জঘন্যতম হিংস্রতা

২৫ মার্চের এই ভয়াল রাত্রি না এলেও এই স্বাধীনতাটা অবধারিতই ছিল। কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি, পাকিস্তানিরা এমন জঘন্য পরিকল্পনা করবে, এমন জানোয়ার হয়ে উঠবে।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন। সকল সুযোগ-সুবিধা তাদের হাতেই। বেসামরিক লোকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের অনীহা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যে, এই বেসামরিকরা আবার বাঙালি। বেসামরিকদের হাতে ক্ষমতা চলে গেলে, বাঙালিরা যে ক্ষমতার নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চলে আসবে_ তা তারা জানত।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে এক মানুষ এক ভোট, এটা ছিল না। তারা একটা সংখ্যাসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। যে সংখ্যাসাম্য ছিল চরমভাবে অগণতান্ত্রিক। কিন্তু এটাকে মানিয়ে নেওয়া হয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সময় এ নীতি করা হয়েছিল যে, পূর্ববঙ্গের ৫৬ জন মানুষ ওখানকার ৪৪ জনের সমান। তাকে দিয়েই এটাকে মানিয়ে নেওয়া হলো। আমাদের ৫৬ জন ওখানকার ৪৪ জনের সমান হয়ে গেল। কিন্তু মানুষের মনে ছিল, সর্বজনীন ভোটাধিকার পাওয়ার দাবি। ইয়াহিয়া খান যখন এই সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিষয়টি স্বীকার করে নিল, তখনই কিন্তু এই রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। অর্থাৎ, তখনই বোঝা গেল যে, এই ৫৬ জন একবাক্যে বলবে তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায়। কিন্তু তাদের একটা হিসাব ছিল যে, তারা এই দাবিকে ভাগ করে ফেলতে পারবে। আমরা ঐতিহাসিকভাবে দেখেছি, একটা আন্দোলন যখন গড়ে ওঠে, তখন আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্য নির্বাচন দেওয়া হয়। যেমন আমরা ‘৪৫ সালে দেখেছি, দেশ ভাগের যে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল, সেটা দমন করার জন্য নির্বাচন দেওয়া হলো। তার ফলে এর আগে যে দাঙ্গাটা ছিল, সেটা আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। আমরা ‘৫৪ সালের নির্বাচনেও তাই দেখলাম যে, ‘৫২ সালের বাংলা ভাষার দাবির মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে যে অভ্যুত্থান সূচিত হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে যে চেতনা বিকশিত হচ্ছে_ সেটাকে অবদমিত করার জন্য চুয়ান্ন সালে নির্বাচন দেওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে তারা যেটা হিসাব করেছিল, সেটাই ঘটল। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলো বটে, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভাগ হয়ে গেল। যুক্তফ্রন্টের দুই অংশের মধ্যে যে সংঘর্ষ বাধল_ মূলত একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক পার্টি_ সে সুযোগে সামরিক শাসক আমাদের এখানে চড়াও হয়ে উঠল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনটাও তারা সে হিসাবেই দিয়েছিল। ঊনসত্তরের যে প্রবল গণঅভ্যুত্থান_ তাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য এ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারা নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিয়েছিল। আইয়ুব খান গিয়ে ইয়াহিয়া খান এলো। তারা হিসাব করেছিল, এই নির্বাচন দিয়ে অভ্যুত্থানকে স্তিমিত করা যাবে এবং একটা বিভাজন তৈরি করা যাবে। কিন্তু তারা এটা হিসাবে আনেনি, আওয়ামী লীগই সব আসন পেয়ে যাবে। এটা হতো না, যদি মওলানা ভাসানীর ন্যাপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত। ন্যাপ যে অংশ নেয়নি, তার ফলেই কিন্তু ভাগটা হলো না। মুজাফফরের ন্যাপ অংশ নিয়েছিল, তবে তারা কোনো সুবিধা করতে পারেনি। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ যে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি_ তার মুখ্য হিসাব এখন মনে হয় যে তিনি চাইছিলেন, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সর্বজনীন রায় বেরিয়ে আসুক। স্বাধীনতার পক্ষে রায়টা কাজে লাগুক।
‘৭০-এর এই নির্বাচনের পরেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের হিসাবটা একেবারে গরমিল হয়ে গেল। এটা অনিবার্য হয়ে গেল, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে সামরিক বাহিনীর কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। তিনি হয়তো অনেক প্রতিষ্ঠান এই বাংলায় নিয়ে আসবেন। এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। কাজেই সত্তরের নির্বাচনের পর এটা অনিবার্য ছিল যে একটা সংঘর্ষ হবে, আপসে কাজ হবে না। আপস হতে পারে একমাত্র নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু তারা এটা চায় না, পাকিস্তানের ক্ষমতা তাদের হাতে না থাকুক।
এ জন্য তারা একটা অবাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে নিল, এইখানে এসে, সমস্ত বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা জয়ী হবে। এই হিসাবটা ভুল ছিল। তারা হিসাবের মধ্যে নেয়নি যে আমাদের সীমান্ত খোলা; ভারতের সঙ্গে আমাদের অবাধ সীমান্ত যোগাযোগ; এখানে যুদ্ধ লাগলে যে শরণার্থীরা ভারতে চলে যাবে এবং সেই শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপের সৃষ্টি হবে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধটা তাদের সেই নির্বুদ্ধিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এবং তাদের সেই নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাদের হিংস্রতা।
এই সামরিক বাহিনী অত্যন্ত হিংস্র। এই হিংস্রতা ব্রিটিশদের যে নিপীড়ন_ তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন গণহত্যা মানুষের ইতিহাসে বিরল। অনিবার্য ছিল যে, মুক্তির জন্য একটা সংঘর্ষ হবে। কিন্তু এ রকম নৃশংস হয়ে উঠতে পারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, তা কারও ধারণায় ছিল না।
যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ভ্রান্ত ছিল। হিন্দুরা একজাতি, মুসলমানরা একজাতি_ এটা ছিল ধর্মের ভিত্তিতে। এখন প্রমাণিত সত্য হলো এটি যে, উপমহাদেশে সে সময়ে কমপক্ষে ১৭টি ভাষাভিত্তিক জাতি ছিল। তাদের প্রত্যেককে পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া যেত। যদি তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতাও দেওয়া হতো, তাহলে এই সকল জাতি মিলে একটা আঞ্চলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো। ইউরোপে যেমন এতগুলো জাতি এখন এক ইউনিয়নের মাধ্যমে বসবাস করছে। আসলে এই একজাতিতত্ত্বও ভুল ছিল, দ্বিজাতিতত্ত্বও ভুল ছিল। একজাতিতত্ত্ব বলছিল, সকল ভারতবাসী এক। দ্বিজাতিতত্ত্ব বলছিল, হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি। তাই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানি যে রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা বেশিদিন এক থাকতে পারেনি। অবধারিতভাবে আলাদা হয়ে গেল। কারণ, যে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি অঞ্চলকে একত্র করা হয়েছিল, সেই ধর্ম এক হলেও দুই অঞ্চলের মধ্যে ছিল বিস্তর বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানাভাবে পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছিল। যে শোষণ একদিন মানুষ অস্বীকার করে বসল। কেবল মাঝখান থেকে প্রাণ গেল আমাদের লাখ লাখ মানুষের।
২৫ মার্চ জঘন্যতম হিংস্রতার প্রমাণ দিয়ে পাকিস্তানিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঙালির ওপর। তারা ভেবেছিল, এই নির্বিচার গণহত্যার ভয়ে বাঙালিরা দমে যাবে চিরতরে। কিন্তু তা হলো না। একেবারে অপ্রস্তুত, নিরস্ত্র বাংলার মানুষ হাজার বছরের অত্যাচারের অবসান ঘটাল বুকের রক্ত দিয়ে।
লেখক
শিক্ষাবিদ,প্রাবন্ধিক।