইংরিজি শিখিয়েছ।

টবী বলল, শেখাবার চেষ্টা করেছে এল।

যাই-ই হোক, আমি বললাম।

আমার স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে টবী এগোল। পেছনে পেছনে আমি আমার নতুন কেনা ওভারকোট-টুপি ইত্যাদি নিয়ে। স্মিতা সবচেয়ে শেষে ঘর বন্ধ করে লিফটে এসে ঢুকল।

কেউ আমরা কোনো কথা বললাম না। এই কয়েকদিনের কারণ-আকারণের হাসি গল্প খুনসুটির সমস্ত উচ্ছ্বাস লিফটের মধ্যে কাছাকাছি ঘোঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের বুকের মধ্যে এক স্তব্ধ নীরবতায় জমে গেল।

একতলায় নেমে লিফটের দরজা খুলে টবী বলল, কী হল স্মিতা–এত চুপচাপ কেন? রুদ্রদা তো বারোদিন পরই আবার আসছে ক্যানাডা যাবার পথে।

স্মিতা হাসল। বলল, তুমিও তো চুপচাপ।

ভিক্টোরিয়া ট্রেন টার্মিনাসে যখন এসে পৌঁছোলাম তখন দেখি স্টেশনের একটা বিশেষ জায়গা ভিড়ে-ভিড়াক্কার। বাহুতে ব্যাজ লাগানো কসমস-ট্রস-এর কর্মচারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। যত যাত্রী বিভিন্ন ট্যুরে যাচ্ছে, আজ আমাদের দেশ হলে কর্মচারীর সংখ্যা অসংখ্য হত। যাই-ই হোক, খুঁজে-পেতে আমার যে ট্যুর সেই ট্যুরের কর্মচারীটিকে পাওয়া যেতেই তাকে দেখে আমি যেমন পুলকিত হলাম সেও আমাকে দেখে তেমনই পুলকিত হল। কারণ ট্রেন ছাড়ার আর বেশি দেরি ছিল না। যা বোঝা গেল তা হচ্ছে কসমস কোম্পানির বিভিন্ন ট্যুরের জন্যে লানডান থেকে ডোভারের এই বিশেষ ট্রেনটির বন্দোবস্ত হয়েছে। ট্রেনের প্রায় সব যাত্রীই বিভিন্ন ট্যুরের যাত্রী।

টবী আমার সময়াভাবের জন্যে যে বারোদিনের ট্যুরের টিকিট কেটেছিল–তাতে লেখা ছিল আটটি দেশ এবং প্যারিস। অর্থাৎ যেন প্যারিসের আকর্ষণ অন্য একটি পুরো দেশেরই মতো। এই ট্যুর একেবারেই জনতা ট্যুর। যাদের অবস্থা ভালো তারা কোন দুঃখে এই অধমের সঙ্গে যাবে। কসমস কোম্পানি অবশ্য দামি ও বিলাসবহুল ট্যুরের ব্যবস্থাও করেন।

দেখতে দেখতে ট্রেন এসে গেল। সকলের সিটই রিজার্ভ করা আছে। যে-যার জায়গায় গিয়ে বসলাম।

টবী ও স্মিতাকে ট্রেন-ছাড়া অবধি অপেক্ষা করতে বারণ করলাম। ওদের অনেক কাজ ছিল। এই উটকো দাদা এসে পড়ে তো এদের সময়ের এবং টাকা পয়সার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছুই করিনি।

ওরা চলে গেলে আমি ওভারকোট ও টুপি সামলেসুমলে রেখে নিজের সিটে বসলাম। শীতের দেশের লোকরা যে কী সপ্রতিভ অবলীলায় ওভারকোট টুপি ছাতা ছড়ি সব সামলায় তা দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

বসে পড়ে মনে হল এই-ই প্রথম আমার একা একা বিদেশ যাত্রা শুরু হল। বোম্বে থেকে প্লেনে ফ্রাঙ্কফার্ট হয়ে লানডানে আসা ইস্তক তো টবী ও স্মিতাই খবরদারি করেছে। এবার থেকে রীতিমতো স্বাবলম্বী। আট-আটটা দেশ ঘুরতে হবে–কতবার যে পাসপোর্ট বের করতে হবে–বিভিন্ন দেশের ভিসা দেখাতে হবে–কতবার যে কত জায়গায় নিজের নাম জন্ম তারিখ পাসপোর্টের নম্বর লিখতে হবে তা জানা ছিল না। ডোভারে গিয়ে আমরা জাহাজে করে বেলজিয়ামের অস্টেণ্ডে গিয়ে নামব। অস্টেণ্ডে কসমস কোম্পানির বাস দাঁড়িয়ে থাকবে। ওই বাসে করেই আমাদের বারো দিনের ট্যুর। রাতে শুধু বিভিন্ন জায়গায় হোটেলে রাত্রিবাস। আর সারাদিন চলা।

আমার পাশে একজন অত্যন্ত লম্বা প্রৌঢ়া মহিলা–উটপাখির মতো খোলা জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে গলা বার করে একটি যুবক এবং এক কিশোরীর সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে, ইংরেজ পুরুষরা কথা কম বললেও মহিলারা অত্যন্ত বেশি কথা বলেন। এবং সব দেশেই এক ধরনের বেশি বয়েসি অথচ নেকুপুযুমুনু মহিলারা প্রচুর জ্বালান অন্যদের।

কথাবার্তায় বোঝা গেল যে ভদ্রমহিলা অবিবাহিতা। যুবকটি তাঁর ভাইপো এবং কিশোরী নাতনি।

ট্রেন ছেড়ে দিলে ভাবলাম বাঁচা গেল। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম যে কত বড়ো ভুল। ভাইপো ও নাতনি চলে গেলে তিনি আমাকে নিয়ে পড়লেন।

এদিকে ট্রেন চলেছে ইংলিশ গ্রামের মধ্যে দিয়ে। দেখতে দেখতে আমরা ক্যান্টারবেরি এসে পৌঁছেছিলাম। রবিনহুড কি এই জায়গায় জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন? শার্লক হোমস-এর কত কান্ডকারখানা আছে এসব অঞ্চল নিয়ে। ক্যান্টারবেরির গল্প পড়েনি এমন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত কোথায়?

সাধারণত মেয়েদের মধ্যে ন্যাকামি আমার অপছন্দ নয়। ন্যাকামিটা মেয়েদের চেহারা ও চরিত্রের সঙ্গে যেমন ওতপ্রোতভাবে মানায় তাতে নারীত্বের একটা বিশেষ নরম দিক প্রকাশিত হয় বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু এই বিগতযৌবনা মহিলার বসার ধরন, কথা বলার কায়দা, চোখ ঘোরাবার ধরন-ধারণ দেখে ইচ্ছে হল যে ডোভারে নেমেই ওঁকে একটা বড়ো আয়না কিনে প্রেজেন্ট করি।

চারপাশে যারা বসেছিল সকলকে দেখা যাচ্ছিল না। যাদের দেখা যাচ্ছিল তাদের কারও সঙ্গেই আলাপ ছিল না। পরে এদের সকলের সঙ্গেই কত ঘনিষ্ঠতা হবে–একসঙ্গে খাওয়া বসা-হাঁটা-চলা। কনডাকটেড ট্যুরে এইটেই মস্ত লাভ যে বহুদেশের বহুলোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পাওয়া যায়।

দেখতে দেখতে ডোভারে এসে দাঁড়াল ট্রেন। একটি সুন্দরী অল্পবয়েসি বেলজিয়ান মেয়ে –কসমসের গাইড আমাদের বলে গেল যে তোমাদের স্যুটকেস নিয়ে কাস্টমস-এর হাত পেরিয়ে এক জায়গায় রেখে দিয়ে। আমরা বোটে নিয়ে যাব এবং বার্থে পাঠিয়ে দেব।

যেহেতু বোট বেলিজয়ামে যাচ্ছে এবং আমরা বোটের যাত্রী–ডোভার স্টেশানেই ব্রিটিশ কাস্টমস আমাদের পাসপোর্ট-টাসপোর্ট দেখে–এনিথিং টু ডিক্লেয়ার? বলে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিল।

আমরা বোট মানে নৌকো বুঝি। নৌকোর চেয়ে বড়ো মোটর-লঞ্চ তারপর স্টিমার তারপরে জাহাজ–শিপ। কিন্তু এখন সারাপৃথিবীতে বোট মানে জাহাজ। ভাষা নিয়ে অনেক রমদা-রমদি হয়েছে ইদানীং। ভাষাতত্ত্ববিদদের হাতপাখার ডাঁটি দিয়ে বসে বসে পিঠের ঘামাচি মারতে হয় দেখে পুরোনো ভাষা ও উচ্চারণ পালটে দিয়ে তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছেন। ধরা যাক ইংরিজি Schedule কথাটা। আমরা জানি শিডিউল। কেউ কেউ বলেন শেডল। কিন্তু আমেরিকানদের দৌলতে ইংরিজি ভাষাটাই গায়েব হতে বসেছে। Schedule-এর বর্তমান উচ্চারণ পুরো পশ্চিমজগতে এখন কেজুল। পুরোনো ইংরিজি কথাটাকে এমন ডাক্তারি বানানের কায়দায় উচ্চারণ করে কী উপকার হল জানি না কিন্তু এখন ওখানে শিডিউল বললে কেউ বুঝবে না।

ব্রিটিশ কাস্টমস-এর কালো ব্লেজার-পরা গুঁফো অফিসারদের চকচকে জুতোর চাকচিক্যের দিকে শেষবার চেয়ে প্রকান্ড জাহাজের হাঁ-করা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম। সমস্ত পশ্চিমি দেশে যা সত্যিই আশ্চর্য করে তা সকলের সৌজন্য। যে লোক টিকিট কেটে ট্রেনে চড়েছে, যে দোকানে এসেছে, যে-আয়কর দিচ্ছে তারা সকলেই ভি-আই-পি। সৌজন্যে কিছুমাত্র খরচ হয় না কিন্তু বিনিময়ে যা পাওয়া যায় তার তুলনা নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা যে সৌজন্যে বিশ্বাস করে সে অন্যের প্রতি তা দেখিয়ে নিজেকেই এক উন্নত আসনে অধিষ্ঠিত করে। সৌজন্যে যা পাওয়া যায় এ জীবনে তা অন্য কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না।

বোটে উঠে একটা বসার জায়গা ঠিক করে মালপত্র তাতে রেখে সামনের ডেকে এলাম। হু-হু করে কনকনে হাওয়া আসছে ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে। ওভারকোট ও টুপি পরেও জমে যাচ্ছি। অথচ ওদেশে তখনও সামার। ঝকঝক করছে রোদ কিন্তু মনে হচ্ছে সোনালি বরফ পড়ছে আকাশ থেকে।

পাশেই ডোভারের বিখ্যাত হোয়াইট রকস। দেখা যাচ্ছে। ডোভারকে বলে ডোভার অফ দ্য হোয়াইট রকস। সাদা সী-গালের ঝাঁক উড়ছে নীল জলের ওপর। সাদা পাহাড়গুলোর ওপরে পাখিগুলোউড়ে বসছে। পাহাড়ের খাড়া গায়ের ফাঁক-ফোকরে সী-গালেদের বাসা।

নীচে ডিউটি-ফ্রি শপ খুলে দিয়েছে। হুইস্কি, চকোলেট আর পারফিউম কেনার ধুম পড়ে গেছে। রথযাত্রার মেলায় তালপাতার বাঁশি কেনা গরিব ছেলের মতো আমি গিয়ে গুটি গুটি একটিন পাইপের তামাক কিনে ফিরে এলাম।

এবার বোট ছাড়ল। আজ সমুদ্র বড়ো অশান্ত। টবী ও স্মিতা বলে দিয়েছিল যে জাহাজে উঠে কিছু খেয়ে নিয়ে নইলে সী-সিক হয়ে পড়বে। ডাইনিং রুম দুটো। একটাতে ওয়েটার খাবার সার্ভ করে। সেখানে দাম বেশি। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যটাতে সেলফ সার্ভিস। এককাপ কফি ও দুটো স্যাণ্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ-পর্ব সমাধা করলাম।

আমার সিটের পাশে একটি অল্পবয়েসি ইংলিশ ছেলে বসেছিল। ও ব্রাসেলস-এর কলেজে পড়ে ইংরিজি এবং তুলনামূলক সাহিত্য। ও বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে চেনে না কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে চেনে। সারাপৃথিবীতে রসিক সকলে অপু-ট্রিলজি দেখেছে কিন্তু পথের পাঁচালির লেখক যে সম্মানের লোক তা জানে না। একথা জেনে দুঃখ হল। ছেলেটির সঙ্গে অনেক্ষণ গল্প করে কাটানো গেল। আজকাল পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই পড়াশোনা একটা ভালো চাকরির সিঁড়ি। পড়াশোনা করার আনন্দে খুব কম ছেলে মেয়েই পড়াশোনা করে আজকাল। কেন জানি না!

বোট বড়ো ঝাঁকাচ্ছে। একদল মেয়ে বমি-টমি করে অস্থির। লেডিজ রুমের সামনে যেন কাঙালি-ভোজন লেগে গেছে। কেউ মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কেউ দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে অসহায় আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে আছে।

মেমসাহেব মানে মার্কেন্টাইল ফার্মের বড়োসাহেবের দারুণ দারুণ গাউন পরা সুগন্ধি পারফিউম মাখা মেয়েছেলে বলেই জানতাম। মেমসায়েবদেরও এমন হেনস্থা হয় তা নিজে চোখে দেখে মনে মনে একটু খুশি হলাম। আসলে ব্যাটা-ছাওয়া; ব্যাটা-ছাওয়া; বিটি ছাওয়া; বিটি-ছাওয়া। পোশাক যার যাই-ই হোক না কেন–আর গায়ের রং যাই-ই হোক।

বিকেল হয়ে এসেছে। রোদে মাতাল হয়ে ওঠা উথাল-পাথাল করা চ্যানেলের ঢেউ-এর মাথায় ফেনা চিকমিক করে উঠছে। দূরে ড্যাঙা দেখা যাচ্ছে। আমরা বেলজিয়ামের তীরে এসে গেছি বলে মনে হচ্ছে। অস্টেণ্ডের জেটির দিকে মুখ করল বোট। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমে আসছে। আবছা তীর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা আরও অনেক জাহাজের মাস্তুল-টাস্তুল দেখা যাচ্ছে।

কথা আছে জাহাজ থেকে নেমে বেলজিয়াম কাস্টমস ক্লিয়ার করে আমরা আমাদের বাসে উঠব। তারপর বাসে করে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ পৌঁছোব। এ রাতটা ব্রাসেলস এই কাটাব। তার পরদিন ভোরে আবার বোরোব।

বোটে বমি না হলেও ওইরকম দোলানিতে শরীর খারাপ লাগছিল। একটা গা-গুলোনো ভাব। জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই বোটের পেটের দরজা খুলে গেল। বাইরে থেকে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আসতে লাগল ভেতরে। হাওয়াতে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। এতক্ষণ হিটেড বোট থেকে বাইরের ঠাণ্ডা সম্বন্ধে কিছুই বোঝা যায়নি। বন্দরে নেমে মনে হল ঠাণ্ডা তো নয় যেন হাঙর-জুতোর মধ্যে ঢুকে পড়ে গোড়ালি কামড়ে ধরেছে।

মালপত্র হাতে নিয়ে সকলের সঙ্গে গুটিগুটি পা-পা করে বাইরে বেরোলাম। এত লোক ঘেঁষাঘেষি ঠেসাঠেসি কিন্তু হুড়োহুড়ি নেই, চেঁচামেচি নেই–আমাদের মতো এত বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না পশ্চিমিরা–কথা বললেও ফিসফিস করে যাকে বলছে তাকে শোনাবার জন্যেই বলে–চারদিকের লোককে শোনাবার জন্যে বলে না।

হাতের মালপত্র নিয়ে জেটি থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই দেখি সার সার বাস দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক বাসের সামনের উইণ্ডস্ক্রিনের ওপরে হলুদ কাগজে লেখা আছে কসমস কোম্পানির বিভিন্ন ট্যুরের নম্বর। আমাদের ট্যুরের নম্বর দুটো কুড়ি।

একটি মেয়ে হলুদ ব্যাজ বাহুতে লাগিয়ে প্রত্যেককে ট্যুর নম্বর জিজ্ঞেস করে করে যার যার বাসের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ইংলিশ ছেলে–পরনে একটা কালচে কড়ু ঝুঁয়ের ট্রাউজার, গায়ে কালচে গরম কোট-ঘাড়-অবধি নেমে আসা লালচে চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে টিকিট দেখে দেখে কার কোথায় বসার জায়গা বলে দিচ্ছে।

এগিয়ে গিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলাম। জানলার পাশের সিট আমার। লক্ষ করে দেখলাম ট্যুরের বেশির ভাগ লোকই বয়স্ক। অল্পবয়েসি কিছু ছেলে-মেয়েও ছিল। কার কী জাত, কে কোন লোক জানি না। আমার পাশে কার সিট তাও জানি না। এক-একজন করে বাসের পাদানিতে উঠে আসছে আর তার দিকে তাকাচ্ছি। শেষে আমার যেমন বরাত তেমনই ঘটল। একজন গোলাকৃতি ফিলিপিনো মহিলা আমার পাশে এসে বসলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল অজানিতে। ইনি না হয়ে যে-কোনো একজন অস্ট্রেলিয়ান বা ইজরায়েলি তরুণীও তো আমার বারোদিনের গা-ঘেঁষা সঙ্গিনী হাত পারত!

যাই-ই হোক তৎক্ষণাৎ আলাপ করে ফেললাম। জানা গেল তিনি একজন গাইনিকোলজিস্ট –ফিলিপিনস থেকে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যাণ্ডে এসেছেন উচ্চতর শিক্ষার জন্যে। এই ট্যুর নিয়েছেন দেশ দেখবার জন্যে–বৃত্তির টাকা জমিয়ে। বৃত্তি ছাড়াও ভালো চাকরি করেন তিনি। এবং একটু কথা বলেই বোঝা গেল ভদ্রমহিলা অত্যন্ত যোগা। আপাতযোগ্যতা ও তাঁর বিশেষশিক্ষা প্রয়োগ করতে পারেন এমন কোনো সম্ভাবনা এই বিরাট বাসের প্রায় জনা চল্লিশকে যাত্রীকে পুঙ্খানুপুঙ্খ করে দেখেও মনে হল না। গাইনিকোলজিস্ট না থেকে আমাদের বাসে কোনো জেনারাল ফিজিশিয়ান বা হার্ট স্পেশ্যালিস্ট থাকলে বোধহয় ভালো হত।

বাসের দু-পাশে পেটের তলায় হোল্ড আছে। সেখানে আমরা আমাদের মালপত্র শনাক্ত করার পরেই সেই ইংলিশ ছেলেটি এবং বেঁটে-খাটো শক্তসমর্থ চেহারার বয়স্ক একজন শ্বেতাঙ্গ লোক সেগুলোকেহোল্ডে তুলে দিলেন। সেই-ই প্রথমবার। তারপর সমস্ত পুরুষদের নিজের নিজের মাল ছাড়াও সমস্ত মহিলাদের মাল চাঁদা করে বইতে হয়েছে এবং বার বার তুলতে-ওঠাতে হয়েছে। এটা একটা বড়ো শিক্ষা। টাকা দিয়ে টিকিট কেটে বেড়াচ্ছি বলেই যে মহারাজা হয়ে গেছে কেউ একথা বিশ্বাস করা ইংরেজদের স্বভাবে নেই। মেয়েদের ওরা যা সম্মান করে ও মেয়েদের যেমন তুলো-তুলো করে রাখে তা বলার নয়। যে-কোনো দেশের সমাজে মেয়েদের আসন কোথায় তা দেখে সেই জাতের সাংস্কৃতিক উচ্চতা বা নীচতা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

দেখতে দেখতে সব প্যাসেঞ্জার এসে গেলেন। বাসের প্রতিটি সিট ভরে গেল। তখন সেই ইংলিশ ছেলেটি বাসের সামনে তার ছোটো আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাসের ভেতরের যোগাযোগের অ্যামপ্লিফায়ারের মাউথপিস তুলে নিয়ে বলল, আমার নাম অ্যালাস্টার। আমি তোমাদের গাইড। পরের বারোদিন আমি সবসময় তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকব। তারপর স্টিয়ারিং-এ বসে থাকা সেই বেঁটে-খাটো শক্তসমর্থ ভদ্রলোকটিকে দেখিয়ে, যিনি মাল তুলতে অ্যালাস্টারকে সাহায্য করছিলেন–বলল, এঁর নাম জ্যাক। ইনি এই বাস চালাবেন। কসমস ট্যুরস লিমিটেডের পক্ষ থেকে এবং আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে আমরা আপনাদের সকলকে এবং প্রত্যেককে স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি পরের বারো দিন আপনাদের ভালোই কাটবে।

বাসটা ছেড়ে ছিল। আমরা বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এর দিকে এগিয়ে চললাম।

অ্যালাস্টার বলল, আমরা ডিনার-টাইমে অর্থাৎ সাতটার সময়ে ব্রাসেলস-এর হোটেলে পৌঁছে যাব।

আমাদের প্রকান্ড বাসটা ভারি চমৎকার। অতখানি চওড়া বাসটার সমস্ত সামনেটা জুড়ে কাঁচ–অর্থাৎ বাসের যেখানে খুশি বসে সামনে পরিষ্কার দেখা যায় ড্রাইভার ও গাইডের সিট নীচুতে। প্যাসেঞ্জাররা যেখানে বসেন সে জায়গাটা অপেক্ষাকৃত উঁচু। দু-পাশে দু-সারি সিট। পাশাপাশি দুজন করে বসার। বাসটা ওয়েস্ট জার্মানির তৈরি। নাম Sentra-240 সি. সি.। একলিটার ডিজেলে চার কিলোমিটার করে যায়। প্যাসেঞ্জারদের সিটগুলো এরোপ্লেনের সিটের মতো আরামের। বাসের পেছনে ব্লোয়ার আছে। গরম হাওয়া পায়ের পাশ দিয়ে নলে করে বইয়ে দেওয়া হয়–যাতে ভেতরটা গরম থাকে।

দেখতে দেখতে আমরা হাইওয়েতে এসে পৌঁছোলাম। তারপর হু-হু করে ছুটল বাস। অ্যালাস্টার মাইক্রোফোনে বিবরণী দিয়ে আমাদের ডানদিক বাঁ-দিকের দ্রষ্টব্য জিনিস দেখাতে দেখাতে যাচ্ছিল।

সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠল। আমরা এসে ব্রাসেলস-এ পৌঁছোলাম। বাস থেকে বার বার স্যুটকেস ও মাল নামিয়ে বয়ে নিয়ে আসতে হল হোটেলের রিসেপশানে। অ্যালাস্টার ও রিসেপশনিস্ট নাম ডেকে ডেকে যার যার ঘরের চাবি তাকে তাকে দিয়ে দিল। ওই হোটেলে লিফট ছিল। মাল সিঁড়ি দিয়ে বইতে হল না সে যাত্রা। পরে অনেকানেক হোটেলে পাঁচ-ছ তলা অবধি নিজের স্যুটকেস বয়ে উঠতে হয়েছিল।

ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে আসতে হল ডিনার সারার জন্যে। স্যুপ, বিফ স্টেক ও পুডিং। তারপর নাইট-ট্যুরে বেরোনো গেল। নাইট-ট্যুরে অ্যালাস্টারের ছুটি। অন্য একটা বাসে করে আমরা গেলাম। ড্রাইভারই গাইড। একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে কমুনিকেশন সিস্টেমের মাউথপিস ধরে রাতের ব্রাসেলস দেখাতে দেখাতে চলেছে।

ব্রাসেলস-এর দ্রষ্টব্যর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে Atomieum এখানে ওয়ার্লড ফেয়ারের সময়ে এটা তৈরি হয়েছিল। স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর দক্ষতার পরাকাষ্ঠা। অনেকগুলো বিভিন্নাকৃতি বড়ো ছোটো অতিকায় বল যেন সাজানো আছে। উচ্চতাতে গড়ের মাঠের মনুমেন্টের চেয়েও উঁচু। লিফট আছে ওপরে উঠবার। নীচের দিকের বলগুলোতে নানারকম রেস্তোরাঁ। সবচেয়ে ওপরের বলটার মধ্যে যে রেস্তোরাঁ সেটা খুব এক্সপেনসিভ। আমাদের মতো কসমস ট্যুরের প্যাসেঞ্জারের সাধ্যের একেবারেই বাইরে। তবু দেখেই চক্ষু সার্থক করলাম দূর থেকে।

একটা ম্যাল মতো জায়গায় বাস দাঁড়াল। ড্রাইভার-কাম-গাইড বলল–সকলে ডান দিকে দেখুন। তাকিয়ে দেখি একটা ব্রোঞ্জের তৈরি বাচ্চা ছেলের মূর্তি। ছেলেটি বাঁ-হাতে প্রত্যঙ্গ বিশেষ ধরে হিসি করছে। গাইড বলল, লক্ষ করুন ওর ডান হাত ফ্রি আছে যাতে সুন্দরী মহিলা দেখলেই স্যালুট করতে পারে।

আমাদের দেশ হলে এমা! কী অসভ্য ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রব উঠত। কিন্তু দেখলাম ব্যাপারটার রসিকতা সকলেই পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে দারুণ উপভোগ করল। পরে দেখেছিলাম শুধু বেলজিয়ামেরই সর্বত্রই নয়–পৃথিবীর অন্যান্য অনেকানেক জায়গায় এই পিসিং বয়ের মূর্তি একটা খুব ফেভারিট স্যুভেনির। এই ছেলেটি নানাজনের কাছ থেকে নানারকম জমকালো পোশাক পায়। সেসব পোশাক সে নাকি তার জন্মদিনে পরে। তার সঠিক জন্মদিন নিয়ে নাকি বিতর্কের অবকাশ আছে, কিন্তু পোশাকের কোনো অভাব নেই বলে সে সব-দিনই ভালো ভালো পোশাক পরে। স্যার মরিস শিভলিয়র নাকি তাকে জব্বর একটি পোশাক দিয়েছিলেন।

এরপর বাস এসে দাঁড়াল বেলজিয়ামের রাজার রাজবাড়ির সামনে। এই রাজবাড়িতে বসে নেপোলিয়ান তাঁর রাশিয়া আক্রমণের প্ল্যান করেছিলেন।

তারপর আরও অনেক কিছু দেখা-টেখার পর গাইড বলল, এবার আপনাদের একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাব। মহিলাদের বলল, স্বামীদের সাবধানে রাখবেন যাতে পরে এইখানে আবার ফিরে না আসেন। অবাক কান্ডই বটে! একটা সরু গলিতে বাস ঢুকল। দেখি দু পাশের বাড়িগুলোর একতলা এবং দোতলাতে কাঁচের শো-উইণ্ডো। অনেকটা শো-কেশের মতো। সেই এক-একটা চৌকো কাঁচের বাক্সের মধ্যে এক-একজন করে নগ্না রমণী বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন। এ রসে যারা রসিক তারা যার যার পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেবে।

বেলজিয়ামের কোনো নিজস্ব ভাষা নেই। এখানকার ভাষা ডাচ অথবা স্প্যানিশ। দুটো ভাষাই চলে কিন্তু ডাচ ভাষায় কথা বলে একান্ন শতাংশ লোক আর স্প্যানিশ ভাষায় ঊনপঞ্চাশ শতাংশ লোক।

বাসটা হোটেলের দিকে ঘুরল। ব্রাসেলস থেকে Antwerp বিখ্যাত বন্দর মাত্র পঁচিশ মাইল। তারপর রাত প্রায় এগারোটার সময়ে আমাদের ছোটো কিন্তু সুন্দর হোটেলে আমরা ফিরে এলাম। হোটেলের নাম A.B.C. Hotel.

দেশ ছেড়ে এসে–লানডানের ভায়ার বাড়ির আতিথ্যের পর এই প্রথম রাত বাইরে কাটানো। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরের বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। পালকের গদি, পালকের লেপ, পালকের বালিশ। ভারি আরাম। শরীরে খুব ক্লান্তি কিন্তু দেশ বেড়ানোর আনন্দ ও উত্তেজনা মিশে থাকায় ঘুম আসছিল না। তার ওপর অ্যালাস্টার বলে দিয়েছিল যে, ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। সাড়ে পাঁচটায় ব্রেকফাস্ট খেতে হবে নিজের নিজের মাল নিয়ে এসে। ঠিক ছ টায় বাস ছেড়ে দেবে। এই ঠাণ্ডাতে অত সকালে উঠতে হবে শুনেই ভয়ে ঘুম আসছিল না। বিছানা ছেড়ে এসে একবার কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়ালাম। রাতের ব্রাসেলস-এর আলো ঝলমল করছে। আমার ঘরের মধ্যে অন্ধকার। ভারি ভালো লাগছিল। কাল ভোরে আমরা ব্রাসেলস ছেড়ে লাকসেমবার্গ, গসবাগ হয়ে পশ্চিম জার্মানির বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে গিয়ে Denzlingen-এ গিয়ে রাত কাটাব।

অনেকক্ষণ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখ ছেয়ে এল।

কে যেন দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে গেল।

ঘুম তার আগেই ভেঙে গেছিল। অত ভোরে উঠতে হবে এবং যদি ঘুম না ভাঙে এই আতঙ্কেই সারারাত ঘুম হল না। যতটুকু হল তা ছেঁড়া-ঘেঁড়া পাতলা ঘুম।

ঘরের মধ্যেই একটা বেসিন ছিল। মুখে-চোখে জল-টলও দেওয়া গেল। কিন্তু বাথরুমে যাওয়া এক সমস্যা। এক-এক তলায় দুটি করে বাথরুম। সেই তলায় যতজন লোক সকলের সেই বাথরুম দুটি ব্যবহার করতে হবে। অন্য লোকের প্রতি কনসিডারেশন ও পাছে দেরি হয়ে যায় এই ভয়ে বাথরুমে যাওয়া আর না-যাওয়া সমান।

স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়ে, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে নীচে ব্রেকফাস্ট করতে নামা গেল।

ইংরেজরা আমাদের প্রভু ছিল বলে ব্রেকফাস্ট ব্যাপারটা আমাদের শেখা তাদের কাছ থেকে। ফুটজুস, পরিজ বা কর্নফ্লেকস, তারপর টোস্ট ডিম ইত্যাদি ইত্যাদি, সঙ্গে হয়তো চিকেন লিভার বেকন অথবা অন্য কিছু। কিন্তু কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট বলতে যা বোঝায় তা হল গরম গরম ব্রেডরোলস–সঙ্গে টেবিলে-রাখা মাখন ও মার্মালেড–তারপর চা অথবা কফি-ব্যস।

যেমন ঠিক ছিল তেমনই সকলে সময়মতো তৈরি হয়ে বাসের কাছে আসা হল। বাস দাঁড়িয়ে ছিল একতলায় ডাইনিং রুমের একেবারে সামনে। তারপরই যতটুকু ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছিল তা হজম হয়ে গেল মহিলাদের স্যুটকেস হোল্ডে তোলার শিভালরাস প্রচেষ্টায়।

সকলে যে-যার সিটে গ্যাঁট হয়ে বসলাম। জ্যাক ও অ্যালাস্টার সকলকে গুডমর্নিং করল। জ্যাক এঞ্জিনের চাবি ঘোরাল, বাসের ব্লোয়ার খুলে দিল–এমন সময়ে অ্যালাস্টার বলল, জাস্ট আ সেকেণ্ড জ্যাক।

দুটি অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে পাশাপাশি সিটে বসে অস্টেণ্ড থেকে ব্রাসেলস-এ এসেছিল, তাদের সিটটি শূন্য।

হইহই পড়ে গেল। কোথায় গেল সুন্দরী মেয়ে দুটি? কিডন্যাপড হয়ে হয়ে গেল না তো?

অ্যালাস্টার সকলকে জিজ্ঞেস করল, কেউ কি তোমরা দেখেছ তাদের?

সকলেই সমস্বরে বলল, না। কেউই দেখেনি। ওদের যে-তলায় ঘর ছিল সে-তলার অন্যান্যরা ওদের বাথরুমে দেখেনি।

তবে?

ইংরেজ লোকরা ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল।

অ্যালাস্টার নিরুত্তাপে ক্যাজুয়ালি বলল, দে ম্যাস্ট বি অন দেয়ার ওয়ে।

দশ মিনিট কাটল। তবুও তাদের পথ ফুরোল না।

ট্যুরের প্রথম দিনের সকালে এমন বিপত্তিতে অ্যালাস্টার বেচারা ঘেমে নেয়ে উঠল। দেরি। হলে সমস্ত দিনের প্রোগ্রামেরই দেরি হয়ে যাবে।

এমন সময়ে জ্যাক বলল, একবার নেমে দেখে এসো তো অ্যালাস্টার ব্যাপারটা কী?

অ্যালাস্টার লক্ষ্মী ছেলের মতো নেমে গেল।

ইংরেজ প্যাসেঞ্জাররা ঘড়ি দেখে দেখে বাঁ-হাতের বগলে ব্যথা করে ফেলল, তবু অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে দুটির পাত্তা নেই।

আমার বাঁ-পাশে একজন বুড়ো ইংরেজ-বুড়ো মানে বছর ষাটেক বয়স হবে কিন্তু দেখতে একেবারে জোয়ানের মতো। তাঁর পাশে তাঁর স্ত্রী। আমার ঠিক পেছনে তাঁর শালা ও শালা-বউ। আমার পাশের ভদ্রলোকের নাম জন ও তাঁর শালার নাম বব। শালা-ভগ্নীপতিতে গতকাল বেশ গল্প-গুজব করতে করতে এসেছেন। জনের মুখেই শুনেছি যে জন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষে ছিল।

জন এবার কাঁধ ফিরিয়ে ববকে বলল, আই নো দ্য অসীসহোয়েন আই ফট উইথ দেম সাইড বাই সাইড। বিলিভ মি–দিজ ফেলাস আর অ-ফুলি স্লো।

যে-সময়ে বেরুনোর কথা ছিল সে সময় থেকে পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল।

এমন সময়ে যাত্রাপার্টির ছোকরার মতো বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে অ্যালাস্টার হোটেলের অফিস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল।

এসে বাসে উঠল দরজা খুলে।

হোয়াটস-দ্য ম্যাটার?

সমস্বরে অনেকে শুধোল অ্যালাস্টারকে।

জন বলল, এনি নিউজ?

অ্যালাস্টার গোবেচারার মতো মাথা নাড়িয়ে জানাল, হ্যাঁ। তালাস মিলেছে।

কোথায়? সকলে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল।

অ্যালাস্টার বলল, ওঁরা ঘুমিয়ে আছেন। হোটেলের মালকিন ওদের তুলতে গেলেন এইমাত্র।

আর যাবে কোথায়?

বলার সঙ্গে সঙ্গে বাসের মধ্যে প্যাণ্ডেমনিয়ম। সাত জাতের লোকে ভরতি বাস। তাদের বিভিন্ন নোট অফ এক্সক্লামাশানে বাস ভরে উঠল। মহিলারা সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হলেন। আমার ভাবগতিক দেখে মনে হল মেয়ে দুটো যখন বাসে উঠবে তখন এঁরা হয়তো আস্ত চিবিয়ে খাবেন ওদের।

না–চিবিয়ে খাওয়া ক্যানিবালদের ধর্ম। একটা ভদ্রগোছে রফা হল। বব প্রস্তাব তুলল যে ওরা যখন বাসে উঠবে তখন সকলে হাততালি দিয়ে ওদের অপমান করবে। প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল।

হঠাৎ দেখি আমার পিঠে কে টোকা মারছে।

তাকিয়ে দেখি, বব-ওর গোল্ড-ব্লক পাইপের তামাকের কৌটোটা খুলে ধরে আমাকে বলছে, হ্যাভ আ ফিল।

আমিও খুশি হয়ে ওই তামাকে পাইপটা ভালো করে ভরলাম।

এই ট্যুর নাম্বার টু-টোয়েন্টির প্রথম সংকটে আমরা ববকে দলের নেতা নির্বাচন করলাম। এর পরেও বহু সংকটে বব নেতাজনোচিত অনেকানেক কাজ করেছিল। নেতার মতো নেতা। ঠাণ্ডা মাথা, স্বার্থপরতা নেই, বিপদের মুখে সবচেয়ে আগে দৌড়ে যায়, সকলের চেয়ে বেশি কষ্ট করে। ববকে নেতা মানতে অন্তত আমার কোনো দ্বিধা ছিল না।

আমরা সকলেই আজ যে বাস ছাড়বে, সে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ছিল পালকের নরম বালিশ আর লেপটার কথা। আরও আধ ঘণ্টা জমিয়ে ঘুমনো যেত! এই অ্যালাস্টারটার যত পাকামি।

এমন সময়ে দেখা গেল তাঁরা আসছেন।

গতকাল থেকে এত জনের ভিড়ের মধ্যে ওরা কারো চোখে পড়েনি। আজ বাস-ভরতি লোক–ওদের দুজনকে শ্যোনদৃষ্টিতে দেখতে লাগল।

একজন বেশ লম্বা। দারুণ ফিগার। ভারি মিষ্টি দেখতে। অন্যজন অত লম্বা নয় কিন্তু দুষ্টু দুষ্টু নীল চোখ; একটু মোটার দিকে। দুজনেরই পরনে খাকি-রঙা কডুরয়ের ট্রাউজার ও ফুলহাতা সোয়েটার। লম্বাজনের সোয়েটারের রং হালকা খাকি, বেঁটেজনের গাঢ় খয়েরি।

ওরা বাসে উঠতেই একসঙ্গে সকলে হাততালি দিতে লাগলেন।

যে মেয়েটি লম্বা সে ভারি লজ্জা পেল। লজ্জানত মুখ নামিয়ে সে নিজের সিটে গিয়ে বসল –আই অ্যাম অ-ফুলি সরি বলতে বলতে। কিন্তু তার সঙ্গিনীর চোখে আগুন ছিল। ভাবটা, দেরি করেছি, আমাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়নি কেন?

যাই-ই হোক, অবশেষ বাস ছেড়ে দিল। একটু পরই জঙ্গলে এসে পড়লাম। Soignes-এর জঙ্গল পেরিয়ে দেখতে দেখতে আমরা Overise হয়ে Wavre হয়ে Gembloux হয়ে নামুর-এ এসে পৌঁছোলাম।

নামুর-এ পোঁছে চা বা কফি খাওয়ার জন্যে দশ মিনিট বাস দাঁড়াল। সকলে নেমে চা বা কফি খেল।

নামুর থেকে রওয়ানা হয়ে Arlon-এ আসা গেল। তারপর বেলজিয়ামের সীমানা পেরিয়ে গ্র্যাণ্ড ডাচী অফ লাক্সেনবার্গ-এ এসে পৌঁছোলাম। গ্র্যাণ্ড ডাচীর রাজবাড়িটি পথের বাঁ-পাশে পড়ল। অ্যালাস্টার কমিউনিকেশন সিস্টেমে বলতে বলতে চলেছে–বাসও চলেছে পথের পর পথ–জেলার পর জেলা পেরিয়ে।

সেখানেই লাঞ্চ খাওয়া হল। এখানে এখনও ফিউডাল প্রথা চালু আছে। লাক্সেনবার্গের মতো ছিমছাম ছোটো একটা রাজ্যের রাজা হওয়া গেলে মন্দ হত না।

যেভাবে দেশের পর দেশ পার হয়ে আসছি যে, আমার মনে হল বর্ধমান থেকে বাঁকুড়া কি বহরমপুর থেকে সিউড়ি আসতে বুঝি কতই না দেশ পার হতে হত।

লাঞ্চ বলতে একটা স্যুপ, একটুকরো চশমা করে কাটা বিফস্টেক-রীতিমতো আণ্ডার ডান অর্থাৎ আধ-সেদ্ধ। সায়েবরা নাকি আণ্ডার-ডান বিফস্টেকই পছন্দ করে বেশি। হবে হয়তো। আমার তো মোটে ভালো লাগে না। তবে, পরে বুঝেছিলাম পেটে থাকে অনেকক্ষণ এবং খেলে শীতটাও বুঝি একটু কম-কম মনে হয়।

ওখান থেকে রওয়ানা হয়ে ফ্রান্সের লোরেন ও আলসাক ব্রডিন্স দিয়ে বাস চলতে লাগল।

অ্যালাস্টার বলল, বিকেলে আমরা স্ট্রসবার্গ হয়ে রাইন নদী পেরিয়ে জার্মানিতে ঢুকব। রাইন এখানে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে।

কখন রাইন নদী দেখব, কখন দেখব করে হা-পিত্যেশ করে বসেছিলাম। কিন্তু যখন অ্যালাস্টার বলল, ওই যে দেখা যায় তখন আমার বরিশালের মাধবপাশা গ্রামের দীঘির পারে শোনা এক কীর্তনীয়ার কীর্তনের কথা মনে পড়ল।

রাইনের সাঁকোর ওপর যখন বাসটা এল তখন অ্যান্টি-ক্লাইম্যাকসের চূড়ান্ত এই যে দেখি। আমাদের কালীঘাটের গঙ্গার চেয়ে একটু বড়ো এক ঘোলাজলের নদী।

হঠাৎই সেই মুহূর্তে আমার বড়ো গর্ব হল আমার সুন্দর দেশটার জন্যে। কী সুন্দর আমাদের দেশটা–কত ভালো আমাদের দেশের সাধারণ লোকেরা–শুধু আমরা যদি, আমরা যদি, এদের মতো দেশকে ভালোবাসতাম, দেশের ভালোকে ভালোবাসতাম, যদি শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ না ভোলাবার চেষ্টা করতাম! কী না করতে পারি আমরা এখনও আমাদের দেশটাকে নিয়ে। যদি সময় থাকতে বুঝতে পারতাম যে দেশটা সকলের প্রত্যেকের দেশটা কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারের বা একাধিক রাজনৈতিক দলের নয়–তাহলে কী ভালোই না হত।

রাজা লিওপোল্ড-এর রাজত্ব ছেড়ে আসার পর চা খাওয়ার জন্যে যে প্রকান্ড অথচ জনবিরল একতলা রেস্তোরাঁতে আমাদের বাস পনেরো মিনিটের জন্যে থামানো হয়েছিল, তার বিরাটত্ব রীতিমতো চমৎকৃত করেছিল।

রেস্তোরাঁ না হয়ে খুব সহজেই জায়গাটা পাবলিক হল হতে পারত। ডায়াসের ওপর একটা অটোমেটিক বিদ্যুৎ চালিত অর্কেস্ট্রা বাজছে। ডায়াস ও বসার বন্দোবস্ত দেখে মনে হল এখানে নিশ্চয়ই গান বাজনা ইত্যাদি হয়ে থাকে।

সকালে অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে দুটি আমাদের দেরি করিয়ে দেওয়া ছাড়াও সে-সকালেই আরও একটা কান্ড ঘটেছিল।

পরশু রাতে ব্রাসলস শহরে ঘুরে বেড়াবার সময় আমাদের একটা লেসের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সুন্দর সব লেসের কারুকাজ। টেবল ক্লথ, পর্দা, টেবল ম্যাটস আরও কত কী। কিন্তু আমাদের দলের একজন আমেরিকান মহিলা–মিস ফাস্ট তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছিলেন। লেস কেনার জন্যে টাকা বের করার সময়ে বোধহয় পাসপোর্ট পার্স থেকে দোকানেই পড়ে গেছিল। তাই সকালে রওয়ানা হয়েই প্রথমে আমরা সেই দোকানের সামনে এলাম সবচেয়ে আগে। কিন্তু শোনা গেল যে দোকান খুলবে সাড়ে আটটায়। জ্যাক আর অ্যালাস্টার বিনা বাক্যব্যয়ে সেই মহিলাকে মালপত্র সমেত ওই দোকানের সামনে নামিয়ে দিল। বলে গেল যে, যদি পাসপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে নিজ-খরচায় ট্রেনে করে যেন Denzlingen-এ চলে আসেন, সেখানে আমরা রাতে থাকব। Denzlingen জার্মানিতে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্ৰাসলস থেকে ওই জায়গায় পৌঁছোতে হলে বেলজিয়াম ছেড়ে ফ্রান্স হয়ে তারপর জার্মানিতে ঢুকতে হবে।

ভদ্রমহিলার বয়েস পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে কিন্তু চেহারা ও সাজগোজের ঘটায় বয়েসটাকে রং চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ছবিতে ব্যাং ব্যাং করে দু-হাতে পিস্তল ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘোড়ায়-চড়ে আসা, সেলুনে ঠ্যাং ছড়িয়ে চুল কাটতে কাটতে বিয়ার খাওয়া নায়কদের সঙ্গে যে চেহারা ও সাজপোশাকের নায়িকাদের লটর-পটর করতে দেখা যায় এই ভদ্রমহিলার হাবভাব, সাজগোজ, চেহারা-ছবি হুবহু সেইরকম।

বাসটা যখন সেই দোকানের সামনে থেকে চলে এল, বাসের বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জারই তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না। ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছিলাম যে, বয়স্ক ও রক্ষণশীল ইংরেজ প্যাসেঞ্জাররা তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে ওঁকে নিয়ে প্রথমদিন থেকেই গুজগুজ ফুসফুস করতে আরম্ভ করেছিলেন। ইংরেজরা, বোধহয় একমাত্র ইংরেজরাই, এত আস্তে ফিসফিস করে কথা বলতে পারে যে, পাশের লোকও সেকথা শুনতে পায় না। এদের দেশের ফুলশয্যা ব্যাপারটা যদি থাকতও তবে মহিলাদের এ বাসর জাগার তাবৎ উৎসাহই মাঠে মারা যেত।

আমার মনে হল ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমাদের সকলেরই চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটল, তাই স্বাভাবিক দয়া ও ভদ্রতার খাতিরে কাঁচের মধ্যে দিয়ে হাত তুললাম।

কিছু কিছু সহযাত্রীও হাত তুলে বাই-বাই করল।

মেজোল পেরিয়ে এসে বিকেলে চা খেতে দাঁড়িয়েছিলাম ফ্রান্সের Alsop জেলার ছোটো শহর Metz-এ। ওয়েট্রেস ট্রে হাতে করে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়াতে দৌড়োতে পাঁদো পাঁর্দো আওয়াজ করছে মুখে। জঙ্গলে হাঁকোয়াওয়ালার তাড়া খেয়ে পালানোর সময়ে অনেক সময়ে শজারু ওইরকম অদ্ভুত আওয়াজ করে।

অনুসন্ধান করে জানা গেল যে, ইংরিজি বেগ ইওর পাৰ্ডন-এর ফরাসি প্রতিশব্দ পাঁদো মঁসিয়ে। তাড়াতাড়িতে আর মঁসিয়ে মাদাম, মাদমোয়াজেল, কিছুই বলার সময় না পেয়ে গাঁক গাঁক করে পাঁর্দো পাঁদো, বলতে বলতে বেচারারা দৌড়াদৌড়ি করছে।

কী ইংল্যাণ্ডে, কী পৃথিবীর পশ্চিম-দেশীয় অন্যান্য যে-কোনো প্রান্তে, যা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে তা ওদের কর্মব্যস্ততা। সব কাজই কত তাড়াতাড়ি করে ওরা। দৌড়াদৌড়ি করে মাত্র দুজন ওয়েট্রেস পঞ্চাশজন লোককে দেখাশুনো করে চা-পেস্ট্রি খাইয়ে দেবে পনেরো মিনিটে। চেঁচামেচি নেই, হই-হল্লা নেই, খরিদ্দারদের মধ্যেও কারোই এমন মনোভাব নেই যে, দোকানে চা খাচ্ছি তো মাথা কিনে নিয়েছি মালিক ও ওয়েটার-ওয়েট্রেসদের। একমিনিট সময়ও যে নষ্ট করার নয়-কাজের সময় কাজ তাড়াতাড়ি না শেষ করলে যে খেলার সময় পাওয়া যায় না, তা ওরা বড়ো ভালো করে বুঝেছে। ওরা সময়ের আগে আগে দৌড়োতে চায় যেন। তাই-ই ওরা এত কাজও করে এত মজাও করে।

স্ট্রসবার্গ বেশ বড়ো শহর। রাইনের ওপরেই বড়ো বন্দর। বছরে দশ মিলিয়ন টন কার্গো ওঠা-নামা করে এ বন্দরে। অসবর্ন ছাড়িয়ে এসে আমরা জার্মানিতে যখন পড়লাম ততক্ষণে সন্ধে হয়ে এসেছে। অটো-বান ধরে মাইল পঁয়তাল্লিশ এসে আমরা Denzlingen-এ পৌঁছোলাম। এটা ছোটো একটি গ্রাম। ছোটো গ্রাম হলে কী হয় এমন গ্রামেও এমন সব হোটেল আছে যে, পঞ্চাশজন লোকের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত অচিরে করে ফেলে এরা।

স্যুটকেস নামিয়ে নিয়ে ঘরে গেলাম হাত-মুখ ধুয়ে একটু পা ছড়িয়ে নিতে। অ্যালাস্টারের হুকুম হল পনেরো মিনিট পর সকলকে ডাইনিং রুমে নেমে আসতে হবে একতলায় ডিনার খেতে।

রোজ সাতটায় ডিনার খেয়ে রীতিমতো সাহেব হয়ে উঠছি দেখলাম। কিন্তু সাহেবেরা শেষরাতে যখন পেট চু চু করে তখন কী খায় তা জানতে ইচ্ছে করে। আমাদের দেশের মতো, চিড়ে আর পাটালি গুড় পাওয়া যায় না ওদের দেশে।

কিছুক্ষণ পর ডাইনিং রুমে নেমে আসতেই দেখি ঘর আলো করে মিস ফাস্ট বসে আছেন; মুখের মেক-আপ একটুও ওঠেনি–হালকা সবুজ গোড়ালি পর্যন্ত পোশাক, গাঢ় সবুজ আই-ল্যাশ, বাঁ গালের কৃত্রিম বিউটি স্পটসমতে ডান পায়ের ওপর বাঁ-পা তুলে তিনি দিব্যি খোশমেজাজে বসে আছেন।

পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা বিদেশে ভাবা যায় না। তাই এই পঞ্চাশোর্ধ্ব তরুণী মহিলার সম্পূর্ণ অবিচলিত ও উত্তেজনাহীন মনোভাব সকালে আমাকে চমৎকৃত করেছিল। আমার নিজের পাসপোর্ট ট্যুর-এর মধ্যে হারিয়ে ফেললে কী করতাম ভাবতেও আতঙ্কিত হচ্ছিলাম। সে কারণে, অবাকই হলাম যে, পাসপোর্ট শুধু উদ্ধার করেছেন তাই-ই নয়; আমরা বাসে এসে পৌঁছোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেলজিয়াম থেকে ফ্রান্স, সেখান থেকে জার্মানির এই গ্রামে দিব্যি পৌঁছিয়ে গিয়ে হাসি হাসি মুখে দেদীপ্যমান রয়েছেন।

ক্যারল ও জেনি, সেই অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে দুটি সকালের লজ্জা বেমালুম ভুলে গিয়ে দুটি সুদর্শন, লম্বা জার্মান ছেলের সঙ্গে একটেবিলে বসে দিব্যি হাসিমুখে গল্প করছে। ওদের দুজনকেই খুব উচ্ছল দেখলাম। কারণটা পরে জানলাম। ওরা আজ ডিনার খেয়ে নিয়ে হোটেলের ঘরে থাকবে না। ছেলে দুটি একটি ভোকসওয়াগেন ট্যুরার গাড়ি নিয়ে এসেছে সেই গাড়িতেই ওদের সঙ্গে ওরা রাত কাটিয়ে ভোরে চলে যাবে ওদের সঙ্গে মুনিকে। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত বিয়ার ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে এখন। বিয়ারের প্রস্রবণ ওঠে সেখানে। Steifel-এ করে ওরা সেই প্রস্রবণ থেকে সারারাত বিয়ার খাবে–হইহই করবে, মেলা দেখবে। তিনদিন তিনরাত হই-হুঁজ্জোত করে আবার আমাদের সঙ্গে মিলবে এসে সুইটজারল্যাণ্ডে। Steifel গামবুটের মতো দেখতে কাঁচের বুট–তাতে করে জার্মানরা বিয়ার খায়। একবুট বিয়ার দু-হাতে ধরে তুলে চোঁ-চোঁ করে গিলে ফেলে।

ধন্যি রাজার ধন্যি দেশ!

ডিনার সার্ভ করতে লাগল দুটি জার্মান মেয়ে। সুপ প্রথমে। তারপর মাছভাজা সঙ্গে স্যালাড ও টার্টার সস। তার সঙ্গে টক বাঁধাকপি, গাজর শসা ও বিট দিয়ে তৈরি স্যালাড। পরিশেষে আনারসের পাই। খাওয়ার আগে Denzlingen-এর স্থানীয় বরুয়ারীর লাগার বিয়ার ও ওয়াইন পান করা গেল কিঞ্চিৎ।

খাওয়া শেষ হতে না হতেই ম্যানেজার এসে বলল, তোমার টেলিফোন এসেছে লানডান থেকে। ফোন ধরতেই দেখি টবী।

ওপাশ থেকে বলল, খী খারবার–আমাদের ভুলে গেলে দেখছি। আছ কেমন? কী খেলে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

একসঙ্গে এত প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না বলে উত্তরগুলো খিচুড়ি পাকিয়ে এককথায় বললাম, খাসা আছি।

ও বলল, ক্লান্ত লাগছে?

না তো! অবাক হয়ে বললাম।

ও বলল, লাগবে।

তারপর বলল, ভয় নেই। তোমার জন্যে বিছানা রেডি করে রাখব। ভিক্টোরিয়া স্টেশানে তোমাকে নিয়ে যাব আমরা। এখানে দু-দিন রেস্ট করে ঘুমিয়ে তারপর টরোন্টো যেয়ো। এই ট্রগুলোরীতিমতো টায়ারিং।

এখনও বুঝতে পারছি না। আমি বললাম।

টবী কসমস-এর লানডান অফিসে ফোন করে ইটিনিরারী জেনে নিয়েছিল। আমরা কবে কখন কোন হোটেলে পৌঁছোব, রাত কাটাব সব ও জানে। আর পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ফোন করা তো কোনো ব্যাপারই নয়। সমস্ত জায়গার একটা করে এরিয়া-কোড আছে। সমস্ত জায়গা থেকে সমস্ত জায়গাতেই প্রায় ডাইরেক্ট ডায়ালিং-এর প্রথা আছে। শুধু এরিয়া কোড ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করলেই মুহূর্তের মধ্যে অন্য প্রান্তে কথা বলা যায়। ট্রাঙ্ক অপারেটরের মুখঝামটা নেই। টিকিট নম্বর মুখস্ত করে রাখার ঝামেলা নেই। কলকাতা থেকে আশি মাইল দূরে ট্রাঙ্কল করতে গিয়ে কল বুক করে বসে থেকে ভগবান ও অপারটেরদের কাছে করজোড়ে ভিক্ষা চাওয়া নেই।

আমাদের দেশের, বিশেষ করে কলকাতার টেলিফোন বিভাগের লজ্জাকর অপদার্থতা মনে পড়ছিল। আমাদের সবই সহ্য হয়, বাঙালিদের মতো সহ্যশক্তি ক্রীতদাসদেরও ছিল না বোধহয়। আমাদের দেশের সরকার ভগবান. সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে তাঁরা। সরকারের কানে তুলো, পিঠে কুলো। লাজলজ্জা সব কিছুই ধুয়ে মুছে তারপই রাজনীতি করেন আমাদের সরকার পক্ষের এবং সরকার বিরোধী রাজনীতিকরা। যাঁরা বলেন আমাদের দেশের সবই খারাপ, আমি তাঁদের দলে ছিলাম না। আবার যাঁরা বলেন যে, আমাদের দেশের সবই ভালো, আমাদের সব কিছুই সমালোচনার উর্ধ্বে–আমাদের গণতন্ত্র ও নেতারা সবই দেবদুর্লভ ও দেবসুলভ, আমি তাদেরও দলে নেই। ভালোটা ভালোই, খারাপটাও খারাপ। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি তাই দেশের ভালোত্বে যেমন গর্বিত হই খারাপত্বে তেমনই দুঃখিত হই। দেশটা আমার যতখানি, নেতাদের বা কোনো রাজনৈতিক দলেরও ততখানিই। একথা বলতে যদি কেনো বিশেষ স্বাধীনতার দরকার হয় তবে বাঁচা-মরায় তফাত দেখি না কোনো। যে স্বাধীনতা নিয়ে আমি জন্মেছি বলে আমি বিশ্বাস করি–সেই স্বাধীনতা কারও কৃপণ ও ভন্ড হাতের দয়ার দান হিসেবে আমি গ্রহণ করতে রাজি নই।

যেসব দেশ উন্নত হয়েছে তাদের দেশের সাধারণ মানুষদের জন্যেই উন্নত হয়েছে। সাধারণ মানুষেরা আত্মসচেতন, কর্মঠ, আত্মসম্মানজ্ঞানী না হলে, নিজের নিজের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করলে, নিজের নিজের স্বাধীনতার ন্যায্য মূল্য দিতে প্রস্তুত না থাকলে তারা এত উন্নত হত না। তাদের অগ্রগতি–এত ঝড়-ঝাঁপটা যুদ্ধ-বিগ্রহর পরও তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর কারণ তারা নিজেরাই। কোনো দল বা নেতা তাদের কোলে করে বিশল্যকরণী গিলিয়ে দেয়নি। তেমন নেতাগিরিতে তারা বিশ্বাসও করেনি কখনো।

ফোন ছেড়ে দিয়ে বাইরের নির্জন পথে, ওভারকোটের কলার তুলে দিয়ে পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার হঠাৎই বহুদিন আগে পড়া, ওয়াল্ট হুইটম্যানের লিভস

অফ গ্রাস-এর ক-টি লাইন মনে পড়ে গেল :

All doctrines, all politics and civilization exurge from you. All sculpture and monuments and anything inscribed anywhere are tallied in you.

The gist of historics and statistics as far back as the records reach is in you this hour-and myths and tales the same.

If you were not breathing and walking here where would they all be?

আমি, তুমি, আপনি, আমরা প্রত্যেকে প্রচন্ডভাবে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকা উচিত। আমাদের নিজেদের প্রত্যেকের নিজের জন্যে; আমাদের গর্বিত, দুঃখিত, অপমানিত বোধ করা উচিত। আমরা, এই খন্ড খন্ড আমরাই একটা পুরো দেশকে বড় করতে পারি, জাগিয়ে তুলতে পারি–সত্যিকারের গর্বিত বোধ করতে পারি নিজেদের উদ্দেশ্যের সততা ও আন্তরিকতার জন্যে এবং আমরাই নিজেদের মিথ্যা দম্ভ, উদ্দেশ্যসাধনের ভন্ড ও মিথ্যা ও পন্ডিতমন্য প্রচেষ্টার গ্লানিতে নিজেদের থুথুতে নিজেদের সিক্ত করতে পারি। আমারটা আমার ভাবার, আমারই করার। আমার একার। তোমারটাও তাই। আপনারটাও।

হঠাৎ, হঠাই, বহুদিন পর আরও ক-টি লাইন মনে পড়ে গেল, এই একলা রাতে, শীতার্ত কিন্তু স্বাধীন, উন্নত ও গর্বিত এক দেশের মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে। মনে হল, লাইনগুলো হঠাৎ যেন আমাকে বিদ্ধ করল।

Long enough have you dreamed contemptible dreams.

Now I wash the gum from your eyes.

You must habit yourself to the dazzle of the light and of every moment of your life.

Long have you timidly worded, holding a plank by the shore.

Now I will you to be a bold swimmer.

To jump off in the midst the sea, and rise again and nod to me and shout, and laughly dash with you hair.

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রাতরাশ সেরে নিয়ে যখন বাসে উঠলাম তখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। দেখতে দেখতে আমরা জার্মানির বিখ্যাত Black forest এলাকায় চলে এলাম। এই জঙ্গল নিয়ে শুধু এদেরই কেন পুরো ইয়োরোপের খুব গর্ব। হায়! ওরা আমাদের দেশের জঙ্গল দেখেনি। দেখেনি ডুয়ার্সের জঙ্গল, দেখেনি উড়িষ্যার মহানদীর অববাহিকার জঙ্গল–ওরা কি বুঝবে জঙ্গল কাকে বলে? সেটা কোনো কথা নয়, আসলে যেটা জানতে ভালো লাগে যে ওরা জঙ্গল খুব ভালোবাসে। যান্ত্রিক সভ্যতার শেষধাপে এসে মঙ্গলগ্রহে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে করতেই দিনের পর দিন ওদের মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হচ্ছে যে, প্রকৃতিই শেষ অবলম্বন। যতই সে উন্নত, সভ্য, শিক্ষিত বোধ করুক না কেন তাকে শেষে প্রকৃতির কাছে ভালো লাগার জন্যে, ভালোবাসার জন্যে ফিরে আসতেই হবে।

ব্ল্যাক ফরেস্ট ফার-এর জঙ্গল। গাছগুলোর গায়ে শ্যাওলা জমে আছে। কিছু কিছু অর্কিড। ঘন সবুজ রং বলে গাছগুলোকে কালো মনে হয়–তাই এই নাম। ব্ল্যাক ফরেস্টের মাঝামাঝি এসে বৃষ্টি নামল। ওদের দেশের বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের বর্ষার কোনো তুলনা চলে না। বৃষ্টিও যেন বড়ো বেশি নিয়মানুবর্তী–আমাদের বর্ষার মেজাজ ওদের দেশের বর্ষার নেই। রবীন্দ্রনাথ ওদেশে জন্মালে আমরা এত বিভিন্ন গান পেতাম না, আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতে এত বর্ষার রাগ-রাগিণী বর্ষাবরণের আনন্দে অধীর হয়ে জন্মাত না।

জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে ছবির মতো সব গ্রাম।

এই ছবি-ছবি ব্যাপারটাও আমার মোটে পছন্দ নয়। আমার গরিব দেশের গ্রাম অগোছালো এলমেলো। অনেক কষ্ট সেখানে, কিন্তু গোরুর গায়ের গন্ধ, জাবনার গন্ধ, ব্যাঙের ডাক, বাঁশবনে জোনাকি জ্বলা, মেঠো পথ, হলুদ-বসন্ত পাখির উড়ে যাওয়া ওদের নেই। ওরা সুখ খুঁজতে গিয়ে সুখকে একেবারে মাটি করে বসে আছে। সুখ কাকে বলে ভুলে গেছে ওরা আরামের কবরে।

অ্যালাস্টার একটা গ্রাম দেখিয়ে বলল–দেখুন এই গ্রাম থেকে ড্যানিউব নদী বেরিয়েছে।

নর্দমার মতো ড্যানিউব দেখলাম। ব্লু-ড্যানিউব বলে এক বিখ্যাত রেকর্ড শুনেছি। বহুবার সেই রেকর্ড শুনতে শুনতে চোখের সামনে যে নদীর ছবি ফুটে উঠেছে বার বার কল্পনায়, তার সঙ্গে এ নদীর চেহারা একেবারেই মেলে না। আমাদের দেশের হোগলা-বাদার পাশে পাশে এমন নর্দমা আকছার দেখতে পাওয়া যায়। নদীমাতৃক দেশের লোককে ইয়োরোপের নদীগুলো বড়ো হতাশ করে।

দূর থেকে লেক কনস্ট্যান্স দেখা যাচ্ছিল। এই হ্রদের একপাশে জার্মানি অন্যদিকে অস্ট্রিয়া আর সুইটজারল্যাণ্ড। লেক কনস্ট্যান্টলি রাস্তার ডানদিকে থাকল। লেকের ওপারে সুইটজারল্যাণ্ডের পাহাড়গুলো-আল্পস-এর রেঞ্জ দেখা যাচ্ছিল। লেকের পাশে পাশে কত যে ছবির মতো গ্রাম, হোটেল, কফি-হাউস তার লেখাজোখা নেই। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেশ বোধহয় ইয়োরোপেও নেই।

লেক কনস্ট্যান্স বাঁ-দিকে রেখে আমরা জার্মানির বর্ডার পার হয়ে অস্ট্রিয়াতে এসে পড়লাম। তারপর Brener Pass (৭০০০ ফিট উঁচু)-এর দিকে এগোতে লাগলাম। ব্রেনার পাস পেরিয়ে ইটালিতে ঢুকব বলে।

ইতিমধ্যে ইজরায়েলের উনিশ বছরের মেয়ে সারার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। নীল চোখ–যেন কত কী স্বপ্ন, প্রত্যাশা, প্রতিজ্ঞা সব লেখা রয়েছে চোখের তারায়। কথা কম বলে, কিন্তু যখন বলে তখন ভারি বুদ্ধিমতী ও রসিকা। এ ক-দিন আমার সঙ্গে কথা হয়নি একটাও। গায়ের রং বাদামি দেখে দুশমন গেরিলা-টেরিলা ভেবে থাকবে হয়তো। কিন্তু গত রাতে খাওয়ার টেবিলে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে ভালো করে। রাজনৈতিক কারণে দেশে দেশে অনেক বিভেদ ও মনোমালিন্য হতে পারে, হয়; কিন্তু কোনো দেশের ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির মানুষ হিসেবে খোলাখুলি মেলামেশায় কোনো বৈরিতা বা আড়ষ্টতা হওয়া বা থাকা উচিত বলে আমার মনে হয় না। আমরা সকলেই তো একই মানবজাতির অংশ। যে হারে গ্রহ-গ্রহান্তরে পৃথিবীর মানুষ নাক গলাতে শুরু করেছে এইচ. জি. ওয়েলস-এর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লেখা ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস সত্যি হয়ে উঠতে পারে যে-কোনো দিন। মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর যুদ্ধ বাধলে রাশিয়া-আমেরিকা ও আরব ইজরায়েল পাশাপাশি লড়াই করে কি করে না দেখা যাবে। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন একটা গ্রহে গ্রহে যুদ্ধ তাড়াতাড়ি লেগে যাওয়া দরকার অন্তত মনোমালিন্য ভুলে গিয়ে–তাতে এই পৃথিবীর সাদা কালো-হলদে-বাদামি মানুষগুলোনিশ্চয়ই আরও কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি আসবে একে অন্যর তারা বুঝবে যে আমরা সকলেই মানুষ-এর চেয়ে বড়ো বা এ ছাড়া অন্য পরিচয় আমাদের কিছুই নেই।

হঠাৎ কাঁধে টোকা পড়ল। আমাদের সর্বসম্মতিক্রমে এবং বিনা ভোটে নির্বাচিত ইংরেজ টেকো-লিডার কাঁধ ট্যাপ করছেন।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বললেন–হাউ বাউট আ ফিল?

আমি হাত বাড়িয়ে ওঁর গোল্ড-ব্লক ট্যোবাকোর টিনাটা নিলম। পাইপ ভরব বলে। আমাদের নেতার চেয়ে নেতার স্ত্রী আমার বেশি ভক্ত হয়ে উঠেছিল। আগেই বলেছি, নেতা আমাদের পেশায় ছুতোর। আমি গবির লোক, গরিব দেশের লোক, তাই টবী-ভাইয়ের দাক্ষিণ্যে যে ট্যুরে ইয়োরোপ দেখতে এসেছি সেটা সবচেয়ে গরিবদের ট্যুর। আমার বাসের কমরেডরা ছুতোর কামার বাস-ড্রাইভার গরিব ট্যুরিস্ট ছাত্র-ছাত্রী ইত্যাদি।

এই টেকো সাহেব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে জীবনের পঞ্চান্ন বছর কঠোর পরিশ্রম করে তবে এতদিনে ইংল্যাণ্ড থেকে কন্টিনেন্টে আসার মতো পাথেয় জোগাড় করতে পেরেছেন। সব দেশেই গরিব বড়োলোক আছে। ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কিন্তু ওদের দেশের যা অর্থনৈতিক মান তাতে যে দম্পতি পঞ্চান্ন বছরের আগে ইংল্যান্ড থেকে কন্টিনেন্টে আসার মতো পাথেয় জোগাড় করে উঠতে না পারেন তাঁদের অবস্থা ভালো নয়ই বলতে হবে। সে কারণেই এতদিনে আসতে পেরে ওঁদের আনন্দের আর অন্ত নেই। নিজের মেহনতের পয়সায় এসেছেন, কালোবাজারি বা ফাটকাবাজারি রোজগারের পয়সা নয়–এটাই বা কি কম আনন্দের?

মেমসাহেব প্রায়ই গুনগুনিয়ে গান গাইতেন। গলাটা ভারি মিষ্টি। এমন এমন সব হিট গান, বেশির ভাগই ফিল্মের গান যে ছোটোবেলায় আমরাও এদেশে তার কিছু কিছু গান শুনেছি।

আমি একবার মুখ ঘুরিয়ে ওঁকে বলেছিলাম–প্লিজ আস্তে গেয়ে আমাকে কষ্ট দেবেন না–একটু জোরে গান–এত ভালো গলা আপনার লুকিয়ে রাখার জন্যে নয়।

পরক্ষণেই দেখলাম মেমসাহেব গান থামিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পাউডারের কৌটো বের করে গালে লাগাচ্ছেন।

এতদিনে ইংরিজি প্রবচনের মানে বুঝলাম–To powder ones nose.

দেশ বা জাত নির্বিশেষে মহিলারা চিরদিন এ বাবদে মহিলাই থাকেন। কমপ্লিমেন্ট পেলে খুশি হন। যেসব পুরুষ জানেন ঠিক কী করে কমপ্লিমেন্ট দিতে হয় তাঁরা চিরদিনই সব বয়েসি সব-দেশি মহিলার কাছে সমান প্রিয়।

আমি কিন্তু জানি না। জানলে খুশি হতাম।

কী করে যে সময় উড়ে যায় বগারির ঝাঁকের মতো তার হিসেব রাখা দায়। লাঞ্চের জন্যে বাস থামল। মাঝে, পথে কফি-ব্রেকও হয়েছিল। জায়গাটার নাম মনে নেই। Dornbin নামের একটা ছোটো গ্রামের একটা ছোটো রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ খাওয়া হল। চমৎকার চিকেনের স্যুপ, বিফ-স্টেক। শেষকালে পাইন-অ্যাপল পাই। সঙ্গে একটু করে জার্মান schnapps- সেই যে schnapps-এর কথা লিখেছিলাম আগে–টবীর সঙ্গে Tyroler Hut-এ সেই খেয়েছিলাম। লানডানের বেজওয়াটার স্ট্রিটে!

এই Dornbin-এর হোটেলে যে ছিপছিপে মেয়েটি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার দেখাশোনা করছিল সে ভারি সুন্দরী। অস্ট্রিয়ান গাউন পরেছিল একটি। দেখতে অনেকটা–ম্যাকসির মতো–বুকের কাছে লেস বসানো, লাল-কালো কাজের। আমাদের বাসের ড্রাইভার জ্যাক তার সঙ্গে খুব ইয়ার্কি করছিল।

অ্যালাস্টার লাজুক শিক্ষিত ছেলে। মিষ্টভাষী। ও-ও গল্প করছিল মেয়েটির সঙ্গে। জানলাম, এই মেয়েটি এক সময়ে এই কসমস ট্যুরের অ্যালাস্টারের মতোই গাইডের কাজ করত। ট্যুর নিয়ে কয়েকবার এই হোটেলে এসেছিল। তখনই এই হোটেলের ইয়াং ও হ্যাণ্ডসাম অস্ট্রিয়ান মালিকের সঙ্গে আলাপ হয়। তারপর তাকে বিয়ে করে কসমস কোম্পানির আমাদের মতো সৌন্দর্যরসিক অনেক যাত্রীর সর্বনাশ করে অস্ট্রিয়ার এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকে যায়। ঘন নীল চোখ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও ব্যারনের রক্তসম্পন্ন তার স্বামীকে দেখে খুব হিংসা হচ্ছিল। এরকম স্ত্রী পাওয়া অনেক পুণ্য-কর্মের ফল। শুধু চেহারাই নয়, তার কথাবার্তা হাঁটাচলা সব মিলিয়ে তাকে তার সেই লাল-কালো গাউনে যেন একটি প্রজাপতি বলে মনে হচ্ছিল।

জ্যাক আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ওর গালে একটা চুমু খেল জোর করে ধরে। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়েই জ্যাকের পিঠে দুম দুম করে কিল বসিয়ে দিল হাসতে হাসতে, গালাগালি করতে করতে।

ওদের দেশে কোনো মেয়েকে চুমু খেলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সতীত্ব নষ্ট হয়ে যায় না এবং চুমু খেলেই ভালোবাসাও হয়ে যায় না।

এ ক-দিন চোখ কান খুলে দেখে-শুনে যা মনে হচ্ছে তাতে এই ধারণাই জন্মাচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ওদের দেশের চেয়ে আমাদের দেশেই বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হবে। ওরা শরীরটাকে কখনো মনের চেয়ে বড়ো করে দেখে না। শরীর যাকে তাকে I Thank you বলার মতো ইচ্ছে করলেই দেওয়া যেতে পারে; দেয়ও ওরা। কিন্তু শরীরের মোহ কাটিয়ে উঠে যখন ওরা কাউকে ভালোবাসে তখন মন, রুচি, ব্যক্তিগত আরও অনেক ব্যাপারে অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়েই বিয়ে করে। আমরা যেহেতু এ ব্যাপারে একটা প্রচন্ডরকম ট্রানজিটরি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি–এই ভাঙচুর আমাদের মেনে না-নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তা ছাড়া আমাদের দেশের মেয়েদের সদ্যপ্রাপ্ত আর্থিক স্বাধীনতা এ ব্যাপারে খুব নগণ্য অংশ নেবে না বলেই মনে হয়। আমাদের ওখানেও স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা আরও অনেক সহজ হয়ে গেলে আমরাও To put the cart before the horse-এর মতো ভুল বোধহয় করব না। সেদিন ভালোবাসা বলতে ভালোবাসাকেই বোঝাব, মোহ নয়, কাম নয়; রোমান্টিক কল্পনামাত্র নয়–তার চেয়েও হয়তো গভীরতর এবং স্থায়ী কিছু।

লাঞ্চ সেরে বেরোতেই এক অবাক কান্ড দেখলাম।

দুপুর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল

Brener pass-এর দিকে যতই এগোতে লাগলাম ততই দূরের পাহাড়চুড়োগুলোতে বরফ দেখা যেতে লাগল। এই সময় লক্ষ করলাম যে রাস্তায় কম করে দেড়শো-দুশো গাড়ি, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, ভলভো, সিত্রয়, ওপেল, ফোর্ড; নানারকম ভোকসওয়াগেন, রোভার, রোলস-রয়েজ বনেটের ওপর একটা করে ফুলের তোড়া বসিয়ে প্রসেশান করে চলেছে।

ব্যাপারটা শবযাত্রা না বিয়ে এই নিয়ে আমরা জল্পনা-কল্পনা করছি এমন সময়ে অ্যালাস্টার বলল যে আজ এখানে এক বিশেষ উৎসব।

কীসের উৎসব?

আমরা সমস্বরে শুধোলাম।

ও বলল—Dorffest.

সেটা আবার কী?

ও বলল, এল যে শীতের বেলা বরষ পরে। তাই এবার আল্পস পাহাড়ে যেসব গোরুদের গরমের সময়ে চরতে পাঠানো হয়েছিল, তাদের নেমে আসার পালা সমতল ভূমিতে। আজ সেই গোরুদের নেমে আসার উৎসব–অস্ট্রিয়ার এ এক ফেস্টিভ্যাল। গোরুরা হাত-পা না ভেঙে হাম্বা হাম্বা করতে করতে ফিরে আসুক-পেছন পেছন অ্যালসেশিয়ান কুকুরগুলোও ঘাউ ঘাউ করতে করতে–আজ সবাই তাই প্রার্থনা করে। প্রার্থনা করে, গোরুদের ভালো হোক, ওরা বেশি করে দুধ দিক।

মনে মনে বললাম, তবে রে, ব্যাটা ইষ্টুপিড; ইংরেজ! তোরা সারাজীবন আমাদের গোরু পুজোর খোঁটা দিয়ে এলি আর তোদের সব বাঘা বাঘা ভাই বিরাদররাও যে গোরু পুজো করে তার বেলা?

না কি স্যুট-পরা সাদা সাহেব, মার্সিডিজ গাড়ির বনেটে ফুলের তোড়া সাজালে পুজো হয় না, গোরুর পায়ে ভুড়িওয়ালা কালো পান্ডা গাঁদাফুল আর গঙ্গাজল দিলেই পুজো হয়!

সাহেবরাও যে গো-পুজো করে এটা জেনে রীতিমতো আত্মশ্লাঘা বোধ করলাম। পেছনে বসা নেতা সাহেবকে একথা বলে একের ক্ষীণকণ্ঠে যতটুকু ইংরেজের চরিত্রহনন করা যায় তাই-ই করতে সচেষ্ট হলাম।

বাস ততক্ষণে ব্রেনার পাসের দিকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। কিন্তু ওপাশ থেকে যত গাড়ি আসছে তাদের ছাদ বনেটে উইণ্ডস্ক্রিনে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি এবার যেসব গাড়ি আসছে তাদের ওপর গুঁড়ো গুঁড়ো নয় প্রায় তাল তাল বরফ।

তারপর ব্রেনার পাসের দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে আর দেখাই যাচ্ছিল না। শুধু সাদা বরফে ঢাকা। ওয়াইপার কোনোরকমে অতিকষ্টে বরফ সরাচ্ছে। দেখতে দেখতে আমরা বরফের রাজত্বে এসে পড়লাম। দু-পাশের মাঠঘাট ঘরবাড়ি সব বরফে ঢাকা। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

আমি বাঙাল তাই আমার কাছে বরফ পড়া দেখার অভিজ্ঞতা দারুণ। কিন্তু সাহেবদের কাছে এ তো রোজকার ঘটনা। আমার এই পরদেশে আসার উত্তেজনাকর পরদেশি এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে স্বদেশি কোনো সমতুল অভিজ্ঞতার তুলনা করি এমন তুলনা মনে এল না।

পরক্ষণেই মনে পড়ল আমাদের কালবৈশাখী!

কলকাতার লোকের কাছে কালবৈশাখী কিছু নয় কিন্তু একজন অস্ট্রিয়ানের কাছে এ নিশ্চয়ই এক অভিজ্ঞতার মতো অভিজ্ঞতা। ধুলোর ঝড়, নারকোল গাছগুলোর মাথা নাড়ানো, মেঘের গুরু গুরু,আকাশের কালো কুটিল রূপ, বিদ্যুতের ঝিলিক; বাজের শব্দ।

কিছুদূর গিয়ে বাস আর যেতে পারল না। সামনে গাড়ির লাইন। দাঁড়িয়ে আছে। ব্রেনার পাসের দিকে আর কোনো গাড়ি যাচ্ছে না, মানে যেতে পারছে না। ওপাশ থেকে যেসব গাড়ি পাস পেরিয়ে ফেলেছে কোনোক্রমে, সেগুলোই তিরতির করে আস্তে আস্তে আসছে।

যে হারে বরফ পড়ছে তাতে মনে হল এখানেই এই বড়ো বাসটারই বুঝি বরফ-সমাধি হবে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরগাড়িগুলোর রং চেনার উপায় নেই। সব সাদা। আশেপাশের বাড়ি দোকান গাছ-পাতা সব সাদা। পুলিসম্যানের ওভারকোটের নীলচে রং সাদার মধ্যে থেকে একটু-একটু উঁকি মারার চেষ্টা করছে। টুপি সাদা।

বাস দাঁড়াল তো দাঁড়ালই।

অ্যালাস্টার ও জ্যাককে খুব চিন্তান্বিত হয়ে কী সব আলোচনা করতে দেখা গেল ফিসফিস করে।

ইতিমধ্যে আমাদের পেছনেও শয়ে শয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। জ্যাক নেমে পুলিশের সঙ্গে অনেকক্ষণ বুড়ো আঙুল কড়ে আঙুল, ডান হাঁটু নাড়িয়ে কথা বলল–তারপর বরফে ঢেকে গাড়িতে ফিরে এসে অ্যালাস্টারকে কী সব বলল বিজাতীয় ভাষায়।

অ্যালাস্টার মাইক্রোফোনে বলল, ওয়েল!

তারপর টিপিক্যাল ইংরেজের মতো ট্যাক্টফুলি একটু হাসল।

পরক্ষণেই বলল

Well, ladies and gentlemen, theres a minor problem!

হোয়াট ইজ ইট? হোয়াট ইজ ইট? রব উঠল।

আমার তিন সারি সামনে কানে-খাটো এক ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর নাম জানিনি। চেঁচিয়ে কথা বলার ভয়েই আলাপ করা হয়ে ওঠেনি। তবে মুখের ভাবটি সবসময়েই ভারি প্রশান্ত। তিনি তাড়াতাড়ি পকেট থেকে হিয়ারিং-এইড বের করে কানে লাগালেন।

পেছন দিক থেকে ইজরায়েলের সারা, ট্রিনিডাডের কালোজামের মতো পুরন্ত ঠোঁট-সম্পন্ন লুসি, সেই মালয়েশিয়ান দম্পতি, রয়্যাল এয়ার ফোর্সের গলায় স্কার্ফ বাঁধা চালু ভদ্রলোক, সেই পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়া ভদ্রমহিলা সকলেই একসঙ্গে ঔৎসুক্য প্রকাশ করলেন।

সব গলা ছাপিয়ে একটি বাঙালি গলা শোনা গেল; সেরেছে।

এই বাঙালি দম্পতি গ্রেটার লানডানে সেটলড। স্বামী এঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী ডাক্তার। কিন্তু আমি বাঙালি পরিচয় দিইনি। আসা-ইস্তক একটি বাংলা শব্দও বলিনি। লোকে আমাকে যে যাই ভাবুক-পাকিস্তানি, আফ্রিকান, আরব, ইরানি,মেকসিকান, মাফিয়া আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না।কিন্তু ক-দিনের জন্যে বিদেশ দেখতে এসে গড়িয়াহাটে কই মাছের দর অথবা অপর্ণা সেনের লেটেস্ট বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা করার একটুও ইচ্ছা আমার ছিল না। যদিও কই মাছ (বিশেষ করে ধনেপাতা ও সর্ষে-বাটা দিয়ে রান্না করা কই মাছ) এবং ওই বুদ্ধিমতী উজ্জ্বল চোখসম্পন্ন মহিলা–এই দুয়েরই আমি সবিশেষ ভক্ত।

অ্যালাস্টার আবার হাসল, যাকে চাকল করা বলে তেমন। তারপর মাইক্রোফোনে ফুঁ দিল। সম্মিলিত অভিব্যক্তি ধুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে।

অ্যালাস্টারের চেহারা চুল কথাবার্তা সমস্তই অতিরোমান্টিক। বড়ো সুন্দর ছেলে। সে কারণেই ও প্রবলেমের খবর দেওয়া সত্ত্বেও আমাদের অতটা হতাশ হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হল না।

অ্যালাস্টার বলল–আমাদের ইটালি যাওয়া বোধহয় হচ্ছে না।

আর যায় কোথায়? যেই না একথা বলা!

আমার মনে হল দিঘা বা বিষ্ণুপুরের কনডাকটেড ট্যুরে বেচারি ইনফরমেশন অ্যাসিস্ট্যান্টদের যাত্রীদের কাছ থেকে যে অভদ্র অবুঝ ও অশালীন ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয় তারই স্যাম্পেল দেখতে পাবে আজ অ্যালাস্টার।

হই হই রই রই রব উঠল। নেহাত সাহেব মেম ইংরিজিতেই কথা বলছিল–কিন্তু যা বলছিল তার অর্থ করলে অত্যন্ত সরল অর্থ দাঁড়ায়। দাও টাকা ফেরত, চালাকি পেয়েছ? বাপের নাম খগেন করে দেব। ভাঁওতা মারার জায়গা পাও না? কেস ঠুকে দেব বলে দিচ্ছি, দেখে নেব ইত্যাদি ইত্যাদি।

আবারো মনে হল সারাপৃথিবীর মানুষই এক। সেই মুহূর্তে মনে হল সাহেবরা দু-শো বছর আমাদের পরাধীন করে রেখে তাদের সম্বন্ধে যা আমাদের বুঝতে দেয়নি তা এই একমুহূর্তেই বোঝা গেল।

তার পা মাড়িয়ে দিলে, তার স্বার্থে, আরামে বা মানিব্যাগে হাত পড়লে পৃথিবীর সব মানুষই সমান।

আমি একবার চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম।

এই তিনদিনের ভদ্রতা সভ্যতা, থ্যাঙ্ক-ইউ, একসকিউজ মি ইত্যাদি যে কত বড়ো মুখোশ, কত বড়ড়া বাহ্য এবং মিথ্যা ব্যাপার তা আর জানতে বাকি রইল না।

বড়ো লজ্জা হল আমার। এদের সকলের জন্যে, আমার নিজের জন্যেও।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, অ্যালাস্টার তার কথা শেষ করেনি। তার অসুবিধের কথা তাকে দয়া করে বলতে দেওয়া হোক।

তক্ষুনি আমার পেছন থেকে আমাদের নেতা জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট। লেট আস হিয়ার হোয়াট অ্যালাস্টার হ্যাজ টু সে। আফটার উই হিয়ার হিম উই উইল কাম টু আ ডিসিশান।

অ্যালাস্টার বলল, ব্রেনার পাস বরফে সম্পূর্ণ ঢেকে গেছে। কতক্ষণে বরফ পরিষ্কার করা যাবে, কতক্ষণে বরফপড়া থামবে–Its no-bodys guess

আসলে এ বছরে এত তাড়াতাড়ি যে বরফ পড়বে এবং এমনভাবে পড়বে–ব্রেনার পাসের তদারকি যাঁরা করেন তাঁরাও বুঝতে পারেননি।

সকলে সমস্বরে বলল, কী হবে? তাহলে কী হবে?

কেউ কেউ জুতো দিয়ে বাসের মেঝেতে পা ঠুকতে লাগল।

হংকং-এর চাইনিজ মেয়েগুলো বাসের একেবারে পেছন থেকে চ-কার এবং অনুস্বারের তুবড়ি ছোটাল।

অ্যালাস্টার বলল, ইটালিতে তো আমাদের হোটেল ঠিক করা আছে। ডিনারও সেখানে তৈরি করে রাখবে–কিন্তু এখন সারারাত এখানে আটকে থাকলে কী হবে? এটা একেবারে আনএক্সপেকটেড ব্যাপার। আমার কাছে পয়সাও নেই যে তোমাদের এত লোকের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করি এখানেই কোথাও।

অনেক স্বর একসঙ্গে বলল, চোপ। ইয়ার্কি পেয়েছ? পয়সা নেই মানে কী? কেন? তোমরা ক্রেডিটে বন্দোবস্ত করো–ওসব আমরা জানি না। আমরা ইটালি যাবই। এদিকে কোথাও খাওয়া-দাওয়া করে সারারাত বাস চালিয়ে চলো।

অ্যালাস্টার অভদ্র হয়ে-যাওয়া বিক্ষুব্ধ অতজনের সামনে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। যেন ও-ই সবকিছুর জন্যে দায়ী।

তখন জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল–পাস পেরোবার কোনো উপায়ই কি নেই অ্যালাস্টার?

অ্যালাস্টার বলল-ব্রেনার পাসের নীচে দিয়ে একটা টানেল আছে–ট্রেনে করে গাড়ি পার হয়। শীতকালে যখন পাস বরফে ঢাকা থাকে। এখনও পার হচ্ছে অনেক গাড়ি কিন্তু এত বড়ো বাস তো ওই টানেল দিয়ে গলবে না।

জন শুধোল, আর কোনো উপায় নেই?

আছে। যদি টায়ারে স্নো-চেইন লাগানো যায়।

তোমাদের সঙ্গে আছে? জন শুধোল।

জ্যাক বলল, এই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি যে এমন বরফ পাব এখানে কে জানত? নেই! আমাদের সঙ্গে চেইন নেই!

অ্যালাস্টার তুড়ি মেরে বলল, নট আ ব্যাড আইডিয়া; উই ক্যান ট্রাই দ্যাট আউট।

তারপর রয়্যাল এয়ার ফোর্সের সাহেব, জন, অ্যালাস্টার ও জ্যাক চেইন পাওয়া যায় কি না খোঁজ করতে বেরোল।

আমার পাশের ফিলিপিনো ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে একগাদা বিস্কুট ও চকোলেট বের করে দিলেন। উনি বড়োলোক। আমার এদেশে বাড়তি চকোলেট বা বাড়তি খরচ করারও টাকা নেই।

খিদেও পেয়েছিল। বিকেলে চা-ও খাওয়া হয়নি, এদিকে রাত নেমে এল বলে। বহু বহু বছর বাদে কুটমুট করে বিস্কুট চকোলেট খেলাম–

কিণ্ডারগার্টেনে পড়া ছেলের মতো।

ওরা ফিরে এল।

বলল, কোথাও চেইন পাওয়া গেল না।

অ্যালাস্টার ব্রাসেলস-এ কসমস কোম্পানির হেড কোয়ার্টারে ফোন করতে চেষ্টা করল একটা দোকান থেকে। ব্রাসেলস-এর বস-এর সেক্রেটারি বলল যে তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে এক পার্টিতে গেছেন।

জনের ভগ্নীপতি যে ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসেছিল, মুঠি পাকিয়ে বলল–টু হেল উইথ দ্য পার্টি।

জন বলল, যা হয় একটা ঠিক করা হোক। বাস থেমে থাকলে তো আর ব্রোয়ার চলবে না সারারাত–আমরা কি এই ব্রেনার পাসের ওপরে ঠাণ্ডায় জমে মারা যাব?

আর এ এফ-এর সাহেব বলল, মেয়েদের খুব খিদে পেয়েছে, কেউ চা পর্যন্ত খায়নি বিকেলে, বাসটাকে কোনোক্রমে পাশের গলিতে ঢুকিয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে অন্তত আপাতত নিয়ে যাওয়া যাক।

ইংরেজ পুরুষগুলো ভারি সেয়ানা। যা-কিছু দয়া-ফয়া, ফেভার-টেভার চায় সব মেয়েদের নাম করে।

বাস থেকে আমি একবার নেমেছিলাম, একটু বরফের ওপর হাঁটার শখ হয়েছিল। প্রচন্ড ঠাণ্ডা। একটুক্ষণ পরই আবার বাসের গরমে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।

জন, এয়ার ফোর্সের সাহেব এবং আমি মিলে আলোচনা করে ঠিক করা হল, সারাদিনের যাত্রার পর আবার সারারাত বাস চালিয়ে গিয়ে ইটালি পৌঁছোনার চেষ্টা করাটা খুবই ঝুঁকি নেওয়া হবে।

জন বলল, তা ছাড়া জ্যাক সারাদিনে আইনমাফিক যতখানি চালানো সম্ভব প্রায় চালিয়েছে। এরপর সারারাত চালানো বেআইনি হবে।

আমার জানা ছিল না যে এরকম আইন কোথাও আছে। আছে জেনে ভালো লাগল।

জ্যাক বাসটা ব্যাক করে নিয়ে পাশের গলিতে ঢুকল। সেখানে পর পর অনেকগুলো দোকান, রেস্তোরাঁ।

অ্যালাস্টার বলল, আপনারা চা-টা খেয়ে নিন এখানে। আমি ততক্ষণে ব্রাসেলসে আবার ফোন করে দেখি, যোগাযোগ করতে পারি কি না।

আগেই বলেছি, পশ্চিমি দেশে ফোনে এ-প্রান্ত থেকেও-প্রান্ত অবধি যোগাযোগ করাটা কোনো ব্যাপারই নয়। এরিয়াকোড় ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করলেই হল। ডায়রেক্ট ডায়ালিং পৃথিবীর এদিকে সর্বত্র! এখন কসমস কোম্পানির ইয়োরোপিয়ান বস যেখানে পার্টিতে গেছেন সেখানকার ফোন নম্বর পেলেই ঝামেলা মিটে যায়।

বাইরে তখন বরফ পড়া থেমে গেছে, কিন্তু টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হয়েছে।

বাস থেকে নামতেই মনে হল ঠাণ্ডায় কে যেন কান কেটে নিয়ে গেল। নেমেই, সামনে দেখি একটা বার ও রেস্তোরাঁ। প্রায় সাতটা বাজে। অন্যান্য দিন এমন সময়ে আমরা ডিনারে বসে যাই। খিদেও পেয়েছে।

বার-এ সার সার ওয়াইন, লিকার, হুইস্কি, শ্যাম্পেন ইত্যাদির বোতল সাজানো আছে। হঠাৎ একটু বড়োলোকি করে গরম হওয়ার ইচ্ছে গেল। এমন সময়ে দেখি, আমার পেছনে সারা। জিনের ফ্লেয়ার, জিনের শার্ট আর তার ওপরে একটা বুক-খোলা হাতওয়ালা সোয়েটার পরে। বাস থেকে নেমেই অবশ্য সোয়েটারের সবকটা বোতাম বন্ধ করে নিয়েছে।

সারা বলল, হাই।

আমি বললাম, হাই!

বাস থেকে নেমে এটুকু এসেই মেয়েটার ঠোঁট নীল হয়ে গেছে ঠাণ্ডায়।

বললাম, কেয়ার ফর আ ড্রিঙ্ক?

সারা আমার দিকে তাকাল, তারপর স্বল্পপরিচিত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আই উডনট মাইণ্ড।

আমি বললাম, কী খাবে?

ও বলল, কনিয়াক।

আমরা দুটো কনিয়াক নিলাম।

এখন ডিনারের ব্রেক নয়। তা ছাড়া পয়সা যখন দিয়েছে ট্যুর কোম্পানিকে তখন খিদে পেলেও নিজের পয়সায় ডিনার খাবে এমন ইচ্ছা কারোরই দেখা গেল না। এমতাবস্থায় গরিব ইণ্ডিয়ানের পক্ষে কপির স্যুপ এবং আলু-মটরশুটি সেদ্ধ খাওয়াটাও বড়োলোকি বলে গণ্য হবে হয়তো। তা ছাড়া সবাইকে ফেলে একা একা খাওয়াটা অশোভনও বটে। কনিয়াকটা শেষ করতে না করতে অ্যালাস্টার এসে খবর দিল যে, যোগাযোগ করা যায়নি; কিন্তু জোর চেষ্টা চলছে। অতএব আমি আর সারা আরও একটা করে কনিয়াক গিলে বাসে ফিরে এলাম। অন্যান্যরা কেউ চা, কেউ কফি, কেউ টকাস করে একটু স্ন্যাপস খেয়ে বাসে ফিরে এসেছেন।

বাইরে বৃষ্টি জোর হয়েছে। বাসের কাঁচে পিটির পিটির করে ছাঁট লাগছে। ব্লোয়ারটা দাঁড়ানো অবস্থায় অনেকক্ষণ চলেছে বলে জ্যাক বন্ধ করে দিয়েছে এখন। নেতা জনের নির্দেশে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। কোটের কলার তুলে, হাত পকেটে ভরে হেলান দিয়ে বসে আছি। বাইরে রাত নেমে এসেছে। কাঁচে বৃষ্টির জল পড়ায় বাইরে বিশেষ কিছু দেখা যায় না। বরফের সাদা, প্রতিফলিত আলো; বড়োরাস্তায় ভিড় করে থাকা গাড়িগুলো সব মিলিয়ে মাথার মধ্যে এক অসংলগ্ন ভাবনার ট্রেন চলেছে ধীরে ধীরে ক্লান্তির টানেলের মধ্যে দিয়ে।

হঠাৎ জনের শালা বলে উঠল–লুক জন। আই টোল্ড উ্য জার্মানি উইল ফাইন্যালি গেট আস।

আমি হেসে উঠলাম।

জনও হেসে উঠল। অন্য অনেকেই হাসলেন।

জন আমাকে বলল–দিস ব্লাইটার অফ আ ব্রাদার-ইন-ল কান্ট ফরগেট হিজ ইয়ারস ইন দ্য ওয়ার।

রসবোধ আছে শালাবাবুর। যুদ্ধের সময়ে হেলমেট মাথায় দিয়ে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে হাওয়াইটজারের আলোয় আলোকিত আকাশে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় এই কথাই অনেকবার মনে মনে বলেছে বাবু। আজ জার্মানিতে সত্যি বার্ধক্য ও অসহয়াতার বলি হয়ে তাই বুঝি পুরোনো কথাটা মনে পড়ে গেছে এমন করে।

মেয়েরা অনেকে ঘুমোচ্ছেন। পিছনের সিটে এয়ারফোর্সের পাপা তার পাতানো মেয়েদের সঙ্গে সমানে বকে চলেছে। যুবতী মেয়েগুলো একগামলা কইমাছের মতো খলবল খলবল করছে। চাইনিজ, ইজরায়েলি, মালয়েশিয়ান, কেনিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান–একগাদা মেয়ে একসঙ্গে কথা বললে ঠিক জলতরঙ্গের মতো আওয়াজ হয়।

এমন সময়ে জ্যাক তড়াক করে দরজা খুলে ভেতরে এসে মহাসমারোহে বাও করে বলল –প্রবলেম–ফিনি…।

জ্যাক ইংরিজির মধ্যে থ্যাঙ্ক ঊ্য; প্রবেলেম; নো প্রবলেম; গুড; ব্যাড এবং মাদাম; মিস্টার এই কটা কথা জানত। কিন্তু এই সামান্য ক-টি কথা সম্বল করে চোখ-মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে সে যেভাবে কথা বলত বহু ভাষাভাষী সর্বজ্ঞ হয়েও তেমন করে বলা যায় না।

সকলে আনন্দে হই হই করে উঠলেন। শীতের লম্বা রাত অভুক্ত শয্যাহীন অবস্থায় কী করে কাটানো হবে এই চিন্তা সকলকেই কম বেশি পেয়ে বসেছিল। এমন সময়ে অ্যাযুলাস্টার এল।

মাইক্রোফোনে বলল, ব্রাসেলসের সঙ্গে কথা হল। এ যাত্রা আমাদের ইটালি যাওয়া হবে না। আমরা আবার কেম্পটেনে ফিরে যেখানে দুপুরে খেয়েছিলাম–সেই অস্ট্রিয়ান হোটেলওয়ালার সুন্দরী ইংরেজ স্ত্রীর হেপাজতে ফিরে যাব। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করে দু তিনটে হোটেলে ভাগ করে শুয়ে পড়ব। সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পরে দশটা নাগাদ কনফারেন্স করে পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু হবে।

জ্যাক বাসটা স্টার্ট করল। আবার ব্লোয়ার চলতে শুরু করল। বাসটা মুখ ফেরাল কেম্পটনের দিকে।

বেশ ক-দিন পর সকাল ন-টা অবধি পালকের লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমোনো যাবে যে, একথা ভেবেই আরামে আমার ঘুম পেয়ে গেল। বাস চলতে লাগল হু-হু করে। ভেতরের বাতি নিবিয়ে নাইট লাইট জ্বালিয়ে দিল অ্যালাস্টার। ভোর ছটায় চলা শুরু হয়েছে আর এখন রাত প্রায় সাড়ে নটা। কারোরই আর জেগে থাকার ইচ্ছা বা জোর ছিল না।

পুরো বাসে বোধহয় ড্রাইভার জ্যাক, গাইড অ্যালাস্টার, নেতা জন এবং আমিই জেগে রইলাম।

সকলে যখন যা করে আমার তখন ঠিক তার উলটোটা করতে ইচ্ছে করে চিরদিন। বরফ ঝরা নির্জন হিমেল রাতের জার্মানির গ্রামের রূপে চোখ ডুবিয়ে বসে রইলাম।

সকালে বলাবাহুল্য আমার উঠতে দেরি হয়েছিল।

ব্রেকফাস্ট করে বাইরে এসে দেখি ঝকঝকে রোদ। চারদিকে বৃষ্টিস্নাত ঘরবাড়ি পথঘাট– চমৎকার দেখাচ্ছে।

কনফারেন্স যত সহজে শেষ হবে ভাবা গেছিল তত সহজে হল না। প্রবল আপত্তি উঠল নানাতরফ থেকে। নানা মুনির নানা মত। অনেকেই জ্যাক ও অ্যালাস্টারের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। যেন ওরাই ব্রেনার পাসের ওপর নিজে হাতে গামলা গামলা বরফ ঢেলে আমাদের ইটালি যাওয়া ভন্ডুল করেছে।

আগেই বলেছি, জনগণ সর্বত্র এক। পাঁচমিশেলি লোকে ভরা। নয়াপয়সা দিয়ে টাকা উসুল করার মনোবৃত্তিটা শুধু আমাদেরই একচেটিয়া নয় দেখে মনে মনে আত্মশ্লাঘা বোধ করলাম।

শেষে মেজরিটির ডিসিশান মানতেই হল। অবশ্য এই ডিসিশান মানাতে জন এবং আমার অনেক মেহনত করতে হল। সেই মুহূর্তে আমাদের সেই গোল হয়ে দাঁড়ানো কনফারেন্স দেখলে যে-কেউ মনে করতে পারত যে এর মধ্যে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং গান্ধিজিও আছেন;

উত্তেজনা প্রশমিত হলে বাস ছাড়ল জ্যাক।

বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল তুলে আমাদের দিকে দেখিয়ে বলল, নো প্রবলেম।

দেখতে দেখতে আমরা অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত টীরল প্রভিন্সে এসে পৌঁছোলাম। এই প্রদেশের নামেই লানডানের বেইজওয়াটার স্ট্রিটের সেই অস্ট্রিয়ান রেস্তোরাঁ টীরলার হুট। যার কথা আগে বলেছি। পথের দৃশ্য যে কী সুন্দর তা বলার নয়। চতুর্দিকে বরফ বরফ পাহাড়গুলো পা অবধি বরফে ঢাকা-উপত্যকা-গাছপালা-পথের পাশের সব কিছু বরফে ঢাকা। সব সাদা। রাতে বরফ পড়েছে–এখন আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে। অটোবান দিয়ে এত জোর ও এত বেশি সংখ্যক গাড়ি যায় সব সময়ে যে, পথটা ভিজে থাকার অবকাশ পায় না–গাড়ির চাকায় চাকায় শুকিয়ে যায় নিমেষে।

ডান দিক দিয়ে ইন নদী বয়ে চলেছে পথের পাশে পাশে। ভারি সুন্দরী ছিপছিপে নদী। অনেকটা আসামের ও ভূটানের সীমানার যমদুয়ারের কাছের সংকোশ নদীর মতো।

যেখানে বরফ পড়ে নেই সেখানের দৃশ্য যেন আরও সুন্দর। কী যে নয়নভোলানো সবুজ, তা বলার নয়। চতুর্দিকে আল্পস-এর বরফাবৃত শ্রেণি।

আসটাগ বলে একটা গ্রামের পাঁচতলা হোটেলে আমরা দুপুরের খাওয়া খেলাম। কাছেই স্কি-লিফট ও স্কি-ক্লাব আছে অনেক। হোটেলটার মধ্যে সনা বাথ, হিটেড সুইমিং পুল সব আছে। আশেপাশে কাছাকাছি কোনো শহর নেই। এখনও এখানে ভিড় তেমন জমেনি– কারণ স্কিইং-এর সময় এখনও শুরু হয়নি এখানে। বরফ এখন এখানে যা পড়েছে তা স্কিইং করার উপযুক্ত নয়। কিন্তু তবুও কিছু কিছু অত্যুৎসাহী লোক এসে জড়ো হচ্ছে। নারী-পুরুষ মাউন্টেনিয়ারিং-এর উজ্জ্বল লাল-নীল পোশাক পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে জোড়ায় জোড়ায়।

দুপুরের খাওয়া সেরে ভারি সুন্দর পথ বেয়ে মাইল চল্লিশেক এসে একটা ছোটো স্কিইং ভিলেজের ছিমছাম হোটেলে উঠলাম। গ্রামটা ইনসব্রাক-এর পথে পড়ে।

বিকেলে খটখটে রোদ থাকতে থাকতে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তখনও ওভারকোট পরে যেতে হল এত ঠাণ্ডা। বিকেলেই চার ডিগ্রি ফারেনহাইট। রাতে শূন্যের নীচে চলে যায় তাপাঙ্ক। এই শুকনো রৌদ্রালোকিত ঠাণ্ডায় নিশ্বাস নিতে ভালো লাগে। মনে হয় বুকের কলজে বিলকুল সাফ হয়ে গেল।

চতুর্দিকে বরফ-ঢাকা পাহাড়; নীল আকাশ। আল্পসের চুড়ো বরফে বরফে সাদা হয়ে আছে। চুড়োর নীচে কালো জঙ্গল। বেশির ভাগই পাইন আর ফার। ছবির মতো। কিন্তু এদেশে জঙ্গল পাহাড় ছবিরই মতো। আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে যে আদিমতা, রসহ্যময়তা তা এদের নেই। বড়োলোকের নিখুঁত সুন্দরী মেয়েদের মতো এই সৌন্দর্য এত বেশি ভালো যে তাকে ভালো লাগাতে ইচ্ছা করে না।

আজ দুপুরে যখন অস্টিগে খাওয়ার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম তখন শিঙে বাজিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে গোরু-চরানো রাখাল ছেলেদের ডাকছিল সমতলের লোকেরা–লাঞ্চ খেতে আসার জন্যে। গোরুর গলার ঘণ্টা আমাদের দেশের গোরুর গলার ঘণ্টার মতোই। পেতলের; মিষ্টি অথচ গম্ভীর আওয়াজ। অস্ট্রিয়ায় গোরুর গলার ঘণ্টা বাজিয়ে সাধারণ লোকেরা নানারকম গান-বাজনা করে। নাচেও। রাখাল ছেলেদের আগে আগে বড়ো বড়ো শেফার্ড ডগ কুকুরগুলো গোরুদের সঙ্গে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গম্ভীর ঘাউ ঘাউ ডাকে পাহাড়তলি মুখরিত করে নেমে আসছিল।

হাঁটতে হাঁটতে একটা স্কিইং ক্লাবের চৌহদ্দির মধ্যে পৌঁছে গেলাম। একটা পাহাড়ের মাথা সমান করে সেখানে ক্লাব হাউস। এখন নিস্তব্ধ পড়ে আছে। বরফ ভালো করে পড়লে এই জায়গা লাল-নীল হলুদ পেশাকে-সাজা স্কিইং রসিকদের ভিড়ে ভরে যাবে। স্কি-লিফট চলে গেছে পাহাড়ের নীচ থেকে ওপরে–এ-পাহাড়ের নীচ থেকে ও-পাহাড়ে। লিফট মানে কেবল-কার। কেবল-কারে পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছে সেখান থেকে স্কিইং করে নেমে আসে নীচে। আশে-পাশে রেস্তোরাঁ, বার, কীয়সক; লগ-কেবিন, ছড়ানো-ছিটানো থাকে।

অটোবান দিয়ে সোঁ-সোঁ করে গাড়ি চলেছে। যেসব জায়গায় গাড়ি চলে সেখানে হাঁটা নিরাপদ নয়। হয়তো বেআইনিও। রাস্তা পার হওয়াও বিপদজ্জনক। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটা গাড়িকে স্থির বিন্দুর মতো কিন্তু রাস্তা পেরুতে না পেরুতেই গাড়িটা কাছে এসে পড়ল। আসলে, এত বেগে গাড়ি চলে এখানে যে, আমাদের গতির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। সে কারণে আন্দাজে ভুল হয়ে যায়।

হেঁটে ফিরে এসে চা খেলাম এককাপ। আটটি অস্ট্রিয়ান শিলিং নিল। ইনকিপারকে দেখতে জব্বর। অস্ট্রিয়ান কাউন্টের মতো। কাউন্ট অব শ্যাটোনোয়ার মতো চেহারা। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি –সাড়ে ছ-ফিট লম্বা। তাঁর স্ত্রী কিচেন ও অফিস সামলায়। সার্ভ করে বাবা ও ফুটফুটে মেয়ে।

চা খেয়ে লবিতে এসেছি এমন সময়ে সেই বাঙালি দম্পতির একেবারে মুখোমুখি। ভদ্রমহিলা সোজা আমার চোখে তাকালেন। তারপর চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন স্পষ্ট বাংলায়, আপনি বাঙালি?

ভদ্রমহিলার আন্তরিক স্বরে প্রবাসে চমকে উঠলাম।

ছাত্রাবস্থায় অনেক শখের অভিনয় করেছিলাম। তারপর জীবনের পরীক্ষায় নেমে প্রায়ই প্রয়োজনের অভিনয় করে করে শখের অভিনয় কাকে বলে তা ভুলে গেছিলাম। তবুও ভাবলাম বলি, চোস্ত ইংরিজিতে যে আমি ইরানের লোক।

কিন্তু পারলাম না। হেসে ফেললাম।

হাসিটা বেধহয় আধেক ধরা পড়েছি গো আধেক আছে বাকির মতো মনে হল ওঁর কাছে।

তিনি বললেন রাগত স্বরে, আপনি খুব অসভ্য! এত দিন হয়ে গেল এমন লুকিয়ে রাখলেন আপনার বাঙালি পরিচয়?

তারপই বললেন, কিন্তু কেন?

আমি হাসলাম, বললাম, কোনো কারণ ছিল না। এমনিই।

মিথ্যে কথা বললাম।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। মিস্টার ও মিসেস বোস। আগেই বলেছি, একজন এঞ্জিনিয়ার আর একজন ডাক্তার। কিন্তু একজন লানডানে থাকেন অন্যজন লানডান থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে–চাকরি ব্যপদেশে।

এই কন্টিনেন্টের ছুটি ওঁদের কাছে দ্বিগুণ আকর্ষণের। প্রথমত দেশ বেড়ানো; দ্বিতীয়ত কাছে কাছে থাকা।

পরে জেনেছিলাম মানে বুঝেছিলাম যে, আমার এই বাঙালি সহযাত্রীরা বর্তমান থাকতেও ভিনদেশিদের সঙ্গে এত বেশি মাখামাখি, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এমন অবাধ মেলামেশা ওঁদের রক্ষণশীল চোখে ভালো ঠেকেনি। কিন্তু আমি যে এরকমই। ছেলেবেলা থেকেই ঠাকুমা পিসিমা এমনকী মা-বাবারও কোনো প্রাকুটি আমার স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে রোধ করতে পারেনি। অবশ্য তার দাম দিতে হয়েছে বুকের পাঁজর দিয়ে। কিন্তু এই মূল্যবান ও মাল্যবান স্বাধীনতারও একটা দাম আছে। কিছু না হারিয়ে যে এ জীবনে কিছুমাত্রই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও যে তা ছাগলের দুধ খাওয়া স্বাধীনতার মতোই জোলো প্রতিপন্ন হয় সে সম্বন্ধেও আমার বিশ্বাস দৃঢ় ছিল চিরদিনই।

যাই-ই হোক ওঁরা দুজনে বিশেষ করে মিসেস বোস আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলেন। মিসেস বোসের স্বভাবটি ভারি সহজ সরল ও সুন্দর। মি: বোস গম্ভীর, সন্দিগ্ধ; ও কিঞ্চিৎ ঈর্ষাকাতর। স্ত্রী যদি স্বামীর সামনে অন্য পুরুষের প্রতি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালো ব্যবহার করেন সেখানে বাঙালি স্বামীমাত্ররই ঈর্ষা হয়ে থাকে। তার ওপর মিসেস বোসের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে–সুতরাং তাঁর স্বাধীনতাটাকে না মেনেও উপায় ছিল না। ভবিষ্যৎ ভেবে আমি সেই মুহূর্ত থেকেই একটু গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। সংসারে সুখ বড়ো তরল জিনিস। নিজের পাত্র পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও উপচে পড়া সুখ যদি অন্য পাত্রে গিয়ে পৌঁছোয় তাহলেও আমাদের সাধারণ রক্ষণশীল মানসিকতায় তা অসহ্য বলে মনে হয়। মি. বোসের দোষ নেই। আমারও নেই।

কিন্তু আমি অন্য কারও জীবনেই দুঃখ বা বিষণ্ণতা ইচ্ছে করে আনতে চাইনি কখনো। জীবনের অভিজ্ঞতার পাতা ভরে উঠেছে ভুল-বোঝাবুঝির কালো কালিতে। ঘর-পোড়া গরু তাই আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পেয়ে শিং নাড়ায়।

লবিতে বসে ম্যাগাজিনের পাতা উলটে গল্প করে, দেখতে দেখতে ডিনারের সময় হয়ে এল।

ডিনার সার্ভ করছিল ইনকিপার ও তার মেয়ে। এখন একটা সবুজের ওপর সাদা পোলকা ডটের কাজ-করা ওয়েস্ট কোট পরেছে হোটেল মালিক। তার দুধসাদা রং খয়েরি ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, দীর্ঘ সুগঠিত চেহারা দেখে আমি স্তুতিতে নির্বাক হয়ে গেলাম। স্যুপ ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। খাওয়া ভুলে গেলাম। মেয়েটি হরিণীর মতো লঘু পায়ে একটি সাদা অ্যাপ্রন পরে সার্ভ করছিল। হাসি মুখ। বাবা ও মেয়ের মুখে কথা নেই।

ডাইনিং রুমের সার্ভিস কাউন্টারে কাঁচের ডিকান্টারে বুড়বুড়ি তুলে অ্যাপল জুস তৈরি হচ্ছে অনবরত।

দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ হল।

এদিকে আমাদের সুন্দরী অস্ট্রেলিয়ান সঙ্গিনীরা এখনও ফেরেনি। ক্যারল ও জেনি আজ রাতে ফিরে আসবে ন্যুনিক থেকে তাদের বয়ফ্রেণ্ডদের সঙ্গে। কাল থেকে তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে।

এই হোটেলের পাশেই একটা জায়গায় ডিসকোথেক ডান্স ও গেমস-এর জায়গা ছিল। ডিনারের পর প্রায় সকলেই সেখানে চলে গেল। এই রেকর্ডের সঙ্গে নাচ বা নানারকম বালখিল্য খেলায় আমার কখনো উৎসাহ ছিল না। বিদেশি নাচ সে ওয়ালটজ বা যে নাচই হোক না কেন বিদেশি যখন নাচে তখন দেখতে ভালো। কিন্তু আমাদের দিশি সাহেব মেমদের দেশ স্বাধীন হওয়ার এতদিন পরেও বিদেশিদের অন্ধ অনুকরণে ধেই ধেই নৃত্য দেখে আমার আজকাল নাচের কথা শুনলেই বমি পায়।

ক্লাবে, পার্টিতে ও অন্যান্য জায়গায় যখন পার্শে মাছের মতো মহিলারা কাৎলা মাছের মতো দিশি সাহেবদের সঙ্গে নাচেন তখন সেখানে বসে থাকতেও আমার অস্বস্তি লাগে। মনে হয়, সঙ্গ সুখের আরও তো অনেক উৎকৃষ্ট পথ আছে, তবুও এই নাচ কেন?

যে-কথা পরাধীনতার কালিমামময় বছরগুলোতে আমরা বুঝেছিলাম, বুঝেছিলাম ইংরেজদের পরমগৌরবময় অধ্যায়ে, যে যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্তমিত হত না সেই যুগে, সেকথাটাই আজ আমাদের নিজের দেশ নিয়ে গর্বের অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরনির্ভর গরিব ও কাঙাল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা ভুলে গিয়ে কত গর্ববোধ করি!

আমাদের মতো আত্মবিস্মৃত জাত বোধ হয় আর হয় না।

আজকে আমাদের ছেলে-মেয়েরা, বড়ো হয়, ন্যক্কারজনক ইঙ্গ-ভারতীয় খিচুড়িমার্কা কিণ্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াশুনো শিখে। তারা আজ আর এক্কাদোক্কা খেলে না, বাংলা ছড়া বলে না, শিশু ভোলানাথ পড়ে না, তারা রিঙ্গা-রিঙ্গা রোজেজ, পকেটফুল অফ পোজেজ গান গাইতে শেখে–অ আ ক খ শেখার আগেই। ঠাকুরমার ঝুলি বা পথের পাঁচালি পড়ার আগেই তারা ইংরিজি কমিকস পড়া শেখে। স্বদেশেও একে অন্যকে হাই বলে সম্বোধন করে। রবিশঙ্কর বা ভীমসেন যোশীর বাজনা বা গান না শুনে তারা বিদেশি পপ মিউজিকের রেকর্ড শোনে।

দিনের পর দিন এসব দেখে শুনে আজকাল এক অসহায় বিষণ্ণতা আমাকে ছেয়ে থাকে। সবসময়ে। পাতাল রেল হওয়া সত্ত্বেও, আমরা অ্যাটম বোমা বানানো সত্ত্বেও, এত এত কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, বাঁধ, রাস্তা বানানো সত্ত্বেও এই সমস্ত কিছুর সমস্ত গর্ব ছাপিয়ে আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সংগীত সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়ার লজ্জাকর মনোবৃত্তির, এই আশ্চর্য হীনমন্যতার, এই কৃতঘ্নতার গ্লানি আমাকে সবসময়ে আচ্ছন্ন করে থাকে।

ওরা ওরা; আমরা আমরা। ওদের অনেক গুণ; দোষও অনেক। আমরা কেন আমাদের দোষ ও গুণ নিয়ে, আমাদের সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের ভারতীয়ত্বতে গর্বিত হতে পারি না আজকেও? একথা ভেবে বড়োই পীড়িত বোধ করি।

আমাদের নিজেদের যা আছে, তাকে সম্যকভাবে না হলেও, মোটামুটি জেনে তারপর পরের সংস্কৃতির খোঁজখবর রাখাটা বুদ্ধিমানের, সংস্কৃতিসম্পন্নতার লক্ষণ সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেদের আলমারির মধ্যে রাখা দামি বেনারসি বা আতরদানির খোঁজ না রেখে আমরা পরের দেশের ম্যাকসি ও ইন্টিমেন্ট সেন্ট নিয়ে মাতামাতি করি।

আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, যতদিন এই হীনমন্য প্রজাসুলভ অনুকরণপ্রিয় মানসিকতা আমরা কাটিয়ে না উঠতে পারব ততদিন আমাদের তাবৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাম কানাকড়িও নয়। এমার্জেন্সি ঘোষণা হওয়ায় স্বাধীনতা গেল গেল বলে আমরা চেঁচাই–অথচ স্বাধীনতা বলতে কী যে বোঝায় তার ন্যূনতম বোধও আমাদের অনেকের মধ্যে নেই। স্বাধীনতা কেউ কাউকে ঝিনুকে করে গিলিয়ে দিতে পারে না, তা যে অর্জন করতে হয়।

এসব ভাবলে উত্তেজিত বোধ করি, রক্তচাপ কমে যায়, মাথা ঘোরে কিন্তু আমার এই দুর্বল কলমে এই লজ্জাকর মনোবৃত্তির অবসান ঘটবে এমন মনে করার কোনো কারণ দেখি না। অনেকেই যদি এইরকম ভাবেন, অন্য দশজনকে আমাদের ভারতীয়ত্বে গর্বিত ও ন্যায্য কারণে স্পর্ধিত করে তুলতে পারেন তাহলে বোধহয় এই সর্বগ্রাসী অশিক্ষাপ্রসূত হীনমন্যতার অবসান হবে।

কোন কথা বলতে বসে কোন কথায় এলাম!

লবিটা এখন ফাঁকা। বুড়ো-বুড়িরা গিয়ে অনেকে শুয়ে পড়েছেন। কাল ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। কাল আমরা ইনসব্রাকে যাব। যেখানে উনিশো পঁচাত্তরের স্কিইং অলিম্পক।

হঠাৎ দেখি ইনকিপারের মেয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল–জুতো হাতে করে।

বাবা-মা যাতে কাঠের মেঝেয় জুতোর শব্দ না শুনতে পান, সেজন্যে কি?

কে বলবে যে এই মেয়েই একটু আগে পরিবেশন করছিল। একটা পিংক গাউন পরেছে, চুলটা আঁচড়েছে ভালো করে, মুখে হালকা প্রসাধন; সেও চলেছে নাচতে। কার সঙ্গে কে জানে?

অ্যালাস্টার আমার পাশে বসেছিল।

মেয়েটি অ্যালাস্টারকে ফিসফিস করে বলল, ওন্ট উ্য?

অ্যালাস্টার বড়ো লাজুক। ভারি মিষ্টি ছেলে। ওর ট্যুরিস্ট গাইড না হয়ে অধ্যাপক হওয়া উচিত ছিল। হবেও হয়তো কোনোদিন। ইতিমধ্যেই পাঁচটি ভাষায় ওর সমান দখল।

লাজুক মুখে ও বলল, নো, থ্যাঙ্ক ঊ্য।

মেয়েটি অবাক হল। ওর এই প্রস্ফুটিত প্রথম যৌবনের গোলাপি অধ্যায়ে নাচের নিমন্ত্রণে এই বোধহয় ও প্রথম প্রত্যাখাত হল। মুখটা কালো হয়ে গেল বেচারির।

কথা না বলে দরজা খুলে পথে বেরিয়ে গেল।

জ্যাক একটু পর ঘরে ঢুকল, ও লা-লা-লা করতে করতে। আমাকে বলল, নো ম্যাডাম? প্রবলেম?

আগেই বলেছি, জ্যাকের ইংরিজি জ্ঞানের কথা। কিন্তু মুখে হাসি থাকলে এবং সকলের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি থাকলে ভাষার বোধ হয় তেমন প্রয়োজন হয় না।

জ্যাক আবারও হেসে বলল, টু কোল্ড; নো ম্যাডাম প্রবলেম!

আমি আর অ্যালাস্টার হাসলাম।

তারপর জ্যাক ও অ্যালাস্টার চলে গেল শুতে। যাওয়ার সময়ে জ্যাক হাত নেড়ে বলল, মি? ওয়ান ওয়াইফ। ইচ পোর্ট।

আমি আর অ্যালাস্টার আবার হাসলাম।

ওরা চলে যেতেই দেখি সারা নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।

ও বোধহয় জেনি আর ক্যারলের মতোই বাড়তি জামা-কাপড় আনেনি। এসে অবধি সেইদিনের ফ্লেয়ার, জিনের শার্ট আর ফুলহাতা সোয়েটার ছাড়া আর কিছু পরতে দেখিনি। একটা চামড়ার জার্কিন শুধু একবার বের করতে দেখেছিলাম কেম্পটেনের রাতে।

বললাম, কী ব্যাপার? তুমি গেলে না নাচতে? সকলেই তো গেল?ও ঠোঁট উলটে বলল, আমার ভালো লাগে না।

কেন? অবাক হয়ে শুধোলাম আমি।

ও বলল, এমনিই।

তারপর আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলল, হাঁটতে যাবে? আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখলাম বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না-আল্পসের চুড়োগুলো রুপোলি পাত দিয়ে মোড়া বলে মনে হচ্ছে।

আমি বললাম, চলো। দরজা খুলে বেরোতেই বুঝলাম কীরকম ঠাণ্ডা বাইরে। সারাকে বললাম, তোমার শীত করবে না?

ও বলল, এখনও করছে না, করলে দেখা যাবে।

তারপরই দুষ্টুমি করে মুখ ঘুরিয়ে বলল, সঙ্গে সমর্থ পুরুষমানুষ থাকলেও যদি কোনো মহিলার শীত করে তাহলে কিছুই বলার নেই।

আমি হাসলাম। বললাম, ইজরায়েলিরা খুব সাহসী। সব ব্যাপারে।

ও হাঁটতে হাঁটতে ফ্লেয়ারের দু-পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে বলল, আমাদের সম্বন্ধে তুমি কী জানো?

আমি বললাম, বেশি কিছুই জানি না। তবে তোমাদের একচোখে কালো চশমা মোসে দেওয়ানকে দেখে রবিনসন ক্রুসোর আমলের জলদস্যু বলে মনে হয়। শুনেছি, পড়েছি; তোমরা মরুভূমিতে চাষ করো, তোমরা খুব ডেয়ার-ডেভিল জেদি জাত।

ও বলল, জেদি হওয়া কি খারাপ?

আমি বললাম, তা নয়, তবে জেদটা কী কারণে, জেদের প্রার্থিত বস্তু কী তার ওপর সব কিছু নির্ভর করে। ভালো জেদ ভালো; খারাপ জেদ খারাপ।

আমাদের জেদ ভালো না খারাপ?

আমি বললাম, এমন সুন্দর রাতে জেদাজেদির কথা না হয় তুলেই রাখো।

ও হাসল, পকেট থেকে একটুকরো চকোলেট বার করে আমাকে দিল, নিজেও খেল। তারপর বলল, ঠিক বলেছ।

রাস্তায় লোক নেই, জন নেই। দূরের অটোবান দিয়েও এখন কম গাড়ি যাচ্ছে। চাঁদের আলো আল্পসের চুড়োর বরফে পিছলে পড়ে পাহাড়ে বনে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারি ভালো লাগছে।

সারা আমার বাঁ-দিকে হাঁটছে। ডান হাত দিয়ে চকোলেট কামড়ে খাচ্ছে কু£রকুটুর করে। ওর সোনালি ডান হাতে একটা প্লাটিনামের বালা-সোয়েটারের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে। সেই চাঁদের আলোয় ওর কাটা-কাটা চোখ-মুখ, নীল চোখ, উড়াল সোনালি চুল, আর ঠোঁটের কাছে ধরা রুপো ছোঁয়া সোনালি বালা পরা সোনালি হাত এক আশ্চর্য চলমান স্নিগ্ধ ছবির সৃষ্টি করেছে।

সারা হঠাৎ বলল, সারাটা জীবন এমন ছুটি হলে বেশ হত।

আমি বললাম, তুমি কী করো?

ও বলল, একটা কমপিউটার ফার্মে চাকরি করি এবং লড়াইও করি।

ভাবতেও অবাক লাগল যে, যে-হাতের স্নিধ সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম একমুহূর্ত আগেও সেই হাত দিয়ে ও অটোমেটিক ওয়েপন ছোঁড়ে; মানুষ মারে।

ভাবছিলাম, এমনিতেই সব মেয়েই মানুষ মারে হেলাফেলায়, তাদের আবার শক্ত হাতে বন্দুক ধরার দরকার কী? ভগবান এমনিতেই তো কম মারণাস্ত্রে সজ্জিত করে পাঠাননি তাদের। তবু আরও কেন?

প্রথম দিন থেকেই লক্ষ করেছিলাম যে, এই মেয়েটি বয়েস অনুপাতে অনেক বেশি ম্যাচিওরড। জীবনে ওর যেন সবই জানা হয়ে গেছে। ওর সমবয়েসি অন্য সমস্ত ছুটি কাটাতে-আসা ছেলে-মেয়েরা এতক্ষণ ডিসকোত্থেকে নাচে মত্ত, জুয়ার চাকার পাশে ঘুরছে, বিয়ার খাচ্ছে পাগলের মতো, নিজেদের বেহিসাবি যৌবন নিয়ে যে কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না, ভাবছে যে যৌবনের কোনো তল নেই, ক্ষয় নেই, শেষ নেই; ভাবছে যৌবন অনন্ত।

অথচ এই মেয়েটি যেন যৌবনে পা দিয়েই যৌবনকে লগি দিয়ে মেপে ফেলেছে। জেনে গেছে কত বাঁও জল তাতে। জেনে শুনে সে সাবধানি ভিস্তিওয়ালার মতো শরীর মনের ভিত্তিতে যৌবনকে পুরে নিয়ে মেপে মেপে খরচ করছে। কৃপণরা যেহেতু সবসময়েই সাবধানি হয়, সারার হাঁটাচলা, কথা বলা, চোখ-তাকানো হয়তো সে কারণেই অতিসাবধানি। এটা খারাপও; আর ভালোও। ভাবছিলাম।

সারা হঠাৎ বলল, তোমাদের দেশে একবার যাব ভেবেছি।

আমি খুশি হয়ে বললাম, এসো না। এলে আমার সঙ্গে, আমাদের বাড়িতে, আমার অতিথি হয়ে থেকো। তোমাকে অগ্রিম নেমন্তন্ন জানিয়ে রাখলাম। আমাদের দেশ ভারি সুন্দর। তোমাকে আমাদের গ্রাম দেখাব, জঙ্গল পাহাড় দেখাব, দেখবে আমাদের দেশের লোকেরা কত ভালো।

যাব, একবার। অস্পষ্ট স্বরে বলল সারা।

হঠাৎ সারা বলল, আমার একা একা হাঁটতে খুব ভালো লাগে।

আমি বললাম, আমরা সকলেই তো একা; সারাজীবন একা। তবু শুধু একা একা হাঁটতেই ভালো লাগে কেন তোমার? একা একা বাঁচতে ভালো লাগে না?

ও বলল, না। আমরা যে সকলেই একা, চিরজীবনের মতো একা একথা জানি বলেই একা একা বাঁচতে ভালো লাগে না।

তবে একা একা হাঁটতে ভালো লাগে কেন?

ভালো লাগে, কারণ একা একা হাঁটবার সময়ে অনেক কিছু ভাবা যায়। নিজেকে একা পেলে নিজের শুভাশুভ, ভবিষ্যৎ, ভালোমন্দ এসব ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়। নিজেকে জানা যায়। তোমাদের গীতায় নিজেকে জানা সম্বন্ধে কীসব কথা আছে না?

আশ্চর্য। আমি বললাম।

তারপর শুধোলাম, তুমি গীতা পড়েছ?

পুরো পড়িনি। ইংরিজিতে গীতার ওপরে একটা বই পড়েছিলাম। তোমাদের কর্মযোগ। তোমরা কিন্তু দারুণ জাত। তোমাদের মতো ঐতিহ্য খুব কম জাতের আছে।

আমি বললাম, একজন আঠারো-উনিশের বিদেশি মেয়ের পক্ষে এত ঔৎসুক্য আমাদের দেশ সম্বন্ধে, ভাবলেও ভালো লাগে।

সারা বলল, আমার মা ও বাবা দুজনকে আমার তেরো বছর বয়েসে একইসঙ্গে, একই দিনে হারিয়েছিলাম। তারপর থেকে জীবন, জীবনের মানে এসব সম্বন্ধে অনেক কৌতূহল জাগে আমার। যা আমার বয়েসি মেয়ের পক্ষে স্বাভাবিক নয়, এমন অনেক বিষয়ে আমি পড়াশুনা করেছি। করি।

তারপরই বলল, অন্যায় করেছি?

আমি হাসলাম। বললাম, অন্যায় কীসের? তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে আমার গর্বিত লাগছে নিজেকে।

হঠাৎ সারা বলল, তুমি একা এসেছ কেন দেশ বেড়াতে?

আমি কী জবাব দিই ভেবে পেলাম না।

আশ্চর্য। ও বলল।

কেন? আশ্চর্য কেন?

আমি শুধোলাম।

তোমার এমন একা একা নির্বান্ধব হয়ে ঘুরে বেড়াতে কষ্ট হয় না? মনের কথা না হয় বাদই দিলাম। শরীরের কষ্টও বোধ করো না তুমি?

আমি বললাম, শরীরের কষ্টটা তত সহজেই লাঘব করা যায়। আসল কষ্ট তো মনের। সেটাই আসল কষ্ট।

হঠাৎ সারা বলল, জানি না। আমার তো মনে হয় শরীরটাও মনের মতো। ইকুয়ালি ইম্পরট্যান্ট! তোমরা ভারতীয়রা শরীরটাকে নেগেটিভ করে একটা বাহাদুরি পাওয়ার চেষ্টা করো। আমার কিন্তু মনে হয় এটা ঠিক নয়। জীবনে শরীরটা মনের মতোই ইম্পরট্যান্ট। শরীরকে পুরোপুরি অস্বীকার করে কি তার দাবিকে দাবিয়ে রেখে কি মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারে?

আমি বললাম, সুস্থতা বলতে তুমি কী মনে করো জানি না। তবে বাঁচতে যে পারে, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।

ও আমার দিকে তাকাল একবার। তারপর বলল, তুমি কি সত্যিই নিঃসন্দেহ এ সম্বন্ধে, না শেখানো কথা বলছ; অথবা সংস্কারের কথা।

তারপর হঠাৎ অত্যন্ত বিজ্ঞর মতো বলল, সংস্কারকে কাটিয়ে ওঠাও কি মনুষ্যত্ব নয়? সংস্কার এবং যাবতীয় সংস্কারই কি ভালো?

আমি বললাম, আমার কোনোরকম সংস্কার নেই। সংস্কারবদ্ধতা একরকমের পরাধীনতা। সংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই।

সারা বলল, তুমি সত্যি কথা বলছ না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, একথা কেন বলছ?

বলছি, কারণ তোমায় পরীক্ষা করলে তুমি পরীক্ষায় পাস করবে না।

আমি হাসলাম। বললাম, করো পরীক্ষা। কী পরীক্ষা করতে চাও তুমি?

সারা বলল, আজকে তুমি আমার সঙ্গে শোবে। আমার খুব একা লাগছে; শীতার্ত লাগছে। পারবে তুমি আমার শীত কাটাতে, আমার একাকীত্ব ঘোচাতে? যে একাকীত্ব একজন মাতৃ পিতৃহীন উনিশ বছরের সঙ্গীহীন লড়াই করা মেয়ের মেরুদন্ডে, মজ্জায় সেঁধিয়ে আছে–যে শীত সমস্ত সত্তায় ছেয়ে আছে সেই শীতকে তুমি উষ্ণ করে তুলতে পারবে? যদি পারো, তাহলে জানব যে, তুমি যথার্থ পুরুষ। যথার্থ সংস্কারমুক্ত জীব।

আমি অবাক হয়ে সারার মুখে তাকালাম। চাঁদের আলোয় ওর সোনালি কাটাকাটা মুখকে খুব নিষ্ঠুর অথচ করুণ দেখাচ্ছিল।

বললাম, ঠিক আছে। তবে হোটেলে ফিরে চলল।

সারা আমার হাতটা ওর হাতে টেনে নিল।

বলল, এখুনি নয়। বাইরের শীতটা আরও একটু লাগুক। ঠাণ্ডায় আমার ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে যাক। আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে উঠুক। তখন, তখন তুমি ধীরে ধীরে আমাকে উষ্ণতায় ভরে দিয়ে।

আমি বললাম, জানো আমার একটা উপন্যাস আছে, তার নাম একটু উষ্ণতার জন্যে। ফর আ লিটল ওয়ার্মথ। সেই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হল যে, আমরা সকলেই এই শীতার্ত নির্বান্ধব পৃথিবীতে একটু উষ্ণতার জন্যে, একটু উষ্ণতার কাঙালপনা নিয়ে বেঁচে থাকি। উষ্ণতাই জীবন, উষ্ণতার অভাবই মৃত্যু। জীবনের অভাব।

সারা বলল, স্ট্রেঞ্জ। ঠিক আমার মতটাও এই। কিন্তু তুমি কোন ভাষায় লেখো?

আমি বললাম, বাংলায়। আমার মাতৃভাষায়।

ও বলল, তোমার ইংরিজিতে লেখা উচিত। আমাদের পড়তে দেওয়া উচিত তোমার বই। বাংলায় লিখলে তো আমরা পড়তে পারব না। নয়তো অনুবাদ করাও।

যখন আমরা ফিরে আসছিলাম, তখন রাত সাড়ে দশটা। আল্পসের মাথায় লক্ষ্মীপূর্ণিমার চাঁদ অঝোরে ঝরছে। ঠাণ্ডায় কান জমে যাচ্ছে। আমি আমার ওভারকোটটা খুলে সারার গায়ে পরিয়ে দিলাম।

ও বলল, তোমার শরীরের উষ্ণতা তোমার ওভারকোটে সব মাখামাখি হয়ে আছে। তুমি বুঝি তোমার সম্পূর্ণ ভুমির বদলে শুধু তোমার ওভারকোটটা দিয়েই ছুটি চাও? বলেই দুষ্টুমি করে হাসল ও একটু।

আমি শুধোলাম, হাসছ কেন?

ও বলল, হাসছি এই ভেবে যে, চিরদিনই কি আমার সব শীত তুমি এমনি করে ঢেকে রাখতে পারবে? দু-দিনের আলাপ। দু-দিন পরে এই ট্যুর শেষ হয়ে গেলেই সব শেষ হয়ে যাবে। তবে এই ধৃষ্টতা কেন?

আমি বললাম, কারণ, ভবিষ্যতে আমার বিশ্বাস নেই। ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ, জাতির ভাগ্য ও সমষ্টির ভবিষ্যৎ এসবই বোধ হয় বানানো কথা। একমাত্র বর্তমানটাই সত্যি। বর্তমানের মুহূর্তগুলোর সমষ্টি নিয়েই জীবন। কখনো ভুলেও এর ভাবনা ভেবে বর্তমানকে মাটি কোরো না। অন্তত আমি কখনো করতে চাইনি। এই মুহূর্তের সত্যকে নিয়েই দারুণভাবে বেঁচে থাকো; উপভোগ করে প্রতিটি মুহূর্ত। জীবন মানেই তো মুহূর্তের গাঁথা মালা। তাই মুহূর্তটাও কি ফেলে দেবার!

হোটেলে ফিরে সারা আমাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে আমার সামনে নিরাবরণ হল। তার সোনালি মরুভূমির মতো পেলব জ্বালাধরা যুবতী শরীরের উষ্ণতা আমার প্রবাসের সমস্ত শীতকে মুছে দিল!

সারা বলল, এসো, ভবিষ্যৎ-এর মুখে ছাই দিয়ে আজকের এই মুহূর্তটিকে আমরা উষ্ণতায় ভরিয়ে তুলি।

ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়েছিল ও। জানালার কাঁচ বেয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরের কার্পেটে, বিছানায় পড়েছিল। জানালা দিয়ে আল্পসের তুষারাবৃত চুড়োগুলো দেখা যাচ্ছিল। নীচে অন্ধকার উপত্যকা।

সারা ফিসফিস করে বলল, কই এসো!

আমার বুকে শুয়ে সারা ফিসফিস করে বলল, আমাকে দারুণ দারুণ আদর করো তুমি, খাজুরাহোর দেশের লোক, কোনারকের দেশের লোক, আদরে আদরে তুমি আমার শৈশবের কৈশোরের প্রথমযৌবনের সমস্ত কষ্ট, গ্লানি, একাকীত্ব সব নিঃশেষে মুছিয়ে দাও। আমাকে সম্পূর্ণতার আনন্দে আপ্লুত করো। আমার সব অতীত ভবিষ্যৎ ভুলিয়ে দাও।

জবাবে কোনো কথা না বলে আমি ওর চোখের পাতায় চুমু খেলাম।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textবুদ্ধদেব গুহ- র আরো পোষ্ট দেখুন