বেড়ে ওঠার দিনগুলো

শুনলাম, আমি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পুরোপুরি বাঁদর হয়ে গেছি। আমার বাঁদরজীবনের সমাপ্তি ঘটানোর জন্যই আমাকে নাকি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া উপলক্ষে একটা নতুন খাকি প্যান্ট কিনে দেওয়া হলো। সেই প্যান্টের কোনো জিপার নেই। সারাক্ষণ হা হয়ে থাকে। অবশ্যি তা নিয়ে আমি খুব একটা উদ্বিগ্ন হলাম না। নতুন প্যান্ট পরছি—এই আনন্দেই আমি আত্মহারা।
মেজো চাচা আমাকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন এবং হেড মাস্টার সাহেবকে বললেন, চোখে চোখে রাখতে হবে। বড়ই দুষ্ট।
আমি অতি সুবোধ বালকের মতো ক্লাসে গিয়ে বসলাম। মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির ওপর বসে পড়াশোনা। ছেলেমেয়ে সবাই পড়ে। মেয়েরা বসে প্রথম দিকে, তাদের পেছনে ছেলেরা। আমি খানিকক্ষণ বিচার-বিবেচনা করে সবচেয়ে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লাম। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে তুই তুই করে সিলেটি ভাষায় বলল, এই তোর প্যান্টের…।
ক্লাসের সব কটা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। মেয়েদের আক্রমণ করা অনুচিত বিবেচনা করে সবচেয়ে উচ্চ স্বরে যে ছেলেটি হেসেছে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাতের কনুইয়ের প্রবল আঘাতে রক্তারক্তি ঘটে গেল। দেখা গেল ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙে গেছে। হেড মাস্টার সাহেব আমাকে কান ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন—এ মহা গুন্ডা। তোমরা সাবধানে থাকবে। খুব সাবধান। পুলিশের ছেলে গুন্ডা হওয়াই স্বাভাবিক।
ক্লাস ওয়ান ১২টার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। এই দুই ঘণ্টা আমি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার সময়টা যে খুব খারাপ কাটল, তা নয়। স্কুলের পাশেই আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প। তাদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। লেফট রাইট, লেফট রাইট। দেখতে বড়ই ভালো লাগছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলাম, বড় হয়ে আনসার হব।
ক্লাসের দ্বিতীয় দিনেও শাস্তি পেতে হলো। মাস্টার সাহেব অকারণেই আমাকে শাস্তি দিলেন। সম্ভবত প্রথম দিনের কারণে আমার ওপর রেগে ছিলেন। তিনি মেঘস্বরে বললেন, গাধাটা মেয়েদের সঙ্গে বসে আছে কেন? অ্যাই, তুই কান ধরে দাঁড়া। দ্বিতীয় দিনেও সারাক্ষণ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, তৃতীয় দিনেও একই শাস্তি। তবে এই শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। আমি একটা ছেলের স্লেট ভেঙে ফেললাম। ভাঙা স্লেটের টুকরায় তার হাত কেটে গেল। আবার রক্তপাত, আবার কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি।
আমি ভাগ্যকে স্বীকার করে নিলাম। ধরেই নিলাম যে স্কুলের দু ঘণ্টা আমাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আজকের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সত্যি আমাকে পাঠশালার প্রথম শ্রেণিটি কান ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটাতে হয়েছে। তবে আমি একা ছিলাম না, বেশির ভাগ সময় আমার সঙ্গী ছিল শংকর। সে খানিকটা নির্বোধ প্রকৃতির ছিল। ক্লাসে শংকর ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু জুটল না। সে আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে রইল। আমি যেখানে যাই, সে আমার সঙ্গে আছে। মারামারিতে সে আমার মতো দক্ষ নয়, তবে মারামারির সময় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আঁ-আঁ ধরনের গরিলার মতো শব্দ করে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যেত। এতেই অনেকের পিলে চমকে যেত। শংকরকে নিয়ে শিশুমহলে আমি বেশ ত্রাসের সঞ্চার করে ফেলি।
এই সময় স্কুলে কিছুদিনের জন্য কয়েকজন ট্রেনিং স্যার এলেন। ট্রেনিং স্যার ব্যাপারটা কী আমরা কিছুই জানি না। হেড স্যার শুধু বলে গেলেন, নতুন স্যাররা আমাদের কিছুদিন পড়াবেন। দেখা গেল, নতুন স্যাররা বড়ই ভালো। পড়া না পারলেও শাস্তি দেওয়ার বদলে মিষ্টি করে হাসেন। হইচই করলেও ধমকের বদলে করুণ গলায় চুপ করতে বলেন। আমরা মজা পেয়ে আরও হইচই করি। একজন ট্রেনিং স্যার, কেন জানি না, সব ছাত্রছাত্রীকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে পড়লেন। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করেন। আমার যা মনে আসে বলি আর উনি গম্ভীর মুখে বলেন, তোর এত বুদ্ধি হলো কী করে? বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। তোর ঠিকমতো যত্ন হওয়া দরকার। তোকে নিয়ে কী করা যায় তাই ভাবছি। কিছু একটা করা দরকার।
কিছু করার আগেই স্যারের ট্রেনিংকাল শেষ হয়ে গেল। তিনি চলে গেলেন। তবে কেন জানি কিছুদিন পরপরই আমাকে দেখতে আসেন। গভীর আগ্রহে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তার খোঁজ নেন। সব বিষয়ে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়ে ক্লাস টুতে ওঠার সংবাদ পাওয়ার পর স্যারের উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। শুধু যে উৎসাহে ভাটা পড়ে তা-ই না, উনি এতই মন খারাপ করেন যে আমার নিজেরও খারাপ লাগতে থাকে।
ক্লাস টুতে উঠে আমি আরেকটি অপকর্ম করি। যে রূপবতী বালিকা আমার হৃদয় হরণ করেছিল, তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলি। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করি, বড় হয়ে সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না। প্রকৃতির কোনো এক অদ্ভুত নিয়মে রূপবতীরা শুধু যে হৃদয়হীন হয় তা-ই না, খানিকটা হিংস্র স্বভাবেরও হয়। সে আমার প্রস্তাবে খুশি হওয়ার বদলে বাঘিনীর মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খামচি দিয়ে হাতের দু-তিন জায়গার চামড়া তুলে ফেলে। স্যারের কাছে নালিশ করে। শাস্তি হিসেবে দুই হাতে দুটি ইট নিয়ে আমাকে নিল ডাউন হয়ে বসে থাকতে হয়। প্রেমিক পুরুষদের প্রেমের কারণে কঠিন শাস্তি ভোগ করা নতুন কোনো ব্যাপার নয়, তবে আমার মতো এত কম বয়সে প্রেমের এমন শাস্তির নজির বোধ হয় খুব বেশি নেই।
স্কুল আমার ভালো লাগত না। মাস্টাররা অকারণে কঠিন শাস্তি দিতেন। পাঠশালা ছুটির পর বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি যাচ্ছে, এ ছিল প্রাত্যহিক ঘটনা। আমাদের পাঠশালায় প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা। কিন্তু একটা ক্লাস থেকে অন্য ক্লাস আলাদা করা নয়, অর্থাৎ কোথাও কোনো পার্টিশনের ব্যবস্থা নেই। কোনো ক্লাসে একজন শাস্তি পেলে পাঠশালার সবাই তা দেখে বিমলানন্দ ভোগ করত।
আমার জীবনে শিক্ষকেরা এসেছেন দুষ্টগ্রহের মতো। আমি সারা জীবনে অনেক কিছু হতে চেয়েছি—আইসক্রিমওয়ালা, জুতা পলিশওয়ালা থেকে ডাক্তার, ব্যারিস্টার কিন্তু কখনো শিক্ষক হতে চাইনি। চাইনি বলেই বোধ হয় এখন জীবন কাটাচ্ছি শিক্ষকতায়।
থ্রি থেকে ফোরে উঠব। বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়াশোনার ধুম। আমি নির্বিকার। বই নিয়ে বসতে ভালো লাগে না। যদিও পড়তে বসতে হয়। সেই বসাটা পুরোপুরিই ভান। সবাই দেখল, আমি বই নিয়ে বসে আছি, এই পর্যন্তই। তখন প্রতি সন্ধ্যায় সিলেট শহরে মজাদার ব্যাপার হতো—তার নাম ‘লেমটন লেকচার’। কথাটা বোধ হয় ‘লন্ঠন লেকচার’-এর বিকৃত রূপ। ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে জায়গায় জায়গায় সিনেমা দেখায়: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ম্যালেরিয়া এইসব ভালো ভালো জিনিস। আমাদের কাজের ছেলে রফিক খোঁজ নিয়ে আসে আজ কোথায় লেমটন লেকচার হচ্ছে—মুহূর্তে আমরা দুজন হাওয়া। রফিক তখন আমার বন্ধুস্থানীয়। লেমটন লেকচারের ভূত আমার ঘাড় থেকে নামানোর অনেক চেষ্টা করা হলো। নামান গেল না। মা হাল ছেড়ে দিলেন। এখন আর সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতেও বলেন না। আমি মোটামুটি সুখে আছি বলা চলে।
এমন এক সুখের সময়ে মাথামোটা শংকর খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তার মা তাকে বলেছেন সে যদি ক্লাস থ্রি থেকে পাস করে ফোর-এ উঠতে পারে, তাহলে তাকে ফুটবল কিনে দেবেন।
সে আমার কাছে এসেছে সাহায্যের জন্য। কী করে এক ধাক্কায় পরের ক্লাসে ওঠা যায়। একটা চামড়ার ফুটবলের আমাদের খুবই শখ। সেই ফুটবল এখন মনে হচ্ছে খুব দূরের ব্যাপার নয়। সেই দিনই পরম উৎসাহে শংকরকে পড়াতে বসলাম। যে করেই হোক তাকে পাস করাতে হবে। দুজন একই ক্লাসে পড়ি। এখন সে ছাত্র, আমি শিক্ষক। ওকে পড়ানোর জন্য নিজেকে প্রথম পড়তে হয়, বুঝতে হয়। যা পড়াই কিছুই শংকরের মাথায় ঢোকে না। মনে হয় তার দুই কানে রিফ্লেকটর লাগান। যা বলা হয় সেই রিফ্লেক্টরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, ভেতরে ঢুকতে পারে না। যাই হোক, প্রাণপণ পরিশ্রমে ছাত্র তৈরি হলো। দুজন পরীক্ষা দিলাম। ফল বের হলে দেখা গেল, আমার ছাত্র ফেল করেছে এবং আমি স্কুলের সমস্ত শিক্ষককে স্তম্ভিত করে প্রথম হয়ে গেছি। ফুটবল পাওয়া যাবে না এই দুঃখে রিপোর্ট কার্ড হাতে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলাম।
এই ক্ষুদ্র ঘটনা বাবাকে খুব মুগ্ধ করল। বাসায় যে-ই আসে বলেন, আমার এই ছেলের কাণ্ড শুনুন। পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছে। কারণ হলো…।
এই ঘটনার আরেকটি সুফল হলো, বাবা মাকে ডেকে বলে দিলেন—কাজলকে পড়াশোনা নিয়ে কখনো কিছু বলার দরকার নেই। ও ইচ্ছা হলে পড়বে, ইচ্ছা না হলে না। তাকে নিজের মতো থাকতে দাও। আমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম। এই আনন্দের চেয়েও বড় আনন্দ, বিশেষ বিবেচনায় মাথামোটা শংকরকে প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হলো। তার মা সেই খুশিতে তাকে একটা এক নম্বরি ফুটবল এবং পাম্পার কিনে দিলেন।
গ্রিন বয়েজ ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হলো। আমি ক্লাবের প্রধান এবং শংকর আমার অ্যাসিসটেন্ট। আমাদের বাসার কাজের ছেলে রফিক আমাদের ফুলব্যাক। অসাধারণ খেলোয়াড়। (নির্বাচিত অংশ)
সূত্র: আমার ছেলেবেলা, হুমায়ূন আহমেদ। আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়ায়, কাকলী প্রকাশনী, ২০০২

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহুমায়ূন আহমেদ- র আরো পোষ্ট দেখুন