তাঁকে প্রণতি

6d099bddc5d0a4f05b205e2885873937-9কবি আবুল হোসেন চলে গেলেন—আমাদের কবিতা সংসারে এক বটবৃক্ষের পতন ঘটে গেল। নজরুল পরের বাঙালি মুসলমানদের প্রায় নিঃসঙ্গ কবিতা-ভূমিতে এই বৃক্ষটি একদা তার শিকড় বিস্তার করে বৃদ্ধিলাভ করছিল, আর সেই সঙ্গে আরও দুটি বিশাল বৃক্ষ—ফররুখ আহমদ আর আহসান হাবীব—হয়ে উঠছিল পঞ্চাশের আমাদের কবিতা-বীজ রোপণের দশকাধিক আগে থেকে। ফররুখ ও হাবীব অনেক আগেই গত, এই সেদিন পর্যন্ত আবুল হোসেন ছিলেন, এই সেদিনও আমি আমার পঞ্চাশের দশকের সাহিত্যিক স্মৃতি তিন পয়সার জ্যোছনা লিখনকালেও তিনি এখনো আছেন আমার শিরোদেশে তাঁর হস্তাবলেপ নিয়ে—এ কথা বড় ভাগ্যের বোধে বলে উঠেছিলাম। কিন্তু তখনি তো জানতাম, তিনি প্রায় স্মৃতিবিরহিত, এখন শুধু কালের কুঠারের হাতে তাঁর শরীর ছেদিত হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। বহুদিন ভেবেছি ধানমন্ডিতে তাঁর মাঠপ্রান্তের বাড়িটিতে একবার গিয়ে শেষ প্রণতি জানিয়ে আসব, হয়ে আর ওঠেনি, হয়ে উঠল না। এখন আমি রিক্ত হয়ে বসে আছি লেখার টেবিলে, অশ্রুর ভারে নত এবং বিষাদিত।
বিষাদিত? হ্যাঁ, তাই—যদিও জানি মরণশীল আমরা সবাই এবং আমাদের অগ্রজ এই কবিও হবেন গত; তবু, তবুও কবিতার অতিরেকে তাঁর স্নেহ এবং আমাদের পঞ্চাশের—বিশেষ করে শামসুর রাহমান ও আমার—হয়ে উঠতে থাকার কালে তাঁর উপদেশ, পরামর্শ আর প্রবর্তনা পেয়ে যে কলম-সক্ষম হয়ে উঠছিলাম আমরা, সেই তাঁর আজিমপুর কলোনির ফ্ল্যাটে প্রতি সপ্তাহে আমাদের যাওয়া, সেই তাঁর সমুখে আমাদের সদ্য লেখা কবিতা পড়ে ওঠা, আর সেই সহযোগে অনুপম জলখাবার—তখন পর্যন্ত অবিবাহিত তিনি—তাঁর হাতে গ্রহণ করা, তাঁর লাল ছোট্ট ফ্রিজের সেই শীতল পানি—আমাদের প্রথম ফ্রিজ–পানি পান করে ওঠা, যুঁইগন্ধি সোনালি চা কাপের পর কাপ পান, আমাদের মতো হা-ঘরে যুবক ও যশঃপ্রার্থী তরুণদের জন্য সে ছিল স্বর্গীয় সন্ধ্যা। কেবল কি তাই?—ততোধিক আমাদের কবিতা সম্পর্কে তাঁর আলোচনা, আধুনিকতা ও সমসাময়িকতার তাঁর সেই পাঠদান, মাঝেমধ্যেই নির্মম কণ্ঠে তাঁর বলা যে, ওখানে তুমি অতিকথনের দোষ ঘটিয়েছ, এখানে তুমি চিত্রকল্প উদ্ভাবনে একটি কবিতায় একাধিক ক্ষেত্র থেকে ছবি তুলে এনে বাহুল্যমুক্ত রাখতে পারোনি রচনাকে, আর এই যে তাঁর অবিরাম শাসন যে কাব্যভাষা—এটি যতটা মুখের কাছাকাছি হয় ততই তুমি সিদ্ধির পথে উঠে আসবে; ভুলতে পারি না।
আবুল হোসেন বিশ্বাস করতেন, কবিতা হচ্ছে অনুপ্রাণিত সংলাপ; তাঁর একটি কবিতার বইয়ের নামই যে বিরস সংলাপ, এটি আকস্মিক নয়, এবং ওই ‘বিরস’ বিশেষণটিও তাঁর সব রচনারই শাঁসে মূলেরই বটে। শেরে বাংলা ফজলুল হককে নিয়ে তাঁর অসামান্য কবিতাটির একটি পঙ্ক্তি—আজকাল দিন এমন পড়েছে যে—‘সিংহের মেকাপে যত শেয়ালেরা আসর জমায়’—কেবল বিরসই নয়, আমাদের চারদিকের বাস্তবতার প্রতি এখনো একটি চাবুক! প্রথম পাঠে আবুল হোসেনের সব কবিতাই মনে হতে পারে সাধারণ মুখচলতি গদ্যেই বুঝি বা এসব, কিন্তু নিবিড়পাঠে ধরা পড়ে যে ওই গদ্যভাষ আর ওই সংলাপভাষণের ভেতরেই আমরা শুনে উঠছি এক মৌলিক কবিতা-কণ্ঠ। এতটাই মৌলিক তাঁর এই কাব্যভাষা যে তিনি ফররুখ ও হাবীবের সময়ে—যাঁরা তখনো তিরিশের কবি—প্রচল ভাষায় লিখছিলেন, কিন্তু অচিরে পেয়ে যাচ্ছিলেন নিজকণ্ঠ, ফররুখ প্রায় অবিলম্বেই আর হাবীব কিছুটা পরে—তাঁদের থেকে কতটাই না স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম তিনি আবুল হোসেন।
নানা সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে, দেশে ও বিদেশে, আবুল হোসেন জীবিকার জন্য ব্যাপৃত ছিলেন কিন্তু কবিতা—কবিতাই ছিল তাঁর প্রতি মুহূর্তের ধ্যানজ্ঞানে, এমনকি নব্বই বয়সেও তাঁর কবিতার কলম থেমে থাকেনি। কিন্তু তিনি ছিলেন বিরলপ্রজ কবি; বলতেনও তিনি—অনেকটা সময় নিয়ে লিখি, মাথার ভেতরে কবিতার মৌমাছি নিয়ে আছি, চাকে সঞ্চিত হচ্ছে তার আনা মধুরস, চাকটি ভরে উঠতে সময় তো লাগে!—যখন ভরে উঠবে তখনই তো তার আহরণ! আবার এটাও দেখেছি, সেই আহরণ পর্বের পরেও একটি কবিতা নিয়ে তাঁর অসন্তোষ যায় না! তিনি বারবার কাটছেন, নতুন করে লিখছেন, এমনকি বহু বছর পরেও পুরোনো ও প্রকাশিত একটি কবিতাও তিনি পরিমার্জনা করছেন, হয়তো একটি শব্দই মাত্র বদলালেন, আর তাতেই কবিতাটি হয়ে উঠল অমোঘ অমোচ্য।
বাংলা কবিতাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন, শুধু বাংলা ভাষার কবিতাই নয়, তাঁর সমসময়ের বা অনধিক পরের অনেক বাঙালি কবিরও স্বতন্ত্রযাত্রায় তিনি মানচিত্র জুগিয়েছেন; বাঙালি মুসলমান কবিযশঃপ্রার্থীদের পক্ষে যখন স্বাভাবিক ছিল নজরুল অথবা জসীমউদ্দীনের পথে অগ্রসর হওয়া—এই অর্থে যে প্রায় সব তরুণই কোনো না কোনো সিদ্ধ কবিকণ্ঠের অনুকরণে বা অনুসরণে প্রথম পা ফেলেন—তখন তিরিশের পাঁচ কবির অতিরেকে, তাঁরা সকলেই সাতচল্লিশের পর রাষ্ট্র সীমান্তের ওপারে, তখন কেবল তিনজনকেই এ জমিতে প্রত্যক্ষে প্রতিদিনে পাওয়া যাচ্ছিল—ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব ও আবুল হোসেন। এঁদের ভেতরে প্রধানত আবুল হোসেনের কাছেই তখনকার তরুণ আমরা পেতাম আশ্রয় ও প্রশ্রয় এবং আমাদের মনে হতো, তিনিই হচ্ছেন সেই কষ্টিপাথর, যাতে আমাদের সৃজনের সোনাটি ঘষে দেখে নেওয়া যায়।
এবং এই কষ্টিপাথরটিকে আমাদের মধ্যে প্রথম যিনি শনাক্ত করেন, তিনি আমার মহান কবিবন্ধু শামসুর রাহমান এবং রাহমানেরই কারণে আমরা আবিষ্কার করে উঠি আবুল হোসেনকে। আমার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শামসুর রাহমানের অসামান্য কলমকে ও-দেশে যেমন বুদ্ধদেব বসু তেমনি এ দেশে আবুল হোসেনই প্রথম শনাক্ত করে ওঠেন। এবং আমার মনে পড়ে, পাকিস্তানের সেই অঘোরকালে ঢাকা বেতারে—তখন আবুল হোসেন বেতারে কর্মরত—তখন যে সাহিত্যসভাগুলো সম্প্রচারিত হতো—কবি গোলাম মোস্তফাদের প্রাধান্য যেখানে অনিবার্যভাবে থাকত, সেখানে আবুল হোসেনই তরুণ শামসুর রাহমানকে প্রতিবারই কবিতা পড়তে ডাকতেন এবং কয়েকবার আমিও সে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকি। অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরপরই আবুল হোসেন আমাদের নিয়ে আলাদা বসতেন, তাঁর ফ্ল্যাটে ওই অত রাতেও নিয়ে যেতেন এবং আমাদের পঠিত কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন।
ওই সময়ের পরপরই তিনি সংলাপ নামে উচ্চমানের একটি সাহিত্য ত্রৈমাসিক সম্পাদনা ও প্রকাশ করতে থাকেন; তাঁর সেই পত্রিকাও আমাদের জন্য ধাত্রীর কাজ করতে থাকে; আমার রক্তগোলাপ নামে বড় গল্পটি ওই পত্রিকাতেই প্রকাশ পায়; তিনি আমাকে সাহিত্যের পথে আরও খানিকটা পায়ের বল জুগিয়ে বলেছিলেন, গল্প লিখছ ভালো কথা, কবিতাই কিন্তু তোমার আরাধ্য দেবী, এটি ভুলে যেয়ো না, আর ভুলো না যে গল্পের ভাষা আর কবিতার ভাষা আলাদা নয়, বস্তুত গল্প যদি এক ধরনের কবিতাই না হলো তো কিচ্ছু হলো না। মনে পড়ছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র একটিই যে ছোটগল্প ইংরেজিতে সরাসরি লেখা—‘দ্য কার্গো’—ওয়ালীউল্লাহ্ প্যারিস থেকে পাঠিয়েছিলেন সংলাপ-এ ছাপানোর জন্য, আবুল হোসেন আমাকে দিলেন বাংলা অনুবাদ করতে, করেছিলাম, বলেছিলেন আবুল হোসেন এবং চিঠিতে প্যারিস থেকে ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেও যে—ওই গল্পে কবিতার যে আবহ ছিল তা চমৎকার রক্ষিত হয়েছে অনুবাদে, এতটাই যে ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর গল্প সংকলনে আমার অনুবাদটাই মৌলিকরূপে জায়গা দিয়ে যান। আবুলভাই বলেন, গল্প আর কবিতার দূরত্বমোচন যে করেছ, এই কলমটা কখনোই হারাবে না। আজও গল্প বা উপন্যাসের জন্য যখন আমি কলম হাতে নিই, আবুলভাইয়ের কথা নিরন্তর ভেতরে থাকে বৈকি।
তাঁর বিদায়ের এই বিষাদিত মুহূর্তে আবুল হোসেনকে আবুল ভাই বলে সম্বোধন করেছি। আমাদের প্রজন্মে অগ্রজ কাউকে এখনকার মতো চট করে ভাই বলাটা রেওয়াজ ছিল না; শামসুর রাহমান তো এক আবুলভাইকে ছাড়া কাউকে ভাই বলেছেন বলে আমার মনে পড়ে না, শামসুর রাহমানের একমাত্র ওই আবুল হোসেনকেই আবুল ভাই বলা থেকে বোঝা যাবে তাঁর কাছে ও আমাদের বা আমারই কাছে কতটা তিনি কাছের ছিলেন, আমরা তাঁকেই যে আমাদের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ ওঠাবসার ও দেখাশোনার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রকৃতই এক অগ্রজ মনে করতাম—বহু বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতের অমিল ও তর্ক সত্ত্বেও—এতেই সেটি বোঝা যাবে।
আবুল হোসেন চলে গেলেন, শামসুর রাহমানও আর নেই, উৎসাদিত বটবৃক্ষটির পাশে আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি। মনে পড়ে শামসুর রাহমান চলে যাবার পরপরই যখন আমি আবুলভাইয়ের কাছে যাই, তিনি বলেছিলেন, কে বলে ও চলে গেছে? ঈষৎ স্মৃতিভ্রংশ তিনি এমনও বলে ওঠেন, ওর তো আমাকে ফোন করবার কথা, আমি টেলিফোনের পাশে বসে আছি! হ্যাঁ, মানুষমাত্রেই তো মরণশীল। কিন্তু মানুষ চলে যায়, তাঁর কাজ থেকে যায়। আমরা আবুল হোসেনের কবিতার রাশির সমুখে এখন। এই তো তাঁর কবিতাবলি—এই তিনি আছেন; আমাদের মহান অগ্রজ তিনি, আমাদের কাব্যরুচির অন্যতম নির্মাতা, বাংলা কবিতার সমুদ্রে বড় একটি তরঙ্গ তিনি, এখনো আছড়ে পড়ছেন আমাদের কবিকল্পনাতীরে, অঙ্কিত করে যাচ্ছেন তাঁর রেখাবলি আমাদের তটে; যদি বটবৃক্ষ বলে জানি তাঁকে, শরীর ছেদিত হবার পরেও মহাকালের সাধ্য কি তাঁর কবিতাকে ছেদন করে!