রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

image_1465_224284ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এবং তার এই চরিত্র গ্রহণের প্রধান কারণ সে ছিল সামন্তবাদবিরোধী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। লক্ষ্য ছিল ওই রাষ্ট্রকে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে দেশের অভ্যন্তরে একটি সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা; এ জন্য তার অধিপতিরা ধর্মকে খুব শক্ত করে অাঁকড়ে ধরেছিল। নিজেরা মোটেই ধার্মিক ছিল না, সাহেব-সুবোই ছিল একেকজন, কিন্তু জনগণকে সামন্তবাদের কারাগারে বন্দি রাখার অভিপ্রায়ে তারা বলেছিল, পাকিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেও তাদের যুক্তি ওই একটাই, উর্দু বাংলার তুলনায় অধিক ইসলামী; নইলে উর্দু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষাও ছিল না এবং বাংলার তুলনায় উন্নতও ছিল না। বাংলাকে তারা বলত পৌত্তলিক ভাষা। বাংলা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা নয়, তাদের মাতৃভাষা উর্দু_ এ সাংস্কৃতিক প্রচারণা পাকিস্তান হওয়ার আগেই শুরু করা হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর জানা হলো যে বাংলার যোগ্যতা নেই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার। একমাত্র হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, অন্যতমও নয়। আরবি হরফে বাংলা লেখার যে চেষ্টা হয়েছিল তা-ও বাংলাকে উর্দুর দ্বিতীয় স্তরে পরিণত করার ইচ্ছা থেকেই উদ্ভূত ছিল।
ভাষা আন্দোলন সরাসরি আঘাত করল সামন্ত সংস্কৃতিকে জোরদার করার ওই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের গোড়াতে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জায়গায় সে নিয়ে এলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে। সন্দেহ নেই যে, এ অত্যন্ত বড় ব্যাপার। এর তাৎপর্য প্রথমে স্পষ্ট হয়নি। ধীরে ধীরে, বর্ষে বর্ষে উজ্জ্বল হয়েছে। সামন্তবাদী সংস্কৃতির বিস্তৃত জটাজালকে ছিন্ন করে সে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল ব্যক্তির পক্ষে ব্যক্তি হিসেবে বিকশিত হওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার। তার ভাষার অধিকার।
কিন্তু কেবল সামন্তবাদবিরোধী নয়, ছিল সে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীও। এ যুগে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চরিত্র সেটাই; একই সঙ্গে তাকে সামন্তবাদবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হতে হয়, কোনোটিকে বাদ দিলে চলে না।
সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের উন্নত স্তর। পুঁজির স্বার্থে সে দেশ দখল করে এবং নিজের দেশে যেমন উপনিবেশে গিয়ে সেই তুলনায় অনেক বেশি নির্মমরূপে অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে না, জনগণকে পশ্চাৎপদ রাখার ইচ্ছায় সামন্তবাদকে উৎসাহ ও উস্কানি দেয়। পুঁজিবাদের শিরোমণি আমেরিকায় নিগ্রো অধিবাসীদের বিশেষ বিশেষ এলাকাগুলোয় যেমন দেখা যায় চারদিকে উগ্র দারিদ্র্য, কিন্তু তারই ভেতরে ধর্ম ও মাদক বিক্রয়কারীরা বেশ সচ্ছল, তেমন উপনিবেশেও অবাধে চলে ওই দুইয়ের সরবরাহ_ ধর্মের ও মাদকদ্রব্যের।
এ মাদক কেবল ড্রাগস নয়। পুঁজিবাদী আদর্শও বটে। সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ হাত ধরাধরি করে চলে। প্রভু ও ভৃত্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাম্রাজ্যবাদ চরিত্রগতভাবেই গণতন্ত্রবিরোধী। যে কারণে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো শুরু থেকেই ছিল তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। পুঁজিবাদের দুর্বৃত্ত হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল। সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু পুঁজিবাদী আক্রমণের পরিমাণ বা তীব্রতা কোনোটাই কমেনি। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। অস্ত্রবলে পারেনি, অর্থনৈতিক অবরোধও সফল হয়নি, শেষে পারল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও অন্তর্ঘাতের কারণে। আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছে আদিম ভোগের। সেই আদিমতার কাছে স্বাধীনতা ও মৈত্রী পরাজিত হয়েছে এবং অসাম্য চলে এসেছে।
সাম্রাজ্যবাদ এখন অনেক শক্তি রাখে, সে সামন্তবাদকেও পুষ্ট করছে দেশে দেশে। পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ অনেক জায়গায়ই সহাবস্থান করছে এখন, ড্রাগসের পাশে ধর্মের মতো।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বলছি কোন বিবেচনায়? বলছি এ কারণে যে, পাকিস্তান আদতেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রশাসিত একটি রাষ্ট্র। পূর্ববঙ্গকে সে একটি উপনিবেশ করে রাখতে চেয়েছিল। আবরণটা ছিল ধর্মীয়; তথা সামন্তবাদী; কিন্তু অভিসন্ধিটা ছিল পুঁজিবাদী, তথা সাম্রাজ্যবাদী। উর্দুর প্রতিষ্ঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠারই একটি স্তম্ভ ছিল বইকি, অন্য সব কিছুর আগে। যে সাম্রাজ্যবাদের অধীনে পাকিস্তান একটি তাঁবেদার শক্তি ছিল তার সমর্থন ছিল পেছনে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা মার্কিন সমর্থনের ওপর ভর করেই টিকে থাকত। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভাষা আন্দোলন যখন ক্রমাগত প্রবল হয়ে একাত্তরে এসে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিল তখন সাম্রাজ্যবাদের চেহারাটা আর লুকানো থাকেনি, ইয়াহিয়ার বীভৎস মুখাবয়বের মতোই খোলামেলা হয়ে পড়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল যে, পাকিস্তান আমেরিকার সাহায্য ও সমর্থন পাবে এবং বাইরে সামন্তবাদী কিন্তু ভেতরে পুঁজিবাদী মুসলিম দেশগুলোর মদদ লাভেও ব্যর্থ হবে না। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সামন্তবাদবিরোধী বাঙালি সেদিন নিহত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত পাকিস্তানি ও তাদের স্থানীয় দোসর সামন্তবাদের মুখপাত্র রাজাকার-আলবদরের হাতে। তাৎপর্যপূর্ণ এটাও যে, ‘স্বাধীন’ পাকিস্তানে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল শুরুতেই এবং ভাষা আন্দোলনসহ যে কোনো আন্দোলনকেই সেদিনকার শাসকরা বলত কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র মাত্র। ওই শাসকরা নির্বাচন দেয়নি এবং সমাজতন্ত্রীদের সুযোগ দেয়নি কাজ করার। একই ঘটনা আসলে_ এপিঠ, ওপিঠ।
এই যে সামন্তবাদবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন মানুষ করল এ নিশ্চয়ই পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ার আগ্রহে নয়। অথচ তাই পড়েছি আমরা। পাকিস্তানি শাসকদের হটিয়ে দেয়ার অর্থ দাঁড়িয়েছিল ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী পুরোহিতদের হটিয়ে দেয়া। এখন আমরা সরাসরি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অধীনে চলে গেছি, মাঝখানের পুরোহিতরা নেই, যারা নিজেরা ঈশ্বরের মতোই আচরণ করত। আমাদের এখনকার শাসকরা আমেরিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ পেয়ে গেছেন_ তা তারা সরকারেই থাকুন, কি সরকারের বাইরেই থাকুন।
আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আপসহীন ছিল। কিন্তু সে যখন অনুগ্রহভাজন হতে চায় আমেরিকার এবং ক্ষীণকণ্ঠে হলেও নির্বাচনের সময় সেই সামন্তবাদী আওয়াজগুলোই দেয় যেগুলো বিএনপি দিয়েছে, তখন বোঝা যায় তার চরিত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা নেই এবং তার সামন্তবাদবিরোধিতাও জোরদার নয়। সন্দেহ থাকে না যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জায়গাটি থেকে সে সরে এসেছে। আর বিএনপি তো সরেই আছে। তার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আওয়াজটা একেবারে নিরীহ নয়, এর ভেতরে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা দুর্বল করার একটা ইচ্ছা যে প্রচ্ছন্ন নেই তা বলা যাবে না। বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল জামায়াতের সমর্থন নিয়ে। তার তাৎপর্য অনস্বীকার্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে আবার সরাসরি বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধি বটে। তার অর্থমন্ত্রী কোনো আড়াল রাখেননি, ওই ব্যাংকের পরামর্শ (আসলে হুকুম) মতোই চলছেন। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের কথা না বলাই ভালো। তারা আরো নিম্নমানের তাঁবেদার।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এসব জাতীয়তাবাদী জাতীয় নয়। মুৎসুদ্দিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তার অবস্থান সেই যে আমাদের মূল আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামন্তবাদবিরোধী ভাষা আন্দোলন, যার স্রোতধারায় এগিয়েই মুক্তিযুদ্ধ, সেই আন্দোলনের পক্ষে নয়, বরং বিপক্ষে। এদের শাসন যত স্থায়ী হবে ততই আমাদের জন্য সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে এবং ওই নির্ভরশীলতার অন্তরালে বৈষম্য ও সামন্তবাদের ভূতপ্রেতের উৎপাত চাঙ্গা হয়ে রইবে।
মানতেই হবে যে, ভালো মনে হলেও গণতন্ত্রের বাজার এখন মোটেই ভালো নয়। সারা বিশ্ব নয়, বাংলাদেশে তো নয়ই। কিন্তু তবু আমাদের ভাষা আন্দোলন তো রয়েছে। সে অতীতের স্মৃতি নয়। বর্তমানের ঘটনাও বটে এবং ভবিষ্যতের জন্য পথপ্রদর্শক। বাংলা ভাষা কতটা প্রচলিত হচ্ছে তার নিরিখে বিচার করলেই বোঝা যাবে গণতন্ত্রের দিকে আমরা কতটা এগিয়েছি, কিংবা এগোইনি, শিক্ষা মোটেই সর্বজনীন হয়নি এবং শিক্ষিতরাও বাংলা ভাষা চর্চায় যে অত্যন্ত অধিক আগ্রহ দেখাচ্ছেন তা নয়। বীর এখন তিনিই যিনি ইংরেজি ভালো জানেন। না, উর্দুর পক্ষে এখন কেউ বলবে না; কিন্তু বাংলার পক্ষে আন্তরিকভাবে বলবেন এমন মানুষও কম। কেননা আন্তরিকভাবে বলার অর্থই হলো সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বলা, সেই কাজ সোজা নয়।
সাম্রাজ্যবাদীরা বলে গণতন্ত্রের শত্রু সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র নেই। এখানে শত্রুতাটা তাহলে করছে কে? তাঁবেদারদের জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, তারা অনেক কথা বলবে, কোনো কথা না বলে। আসলে শত্রুতা করছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অধীনে নির্ভরশীল পুঁজিবাদ, যার ভেতর উন্মেষ যুগের পুঁজিবাদের কোনো গুণ নেই বরং সামন্তবাদের সঙ্গে আপসপ্রবণতা রয়েছে। পুঁজিবাদ ও মৌলবাদ একই সঙ্গে তৎপর এখানে।
কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি আছে। তার লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং গড়ার পরেও এগিয়ে যাওয়া_ স্বাধীনতা, মৈত্রী ও সাম্যের লক্ষ্যে। সে আপস করে না, কেননা সে জানে কোনো আপসই নিজের শর্তে হয় না, হয় নিঃশর্তে। সে বাজারের নয়, সে জনগণের, অর্থাৎ প্রকৃত গণতন্ত্রের। তার পথই আমাদের জন্য মুক্তির পথ।