বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

মানবদেহ বা যে কোনো জৈব দেহের মতো মানব সমাজও এক অখণ্ড সত্তা। মানবদেহে মস্তিষ্ক এক কম্পিউটার। যতদিন দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ ও কার্যকর থাকে, ততদিন মস্তিষ্ক কাজ করে। এটা সত্য এ কারণে যে, দেহের কোনো অংশই অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সব অংশকে নিয়েই গঠিত দেহ এবং সব অংশের সজীবতা দেহের সজীবতার অপরিহার্য শর্ত। মানবদেহের ক্ষেত্রে যেমন, সমাজ বা সমাজদেহের জন্যও ঠিক তেমনি। কাজেই কোনো সমাজের চরিত্র এবং সমাজের স্বাস্থ্যের অবস্থা বোঝার জন্য তার সমগ্রতার দিকে তাকাতে হবে।

মানবদেহে কোনো রোগ দেখা দিলে যেমন তার প্রভাব সমগ্র দেহেই পড়ে, সমগ্র দেহই তার ফলে অসুস্থ হয়, তেমনি সমাজদেহের কোনো অংশ যদি ব্যাধিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়ে সমগ্র সমাজব্যবস্থায়। কোনো কর্মক্ষেত্র যদি সংকটের মধ্যে পড়ে, তাহলে তার প্রভাব অন্য ক্ষেত্রেও পড়ে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভের পর থেকে এখানকার সমাজের যে পরিবর্তন হয়েছে তার দিকে তাকালে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। আজকের বাংলাদেশী সমাজে মানুষের চরিত্র যে রকম দাঁড়িয়েছে সেটা ১৯৭১-পূর্ব পর্যায়ে দেখা যায়নি। তখনও এ অঞ্চলের মানুষের চরিত্র নির্দোষ ছিল না। চোর, ডাকাত, মিথ্যাবাদী, সুবিধাবাদী, ধাপ্পাবাজ তখনও সমাজে ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যার পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। মিথ্যা বলা এখন পরিণত হয়েছে প্রায় এক সার্বজনীন ব্যাপারে। মানুষ এখন কারণে তো বটেই অকারণেও মিথ্যা বলে। কারণ এটা পরিণত হয়েছে অভ্যাসে। মিথ্যা নিজে কোনো অপরাধ নয়, কোনো না কোনো ধরনের অপরাধ আড়াল করা, খারাপ কাজ করে সেটা সামাল দেয়ার জন্যই মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এ কারণে সমাজে মিথ্যার চর্চা ব্যাপক হওয়ার অর্থ হল সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটা। অপরাধের বিস্তার ঘটার অর্থ সমাজের সর্বস্তরে ও রন্ধ্রে রন্ধ্রে সব ধরনের অপরাধ ঘটতে থাকা। বাংলাদেশে এখন সেই অবস্থাই দেখা যাচ্ছে।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো সুগঠিত শাসকশ্রেণী বা শাসক দল ছিল না। ঘটনাচক্রে আওয়ামী লীগ শাসক দলে পরিণত হয়ে নিজেদের অনুসৃত নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে এখানে এক নতুন শাসকশ্রেণী গঠন করে। লুটপাট, চুরি, দুর্নীতি, ঘুষখোরী, প্রতারণা এবং তার প্রয়োজনে সন্ত্রাসের ওপর দাঁড়িয়েই এই শ্রেণীটি বিকশিত হয়। মানুষের অর্থনৈতিক জীবন যেভাবে গঠিত হয়, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই গঠিত হয় তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক জীবন। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বিগত ৪২ বছর ধরে অর্থনীতি ক্ষেত্রে লুটপাট, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তি ও সন্ত্রাস যেভাবে এদেশের সমাজ বিনির্মাণ করেছে তার প্রতিফলন শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধির চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঘটেছে। সুবিধাবাদ এদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের চিন্তাভাবনা ও তৎপরতার চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে সততার চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক মহাব্যতিক্রমী ব্যাপার। সততার যেখানে অভাব, সেখানে সত্যকে যে শিকেয় তোলা হবে এটা এক অবধারিত ব্যাপার। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, বাংলাদেশে সত্যই হল সব থেকে বড় শহীদ। লুটপাট, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তি, সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে যে শাসকশ্রেণী গঠিত হয়েছে, সত্য হত্যাকারী না হয়ে তাদের উপায় নেই। এ উদ্দেশ্যে তারা প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্কুলে ইতিহাস পাঠ উঠিয়ে দিয়ে অর্থাৎ পাঠ্যবিষয় হিসেবে ইতিহাসকে উচ্ছেদ করে নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারে রাখার ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে নিজেরা চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা অনুযায়ী কতগুলো মিথ্যাকে সাম্প্রতিক ইতিহাস নামে চালিয়ে দিয়ে ইতিহাসের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে। প্রকৃত ইতিহাসের পরিবর্তে তারা এই বিকৃত ইতিহাসকেই সরকারিভাবে প্রচার করছে এবং কেউ তার বিরোধিতা করে সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে তাদেরই ইতিহাস বিকৃতকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে! এমনকি তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও করছে!!
কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটা হতে পারে না। এটা সম্ভব একমাত্র ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায়। বাংলাদেশে এটা সম্ভব হওয়ার কারণ এখানে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এখন জনগণের ওপর চেপে বসেছে। এটা রাতারাতি হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকে এই ফ্যাসিবাদের যে বিকাশ শুরু হয়েছে তার পরিণত রূপই এখন এখানে দেখা যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের জীবনের কোনো ধরনের নিরাপত্তা আজ নেই। মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। একদিকে যেমন সভা-সমিতি-মিছিলের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, তেমনি চারদিকে পুলিশ-র‌্যাব-ডিবি দিয়ে চলছে গুম, ক্রসফায়ার ইত্যাদি হত্যাকাণ্ড। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে জেল হাজতে আটক ব্যক্তিদের ওপর তাদের নির্যাতনের বিষয়টিকে আইনের আওতার বাইরে রাখার! অর্থাৎ জেল হাজতে পুলিশ কর্তৃক আটক ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের অবাধ অধিকার!!! এটা যে এদেশে ঘটতে পারে তা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেটা না হলেও বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় এই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে এসবই ঘটছে।
সমাজ যেহেতু এক অখণ্ড সত্তা, কাজেই দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলও এ ব্যবস্থার বাইরে নেই। যে অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দেশের শাসকশ্রেণী ও নব্যমধ্যবিত্ত শ্রেণী দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার সঙ্গে সমাজের উপরোক্ত অংশ একই সূত্রে গাঁথা। এ কারণে বর্তমান যে শাসন ব্যবস্থা জনগণের বুকের ওপর চেপে আছে, তাকে সরানোর কোনো চিন্তা বা চেষ্টা মধ্যশ্রেণীভুক্ত সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নেই। তারা এ ব্যবস্থার হুকুমবরদার। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এরা শাসকশ্রেণী ও সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী। এদের ওপর এখন সরকারি কৃপা বর্ষণের শেষ নেই। শুধু সরকারই নয়, ধনিক গোষ্ঠীরও কৃপা এদের ওপর বর্ষিত হয়। বাংলাদেশে এখন সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের জন্য সম্মাননা ও পুরস্কারের ব্যাপক আয়োজন দেখা যায়। এত লোককে এসব দেয়া হয়, যা থেকে মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশে এখন প্রতিভা গিজগিজ করছে! কিন্তু আসল প্রতিভা বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য। সরকার সমর্থক নকল প্রতিভাদের যে মাথায় তুলে প্রচার কাজ চালানোর উদ্দেশ্য একদিকে এদের বর্তমান ব্যবস্থা অটুট রাখার কাজে নিয়োজিত রাখা এবং অন্যদিকে এদের ছোট মাপকে বড় মাপ হিসেবে জাহির করা। চন্দ্র-সূর্যের পরিবর্তে এখন এই জোনাকিদের রাজত্বই বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে। এই লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বুদ্ধি ও বিবেককে নিজেদের হীন ব্যক্তিস্বার্থে শাসকশ্রেণীর নিকৃষ্টতম অংশ ও সরকারের কাছে বন্ধক রেখে এখন হৃষ্টপুষ্ট শরীর নিয়ে ফুর্তির জীবনযাপন করছে। দেশের ও জনগণের স্বার্থের দিকে তাকানোর মতো বৌদ্ধিক ও নৈতিক ক্ষমতা এদের নেই।
১৪.০৩.২০১৫

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
বদরুদ্দীন উমর- র আরো পোষ্ট দেখুন