শরতের স্মৃতিমালা

শরতের স্মৃতিমালা

শরতের স্মৃতিমালা
শরতের স্মৃতিমালা
বাংলা ষড়ঋতুতে ভাদ্র আর আশ্বিন মাসের সংমিশ্রণ শরৎকাল। আমাদের ছেলেবেলায়, কৈশোরে, এমনকি প্রথম যৌবনে শরৎকালের একটা আলাদা রূপমূর্তি ছিল। ঋতুচক্রে সেই রূপমূর্তির দেখাও মিলত। সেটা কী? সেটা হচ্ছে আকাশে ছাড়া ছাড়া সাদা মেঘ, নদীর ধারে বাতাসে দুলতে থাকা সাদা কাশফুল। আমরা দেখেছি গ্রীষ্মের তীব্র উষ্ণতা আর দহনের পর শরতের বাতাস অনেক কোমল হয়ে আসত। শরৎ ঋতুর এই রূপ অনেকের কাছে প্রিয় ছিল। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শরৎ ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। কারণ শরৎকালে তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। মাঝে মধ্যে আমাদের রোজার ঈদ এই মাসে অনুষ্ঠিত হয়। সব মিলিয়ে বলতে হয়, এককালে আমাদের দেশে শরৎকাল সত্যি সত্যিই উপভোগ করার মতো, অনুভব করার মতো সময় ছিল।
আমার দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি গ্রামে অতিবাহিত করেছি। এরপর লেখাপড়ার সময়টা শহরেই কাটিয়েছি। এরপর মাঝে মধ্যে ছুটিতে গ্রামে যেতাম। আমাদের ছেলেবেলায় শরৎকালে একটা ছুটি ছিল। আমরা সে সময় গ্রামে যেতাম ট্রেনে করে। তখন ট্রেনে খুব একটা যাত্রী ভ্রমণ করত না। স্টেশনে নেমে গ্রামের বাড়িতে যেতে হলে আমাদের মাঠ, ঘাট, প্রান্তর, নদী-নালা ডিঙিয়ে প্রায় তেরো থেকে পনেরো মাইল পথ অতিক্রম করতে হতো এবং সেটা অতিক্রমের জন্য লেগে যেত প্রায় আট থেকে দশ ঘণ্টা। কারণ রাস্তা বলতে তখন কিছুই ছিল না। আমরা যেতাম কারও উঠানের পাশ দিয়ে, কোনো বাঁশবনের মাঝ দিয়ে, নদীর পাড় দিয়ে, কারও বাড়ি ডিঙিয়ে অথবা কোথাও কোনাকুনি একটা মাঠ পেরোতে হচ্ছে। এভাবে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা পেঁৗছতাম বাড়িতে। এতদূর পথ পায়ে হেঁটে যাওয়ার মধ্যেও কোনো ক্লান্তি আসত না। কারণ প্রকৃতির মাঝে এক অনন্য মাধুর্য বিরাজ করত। সে সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। গ্রামে ঢুকলেই ঢাকের আওয়াজ পাওয়া যেত। তারা দুর্গাপূজার আয়োজন করছে। চারদিকে কেমন একটা সাজ সাজ রব। আমার মনে আছে, তখন আমি স্কুলে পড়ি। বয়স আর কতই বা হবে, তের কী চৌদ্দ। এই বয়সটা হচ্ছে অভিযানে যাওয়ার বয়স। ভয়কে দূরে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বয়স। সেবার আমি একাই রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির উদ্দেশে। তখন তো আর ছেলে ধরার ভয় ছিল না। একা একা স্টেশনে নেমে প্রথমে ভাবলাম, নৌকা নিয়ে চলে যাই। কিন্তু শেষে ভাবলাম না, হেঁটেই চলে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি হেঁটে রওনা দিলাম। সেই হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি আমাকে আজও স্মৃতিকাতর করে তোলে। গাছপালার ভেতর দিয়ে, নদীর পাড় ঘেঁষে, কারও বাড়ির ভেতর দিয়ে, ঢাকের আওয়াজ শুনতে শুনতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এসব চিত্র আজও আমার মনে পড়ে। বাড়িতে গিয়ে যখন পেঁৗছলাম, তখন আমার মা জীবিত, সবাই হৈ হৈ করে আনন্দে বেরিয়ে এলো। আমার বাড়িতে আসাকে সবাই আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করল। হাজার বিস্মৃতির মাঝেও আমি ভুলতে পারিনি এই স্মৃতি।
এমন আরও কিছু স্মৃতি আছে আমার শরৎকে কেন্দ্র করে।
বর্ষার পরপরই পুকুর, খাল-বিল পানিতে ভরে থাকত। এই সময়ে আবার প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। একবার কলেজে পড়ার সময়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলাম। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরার মজাই ছিল আলাদা। ময়মনসিংহ শহর থেকে আমরা মাইল বিশেক ভেতরে কোনো বন্ধু কিংবা পরিচিতের বাড়িতে যেতাম। মাছ পাওয়া বা না পাওয়া বড় কথা নয়, সেটা তো ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে যে মজা হতো, যেই বাড়িতে যেতাম, সেখানে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়া এসব আনন্দের কথা তো ভোলা যায় না। আর এসব হতো বেশিরভাগ সময়ে শরৎকালেই। কারণ তখন খুব একটা গরম থাকে না।
বর্ষার পরপরই শরৎ আসে বলে এই সময়ে বিয়ের একটা ধুম পড়ে যেত। এখনও এই রেওয়াজটা চালু আছে। আফসোসের কথা হচ্ছে, শরৎকাল বদলে যাচ্ছে। কারণ সময়ের পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব জলবায়ুতে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই পরিবর্তনটা কী হয়েছে? সহজ করে যদি বলি এখনকার আবহাওয়া অনেকটা খেয়ালি হয়ে গেছে। কখন কোন ঋতু প্রবহমাণ সেটা বোঝার উপায় প্রায় নেই বললেই চলে। এখন বসন্ত কখন আসে, সেটা টের পাওয়া যায় কম। শরৎও কখন আসে, বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে যায়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আমাদের এখানে প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে তো বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। এমনকি সমুদ্রও নিয়মিত চঞ্চল থাকছে। যার ফলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতির এমন খামখেয়ালিতে শরৎকালের যে শোভা, যে রূপমূর্তি এককালে আমরা চিনতাম, জানতাম_ সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে পেলেও সেটা অনেক ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ছাড়া ছাড়াভাবে কোথাও কাশফুল ফুটে থাকতে দেখা যায়। কয়েকদিনের জন্য আকাশে সাদা মেঘের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু শরতের যে নমনীয় স্বভাব এবং শোভা ছিল সেটা আমরা আর পাই না। আমরা যারা শরতের এই শোভা দেখে এসেছি, তারা খুবই শূন্যতায় ভুগি। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে ষড়ঋতুর দেশ। দু’মাস করে একেকটি ঋতু। আর এখন বাংলাদেশ কার্যত গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু প্রধান হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের বাইরে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়াসহ বেশকিছু দেশে গ্রীষ্ম এবং বর্ষা হলো প্রধান ঋতু। যদিও বর্ষা এ দেশগুলোতে তেমন একটা স্থায়ী নয়। আর গ্রীষ্মকালে এসব দেশে তীব্র গরম অনুভূত হয়। যাকে বলে ভ্যাপসা গরম। আমাদের এখানকার ঋতুচক্রের বদল দেখে আমার ভয় হচ্ছে, বাংলাদেশও হয়তো এসব দেশের আওতায় চলে আসে কি-না?
বিজ্ঞানীদের একটা ধারণা হচ্ছে আগামী ত্রিশ থেকে চলি্লশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বাসযোগ্য দেশ হবে হাতেগোনা কয়েকটি। আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, সাইবেরিয়া, আমেরিকার উত্তরাংশসহ পৃথিবীর অনেক দেশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশসহ আমাদের পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোতে উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এত বেশি পরিমাণে গরম পড়বে যে এসব দেশের মানুষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ গরম কম অনুভূত হওয়ার নানা পন্থা ব্যবহার করেও টিকতে পারবে কি-না সন্দেহ। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনগুলো কিন্তু খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে বিপদের আশঙ্কাও তত বাড়ছে। আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা ভীতিকর এবং বিপর্যস্ত একটি পরিবেশ রেখে যাচ্ছি বলে আমার মনে হচ্ছে। ওজোন স্তরে ফাটল দেখা দিয়েছে। হিমালয় ও এন্টার্কটিকায় যে বরফ আছে, অতি উষ্ণতায় সেসব গলতে শুরু করেছে। এ জন্য পানির স্তর বেড়ে গিয়ে অনেক ভূখণ্ড তলিয়ে যাওয়ার অবস্থা দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর উষ্ণতা রোধে এবং জলবায়ু সংক্রান্ত কিয়োটো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো সর্বোচ্চ দূষণপ্রবণ দেশ একটা পর্যায়ে দূষণ রোধে চুক্তির আওতায় চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। জর্জ বুশের শাসনামলে এমনটা হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি আরও কয়েকটি দেশও চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ভারত ও চীন অন্যতম। শিল্পোন্নত এই দেশগুলোর যারা বেশি মাত্রায় দূষণ করে তাদের অসহযোগিতার ফলে দূষণ রোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, সেসব কিছুই নেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে নিকট ভবিষ্যতের সমূহ বিপদের কথা চিন্তা করে অনেক দেশই সচেতন হচ্ছে। নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সবার মধ্যে। এমনও শোনা যাচ্ছে, ওজোন স্তরের যে ফাটল সেটা জোড়া দেওয়া না গেলেও এই ফাটল আর যেন বৃদ্ধি না পায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইউরোপের শীতপ্রধান অনেক দেশই ইদানীং তাদের দেশের সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত বরফাঞ্চল ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করছে, যাতে অধিক উষ্ণতায় বরফ গলে না যায়। এ ছাড়া মহাশূন্যে কার্বন শুষে নেওয়ার মতো প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে। এই ব্যবস্থাগুলোর যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়, তবে যে ভয়াবহ ভবিষ্যতের চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা হয়তো পুরোপুরি ঘটবে না।
এত সব কথার পর বলতে হয়, শরৎ আমাদের দেশে বসন্তের পর রূপমাধুর্যে এক অনন্য ঋতু। কিন্তু ঋতু চক্রের বদলে শরৎ অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দিকে যদিও এখনও শরতের দেখা মেলে কস্ফচিৎ, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। আমার বিশ্বাস আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন হবে। আমরা আবার ফিরে পাবো আমাদের ঋতুগুলোকে। শরৎ আবার তার রূপমাধুর্য নিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রাহাত খান- র আরো পোষ্ট দেখুন