মরুস্বর্গ-৫

ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী। কনানে এসে তাঁবুরই তলে আশ্রয় পেয়েছিল। সৈনিক আর দেবদাসীরা। গৃহ পায়নি। সাদইদের ভাল লাগল, দেবদাসীর সঙ্গে অনেক সৈনিকের বিয়ে দিয়েছেন ইহুদ। তবে দেবদাসীর সংখ্যা বেশি ছিল না বলে অনেক সৈনিক অবিবাহিতই রয়েছে। সেই অবিবাহিতদের মধ্য থেকে কিছু সৈনিকের বিয়ে ইহুদ দিয়েছেন অনেক আগে আসা যাযাবর পরিবারে–যারা ইয়াহোর উপাসক। তবে সেইসব পূর্ববর্তী যাযাবর পরিবার যারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং এখনও যারা তাঁবুরই তলে রয়েছে। তাছাড়া কিছু উট-উপাসক পরিবার ইহুদকে সম্মান করে–তারা সৈনিকদের পাণিগ্রহণে আগ্রহী–কিন্তু লোটার ঘটনা সত্ত্বেও সৈনিকদের ভিতর কেমন একধারা নাক-উঁচু ভাব ।

দেবদাসী, বিয়ের পরও কি দেবদাসী? নইলে অনেক সৈনিকের মধ্যেই কেন এক গোপন চোরা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! তারা কনানী চাষীর মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়তে চায়। দু’ একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। প্রেম শুধু নয়, বিয়ে অবধি হয়েছে। তারা ভাগ্যবান। মেয়ের বাবা সেই জামাইকে গৃহ নির্মাণের জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছে। খড়ের চাল আর মাটির দেওয়াল। তারপরই ঘটনা অন্যরকম হয়েছে। একটি বউ তাঁবুতে, অন্যটি, কম বয়েসী বউটি, রয়েছে কুটিরে। সৈনিকের হয়েছে দু’তরফ। ফলে দেবদাসীর এখন উপোসের কাল এসেছে। খেতে না পেয়ে শুকিয়ে থাকা। কেননা সৈনিক থাকে। কুটিরে–চাষবাসে ঢুকে গেছে। তাঁবু বাতাসে নিঃসঙ্গ ফটফট আওয়াজ করে চলে।

দেবদাসী থাকে একা। চাষীর ছেলেরা আসে। বিয়ে করতে নয়। ভোগ করতে। দু’এক কুনকে গম অথবা বাড়ি থেকে গোপনে নিয়ে আসা বউয়ের পুরনো কাপড়। দানধ্যান দেওয়া-থোয়ার এই হল বহর। এদিকে ঘরের বউটি ভারী মুখরা আর তিড়িঙ্গে–লাফিয়ে ছুটে এসে দেবদাসীর পরনের কাপড় ধরে টানলে—খোল্‌ মাগী কাপড়!

লজ্জায় তখন দেবদাসীর ধরিত্রী দ্বিধা হতে বাকি, মুখ লুকোবার মন্দির-কাণটি সে হারিয়েছে। কাপড় টানাটানির এই দৃশ্য দেখে সাদইদ স্তম্ভিত হয়ে যায়।

ইহুদের সামনে দেবদাসীর বিচার বসল। দেবদাসী বলল–লজ্জা ঢাকবার পরনের দু’প্রস্থ কাপড় দাদাবাবু দিয়েছিল! তারই খোঁটা এত! এই মারে তো সেই মারে! বলি কি এই সোনার অঙ্গে কুষ্ঠ হয় আমার। আমি পাপী! মহাত্মার সামনে বলছি, সামনে শীতে আমি আর বাঁচব না। জুম পাহাড় কী দোষ করেছিল শুনি–এখানে টেনে আনলে কেন? আমারও স্বামী ছিল, ঘর ছিল! তাঁবুর মিনসে কি মিনসে নাকি! কে দেয়, কে থোয়–দেখবার কে আছে! তাঁবুতে ফেলে রেখে চাষার ঘরে চলে গেল। আমি ধম্ম ধুয়ে খাব!

ইহুদ বললেন–সবুরে মেওয়া ফলে মা!

–হ্যাঁ খোবানী জন্মায়! কিন্তু গাছ তো পুঁতবেন!

–ইয়াহো ধর্মের উদ্ভিদ। তিনি তোমায় ছায়া দেবেন।

এই দৃশ্যের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সাদইদ সরে চলে আসে। তাঁবুর এই পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কত নির্মম ছবি চোখে পড়ে। সাদইদ দেখে এক নিঃসঙ্গ সৈনিককে–একা একটি পাথরের উপর বসে আছে। বয়স বেশি নয়। বেচারি মরুভূমির জাতক–যে কিনা উটের পিঠে প্রসবিত হয়েছিল। চাষী জীবনের সঙ্গে এর কখনওই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। নাম দিনার। এ যেন সমেরু আর লোটার মিলিত প্রতিচ্ছায়া। বাপ-মাকে কোথায় হারিয়েছে। সে তার দেহ থেকে হিতেনের উল্কি মুছে ফেলেছে–সেই ক্ষতস্থানে চেয়ে ঘাড় গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে।

–একা বসে আছো?

–হ্যাঁ।

আর কোন কথা বলল না। দু’ধরনের সৈনিক। এক যারা চাষী ছিল। জমি থেকে উৎখাত হয়ে ক্রীতদাস হয়। দ্বিতীয় যারা মরুভূমি থেকে ক্রীতদাস হয়ে পিরামিডে কাজ করত। পরে সৈনিক হয়েছে। পদাতিক। যারা চাষী ছিল তারা চাষে ঢুকবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা পাথর বইত উটের পিঠে বা চাকাঅলা গাড়িতে, তারা চাষীদের চোখে ঘৃণ্য। এদের জন্য এই গ্রামে কোন কাজ নেই।

নতুন জামাতা হয়েছে যে সৈনিক, তার সঙ্গে শ্বশুরের সংলাপ কানে আসে।

–শ্যামাঘাস চেন বাপ? গম আর ঘাসে একাকার।

–চিনতে হবে!

–ওহ্! এখনও চিনতে হবে! কবে চাষবাস করতে মানিক!

এক ঝটকায় কানে এল কথা। শ্বশুর বলল–কত না জমি-জিরাত ছিল। মানিকের! খেজুরের বাগান! খোবানির চাষ। খেজুরের আঁটি যেন পিরামিডের পানা খাড়া হয়ে থাকত! গাইয়ের দুধে গোঁফ চুমরে যেত! আঁটি হত জ্বালানি আর দুধ হত ক্ষীর। একবার ফরাতের পলিতে আটকে গেল পাঁচখানা গাই, সেকি কাণ্ড! বাঁট ঠেকল কাদায়, দুধের ভারে থইথই! কাদায় গড়িয়ে পড়ে দুধ। কালো এটেল আর সাদা দুধ! সেই একটা জীবন ছিল বটে।

–আজ্ঞে!

–তবে মানিক আমার শ্যামাদাস চেনেন না!

–আজ্ঞে বিস্মরণ হয়েছে।

–তা তো হবেই, কতকালের কথা!

–আজ্ঞে!

–ওট্‌ শালা সেপাই! মিছে বলার আর জায়গা পেলে না। আরে যা যা, তাঁবুর ইস্তারীর কাছে যা! শরীরের কী ব্যাধি আছে, কে জানে ঘোড়াখোর! আমার মেয়েকে ভোগাভাগা দিয়ে এখন জমিতে দাগ বসাতে চাও! ওই যে কী বলে নাম, ইয়াহুদ, সেইটেই সব্বেনেশে! মহাত্মা বলে কথা!

এই অপমান হজম হয় না। তাঁবুতে অগত্যা জুমপাহাড়ীর স্ত্রীর কাছে ফেরে সেই লোক। কুটির থেকে নতুন কনে হামলায়। তাঁবুর বউ স্বামীকে পেয়ে বলে–সবুর আর কত করব সেপাই!

সেপাই ডাকটি শুনে মাথা গরম হয়ে যায়। দেবদাসীকে অকথ্য গাল দেয়। পিটিয়ে পাট পাট করে দেয় লোকটি।

দেবদাসী বিধবস্ত বাহু, পিঠ দেখিয়ে বলল–দেখুন সারগন! আপনি বলুন, মুক্তি কবে পাব? হে অদৃশ্য ঈশ্বর, তুমি কি দেখতে পাও না!

লোটার অশে ধাবিত সাদইদ আকাশে চোখ তুলল। আকাশে চাঁদের সভা বসেছে। তারকারা চাঁদের মুখপানে ঝুঁকে আছে। চাঁদ কথা বলছে, তারকারা শুনছে। একটা নীলাভ গোল বৃত্ত। কস্তুরী আভা জড়ানো যেন এক গোল তাঁবুর রাত। আজ প্রচুর বাঁচতে ইচ্ছে করে! কিন্তু বেদনা জাগে গম শিষ আর যব শিষের পার্থক্য বোঝে না বলে একজন সৈনিক যখন অপমানিত হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশুকে চুম্বন করল সাদইদ। তারপর বলল–ওহে নিভা! ভাল করে আঁকড়ে থাকো পিছনে। পড়ে যেও না!

হেরা তার শিশুকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। আরো আশ্চর্য নিভাকে দেখে। সাদইদের হাত দুখানি ধরে বললে–এমন কখনও হয় না সাদইদ! কখনওই হয় না। আমি আরো মূর্তি বানাব। পুরনো দেবদেবীদের অনেক ভাব আমার মাথায় এসেছে। এবার নববর্ষে মন্দিরে একেবারে মচ্ছব হবে। দেবদেবীদের অভিনয় করবে মানুষ। লিঙ্গপূজা হবে। কত কি হবে। নিনি আমার সঙ্গে থাকবে। ওর নাম কিন্তু নিভা নয় সাদইদ। ও নিনি। আমার স্বপ্ন।

–এ তোমার পাপের উপার্জন। এ তোমার দণ্ড হেরা। তুমি কখনওই আর মূর্তি বানাতে পারবে না। ইহুদের সঙ্গে শর্ত করে এসেছি। শিশু আর নারীর জন্য তোমায় শিল্পচর্চা ত্যাগ করতে হবে। যদি এই শর্ত অমান্য করো, তোমার আঙুল কর্তন করা হবে।

–অসম্ভব! এ হতে পারে না। হাস্যকর প্রস্তাব। মূর্তি না বানালে আমি খেতে পাব না। বাঁচতে পারব না। মাটি মানেই মূর্তি। মাটি তার রূপ চায়। পাথর তার রূপ চায়। পেত্তল তার রূপ চায়। সোনা চায় অপূর্ব রূপের কান্তি। নগর হল রূপের একটি উচ্চতা। নিনি আমার পাপের উপার্জন নয়। সে আমার অর্জন। একটা রূপের বদলে পেয়েছি। ও আমার বোবা দেবী, ওর সঙ্গে দেহ মিলনে কোন পাপ নেই আমার। আমায় বিরক্ত করো না! নিনিভা! ও নিনি! স্বপ্নের নগরী! হায়!

বলে শিশুকে কোলে করে নিনির হাত ধরে জ্যোৎস্নায় নেমে গেল হেরা। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। তারপর আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলল। হেরাই। পারে জীবনের একটা ভয়ানক সমস্যাকে মুহূর্তে মিটিয়ে ফেলতে।

এই হেরাই অতঃপর যোবা মেয়েটির মুখে ভাষা দিল। নিনি একদিন আশ্চর্য প্রশ্ন শুধালো-সবারই তো কিছু না কিছু রয়েছে। সারগনের কেউ নেই কেন?

হেরা সাদইদকে চোখের ইশারা করে বলল-এবার জবাব দাও!

সঙ্গে সঙ্গে সাদইদের চোখের সামনে ভেসে উঠল দিনারের মুখচ্ছবি। সে ঈষৎ হাসল। বলল–আমার অনেক আছে নিনিভা। তোমরা জানো না! তোমরা নতুন ঘর বাঁধলেনগর ধ্বংস হয়ে গেছে, তোমাদের দেখলে সেকথা মনেই হয় না! আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছ তোমরা ইহুদ ভেবেছিলেন তোমরা বিয়ের সময় তাঁর কাছে যাবে! এ তাঁর ব্যর্থতা!

হেরা বলল–তোমার কি মনে হয় না, যার যা ভাল লাগে সে সেই ধর্ম করবে! পূজাবিধি কতকালের অব্যেস! মূর্তি ছাড়া ধর্ম কী করে হবে! নগর কী করে হবে!

সাদইদ বলল–তোমার সেই এক কথা হেরা। নগর। নগরের সঙ্গে মূর্তির কী সম্বন্ধ!

–সম্বন্ধ আছে সাদইদ। ডানাঅলা বৃষ–নিনিভের ভাস্কর্য! মূর্তি ছাড়া তুমি তোমার শক্তি, সমৃদ্ধি, তোমার শৌর্য–কিছুই প্রকাশ করতে পারো না। মানুষ মূর্তিতে পরিণত না হলে দেবতা হতে পারে না। যেমন মিশরের ফেরাউন। মূর্তি যত বিশাল হবে মানুষও তত দেবতা হয়ে উঠবে। নতুবা দেহটা হবে সিংহের, মাথা হবে মানুষের–অন্তত তুমি তাই হও–আতঙ্কের জনক। তোমার পায়ের তলায় পিঁপড়ের সমান পড়ে থাকবে চাষা। একজন মুটে। একজন কারিগর। একজন ঘরামী।

–তাহলে বলছ, মূর্তিই সব?

–মূর্তিই সব সাদইদ। নগর মানে মূর্তি। বিশাল মূর্তি। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার উপর মূর্তি। কোন উচ্চতার উপর মূর্তি। যাতে ভয় আর সম্ভ্রম হয়। উচ্চতা, কেবল উচ্চতা। ক্রমাগত উচ্চতার দিকে ওঠা। পিরামিড একটি সুউচ্চ আকৃতি–একটা জ্যামিতি ছাড়া কিছু নয়। এর কি কোন মানে নেই? নগর। বলতে কতকগুলি সুউচ্চ বিশাল আকৃতিকে বোঝায়। মিনারকে বোঝায়। সৌধ বোঝায়। স্তূপ। জিরাত। স্বর্গ! এইসব বোঝায়।

–কিন্তু স্বর্গ বোঝায় না হেরা!

দু’জনের উত্তেজিত তর্কে নিনিভা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা তার কখনওই ছিল না। বাচ্চাকে সে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছে সবেগে।

হেরা অবাক হয়ে বলল–স্বর্গ বোঝায় না?

সাদইদের গভীর জবাব–না।

একটু থেমে বলল–বোঝায় না। মধুদুগ্ধের দেশ এটি। সহিষ্ণু। সব ধর্ম এখানে থাকবে। কিন্তু মধু থাকে উচ্চে। মধুচক্র থাকে উপরে। কিন্তু তা টুপিয়ে পড়ে মাটিতে। গাভীর দুধ মাটিতেই ঝরে পড়তে চায়। উপরে থাকে এইজন্য। যে,তা মাটির উপর ঝরবে। উপরে থাকার নিয়মই হচ্ছে নিচে নামার উদ্দেশ্য। মধুদুগ্ধপ্ৰবাহিণী দেশ। মর্তের অমরাবতী। স্বর্গ উপর থেকে নিচে নামবে। তাড়া করে ওঠা নয়।

হেরা বিড়বিড় করে বলে–তাড়া করে ওঠা!

সাদইদ বলল–হ্যাঁ। একটা জ্যামিতির কথা তুমি প্রায়ই বল। তোমার সঙ্গে আমি একমত। তুমি ভাস্কর, স্থপতি, জ্যামিতি মানে যেমন ধরো তিনটে বাহু উপরে খাড়া হয়ে আকাশ ধরতে চায়। ত্রিভুজও তো একটি জ্যামিতি। কিন্তু সেটা আদৌতে কবর। হাত দিয়ে ছুঁতে না পারার ফলে পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে বাহু বাড়ানো–এই আকৃতি সম্ভ্রম ঘটায়, কিন্তু একজন চাষীর দুঃখ বাড়িয়ে দেয়, পিঠ নুইয়ে দেয়। আমি বলছি, এভাবে তেড়ে ওঠাকে আমি সুন্দর বলি না। মধু টুপিয়ে মাটিতে পড়ছে, ফল মাটিতে পড়ছে, ফুলের ভারে ডাল নুইয়ে নামছে। হাওয়ায়। যত কিছু সুন্দর তা মাটির দিকে নামতে চায় কেন! সূর্যের আলো, চাঁদের আলো মাটির দিকে নেমে আসছে কেন? ইন্দ্রধনুটা নামতে পারছে না। বলে শান্ত জলের তলায় এসে ভাসছে। মেঘ নামছে বৃষ্টির হাত ধরে মাটিতে! তাহলে স্বর্গ কেন মাটিতে নামবে না! তোমার কী মনে হয়?

হেরা স্তব্ধ হয়ে চুপ করে গেল। নিনি অবাক হয়ে সাদইদের বুকের দিকে চাইল। ওখানে হৃদয় আছে। কিন্তু এতসব কথা হৃদয় চিন্তা করতে পারে । চিন্তার ধকলে এই মানুষটি মরে যাবে না তো! ফের হেরাও তর্ক বাধানোর জন্য। দম ধরেছে। দুটিই পাগল।

হেরা বললনগর না গড়লে তুমি কিছুতেই স্বর্গ গড়তে পারো না। মধু যে মাটিতে টুপিয়ে পড়বে তার জন্য মধুচক্র দরকার। উচ্চতা দরকার। বন্যা যাতে তোমাকে ঘিরে না ধরে। দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধ যেন তোমাকে তেড়ে না মারে। গ্রামগুলির দিকে যদি তুমি নজরদারি করতে চাও, তোমাকে উচ্চতার দিকে যেতেই হবে।

সাদইদ বলল–হ্যাঁ, গ্রামগুলির দিকে নজর রাখা। উপরের দিকে ওঠা এই জন্য যে, যেন আমি নিচের শেষ অবস্থাটা, একেবারে তলার স্তর দেখতে পাই। যেখানে লোটা মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে!

হেরা চমকে উঠল। অবাক হয়ে সাদইদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সাদইদ অতঃপর ম্লান হেসে বলল–মূর্তি আমার চাই। লোটা মুখ খুঁজড়ে মরুভূমির বালিতে পড়ে আছে, তার কাছাকাছি ছড়িয়ে রয়েছে পশুগুলি-মরু আকাশ থেকে নেমে আসছে নখরঅলা ভয়ংকর কালো ঈগল। এই মূর্তিটা আমার চাই হেরা! একজন নিঃসঙ্গ পড়ে থাকা হাঁটু ভেঙে পড়া মানুষ–অথচ নির্দয় আকাশ, মরু ঈগল!

–ও হো হো! অমন করে বলল না সাদইদ–সহ্য হয় না!

ভয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে হেরা। নিনিভা নরম লাবণ্যময় শ্যামা-উজ্জ্বল মুখ ভয়ে বিস্ময়ে ভরিয়ে তোলে, দুচোখে তার টলটল করে কাঁচা শিশুগম চারার মত আলো। স্নিগ্ধ করুণ চির হরিতের মুগ্ধতা নিনিভাকে কখনও যেন ছেড়ে যাবে না মনে হয়।

–একজন মানুষ ভালবাসে কতকগুলি আকৃতি-নারী তার মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আকৃতি–স্বর্গ মানে চির বসন্তের আলোপগ্ন নারী আর নগ্ন শিশুর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সেই আলোর মধ্যে নারী আর শিশুরা থাকে। হেরা! আমি আর কিছু চাই না!

–কিন্তু তোমার সেই নারী কোথায় সারগন!–নিনিভা শুধালো।

সেকথার জবাব না দিয়ে সাদইদ বলল-ইয়াহোর স্বর্গে শুধু নারী থাকে। পুরুষ আর নারীর অবিচ্ছিন্ন ক্লান্তিহীন মিলন। সেখানে শিশু নেই। স্বর্গের দেওয়ালে তুমি একেছ একটি স্রোত। গাভী আর বৃষের তুমুল প্রবাহ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে-দেবতা আমন আকাশে ডুবুডুবু, যাই যাই করছে। পশুর গলায় ঘণ্টা বাজছে। সেই একটা স্রোত চলেছে তো চলেইছে। ভেবে দ্যাখো হেরা! সেই দলটির মধ্যে তুমি একটা শিশু; সাদা ধপধপে বাছুর দাওনি! আমি তাহলে তোমাকে স্বর্গের সেই দেওয়ালটি ভেঙে ফেলতে বলব।

–তাহলে তোমার শিশু কোথায় সারগন!

সাদইদ সেই জবাব না দিয়ে বলল–ইয়াহোর স্বর্গ–ইহুদের বেহেশ্‌ত অসম্পূর্ণ হেরা! অথচ ইহুদের কিছু কল্পনা আমার মন্দ লাগে না। ওঁর ওপর ইয়াহো যখন ভর করেন, তখন বেচারি স্বর্গের বিবরণ দেন–যেন তিনি স্বর্গের সকল আকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? সেই বর্ণনায় কখনও শুনিনি যে,তিনি দেখছেন #কটি উটের পিঠে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে! আমার কথা হেরা তুমি বুঝবে না!

উটের পিঠে জন্ম, উটের পিঠেই মৃত্যু-একঘেয়ে ধূসর মরুপথ–তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে–উটকেই অতঃপর হত্যা করে জলের থলি টেনে বার করে তেষ্টা মেটানো-মরুভূমি এমন মানুষকেও বাঁচিয়ে রাখে। আর যেখানে মানুষ বৃক্ষের স্বভাব পায়–নদী পায়–উপত্যকা পায়–সেখানেও বৃষ্টির জন্য কুমারী বলি দিয়ে রক্তাক্ত নারীদেহ ফসলের মাঠে টেনে নিয়ে ফেরে। একটা কুমারী দেহ, জল্লাদ কেটে ফেলে দিলে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়–কার জমি কুমারীর রক্তের ছোঁয়া পাবে! ফসল ভাল হবে। যুদ্ধের পর নারীর সংখ্যা বাড়ে পুরুষের তুলনায়, কুমারী বলি থাকলে সেটা ফের সমতায় ফিরে আসে। এই কি জীবন?

মানুষ এভাবে কতকগুলি নিয়ম চালু করে। কুমারী বলি রদ করেছেন মহাত্মা ইহুল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য দেবদেবীর দেহমিলনের অভিনয় হয় নববর্ষে–সেটা এখনও রদ হয়নি। শুধু একটা লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে। হলে আকাশে মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে চিৎকার করে বলতে হচ্ছে, কুমারী বলি অতি দূর দূরান্তরের দেশের, মহুলা নদীর পারের ঘটনা—হাল আমলে এখানকার পুরুতরা চালু করেছিল–জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানারকম পূজা চালু করছে–যার কখনও নামই শোনা যায়নি। আর একবার একটা জিনিস চালু হলে সহজে রদ করা যায় না। নতুন একটা নিনিভে-পূজাও চালু হয়েছে। মড়ক-পূজার নতুন নাম হয়েছে নিনিবে। মারীর দেবী নিনিবে।

অথচ হেরাকে ধন্যবাদ যে, সে তার স্ত্রীর নামই রেখে দিলে নিনিভা। তার সংস্কারে বাধলও না একটু। ভয়ও করল না! আতঙ্ককে ভালবাসার মধ্যে হেরা মজা পায়। লোটার কথায় তার দুচোখ ঢেকে ফেলার ভয় বোধহয় ভয় নয়–কান্না। এই ছবি তার হৃদয়ে ঢুকে গেল। সারাদিন, সারাজীবন হেরা ওই দৃশ্যটা ভুলবে না। ক্রমান্বয়ে সে ভাববে।

বছর চৌদ্দ বয়েস নিনিভার। বলির মুখ থেকে বেঁচেছে সে, তারপর বোবা হয়ে যায়। নিনিভা যদি বোবা না হত, তাহলে হয়ত হেরা তার কাছে ছুটে যেত না। হেরা এরকমই।

সাদা অশ্বটার পিঠে লাফিয়ে উঠল সাদইদ। প্রবল জ্যোৎস্নার ভিতর ছুটতে শুরু করল।

নদীর বাঁধটার কাছে এসে ঘোড়ার পিঠে শান্ত হয়ে দাঁড়াল সাদইদ। জল ফেঁপে উঠে খালে গিয়ে পড়ছে। মাটির উপর পলি জমলে মাটি উর্বর হয়–মেসোপটেমিয়া তার নদীর তীরে এই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। সেখানকার চাষীদের দক্ষিণ এলাকা থেকে, মারীর বিভীষিকার কবল থেকে টেনে এনেছে সাদইদ–এখানকার লোকেরা ভয়ে শুকিয়ে কাটা হয়ে গিয়েছিল। নদীর এই দূরবর্তী এলাকায় তাদের ঘর বেঁধে দিয়েছে সাদইদ। এরা বাধ বেঁধেছে, খাল কেটেছে। এমন ফসলের রূপ কনান কখনও দেখেনি। শস্য পাবার সময় হয়ে এল। সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

জ্যোৎস্নায় চারিদিক নিথর। হঠাৎ দূরে মাঠের ভিতর মশালের আলো চোখে পড়ল। তারপর সমবেত বিচিত্র চিৎকার। ঘোড়া ছোেটালো সাদইদ। কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল কতকগুলি লোক মাঠের উপর দিয়ে কী যেন বস্তু দারুণ উল্লাসে মাতলামো করতে করতে টেনে নিয়ে চলেছে, চিল্কারে আকাশ ফাটিয়ে তুলছে। অষের পায়ের শব্দ শুনে লোকগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর কে একজন চেঁচালো–সারগন! ওরে সারগনের ঘোড়া! চ! ফেলে দে! আর নিয়ে যেতে হবে না। অ্যাই! সর্বনাশ হল! পালা, পালা!

মাঠের উপর মশাল ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। অশ্বের পিঠ থেকে নেমে মাটিতে পড়ে থাকা জ্বলন্ত মশাল তুলে ঝুঁকে পড়ল সেই বস্তুটির উপর। সাদইদ দেখল–নিনিভা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একটু আগেই তো সাদইদ নিনিভার সঙ্গে কথা বলে এসেছে। মুহূর্তে এ ঘটনা কী করে ঘটে! অবিকল নিনিভার মুখ।

সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে ফিরে আসে। এসে দেখতে পায় নিনিভা হেরার সঙ্গে কথা বলছে। অশ্ব থেকে নেমে এসে বলে-তোমার মত দেখতে এই গ্রামে আর কেউ আছে?

–হ্যাঁ। আমার বোন। দু’বছরের ছোট। আমার আরো পঁচটা বোন আছে। একজন দেখতে আমার মত। কেন?

–ও বলি হয়ে গিয়েছে নিনিভা। ইহুদের ভয়ে রাত্রে কেটেছে।

নিনিভা আর্তনাদ করল–জানতাম! বাবা বোনটাকে বাঁচতে দেবে না। মাঠে ফসল হচ্ছে না বলে বলির জন্য বাবার কাছে পুরুত আমাদের চাইত। হায় গোলাপী, শেষে তুই ..

বোনের নাম ধরে ডুকরাতে থাকল নিনিভা। অশ্ব ছুটিয়ে এসে মাঠের মধ্যে গোলাপীর বলি হওয়া মৃত গলা কাটা দেহ খুঁজে পেল না সাদইদ। হেরা কালো ঘোড়ায় চড়ে সাদইদের পিছু পিছু এসেছিল।

বলল–তোমার কি কষ্ট হচ্ছে সাদইদ? কতকগুলি নিয়ম তুমি বুঝতে চাও না কেন? তিনটে ভেড়ার বদলে হাটে একটা বালিকা খরিদ করা যায়। পশুবলি হলে নারী কেন বলি হবে না? তুমি একটা স্বাভাবিক ঘটনায় এত উত্তেজিত হও! তুমি কি ভাবছ, হাটে কেবল পশুই বিক্রি হবে, মানুষ বিক্রি হবে না? পশু আর মানুষে তফাত করাটা তোমার কবিত্ব হতে পারে, নিয়ম হতে পারে না।

–কিন্তু ইয়াহোর নিয়মটা তাহলে আমাকে বলবে! ইহুদ কেন এই নিয়ম রদ করতে চাইলেন? শোন বলি, মসীহ পশুদের চালনা করেন। চাষী পশুদের খেতে দেয়, বাঁচায়, চালিয়ে নিয়ে ফেরে। তাই মানুষ কখনও পশু হতে পারে না। চালকের বেঁচে থাকা দরকার। লোটার মৃত্যু তাই মেনে নেওয়া যায় না। সে পশুদের চালিত করেছিল। তুমি একটা অন্ধকার সময়ের কথা বলছ–এখন মানুষ হত্যা করা অন্যায়। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। যা আমার কবিতার সমর্থন পাবে না তাকে আমি উচ্ছেদ করতে চাই। কুমারীর রক্ত নয়, জমি উর্বর হয় পলিজলে।

–পলিজল!

–হ্যাঁ, পলিজল! এটা মাটির নিয়ম। সে উর্বর হওয়ার জন্য মানুষের রক্ত প্রত্যাশা করে না। সে চায় মাটিরই প্রলেপ। মাটি আপন নিয়মে কাজ করছে। জল তার আপন নিয়মে পলি বইছে। এই নিয়ম নিরন্তর চলছে। মানুষ এদিকে সে নিয়ম না জেনে নরবলি দিচ্ছে, কুমারীর দেহ কেটে ফেলছে। এদিকে মহাত্মা ইহুদ করলেন কি,মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে বললেন–লাঠিই শ্রেষ্ঠ! পশুকে শাসন করে। হেদিয়ে মরছেন তিনি। এ করে হয় না হেরা!

–হয়, তা কে বলেছে!

–আমি নিয়ম না জানতে পারি, তাই বলে কুমারী মেয়েটি অকারণ হত্যা হয়ে গেল, তারা মৃতদেহ হিঁচড়ে টানছে মাঠের উপর দিয়ে–হৃদয় যদি তোমার দুঃখ না পায়, তুমি কখনও জল, বৃক্ষ, মাটির কথা বুঝতেও পারবে না–স্বর্গও তৈরি হবে না তোমার হাতে। নোহ নিয়ম জানতেন। তাই কিস্তি তৈরি হল। তিনি জল এবং মাটির কাছেই থাকতে চেয়েছেন। জলের উপর ভাসছেন। কিনারা খুঁজছেন। যিনি নৌকা তৈরি করবেন, তার কিন্তু লাঠি ঘোরানোর সময় হবে না। কারণ নৌকায় তাকে তুলে রাখতে হবে সকল জীব এবং বীজের নমুনা। একটা কালো খর্ব হাবসী কন্যাও যেন আমার স্বর্গে আশ্রয় পায় হেরা! কখনও যেন নিনিভার আর্তনাদ আর শুনতে না হয়!

–কিন্তু নৌকায়, তো সবাই আশ্রয় পায়নি। যারা পাপী তারা ঠাই পায় না। তারা মরে! নোহ তাদেরই নিয়েছিলেন, যারা পুণ্য করেছিল। আমি ইহুদের বক্তৃতায় একথা গত কদিন আগে শুনে এসেছি। তিনি আমায় দেখে বললেন, ওহে কর্মকার–কী ব্যঙ্গ ভাবো–বললেন, আর কী সব বানাচ্ছো এখন বললাম–নোহর কিস্তি মহাত্মা! তা উনি শুধালেন–কার জন্য! কথাটা অত্যন্ত বাকা–একেবারে হৃদয়ে এসে বেঁধে! বললাম, তেমন বাছবিচার করিনি মসীহ! তা উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন–তবে এ নৌকা তোমার তলিয়ে যেতে বাধ্য হেরা! বাকি কথা তোমায় আর বলতে পারব না। সাদইদ!–চুপ করে গেল হেরা!

সাদইদ চেয়েছিল গমের ঝাড়ালো শিষগুলির দিকে। ভাবছিল মধু আর রুটি আর ডুমুর। খোবানী-খেজুর! মানুষ খাবে। মাটি এবার প্রচুর দিয়েছে। গমগাছের গোড়ায় জল জ্যোৎস্নালোকে চিকচিক করছে। সেই ঝিলিমিলি অসম্ভব সুন্দর! চেয়ে থাকলে নিশ্চয় পুণ্য হয়। হঠাৎ পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে সাদইদ বলল–লোটা তবে কী পাপ করেছিল হেরা! মরল নে?

হেরা বলল-লোটা তো মরেনি!

–মরেনি?–সাদইদ কাতর স্বরে এক তীব্র আর্তনাদ করে।

–না। ইহুদের উম্মতরা লোটার মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করে না। এই মিথ্যা প্রচারের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে! পুণ্যবান লোটার কখনও মৃত্যু হতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে লোটা একদিন ফিরে আসবে।

–অসম্ভব!

–সে তত তোমার আমার কাছে সাদইদ। ইহুদের উম্মতরা মনে করে, লোটা মরুভূমিতে রয়েছে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ফলে লোটার স্ত্রীর আর কখনও বিয়ে হবে না। রিবিকাকে আমি কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই সে নিনিভার মত বোবা। রিবিকা নিশ্চয়ই দেবীর মত সুন্দর। লোটা ছাড়া তাকে কেউ কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। ভেবে দ্যাখো সাদইদ, সামনের ওই কালো ঘোড়াটা কী মিথ্যা হয়ে গেল!

–এসব কথা তোমার মুখে আমি আর শুনতে চাইনে হেরা! তুমি ফিরে যাও! আমার ফিরতে দেরি হবে।

–এখানে কী করবে এখন?

–লোটার জন্য অপেক্ষা করব!

–পাগল! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে! যা তুমি বিশ্বাস কর না, তার জন্য কি অপেক্ষা করা যায়!

–একটি মেয়ে কী করে পারে!

–পারে না সাদইদ, পারে না!

পারে, কে বলেছে তোমায়? পারা উচিত নয়।

–উচিত নয়? তবে সে রয়েছে কী করে?

–সে তো আমি বলতে পারব না।

–তবে তুমি কথা বলছ কেন হেরা! কেন বলছ কথা!

প্রায় চিৎকার করে ফেলল সাদইদ। আর্ত সে স্বর গলায় হাহাকার করে উঠল। হেরা নিচু সুরে বলল–নিনিভার বোন মরল এই রাতে। কেন মরল, এতদিন যা জানতাম তা ভুল! কিন্তু রিবিকা যে অপেক্ষা করে রয়েছে একথা ভুল নয় সাদইদ। ভুল হতে পারে না। লোটা ফিরে এসে যুদ্ধ করবে।

–যুদ্ধ!

–হ্যাঁ। ইহুদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে সেদিন।

–কী বলছ তুমি?

–তুমি ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করো সাদইদ! তুমি পাপী!

–এ পাপ কিসের হেরা!

–যুদ্ধের! লোটার অপমানের। লোটা ফিরে আসবে সেকথা বিশ্বাস না করার পাপ। তুমি তুচ্ছ একটা মানুষ সাদইদ। কাফের! পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

হঠাৎ মনে হল, এ যেন হেরা নয়, ইহুদেরই কণ্ঠস্বর। কালো অশ্বটি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। একা দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। ক্রমশ তার হৃদয়ে হেরার বলা কথাগুলি চেপে বসতে লাগল। তুমি একটা তুচ্ছ মানুষ। পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

নিনিভার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল–সবার কত কিছু আছে। তোমার নেই কেন? তোমার শিশু! তোমার নারী!

–আমার আছে নিনি! আর্তস্বর ফুটে বার হয় সাদইদের কণ্ঠে । তারপর সাদইদ আকাশে চোখ তুলে বলে–আমার পাপ করার অধিকার আছে নিনি! নিশ্চয়ই আছে। দেবদাসী রুহা! তুমি শুনে রাখো, আমি পাপী! আমার কুড়িয়ে পাওয়া নারীতে আমার পাপেরই অধিকার মহাত্মা ইহুদ! এ নারী লোটার নয়।

এই নিথর, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতি সাদইদের কথায় বিচলিত হল না! কিছুক্ষণ বাদে একলা কালো ঘোড়াটা ফিরে এল। অনেকদিনই এরকম হয়, সাদইদ সাদা ঘোড়ায় চলেছে সম্মুখে, পিছনে ছুটে আসছে লোটার কৃষ্ণ অশ্ব। অকারণ কালো ঘোড়া অসহায়ের মত, অবাধ্যের মত দৌড়য়। তাকে ফেরানো যায় না।

কালো অশটিকে দেখে ভয়ে সাদইদ একটা বোবা আর্তনাদ করে কেঁদে ফেলে। সাদা ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ে। ছুটিয়ে দেয় ক্ষিপ্র বেগে। কালোটি তাকে অনুসরণ করে। সাদইদকে এক আশ্চর্য পাগলামি পেয়ে বসে। এই জ্যোৎস্নায় দেবদেবীর রমণকৃত সুঘ্রাণ হাওয়ায় ছড়ানো। পশুরা ঘুমাতে পারছে না। নদীর জলে সোনালী একটি সিংহী চকচক শব্দে জল পান করছে। জ্যোৎস্নার তীব্র দোলনে জল কাঁপছে সাদা ইস্পাতের ঢালের মত। সিংহীর নধর শরীরে কামনার কাপুনি। অশ্ব ছুটে যায়। রাত্রি বেড়েছে ঢের।

তাঁবুর পৃথিবী চোখে পড়ে। সাদা অশ্ব এসে থামে দিনারের তাবুর সামনে। কালো অশ্ব মুখ তুলে শূন্যে ভেসে বেড়ায় নিরুপায় অর্থহীন। দিনার বেরিয়ে আসে চুপচাপ।

সাদইদ বলে–তুমি কাল রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োগ হলে দিনার। কাল আমার সঙ্গে দেখা করো। যাও রিবিকাকে ডেকে দাও।

দিনার প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব বুঝতে পারে না। কাজে সে নিয়োজিত হবে কোথায়? আর কেনই বা রিবিকাকে ডেকে দেবে? কাজ এবং ডেকে দেওয়ার মধ্যে সম্পর্ক কোথায়!

দিনার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্ত হয়ে সাদইদ বলল–শুনতে পাও না?

একটুখানি কেঁপে উঠল দিনার। তারপর জুমপাহাড়ী ভাষায় দিনার জবাব দিল–আপনার জিভ খসে পড়বে সারগন! কাকে ডাকতে বলছেন আপনি। উনি আমাদের মায়ের মত। সবার মা! আর আমাকে কাজের লোভ দেখাবেন না! আপনি তো ইয়াহোর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যার কিনা হিতেন রাজার বিরুদ্ধে একটা কথা বলার সাহস নেই, সে বানাবে জিগুরাত! ওই কাজে আমাদের দয়া করে ডাকবেন না। থুঃ! কী ভাষায় কথা বলছি হায় ইয়াহো! যান চলে যান!

দিনার চলে গেল! কালো অশ্ব তীব্র আর্তনাদে আকাশে গলা তুলল। রিবিকার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, লোটা যেন এসেছেন! রিবিকা পাগলের মত বাইরে বেরিয়ে চলে আসে। সাদইদ ওকে হাত ধরে অশ্বে টেনে তুলে নেয়। তারপর অশ্ব আর থামে না। রিবিকার ঘোর কাটতে সময় লাগে না।

সাদইদ রিবিকার কানের কাছে মুখ রেখে বলে–বলেছিলে ভয় পেও না!

–আমায় ছেড়ে দাও সাদইদ!

–কেন তুমি বেরিয়ে এলে!

–আমার যে মনে হল, উনি এসেছেন!

–আমি সাদইদ রিবিকা! তোমার সারগন!

–অ। তুমি?

পাগলের মত কথা বলে রিবিকা। তারপর সাদইদের কোলে মূৰ্ছা যায়। অশ্ব কোথায় এসে পৌঁছয়, সাদইদ ছাড়া কেউ জানে না। এক আশ্চর্য উপত্যকায় উঠে এসেছে জ্যোৎআফেননিভ অশ্ব। স্বর্গের আলোয় জ্বলছে তার দেহ।

এমন সুন্দর উপত্যকা সাদইদের স্বপ্নের ভূমি। এ উচ্চস্থান ঝর্নার ধারায় সিক্ত, প্রকৃতিই নিজে সেজে রয়েছে, সমতল থেকে ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে পাহাড়ের গা অবধি প্রসারিত হয়েছে এ পাহাড়ে ইয়াহোর অগ্নিচক্ষু আকাশ রক্তাক্ত করে না। এখানে ঝর্নাটি বাতাসে যেন দেবদাসী রিবিকার মাথার নীল ফিতার মত ভাসছে, অনন্ত সুরে বইছে, ফেনাইত হচ্ছে স্ফটিক বুদ্বুদ, নীল আভা-মাখা স্রোতে মিশে আছে কিঞ্চিৎ গেরুয়া পলি। এখানে আপনা-আপনি জন্মেছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ, গাছপালাগুলি ঝুলিয়ে রেখেছে ফল ফুল মধুচক্র আর লতানো দোলনা। এখানে কখনও ভূমিকম্প হয় না। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে না ভয়ংকর পাগলা পাথর। এখানে গাছের ডালের দুবাহু তোলা ফাঁকে মুখ রেখে বসে থাকে পূর্ণিমা। লাল আলোর ঘোর আর ছায়া-মাখা চাঁদটি ফর্সা হয়ে ওঠে ক্রমশ। চাঁদটা একটা বিশাল মধুচক্রের ঝুলন্ত শিলার পাশে উঁকি দিয়ে ডালের দু’বাহুর উপর ধীরে ধীরে খাড়া হয়।

সেই ছায়া, সেই আলো, সেই শুভ্রতা রিবিকারসংজ্ঞাহারা মুখে এসে লাগে। চুলে এসে ঝর্নার বাতাস সুরের দোলা দিয়ে একটা তরঙ্গ উদ্বেলিত করে। রিবিকার বুকের কাপড় বাতাস যেন আকুল হয়ে অতি সন্তর্পণে খসিয়ে দিয়ে চলে যায়। পাথরে শায়িতা রিবিকা। চোখ মুদিত। হাত দুটির একটি মাথার দিকে এলিয়ে শ্লথ আবেশে পড়ে রয়েছে। অন্য হাতটি পাথর ছাড়িয়ে শূন্যে ঝুলে পড়েছে। নাভিমূলের একটি-দুটি রেখার নিচে কাপড় বিস্রস্ত। একটি পা পাথরের উপর সটান, অন্যটি পাথর গড়িয়ে ঝুলছে। রিবিকা কি পড়ে যাবে?

রিবিকার মাথার কাছে ঝর্না এঁকেবেঁকে চলেছে মেসোপটেমিয়ার খালের মত। যেন সুরই এঁকেবেঁকে গেছে। এই অবস্থায় আকাশের দেবতারা যেন চাঁদের মশাল তুলে রিবিকার মুখ দেখছে। দেবতারা এই রাতে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। তারপর তারা আর আকাশে ফিরে যেতে পারে না। তারা প্রজাপতি হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায়।

হঠাৎ সাদইদের ভয় হয়, রিবিকা যদি আর না জেগে ওঠে? লোটার মতই যদি ঘুমিয়ে পড়ে? সাদইদ রিবিকার মাথায় হাত রাখে। রিবিকার দেহ নড়ে ওঠে।

চোখ দুটি পাপড়ির মত খুলে যায়। সভয়ে রিবিকা দ্রুত উঠে বসে। কাপড় তুলে বুকের কাছে জড়ো করে। সাদইদ রিবিকাকে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করার জন্য পাথরের উপর বসবার চেষ্টা করে। রিবিকা পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আমায় হেঁবে না সাদইদ।

–কেন রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে।

–লোটা নেই। ও মরে গেছে। লোটা আর ফিরবে না রিবিকা! এখানে কেউ নেই। চারিদিক নির্জন। দ্যাখো সেই চাঁদটা এখানেও এসেছে। এই উপত্যকা ছেড়ে চাঁদ আর কোথাও যাবে না। এখানেই আমাদের স্বর্গ মিবিকা!

–তা হয় না সাদইদ। চাঁদ যেমন মিথ্যা, স্বর্গও সত্য নয়। একমাত্র ইয়াহোর স্বৰ্গই সত্য সারগন। লোটা ফিরে আসবে। সমস্ত মরুভূমিতে সে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষ আজ জেনেছে, লোটা মরে না। সে মরেছে ভাবলে পাপ হয়। তার জন্য অপেক্ষা করলে মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধি পায়। আমি আজও বেঁচে আছি কেন? বলে দাও, কেন বেঁচে আছি! তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও যে আমার জন্য খাদ্য আর বস্ত্র জোগাড় করতে গেছে সাদইদ।

–আমি তোমায় খাবার আর পোশাক দেব রিবিকা! তুমি তো আমারই ছিলে! মনে আছে জুম পাহাড়ের সেই রাত। সেই সকালবেলা! আমার এই লুঠ করা হাত দুটি দুর্বল নয় রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে সাদইদ! তুমি যদি এই নির্জন স্থানে আমার অসম্মান করো–পাপ হবে তোমার! লোটার পত্নীকে কেউ ছুঁতে পারে না। দেবতা পর্যন্ত তার ওপর কু দৃষ্টি ফেলতে পারে না। আমি চিরপবিত্র নারী! ছোবে না আমাকে। স্বর্গ একটা প্রতারণা। তুমি পাপী!

সাদইদ বিষঃ সুরে বলল–তোমার দেহ! আমি যদি প্রজাপতি হতে পারতাম, তুমি আমায় পাপের কথা তুলে এভাবে কষ্ট দিতে না! আমার কষ্টের কি কোন দাম নেই? আমি নোহের সন্তান। কবি আমি। মনে নেই? আমি তোমাকে একটি ফুলের বিনিময়ে খরিদ করতে পারি। পারি না? এই নাও রিবিকা। অন্তত তুমি আমায় ফুলের পাপড়ি দিয়ে স্পর্শ করতে দাও।

হাতে ধরা ফুলটি সাদইদ সামনে এগিয়ে ধরে। বলে–এই ফুল নিশিগন্ধা । সাদা এর কলিকা। এখানে মধু আর শিশির জমেছে রিবিকা। এই রাতে একটি উটের চোখের জল এভাবে ঝরে পড়ে।

–ওভাবে বলল না সাদইদ! আমি আশ্রয়চ্যুত হব । আমার কেউ নেই যে সারগন! এই মাটিতে আমার জন্ম। তিনটি ভেড়ার বদলে আমি এখান থেকে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলাম এক বণিকের হাতে। ঠাকুমা বলেছিল আমার কাকারা ফসল ভাল হলে উট নিয়ে যাবে আমায় ফিরিয়ে আনতে। সেই অপেক্ষা করছি কত বছর। ওরা যায়নি ফরাতের বস্তীতে। কেউ নেই। এখানে এলাম। কেউ আমায় চিনল না। দেবদাসীকে কেউ চিনতে চায় না। মনেও রাখে না। তুমি ভুলে যেও সাদইদ। এই স্বর্গ আমার জন্য নয়। স্বৰ্গ কি কখনও নেমে আসে?

–আসে না? তোমার এই দাঁড়িয়ে থাকা কি সত্য নয়? –সাদই অবাক হল, গলায় অদ্ভুত কাতরতা।

–এ অলীক! সাজোয়ার মৃতদেহের ভিতর আমার এই দেহ কি শুয়ে থাকতে পারে না? পারে, খুব পারে! মনে করো, আমি নেই। অদৃশ্য জগৎ আমায় ডেকে নিয়েছে! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।

এই সময় সাদইদের হাত থেকে নিশিগন্ধার কলিকা স্খলিত হয়ে রিবিকার পায়ের উপর পড়ে যায়। ফুলের স্পর্শে রিবিকার তামাম দেহ রোমাঞ্চিত হয়। মুহূর্তে তার দু’চোখ মুদে আসে। নাকের গোড়া স্ফীত হয়, বুকের ভিতর ঘন মদির খাস যেন ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে নারীর দেহ কেঁপে ওঠে ঠোঁটের উপর ঘাম জমে।

সাদইদ রিবিকাকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে বসে পড়ে পায়ের কাছে। ফুলের দীর্ঘ কলিকা তুলে নিতে গিয়ে দুটি হাতের তালু প্রসারিত উপুড় করে পায়ের উপর চেপে ধরে। রিবিকা গলায় অদ্ভুত সুখ আর কাতরতার মিশ্র ধ্বনি উচ্চকিত করে। তারপর সে সাদইদের মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে শরীরে চেপে ধরে।

এমন সময় কালো অশ্বের হ্রেষা তীব্র মন্থনে গলার শিরা ছিঁড়ে আকাশে দীর্ণ হয়। পাগলের মত ছুটে আসতে থাকে ঘোড়াটা। কী যে হয় ঘোড়া ফের ফিরে যায় নিচের দিকে। অশ্বের এত আর্তনাদ কখনও শোনা যায়নি।

সাদইদ রিবিকাকে পাথরের উপর শুইয়ে দেয়। জ্যোৎস্না আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ডালের দু’বাহুর ফাঁকে ঝুলছে মধুচক্র, মৌমাছির জ্যোৎস্নার মাদকতায় অদ্ভুত নড়াচড়া। চকচক করছে কালো পুঞ্জীভূত দেহগুলি। সাদইদ ভাবল, মধু যেমন সঞ্চিত থাকে মধুচক্রে, এই স্বর্গস্থানে সঞ্চিত থাকবে খাদ্য, পানীয় আর পোশাক। দুর্ভিক্ষে, বন্যায়, অভাবে মানুষ এখানে আশ্রয় পাবে। বন্যার জল নেমে গেলে, বর্ষার জল মাটিতে পড়লে, শীত অথবা গ্রীষ্ম কমে গেলে মানুষ নিচে নামবে।

কিন্তু নোহের নৌকাকে যেমন সেদিন মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি, তার স্বর্গকেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এই রিবিকা স্বর্গ বিশ্বাস করে না। তাকে বোঝানো দরকার, স্বর্গ আকাশে থাকে এ ধারণামাত্র। সেই কল্পনা সত্য। কিন্তু এই মর্তে তার বিশ্ব মিথ্যা নয়। নারীর এই রূপ যেমন সত্য, স্বর্গও সত্য। স্বর্গ ছাড়া, হেরার ভাস্কর্য ছাড়া এ নারীর রূপ কোথাও বিম্বিত হতে পারে না।

অশ্ব আর্তনাদ করে উঠল। সাদইদ রিবিকাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলল। রিবিকা কেঁদে উঠল। দু হাত জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল–হায় ইয়াহো। এ পাপীকে রক্ষা করো প্রভু!

কালো অশ্ব তীর এবং বর্শাবিদ্ধ হয়েছে। কে তাকে মারছে কেউ জানে না। অশ্ব ছুটে এসে পাগলের মত সাইদের গা ঘেঁষে আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে প্রাণপণে উঠে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–লোটা তুমি এ কী করলে? আমার পাপ তোমার সহ্য হল না!

অশ্ব কান পাতল বাতাসে। মরুভূমি তাকে ডাকল লোটার গলায়–সালেহ-ও-ও-ও, হায় পিতা-আ-আ-আ…

.

১০.

পায়ে বর্শা বিঁধেছে দাবনা বরাবর। ঘাড়ে বিঁধেছে তীর। ছোট বর্শা এবং তীর ছুঁড়েছে শত্রু। এইসব বর্শা এবং তীরে বিষ মাখানো থাকে। অশ্ব কান পাতল বাতাসে। লোটা ডাকছে। আর তো বিলম্ব করা ঠিক নয়। ঘোড়া ছুটতে শুরু করল ।

সাদইদ রিবিকার পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। রিবিকার নগ্ন বুকে মুখ রেখে ডুকরে উঠল। গলার স্বর থরথর করে কেঁপে উঠল। ভাঙা অধস্ফুট স্বরে সাদইদ বলল–আমি আর বাঁচব না রিবিকা!

অত্যন্ত অসহায় শোনাল সাদইদের গলা। বিষাদে মায়ায় পূর্ণ, কামনাহত, অথচ নিঃস্ব, বঞ্চিত সে স্বর। আহত অশ্ব তীব্রতম হ্রেষা ছড়াতে ছড়াতে গ্রাম অতিক্রম করে গেল। অশ্বের এই আর্তনাদ যুদ্ধের স্পষ্ট সংকেত।

শিশুর মুখকে নারী অত্যন্ত আদরে যেমন করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে,রিবিক বক্ষলগ্ন সাইদের মাথাটিকে তেমনি সমাদরে নিবিড়তম আশ্লেষে চেপে ধরল। বলল–আমার ভালবাসার পাপে তোমার স্বর্গ গড়ে উঠুক সারগন। ভয় পেও না! আমার ঈশ্বর কে আজও জানি না। কিন্তু তুমিই আমার দেবশিশু, তুমিই দেবতা! আমি নাঙা দেবী। আমার জন্য তুমি বারবার জন্মাবে এই পৃথিবীতে! বস্ত্র দিয়ে আমার লজ্জা ঢাকবে।

কালো অশ্বের আহত উন্মাদনা সহ্য করা যায় না। কিন্তু সেই চাপে রিবিকার সব অবদমন অনর্গলিত উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের রূপান্তর ঘটায়। সে বুঝতে পেরেছে, ইহুদের লোক লোটার অশ্বকে হত্যা করে গেল!

শান্ত এক সমাহিত ধ্যান-মূর্তির মত চাঁদটা স্থির। হাত বাড়ালে তাকে যেন ছোঁয়া যাবে মনে হয়।

সাদইদ বলল–এখানে আর এভাবে বসে থাকা ঠিক নয় রিবিকা!

রিবিকা শুধালো–কোথায় যাব?

–কোথাও আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে।

–চলো তাহলে, আর দেরি করো না!

সাদইদ তার নগ্ন দেবীকে সাদা ঘোড়ায় করে তীব্র বেগে নেমে এল উপত্যকা থেকে। নদীর তীর বরাবর ছুটতে থাকল অখ। রিবিকার মনে পড়ল, এইভাবে সে একদা নীল নদীর কিনারা ধরে চালোকিত নীল রাত্রিতে আমারনা থেকে এলিফেনটাইন দুর্গের দিকে অশ্ব ধাবিত হয়েছিল। জানি না, এবারে ভাগ্যে কী আছে? ভাবল রিবিকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নদীর তীরভূমিতে দুই পারে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। কারিগর, শ্রমিক, পাথর কাটিয়েদের বাসস্থান। আর আছে দু’ চারজন চাষী। সবাই বিদেশী। প্রায় সকলকেই সাদইদ দূর-দূরান্তর থেকে, বিধ্বস্ত নগরী থেকে সংগ্রহ করেছে। একবার ভাবল, এখানেই কোথাও আশ্রয় নেয়।

হঠাৎ সাদইদ আশ্চর্য প্রশ্ন করল–তুমি কী রূপে বাঁচতে চাও রিবিকা!

–মানে? তোমার কথা বুঝলাম না!

–মানে আর কী? অশেষ তোমার রূপ! দেবী-রূপে বাঁচবে, নাকি মানুষ রূপে বাঁচবে। আমি তোমাকে, যা চাইবে তাই করব! হেরা তোমাকে তেমন করেই আকৃতি দেবে!

রিবিকা চুপ করে রইল। সহসা অদ্ভুত একটি মাটির সুউচ্চ মূর্তি চোখে পড়ল। একজন অশ্বারোহী মরুভূমির উপর দিয়ে তীর-বেগে ছুটছে। অবাক করার মত। এই মূর্তিটাই এখন অবধি বৃহৎ। তাতে লেখা আছে–এই রাস্তা স্বর্গের দিকে গেছে! অশ্বারোহীর তীক্ষ্ণ বর্শার গায়ে অক্ষরগুলি আঁকা।

–হেরা তোয়ের করেছে!

–হ্যাঁ রিবিকা! এসো লোটাকে আমরা স্পর্শ করি!

অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সাদইদ মূর্তিটির তলায় নত হল। মূর্তির গায়ে হাত দেওয়া মাত্র সাদইদের বুক হাহাকার করে উঠল।

–লোটার ঘোড়াটিকে তুমি খুজবে না সাদইদ!

–না রিবিকা। আমি আর পাব না। মরুভূমির ভিতর চলে গেছে। এতক্ষণ বেঁচেও নেই। এই মূর্তিই আমার সম্বল। পরে এটা পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হবে । চেয়ে দ্যাখো হুবহু সেই মুখ। সেই দেহ। সেই বলিষ্ঠতা। সেই উল্লাস! হেরার হৃদয় কী স্বচ্ছ!

আবার অশ্বারোহণ করল ওরা। নদীর বহু পথ অতিক্রম করে ঘোড়াসুদ্ধ ওরা ভেলায় চড়ে নদী পার হল। তারপর সাদইদ বলল–সামনে ওই যে। বাড়িগুলো দেখছ, এই গ্রামে আমি জন্মেছি। এখানে আমার কেউ চেনা থাকলেও তাকে যেমন আমি চিনতে পারব না, সেও আমায় পারবে না।

–এখানে কোথায় থাকবে তাহলে? –রিবিকা প্রশ্ন করল।

সাদইদ বলল–এই গ্রামে নিনিভের এক নৌকারিগর থাকে। খুবই বুড়ো হয়েছে। চোখে ভাল করে দেখতেও পায় না। ওর একটা আট-নয় বছরের নাতনি আছে। সংসারে আর কেউ নেই। সবাই যুদ্ধে বিনষ্ট হয়েছে। বুড়োর নাম মিশাল । নাতনির নাম বিদ্যা। এদের কাছে থাকবে তুমি। এদের একখানা উটমুখী নীল নৌকা আছে,ভারী মজবুত। সমুদ্রের উপর পর্যন্ত ঘোরে। বুড়ো আমার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ । মিশাল তোমায় ওই নৌকায় সমুদ্রের ভিতর লুকিয়ে রাখবে!

রিবিকা এই সময় ঈষৎ ফুঁপিয়ে উঠল। রাত্রি তখনও কিছুটা বাকি। হঠাৎ সে সামনে দেখতে পেল সমুদ্র। তার কান্না থেমে গেল। নদী পিছনে পড়ে রইল অনেক দূরে। গ্রামকে তারা অতিক্রম করে এসে সমুদ্র পেয়েছে। নীল নৌকাও চোখে পড়ল কিনারে । মিশাল রিবিকাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বলল–সারগন! আমার হিফাজতে রইল, চিন্তা করবেন না।

ফেরার পথে নদী অতিক্রম করার পর অশ্বারোহী সাদইদ কারিগরদের কুটিরের পথ অতিক্রম করছিল। হঠাৎ ইহুদের মন্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–সেই মহামারী আর ধ্বংসের কথা মনে নেই আপনাদের? নদীর স্রোতের মত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল পর্বত গহ্বরে, গিরিখাতে; উচ্চ ও সমতলভূমি আর পাহাড় রঞ্জিত হয়েছিল এমনভাবে, মনে হত যেন লোহিত কম্বল–আমার কাঁধের এই লাল কম্বল লক্ষ্য করুন! শিবিরাগ্নির মত জ্বালানো হয়েছিল পাশ্ববর্তী সমূহ জনপদ, আর খালের টাটকা পানীয় জলকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল জলাভূমিতে। সুন্দর সব ফলের বাগানে ঝটিকার মত গিয়ে প্রবেশ করেছিল সৈন্যবাহিনী, দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল লৌহকুঠারের শব্দ ..একটি শস্যমঞ্জরীও তারা অক্ষত ছেড়ে দেয়নি। তারা কারা? এই সাদইদ সেই এক নির্মম সেনাধিপতি ছাড়া কেইবা ছিল? আপনারা কেন তার মত মানুষকে অনুসরণ করলেন! আপনারা ফিরে যান।

ইহুদ সামান্য থেমে আবার বললেন–সাদই একজন লুণ্ঠনকারী। সে তাবুর পবিত্র নারী রিবিকাকে লুঠ করে নিয়ে গেছে । সেই অভিমানে লোটার অশ্ব ফিরে গেছে মরুভূমিতে । মহাত্মা লোটা সেই অষে চড়ে ফিরে আসবে। একদিন এই ইয়াহোভক্ত ইহুদের ধর্মরাজ্য গড়ে উঠবে। সেই রাজ্যে থাকবে আদর্শ গ্রাম। কখনও উদ্ধত নগর গড়া হবে না। নগর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। নিনিভে আমার বাবিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। জাতিভেদ এবং ভাষাভেদ ঘটিয়েছে। স্বর্গ ঈশ্বরের জিনিস। মানুষ আকাশে সৌধ আর তৃপ বানালেই, সিঁড়ি গড়লেই ঈশ্বরের স্বর্গ হেঁয়া যায় না ভাই। তা কখনও নিচেও নামে না। সব বস্তুর বিম্ব হয়। স্বর্গের হয় না। মর্ত মর্তই। মরুভূমি যেমন গ্রাম নয়। ইয়াহহ যেমন ইস্তার নয়–তেমনি স্বর্গ স্বর্গ-ই–মর্তে সেই ছবি আসে না। মানুষ নগর গড়তে পারে। স্বর্গ পারে না।

আবার থামলেন ইহুদ। তারপর বললেন–সাদইদের স্বর্গের জন্য একখানা পাথর যে পুঁতবে, তার জিভ খসে পড়বে। মহাত্মা লোটার স্ত্রী দেবীর মত পবিত্র। তার উপর বলপ্রয়োগ করলে ইয়াহোর বুক কেঁপে ওঠে। সেই পাপ বহন করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর নেই। সাদইদ রিবিকাকে নিয়ে আপন হাতে বানানো স্বর্গে প্রবেশ করবে–তোমরা বাইরেই পড়ে থাকবে বন্ধু! মানুষের হাতে গড়া স্বৰ্গকে কখনও বিশ্বাস করো না। ফেরাউন কখনও প্রজার জন্য পিরামিড গড়েনি। প্রজার লাশ পথের উপর পচেছে, শেয়াল শকুনে টানাটানি করেছে। তোমরা ফিরে যাও!

–কোথায় ফিরে যাব আমরা?–একজন চিৎকার করে বলল।

–যেখানে খুশি যাও। এখানে থেকো না।

ইহুদ কুটির অঙ্গন থেকে বাইরে চলে আসেন। তখন সবে সূর্য উঠছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা। লাঠি হাতে, কম্বল কাঁধে রাস্তার উপর চোখ রেখে এগিয়ে আসছেন তিনি।

সাদইদ লোটার মূর্তির কাছে এসে দেখল, সেটি বিধ্বস্ত। মাথা ওপড়ানো, একটি পা ভাঙা, কোমর নড়বড়ে। হতাশায় অভিভূত চোখে নির্নিমেষে দেখছিল সাদইদ। মনে মনে ভাবল–এ দৃশ্য হেরা সইতে পারবে না!

ইহুদ সাদা অশ্বের কাছে এসে থামলেন! চোখ তুললেন সাদইদের বিমর্ষ চোখে। সাদইদ ইহুদের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল–এতক্ষণ আপনার বক্তৃতা শুনছিলাম মহাত্মা ইহুদ! স্বর্গ এই দুনিয়ায় সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু চাষীর পক্ষে প্রচুর ফসল ফলানো সম্ভব। সেই ফসল থেকে উদ্বৃত্ত অংশ একটি শস্যভাণ্ডারে আমি জমা রাখব। যেসব খালকাটা শ্রমিক এখানে এসেছে, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনার কী উপকার হবে! দুর্ভিক্ষ হবে, মানু খেতে পাবে না। তখন আকাশে বৃষ্টির দেবতার কাছে দু’হাত তুলে কাদবে আর কুমারী বলি দিয়ে অসহায় নারীর প্রাণনাশ করবে। এই কি আপনি চান?

গম্ভীর গলায় ইহুদ বললেন–আমি কী চাই, তুমি ভাল করেই জানো! কুমারী বলি আমিই রদ করেছি। ফসল বেশি হলেও ওই হত্যাকাণ্ড রদ হত না সাদইদ! তার জন্য এই লাঠির শাসন দরকার ছিল! কিন্তু উদও ফসল তুমি কেন শস্যভাণ্ডারে তুলবে? তুমি কে? তুমি অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে স্বর্গ বানাতে চাও–একথাও আমি সর্বসাধারণকে বলেছি! আজ আমি আর গামছাবালা নই সাদইদ। এই লাল কম্বল দেখে মানুষ বোঝে–এই মানুষটি যুদ্ধের শোক আর বিভীষিকা কাঁধে করে বইছে। মানুষ মরলে তোমার প্রাণ কাঁদে কিনা জানিনে, কিন্তু আমি সইতে পারি না।

সাদইদ বলল–এ কারণেই আপনি মহাত্মা। কিন্তু লোটার এই মূর্তি ভেঙে দিয়ে আপনি মহাত্মার কাজ করেননি। আপনি জানেন, লোটা বেঁচে থাকলে ফিরে আসত। লোটা নেই বলেই তার মূর্তিটা হেরা তৈয়ের করে এই রাস্তার উপর খাড়া করেছে। হেরা প্রচুর পরিশ্রম করেছে, দিনরাত ভেবেছে। লোটার মৃত্যু সে দেখেছে মহাত্মা ইহুদ! আপনি কেন ভেঙে দিলেন?

ইহুদ বললেন দ্যাখো সাদইদ! লোটার মৃত্যু ধারণা মাত্র। তার মৃত্যু হতে পারে না। মহারাজা হিতেনের মত বলশালী রাজচক্রবর্তীকে যে হত্যা করে, তার মৃত্যু নেই। কালো অশ্ব তাকে আনতে গেছে। সে ফিরে এসে রিবিকাকে উদ্ধার করবে। তোমার লাম্পট্যের গহ্বরেই তোমার পতন অনিবার্য সাদইদ। লোটার আর কোন রূপ নেই! ইয়াহো তুলে নিয়েছেন।

একটু হেসে ইহুদ বললেন–কোন মূর্তি দিয়ে মহাত্মা লোটাকে বাঁধা যায় না সাদ। সেই চেষ্টা কখনও করো না! মূর্তি গড়া পাপ।

সাদইদ বলল–মূর্তি দিয়ে চিন্তা করা সহজ মহাত্মা। নকশার ভাষা হল মূর্তির ভাষা। মূর্তি আবার সকল ভাষার চেয়ে শক্তিশালী। আপনি জেনে রাখুন, মানুষ মূর্তি বানাবেই। আকাশের ঈশ্বর মূর্তি বানিয়েছিল, সেগুলি মানুষ। মূর্তি গড়া একা ঈশ্বরের অধিকার নয়। মানুষেরও অধিকার।

–মূর্তি ধ্বংস করাও কিন্তু ইয়াহোর নির্দেশ। কারণ তার নিজের কোন রূপ নেই।

–মরুভূমির ঈশ্বরের কোন রূপ থাকে না মহাত্মা ইহুদ। কারণ সেখানে মাটি নেই। বালু মুঠিতে ধরে ছেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এখন মাটিতে এসেছেন। মূর্তির অধিকার আপনাকে মেনে নিতে হবে।

–তুমি তর্ক করছ সাদইদ! আমি বিতর্ক পছন্দ করি না। মূর্তির আড়ালে রয়েছে ব্যভিচার। যৌনাচার। মানুষ দেবদেবীর অভিনয় করে অবৈধ দেহমিলনের জন্য। বৃষ্টি হওয়া না-হওয়া তার উপলক্ষ। কেননা, এখন সে জেনেছে ইয়াহোর নির্দেশে বৃষ্টি হয়। অথচ সে মন্দির মণ্ডপে নববর্ষের ব্যভিচার ত্যাগ করেনি। তোমার হেরা নগ্ন দেবীর মূর্তি বানায়। এ পাপ। নারীকে উলঙ্গ করা পাপ সাদইদ। নগর নারীকে উলঙ্গ হতে শেখায়। দেবদাসী করে। মন্দির। হল পাপপুরী। যদি মন্দির কখনও পবিত্র হয়ে ওঠে, জানবে পৃথিবী সেদিন নেই। মন্দির মানে রক্তপাত, মন্দির আর মূর্তি মানে কুৎসিত যৌনাচার। তুমি মূর্তির অধিকার ছেড়ে দাও। ইয়াহোর ধর্ম স্বীকার করো। রিবিকা তাহলে তোমার হবে সাদইদ। নতুবা নয়।

ইহুদ আর দাঁড়ালেন না। অনেকটা পথ যখন তিনি অতিক্রম করেছেন, সাদইদ অশ্ব ধাওয়া করে ছুটে এল। ইহুদ থেমে পড়ে ওর দিকে চোখ তুললেন। অশ্ব ছটফট করছে। লাগাম টেনে ঘোড়াকে সামাল দিতে দিতে সাদইদ বলল–লোটা আজ মূর্তি ছাড়া কিছু নয় মহাত্মা ইহুদ! আমার মনের ভিতর সে আছে–তার মূর্তি! তাকে বাইরে না আনলে আমার যেমন নেই, লোটারও মুক্তি নেই। যাকে ভালবেসেছি, তাকে ভেতর থেকে বাইরে আনাই তো আমার ধর্ম । একথা বোঝার জন্য আপনাকে আবার আসতে হবে এই মর্তে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সুযোগ আপনার নেই। আপনি কখনও তেমন প্রত্যাদেশ পাবেন না। দুঃখিত মহাত্মা ইহুদ! রিবিকা দেবী নয়। সে আমার জীবন যুদ্ধের পাওনা। রিবিকার জন্য আমি বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং প্রকাণ্ড নগরী গড়ে তুলব। আপনি শুনে রাখুন, আপনার লাঠির চেয়ে একটি অসি কিন্তু কম শক্তি ধরে না।

বলেই সাদইদ তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। পিছন থেকে ইহুদ চিৎকার করে বলে ওঠেন–ওহে সারগন! তুমি কিন্তু শুনে রাখো, নোটার এই মূর্তি ভাঙার জন্য আমি কাউকে নির্দেশ দিইনি। আকাশের দেবদূত রাত্রে এসে ভেঙে দিয়ে গেছে।

. ইহুদের জোরে জোরে বলা কথাগুলির কিয়দংশ সাদইদের কানে গিয়েছিল–সে তীব্র বেগবান অশ্বটিকে মোচড় মেরে ঘুরিয়ে মুহূর্তে ছুটে এল ইহুদের সামনে। বলল–কে ভেঙেছে বললেন?

–জিব্রিল!

–অ! আকাশ আর মর্তের ভ্রাম্যমাণ অদৃশ্য দেবদূত! তবে শুনে রাখুন, সেই জিব্রিলই কিন্তু গতরাত্রিতে ব্লিবিকাকে তুলে নিয়েছে আকাশে,আর লোটার ঘোড়াটিকে বর্শা, তীর ছুঁড়ে মেরেছে!

–হতে পারে! আমি অবিশ্বাস করছি না।

মৃদু ঘাড় নেড়ে সাদইদের কথা সমর্থন করলেন ইহুদ। সাদই অবাক হয়ে চমকে উঠল।

ইহুদ বললেন–জিব্রিল যদি সত্যিই তুলে নিয়ে থাকেন, তবে তিনিই এই তাবুর দুনিয়ায় তাকে ফেরত দিয়ে যাবেন। কারণ লোটা আর রিবিকা এই মর্তেই মিলিত হবে। জেনে রেখো সাদইদ, লোটার কামনা ছিল রিবিকার উপর। মরুভূমিতে যে-মিলন ঘটেনি, এই শস্যসবুজ কাননে, যিহুদায়, জেরুজালেমে সেই মিলন ঘটবে। ঘটতে বাধ্য! এর অন্যথা হতে পারে না।

বলতে বলতে আকাশে দু’হাত প্রসারিত করলেন ইহুদ।–হায় ইয়াহো। তোমার বান্দার প্রার্থনা মঞ্জুর কর পিতা! আমার উম্মতদের (মন্ত্রশিষ্য) মোনাজাত (প্রার্থনা) কবুল কর! পিতামাতা আমার নাম রেখেছিলেন ইহুদ! আমাকে সার্থকনামা করে তোলো ঈশ্বর। আমার অনুসরণকারীরা,ইহুদি! তাদের স্বপ্ন যেন বিফল না হয়! পিতা মুসা–তোমার ইহুদ যেন ব্যর্থ না হয়!

শুনতে শুনতে অশ্বারোহী সাদইদের মাথা নিচু হয়ে গেল। তার থুতনি এসে বুকে ঠেকল। মনে হল তার, সে অপরাধী। তার দু চোখে অশ্রুর পীড়া –গলার কাছে দলা পাকানো লোটার কামনা, যা ভালবাসায় করুণ, মরুতৃষ্ণায় ব্যাকুল। বুক তার খা খাঁ করছিল।

সাদইদ মাথা নিচু করেই বলল–আমার মত পাপীর জন্য তোমার ঈশ্বরের কাছে কোন প্রার্থনা নেই মহাত্মা ইহুদ!

কণ্ঠস্বর কাঁপছে। মাথা তুলল সাদইদ। চোখ দুটি প্রত্যাশায় সহসা উজ্জ্বল হয়, মনে হয়, মহাত্মা ইহুদের কাছে সে যেন তার স্বপ্নসাধ ভালবাসা মজুত করেছে, ইহুদের করপুটে, প্রসারিত বাহুতে তার হৃদয় জড়ানো, যেন তাবুর দূরবর্তী মরুদ্বীপের মত হাওয়ায় দুলছে।

ইহুদ গম্ভীরভাবে বললেন–হ্যাঁ আছে! তোমার হৃদয়ে সত্যের আলো পড়ক। প্রার্থনা করি।

বলেই ইহুদ অগ্রসর হতে থাকেন সামনের দিকে। যেতে যেতে বলেন–বাবিলের স্বর্গ ঈশ্বর নিজে হাতে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি কখনওইতোমার হাতে ফিরিয়ে দেবেন না! তোমার জুমপাহাড়ী ভাষা যেমন গড়ে উঠতে পারে না, তোমার স্বর্গও গড়ে উঠতে পারে না।

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছেন ইহুদ। আপন মনে বলে চলেছেন–ঈশ্বর সৃষ্টি করেন গ্রাম। মানুষ তৈরি করে নগর। তাই নগর বারবার ধ্বংস হয়।

সাদইদ বলল–অথচ পিরামিড টিকে থাকে।

ইহুদ সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন–ওহে দয়াল সারগন! স্বর্ণ কিন্তু কিছুতেই টেকে না।

বলেই ইহুদ অদ্ভুত বাকা করে অট্টহাসি ছড়িয়ে হাঁটতে থাকলেন।

অশ্ব নিয়ে মাটির উপর সহসা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ। সামনে এগিয়ে চলে গেলেন ইহুদ। প্রথমেই সাদইদের এই মুহূর্তে যেকথা মনে হল, তা হল, মানুষের কণ্ঠস্বর কী রহস্যময় হতে পারে!

তারপর তার শরীরে অদ্ভুত ক্রোধ তৈরি হতে লাগল। ক্রোধ যদি আগুন হয়, তাহলে তা এক সময় নিবে গেল। নিবে যাবার পর তার হৃদয় এক চাপা অনুশোচনায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে কি তবে সত্যিই পাপ করেছে গত রাতে?

লোটার কামনা কি মরুমর্তে এখনও রিবিকাকে খুঁজছে! মরুভূমি সব সময় সবুজ মাটির দিকে তৃষ্ণার্ত জিভ বার করে চাটতে থাকে জল আর উদ্ভিদ, মরু গিরগিটির ললকানো পাতলা জিভের মত। নারীর শরীরের রূপ আর মায়া যেন মাটিরই গড়ন, ছায়াময় গাছ আর নীল জল এবং জ্যোৎস্না। পুরুষ উটের মত নিরবলম্ব গলা দোলানো জীব। পুরুষ এক বর্শা-বেঁধা কালো অশ্ব যে মরুভূমির দিকে মরবার জন্য তুমুল জ্যোৎস্নায় ছুটে যায়। ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুক হাহাকারে মুচড়ে ওঠে।

কী পাপ করেছি আমি! বলে সে আকাশে মুখ তোলে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সাদা ঘোড়া। তাবুর সংসার পাতা গ্রামের প্রান্তসীমায় চলে আসে তার ঘোড়া। কেন চলে আসে, সাদইদ বুঝতে পারে না। সামনে তারবেড়া তোলা হয়েছে কেন? অবাক হয় সে! সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে–কেন এই ব্যবস্থা!

চাষীদের সঙ্গে তাঁবুঅলাদের সীমানা এভাবে নির্দেশ করেছে মানুষ। চাষীর ক্ষেতে যাতে তাবুর পশুরা হানা না দিতে পারে। পশুদের থানা বসানো হয়েছে। চাষীদের গ্রামের ভিতর। সমস্যা গুরুতর হলে ইহুদের ডাক পড়ে। তিনি বিচার করে দেন। চাষীরা তার বিচার মান্য করে। কারণ তিনি নবী। সবই সত্য। কিন্তু ইহুদের অনুগামী মরুভূমির মানুষ আজও আলাদা হয়ে রইল–একখানা তাবু পর্ণকুটিরে রূপান্তরিত হওয়া কী শক্ত!

তারবেড়া যেন সেই মরুভূমির সৈন্যশিবির। সাদইদ খুব আশ্চর্য হয়–সৈনিকরা এই ভোরে বর্শা ছোঁড়া অভ্যাস আছে; তাহলে কি যুদ্ধ শেষ হয়নি! নাকি চাষীদের ভয়ে অথবা চাষীদের ভয় দেখানোর জন্য এই বর্শাযুদ্ধের খেলা! আচ্ছা, একজন সৈনিক কি কখনও যুদ্ধ ত্যাগ করে না? একজন ভাড়াটে সৈনিক কি কখনও চাষী হয়ে ওঠে না? যে লোকটি একদা চাষীই ছিল সে কেন তার পূর্বের বৃক্ষের স্বভাব ফিরে পায় না? যে ছিল, সে থাকেনি, এ তার শাপলাগা জীবন, কিন্তু মরুভূমি তো আর নেই, সে এসেছে মাটিতে, তু কেন সে শস্ত্র অভ্যাস করছে? হঠাৎ সাদইদের রাত্রির দৃশ্য মনে পড়ল। কালো ঘোড়া বিদ্ধ। হয়ে চিৎকার করছে। বর্শার খেলা কি তবে কোন একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি।

একজন চাষী কাঁধে গামছা ফেলে খাটো লুঙ্গি পরে সামনে পথ ভাঙছে দেখে সাদইদ চোখের ইশারায় তাকে ডাকল। চাষীটি সামনে এসে মাথাটি খুঁকিয়ে সেলাম জানাল সাদইদকে। তারপর বলল–কী দেখছেন রাজা! ওই ভয়েই তো মরছি আমরা। ভেবে দেখুন, কে বেদে, কে নয় বলা যাবে না। কে আগে, কে পরে এই কানে থিতু হয়েছে, তারও সন তারিখ নাই। কতজন পরে এসে ঘর পেয়েছে, জমি পেয়েছে, বুদ্ধি আর গায়ের জোর! তবু মুশকিল আসান হল না। আকাশের মালিকরা, ওই দেবদেবীরা মানুষকে আলাদা করেছে, মুখের কথা। ভেন্ন ভেন্ন–এ প্রত্যয় সবার। কিন্তু ইয়াহুদ বেচারি হামলে মরছে, কী হবে কে জানে! কখনও বলছে, লড়াই ভুলে যেও না, কখনও বলছে অস্তর ধারণ করো না। কিন্তু একজন সেপাই কি অস্তর ছাড়ে!

একটু চুপ করে থেকে তাগড়া, কপাল-কাটা চাষীটা বলল–আপনাকে টিকে থাকতে হলে অস্তর শান দিয়ে রাখতে হবে। মোদ্দা হল, যুদ্ধের মুড়ো ল্যাজা নাই। শ্যাষ নাই রাজা। সেইটে আপনার শুঁটকি বনাম কাকড়া হতে পারে। উট বনাম অশ্ব কি ষণ্ড হতে পারে। পূর্বপুরুষ নোহু বলে গিয়েছেন সক্কল হল জীব। তিনি তোমার ভেলায় শুঁটকি মাছও রাখলেন, কাকড়াও রাখলেন। তাই কিনা!

–হ্যাঁ! তাই তো রেখেছিলেন! সাদইদ মাথা দোলাল।

হঠাৎ কোথা থেকে একজন ছোকরা চাষী ছুটে এসে বলল–আরে বাবা, নোহু অত বোকা ছিলেন না! খেয়েদেয়ে কাজ নেই মরা মাছ তুলতে যাবেন ভেলায়। কিন্তু কাকড়ার জান সহজে যাবার নয়। সেই কথা রাজাকে বলে

প্রথমে যে এসেছে, বয়স্ক চাষী, সে ত্বরিতে জবাব করল–সেই কথাই তো কইছি ভাই রাজাকে। আমরা মশাই, একটু-আধটু কাঁকড়া খাই। দুধও খাই কাঁকড়াও খাই। নোহু যে পদার্থ ভেলায়’ তোলেন নাই, সেই মরা জিনিস ছুঁই না! ওসব হল পূর্বদেশীদের অভিরুচি। আপনিই বলেন, কার গন্ধ খারাপ–যেটা মরা সেইটে, নাকি যেটা তাজা রইল সেইটে! ওরা কি বলে শুনবেন, কাঁকড়া হল, থলচরা, মানে মাটিচরা আর জলচরা–উভয়। সেইটে নাকি দোষ! আর গায়ে খালি খোসা। ওই কাঁকড়া নাকি মরুভূমি থেকে এসেছে! কথার কী মাহাত্ম্য দেখুন! আরে বাবা, মরুভূমি থেকে এসেছে বিছে। যত বিষ, সব এসেছে! পূর্বদেশীদের কাছে আমি সৃষ্টি-পুরাণ শিখব মনে করেছে! যা মুখে আসবে বলবে, ফেরাউনের রাজত্ব পেয়েছে কিনা! তা আপনার অভিরুচি একবার শুনতে পাই রাজা!

সাদইদের সহসা মনে হল, বয়স্ক চাষীটি তাকেও যেন বিদ্রূপ করছে। তবু সে হেসে ফেলে বলল–আমি তো রাজা! সমস্ত দেহে বিষ। কিন্তু জন্মেছিলাম এই মাটিতে। কার জন্য ভাড়া খেটে মরেছি জানি না। কে আমার ঈশ্বর তাও জানা নেই! কী খেয়ে বেঁচে থেকেছি তারও কোন বিচার করিনি কখনও। আমি শুধু একটা বীজ কীভাবে পূতলে সোজা হয়ে মাটি খুঁড়ে উঠবে সেই কথা ভাবি। আমি তোমাদের জন্য উন্নত চাষ কীভাবে সম্ভব, সেই নিয়ম চালু করেছি।

অবরুদ্ধ এক আবেগকে ঠোঁটের আড়ালে চেপে ধরে সাদইদ বলল–সব মানুষ মাটি চায়। মরুভূমি কেউ চায় না। অথচ যুদ্ধটা থাকে মরুভূমির বুকে। এখানে এসে আমি দেখলাম, মাটি কখনও রক্ত চায় না। সে চায় নিজেরই প্রলেপ। পলিজল। মাটির নিয়ম মাটিরই নিজস্ব। সে কারো মুখ চেয়ে বসে নেই। মানুষের রক্তের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। সে চেয়ে থাকে নদী আর বিশাল আকাশের দিকে। নোহ তাই আকাশ দেখেছিলেন,আর নদী। সেখানে বন্যার সংকেত ছিল। আমরা যাই খাই না কেন, দুনিয়ার শিশুরা মধু খেতে ভালবাসে। আমি চাই প্রচুর মধু আর দুধ। বাগান গড়ে না উঠলে স্বর্গের পথ। তৈরি হবে না–বিষ না মধু, এবার তোমরাই বল!

দু’জন চাষীই ঘাড় নিচু করে কথা শুনছিল। সাদইদের কথার কিছু তাদের বোধগামী ছিল, কিছু-বা ছিল না।

হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ছোকরা চাষীটা বলল–আপনাকে আমরা বলে রাখছি–ফসল এবার সাধারণ হয় নাই। চাষীর মন ভাল আছে। নববর্ষে দেবীর মণ্ডপে যেন সেপাইরা বিবাদ না বাধায়। আমরা নিজেদের ভিতর যত নষ্টামিই করি, সে আমাদের নিজস্ব রেওয়াজ। ওইদিনে একটু-আধটু মাতলামি হয়, ইয়ে হয়–যার যাকে ভাল লাগে মেয়েপুরুষ–বুঝলেন রাজা–বাপ-ঠাকুদ্দার জিনিস–নইলে মেঘ কী করে আসবে। মেয়েদের আগ্রহই বেশি। তাই বলে একটা সেপাই আমার পরিবারকে ধরে টানবে–এই অনাছিষ্টি সইব না! আপনি রাজা বলে মানি, ইয়াহুদ নবী বলে মানি। কিন্তু আমাদের দরবার উভয়ের কাছে।

বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলে যাচ্ছিল ছোকরা চাষীটি। সাদইদ আর চিন্তা করতে পারছিল না। তবু সে তার হৃদয়কে সংযত করে মুখে হাসি টেনে এনে বলল–তোমরা এত ভোরে এখানে কেন এসেছিলে!

একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বয়স্ক চাষী বলল–ওই একটু যুদ্ধ দেখা, কসরত দেখা!

ছোকরা হঠাৎ ধমক দিয়ে বয়স্ককে থামিয়ে দেয়–কী দেখি, না দেখি, অত বিবরণের কী আছে। তামাশা আর নাইবা করলে, চলো, উনি রাগ করবেন–হাজার হোক, তেনারই সব শিক্ষা! গত রেতে লোটার ঘোড়া চলে গিয়েছে, তাঁবুতে সবার মুখ পানসে হয়ে রয়েছে–দিনার আজ খেলতেই নামল না! বাসীমুখে মদ খাচ্ছে বেদম–কী যে হয়েছে! চলল, চলো!

ওরা হনহন করে চলে গেল। সাদইদ চাইল তারবেড়ার ওপারে। দেখল, দিনার এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুর দিকে এগিয়ে চলেছে টলতে টলতে। পা নড়াতে পারছে না। তার দিকে চাইছে পাগলের মত। ভয়ানক সেই চাহনি। হঠাৎ মনে হল, এই দিনারই কালো ঘোড়ার ঘাতক! মূর্তিও কি এই দিনারই ভেঙে দিয়েছে?

এই দিনার, যার জন্ম হয়েছিল উঠের পিঠে–ভাবা যায় না, ছেলেটা কী ভয়ংকর জোয়ান হয়েছে! চেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ সদইদের মনে করুণার উদ্রেক হয়। এই সেই দিনার যে কিনা উঠের পিঠে মসীহর লাঠির মত এতটুকু পুঁচকে, মাথাটা যেন পুঁটুলি–দাঁড়িয়ে থাকত দিনমান। কাঁদত, চেল্লাত। কেউ ওকে নামিয়ে নিত না। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় মিইয়ে গিয়ে থামত। সবাই। ওর মুখের দিকে দূর থেকে চেয়ে থেকে মজা পেত। ও নাকি গুনতে শিখেছে। উট গোনে। মেষ গোনে, ছাগ-ছাগী গোনে। মানুষ গোনে। তার নিজস্ব ভাষায়, যা সবার কাছে দুর্বোধ্য। শিশুদের ভাষা আসলে দুর্বোধ্যই হয়। সেই দুর্বোধ্য ভাষায় দিনার গুনতে পারত এক দুই।

দিনার গুনত মৃত্যু। একটি লাশ এল। দুটি লাশ এল। এভাবে উটের পিঠে মসীহর লাঠির মত দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি মৃত্যুর সংখ্যা নাকি গুনত। মানুষের এইরকম ধারণার . কোন হেতু পাওয়া যায় না। যুদ্ধের মানুষ শিশু সম্বন্ধে যে এধারা অদ্ভুত একটা গল্প চাল করে দেয় অথবা সেটা তারা সত্য মনে। করে–কেন করে তার কোন অর্থ বোঝা যায় না। তবে তাই যদি সত্যিকার ঘটনা হয়, তবে এই দিনারের মধ্যে কী একটা ভয়ংকর বস্তু নিশ্চয় গোপন আছে। যার ফলে সাদইদ তাকে ঘাতক মনে করছে–এইরকম মনে করাও হেতুহীন। অন্যায়। সে হয়ত জানেই না, লোটার ঘোড়া কখন কীভাবে মরুভূমিতে চলে গেছে।

তবে বিস্ময় অন্যত্র রয়েছে। চাষীরা তাঁবুপাড়ায় কালবেলা অনেকে কসরত দেখতে আসে। জালের আড়ালে আটকে থাকা ভাড়াটে সেনারা কী করছে এই তাদের কৌতূহল। ভয় করে। আবার ঘৃণা ও করুণাও করে মনে মনে। এভাবে মরুভূমি শেষ হয় না। মরুর জীবন ফুরায় না। মাটিতে মেশে না জীবন। মাটি আলাদা থাকতে চায়। একটা কুটির আর একটা তাঁবু আলাদাই থেকে যায়। মাটি ভয় করে। করুণা করে। বিদ্বিষ্ট হয়। অথচ দূর থেকে দেখে। একটি বৃক্ষ ছায়ানিবিড় চোখে যেন মরুপ্রান্তরের ঊষর বিকটদর্শন উটের মুখের ফেনার দিকে অপলক চেয়ে রয়েছে। ঠিক যেভাবে রিবিকার চোখ চেয়ে থাকে।

হঠাৎ সাদইদের মনে হল, রিবিকা কখনও তাকে ভালবাসেনি। লোটাকে সে বিয়ে করেছিল, সেটাই হয়ত রিবিকার শেষ স্বপ্ন। তাহলে কি স্বর্গ কখনও তৈরি হবে না! লোটা চিরকাল অদৃশ্য ঈশ্বরের মত মরুভূমিতে বিরাজ করবে? কখনও সে স্বর্গ এই মাটির উপর তৈরি হতে দেবে না?

সাদইদের ঘোড়া ছটফট করে উঠল। সে ছুটতে থাকল দিগ্বিদিক। কী আশ্চর্য! আবার ঘোড়াটি ভুল করে ভাঙা মূর্তিটার কাছে, বিধ্বস্ত লোটার কাছে চলে আসে। ঘোড়ার এমনধারা অবশ পাগলামি থাকে। পথ ভুলে যায় । যেখানে যেতে চায় সেখানে যায় না। সাদইদের রাগ হল, কেন ঘোড়া ভাঙা মূর্তির কাছে টেনে আনল তাকে? মাথা খারাপ হয়ে গেল! ঘোড়ার না তার–সাদইদ বুঝতে পারল না! হঠাৎ-ই সাদইদ অযথা সাদা অশ্বকে প্রহার করতে লাগল। প্রহার করতে করতে দেখল, ঘোড়া মাটির উপর শুয়ে গেছে। সাদইদ ক্রোধে আর প্রবল শূন্যতায় দিশে হারিয়ে ডুকরে উঠল। হঠাৎ মনে হল, এই অবস্থায় কেউ যদি দেখে, কী ভাববে! ঘোড়াকে কখনও সে মারে না।

হঠাৎ-ই চাবুক-ধরা হাতটা, যে চাবুক সে কোমরে বাঁটসুদ্ধ জড়িয়ে রাখে, ব্যবহার করে না, সেইসব, হাত এবং বাঁট সজোরে চেপে ধরল কেউ। অবাক হয়ে সাদইদ দেখল, হেরা একটি গাধার পিঠে চড়ে এসেছে এই ভোরে।

সাদইদ ভেঙে পড়ে বলল–দেখো হেরা! লোটার কী হয়েছে! তুমি ভাল করে দেখো, তোমার কষ্টের মূর্তিটা কেমন করে ভেঙে দিয়ে গেছে।

হেরা বলল–আরে, ওটা তো আমার বুকের মধ্যে আছে! যতবার ভাঙবে ততবার আমি ওটাকে বুকের ভিতর থেকে বাইরে টেনে আনব! তুমি ভেবো না। কিন্তু এই ঘোড়াটা মরে গেলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে! ওকে ছেড়ে দাও। সবচেয়ে দ্রুতগতির এই জীবটি তোমাকে আগলে রেখেছে সাদইদ! দাও, ছেড়ে দাও। পাগলামি করো না, দেখো, ও কীভাবে অসহায়ের মত শুয়ে গিয়েছে!

সাদইদ স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। এবং মনে হল, কালো ঘোড়াটির কথা কীভাবে সে হেরার সামনে পেশ করবে!

গাধাটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল–কালো ঘোড়াটা শেষে পাগল হয়ে মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছে। ঘোড়া এভাবে হারিয়ে যেতে পারে। ফের একদিন ফিরে আসবে দেখে নিও!

এবার আর্তনাদ করে উঠল সাদইদ–কী বলছ হেরা! তুমি কী বলতে চাও, রিবিকাকে আমায় ফিরিয়ে দিতে হবে! ঘোড়া কখনও ফিরবে না। ফিরতে পারে না!

সাদইদের কথা হেরা বুঝতে পারে না। ঘোড়ার সঙ্গে রিবিকার কী সম্বন্ধ? তারপর বুদ্ধিমান হেরার হৃদয় সমস্তই অনুভব করতে পারে। তার কাছে আলোকিত হয়ে ওঠে সাদইদের হৃদয়। মাথা নিচু করে হেরা।

–তোমার কথা ফিরিয়ে নাও হেরা!–সাদইদ পাগলের মত বলে।

হেরা কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। সাদইদ সাদা অশ্বটাকে খাড়া করে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে, সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হেরার মনে হয় তার বলার মত কোন কথাই যেন নেই।

হঠাৎ বলে–কারিগররা চলে যেতে চাইছে সাদইদ!

–না। অসম্ভব। যেতে পারে না। কিছুতেই পারে না। আমি বহু কষ্টে ওদের জোগাড় করেছি!

বলেই সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। দ্রুত বেগে কারিগর পাড়ায় এসে পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়। একা।

চিৎকার করে বলে–তোমরা যেও না। তোমাদের আমি কাজ দেব।

কারিগরদের মধ্যে একজন মাতব্বর বলে ওঠে–ইহুদ চান না আমরা থাকি। আমরা কী করব! কাজও তেমন পেলাম না। একটা নগর গড়ে তোলা সহজ নয় সারগন। আপনি চান ঠিকই, হয়ত একদিন কাজও আমরা পাব। কিন্তু এখানকার পুরনো বাসিন্দারা আমাদের ঠিক সইতে পারে না। আমরা সবাই বউ সঙ্গে আনিনি। কিছু কিছু এনেছি। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগছে, চাষার ছেলেদের অত্যাচারে বউরা মাঠে গিয়ে প্রাতঃকাজ করতে পারছে না, ছোকরারা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তখন ভোর পুইয়ে সাফ হয়নি, একজন চাষার বেটা কচি বউটাকে হামলা করে মাঠে পেড়ে ফেললে! দেখুন! আমরা নিরীহ লোক। আমরা ফরাতের তীরে ভাল সূক্ষ্ম কাপড় বানিয়েছি কত। এরা মোটা কাপড় বোঝে, পাতলা কাপড়ে ইহুদের আপত্তি আছে। ওদিকে কুমোর পাড়ায় গিয়ে দেখে আসুন! টালি বানাতে দিচ্ছে না। ভাঁটার গর্ত বুজিয়ে দিয়েছে। পাথরের উপর গর্ত করে একটা পাত্র বানানো হয় এখানে। কী মোটা কাজ! নিনিভের কুমোররা সূক্ষ্ম কাজ জানে। একটা ঘটির কী নকশা ভেবে দেখুন!

হেরা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিল। ওকে দেখে কারিগররা বলল–উনি আমাদের কতরকম নকশার কথা বলেন! কিন্তু এখানে সেসব সম্ভব নয়। আপনি দেশের উন্নতি করুন, তারপর আমরা আসব!

সাদইদ বলল–কিন্তু যাবে কোথায় তোমরা!

–অন্য কোন রাষ্ট্রে চলে যাব। আপনার সাধ আহ্লাদ আছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেই। টালির উপর নকশা করবেন হেরা, কিন্তু আপনার দেওয়াল কোথায়! সূক্ষ্ম কাপড় পরবে, তেমন মানুষ নেই। আমাদের এরা যাযাবর ভাবছে, কিন্তু এদের কোন শিক্ষাদীক্ষা আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ভাবছে, আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি! কতরকম অপমান সইতে হয়। মুখের ভাষা শুনে সেই ভাষার উপর টিটকিরি করার জন্য ছন্দবাঁধা বোল তৈরি করছে। আসলে আমরা কি যাযাবর, হেরা, আপনিই বলুন!

মাতব্বরের কথা শুনতে শুনতে হেরা বলল–আপনারা সাদইদের আন্তরিকতার মূল্য দেবেন আশা করি! দেখুন! আমার চেয়ে কর্মহীন আপনারা কেউ নন। কবে আমার কাজ শুরু করতে পারব কিছুই জানি না। এখানে কাপড়ের সূক্ষ্মতাই যখন বোঝে না, তখন আমার শিল্প কে বুঝবে! তবু রয়েছি, যদি কখনও হয়ে উঠে কিছু!

একজন বলল–এই তো আপনার মাটির ঘোড়াটা গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়ল । এখানে জিব্রিলের কোপ পড়েছে হেরা! অবশ্য আপনার ঘোড়াটা খুব বেড়ে হয়েছিল। মাটির হলেই বা হবে না কেন, পাথর হলে আরো দাম্ভিক দেখাত । দর্প জিনিসটা খারাপ। ইয়াহুদের কথা ফেলা যায় না। তাছাড়া এখানে সুতোও পাওয়া মুশকিল! বরং যা আছে তাই থাক। গম দিয়ে বণিকদের কাছে কাপড় কিনে নেবে এখানকার লোকেরা! মোটা কাপড়।

হেরা বলল–সূক্ষ্ম কাপড়ও তো দর্প, অহংকারের জিনিস ভাই! তোমার কথার ভিতর খাদ আছে!

মাতব্বর বলল–দেখুন হেরা, আহত হবেন না। সামান্য মানুষ আমরা । যেখানে ব্যবস্থা ভাল দেখব চলে যাব। নিনিভে আমার দেশ ছিল। ইয়াহহ জিব্রিলকে পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইয়াহুদ যখন চাইছেন না, আমরা থাকতে পারব না। চলো হে, চলো! বেলা চড়ে যাবে।

চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কারিগররা, সাদইদ কোন কথাই বলতে পারছে না। ভাবল, হেরা ভাবল নিজের সূক্ষ্মতাটা মানুষ বোঝে, অন্যেরটা ধরতে পারে না। অন্যের জিনিসে সে অহংকার খুঁজে পায়। যা সূক্ষ্মতর, তারই ভাগ্য খারাপ। তার যশ নেই, উপেক্ষা রয়েছে। তাকে মারবার জন্য রয়েছে জিব্রিল। অথচ এখন মুখ বুজে থাকাই ভাল। জিব্রিলই কি ঈগল পাখির মত আকাশে ওড়ে? একটা পাগলা পাথর যখন পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে, তা কি তখন জিব্রিলই ধাক্কা দেয়? কারিগররা যে চলে যাচ্ছে, কে টেনে নিয়ে চলেছে এদের? হেরা ভাবল, ইহুদের ধর্মটা মন্দ নয়! তাকে ঘোরতর অবিশ্বাস করলে কালো ঘোড়ার বদলে পাওয়া যায় একটি বেঁটে ধূসর গাধা-নিনিভের বদলে কনান। হেরা ভাবল, সেও কি তবে চলে যাবে কোথাও–এখানে অর্থহীন আয়ু ক্ষয় করার কি সত্যিই কোন মানে আছে? বাচ্চা এবং নিনিভাকে সে পেয়েছে, এবার রওনা দেওয়া যায়।

এমন সময়, সাদইদের কম্পিত একটা হাত হেরার কাঁধের উপর এসে আশ্রয় পায়। সাদইদের হাতটি যেন হাত নয়। হৃদয়। হৃদয় হেরাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। সাদইদের চোখ চিকচিক করছে। সেদিকে চোখ তুলে হেরা চোখ নামিয়ে নিল। এই সাদইদ তাকে মড়কের মুখ থেকে টেনে এনেছে। নিনিভাকে, শিশুকে উপহার দিয়েছে কুটির বেঁধে দিয়েছে। অথচ লোকটির কেউ নেই। রিবিকা এক মরীচিকা! লোকটি লোটার চেয়েও হতভাগ্য–সবই সামনে রয়েছে, সবই সে স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না। তথাপি আঁকড়ে ধরতে চায় । হেরা তার কাঁধের উপরে এসে পড়া সাদইদের হাতের উপর নিজের একটা হাত তুলে স্পর্শ করল। সাদইদ কেঁপে উঠল।

কারিগররা যখন চলে গেছে হেরা বলল-তবু তোমায় শুরু করতে হবে। সারগন।

অন্যমনস্ক সাদইদ চমকে উঠল। বলল–তোমার জন্য একটি সোনালী অশ্ব দরকার। তুমি, নিনি আর খোকাবাবু সেটায় চড়বে। উদ্বৃত্ত শস্য হবে অনেক। চাষীদের জন্য কাপড় আর তোমার জন্য ঘোড়া। ওরা বুঝল না হেরা! চলে। গেল!

সাদইদের কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়তে চাইছিল। ফের কাঁপা কাঁপা গলায় সাদইদ বলল–এখানে পাথরের ফলক বসাও হেরা। তাতে লিখে দাও, এখানে পৃথিবীর প্রথম আক্রমণের নীতি বর্জিত হয়েছে। অতীতের ইতিহাসকে এই পথ ঘৃণা করে। একটা বসন টাঙিয়ে দাও, রক্তাক্ত কাপড় নয়। কোন লোহিত কম্বল নয়। ভয় নয়। একটি প্রজাপতি নির্ভয়ে উড়বে এমন একটা ছবি ভেসে থাক সেই বসনের উপর।

হেরা বলল–ফের আমি লোটার মূর্তি গড়ে তুলব সাদইদ! কিন্তু আক্রমণ ছাড়া বাঁচা যায় না। তোমাকে একটি পুরু প্রাচীর এবং সৈন্যদল গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত রাখতে হবে প্রচুর সাঁজোয়া। প্রচুর অখ। মনে রেখো হিতেন মরেছে। কিন্তু হিত্তীয়দের বিনাশ হয়নি।

হেরার কাঁধ খামচে ধরল সাদইদ।

হেরা বলল–একটা ভারী কথা তোমাকে বলতে চাই। নগর গড়া আর ধ্বংস করা–তারই যোগফল হল সভ্যতা। যারা ধ্বংস করে এবং অধিকার করে তাদের কথা মানুষের মুখের কাহিনীতে থেকে যায়। মানুষ ধ্বংস করে নগর। ঈশ্বর ধ্বংস করেন স্বর্গ।

সাদইদ শুধালো–তাহলে গড়ে কারা?

হেরা বলল–তুমি সেকথা ভাল করেই জানো! নোহের সন্তানরা গড়ে।

–কিন্তু গড়ে তোলে কেন বলতে পারো?

–সেকথা সহজ করে বলা যায় না। বলাই হয়ত যায় না। আমি কেন লোটার অশ্বারোহী মূর্তিটা বানালাম বলতে পারব না। ধ্বংসের ব্যাপারটা বলা যায়। নির্মাণের ব্যাপার বলা খুব মুশকিল। অহংকার?

বলেই হেরা চাপা গলায় অদ্ভুত হেসে উঠল। তারপর বলল–দুটোই কাজ। ধ্বংস করা একটা কাজ। গড়া একটা কাজ। মানুষ কাজ করছে। যার যেমন ভাল লাগছে করছে। তুমি ভেবো না, তুমি গড়ছ বলেই খুব মহৎ। যারা ধ্বংস করছে তারাও সম্মানিত। ঈশ্বর স্বর্গ ধ্বংস করেছেন বলে তাঁর কিন্তু মড়ক হয়নি। যারা রাজা তারা ধ্বংস করে বলেই রাজা। ধ্বংসের জ্ঞান এবং বুদ্ধিকে তুমি উপেক্ষা করতে পারো না। আগে ভাল করে পিষে দাও, কোমর ভেঙে দাও, কপিকলে জুড়ে দাও, তারপর ফলকে লিখে রাখো, আমি একটি পশুকেও আঘাত দিইনি।

সাদইদ বলল–আমি কিন্তু আঘাত দিয়েছি হেরা!

হেরা বলল–সেটা কখনও ফলকে লিখে রাখবে না। একটা মানুষ দুমড়ে ভেঙে পড়ছে, থলি টানতে পারছে না, নুইয়ে পড়ছে, এটা আঁকবে মানুষ যাতে দুমড়ে নুয়ে পড়তে শেখে, ভয় পায়। ক্রমাগত ভয় সৃষ্টি করতে না পারলে তুমি কখনও সারগন হয়ে উঠতে পারো না। জীবন থেকে তুমি কিছুই শেখোনি সাদইদ। রাজা হিতেনের সন্ধিফলক তোমার মনে নেই?

–আমি কিন্তু একটি স্বর্গের কথা বলছি হেরা!

–সেটা ধ্বংস করার জন্য ঈশ্বর আছেন!

–তাহলে আমি কী করব?

–তুমি মরো!

বলেই হেরা সাদা গাধার পিঠে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। ছোট ছোট পা দ্রুত ফেলে ফেলে গাধা চলতে শুরু করল। তথাপি সাদইদের নগরনির্মাণের কাজ থামল না। আবার সে কারিগর, কাঠের এবং সুতোর কারিগর, মাটির কুমোর–সকলকে ধরে আনল। বাঁধ বাঁধবার চাষীদের, খাল কাটবার কুশলীদের সংগ্রহ করে আনল। ইহুদ আবার তাদের ভাগিয়ে দিলেন। হেরা কুমোরদের কাছে গিয়ে নকশা দেখায়। কল্পনা দেয়। নকশাদার একটা ভাঁড় রঙ করিয়ে পুড়িয়ে এনে দ্রাক্ষার রস পান করে পথের উপর দাঁড়িয়ে। মাথা পা টলমল করে। বাজে কথা বলতে থাকে–শালা সাদ! স্বপ্নের তোর সর্বনাশ করি রে সারগন! মধু টুপিয়ে পড়ে, দুধ গড়িয়ে যায়! ইয়ের্কি!

এই মত্ত অবস্থা তার কাটে না। সে বুঝতে পারে না এই যন্ত্রণার উপশম। কীভাবে হবে। রাত্রে ঘুম হয় না। বুকের ভিতরের নগরী তাকে স্বপ্নের ভিতর। টেনে নেয়। সে দেখে নগরী দাউদাউ করে পুড়ছে।

বাইরের দাওয়ায় শুয়ে আছে শিশু আর নারী। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সে। নারীর কাছে আসে, তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে নিনিভাকে সম্ভোগ করে–ঘরে আসে, মদ খায়। ঘুমানোর চেষ্টা করে। পারে না। ফের মদ খায়। আবার সম্ভোগ করে। বিছানায় শোয়। দুঃস্বপ্ন দেখে। পৃথিবীর সমস্ত মূর্তি ভেঙে পড়ছে। ঘুম চটে যায়। আবার সম্ভোগ করে। আবার মদ খায়। নিনিভা হেরার পায়ের উপর পড়ে গিয়ে বলে–তুমি পাগল হয়ে গেছ! আমি আর পারছি না!

রাত্রি-শেষে নেতিয়ে পড়ে হেরা। ভোর হয়। নিনিভারও ভয়ানক ঘুম এসে পড়েছিল। প্রত্যুষ জেগেছে। কিন্তু নিনিভার দেহ কিছুতেই জাগতে চাইছিল না।

ভোররাত্রির অন্ধকারে দুটি কালো হাত এসে নিনিভার কোলের কাছ থেকে শিশুকে তুলে নয়। ঘুমন্ত শিশুকে একটি গাছের গোড়ায় শুইয়ে দেয়। তারপর একটা ভারী ধরনের পাথর, যা ছুঁড়ে একদা মানুষ পশুকে ঘায়েল করত, তাই দিয়ে ঘুমন্ত শিশুর মাথা থেতলে দেয়। শিশু কেঁদে ওঠারও সময় পায় না। ঘুমের ভিতরই শিশুর মৃত্যু হয়।

মৃত শিশুকে ঘাতক গাছের গোড়ায় বসিয়ে দেয়। ঘাড় কাত হয়ে একদিকে কাণ্ডের উপর পড়ে থাকে। একই রাতে অন্য এক গাছের তলায় একইভাবে বসিয়ে রাখা হয় আরো একটি মৃতদেহ। সেটি এক দেবদাসীর।

সাদইদ ভোরে এসে হেরাকে মারতে মারতে জাগিয়ে তোলে, নইলে হেরা জেগে উঠতে পারত না। এই মার চপেটাঘাত মাত্র। চক্ষু টকটকে লাল। চোখ মেলল হেরা।

তার শিশু নেই। প্রথমে সে এই সংবাদ বুঝতেই পারল না। বারবার তাকে বলা হয়, খোকা নেই হেরা! তোমার শিশুকে কে একটা পাগল, জিব্রিল,মেরে রেখে গাছের তলায় ফেলে চলে গেছে। পাথরঅলা একটা লোক! বুঝতে পারো না, তোমার লকেট-ঝোলানোনা শিশুটি আর নেই। হতে পারে গর্ভবতী বউটাই হয়ত মেরে ফেলেছে। আপন মা তো নয়। সে কি আর মধু খাওয়াবে, গরলই গেলাবে!

Search

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন