মরুস্বর্গ-৪

জুম পাহাড় কোন উত্তর দিল না। আমার সমন্বয়ী অরমিক ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই। আর্তনাদ করেছিল সাদইদ। তার নিজস্ব পাহাড়ও কোন জবাব দেয়নি। শিশুর গলার লকেটটি সে ঝুলিয়ে রেখেছে সাদা অশ্বের কপালে। এই চিহ্ন ছাড়া জুম পাহাড়ী জীবনের আর কোন অবশেষ নেই। কোন দিগন্তেই লোটার সাক্ষাৎ মেলেনি।

ঈগল উড়ে আসা যত অলৌকিক, তারও চেয়ে রহস্যময় লোটার হারিয়ে যাওয়া। সে যেন পয়গম্বরের মত কোথাও চলে গেছে। মৃত রাজার নাকের কাছে একটি লাল ইঁদুর মরে পড়ে আছে। রাজার নাকের ভিতর ইঁদুরের গা থেকে নেমে চলে গেছে লাল পিঁপড়ের একটা স্রোত। রাজার এই মৃত্যুও অলৌকিক।

প্রজাপতির রেণুর মত তুচ্ছ এ জীবন রাজা! বিড়বিড় করে একলা নিঃসঙ্গ মরু-যাযাবর সাদইদ বলে উঠল। গাছের ডালে বসে থাকা কালো ভয়ংকর ঈগল ছাড়া সেকথা কেউ শুনল না। দিগন্তে মিলিয়ে গেছে মহাত্মা ইহুদের জনতা।

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। তারপর নিনিভের দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে দিল। চলতে চলতে সহসা তার দ্বিতীয় শিক্ষা শিবির, যেখানে সে আটাশ জন সৈন্য রেখে এসেছিল, যেখানে রয়েছে কিশোর সমেরু, মনে পড়ল সেকথা। সেখানে রয়েছে ক্ষুদ্র অরণ্য,সমুদ্রের হাওয়া সেখানে তবু লাগে–এখানেই সে রিবিকাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। শিবিরের ভিতর ঢুকে পড়ল সাদইদ। তাঁবুতে সামুদ্রিক হাওয়া এসে লাগছে। তাঁবু ফটাস ফটাস করে ক্রমাগত শব্দ করছে। যেন কোন ডানাঅলা প্রাণী।

অবাক হওয়ার শক্তিও সাদইদের ফুরিয়ে এসেছিল। সে দুই চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল। কেউ কোথাও নেই। সমস্ত শিবির জনশূন্য। অশ্বগুলিও নেই। দেবদারুর ডালে ঝুলে আছে সমেরুর মৃতদেহ। সাদইদ বুঝল এ আত্মহত্যা নাও হতে পারে। সমেরু একটি তাঁবুর তলে তার মাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। এমন সুন্দর কিশোরের সঙ্গে রিবিকার দেখা হল না। একটি মরুশকুন ডালে বসে সমেরুর গলিত দেহ থেকে মাংস খুবলে চলেছে। শকুনের গলার শব্দে গদগদ স্ফূর্তির চলকানি।

সাদা অশ্বের গায়ে হাত রেখে সাদইদের সমস্ত দেহ থর থর করে কেঁপে উঠল। সে অশ্ব চালনা করল মরুভূমির বুকে। সমস্ত দিনটা মরুভূমির উপর শেষ হয়ে গেল। মানুষের প্রবাহ চারিদিক থেকে ছুটে চলেছে দিগ্বিদিক! সাদইদ সমস্ত রাত্রি অশ্ব চালনা করল, কেবল মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছে গাছের তলে।

কয়েক দিন পর কোন এক অপরাহে নিনিভে পৌঁছে গেল সে। মড়কে প্রাণহীন নগরী। রাত্রি আসন্ন, আলো জ্বালাবার কেউ নেই। পথের উপর দিয়ে গান গেছে যাচ্ছে একজন। চওড়া সড়ক, প্রকাণ্ড শহর। লোকটা গাইছে,নাকি আর্তনাদ করছে, বোঝা যায় না।

‘আমার বীণা টাঙানোর দেওয়ালখানা কই?
ওহে সুন্দরী নিনিভে!
পুড়ে গেছে সব, জ্বলে গেছে সর্বস্ব প্রভু!
কোথায় তারকাঁটা পোঁতা দেওয়ালখানি–
আমার বীণাখানি যে ইনিয়ে বিনিয়ে ওঠে,
মহানগরী নিনিভে! নানভী, আমার নানভী!’

বীণার মীড়ে নগরীর শেষ স্তব্ধতা জমাট বাঁধছে! সাদইদ লক্ষ্য করল পথের উপর গাছের নিচে বসে একটি অদ্ভুত ধরনের লোক কী যেন মাটির ফলকের উপর লিখে চলেছে!

‘কাল যে বেঁচে ছিল আজ সে বেঁচে নেই,
একটু আগে যে গান গাইছিল,
সে এখন শোকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।’

[মেসোপটেমিয়ার কবিতা]

–এসব কেন লিখে রাখছ তুমি?

সাদইদ প্রশ্ন করতেই লোকটা চমকে পিছন ফিরে চাইল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটি বিষয়, কিন্তু কোমল। কেমন শুকনো করে হেসে বলল-আর কেন! এটাই আমার অভিজ্ঞতা কিনা! মড়কে উচ্ছন্নে গেল, দাগা খেল প্রচুর! সবাই চারিদিক থেকে এসে ধ্বসিয়েই দিলে। তবু মায়া হয়। দু’ ছত্র লিখে রাখলাম–যদি কখনও কেউ পড়ে, ভাববে–আচ্ছা কী ভাববে বল তো!

লোকটার কথার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ছিল। সাদইদ কোন জবাব দিতে পারল না। লোকটা আরো হয়ত কিছু লিখত কিন্তু হাতের খোদাই করার বাটালি ফেলে দিয়ে বলল–নিয়ে যাও, তুমিও নিয়ে যাও। এখনও যা রয়েছে, দু’একটা গ্রাম বসাতে পারবে। গরু! প্রচুর গাভী! ভেড়া! ছাগল! একটু গাঁয়ের দিকে গেলেই এসব পেয়ে যাবে। নেবার লোক নেই। সবাই পালিয়েছে। মড়ককে যদি ভয় না করো, মন্দিরে ঢুকে পড়ো। প্রচুর সোনাদানা। তবে খাবার ছোঁবে না! মারা পড়বে। জল খাবে না। বিষ।

একটু থেমে লোকটা ফের পাগলের মত বলল–আজ এখানকার মানুষকে কেউ নেয় না। তুমি তো সৈনিক। আমায় নিয়ে চলো । আমি তোমার গুলাম হতে চাইছি। একটা নগর কীভাবে গড়ে ওঠে? খরিদা গুলামের মেহনতে! চাষার বেগারিতে। চাচা খাটে বলেই একটা নিনিভে তৈরি হয়। কারিগর পাড়ায় গিয়ে দেখে এসো সবাই ধুকছে। কেউ তাদের নিতে চাইছে না! ক্রীতদাস মানে হল মেহনত। উল্কির দাগা মারা ঘোটলোক! তবু বলছি, আমায় নিয়ে চলো, আমি মরব না। আমার মড়ক হয়নি।

–আপনি অসুস্থ!

–নাহ! আমি অসুস্থ নই। আমাকে রোগ এখনও ধরেনি। কিসের মায়ায় এখনও পড়ে আছি এখানে! আমার যা বলার ছিল এতক্ষণ খোদাই করলাম। চলো। আমি ভয়ে জল অবধি স্পর্শ করিনি। যদি দ্রুত কোথাও নিয়ে না যাও, আমি বাঁচব না। আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাকে এই বাটালির মুখ থেকে হাতুড়ি থেকে একটা নগরী উপহার দেব। আমি পারি। যোদ্ধা নই। রাজাও নই। তবু পারি।

বলতে বলতে লোকটি তেষ্টায় জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। তার চোখ দুটি ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। মুদে আসতে চাইছিল।

সাদইদ ভাস্করের পাশে বসে পড়ে বলল–আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি হেরা! আপনি বিখ্যাত মানুষ।

সাদইদ হেরাকে চিনতে পেরেছে শুনেও হেরার চোখেমুখে তেমন কোন উৎসাহ দেখা গেল না। সাদইদ হঠাৎ মনে পড়ায় অশ্বের কপাল থেকে লকেটটা খুলে এনে হেরার হাতে দিতেই হেরার চোখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল খুশিতে। পর মুহূর্তেই হেরার মুখ ম্লান হয়ে গেল।

হেরা বলল–আমার ছেলে কি বেঁচে আছে? কী দিয়েছ ওর মুখে? বলেই হেরা সাদইদের বুকের কাপড় সজোরে খামচে ধরল।

সাদইদ শান্ত গলায় বলল–আছে। বেঁচে আছে। মধুই দিয়েছি।

–তবে এক্ষুনি আমায় নিয়ে চলো!

বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও পারল না হেরা। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বলল–জল!

অশ্বের পিঠে হেরাকে উঠিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে চলল সাদইদ। পিছন ফিরে একবার নগরীর দিকে চেয়ে দেখে বলল–তোমার একটা দেওয়ালও আর আস্ত নেই। তোমাকে লুঠ করব এমন অবস্থাও তোমার নয়। তবে যা পেলাম, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। সেলাম নিনিভে! সেলাম ডানাঅলা বৃষ!

অনেক দূর আসার পর সন্ধ্যা ঘনালো ঘোরতর। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার নিবিড় রাত্রি । গত রাতে একাকী সাদইদ পথ চলেছিল। কিন্তু আজ অসুস্থ হেরাকে সঙ্গে করে অতিঘোর অন্ধকারে পথ চলার সাহস তার হল না। একটি ক্ষুদ্র মরূদ্যান তার চোখে পড়ল। চারিদিক গভীর নির্জন। এখানে জল রয়েছে। হেরার মুখে জল তুলে দিল সাদইদ। হঠাৎ চোখে পড়ল জলাশয়ের জলে অঞ্জলি পাতার সময় অন্ধকারেই একটি উট তার গলা নামাচ্ছিল–সে সামনেই বসে রয়েছে। সামনের দুপা ভাঁজ করে মাটিতে ভেঙে প্রাণীটি পিছনের অংশ তুলে জলে মুখ নামিয়েছে।

অত্যন্ত তীব্রভাবে লোটার কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা, কেনই বা ওভাবে হারিয়ে গেল! ওই প্রাণীটির কথা ভাবলে লোটাকেই শুধু মনে পড়ে না–কত ভাবনার উদয় হয়। মরুভূমির মানুষ তৃষ্ণার সময় এই প্রাণীটিকে হত্যা করে এর শরীর থেকে জলের থলি বার করে নেয়। বাঁচার জন্য এমন নৃশংসতার কথা একজন চাষী ভাবতে পারে না। একে না মারলে জীবন বাঁচে না।

বেঁচে থাকার এই নীতিই যুদ্ধের নীতি । মানুষ পশুর কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে হত্যার মাধ্যমে। এ ভিক্ষা নয়, অপর অস্তিত্বকে মুছে দিয়ে নিজেকে টেকানোর নামই যুদ্ধ। মানুষ যখন এভাবে বাঁচার শিক্ষা পায়–অন্য কোন উপায় ভাবতে পারে না, তখন যুদ্ধের নীতি হয়ে ওঠে আক্রমণলুঠ, হত্যা, বিনাশ। এই নীতি মানুষ তৃষ্ণা ও খাদ্যের বেলা যেমন পশুর উপর প্রয়োগ করে, তেমনি মানুষের উপরও প্রয়োগ করে।

এই নিয়মের বাইরে কি কিছু নেই? হিতেনকে হত্যা না করলে কি লোটার বাঁচা হয় না! লোটাকে না মারলে কি হিতেনের বাঁচা অর্থহীন হয়ে যায়। একটি নগর ধ্বংস না হলে কি আর একটি নগর গড়ে ওঠে না। জীবন কি মরুভূমি মাত্র! অঞ্জলিবদ্ধ হাত জলে ছোঁয়ানোর সময় সাদইদ লক্ষ্য করছিল উটটি সমান তালে মুখ নামাচ্ছে জলে।

উটের কোন গৃহ নেই। তাঁবুর পাশে তার নগ্ন আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকা কাঠামো–সে শূন্য মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে থাকে একা। লোটা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। উটকে মানুষ একটি কুকুর কি অশ্বের মত ভালবাসে না। তাকে ঘর দেয় না। স্নেহ দেয় না। তৃষ্ণার জল নেয়। হত্যা করে। তার পিঠে রতিবিহার করে। উটের কাঠামো শিল্পহীন, অশ্বের মত তার দেহে আকাশ ঝিকিমিকি বিদ্যুৎ নেই।

চাঁদ না হলে রাত্রি পার হওয়া যায় না। দিনে অশ্বারোহণ, রাত্রে বিশ্রামকতকাল এভাবে, আর কতকাল?–অন্ধকারে মুছে যাওয়া আকাশে চোখ তোলে সাদইদ। বহু দূরবর্তী এক নিঃসঙ্গ তারকা জ্বল জ্বল করে–যেন লোটার চোখ। সাদইদের এত কষ্ট হচ্ছিল যে,বুক ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। উটটা মরূদ্যান ছেড়ে অন্ধকার মরুভূমিতে নেমে চলে গেল–যেন একটি কবর ভেসে গেল, মানুষের মৃত্যু-গহ্বরের ভূপ। এই গহ্বরে তলিয়ে গেছে নগরী নিনিভে।

একজন চাষী ফলবান বৃক্ষের কাছে যা শেখে, একজন মরুভূমির যাযাবর তা কখনও শিখতে পারে না। গাছ মাটির তলে ‘আপন হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে। নিজেরই জ্ঞানে শেকড় চালিয়ে দেয় রস টেনে নেয় দেহে, পাতার আড়ালে রচনা করে পুষ্প, দিয়ে তৈরি করে রসালো ফল। গাছ কোথাও যায় না। সে চুপচাপ ফুল ও ফল তৈরির ধ্যান করে, শেকড় ক্রমশ প্রসারিত করে। নিঃশব্দে–সে কখনও হুংকার দেয় না, আর্তনাদ করে না অযথা। একজন চাষী তাই কোথাও যেতে চায় না–সে ফোঁটাতে এবং ফলাতে ভালবাসে। অথচ রাজারা, দাসমালিকরা নগর গড়বার জন্য তাদের জমি থেকে উৎখাত করে নিয়ে যায়। কপিকলে জুড়ে দেয়। আর একজন যাযাবরকে পাকড়াও করতে পারলে মিশরের রাজা পিরামিড বানানোর পাথর বহন করিয়ে নেয়–তারা কবরের পাথর টানে উটের পিঠে করে। অথচ লোটা বৃক্ষের মত একটি নারীর ছায়ায় আশ্রয় চাইত।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মুখটা, তার নগ্ন প্রজাপতির ছবি মনে পড়ে গেল। দিনের পর দিন ধূসর দিগন্তহারা মরুভূমি মানুষকে কী দিতে পারে? না কোন শিল্প, কোন বৃক্ষচরিত্রহায় প্রজাপতি!

আবার ভোরবেলা মরুভূমির বুকে নেমে এল হেরা আর সাদইদ। এভাবে ওরা কতদিন চলেছে খেয়াল ছিল না। কিন্তু মরুভূমি আজ আর দৃশ্যহীন নয়। একটি স্থির ছবি যেন অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। প্রায় স্থিরই বলা যায়। গরুবাছুর ছাগছাগী মেষ গাভীর দল অল্প অল্প লেজ নাড়ছিল বৃক্ষগুলির ছায়ার নিচে। বড় গাছটির তলায় মুখ খুঁজড়ে পড়ে আছে শিকড়ের আড়ালে একজন। যেন কোন মসীহ।

মুখটা শিকড়ের ভিতর গোঁজা। এতগুলি পশু নিয়ে লোকটা কোথায় যাচ্ছিল? পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চাষীর মতই খালি গা। খুব মেহনত করেছে বোঝা যায়। কিন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? নিনিভে থেকেই লোকটা দূরপাল্লার পথে নিশ্চয়ই যাত্রা করেছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন মসীহ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সাদইদ ডাকল–অ্যাই শুনছেন! ওহে, এদিকে একবার দেখুন?

মুখ গোঁজা বেচারি কোনই সাড়া দিল না। এমনকি নড়ল না অবধি। সাদইদ বার কতক ডাকার পর ঘোড়া থেকে নেমে এল। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এল কালো অশ্বটি। দ্রুত পড়ে থাকা মানুষটির গায়ে মুখ রেখে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অশ্ব স্থির। যেন সে শ্বাস নিতেও চাইছে না। সাদইদ অশ্বটিকে চেনবামাত্র মুখ গোঁজা লোটার কাছে ছুটে গেল। ঘোড়া সাদইদকেও চিনতে পেরেছিল। গা ধরে মুখটা চোখের উপর টেনে আনল সাদইদ। কষে রক্ত গড়ানো ফর্সা মুখ নির্বাপিত, পীতবর্ণ। ক্ষণকাল আগে রক্তাভায় জুলজুল করছিল, ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছে–দু চোখ মুদিত। লোটা জীবিত নেই। এভাবে অবশেষে এইভাবে দোস্ত!কথাগুলি উচ্চারণ করতে গিয়ে অভিমানী শিশুর মত সাদইদের ঠোঁটদুটি প্রবল আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল।

হেরা বলল–আকছার এমনটা ঘটছে সাদইদ! নিনিভের অভিশাপ আছে, সে পৌঁছতে দেয় না। দ্যাখো, একটু দূরেই তো গ্রাম শুরু হয়েছে! অথচ বেচারি আর যেতে পারল না। কত মানুষ এরকম রাস্তায় পড়ে রইল তার ইয়ত্তা হয় না।

কিন্তু তাই বলে লোটা এভাবে থেমে পড়বে। ও হয়ত মৃত্যুর একদণ্ড আগেও ভেবেছে, রিবিকার কাছে পৌঁছতে পারবে। ওর বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন। আগে। ও রিবিকার জন্য ধর্ম অবধি ত্যাগ করেছিল। এই পশুগুলি সে প্রচণ্ড মেহনত করে জোগাড় করেছে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে টেনে এনেছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। হেরা বোঝে কিনা জানা নেই, যে মানুষ মড়কের ভিতর থেকে পশুদের জোগাড় করে আনে, রাজা হিতেনকে বর্শায় গেঁথে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটায় নিনিভের দিকে, তার থেমে পড়া উচিত নয়। এই মুহূর্তে তার জেগে উ পণ্ডদল তাড়িয়ে নিয়ে দিগন্ত পার হয়ে গ্রামে পৌঁছনো দরকার। লালমুখো ইঁদুর যখন দেখা দেয়, তখনই মড়ক লাগে–পশুর দিকে চেয়ে মানুষের কতকিছু জানতে হয়। মানুষের মড়কের সংবাদ বহন করছে লাল ইঁদুর–একথা লোটা নিশ্চয়ই জানত! সে জেনেশুনেই, ইঁদুরের সংকেত পেয়েও, রাজা হিতেন রিবিকাকে ছিনিয়ে না নিয়ে, লোটাকে বধ না করে ফিরে যেতে চাইল, পারল না–সমস্ত সংকেত জানা ছিল–সংকেত পেয়েই লোটা লাফিয়ে চড়ল ঘোড়ায়। ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল লোটা। লোটা শেষ হয়ে গেল।

–এখান থেকেই তোমাকে শুরু করতে হবে সাদইদ। ঠিক এখান থেকে। চমৎকারভাবে বলে উঠল স্থপতি হেরা–নিনিভের নির্মাতা।

একথা শুনে তামাম প্রত্যঙ্গ বিপুল এক বেগে, হৃদয় এক মহাভাবে আন্দোলিত হতে লাগল সাদইদের। এই মরুমর্ত কী নিঃসীম তৃষ্ণা জাগায়–এ তৃষ্ণা জলে মেটে না। নারী, শিশু এবং শিল্পেও মেটে না–একটি প্রজাপতির ইন্দ্রধনুর রঙেও সেই তৃষ্ণা ছড়ানো থাকে–এই বাঁচা যে কী, কেউ জানে না। লোটা যেভাবে মরে পড়ে রইল, সেই তৃষ্ণার কী রূপ,কোন ভাষায় তা আঁকা যায় না। সে পৌঁছতে চেয়েছে; ফিনিসীয় বর্ণমালায় তার বিবরণ নেই, হাম্বুরাবির অনুশাসনফলকে তার হদিস নেই, আমারনার পত্রাবলীতে তার ঠিকানা মেলে না। উগারীতের সাহিত্যে, মেসোপটেমিয়ার কবিতায় তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। তবু এখান থেকেই শুরু করতে হবে।

লোটার গায়ে হাত দিল সাদইদ। হিম। খাস স্তব্ধ। সে শিশুর মত মুখ গুজড়ে পড়ে ছিল। যেন সে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন এভাবে পড়ে থাকা লোটা? লোটা কোন উত্তর দিল না। এই পশুদল নিয়ে তুমি কী করতে, আমায় বলে দাও। তোমার অশ্ব রইল, যাকে নিয়ে তুমি একলা খেলা করতে। কত অপরাহু কত প্রভাত তুমি একলা খেলা করেছ, আমার বানানো ভাষা তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা পারে না। ভাষার উর্ধ্বে থাকে হৃদয়।

সাদইদ সহসা লক্ষ্য করে কালো অশ্বের কপালে একটি মাটির ফলক। ভাঙাচোরা নকশা আঁচড় কেটে কেটে তৈরি, খুবই পুরাতন নকশা, একজন রাজার ছবি, অনেকটা ফেরাউনের মত, পায়ের তলায় দেবী ইস্তারের নগ্নমূর্তি। এ দেবী রিবিকা ছাড়া কেউ নয়।

অপটু হাতে মৃত্যুর আগে একজন যাযাবর একে রেখে গেল। ফলকে হাত রেখে হেরার দিকে ঈষৎ বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা পানসে হেসে বলল–তোমার বন্ধু খুব উচ্চাশী ছিল মনে হচ্ছে। সে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখত।

–না হেরা। আপনি নোটার অভিপ্রায় বুঝবেন না।

–কেন?

–-ও এঁকেছে ওর স্ত্রীর ছায়া। সে যেন তোটাকে স্বীকার করে। এতগুলো পশু নিয়ে সে ফিরছে, সে রাজা ছাড়া কী? কী আশ্চর্য! কোন দেবদাসী কখনও ওকে সারগন বলে ডাকেনি!

ক্রমাগত লোটার স্মৃতি মরু আকাশের ভাসমান মেঘের পতিত ছায়ার মত দিগন্ত ছুঁয়ে ছুটে আসছিল। কালো ঘোড়ার কপালে ঝোলানো ফলক লোটা পরম আহ্লাদে পথ চলতে চলতে সংগ্রহ করে উৎকীর্ণ করেছে। এ ফলক শিলার মত মসৃণ। সহজে আঁচড় পড়ে। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সাদইদ হাতে ধরা ফলক ছেড়ে দিয়ে বলল–তাহলে এখান থেকেই শুরু!

হেরা বলল–একজন যাযাবর ঠিক এখান থেকেই শুরু করে কিনা! ফেরাউনের রাজসভায় এমন অনেক যাযাবর মন্ত্রিত্ব করেছে, যার হাতে উটের লাগাম ধরা ছাড়া ধরবার কিছুই ছিল না। লোটা যদি একজন চাষী হত, কখনও মড়কের শহরে পা দিত না। দুঃখিত সাদইদ, একথায় আমি কিন্তু তোমায় কোন ইঙ্গিত করিনি।

অসহায় আর করুণ চোখ দুটি তুলে সাদইদ হেরাকে বলল–তুমি শিল্পী তোমার তো অহংকার থাকবেই। স্ত্রী মরেছে মড়কে, শিশু হারিয়ে গেছে। তথাপি বাঁচালতার কোন কামাই নেই। ইহুদের অহংকার লাঠি, ফেরাউনের পিরামিড, তোমার অহংকার ছেনি, বাটালি। কিন্তু লোটা? ওর ছিল উট। এই কালো ঘোড়াটা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ফলে উটের পূজারী কখনও। মাথা তুলে কথা বলত না। ওর ছিল সাহস–তাই সে মড়ককেও ভয় পায়নি। যাক গে। লোটার ঘোড়াটা এবার তুমি নাও। তোমায় দিচ্ছি।

হেরা কেমন অসহায়ের মত ব্যস্ত সুরে বলে উঠল–না না। ওটা তুমিই নাও । আমার এই সাদাটাই ভাল। বেশ আছি এটার পিঠে!

–ওটা ভাল নিশ্চয়। এটাও খারাপ না। তবে সাদাটা কিঞ্চিৎ বজ্জাত। তোমায় ফেলে দিতে পারে।

–না না। ফেলবে কেন! আমরা তো ধীরে ধীরে যাব। এতগুলো জীবকে তো খেদিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

–সে আমি দেখব’খন তুমি কালোটার পিঠে উঠে পড়।

–না সাদইদ । আমায় বিরক্ত করো না। বলছি তো সাদাটায় বেশ আছি।

–আমি যা দিতে চাইছি, তোমার তাতে আপত্তি কিসের?

কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে হেরা বলল-লোটার অশ্ব! ভেবে দ্যাখো, সেটা কী হতে পারে। তা ছাড়া লোটা অসুস্থ ছিল বন্ধু সাদ! মিতে তোমায় গোপন করব না–তোমার মিতবউ মড়কে মরেছে–একটা লাল ইঁদুর কী ভয়ানক। আমায় ওভাবে বারবার তাগাদা দিচ্ছ কেন? একটা অসুস্থ উট-উপাসক ভাড়াটে সেনা–মানে, তুমি ঠিক বুঝবে না, আমি কী বলতে চাইছি! ইঁদুর কী ভয়ানক। তা ছাড়া উট-উপাসক! মানে ঠিক তোমায়…

–অ। ঠিক আছে!

দণ্ডভর দম বন্ধ রেখে সাদইদ দিগন্তের আবছা গ্রামগুলির দিকে চাইল। চেয়েই থাকল। তার চোখ অপ্রতিরোধ্য অশুতে ছলছল করে উঠল। শান্ত গলায় সে বলল ঠিক আছে। এখান থেকেই যখন শুরু করতে চাই! নাও, তুমি সাদাটায় গিয়ে উঠে পড়। আমি লোটার ঘোড়ায় চড়ছি। আমাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। যদি তাই হত, তাহলে তোমাকে সঙ্গে নিলাম কেন? মড়ক আমাকে ধরবে না স্থপতি!

শেষের বাক্য দুটি সাদইদের গলার খাদে বুজে গেল। ততক্ষণে শ্বেত অশ্বের পানে এগিয়ে গিয়েছে, হেরা শুনতে পেল না।

সাদইদ কালো অষের পিঠে চড়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল নিঃশব্দে। তারপর সে তার অনভ্যস্ত গলায় যাযাবরী স্বর নকল করে চিৎকার করে উঠল–হরররররহু! হরররররহ্! হাহা! হিররররর হে! হিরররর ইহ! হো হো! উররররহ্! হট হট হাঃ! হা হা হ্!

কালো অশ্ব পশুদলকে খেদিয়ে নিয়ে চলল। পড়ে রইল লোটার নিষ্প্রাণ দেহ। বৃক্ষের ডালগুলি মরুশকুনের ভিড়ে থিক থিক করছে। চোখগুলি হলুদ রেখার বৃত্তে তালশাঁসের ভিতরের জলের মত টলটলিয়ে উঠছে।

গ্রাম ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। সবুজ গাছপালার নিবিড় ছবি। এই তার জন্মভূমি। সেই জন্ম যেন কিংবদন্তীর মত । পিতা নোহ কখনও এখানে ছিলেন নশ্চয়। মিশরেও ছিলেন তিনি। তিনি রয়েছেন রক্তে আর নিঃশ্বাসে।

সাদইদ মনে মনে বলল–এই জীবগুলি সবই লোটার দান পিতা। এদের তুমি রক্ষা কর। হেরার পুত্র যেন বেঁচে থাকে।

.

০৮.

দ্বিতীয় পর্ব

তারপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে মধুদুগ্ধের দেশে। রিবিকার সঙ্গে সাদইদের দেখা হয়নি। সাদইদ তার জীবন শুরু করেছিল একটি বৃক্ষের মত। একটি ছোট গ্রামে নদীর তীরে ছোট কুটির বেঁধেছিল। চাষীর চোখে ছিল তার প্রতি ঘৃণা আর করুণা। পশুদল নিয়ে সে প্রবেশ করেছে, যাযাবর যেমন প্রবেশ করে। রাত্রির অন্ধকারে হানা দিয়েছিল যেন সে। চাষীরা তার পশুগুলি কেড়ে নিয়ে বলেছিল–যা ভাগ! এ লোক যুদ্ধ বাধাবার জন্য এসেছে নিশ্চয়। শোন ভাই, এখানে ওসব চলবে না।

মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চাষীদের সাদইদ বলল–পশুগুলি আমি তোমাদের জন্যই কষ্ট করে এনেছি। আমি যুদ্ধ-ফেরত একজন সাধারণ সৈনিক। চাষবাস জানিনে। এই সব গরু আমার কোনই কাজে লাগবে না। তোমরাই রাখো। তবে আমায় তাড়িয়ে দিও না। এ আমার বন্ধু হেরা। নিনিভের লোক। ওর বউ মড়কে মরেছে। শিশুপুত্র হারিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটিকে আমরা খুঁজছি। আমাদের আশ্রয় দাও। মহাত্মা ইহুদের কাছে আমাদের ছেলেটি রয়েছে, ওঁর এক মেয়ের কোলে আমরা তাকে দিয়েছি।

–কোন্ মেয়ে সেকথা বলবে তো! তাঁর কি মেয়ের শেষ আছে? অবিবাহিত ইহুদের চোখে মেয়ে মাত্রই হয় মা, নয় মেয়ে। অতএব সঠিক করে বলতে হবে কার বউ, কার কী, কোথায় থাকে–গ্রামের নাম–সবকিছু বলতে হবে! ইহুদ থাকেন পাহাড়ে–কোন্ পাহাড়ে তাও আমরা দেখিনি। কত শিশুই যে তাঁর দয়ায় বেঁচেছে! তিনি তো মহাপুরুষ! হলফ করে বলতে পারি ওই ছেলে নষ্ট হয়নি। মহাত্মা বহাল রাখেন, নষ্ট করেন না!

একজন মধ্যবয়স্ক চাষী গড়গড় করে বলে যেতে লাগল। একজন বৃদ্ধ তাকে সমর্থন করে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক! মড়কের মুখ থেকে তিনি রক্ষা করেন, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচান। রাজা হিতেনের অতবড় সৈন্যদল তাঁর লাঠির ইশারায় মাটিতে শুয়ে গিয়েছিল, আর ওঠেনি! রাজা মুখে রক্ত তুলে পথের ওপর পড়ে গেল। সেই যে পড়ল, আজও পড়ল, কালও পড়ল। বলি কি, ছেলে নিশ্চয় আছে, নষ্ট হয়নি।

মহীপাল নামে একজন সম্পন্ন কৃষকের গোয়ালে গরুগুলিকে লোকেরা বেঁধে দিল–ভেড়াগুলিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বলল–যাও, ঢুঁড়ে দ্যাখো!

এইভাবে মধুদুগ্ধের দেশ সাদইদ আর হেরাকে অভ্যর্থনা জানায়। হেরা ধৈর্য, রিয়ে বলে ওঠে–শিশুকে আমি আর পাব না সাদ!

–পাবে। নিশ্চয় পাবে। অতবড় একটা নগরের স্থপতি তুমি। একদিনে সই নগরী গড়ে ওঠেনি। তুমি কত ধৈর্যে সেই রূপ তোয়ের করেছ। আগে কিটু ঠাঁই দরকার। তারপর শিশুকে খুঁজব আমরা।

–ঠাঁই তুমি কোথাও পাবে না! তখন সেদিন রাগ করেছিলে, এখন দেখলে তা যাযাবর ভাড়াটে সৈনিকের কোথাও জায়গা নেই। মড়কের নগরী থেকে সেছি বলে এই একটা ভাঙা কুঁড়ের কাছে ফেলে রেখে ওরা দিব্যি চলে গেল! লো ফিরে যাই।

–কোথায় যাব! জীবনভর এই একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছি হেরা! সন্যদের বলতাম যদি কখনও একটা গ্রামের অধিকার পাই… থাক সে কথা। এলাম তো যাযাবরের মত। অথচ এ আমার নিজের জন্মস্থান। কেউ আমায় চনে না। আবার আমি মরুভূমিতে ফিরে যাবো! সেই তাঁবুর জীবন, সেই উটের গাম ধরে পথ চলা।

–তাহলে ইহুদের শরণাপন্ন হও। তার ধর্ম গ্রহণ করো।

–অসম্ভব!

–কেন?

–ইহুদের ধর্ম মরুভূমির ধর্ম! মাটি ছাড়া মূর্তি হয় না। ভেবে দ্যাখো!

–হ্যাঁ! সেকথা ঠিক।

–বালি মুঠো করলে মূর্তি তো হবে না!

–না।

–মরুভূমি একঘেয়ে। ধূসর। যতদূর চাও কোন ছবি নেই।

–নেই বটে।

–ইহুদের ধর্মের ঈশ্বর পাহাড়ে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। আছে কবল আগুন-ঝরা দুটি চোখ। চোখ দু’টিও দেখা যায় না। কল্পনা করা যায় ত্র। রূপ মানে তো মাটি। মানে গ্রাম + ছবি। ঠিক তোমায় বোঝাতে রছিনে।

–বুঝতে কিছুটা পারা যে না যায়, তা নয়। তবে সেই ইহুদই জিতে গছেন। মূর্তিহীন ঈশ্বরই সব দখল করেছেন–এখন তুমি কী করবে!

–তবু রূপ যে খুব গুরুতর বিষয় হেরা! তা যে একটা প্রজাপতি!

–তোমার কথা আর বোঝা গেল না।

–আমিও ঠিক বুঝি না, বালিতে মূর্তি হয় না কেবল এটুকু তোমায় বলতে পারি। দ্যাখো, রূপ, আকৃতি, জ্যামিতি, একটা ছায়া–এসব আমার চাই। পরমায়ু যখন ফুরায় তখন একটা পিরামিড খাড়া হয়। পাহাড়ের গুহায় আঁক শিকার শিকারী–এ তো ছায়া। নিনিভের গায়ে আঁকা রাজা চলেছে মৃগয়ায়–রাজা থাকল কি গেল সেটা কথা নয়। ছায়াটাই আসল। রূপ তাছাড় কী? তুমি কেন আমার সঙ্গে এসেছ! নিনিভে নেই। কিন্তু তোমার হৃদয়ের ভিতর সেটা দেখতে পাও! পাও না?

–পাই।

–তবে? বল, এমন কেন হয়! আমি কেন দুটি প্রজাপতি আর লোটার করুণ মুখখানা ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনে। লোটা হিতেনকে বশবিদ্ধ করে মারে। এইজন্যই মারে যে,রাজা হিতেন তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে বধ করতে চেষ্টা করে। সেই সময় আকাশ ছেয়ে যায় ঈগল পাখিতে-পাখিরা মড়ব সংকেতকারী লাল ইঁদুর নখে ধরে উড়ে আসে, কারণ ইঁদুর তাদের খাদ্য। ভয়ে রাজা তার দলবল নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে–ছুটে চলেছে–এমন সময় লোট বশ ছোঁড়ে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। তারপর লোটা পশুদল নিয়ে বালি ছেড়ে মাটির দিকে যাচ্ছিল। সে একটা ছবি হতে চাইছিল। আকাশে একটি যুদ্ধ চলছিল ঈগলে আর ইঁদুরে। নিচে ঘটছিল হিতেন আর লোটার যুদ্ধ। তাহলে বল, এখানে ইয়াহোর ইশারা কোথায় ছিল!

হেরা অনেকক্ষণ মুখ বুজে থেকে বলল–তোমার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক কিন্তু কারো কাছে সেটা স্বাভাবিক না-ও হতে পারে। ক্রমাগত যুদ্ধ সমস্ত রূপ আকৃতি, ছবি, জ্যামিতি, তাঁবু, গৃহ সব–সমস্ত ভেঙে দেয়। তামাম কিছু অদৃশ করে দেয়। তাহলে অদৃশ্য একটা জগৎ আছে কোথাও। ইহুদ মনে করেন ইয়াহো সেই জগতে থাকেন। তোমাকেও ভেবে দেখতে হবে এসব কথা লোটা ছিল, লোটা নেই।

সাদইদ হেসে ফেলে বলল–এভাবে আমায় বোঝাতে পারবে না হেরা! য কিছু অদৃশ্য হয় তা মানুষ আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। সব ছবি । এবং তা আরো সুন্দর করে আনতে পারে। সব রূপ। সমস্ত।

–হ্যাঁ পারে! পারে বইকি!

বলতে বলতে দূরে কুটিরের আলোর দিকে চাইল হেরা। একটি বউ ছোট মশাল ধরিয়ে আলোর শিখার দিকে উপরে চোখ তুলে চেয়ে আছে। অন্যমনস্ক সুরে হেরা অতঃপর বলল–কিন্তু লোটা আর ফিরবে না!

–সে তো ইয়াহোর ইচ্ছে! সেই ইচ্ছেয় আমার আগ্রহ নেই। কারণ লোটাকে ফেরানোর ক্ষমতা আকাশের খোদারও নেই। রেগে যেও না স্থপতি! যা তিনি ফিরিয়ে দেন না নিয়ে ব্যাখ্যা চলতে পারে কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় অদৃশ্য জগৎটা অদৃশ্যই থেকে যায়–আলো পড়ে না সেখানে। সেই অন্ধকার আমি চাই না।

–রেগে তো তুমিই গেছ সাদইদ! তর্ক তুমিই করছ!

–তর্ক তো এক মুখে হয় না। যা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি, সেই অদৃশ্য জগতের কথা তুললে! বরং একটি বীজ থেকে একটি গাছ কীভাবে উঠে আসছে, সেই পর্যবেক্ষণ অনেক সুন্দর। তোমার শিশুকে যেদিন নলখাগড়ার কাগজে তৈরি নৌকা, উপহার দিলাম–সেদিন সে হেসে উঠেছিল। আজও সেই হাসি দেখতে পাই। এর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! এই নৌকা আমার পিতা নোহ বানিয়েছিলেন। জীব এবং বীজের সুরক্ষার জন্য। আমি কাগজের নৌকা বানাতে বানাতে ভেবেছি আসল নৌকা জ্যামিতি মাত্র কাঠের বাহু ছোটবড় করে গাঁথা–এই বুদ্ধি নোহের ছিল।

হেরা বলল–কিন্তু এখন আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সাদ। ভয়ংকর রাত। কড়িয়ে শীত পড়বে! বাঁচব তো? দাঁড়াবার মত মাটিও যে পাইনি!

একটু ভেবে হঠাৎ সাদইদ বলে উঠল–একটা উপায় হতে পারে হেরা! চলো ওই বউটার কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি! যুদ্ধ নারীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষয় করে–কিন্তু চাষীর ঘর–দয়ামায়া থাকতে পারে! একখানা কাঁথা যদি দেয়, রাতটা তাহলে কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারব!

কাঁথা চাইতে গিয়ে আশ্চর্য ঘটনা হয়! বউটি ওদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে মেঝেয় পড়ে থাকা কাঁথা জড়ানো এক বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তোলে। বৃদ্ধা ঘুম জড়ানো চোখে সাদইদকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়। এ যে সাদইদ! সারগন!

বোবা বুড়ি অদ্ভুত অব্যক্ত আহ্লাদে চাপা স্বর তোলে মুখে। বউ বুঝতে পারে লোক দুটি খারাপ নয়। বুড়ির চেনাজানা ঠাহর হচ্ছে। বুড়ি তার আঁচল খুলে কুমীরের প্রতীকগুলি দেখিয়ে অভিমানের সুরে জিভ ঠেলে ঠেলে একটা শব্দই কেবল বার করতে পারে বহু কষ্টে–লোটা! লোটা!

শিউরে ওঠে সাদইদ।

–তুমি চেন? প্রশ্ন করে হেরা!

অশ্রুরুদ্ধ স্বর চেপে বুড়ির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে সাদইদ বলল–লোটা আসবে বুড়ি-মা! একদিন লোটা কি আসবে না! দ্যাখো, কেঁদো না!

কুমীর বুড়ি এ সংসারে কী করে এল? কপাল চাপড়াচ্ছে বোবা ভাষায় করাঘাত করতে করতে! মশালের আলো কাঁপছে! নদী থেকে বাতাস বহে আসছে! বাতাসে আঁশের গন্ধ! বোধহয় কোথাও মাছের জালও অন্ধকার উঠোনে টাঙানো আছে। নইলে গন্ধ এত স্পষ্ট হবে কেন! এ তবে চাষী পুরোপুরি নয়, জেলেও বটে। কুমীর সেই নদী অববাহিকার ত্রাস। দেবতা মাত্র।

কাঁথা ওরা পেল। ভাঙাকুটিরে ফিরে এল। সমস্ত রাত দাঁত কাঁপানো শীত। কাঁথা গায়ে দেওয়া দুটি সুন্দর বলিষ্ঠ গাভী সারারাত শীতে নাদলো আর প্রস্রাব করল ছড়ছড় শব্দে। একই ভাঙা কুটিরে বাঁধা থাকল দুজন মানুষ আর দুটি গরু।

ভোরের দৃশ্য আলাদা। বুড়ি ছুটে এল সাত সকালে। এসেই সে যেমন করে লোটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ঠিক তেমনই ভালবাসায় সাদইদের গায়ে হাত বুলিয়ে চলল। সে যেন যুদ্ধের রক্ত মুছিয়ে দিচ্ছে। লোকে সবাই ভিড় করে এল। বুড়ির আহ্লাদ ধরে না। যুদ্ধের দ্বাত্মক রুদ্রতার আড়ালে বোবা এই বুড়ি পড়ে ছিল! এককোণে। যুদ্ধ তাকে কী করে যেন ধর্তব্যই ভাবেনি। অথচ সে ছিল। এই বউটি তার ছেলের বউ। তাদের সে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তার থাকাটাই বিস্ময়কর!

হেরা বলল–তুমি বুড়িকে মিথ্যে কথা বললে কেন?

–বুড়ি শুনতে পায় না হেরা! ওর কাছে লোটার মৃত্যু নেই! আর এরকম একজন মানুষকে সবাই বিশ্বাস করে। ও না থাকলে জীবনটা শুরু করাই যেত না।

এইভাবে গ্রামে ঠাঁই পেল ওরা। কিন্তু শিশুর সন্ধান তারা পেল না। হেরা একদিন নির্জন দুপুরে ফুঁপিয়ে উঠল নদীর মৃদু কলোলিত স্রোতের দিকে চেয়ে। তার বুকের ভিতর রয়েছে অবলুপ্ত বিধ্বস্ত নগরীর স্মৃতি। সে প্রসিদ্ধ স্থপতি। কিন্তু আজ তার কোন কাজ নেই। গ্রামের কুঁড়েঘরে তাকে থাকতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবেশ। স্যাঁতসেতে ঘর। কখনও বৃষ্টিতে মাটি ফুলে ওঠে জোঁকের মত। মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় সেই গৃহ হাহাকার করে কখনও বা। নদীর বন্যায় সেই কুটির তলিয়ে যায়। এখানকার চাষবাস অত্যন্ত পুরনো ধরনের। বীজ ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে ছাগল ভেড়ার পাল দৌড় করানোর বুদ্ধিও জানে না–যাতে করে পশুর পায়ের দাপানিতে বীজ পুঁতে গিয়ে তোফা উদ্ভিদ দিতে পারে। কিছুই জানে না। এত খাদ্যাভাব এখানে। আকাশে মুখ তুলে হাহাকার করা আর রাতদিন ঢোল বাজিয়ে বালদেবের মন্দির মাত করা এদের কাজ। চারিদিক থেকে নানান জনপ্রবাহ এসে মিশেছে–কাউকে এরা খেদায় না। নানান দেশে পৌঁছনোর রাজপথগুলি এই দেশের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে। রথ, অশ্ববাহী সেনা, পদাতিক ছুটাছুটি করেছে এই পথে। চাষী তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে।

চোখের সামনে সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার খেলা খেলে চলে গেছে–চাষী মুখ বুজে থেকেছে। মিশরের দূতরা এসে লোভ দেখাতোযুদ্ধে চলো, প্রচুর উপহার দেব–মাতব্বর যদি হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে দেয়,রাজা করে দেব। চাষী প্রলোভনে ভোলেনি। যুদ্ধ করা নয়, যুদ্ধ দেখা এদের রোমাঞ্চ। যুদ্ধ থামলে এরা বীরের গল্প ফাঁদে–আরে ভাই অমুক সারগনের কথা বোলো না–এমনি হাঁকলে ওই দেওদার তলায় দাঁড়িয়ে যে, লেডুর গর্ভবতী বউটা ছেলে বিইয়ে বসলে! লাও লেঠা!

বলেই বিবরণকতা মাড়ির দাঁত বার করে এমনি নিঃশব্দে হাসলে যে, সেই হাসিটা গাঁময় ছড়িয়ে গেল, যারা দেখেছে তারাও তো আকুল, হেসে অস্থির, যারা মাড়ির বর্ণনা শুনল তারাও নিরাকুল হাসিতে আকাট হয়ে রইল। তারপর দলে দলে শুঁটকি মাছের চাট দিয়ে আঙুর তাল খেজুরের চোলাই মেরে তামাম রাত দেবী ইস্তারের ভাসান শুনল। দেবী কী করে পাতালে যেতে যেতে ক্রমশ নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, বস্ত্রহরণের সেই দৃশ্যে মেতে গেল গ্রাম। তখন নদীর জল ফেপে উঠে মরাই তলিয়ে মাটির গোলার তলা ফাঁক করে ডিহি ছুঁয়ে এসে ভাসান শ্রোতাদের পাছার কাপড় ভিজিয়ে দিলে। সবাই তখন চমকে লাফিয়ে উঠে বলল–ওরে বাপ। হায় দেবী–এ যে বান বটে গো!

এরা নদীতে বাঁধ দিতেও জানে না। নালা কেটে জলাশয় তৈরি জানে না। বান হলে পূজা দেয়। বজ্ৰ গজালে পূজা দেয়। মাটি শুকালে জিভ ফুড়ে একটা লগির সঙ্গে শেকল বেঁধে ঝোলে। বলে, লে মাতৃকা রক্ত খা! এ হল এদের দুর্ভিক্ষের শুখা মাটির মাদল বাজানো উৎসব। এই উৎসবে হঠাৎ জড়ো হওয়া কোন বহিরাগতকে দেখলেই হোতা ব্যক্তিটি শুধায়–মশাইয়ের যুদ্ধ জানা আছে নাকি! ভাড়াটে, না আসল! বহিরাগত মিটকি মিটকি হাসছে দেখে বললে–আচ্ছা নিবে নগরে একটা পাঁচিল ছিল শুনেছি। দেখতে কেমন ছিল মশাই! শুনেছি প্রস্থে আপনার কত গুণিতক কত হাত যেন পুরু। তা বেশ! শুনি সেই পাঁচিল নাকি ধ্বসে গেল তিনতলা সাঁজোয়ার ধাক্কায় । মিথ্যা বলব না। দু’ একখানা দেখেছি! এই রাস্তা ধরে গেছে…তিনতলা–সব চোলাই আর দেবদাসী ভর্তি হয়ে চলে গেল! দেখবেন, ঈষৎ রঙ লাগলে বলবেন, কথায় রঙ দেওয়া ঠিক নয়।

–না না। বলুন। বেশ বলছেন আপনি। পাঁচালী শুনেছি তো, তাও এত ভাল লাগে না।

উৎসাহিত দ্রাক্ষাবাগিচার মালী বলল–একথা শুনে ইহুদ বললেন, মেয়েলোক বাড়লে, দেবদাসী বাড়লে, বেশ্যা বাড়লে জানবে–এটা যুদ্ধের লক্ষণ! দ্যাখো আর নাই দ্যাখো, এটা যুদ্ধ। পুরুষ কমে যাচ্ছে, এটা যুদ্ধ! একথা মহাত্মার কাছে কোথায় শুনলাম শুনবেন! গত মাসে ওলাওঠা দেবীর থানে। না ভাই ঈষৎ ভুল হল। শুনলাম ভোমরাতলীর হাজারী থানে। ও গাঁয়ে কুমারী বলি হচ্ছে সেদিন। মহাত্মা এসে ঢাকের কাঠি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন কুমারী মেরে বৃষ্টি নামে না–ইয়াহোকে ডাকো! তা আমরা ইয়াহোকে ডাকি না এমন নয়। ডাকি। অবসর পেলে ডাকি! বাপঠাকুদ্দা কুমারী বলি দিয়েছে, চারটা দশটা বিয়ে করেছে–আমরাও করছি। পূজা করলে কি আর ইয়াহোকে ডাকা যায় না। খুব যায়। ধম্ম ঠাকুর জানে, এই দিগরে দশটা কুমারী বলি হলে হুড়মুড়িয়ে আকাশে মেঘ জমে যাবে। ফলে সবাই মহাত্মাকে মারতে তেড়ে গেল! ইহুদ আকাশে লাঠি উচিয়ে বললেন, আমি নোটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেছি। আমি পারি! মেঘ জমবে। ওই দ্যাখ পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আকাশের তলায় রুদ্র জিহ্বা নীল রঙ চাটছে। মেঘ জমবে। ইয়াহোকে ডাকো।

তারপর কী বলব ভাই, দুদিন যেতে না যেতেই আকাশ ফেড়ে ঢল নেমে গেল!

হেরা বলল–সবই শুনলাম। কিন্তু আমি নালা কেটে জল ধরে রাখার কথা বলছি। নিনিভের গ্রামগুলিতে এই প্রণালীর চাষাবাদ ছিল। জলকেও বাঁধা যায় মালী। পাথর ফেলে, তক্তা বসিয়ে বন্যা ঠেকানো যায়। এ তোমার ঢাকের কাঠির সঙ্গে হাতের লাঠির তজা নয়। সেটা শ্রম ঢালবার অন্য চেহারা। তা ওহে মালী, সেই কুমারী মেয়েটা তো বেঁচে আছে!

–আজ্ঞে আছে বইকি! যাবেন নাকি দেখতে! বাঁচার পর, মানে বলি তো হল না–সেই থেকে মেয়েটা বোবা হয়ে রয়েছে! দেখতে খুবই খাসা!

–আচ্ছা যাব! কোথায় থাকে!

–ওই আপনার উট-পাড়ায়!

–উট?

–আজ্ঞে!

ক্ষুব্ধ হেরা এই প্রথম কনানের মাটি খামচে তুলল হাতে। তৈরি করল একটি উটের মূর্তি। মরুভূমিতে পায়ে হেঁটে গিয়ে শুকিয়ে আনল। রঙ করল। সাদইদ ঘোড়া নিয়ে কোথায় চলে যায়, অনেক রাতে ফেরে না। উটের মূর্তি দেখে বলল–এটাও তো কাজ হেরা!

হেরা বলল–এটাই একমাত্র কাজ! এটা এক মূর্তিমান দেবতা। যে মেয়েটি বলি হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য উপহার। আমি ভাস্কর নই। কারিগর। অজস্র মূর্তি দিয়ে এই দেশকে ভরে দেব সাদইদ। ইট কাঠ পাথর মাটি–সকল বস্তুকে দেবতা করে না তুললে মূর্তিহীন ঈশ্বর ডরাই না। ইহুদ কোথায় আছে–দেখে নাও, এরপর আত্মপ্রকাশ করে কিনা! আমার শিশুকে আমিই বহাল রাখব, সে নয়! সে কে?…

সাদইদ বলল–আমার এখন কিছু মিস্ত্রী, কারিগর আর শিক্ষিত নালা প্রস্তুতকারক চাষীর দরকার। আমি বিধ্বস্ত নগরী থেকে তাদের তুলে আনতে চাই। বাড়তি ফসল–উদ্বৃত্ত ফসল না হলে তোমায় কাজ দেওয়া যাবে না। আমার চাই প্রচুর খাদ্য। পরিধান। পশম। আতর। সুম। ফুল। প্রচুর প্রজাপতি।

–আমার এই উট–এই যথেষ্ট এখন।

মালী এসে হেরাকে নিয়ে গেল কুমারী মেয়েটির কাছে। হেরা তাকে উট উপহার দিয়ে সম্ভোগ করল। মেয়েটি বাধা দিল না। সম্ভোগ শেষ হলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হেরা পাগলের মত ভাঙা ঘরটি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে চলে এল পথে। মালী তাকে প্রচুর মদ খাইয়ে বলল–আপনি এবার কেঁদে হালকা হোন–আমরা জানি আপনার খুব কষ্ট ।

–কিছুই জানো না তুমি,আহাম্মক! আমাকে ঠকালে কেন? বলেই চড় মারতে গেল হেরা। পারল না। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পড়ে রইল পথের উপর। মুখ ঘষড়াতে থাকল। বমি করল।

মালী বলল-শালা রসের নাগর। কুত্তা!

হেরা মদ খায়। মূর্তি তৈরি করে। দোকানপাটে সেই মূর্তি দিয়ে আসে। তার মন ভাল থাকে না। তার কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে রয়েছে তার নিনিভে নগরী। তার পাগলামি কিন্তু সত্যিই ব্যর্থ হয় না। ইহুদ লক্ষ্য করেন, এইসব মূর্তি নিনিভের বাজারে পাওয়া যেত। দোকানপাটে সেই মূর্তি ছেয়ে গেছে। এই কারিগর কোথা থেকে এল! এ তো নাগরিক-বিদ্যার জিনিস!

লোক দিয়ে সাদইদকে ডেকে পাঠালেন ইহুদ–তোমার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোন প্রবৃত্তি আমার নেই সাদইদ। তবু তোমায় ডেকে পাঠাতে হল!. বললেন ইহুদ।

সাদইদ বলল–আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়ার শেষ হয়নি। আমি কাজের লোক। ধর্ম আপনার জিনিস! কিন্তু সেই ধর্ম যেন সত্য কথা বলে আমি চাইব! লোটাকে আপনি মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন একথা সত্য নয়। লোটা বাঁচেনি।

–তাহলে তুমিই তাকে হত্যা করেছ।

কথার শুরুতেই পা থেকে বক্ষস্থল অবধি এবং দাঁড়া বরাবর একটা হিম স্রোত বহে গেল সাদইদের। উচ্চাসনে বসে দিব্যতা-মুগ্ধ চোখে কথা বলছেন শান্ত তীব্রখরে ইহুদ। সাদইদ বুঝতে পারল মূর্তিহীন ঈশ্বর তুচ্ছ নয়। তথাপি খানিক ইতস্তত করে সাদইদ বলল-লোটা মারা গিয়েছে, হত্যা তাকে কেউ করেনি। হেরা দেখেছে!

–হেরা তো একজন পাপী মানুষ সাদইদ। মূর্তি বানায়। তা সে বানাক। কিন্তু নাগরিক পাপ যেন কুমারী মেয়েকে না দংশায়। নিভাকে আমি বলির হাত থেকে বাঁচিয়েছি–তাকে সে উটের মূর্তি উপহার দিয়ে বলাৎকার করেছে। বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করার শাস্তি কী হতে পারে বিধান দাও হিতেনের পোলা। কী হে ভিত্তি! নিভাকে ডেকে আনো! আমি সমস্ত আঙুল কর্তন করব না। খালি ডান হাতের বুড়া আঙুলটা কেটে দেব। নদীতে বাঁধ বাধলেই হয় না সাদইদ। বাঁধ বাঁধো চরিত্রে! অবশ্য তোমার আর আমার সত্যের ধারণা আলাদা। কিন্তু তোমার ধারণা অনুযায়ী হেরার মৃত্যুই অনিবার্য ছিল।

–এতবড় শাস্তি ওকে দেবেন না মহাত্মা ইহুদ!

–কেন দেব না?

সাদইদ কোন উত্তর দিতে পারল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিশু কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিল রিবিকা,ইহুদের আসনের আড়ালে। লোটার মৃত্যুর কথা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার জানতে ইচ্ছে করছিল কোথায় কীভাবে লোটা মরেছে। তার চোখের সামনে বারবার লাফিয়ে উঠতে থাকল। দিগন্তাভিসারী এক কৃষ্ণ অষ। তার গলায় আজ আর কোন কান্না এল না। সে অপেক্ষা করেছে দিগন্তের দিকে চেয়ে। কেঁদেছে। কিন্তু কান্না এক সময় নিজেই থেমে গেছে।

আজ মাথা নিচু করে থাকা সাদইদকে দেখে তার অন্তর কেমন মুচড়ে উঠল। একজন সামান্য চাষীর পোশাক পরা এই কি সারগন! মহা অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ইহুদ সহসা কঠোর স্বরে বললেন–ঠিক আছে। দুটি শর্ত তোমায় পালন করতে হবে। প্রথমত হেরা আর মূর্তি বানাবে না। দ্বিতীয়ত নিভাকে সে বিবাহ করবে। যাও! ওহে কে আছে ওকে ওর শিশুকে দিয়ে দাও!

রিবিক এগিয়ে এল সামনে! সাদইদের বলতে ইচ্ছে করল–এই নারীকে আমি চাই মহাত্মা ইহুদ। এর সঙ্গে আমার পাপের সম্বন্ধ!

কিছুই কিন্তু বলতে পারল না সাদইদ। কেবল রিবিকার বিমর্ষ আর গভীর চোখ দুটির দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল–কেমন আছে প্রজাপতি!

রিবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-জানি না সারগন!

–শোন সাদইদ। লোটাকে আমি বাঁচাইনি। ইয়াহো বাঁচিয়েছিলেন! তোমার কথাই ঠিক। লোটা যদি না ফেরে কখনও, তবু এই সত্য স্থির থাকবে!

বললেন ইহুদ।

রিবিকা বলল-যুদ্ধ থেমেছে। তবু যুদ্ধ থামেনি সারগন। ভয় পেও না!

কালো অষের পিঠে ওরা তিনজন। শিশু, নিভা আর সাদই। এ এক আশ্চর্য অশ্বারোহণ। চকিতে অন্য এক দৃশ্য ভেসে উঠল রিবিকার মনে। সাদা অশ্ব ছিল। সেটি। কিন্তু আজকের অশটি তো কৃষ্ণকায়। মুহূর্তে ম্লান হয়ে আসে চোখ।

ভয় পেও না। যুদ্ধ থামেনি সারগন! আজ সাদইদের মনে হল, লোটা নেই, তবু তার অশ্ব আছে যেমন, তেমনি যুদ্ধও ফুরোয়নি। একদিন যুদ্ধ থামবে মনে হলে জীবনে আর কিছু বুঝি নেই, মনে হত! আজ মনে হচ্ছে, সব আছে তার। কিছুই হারায়নি। শুধু একটি শব্দ–ভয় পেও না। এ কী বিষম শক্তিধর। কুমারী বলি হয় যে দেশে, দেবী থাকেন নাঙা, বাবা মেয়ে ধর্ষিত হয়–সেই। দেশের নারীকণ্ঠে এত জোর থাকে কী করে! যুদ্ধ সব রূপ ভাঙে, আকৃতি ভাঙে, স্বর্গ ধ্বংস করে, ঈগল ওড়ায় আকাশে, যোদ্ধা ঘুমিয়ে পড়ে পথে, আর জাগে না, মরুশকুনের চোখ টলটল করে, সমেরু ঝোলে ডালে, তাঁবু আওয়াজ করে। ফটফটসু বহে, দুর্ভিক্ষ হয়, বান ডাকে, শোকে স্তব্ধ হয় পৃথিবী–তারপরও নারী বলে, ভয় পেও না। সামান্য চাষীকে, অতি তুচ্ছ যাযাবরকে, ভাড়াটে ফেরতা সৈনিককে ডাকে সারগন! সেই এক কোমল নারী ডেকে ওঠে, যাকে দুটি অদ্ভুত বর্ণবহুল ডানা কাঁপানো প্রজাপতি ফুল ভেবে অধিকার করেছিল! এ কী বিস্ময় ব্যাকুল চন্দ্রকলার দেশ। এ মরুমর্ত অশেষ শোকেও গান গায়!

হঠাৎ কতকাল পর আকাশে চোখ তুলে চাইল সাদইদ। মনেই ছিল না, মাথার’পর আকাশ রয়েছে। সেখানে চাঁদ আর নক্ষত্ররাজি ওঠে। তার একদা পাহাড় ছিল, তথায় চাঁদ উঠত। রিবিকা সেই চাঁদের কথা বলেছিল। এই চাঁদ ওই পাহাড় ছেড়ে কোথাও যাবে না। এইরকম মনে হত! আজ আকাশ এমন করে সেজেছে কেন। চাঁদ তার চারপাশে নীল কস্তুরী আভায় জড়িয়েছে এক গোল পুরু বৃত্ত। যেমন নীল তেমনি সাদা। কী দারুণ ছবি! সমস্ত রাতেই চাঁদ একটি তারকা সঙ্গে করে উদিত হয়। সেই তারকাকে চাঁদ ছাড়ে না। আজ অজস্র তারকা চাঁদের চারপাশে ঘিরে বসেছে। চাঁদ যেন কথা বলছে, তারকারা ঝুঁকে পড়ে শুনছে–এইসব তারকা কোথায় ছিল। এভাবে চাঁদের চারিদিকে জুটল কী করে! চাঁদ যেন সভা বসিয়েছে আকাশে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন