কেরানিও দৌড়ে ছিল



মঙ্গলবার! দেশের বাড়িতে পেঁৗছুতে হবে মঙ্গলবারেই, বাবার চিঠিতে আদেশ। লঙ্ঘন করার উপায় নাই, সাধ্যও নাই কেরানির, বাবার কথা উপেক্ষা করার ইতিহাস তার নাই। আমি এখন অচল আতুর হয়ে পড়েছি, সংসারের ভার এখন তোমার যুবক ছেলের প্রতি কোনো বাবা যদি এমন ঘোষণা দেয়, একালের ছেলে ক’জন তা মাথা পেতে নেয়? বরং অবিলম্বে একটা ছুতো ধরে ভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কেরানি যে সে রকম ছেলে নয়, কতবার তা বলতে হবে। হস্তিবাড়িতে তার কত প্রশংসা। বাবার সংসার প্রতিপালন করছে মুখ বুজে। মাসে মাসে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছে। সপ্তাহান্তে চিঠি লিখে খোঁজ নিচ্ছে। বাবাকে এও বলেছে, একটু সুদিন আসুক, ঢাকায় এনে তোমার শূলব্যথার চিকিৎসা করাব। সোনার ছেলে এমন ক’জনার ঘরে!
মঙ্গলবার! আজ শনিবার। মাঝখানে রবি আর সোম। ঢাকা থেকে হস্তিবাড়ি যাওয়া। সে কি সোজা ঝামেলা! প্রথমে বাস ধরো রংপুরের। এসি বাসে ছয়-সাত ঘণ্টার রাস্তা, আরামেও যাত্রা, কিন্তু ভাড়া বেশি। সস্তার বাস পথে পথে থেমে চলে, নয়-দশ ঘণ্টার আগে পৌঁছানো নাই । যাত্রাও বড় কষ্টের। বসার আসন পাষাণ! তবু তো কম ভাড়ায় যাওয়া যায়। কতই বা কম, পঞ্চাশ টাকার তফাত। সেই পঞ্চাশ টাকায় বাড়ির জন্য কত কী নেওয়া যায়! আচ্ছা, সস্তার বাসেই রংপুর, সেখান থেকে মুড়ির টিনের মতো বাসে ওঠো, তবে জলেশ্বরী। তারপর আধকোশা নদীর পাড়ে যাও। ঘাটের নৌকায় ওপারে নামো। তারপর ভ্যান পেলে ভ্যানে, নয়তো পায়ে হেঁটেই হস্তিবাড়ি। পুরো একদিনের ধাক্কা। সকালের বাস পেলে সন্ধ্যে নাগাদ কি রাতের বেলা বাড়িতে।
কিন্তু মঙ্গলবারে যে যাওয়ার আদেশ, সেটা কি ওইবারের সকালে না সন্ধ্যেকালে? কেরানি বুঝে উঠতে পারে না। অতএব সে ঠিক করে সোমবারের রাতের বাসেই যাবে, তবে যদি সে মঙ্গলবারের বেলা দুপুরের মধ্যে হাজির হওয়া যায়। আর এই মাঝের দু’দিনে বিয়ের যে ফর্দ পাঠিয়েছে বুবু তারও বাজার করতে হবে। কিন্তু হ্যাপা আছে আরও। ছুটি নিতে হবে। অন্তত সাত দিনের ছুটি। বরিশাল থেকে ফিরতি লঞ্চ নিয়ে যদি সোমবারের ভোরে ঢাকা পৌঁছায়, তবে ছুটির শুরু সেইদিন থেকেই হওয়া চাই। বিয়েটা শুক্রবারে, শনি, রবি যাবে পরের ধাক্কায়। ফিরে আসা যদি রবিবারের রাতের বাস ধরেও হয়, সোমবারে ঢাকা আর সোমবারের বিকেলের লঞ্চেই তাকে ডিউটি শুরু করতে হবে। আর সোমবারের বাস ধরলে মঙ্গলবার। সাত-আট দিনের ছুটি হয়ে দাঁড়ায়।
কেরানির ভয় হয়, এত লম্বা ছুটি বোধহয় সে পাবে না। লঞ্চের মেজো কেরানির বড়ভাই দুবাই যাচ্ছে দিন পনেরোর মাথায়, ছুটির দরখাস্ত সে দিয়ে রেখেছে, পাসও হয়েছে। আমাদের কেরানিও যদি এই গতিকে ছুটি নেয়, তবে তো লঞ্চ অচল! এক বড় কেরানিকে দিয়ে তো আর তিন-চারশ’ যাত্রী সামাল দেওয়া যাবে না। লঞ্চের সুকানির কাছে কথাটা সে কেবল আবছা করে পেড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীর দুর্বোধ্য দ্রুত উচ্চারণে সে জানিয়েছিল, ইয়ান না মনোতে আনো! তর চাগরি যাইত্ ফারে!
এর পরে আর কথা কী! ছুটি সে পাবে না। কিন্তু তাই বলে তো বিয়ের তারিখে হাজির না হয়ে সে পারবে না। চাকরি যদি ছেড়ে দিতেই হয়, নতুন চাকরি পাওয়ার আশাও আর একালে কোথায়? সদ্য বিয়ে করা বৌ আর মাথার ওপরে বাবার অসুখ, বাবার সংসার নিয়ে তো তাকে গলায় দড়ি দিতে হবে তখন।
তাহলে! বিয়ের কথা বলে যে ছুটি চাইবে, মালিকের ম্যানেজার যদি বলে এইডা কুন্ আহ্লাদের কথা, তরে না জিগায়া বিয়ার তারিখ ফ্যালছে! আর তুইও আঁখ মে ছুরমা লাগাকে ছুটির দরখাস্ত লিয়া হাজির! সুমুন্দির পো, তারিখ পিছায়া দে! তখন কি করবে কেরানি?
শনিবার সারারাত লঞ্চের ধিকিধিকি গুমগুম ঘটাঙ ঘঙ চলনের ভেতরে নদীর পর নদীতে কালো ছলচ্ছল পানির ওপরে লঞ্চের বাতির ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে, যাত্রীদের নিদ্রাঘোর সারির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেরানি ভাবে, পৃথিবীতে সে একমাত্র জেগে আছে তার সমস্যা নিয়ে। একমাত্র তারই চোখে ঘুম নাই। সে-ই শুধু পানির বুকে যাত্রী। আর যাবে যে কোথায়, তারও কোনো নির্ণয় নাই। পানির বুকে আলোর ওই ঝিকিমিকি তারও কোনো রহম নাই, তার বিপদ দেখে যেন খিলখিল করে হাসছে।
পাটাতনের এক পাশে এক যাত্রীকে দেখা যায়, এক ফকিরের সমুখে উবু হয়ে বসে আছে হাত পেতে। এ ফকির ভিক্ষার ফকির নয়, সাধু ফকির। বেশ কয়েকবারই এ লঞ্চে তাকে আগেও দেখেছে কেরানি। পরনে শত টুকরা সেলাই করা জোব্বা। মাথার চুল নারীদের মতো দীর্ঘ, খোঁপা করা। দুই হাতে গোছা গোছা বালা চুড়ি। এত নিশুতি রাতে তার সমুখে একজন হাত পেতে বসে আছে, সারা লঞ্চে একমাত্র এই দু’জনই জেগে, দেখে কৌতূহল হয় কেরানির। পায়ে পায়ে সে কাছে যায়।
বাবা, দ্যাখেন আমার হাতে পিতৃবিয়োগ আছে কি নাই।
আরে ব্যাটা, পিতা থাকলে পিতৃবিয়োগও আছে, যদি তার আগে আপনে নিজেই না নাই হয়া যান!
বাবা, বড় বিপদে পড়িয়া প্রশ্নটা করি। বাপজানের কঠিন সংবাদ পাই আইজে, অফিসে সায়েবের ধারে ছুটিয়া গেলাম। ছুটিও দিলে, অ্যাডভান্সও কিছু দিলে। সায়েবের দিলে রহম আছে, আল্লার রহম আছে কি-না সওয়ালটা এই। বাপজান কি টেকবে? জীবিত পাবো কি-না, হাতে কী দ্যাখেন?
আর শোনার দরকার নাই কেরানির। বুদ্ধি সে পেয়ে গেছে। বাবার অসুখ। এখন যায় কি তখন যায়। ম্যানেজারের পায়ে গিয়ে পড়লে কি আর ছুটি না দিয়ে পারবেন তিনি? আর বাবার অসুখের বৃত্তান্ত যখন, তখন ছুটিটাও খোলামেলা হতে বাধা নাই! সাতদিন কেন দশদিন পরে এসেও বলা যাবে, বাবাকে সম্পূর্ণ নিরাময় না দেখে আসি কী করে!
মনটা হালকা হয়ে যায় কেরানির। পরমুহূর্তেই চমকে ওঠে, তবে সে কেবল লঞ্চের হঠাৎ ভোঁ শুনে। না, ছোটখাটো মিথ্যে বলায় দোষ-পাপের কিছু নাই। তবে কেরানির এ কেবল মিথ্যে বলার শুরু। সে বিষয়ে অচিরেই আমরা খবর পাবো। কিন্তু ততদিনে চমকে ওঠা আর তার নাই। তা ছাড়া আমরা তো আগেই জেনেছি দুশ্চিন্তা করা আমাদের এ কেরানির ধাতে নাই।
হাঁ, বাবার অসুখের কথা বলেই ছুটিটা পাওয়া যায়।
সন্দেহের চোখে ম্যানেজার একবার তাকিয়েছিল আর প্রশ্ন করেছিল, টেলিগেরাম পাইছোনি?
সেসব পুরাকালের কথা। টেলিগ্রামে বাবার অসুখের খবর! এখন মোবাইল আছে না?
মোবাইল করছিল আমার বুবুয়ে। এখন তখন অবস্থা, ছাড়!
আমরা একটু থামি এখানে। হ্যাঁ, সে একটা সময় ছিল বাবার অসুখ বলে টেলিগ্রাম করা হতো, ছেলেটি বাড়ি গিয়ে দেখতে পেত, আরে কিচ্ছু না, তার বিয়ের জোগাড় চলছে! আর,বারে বা, কেরানির বেলায় দেখছি বিয়ে ঠিক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু সে ছুটি নিচ্ছে বাবার অসুখ বলে। না, আমাদের কেরানির বেলায় যে পুরনো হিসাব চলবে না, তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি এবং আরও দেখব।
ছুটি মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেরানি উতাল হয়ে ওঠে বিয়ের বাজার করবার জন্যে। চিঠির সঙ্গে ছোটখাটো একটা ফর্দ পাঠিয়েছিল বুবু। ফর্দটা সে আট ভাঁজ করে শার্টের চোরা পকেটে লুকিয়ে রেখেছিল। এখন সেখানে আঙুল ঢুকিয়ে দ্যাখে ফর্দ নাই! আরে! স্পষ্ট মনে আছে এখানেই তো রেখেছিল, গেল কোথায়? এ পকেট, সে পকেট, না, কোত্থাও নাই! ফর্দটা ভালো করে পড়েওনি সে, কী বাজার করতে হবে কিচ্ছু মনে নাই।
কী করে এখন কেরানি? বাবার অসুখের কথা বুবু মোবাইল করে জানিয়েছিল, বলেছিল সে, কিন্তু বুবুর তো মোবাইল নাই যে ফোন করে ফর্দটা জেনে নেবে। এখন উপায়? খালি হাতে বিয়ে করতে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। তা ছাড়া গৈগেরামে কি বিয়ের সওদা পাওয়া যাবে? খোদ জলেশ্বরীতেও লোকেরা বিয়ের বাজার করতে ঢাকা না হোক রংপুরে যায়। ততটুকু সময় তো পাওয়া যাবে না সোমবারে হস্তিবাড়ি পৌছে।
এটা আর সকলের জন্যে ঘোর একটা দুশ্চিন্তার বিষয় হলেও কেরানির ভেতরে মুহূর্তের জন্যে সামান্য একটু অস্থিরতা ছাড়া আর কোনো বড় ঢেউ আমরা লক্ষ্য করি না, নদীর কোনো পাড়ও ধসে পড়ে না। রবিবারের ভোরে লঞ্চ থেকে নেমে সে তার আস্তানা বুলবুল মিয়ার বাড়িতে ফেরে।
বেলা তখন এগারোটা। সারা রাতের যাত্রা জাগরণের ফলে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। রোজকার এই ঘুম। লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠে, তিনটের মধ্যে ভাত খেয়ে তবে আবার সদরঘাট, আবার লঞ্চ, আবার তার ডিউটি।
ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। লঞ্চের চাকরি করে তার ঘুম এমনিতেই পাতলা হয়ে গিয়েছিল। লঞ্চে যে একটু-আধটু ঘুম দেয়, কান খাড়া রাখতে হয় কখন যাত্রীদের নিয়ে কী সমস্যা হয়, কি বেগতিক কিছু একটা ঘটে যায়, জেগে উঠতে হয়।
ঠুং ঠাং ঠং।
চোখ মেলে দ্যাখে রুহিতন। ধড়মড় করে উঠে বসে কেরানি। চোখ কচলে দেখতে পায় ঘরের কোণে মাটির কলসিটার ঢাকনি তুলে দেখছে মেয়েটা।
রুহিতন মুচকি হেসে বলে, আল্লারে আল্লা, এত পিয়াস! ঠিলা দেহি শুনা কইরা ফালাইছেন!
যাই, পানি ভইরা লিয়া আহি।
কোমরে একটা বাড়তি দোলা তুলে কলসিটা কাঁখে নিয়ে রুহিতন বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেছন ফিরে একটা মুচকি হাসি ছুড়ে দেয় কেরানিকে। কেরানির বুকের ভেতরটা তখন ঢিপ করে ওঠে। গলার কাছে কী একটা দলা হয়ে পাকিয়ে থাকে।
রুহিতনের মুচকি হাসির সঙ্গে কেরানির পরিচয় নাই, তা নয়। সেই প্রথম দিন থেকেই তো!
সব মানুষে জিগায়, আপনেই দেহি জিগাইলেন না আমার নাম রুহিতন ক্যালা?
বলেই রুহিতন মুচকি হেসে সেই যে তার দিকে রোশনাই চোখে তাকিয়েছিল, কেরানি আজও সেটি ভুলে নাই।
বাপে তাছ খেলতো। তাছ খ্যালেন নাই? আরে, তাছের ছবি আছে না হত্তন রইত্তন টেক্কা না কী কয়, তার বাদে চিড়াত্তন, হেই রইত্তন আছিল বাজানের খুব কিসমতের তাছ! হেই থিক্কা আমি হইলাম বাদে বাজানে আমার নাম রাখলো রইত্তন। বহুত রোজ আগে নোয়াখাইল্লা এক বুড়া ব্যাডায় এই মোকামে কেরায়া আছিল, আমি তখন ছোডো, হে বাজানরে কইলো_ মিয়া হেতানরে কয় রুহিতন! অ্যালা মহল্লার সক্কলে আর আমি ভি ঠিক কইরা কই রুহিতন! খালি আব্বায় পারে না।
এই কথা, আর কথার ফাঁকে ফাঁকে সেই হাসিটা_ চাঁদের ফালির মতো।
কত কতদিন নদীর বুকে ভাসমান লঞ্চ থেকে যদি কেরানির চোখে পড়ে ফালি এক চাঁদ, রুহিতনের ছবি তার চোখে ভেসে ওঠে। যুবকের চোখ থেকে যুবতীর ছবি জগতে বিলয় পায় না, বিশেষ যদি সেই যুবতীর সঙ্গে তার নিত্য দেখা হয়।
রুহিতনের নিত্যদিনের মুচকি হাসি যেন আজকের হাসিটি নয়। কী এক নতুন অর্থ যেন আজ ওই হাসিটিতে। সতর্ক হয় কেরানি। সামনের শুক্রবারে তার বিয়ে, এ কথা এ বাড়িতে বলা হয় নাই। বুলবুল মিয়াকে গতকালই বলবে ভেবেছিল, কিন্তু কাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার দেখা কেরানি পায় নাই। আর বাপের আগে মেয়েকে বলার তো প্রশ্নই উঠে না।
ওই মুচকি হাসিতে রুহিতনের কী ছিল, কেরানির প্রাণ ছনমন করে ওঠে। তৎক্ষণাৎ সে ঠিক করে না, রুহিতনকে নয়! বিয়ের কথাটা তাকে বলা যাবে না। রুহিতনকে তো নয়ই, তার বাবা বুলবুল মিয়াকেও নয়।
কেরানি উঠে বসে ছিল, রুহিতন ভরা কলসি নিয়ে ঘরে আসে। কিন্তু তখনি ঘরের কোণে বিড়ের ওপর কলসি না নামিয়ে কাঁখেই ধরে রেখে বলে, আম্মায় মহল্লা বেড়াইতে গেছে গা।
কেরানি সঙ্গে সঙ্গে পা নামিয়ে বিছানায় ঝুল হয়ে বসে। মায়ের বিষয়ে রুহিতনের এ সংবাদ দেওয়ার একটিই কারণ সারা বাড়িতে সে এখন একা, অতএব কেরানির দিলখোলা হওয়ার সুযোগ আছে, অনুমতিও আছে। অনুমতিটা রুহিতনের ঠোঁটে আবার তেরছা মুচকি হাসিতে লিখিত হয়ে আছে।
কেরানি পায়ে স্যান্ডেল পরতে পরতে বলে, খিদা পেয়েছে।
পাইবোই তো! বেলা কত হইছে! ব্যানারছি! লা-ল!
কেরানি বিভ্রান্তবোধ করে। ব্যানারছি? সে আবার কী? বস্তুটা যে লাল বলা হলো, তাতেও কিছুমাত্র ইঙ্গিত পায় না কেরানি। সে প্রশ্ন তুলে নীরবে তাকিয়ে থাকে।
রুহিতন ঝুঁকে পড়ে কলসিটা বিড়ের ওপর বসিয়ে দেহ তুলে বলে, যাই, খাওন লিয়া আসি। শইল মাছের ছালোন পাকাইছি। আবসাত্! পাউডার! ইস্নো!
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে কেরানির। এবারে একটু একটু বোঝা যাচ্ছে। মুখে ঘষা পাউডার স্নোর কথা হচ্ছে। কিন্তু আবসাতটা কী?
মুখ ফসকে প্রশ্নটা তার বেরিয়েই পড়ে। আবসাত?
খিলখিল করে হাসতে হাসতে রুহিতন বলে, হেইয়া বুঝলেন না? বুঝলেন না তয় ল্যাখলেন ক্যামনে? আরে জ্বালা, বিয়ার সম মাইয়া সাজাইতে মাইয়ার চুলে যে দ্যায় আবসাত চিকচিক করে!
বলেই লহর তুলে রুহিতন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আক্কেলগুড়ূম হয়ে যায় কেরানির। এ যে বিয়ের সেই ফর্দ! ফর্দের শুরুতেই বেনারসি লাল শাড়ির কথা লেখা ছিল। রুহিতনই তবে ফর্দটা তার পকেট থেকে সরিয়েছে। কখন?
গা ঘামতে থাকে কেরানির।
খাঞ্চায় করে ভাত আর শৈল মাছের তরকারি ডাল নিয়ে আসে রুহিতন। মেঝের ওপর পাটি পেড়ে বিছায়, থালা গেলাশ সাজায়। সাজাতে সাজাতে ভাত-তরকারির দিকে চোখ রেখেই গাঢ় গলায় বলে চলে, জোড়বদলের শাড়ি দুইখান! হলদির শাড়ি একখান! পাত্রীর মেম জুতা! নিজের পাঞ্জাবি কোর্তা আর জরির টুপি!
এ যে মুখস্থ বলছে ফর্দটা! কেরানি হতবাক হয়ে যায়! পকেট থেকে চুরি করে রুহিতন কাগজটা সরিয়েছে তার জন্যে যতটা নয়, তার অধিক কী করে সামাল দেবে এখন সে সেই চিন্তায়। লন, খাইতে বসেন। আমি পাঙ্খা করি।
না, না, আমার পাঙ্খা লাগবে না। তুমি যাও!
পুরুষ পোলার এত শরম ভালা না!
শরীরে আবার ঘূর্ণি তুলে রুহিতন চলে যায়।
গলা দিয়ে ভাত নামে না কেরানির।
রুহিতনের মায়ের গলা পাওয়া যায়। কী করোছ রে হারামজাদি! জজমিয়ার ঘরে গেছিলি যেমুন!
এখানে বাসা নিয়েছে পর, আফলাতুন মিয়ার সেই যে কথা কপাল মন্দ, নাইলে তো কাছারিতে জজ ম্যাজিস্টর হইতো এতদিনে সেই কথা থেকেই এ বাড়িতে কেরানির নাম পড়েছে জজমিয়া!
রুহিতনেরও খর জবাব শোনা যায়।
হ, গেছিলামই তো! যায়া কুনু দুষ করছি নি! তুমি যাইবা মহল্লা বেড়াইতে, মানু-টারে খাওন দিবো ক্যাঠা?
পিঠেপিঠে মায়ের কলকলানি ভেসে আসে, কুলে বহায়া খাওয়া! হারামজাদি, আয়া লউক তর বাপে, ঘোড়ার চাবুক যুদি তর পিঠে না আইজ ভাঙছে রে বাপভাতারি!
আর সেইটানে রুহিতন না, তুমার লগে হিস্সা কইরা লমু না কুনো ব্যাডারে!
আ ছিঃ ছিঃ! আ ছিঃ ছিঃ! কেরানির মাথা নত হয়ে আসে মা-বেটির কথা শুনে। তবে এ তো নতুন নয়। মা-বেটিতে এমন কলকলানি নিত্য শোনা যায়। কিন্তু আজ বড় কানে বাজে। কানে বাজে কি প্রাণে বাজে!
মায়ের নজর ঠেলেই রুহিতন আবার ঘরে আসে। তার মুখে রাগ-ঝালের বংশ নাই, আছে সেই হাসিটি। বড় রহস্যের মনে হয় কেরানির। রুহিতনের হাসিতে আজ যেন অন্য কিছু আছে। না, ঘাঁটিয়ে কাজ নেই।
রুহিতন বলে, প্যাট ভইরা খাইছেন তো! ছালুন ক্যামন হইছে! আমি কলাম পাকাইছি।
ভালো। ভালো।
আরে, হে দেখি তারিফও করবার জানে না! কইবো, এমুন আমি জিন্দিগিতে খাই নাই। হাত পুড়ায়া কার লাইগা কী পাকাইলাম!
কথায় রাগের অভিমানের টান, কিন্তু মুখে দিব্যি সেই হাসিটি।
কেরানি দ্রুত হাতে প্যান্ট-শার্ট পরে সদর ঘাটের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরোয়। ভয় ছিল, উঠোনে বুঝি রুহিতন দাঁড়িয়ে আছে। আবার বুঝি সেই ফর্দের কোন আইটেম ফরমায়! না, উঠোন ফাঁকা। রুহিতনের মাকে দেখা যায় গায়ের বোরকা খুলে দড়িতে মেলে দিচ্ছে। ছোট্ট করে আসি বলে কেরানি টিনের গেট খুলে বাইরে যায়।
গলির মুখে রুহিতন!
কেরানি থমকে দাঁড়ায়।
হাপ দেইখা ডরাইছেন?
না! না!
আমি হাপও না, পেত্নীও না। রইত্তন!
ছাট পিনছেন, জেবের ভিত্রে হাত দ্যান নাই?
পকেটে! কী বলে মেয়েটা! কেরানি দ্রুত হাতে শার্টের এ পকেট সে পকেটের ওপর হাত রাখে।
আরে মর্দ! জেবের ভিত্রে!
তালগোল পাকিয়ে যায় কেরানির।
রুহিতন চোখ মটকে ফিসফিস করে বলে, হারানি কাগজখান জেবের ভিত্রে পাইবেন। হেই যেইখানে লুকায়া রাখছিলেন হেইখানেই পাইবেন। আমি মুবাইল করুম নে!
মোবাইল! রুহিতন তো কখনও তাকে মোবাইল করেনি। তার মোবাইল আছে বলেও তো তার জানা নাই। আহ, রুহিতনের সবটাই কি কেরানি জানে? আজ এক বছরের ওপর এই বাসায় থাকবার পরও কতটুকু সে জানে?
মানুষের জানা! আমরা যা জানি বলে মনে করি, তার অনেকটাই আমাদের ধারণা করে নেওয়া। রুহিতন যে বিয়ের ফর্দটা হাতে পেয়ে কী ধারণা করেছিল, কেরানি তা ধারণাও করতে পারে নাই।
ফোন বেজে ওঠে লঞ্চ ছাড়ার মুখে মুখে। যাত্রীদের ভাড়া আদায় করতে করতে তখন হিমশিম খাচ্ছে কেরানি। এর মধ্যে ফোন। অচেনা নম্বর। হয়তো অফিসেরই কেউ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোনটা ধরে কেরানি।
হ্যালো।
ওপার থেকে মেয়েলি কণ্ঠে খিলখিল হাসি।
কে? কে?
আমি! আমি! চিনবার পারেন নাই!
রুহিতন, এখন আমি ব্যস্ত, খুব ব্যস্ত।
খিলখিল হাসি।
এখন রাখছি!
একখান কথা! বিয়ার ফর্দ যে কইরা রাখছেন, আগে পরস্তাবটা আব্বার কাছে পারছেন?
কী বলছো তুমি?
আমি তো পলায়া বিয়া বইতে পারুম না। তয় কি আমারে লয়া ভাগনের মতলব করছেন! আমি কলাম তাতেও রাজি।
লঞ্চের ঘণ্টা পড়ে। ভোঁ বেজে ওঠে কেরানির বুক বিদীর্ণ করে। সরসর করে যাত্রী ওঠার কাঠ উঠে যায়। দু’একজন যাত্রী পাশের লঞ্চে দৌড়ে উঠে নীল সাগর-৩-এর পাটাতনে লাফিয়ে পড়ে। এতখানি ঝুঁকি নেওয়ার পরও যে তারা পানিতে পড়ে যায় নাই বা দুই লঞ্চের মাঝখানে পড়ে চ্যাপটা হয়ে প্রাণ হারায়নি, সেই বিস্ময়ে তারা হতবাক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কুলিরা লঞ্চের সমুখ গলুইয়ে বালতি বালতি পানি ঢালে। এ যেন ওপরওয়ালার কাছে আগেই মাফ চেয়ে রাখা। আল্লা গো, পানিতে জাহাজ ডোবার আগেই পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছি গলুই। আর কিন্তু নিমজ্জন রেখো না কপালে!
নদীর পানিতে লঞ্চের প্রপেলারের আঘাতে শাদা ফেনার ঘূর্ণি ওঠে পাকিয়ে। লঞ্চ পাছা ঠেলে ঠেলে মাঝগাঙে যেতে থাকে।
[চলবে]