মরুস্বর্গ-৩

লোটার কেবলই মনে হচ্ছিল তার সমস্ত গা পচে যাবে। শব বহনের সময় মানুষের মৃতদেহ থেকে গলিত রক্ত সারা দেহে লিপ্ত হয়েছে, দেহ থেকে একটা বীভৎস গন্ধ কিছুতেই নড়তে চাইছে না। একথা সে কাকে বলবে? কালো ঘোড়া ছুটিয়ে সমস্ত রাত সে জ্যোৎস্নায় মরুভূমি তোলপাড় করেছে। কিন্তু এভাবে তো বাঁচা যায় না।

সকালবেলায় রুহার মৃত্যু-সংবাদ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। রুহার মৃত মুখে গাঁজলা উঠছে। রুহা ভোররাতের কোন এক সময় বিষ গিলেছে। মরবার সময় সে অন্য দেবদাসীদের বলে গেছে–সে ছিল চাষীর মেয়ে। দেবী ইস্তার যেমন দুঃখী, সেও তাই। মরে যেতে তার বাধে না। আবার সে পৃথিবীতে আসবে। সঙ্গে থাকবে তামুজদেব। তামুজকে যুদ্ধের গহ্বর থেকে সে উদ্ধার করে ফিরে আসবে। সে আর দেবদাসীর জীবন নয়, চাষীকন্যার মত দুঃখে তাপে বেঁচে থাকবে। হাজার একটা লোক তাকে ছিঁড়ে খাবে দেবী ইস্তার তা চান না, তাই সে চলে যাচ্ছে।

খোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির তলায় তক্তার উপর শোয়ানো হয়েছে তাকে। তার চোখ তুলে তাকানোর সাধ্য নেই। গা খিঁচুনি দিচ্ছে প্রবল ধাক্কায়। তার পা দু’টি তক্তার উপর স্থির রাখা যাচ্ছে না–মাথা পড়ে যাচ্ছে তক্তা ছাড়িয়ে। মাথা একজন, অন্যজন পা দু’খানি ধরে আছে চেপে। এই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে লোটা। রুহার মুখে যাতে বাতাস লাগে, সেজন্য লোকজনের ভিড় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোটা স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে। তার গায়ে গরম জল ঢালছে। এক কানা বুড়ি। এই বুড়ি ছাড়া কেউ লোটাকে স্পর্শ করে না। বুড়ি বোবা বলে তার ভাষার বালাই নেই। তাছাড়া বুড়ি তার নিজের ধর্ম কী বলতে পারে না। তার কাপড়ের আঁচলে বাঁধা থাকে গুটিকতক কুমীরের প্রতীক। তাই হয়ত তার দেবতা।

বুড়ি গরম জল ঢেলে ঢেলে পাথরের খোয়া দিয়ে নোটার গায়ের রক্ত ঘষে তুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কানা বুড়ি এক চোখে ঝাঁপসা দেখতে পায়। লোটা কড়াইতে করে মৃতদের পরিত্যক্ত কাপড়-চোপড় সেদ্ধ করে চলেছে। জ্বালানি ঠেলে দিচ্ছে আর লাঠি দিয়ে কড়াইয়ের সেদ্ধ হতে থাকা বাষ্পময় বস্ত্রগুলি গুতোচ্ছে। মাঝে মাঝে গরম জল গায়ে পড়ার সময় লোটা সামান্য চেঁচিয়ে উঠছে। সে দেখছে চোখের সামনে রুহার মৃত্যু।

খিঁচুনি দিতে দিতে এক সময় রুহার দেহ স্থির হয়ে গেল। লোটা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সাদইদ লোটার সামনে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। অনেকক্ষণ কোন কথাই বলল না । লোটা রক্তাক্ত চোখ তুলে সাদইদকে একবার। দেখল। তার বুকে কান্না জমাট বেঁধে গেল–সে আর কাঁদতে পারল না।

লোটা জানত এখন তাকে কী করতে হবে। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। একটা উট টেনে আনল মৃতদেহের কাছে। সবাই সরে দাঁড়াল একটু তফাতে। মৃতদেহ স্পর্শ করা মাত্র লোটার তাবৎ দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল।

লোটা অদ্ভুত একটা আর্তনাদ করে উঠল। তার ভাষা তো কেউ বোঝে না। বারবার সে সাদইদের দিকে চোখ তুলে কী যেন প্রশ্ন করছিল। সাদইদ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত করল রিবিকাকে আনা দরকার। ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সাদইদ রিবিকাকে পাহাড় থেকে তুলে আনল।

লোটা তখনও আর্তনাদ করে চলেছে। রিবিকা দুই চোখ বিস্ফারিত করে শুনতে পেল–ছায়া। ছায়া থাকবে তো! রুহার ছায়া কি থাকবে না কোথাও?

কথা বলতে গিয়ে রিবিকার গলা কান্নায় বুজে এল। সকলে তার মুখের দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চেয়ে আছে। রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–ছায়া। ও বেচারি রুহার ছায়ার কথা বলছে!

এখানকার কিছু মানুষ রিবিকার কথা বুঝতে পারল। রিবিকা বিচিত্র ভাষা জানে। কখনও সে আমারনার ভাষা, কখনও হিদ্দেকলের ভাষা, কখনও কনানী ভাষায় বলল-ছায়া কি থাকে না কোথাও!

পুরোহিত রুহার শেষ স্নান করিয়ে দিল। তারপর বলল–ছায়া তো থাকেই । থাকবে না কেন? কিন্তু কোথায় থাকে সে কি আর দেখা যায়। জ্ঞানী মানুষ দেখতে পান মাত্র। তুমি তো পাপ করেছ লোটা। সরে দাঁড়াও!

পুরোহিত আর লোটাকে রুহার দেহ স্পর্শ করতে দিল না। সাদইদ লোটাকেই মৃতদেহ উটের পিঠে তোলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। পুরোহিত সেই নির্দেশ বাতিল করে দিয়ে বলল–মানুষ মৃতাকেও গমন করে জানবেন। লোটা শবানুগমন করতে পাবে না।

রুহাকে পিঠে করে উট চলতে শুরু করল দিগন্তের দিকে। পুরোহিত প্রবল ঘৃণায় লোকটাকে বলল–ভাষা তো শিখলে না! আমি কতদিন তোমায় যুদ্ধের জরুরি ভাষা, তাঁবুর ভাষা শেখাতে চাইলাম। গা করলে না। নিজ ধর্মে তুমি একটা পাষণ্ড! সালেহর মত তোমারও কোথাও ঠাঁই নেই বাপু! চলো হে, শব এখন যাত্রা করুক, রোদ চড়া হয়ে যাচ্ছে! একটা উটই তোমার নিয়তি, ওই বিকট পশুটাই একদিন তোমাকে দিগন্তে পৌঁছে দেবে–ভাবনা কিসের!

যাত্রা যখন সবে শুরু হয়েছে, সকলে নড়েচড়ে চলতে শুরু করেছে, মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য, এ যে যুদ্ধে বিনাশ হওয়া নয়, তাই এর শবানুগমন আছে, উট একলা দিগন্তে নিয়ে যাবে না, মানুষও শবের পিছনে পিছনে যাবে মৃত্যুর খাদ অবধি–মানুষ সবে চলতে শুরু করেছে, সবার শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইহুদ। তিনি লোটার কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে কাঁধে হাত রাখলেন।

লোটা আশ্চর্য হল। মানুষটি তার চরম উন্মত্ত অবস্থায় কাঁধে হাত রেখেছিলেন, চরম দুর্দশার মুহূর্তে এবং এখন শোক আর ব্যর্থতার, অপমানের। শেষহীন সংকটকালেএগিয়ে এসে দ্বিতীয়বার হাত রাখলেন। এ কেমন মানুষ!

চাপা সুরে এই প্রথম ইহুদ কথা বললেন–তোমার ভাষায় যে কথা বলে সেই তোমার আপনজন লোটা। দুঃখ করো না। যবহ তোমায় বিচ্ছিন্ন করেছেন।

লোটা ইহুদের কথা বুঝতে পারল না বটে, কিন্তু মনে মনে কী যেন এক আশ্বাস অনুভব করল।

উট তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।

লোটাকে ইহুদও ছেড়ে গেলেন। শবানুগামী দলটি ক্রমশ দূরবর্তী দৃশ্যে মিলিয়ে যেতে থাকে। লোটার কালো ঘোড়াটি কাছে এসে পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবল শক্তিমান নিবার্ক প্রাণীটিই তার একান্ত আশ্রয়। লোটার চোখ যবহের চোখের মত জ্বলতে থাকে। ইহুদের ভাষা সে বোঝেনি, কিন্তু কেমন এক ধারা আশ্বাস পেয়েছে, অবশ্য একজন গামছাবালার আশ্বাসেরই বা কী দাম! বেচারি এরপর অন্য দেবদাসীর তাঁবেদারি করবে। ইহুদের কোলে রুহার কালো বাচ্চাটা খেলা করছিল। একজন কোন দেবদাসীর কাছে বাচ্চাটা জমা হবে। যারা বৃদ্ধা, তারাই অবৈধ পিতৃমাতৃহীন শিশুদের আগলায়।

লোটা সাদইদকেও চলে যেতে দেখল পাহাড়ের দিকে–সুন্দরী ওই মেয়েটিকে ঘোড়ার উপর কোলের কাছে বসিয়ে নিয়ে রাজার হালে সাদইদ হেলেদুলে যাচ্ছে–এই দৃশ্য অসহ্য! নোটার কাঁধে তামাম যুদ্ধের ভার। অথচ সকলের জন্য রয়েছে নারী আর শিশু। লোটার কেউ নেই। আছে কেবল অপমান। রুহা আত্মহত্যা করেছে ঘৃণায়। পূর্বদেশে চাষীদের সঙ্গে উটবালাদের দাঙ্গা দীর্ঘকালের ঘটনা। চাষীরা উট উপাসকদের সহ্য করে না। যাযাবর বেদে বলে উপহাস করে। যারা থিতু জীবন পেয়েছে, তারা ভেসে বেড়ানোদের কেনই বা সইবে! হানাদার বলে প্রবল ঘৃণায় চোখ কোঁচকায়। সবই লোটা জানে।

অথচ সবই ভগবানের ইচ্ছে। বাবিলের জিগুরাত ঈশ্বর ধ্বংস করে দিলেন। মানুষের স্পর্ধা আকাশের দেবতাদের ভাল লাগল না। মানুষ স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে দেবতাদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল। দেবতাদের অন্তত তাই ধারণা। স্বর্গ ধ্বংস হল–এই শাস্তিই যথেষ্ট ছিল। ক্রুদ্ধ দেবতারা কিন্তু আক্রোশবশত মানুষকেই বিচ্ছিন্ন করে দিলেন! ভাষা আলাদা হয়ে গেল।

লোটা ভাবল, তার নিজের ভাষাটি ঈশ্বরের দান। ঈশ্বরই লোটার বিচ্ছিন্নতা চেয়েছেন। না চাইলে এই ভাষা তিনি যোগাচ্ছেন কোথা থেকে! ভাষা ত্যাগ করলে মানুষের আর রইল কী? সাদইদ তার ভাষাই কেড়ে নিতে চাইছে। ভাষা চলে গেলে ধর্মও আর আস্ত থাকবে না। সাদইদ তাকে কিছুই দেয়নি। বরং কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ বারংবার আশ্বাস দিয়ে চলেছে, নিনিভে ধ্বংস হলে যুদ্ধের যা পাওনা লুঠ করে নিতে পারা যাবে, তাই হবে জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। অতঃপর তারা কানের দিকে ঢুকে যাবে। সেইসব লুঠ করা পশু, খাদ্য, বস্ত্র, অলংকারাদি নিয়ে কনানে ঢুকতে পারলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারে। আসলে কী হতে পারে কেউ জানে না। রাজা হিতেন সমস্তই কেড়ে নিতে পারে।

এই যুদ্ধে জীবন তো কোথাও আস্ত নেই। সর্বত্র ধ্বংসলীলা চলেছে। চাষীর খেতখামার জ্বালিয়ে দিয়েছে সর্বত্র। পশু বধ করে চলে গেছে অসুররা। চাষীরা যেসব রাষ্ট্রে খাল কেটে চাষ করার নতুন প্রণালী আবিষ্কার করেছে, তারাও গৃহছাড়া–খালগুলি বুজিয়ে দিয়ে গেছে যে যেমন পেরেছে–শুধু অসুর নয়, সর্বাত্মক এই যুদ্ধে সকলেই যেন সকলের শত্রু হয়ে গেছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক, আঙুর কুঞ্জগুলি তছনছ করেছে এই যুদ্ধ। মানুষ মদ অবধি তৈরি করে খেতে পারছে না। মদ না পেলে সৈনিক লড়বে কী করে?

ভাবতে ভাবতে লোটার আকণ্ঠ তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মদ আর শুঁটকির চাট তার রক্তের অধিকার, রক্তের উষ্ণতা এ ছাড়া হয় না। শীত আসার আগেই যদি নিনিভে ধ্বংস না হয়, তবে এই শিবির প্রাণীশূন্য হয়ে যাবে। সাদইদ কাপড়, মদ, খাদ্য কোনটাই পর্যাপ্ত জোগাড় করতে পারবে না। গ্রামগুলিতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী–তন্দুর বিড়! একখানা রুমালটি আর চারখও ভেড়ার মাংস নিয়ে একটা পরিবারে হানাহানি অবধি হয়ে যাচ্ছে।

জীবনটা এখন অন্ধ কেঁচোর মত–কোনদিকে চলেছে বোঝা যায় না। যেদিকে অত্যধিক আঘাত পাবে মনে করে, সেদিক থেকে গা টেনে ভয়ে অন্যদিকে ছোটে। কিন্তু কোথায়, জানার উপায় নেই। চলেছে মাত্র। দিকহীন, অন্ধ এক যাত্রার নাম যুদ্ধ। ক্রীতদাস যারা, কেন ক্রীতদাস তা যেমন তারা জানে না, যুদ্ধ কেন, কিসের যুদ্ধ সে জানে না। ইহুদও কি জানেন এই যাত্রার অবধি? যাদের তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন মিশর থেকে, তারা কোথায়? সবই মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলেছেন। লোকটা নিতান্তই বোকা! তাঁর অনুসরণকারী নেই। পশুদল নেই। অথচ লাঠিখানা হাতছাড়া করছেন না। সৈনিকরা তাঁকে বেঁধে এনে দেবদাসীর মন্দিরের সামনে টুল পেতে বসতে দিয়েছে। সাদইদ এই বেচারির সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কেনই বা না হবে? লাঠিধারীদের এই যুদ্ধের সময় কত বেশেই না দেখা যায়। আসলে এসব লোক, আপনি বাঁচলে বাপের নাম করে, মোদ্দা হল বাঁচা-মাথাটা এখানে জড়ে দিয়েছে। তা, লোকটা বোকা, কিন্তু ভদ্র। কেঁচোবৎ নড়াচড়া করছে। কাঁধে হাত রাখলে মন্দ লাগে না। তবে গা কেমন সিরসির করে।

ভাবতে ভাবতে লোটার বুক হু-হুঁ করে উঠল। কোথায় চলেছি? কেন যুদ্ধ করছি! শীতে বাঁচব কিনা জানি না। সাঁজোয়া ভর্তি করে লাশ বহে এনে পোশাক ছিনতাই করছি–জীবনের এই তলানি এত উষর যে, সেখানে একটা নারী অবধি পাওয়া যায় না! কারুকে ছুঁয়ে ফেললে সে আত্মহত্যা করে! এই অন্ধ জীবন আর আমি চাই না, হা নবী!

লোটা আকাশে মুখ তুলে সুতীব্র চিৎকার করে উঠল। জেহাদী এই কণ্ঠস্বর যুদ্ধের আর্তনাদ। মানুষ যখন শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন এভাবে চিৎকার করে। এই আর্তনাদ মনে হয়, তামাম চন্দ্রকলাকৃতি বাঁকা ভূখণ্ডকে মথিত করছে। আকাশ থেকে চোখ নামালো লোটা। দূরপথে চোখে পড়ল এক পুরোহিত একা ছুটছে রুহাকে বহে নিয়ে যাওয়া উটের শবযাত্রীর পশ্চাতে, সে পিছিয়ে পড়েছে। এই পুরুত টোলে বসে সাদইদের জুমপাহাড়ী অরমিক সমন্বয়ী ভাষা শেখানোর ওস্তাদি করে। শালা পা নাচায় আর উচ্চারণ করে ইয়াহো! ইয়াহো! হা খোদা! যখন লোটা টোলের বাইরে দেবদারুর তলায় বসে থাকে-ওই পুরুত বাঁকা তলচোখে যেন ব্যঙ্গ করে। একে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হল লোটার।

লোটা ফের আর্তনাদ করে উঠল। এ গর্জন তার নাভিতে মোচড় দিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল। লোটা হাহাকার করে উঠল–এই মুহূর্তেও তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না।

নোটার আর্তনাদে সাদইদের পাহাড় অবধি কেঁপে উঠল! গা কেঁপে উঠল। রিবিকা ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল–লোটা কেন অমন করছে! ও কি মরে যাবে!

আবার আর্তনাদ ভেসে এল-সলেহও … …ও ও… পি. ই ই তা… আ… আ… আ…

রিবিকা আপাদমস্তক শিহরিত হয়। তার শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠে।

অগ্নিদগ্ধ গ্রাম। দুর্ভিক্ষ-কবলিত উৎসন্ন জনপদ। মারী-পীড়িত লোকশূন্য গৃহ। খুঁটায় ঝুলন্ত মৃতদেহ। শেয়াল-কুকুরে-শকুনে টানাটানি করা মৃত্যু। নগরীর একটি ধ্বস্ত দেওয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়েছে। মুহূর্তে চোখের উপর দিয়ে। ছবির মত ভেসে যায় সাদইদের। এ যেন সেই আর্তনাদ, যার নগর কিংবা গ্রাম বলে কিছু নেই–সর্বত্র এই প্রাণফাটা চিৎকার উঠছে! কিন্তু এ আর্তনাদ এখন লোটারই একান্ত হৃদয় থেকে নিংড়ে বার হচ্ছে। তার মুখ বন্ধ করার উপায় সাদইদ নির্ণয় করতে পারছে না।

সাদইদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চাইল। দিগন্তে ওরা পৌঁছে গেছে। ছোট পাহাড়টির মাথায় রয়েছে বালদেবের মন্দির। সেখান থেকে প্রকাণ্ড একটি ঘণ্টাধ্বনি কান পাতলে এই নির্জন দুপুরে শোনা যেতে পারে। সেখানে রয়েছে পবিত্র শিলা আর পবিত্র বৃক্ষ। পুংশক্তি আর স্ত্রীশক্তির প্রতীক। এ স্থান গ্রাম নয়, নগরও নয়। অথচ দেবতা ছোট পাহাড়টির শীর্ষস্থান কখন কীভাবে দখল করে বসেছেন সাদইদ জানতেই পারেনি। শুধু তাই নয়, সূর্য মন্দিরগুলির সামনে গাছের বদলে খুঁটি পুঁতে রেখেছে দেবদাসীরা। এর নাম ‘আসেরা’।

এরা দেবদাসী বটে, কিন্তু কেউই চাষী জীবনকে ভুলতে পারে না। দেবী ইস্তার অথবা বালদেবকে স্মরণ করে। আসেরা তারই প্রমাণ। এরা কেউ ছিল বাবিলে, আসিরিয়ায় অথবা মিশরেকীভাবে ভাসিয়ে এনেছে যুদ্ধ! নিনিভের অবরোধ। মিশরের দুর্ভিক্ষ। কিন্তু এদের বেশির ভাগ এরা অরমিক ভাষাটি মান্য করল, তাঁবুর ভাষা দ্রুত শিখল–কেবল উট-উপাসক বেদেটি মাথা নোয়াল না। তার কারণ, মিশরীয়, মোসোপটেমিয়া, হিটাইট আর কনানী হিব্রসদৃশ সমন্বয়ী ভাষাটি কীলকাকৃতি নকশার ভাষা নয়। অথচ এ ভাষা মরুভূমিরই ভাষা। এ কথা লোটা বুঝতেই চাইল না। সে ভয় পেয়ে গেল। নকশা থেকে লিপিতে এ ভাষার পরিণতি ঘটেছে, একথা লোটা সহ্য করল না। তার ভাষা কত পুরনো। ধর্মও পুরনো।

লোটা কি প্রাচীন আমালেক জাতির লোক? প্যালেস্টাইনের মরু অঞ্চলে এর পূর্বপুরুষরা বাস করত? বারো গোষ্ঠীর কোন এক গোষ্ঠীই কি তার গোষ্ঠী? কী যে তার অতীত ইতিহাস, জানা যায় না। এমন হতে পারে, তার গোত্রের নাম। হয়ত ‘আসের’ । সে যে চাষবাস মোটেও জানে না, তা বোঝা যায়।

তবে লোটা যে ইউসুফ’ গোত্র নয়,তা ঠিক। কারণ বারো গোষ্ঠীরা আব্রাহামী আমোরাইট। মোসি ছিলেন ইউসুফ গোষ্ঠীর লোক হয়ত। কী ছিলেন বোঝা ভার। বারো গোষ্ঠীর নামগুলি চমৎকার। রুবেন, সিমিওন, লেবি, যিহুদা, দান, নপ্তালি, গাদ, আসের, ইষাখর, সবুলুন, ইউসুফ। হতে পারে মোসি ছিলেন যিহুদা গোত্রের মানুষ। কী হতে পারে কেউ জানে না।

লোটার আমালেকরা হয়ত বারো গোষ্ঠীরই কোন গোত্র-উদ্ভূত। কী বিচিত্র। গোত্রধর্মগুলি! কেন যে লোটাকে বোঝানো গেল না, এ ভাষা যেমন চাষীর ভাষা, তেমনি তাঁরুর মাংসখেকোদের ভাষাও বটে। যাযাবরী সংস্কৃতি কী উচাটন!

না পারে গৃহনির্মাণ, না পারে ধাতু বা পাথরের কাজ কিংবা চাষবাস। পুরো এক যাযাবর! এ লোক যুদ্ধ ছাড়া কিছুই পারবে না। পারবে হানা দিতে, লুঠ করতে, ঘর জ্বালাতে, উট দিয়ে শস্যক্ষেত্র তছনছ করে দিতে! এ মেষ প্রকৃতি নয়। উটের মত শূন্যে ভাসমান জীব। খুব অদ্ভুত যে,এখানকার অন্য সৈনিক আর দেবদাসীরা নিজেদের চাষী মনে করে–দুঃখী, কিন্তু তাদের জমিজায়দাদ ছিল একদা–ঐশ্বর্য ছিল! এই গর্ব তাদের সম্বল। ক্রীতদাসত্বেও অনেকে তার চাষীত্বের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি। অথচ যখন একজন সৈনিক তার বেদনার্ত গলায় সুর করে বলে :

‘আমার থাকবে এক আঙুর বাগিচা–
এ আমার নিজের কুঞ্জখানি প্রিয়,
বসিতে দিও ঠাঁই বিছায়ে আঁচলখানি তব;
ডুমুর বৃক্ষের তলে, আমার সে নিজস্ব ডুমুর,
কেউ মোরে হানিবে না তীর, বর্শা বা কুড়ল,
নির্ভয় সে জীবন মম, সেই মোর অমরাবতী তীরে
স্বপ্নের কুটীর ॥ [মীখা ৪ : ৪ ]

বোঝা যায় না, এই সৈনিকটি কে? যাযাবর,নাকি চাষী! এ তার কিংবদন্তীর সত্যযুগে নিবিষ্ট দু চোখ মেলে চেয়ে থাকা। সাদইদ জানে, যাযাবর আর চাষী আলাদা থাকেনি চন্দ্রকলার বাঁকা মৃত্তিকায়–অথচ লোটাকে তারা সহ্য করল না।

অথচ নিশিমার মত সামান্য দেবদাসী তাকে কুকুরের মত ধাক্কা দিয়ে দুয়ারের বাইরে ঠেলে ফেলে দিলে। এই দেবদাসীরা আমনের বউ। দেবতা সামাশকে সহ্য করে তারা, গ্রহণ করেছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের তুলাদণ্ডে মেপে। বালদেব আর আমন বা সামাশ অনেক শক্তিশালী–কিন্তু উট কী কাঙাল একটি জীব! অচ্ছুত ওই জীবটা, মৃতদেহ বহা ছাড়া কোনওই কাজ হয় না। চাষী বৃষভক্ত, তার শস্য বইবার গাড়ি কী উন্নত! দেবী ইস্তার কী লাবণ্যময়ী। হিত্তীয়রা রথ চালায়, আমনভক্তরানী ইবেলসূর্যের ধর্ম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছেন! রথের যুগ এখন শ্লথগতি ভাসমান উট কী বোকা! গা ঘৃণায় কুঁচকে যায়।

নিশিমারা সম্রাট ফেরাউনের ধাতুবলয় নির্মিত রথের চাকা বালুরাশির ঘর্ষণে আগুন-স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে ধাবিত হতে দেখেছে। কী শৌর্য! এই রথ নিয়ে ফেরাউন মোসিকে লাল দরিয়া অবধি তাড়া করে গেছিল! রাজা হিতেন যখন সুন্দরীদের দেখতে আসে এই জুমপাহাড়ীতে, তখনও আগুন ঝলসায় চাকার আবর্তে। রাজার পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সাধ হয় তেনার হারেমে গিয়ে থাকতে। রাজা হিতেনের দেহে রতি আর কামের সমান অবস্থা। কেমন সেই হারেম। নিশিমা বলেছে–আমি যাব! কিন্তু কে তাকে নিচ্ছে? ত রূপ তো নিশিমার নেই!

সাদইদ ভাবতে ভাবতে রিবিকার সুন্দর মুখোনির দিকে সকরুণ চোখে দেখল। রিবিকা বলল-লোটার কাছে একবার যাও। ও যে পাগল হয়ে গিয়েছে! রুহার অন্তরে এত ঘৃণা ছিল সারগন!

সাদইদ বলল–হ্যাঁ, রিবিকা! এখানকার দেবদাসীরা কোহিন আর বল-এর গল্প করতে ভালবাসে! আদম আর হবার দুই পুত্র! কোহিন চাষী। এবল মেশপালক, পশু চরায়। ওরা দুজনে ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য পাথর দিয়ে দু’টি বেদী তোয়ের করে। কোহিন তার শস্যসবজির উপচার বেদীতে রাখল। এবল রাখল তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ পশুর মাংস। তারপর দুজনই আগুন লাগিয়ে দিল। উদ্দেশ্য ছিল তাদের নৈবেদ্যের আগুনে পোড়া সুগন্ধ দেবতা গ্রহণ করবেন।

রিবিকা বলল-ইহুদের মুখে এ গল্প শুনেছি। এবলের ধোঁয়া আকাশে যবহের দিকে উঠে গেল। কোহিনের ধোঁয়া নিচে নেমে গেল। এই পাল্লাতে মেষপালক জিতেছে।

সাদইদ বলল–না রিবিকা! নিশিমারা কোহিনকেই জেতায়। বুঝতে পারি এই দ্বন্দ্ব যাবার নয়। অনেক দেবদাসী নিরামিষ আহার করে। অথচ মরুভূমির শীতে গা উষ্ণ রাখতে হলে মাংস-রুটিই খেতে হয়। ডুমুর-রুটি সৈন্যরা পছন্দ করে না। দেবদাসীরা কেউ কেউ ঘুচিবায় দেখায়। তবু শেষমেশ সেনাদের ঘরে নিতে আপত্তি দেখি নে! কিন্তু লোটা যে উট-উপাসক। খুব দুভাগ্য! আমরা যাযাবর, কে আর কে নয়-কারো বলার সাধ্য নেই। যুদ্ধ আমাদের এখানে গুতিয়ে এনে জড়ো করেছে। লোটা উটে করে মড়া বইবে–এ যেন একটা পেশা! এভাবে তাকে ঘৃণা করে ঠেলে দেওয়া হল! রুহার মৃত্যুর জন্য এই দুভাগ্য দায়ী। নবী সালেহও তো একটা শস্যসবুজ উপত্যকার স্বপ্ন দেখেছিলেন!

শুনতে শুনতে রিবিকা চমকে উঠল! সহসা তার চোখের সামনে আক্কাদের ভয়ংকর কঠোর মুখ ভেসে উঠল। উটের পিঠে দোলায়িত রমণের ক্ষুব্ধ বিষয় শোকাবহ স্মৃতি হৃদয়ে গুমরে উঠল।

রিবিকা সহসা এক অজ্ঞাত ভয়ে আপনমনে সিটিয়ে উঠল। সে তার অতীত জীবনের ছায়াকে মনের তলায় দেখতে পেয়ে জীবন সম্পর্কে এক অপূর্ব তৃষ্ণা অনুভব করছিল। এ তৃষ্ণা যে কিসের তা সে জানে না। সে আর সাদইদকে বলতে পারল না লোটার কাছে যাও। বরং তার মনে হল, সাদইদ তাকে এই মুহূর্তে যেন ছেড়ে না যায়। হঠাৎ তার মনের এই পরিবর্তন দেখে রিবিকা নিজেই কেমন হয়ে গেল।

বলল–এই দুপুরে আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই তোমার। যা হবার তা হয়েই গেছে। আমাদের বাচ্চাটা একা রয়েছে, ঘুম থেকে জেগে উঠলে ভয় পাবে!

সাদইদ রিবিকার কথা শুনে আশ্চর্য হল। মনে হল, এই মেয়েটির মনেও একটা সংসারের ছবি বিরাজ করছে, যে কিনা যুদ্ধকে ভয় পায়–আর লোটা যেন যুদ্ধেরই বিভীষিকা! রুহার মৃত্যুকে যেন রিবিকা গোপন করতে চাইছে!

সাদইদ বলল–লোটা গৃহনির্মাণ, চাষবাস, পাথরকাটার কাজ কিছু নিশ্চয়ই পারবে না। কিন্তু দেশরক্ষার কাজে তার কোন জবাব নেই। অথচ দেখো লোটার নিজেরই কোন দেশ নেই।

রিবিকা এ প্রসঙ্গ আর শুনতে চাইছিল না। বলল–তোমার পাহাড়টা কি ভাল সারগন। আকাশের তলায় এ যেন আশ্চর্য স্বপ্ন!

–তোমার পছন্দ হয়েছে?

–খুউব! তবে আমার পছন্দের কীই-বা দাম!

–কেন?

–কালই তুমি আমায় তাড়িয়ে দেবে! দেবে না?

–কী করে বলব!

সাইদের এই জবাবে বক্তা এবং শ্রোতা দুজনই অবাক হয়। রিবিকা প্রথম থেকেই শুনছে সাদইদের প্রচুর সুন্দরী রয়েছে, অথচ নিজের বলতে তারা তার কেউ নয়-বাই মন্দিরের মাল। যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া মজুত দ্রব্য। সাদইদ প্রকৃতপক্ষে লোটারই মত একা। কিন্তু লোটার মত বিচ্ছিন্ন নয়, বঞ্চিতও নয়। কাকে তবে সে ভালবাসে? একজন দেবদাসীর কী হবে–সেকথার জবাব তার জানা নেই–একথা বিশ্বাস করতে হবে! পরম আশ্চর্য হয়ে ঘাড় ফেরাল রিবিকা! সাদইদের চোখের দিকে তবু সে চাইতে পারল না।

সাদই অবাক হয়ে রিবিকাকেই অপলক দেখছিল। কী এমন ঘটল যে,এমন কথা তার মুখ থেকে বার হল! দেবদাসীর কী হবে কাল–এ যে বাতুল অতি নগণ্য প্রশ্ন! একজন দেবদাসী সূর্যমন্দিরের রক্ষিতা যুদ্ধের জ্বালানি–সৈনিকের দ্রাক্ষারস!

দিগন্ত থেকে এক ঝলক বাতাস এসে অশ্বের গায়ে লাগে। রিবিকার গাত্রাবরণ খসে পড়ে, সোনার মত শরীর, মায়াপুষ্পময় বক্ষস্থল, যা বর্ণবহুল। প্রজাপতির পুষ্পভ্রম ঘটায়, মরুর বুকে এক আশ্চর্য শীতলতা, কোন দামেই এ ঠিক খরিদ হবার নয়, এ যেন সৌন্দর্যের সকল আধারকে উপচে ফেলে!

আকাশে দীপ্যমান দেবতা সামাশ। দূরবর্তী মরুপ্রাঙ্গণে আর্ত তৃষ্ণার্ত লোটার। নিরাকুল চিৎকার চকিত হয় মাঝে মাঝে! দিগন্তে মানুষের সারিবদ্ধ ছায়া, সামনে শববাহক উট, জীবন চারিদিকে ধু-ধু করছে। ঘোট পাহাড় থেকে খোমশের (বালদেব) পূজার ঘণ্টা বিষয় বাতাসে অস্পষ্ট ভেসে আসে। এমন আবহের ভিতর জীবনের এক অবধিহারা বিস্ময় প্রজাপতির পাখার তরঙ্গের মত কাঁপতে থাকে–রিবিকার চোখ দুটি যেন ছায়াচ্ছন্ন রঙিন সবুজ হ্রদ–দুটি চোখ কাঁপে–পাতা কাঁপে, জল ভরে ওঠে।

ধরা গলায় রিবিকা সহসা বলে–পিরামিডের আকাশে চাঁদটা উঠত সারগন। মনে হত, ওই আকাশ আর চুড়ো ছেড়ে কোথাও সে যেতে পারবে না।

–তারপর?

–এখানে এসে দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় চাঁদটা এসে পৌঁছেছে। এবার ফের মনে হল, চাঁদটা আর কোথাও যেতে পারবে না। পাহাড় ছেড়ে পালাবার সাধ্যই তার নেই। নীল নদীর আকাশে এই চাঁদটা অস্ত গিয়েছিল সারগন!

বলতে বলতে উচ্চকিত স্বরে কেঁপে উঠল রিবিকা। অষের পিঠের একপাশে রিবিকার পা দুখানি ঝুলছিল–তার পিছনে সূর্য সামনে পাহাড়।

–তারপর?

–কে জানত! চীদ আবার ওঠে! আকাশ কত দূর। তার শেষ নেই। এখানে রাত্রি এল! চাঁদ উঠল! আমি তাঁবুর তলে শুয়ে চাঁদ দেখেছি সারগন! কাল আমার কী হবে বলে দাও!

–সে তো গণকের কাজ রিবিকা!

–দেবদাসীর ভাগ্য তুমি জানো না? আমায় তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ! কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস ফের হারিয়ে গেলে হৃদয় তবু খারাপ করে! করে না? যার কোনই দাম নেই, তা হারালে মন (হৃদয়) খারাপ হওয়া কী যে বাজে ব্যাপার!

–তারপর?

–তবু তুমি আমায় কিনবে কবি? নোহের সন্তান তুমি!

এই হৃদয়বিদারক আকুলতা যেন শেষহীন এক তরঙ্গ–যা লোটার আর্তনাদকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। দুটি স্বরই নিরাকুল, নিরাশ্রয়-দুটি বিপরীত আঘাতে বুক ভাঙে। সাদইদের হৃদয় একটি দ্বীপের মত সমুদ্রে একা জলের তরঙ্গায়িত দোলায় বিধৌত হয়–সেই সমুদ্র, যার বাতাস কিনারে এসে সমুদ্রেরই গর্ভে ফিরে যায়–সে তেমনি এক রুদ্ধ সমুদ্রের মত তোলপাড় করতে থাকে।

–নোহের সন্তানের কাছে বেদামী মানুষও দাম চাইতে পারে সারগন। তুমি কবি। তুমি ছাড়া আমায় তো কেউ কিনবে না। মহাত্মা ইহুদ আমার বাবা। তাঁকে একটি ভাল কাজ দাও। অপমান করো না।

–অ!

–কী হল?

–না। কিছু নয়। আমি কবি নই রিবিকা! আমি ভাড়াটে সৈনিক।

–তুমি রাগ করলে? ইহুদকে মহাত্মা বলেছি বলে?

সহসা কড়া গলায় সাদইদ বলল–একজন দেবদাসী খুবই চালাক হয় রিবিকা! বাইরে সে সুন্দর হলেও অন্তরে অনেক ফাঁদ পেতে বসে থাকে। জানি নে তুমি আমার কাছে কী চাইছ? প্রজাপতি দুটি আমার মত ব্যর্থ কবির ভ্রান্তি মাত্র । দ্যাখ, দেবদাসী কী করে একই সঙ্গে এক পুরুষকে লেহন করে, অন্য পুরুষকে দেহ দেয়। যাকে পিতা বলে ডাকে, সে হয়ত তার প্রেমিক!

রিবিকার দুই চোখ দপ করে জ্বলে উঠল মুহূর্তে। তার মনে পড়ে গেল আক্কাদ তাকে কন্যারূপে খরিদ করে দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের সময় পুরুষের হৃদয়ে কোন সত্য থাকে না।

রিবিকা অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে বলল কার কাছে কী চাইছি সারগন! কিছুই চাই না।! তুমি যা খুশি করতে পারো। তোমার কাছে দয়া চাওয়া যায়। ভদ্রতা আশা করা যায় না। ভাড়াটে সৈন্য বর্বর–সেকথা সবাই জানে! যুদ্ধই যার নেশা–তার কাছে চাইবার কী আছে! আমায় ঘোড়া থেকে নামতে দাও! তুমি হেরার পুত্রকে মধু দিতে চেয়েছ, তাই যথেষ্ট!

বলে রিবিকা গায়ের কাপড় সামলে তুলে নিচে লাফিয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত পাহাড়ের দিকে ছুটল। পাহাড়ে ঢুকে এসে দেখল শিশু তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘুমন্ত শিশুকে বারবার চুমু খাচ্ছিল আপন মনে রিবিকা–একসময় তার পিছনে এসে দাঁড়াল সাদইদ। তার আসা টের পেয়ে পিছন ফিরে স্পষ্ট চোখে দেখল সাদইদকে।

সাদইদ হঠাৎ বলে উঠল–যুদ্ধই আমার নিয়তি রিবিকা। তুমি তোমার কাল কী হবে জানতে চেয়েছিলে। রুহার মন্দিরটা খালি হয়ে গেল! সেখানে তুমি কালই

–সারগন!

দুচোখে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।

–বাইরে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে হিতেনের দৃত। হয়ত এখনই আমায় চলে যেতে হবে! তোমায় খরিদ করার সামর্থ্য আমার নেই বলেই সারগন বাইরে বেরিয়ে চলে গেল! রিবিকা তার পিছু পিছু ছুটে এসে দেখল একটি সোনালী অষের চালক সারা গায়ে কালো পোশাক মোড়ানো, সাদইদের সঙ্গে কথা বলছে। গোল কাগজে পাকানো পত্র পাঠ করল সাদইদ। তারপর তড়াক করে অশ্বে লাফিয়ে উঠে পিছন ফিরে রিবিকাকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল! অস্বাভাবিক ক্রোধে মুহূর্তে তার মুখ কঠোর হয়ে গেল। সহসাই নেমে এল ঘোড়া থেকে। রিবিকার সামনে এগিয়ে এসে গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল–কেন ছুটে এলে?…যাও!

এই সময় কালো পোশাক হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠল। তার কালো মুখ সাদা দাঁতে সবুজ একটা ছোপ লাগানো চামড়ায় হাসির চোটে কুঁচকে গেল।

এত জোরে চড়টা মেরেছিল সাদইদ যে,রিবিকার মাথা ঘুরে গেল! সে পড়ে গেল নিচে। আশ দুটি ছুটে গেল দিগন্তের দিকে। ঝাঁপসা চোখে কান্না-প্লাবিত রিবিকা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পাহাড়ের পায়ের কাছে ছায়ায়, এই অংশে পাহাড়টি বেঁকে সূর্যকে আড়াল করেছে।

দিগন্ত থেকে শবানুগামীরা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে শববাহক উট। নিঃসঙ্গ উট, যার দোলানো গলা শূন্যে ভাসে নিরবলম্ব। আর্তনাদ করছে লোটা। তার অশ্ব চিৎকার করে আকাশ মথিত করছে।

রিবিকার গালে সাদইদের পাঁচটি আঙুলের ছাপ স্পষ্ট বসে গেছে। গালে হাত বুলাতে বুলাতে কান্নায় ফোঁপানো রিবিকা চোখ মুদে ফেলে আশ্চর্য হল–সারগন কি তবে তাকে সত্যিই ভালবেসেছে! নাকি অন্য কিছু? সারগন হঠাৎ অত খেপে গেল কেন? কালো দূতটির সামনে তার বেরিয়ে আসায় কী অপরাধ হয়েছে? ওহো! মা গো! ও যে হিতেনের তাঁবেদার! এ যেন আর এক ফেরাউনের সেপাই।

হঠাৎ রিবিকার শিশু কেঁদে ওঠে। রিবিকা সেই কান্না ক্ষীণ সুরে ভেসে আসতে শোনে। দ্রুত ছুটে যায় পাহাড়ের ভিতর।

শিশু রিবিকার গালে স্পষ্ট ছাপ দেখে হাত বাড়ায়। একটু-আধটু অবোধ গলায় কথা বলার চেষ্টা করে। শিশুর কোমল আঙুলের ছোঁয়ায় রিবিকা শিহরিত হয়। সাদইদ শিশুর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। পর্যাপ্ত দুধ। মধু,আঙুর। এমনকি নানারকম খেলনা। তার মধ্যে মিশরের কাগজে আপন হাতে বানিয়েছে নৌকা। যার মধ্যভাগ পিরামিডের মত খাড়া হয়ে উঠেছে একটু বেশি।

শিশুকে বলেছে–এই তোমার নৌকা বাবুসোনা! নোহের কিস্তি। এই তোমার ফেরাউনের পিরামিড। সবই তোমায় দিলাম। মানকরোনা! পিরামিড তোমার ঐশ্বর্যের নিশানা। নৌকা তোমার দুঃখের ভার বইবে। জীব আর বীজের প্রতিপালক হবে তুমি। তোমার হাতে যেন মানুষ কখনও দুঃখ না পায়! তুমি কখনও আমার মত শিশুমেষকে হত্যা করবে না। তুমি পিঁপড়ে পাখি পতঙ্গের ভাষা বুঝবে। তুমি হবে নতুন স্বর্গের ভাস্কর।

রিবিকা ককিয়ে উঠল–সারগন যে আমায় কিনতে চাইলে না খোকা! তোর জন্য যে লোকটা ব্যবস্থা করেছে, সে যে কালই আমায় মন্দিরে ঢোকাবে! এই পাহাড়টার মতই মানুষটা কী রহস্যময়! আমি কী বোকা রে!

শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অঝোরে অশ্রুপাত করছিল নিঃশব্দে রিবিকা। এমন সময় গবাক্ষপথে একটি রক্তমাখা অদ্ভুত মুখ ভেসে উঠল। কে ওটা? ও কি মানুষ? আঁতকে উঠল রিবিকা।

লোটা হা-হা করে হেসে উঠে বলল–শোন বোন! আমার ভাষা তুমি ছাড়া কেউ বোঝে না! তুমি কুমারী আনাথ। আমি তোমার ভাই বালদেব! ভয় কি? তুমি ছদ্মবেশী বকনাবাছুর! এখন চারিদিক নির্জন। কেউ জানবে না। দুয়ার খুলে দাও । আমি ক্ষুধার্ত! রুটি মাংস চাইনে। তোমাকে চাই। তোমার আমার মিলনে সমুদ্র মেঘ পাঠাবে! এ জীবন অমর নয় রিবিকা! আমি শববাহক। ঘেন্না হয় বুঝি! এসো আমরা দু’জন উঠের পিঠে মিলিত হই!

কনানী পৌরাণিক গল্পের কুৎসিত প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপন করছিল লোটা । অপমানে ভয়ে রিবিকার মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। স্বয়ং যুদ্ধের বিভীষিকা গবাক্ষ ধরে দাঁড়িয়েছে। ভয় হচ্ছিল সে যদি জোর করে পাহাড়ের ভিতর ঢুকে পড়ে!

লোটা ফের বলে উঠল–আমি পদাতিক নই। আমি সাদইদের অশ্বারোহী এক নম্বর সেনাপতি। আমার গোত্র ছোট হতে পারে, ধর্মে আমি কাঙাল হতে পারি কিন্তু আমার সম্মান আছে রিবিকা! আমি মন্দিরের সামনে যত্রতত্র লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পারিনে। আমি নোংরা দেবদাসীর কাছে গিয়ে শরীরে রোগ বাধাতে পারিনে। আমার নবী সালেহ। তিনি পয়গম্বর। তিনি জীবন আর মৃত্যুর অধিপতি। জীবন আর মৃত্যুকে কেউ বহন করে না। তুমি দুয়ার খুলে দাও। যদি অনুমতি করো, আমি ভাল পোশাক পরে আসতে পারি। আমাকে একটিবার অন্তত সারগন বলে ডাকো তুমি। একবার ডাকো!

গবাক্ষের নিচে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে লোটা। যদি পড়ে যায়, দৈবাৎ হাত ফসকে গেলে মাথার খুলি পাষাণে পড়ে থেঁতলে যাবে নির্ঘাত।

মুখাকৃতি কেমন এক মায়াময় লোভে, রক্তের ছিটে দাগে করুণ আর ভয়ংকর দেখায়। ককানো আর্ত ভাষা পাগলের মত।

–ঠিক আছে, ছোট জাত বলে দুয়ার না হয় বন্ধ রাখো। আমি এই পাহাড়তলীর জনপদ রক্ষা করছি বিবিকা! মড়ার গন্ধে তিষ্ঠোতে পারতে না। এখন দুপুরে হালকা লু বইছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর শীত পড়তে শুরু করবে। শীত আসন্ন। কত দেবদাসী আর শিশু মহা-শীতে নষ্ট হবে– বাঁচবে না। মড়ার গা থেকে পোশাক খুলে নিয়ে সেদ্ধ করার ছোট কাজটি কেউ করবে না। সালেহ। ছিলেন পবিত্র। তাঁর উম্মত বলে এ কাজ করি। তাই বলে জাত আমার ছোট নয়। তোমরা কেন উটের মত উপকারী প্রাণীকে শব বইবার দায়িত্ব দিয়েছ? শুঁটকি আর মদ বহে বেড়ায় এই জীবটা, কিন্তু প্রকাণ্ড পাথর টানা ছাড়াও সোনাদানাও তো বইতে পারে। পারে না? তোমরা চাষীবাসী, তোমরা মিশরের। দেবদাসী, দেবরাজ সামাশতোমাদেরভগবান। সব ঠিক। কিন্তু আমি তো শুধু পায়ে হাঁটা লাগাম ধরা চুটকিলা গাওয়া উটের চালক যাযাবর নই। আমি সেনাপতি, রিবিকা!

মানুষের দীনহীন এমন আকুলতা কখনও শোনেনি রিবিকা–যুগপৎ মর্যাদাবান অভিমানও দেখেনি কোনদিন। একই সঙ্গে তার আপন ধর্মের প্রতি, ভাষার প্রতি ভালবাসা আর সংকোচ লোটাকে দগ্ধাচ্ছে। লোটা যেন স্বয়ং যুদ্ধের অস্তিত্ব–যাযাবর জাতিগুলির সমষ্টি সত্তার রূপ, ক্রীতদাসের একান্ত-হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। লোটা কাতরাচ্ছে পথ হারানো মরু যাযাবর পিতা আব্রাহামের মত। অধিকারহারা এমন মানুষটিকে একবার রিবিকার সারগন বলে ডেকে উঠতে মন চায়। পারে না।

ভয় করে। সংকোচ হয়। ঘৃণাও হয়। কেন এই ঘৃণা সে জানে না। সে নিজে দেবদাসী–যুদ্ধের পাপ মোছর রুমাল! জীবনের তলানি মদ, কটু কাদামাখা বালিভরা মরুকূপের জল। নানান পুরুষে লেহিত, এটো ঝুঠো পরিত্যক্ত মদপাত্র, কানাভাঙা, কুকুরে চেটে তোলা শীতার্ড বাটিখুরির ছবি। রক্তমাখা ওই মুখটা, ফাটা জামা ছিঁড়ে গা থেকে ঝুলছে, যুদ্ধের শোণিতে কালো ছোপঅলা শবগন্ধময় পোশাক দেখে, শক্ত চোয়াল, চোখের তলায় মরুভূমির বালি, খোঁচা-খোঁচা দাড়ির ভিতর লু ঝাঁপটানো উষরতা–চোখ করুণ আর রক্ত রাঙানো বদ গোপন ধূর্ততা জড়ানো–এ মূর্তি কী ভয়াল! এ দেখে বুক শুকিয়ে কাঠ হয়।

রিবিকার ঠোঁট থরথর করে কাঁপে। হেরার পুত্রকে বুকে আঁকড়ে ধরে সভয়ে বারবার। চোখ তুলে গবাক্ষে চাইতে গায়ে ঘাম দেয়। সারা মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষের ক্ষুধার্ত কাতর চোখ এত তীব্র আর আকুল হয় করুণাঘন হয়? কী করবে রিবিকা?

–আমার ভাষা কেবল তুমিই বোঝে রিবিকা! এই মরুভূমিতে আর কেউ নেই। মানুষ কথা না বলে থাকতে পারে! বলল দেবী ইস্তার! কতকাল মুখ বুজে থাকব!

রিবিকা পারে না। মনে মনে বলে ওঠে–আমার সারগন যে একজনই লোটা!তাকে পাই না-পাই জীবনের শেষ বাসনা তারই পায়ে অঞ্জলি দিয়েছি। সারগন নিজেও জানে না আমার কী হয়েছে। মন্দিরে আমায় এভাবে ডেঝে না লোটা!

গবাক্ষ আঁকড়ে ধরায় পেশল কঠিন হাত দুখানি ফুলে উঠেছে শক্তির উল্লাসে। কিন্তু হাত ফসকে গেলে লোটা বাঁচবে না। একদিকে রিবিকার শেষ বাসনার সুতীব্র তৃষ্ণা, অন্যদিকে লোটার দুর্ভাগ্যের প্রতি ঘৃণা-মেশানো সহানুভূতি তাকে বিচলিত করে। সে ফুঁপিয়ে ওঠে।

লোটার মুখটা এই কান্নার স্পর্শে অসাধারণ কোমল হয়ে পড়ে। দগ্ধ রক্তাক্ত চোখ নিবে গিয়ে ঘষা নক্ষত্রের সুদূর আলোর মত ম্লান হয়ে ওঠে। ঠোঁটের ভাঁজে সিঞ্চিত হয় অপরাধের ভাষা। লোটা যেন অন্যায় করে ফেলেছে।

হঠাৎ তার মনে হয়, তারই কারণে রুহা আত্মহত্যা করেছে। এবার রিবিকার যদি কিছু হয়! লোটার আঁকড়ানো হাত মুহূর্তে শিথিল হয়ে পড়ে! হাত খসে যায়।

লোটা পাষাণের উপর পতিত হয়। রিবিকা প্রাণফাটা আর্তনাদ করে গবাক্ষর কাছে ছুটে আসে। নিচে চোখ মেলে বোবা হয়ে যায়। পাষাণেই পড়েছে বটে কানি-পরা আব্রাহাম। নড়ছে না। মৃদু ফোঁপানি চকিত হয় রিবিকার কণ্ঠে। কালো ঘোড়া মনিবকে এসে শোঁকে। ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে দেহ। মরেনি। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে পড়েনি। তবে পায়ে লেগেছে। লেংচে ওঠে লোটা।

ঘোড়ার পিঠে ওঠার আগে করুণ চোখে গবাক্ষর দিকে চায়। লোটা সেই যুদ্ধ, যার অবসান সহজ নয়। পা খোঁড়া হতে পারে, কিন্তু যে পড়ামাত্রই মরে না। কালো ঘোড়া লু-প্রবাহিত ঝাঁঝালো রৌদ্রে, কম্পমান রৌদ্র তরঙ্গে-তরঙ্গে কেঁপে ওঠে ছবির মত। অশ্ব আর অশ্বারোহী–দূরে ভেসে যায়। এবার একা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিবিকা।

আকাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেষশিশুর মত মেঘ জমতে থাকে। হঠাৎ রিবিকা দেখে ভগবানের বন্ধু মোসি লাঠি হাতে মেযেদের চালিত করছেন–আকাশে মানুষের মত একটা মেঘ দেখা যায়।

রিবিকা মহাত্মা ইহুদের নাম ধরে কেঁদে ওঠে সশব্দে। হঠাৎ তার মনে হয়, এ পাহাড়টি যেন এলিফেনটাইন দুর্গের মত। সে বন্দী। এই শিশু বন্দী। সাদইদ এক নব্য ফেরাউন।

সাদইদ যখন ফিরে এল, রাত্রি তখন যথেষ্ট গম্ভীর হয়েছে। চাঁদ পাহাড়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে অনেক উপরে দাঁড়িয়ে। সাদা অশ্ব পাহাড়ের গা চাটছে। তার ফোঁসানি শোনা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একা সাদইদ। রিবিকা ঘুমাতে পারেনি।

রিবিকা ফোঁসানি শুনতে পায়। বাইরে বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারে সাদইদ ফিরেছে। ভয়ে ভয়ে সে সাদইদের কাছে এগিয়ে আসে। সাদইদ রিবিকাকে ফিরে দেখে না। চাঁদের আলোয় তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। এক-পা এক-পা করে একটি উচ্চ শিলার দিকে এগিয়ে যায় সাদইদ। বসে পড়ে। সামনে পা মেলে দেয়। চওড়া শিলা। পিছনে হাত মেলে দেয়। হাতের উপর ভর দিয়ে পিছনে চিতিয়ে থাকে। চাঁদ দেখে যায় আপন মনে। তার এই নীরবতায় ভয় পায় রিবিকা।

সাদইদ যখন চোখ মুদে বসে থাকে–তখন রিবিকা ভয়ে অপরাধে, দুপুরের দূত আসার সময়ের ঘটনার কথা মনে করে, হঠাৎ বোকার মত পাহাড়ের বাইরে চলে আসার অপরাধ করার কথা ভেবে সাদইদের পায়ের তলায় চুপ করে বসে পড়ে। রিবিকার ছোঁয়ায় চোখ মেলে সাদইদ।

সাদইদের মনে হয় তার পায়ের তলায় একটি মেষ, যাকে সে বশায় গেঁথে ফেলেছিল, সে পড়ে আছে। বুকে তার এক পরমাশ্চর্য মায়া ছলছল করে ওঠে। সে জানে, এই বুক বৃষবক্ষ, নির্মম। তবু কোথাও একটা নদী আছে বিস্তীর্ণ সাদা মরুর তলায়–দেখা যায় না। নদীতীরে অমরাবতী–এক নগরীর কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে। স্বর্গের হৃদয়ে এক কক্ষ–যেখানে বিরাজ করছে চির বসন্তের স্ফটিক স্বচ্ছ আলো–সেই আলোয় ঘুমিয়ে রয়েছে এক নারী–দুটি প্রজাপতি তাকে খুঁজছে। এই মোহ কি দূর হবে না কখনও? খুবই ভাবাবেগে হৃদয় যেন বুজে আসে!

রিবিকা হঠাৎ বলে–আমাকে মুক্তি দাও সারগন!

মুহূর্তে সেই নদী যেন সাদইদের পায়ের তলা ছুঁয়েছে–চাঁদ সাক্ষী! সাদইদ সহসা রিবিকাকে দু’হাতে আকর্ষণ করে বুকে টেনে নিয়ে বলে–আমি কিছুতেই আর পারছিনে রিবিকা! তোমাকে আমি কারুর জন্য দিতে পারি না। তুমি আমার যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া, কুড়োনো! চাঁদ জানে, আমি কী বলছি!…

.

০৬.

এক গভীর অবসাদ ছাড়া আর কিছুই নেই। রিবিকার শরীরকে শতবার আলিঙ্গন করেও সাদইদের তৃপ্তি হয়নি। এক অব্যক্ত অবসাদে মন ভরে আছে। তার কোমরে ঝুলছে রাজা হিতেনের দেওয়া সন্ধিপত্রের স্বর্ণফলক। এই সন্ধিপত্রে রাজা সাদইদের কল্যাণ কামনা করে লিখেছে–তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সীলমোহর অঙ্কিত স্বর্ণফলকে তোমার স্বাক্ষর চিহ্নিত করেছি, তোমার আমার যুক্ত স্বাক্ষর খোদিত হয়েছে। তোমার সৈন্যবাহিনী আমার অনুগত থাকবে। কেউ কোন সামাজিক অপরাধ করলে তার বিচার-ভার তোমার বটে, কিন্তু আমার পরামর্শ প্রার্থনীয়, তুমি অনুগৃহীত সেনাধিপতি, আমার দানছত্রের অধীন মরু অঞ্চল, পাহাড় ও দ্রাক্ষাকুঞ্জগুলি শোভিত রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা তোমার কাজ। তোমার নিকট কর প্রার্থনা করি না। কেবল যখন আমার সাম্রাজ্যে সুন্দরীদের প্রতিযোগিতা হয় তখন তুমি উৎকৃষ্ট সুন্দরী সরবরাহ করবে। একটি উৎকৃষ্ট সুন্দরীর বিনিময়ে তোমাকে দেওয়া হবে কিছু ডুমুরবৃক্ষ, একটি দ্রাক্ষাবাগিচা এবং নতুন কোন অঞ্চলরেখা, তাতে থাকবে উদ্যান আর শান্ত জলাশয়। তোমার কল্যাণ এবং মঙ্গলসাধনা রাজা হিতেনের কর্তব্য। তুমি নিজে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারো না। আমার প্রণীত আইনই তোমার পালনীয় আজ্ঞাস্বরূপ। কারো উপর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রয়োগ করার অধিকার তোমার নেই। যৌন-পীড়কের শাস্তি মৃত্যু। দেশদ্রোহিতা-হত্যা এবং যৌন অপরাধের জন্য আমার নির্দেশ আছে মৃত্যুদণ্ড। তাছাড়া বাকি অপরাধের দণ্ডগুলি মৃদু ও কোমল। ‘নারী-বিলাস’ পুরুষের সৌন্দর্যচর্চা। নারী তার প্রিয় পুরুষের কাম প্রশমন করে সূক্ষ্ম কলানৈপুণ্যে, ব্ৰীড়ায়, লাস্যে,সংগীতে ও নৃত্যে। নারীর ক্ষমতা স্বর্গীয়। তাকে পদাঘাত ও বলাকার করা পাপ। অত্যন্ত সুদক্ষ, প্রত্যয়বান সৈনিকও যদি কোন সামান্য দেবদাসীর উপর গর্হিত আচরণ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে মৃত্যুদণ্ডই হবে সৈনিকটির শাস্তি। মনে রাখবে আমার চর তোমাকে সর্বদা অনুসরণ করে। অথচ তুমি আমার সন্তান মাত্র।

নারীর ক্ষমতা স্বর্গীয় অথচ আমি হিতেনের সন্তান হয়েও চোখের সামনের এই নারীকে উপভোগ করতে পারছিনে। কেবলই এক বিষাদ আমাকে আচ্ছন্ন করছে। ভাবতে ভাবতে বেদনা-জড়ানো চোখের পাতা তুলে রিবিকাকে দেখল সাদইদ। ভোর হয়েছে পাহাড়ের শীর্ষে–শান্ত সাদা সীসার মত উজ্জ্বল।

পাহাড়ের মাথায় সেই এক শান্ত রহস্যময় স্নিগ্ধ প্রত্যুষ। সূর্য ওঠেনি। ঈশ্বরের নিঃশ্বাসে ভরে আছে মরুভূমি।

সাদইদ রিবিকার দিকে চেয়ে বলল-রুহার মৃত্যু এক অভিশাপ রিবিকা! রাজা হিতেন লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিয়েছে। রাজার রথ আসবে। তার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় তোমার নাম তালিকাবদ্ধ হয়েছে। এই দণ্ডাজ্ঞা পালন করতে আমি বাধ্য। তোমাকে উপহার দিয়ে আমি যা পাব–দ্যাখো রিবিকা রাজাই তো ঈশ্বর! তার অলক্ষ্য কিছু নেই।

বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাদইদ। সাদইদ ফের বলল–লোটা জানেই না, তার পরমায়ু শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমিও জানতে না তোমার ভবিষ্যৎ। গত রাত্রি এক দুঃস্বপ্ন ছিল। কোন নারী বা কোন সৈন্য আমার নয় রিবিকা। এই পাহাড়ও আমার নয়। ইতিহাস সুদীর্ঘ মানুষ একদিন বিশ্বাস করতেই চাইবে না রাজা ঈশ্বরের মত ক্ষমতাবান ছিল। এই যুদ্ধ শেষ হবে। আমি কী তুচ্ছ দ্যাখো, তোমাকেও রক্ষা করতে পারি না! নারী আর শিশুর রূপ স্বর্গীয় নিশ্চয়ই–যুদ্ধই বারবার তাকে ধ্বংস করেছে। আমার যদি দেশ থাকত তোমাকে আর লোটাকে নিয়ে সেখানে চলে যেতাম। চোখের সামনে লোটার মৃত্যু আর তোমার বিসর্জন দেখে যেতে হবে।

–না। এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না!

বিপন্ন আর্তস্বর রিবিকার কণ্ঠে দলিত হয়ে ওঠে। তার কেবলই মনে হতে লাগল, এই ভোর কেন এল? এই জীবন কেন সে পেয়েছিল! গত রাত্রির মত একটি বিপুল বিস্ময়কর অপার সুখের রাত কেন তার মত হতভাগ্য দেবদাসীর জীবনে আসে! কেন তার হৃদয়কে দুটি নির্মল প্রজাপতি অধিকার করেছিল। শববাহক লোটা কেন এই মরুমর্তে জন্মলাভ করে! রাজাই যদি দেবতা, রাজাই যদি ঈশ্বর, তবে মহাত্মা ইহুদ কেন তাদের মুক্তির কথা বলেছিলেন?–হায় যবহ, হায় ইয়াহো!

–অসম্ভব! এ হতে পারে না। কিছুতেই নয়। আমি যাব না সারগন! ছেড়ে দাও। তুমি যুদ্ধ ছেড়ে দাও! এতটুকু জায়গা কি কোথাও নেই?

কামনাদীর্ণ স্বর উচ্চকিত নিনাদে ফেটে পড়ে পাহাড়ের অভ্যন্তর-সীমায়। যখন দিনের প্রথম সূর্যালোক মরুভূমির বালুকা স্পর্শ করল, লোটার কালো ঘোড়া লাফিয়ে উঠল, লোটা তার পিঠে চড়েছে–একা ভোরে অশ্বারোহণ লোটার এক ধরনের নিঃসঙ্গ খেলা। অশ্ব মাঝে মাঝেই তাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। ইচ্ছে করেই হুমড়ি খেয়ে বালুতে আচমকা লুটায়। অশ্ব জানে না, এইই লোটার শেষ ঘোড়ায় চড়া। ঘোড়াটি থাকবে। লোটা থাকবে না। একথা অশ্ব যেমন জানে না, নোটাও জানে না।

মরুস্থলীর সকলে জেনেছে যেকথা–ভাষার অভাবে লোটা তা জানতে পারেনি। সে আহ্লাদে নিশ্চিন্তে আপন মনে খেলা করে চলেছে। তার বিশ্বাস। অগাধ। সাদইদ থাকতে তার কোনওই ভয় নেই। মৃত্যুও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সাদইদ লোটার চাউনি, চলাফেরা, যুদ্ধযাত্রার প্রতি মুহূর্তে একথা অনুভব করেছে।

লোটার আহ্লাদিত অশ্বক্রীড়া দেখতে দেখতে সাদইদের বুক অসম্ভব বিষাদে। পূর্ণ হয়ে যেতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধ রিবিকার চোখ ছলছল করে উঠল। মনে পড়ল, কালই বেচারি তার কাছে অদ্ভুত প্রস্তাব করেছিল। একবার অন্তত সারগন বলে ডাকার জন্য আকুল প্রার্থনা জানিয়েছিল। ডাকলে কী ক্ষতি ছিল!

মহাত্মা ইহুদ পাহাড়ের দিকে এই ভোরবেলা পায়ে পায়ে হেঁটে আসছেন। অদ্ভুত দৃপ্ত তাঁর ছুটে আসার ভঙ্গি। মসীহরা যেমন লম্বা পা ফেলে হাঁটেন। তাঁকে দেখে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সহসা স্খলিত লোটা কপালে হাত ঠেকিয়ে সহাস্য অভিবাদন জানাল। সলজ্জ ভঙ্গিতে গা ঝাড়তে লাগল। ইহুদ ইশারায় লোটার অভিবাদন গ্রহণ করলেন। তারপর একদণ্ড সময় নষ্ট না করে সাদইদের সামনে এসে বিনা ভূমিকায় বললেন–লোটা জানে না আজ তার মৃত্যুর দিন। তাকে এ কথা শোনানোর দায়িত্ব কে নেবে? তুমি তার মৃত্যু-সংবাদ বহে এনেছ।

–হ্যাঁ এনেছি।

-সেকথা বলার জন্য কাউকে নির্দেশ দাওনি? তোমার সন্ধিপত্র মাটির ফলকে উৎকীর্ণ করে দেবমন্দিরের সামনে স্থাপন করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না হিতেনের পোলা!

এরকম দৃপ্ত বাঁকা কথায় কী আশ্চর্য আজ সাদইদের মেরুদণ্ড কেঁপে উঠল। হঠাৎই ইহুদ নামের সামান্য সেবক লোকটি, দেবদাসীর অনুগত অত্যন্ত নিম্ন পেশার মানুষটি যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছেন। সাদইদ ইহুদকে চিনতে পারছিল না।

–রাজার আইন আমি মানতে বাধ্য ইহুদ!

–কিন্তু আমি ঈশ্বরের আইন ছাড়া কোন আইন মানতে বাধ্য নই সাদইদ! একথাটা তোমাকে বলার আজ বিশেষ প্রয়োজন। রাজার রথকেও আমি ডরাই না। জানি রথ আসবে। কিন্তু লোটার মৃত্যুই কি অনিবার্য। তুমি তাকে ভাষা দিতে পারোনি, ধর্ম দিতে পারোনি–এমনকি একটি নারীও তোমার ছিল না! অথচ সে তোমার জন্য প্রাণ বিপন্ন করেছে কতবার! সেই প্রাণটাই আজ তুমি। কেড়ে নিতে চলেছ! এই যদি তোমার আইন–তবে সেই আইন আমি মানি না। কেউ মানে না।

–এ আমার আইন নয় ইহুদ। রাজার আইন!

–তুমি তার পুত্র!

–না। আমার পিতা একজন ভিস্তি। আমার জন্মের ইতিহাস নেই।

–তবে তুমি এই আইনকে অস্বীকার কর।

আপনি করুন। আমি বাধা দেব না। আপনি আমাকে কেন এভাবে আঘাত করছেন!

সাইদের চোখ ছলছল করে উঠল। ইহুদ কিঞ্চিৎ নরম হয়ে সাদইদের সামনে মেঝেয় বসে পড়লেন।

সসম্ভ্রমে ব্যস্ত হয়ে সাদইদ বলল–ওভাবে মাটিতে বসছেন কেন আপনি! আহা! আপনি ওই শিলাসনে বসুন!

–না থাক!… যেন বিরক্ত হয়ে ঈষৎ ধমকেই উঠলেন ইহুদ! তাঁর চোখ সহসা কেমন এক অনির্বচনীয় দিব্যালোকে যেন ভরে যেতে লাগল। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ল রিবিকার মুখে। রিবিকার দ্বাঙ্গ ভাষাতীত এক মহাভাবে মুহূর্তে শিহরিত হয়ে উঠল।

ইহুদের গলা ভারী হয়ে উঠল–আমার এই হাতের লাঠিখানা চিনতে পারিস মা!

ইহুদের কণ্ঠস্বরে অপার্থিব এক জাদু মিশেছিল, রিবিকার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। তার পা দুখানি যেন গেঁথে গেল পায়ের তলার পাষাণের সঙ্গে। কোলের শিশুকে সে বুকের সঙ্গে সপাটে আঁকড়ে ধরেছিল। হঠাৎ তার মনে হল সমস্তই যেন ইহুদ ছিনিয়ে নিতে এসেছেন।

অর্ধস্ফুট স্বরে রিবিকা বলল–পারি বাবা!

–আমাকে তুমি ভুলে গেছ!

–আপনাকেই আমি মরুভূমির বুকে খুঁজেছি বাবা!

ইহুদ এবার ফের ঈষৎ গর্জে উঠলেন–মিথ্যে কথা!… সেই গর্জনে হেরাপুত্র মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে শূন্যে চোখ মেলে কী যেন খুঁজে দেখল, পেল না। আবার মায়ের বুকে মাথা রাখল। লজ্জায় রিবিকা চোখ নত করল।

ইহুদ বললেন–তাই যদি না হবে তাহলে আমার অপমান তোমার বুকে বাজল না কেন? তুমি কী করে এই পাহাড়দুর্গে রাত কাটালে! তোমার পাপের বিচার কে করবে! রাজার আইন আছে, সে আইন রাজাকে স্পর্শ করে না।

সাদইদ আর স্থির থাকতে না পেরে বলল–মানুষকে প্রাণে বাঁচানো যদি পাপ হয় তাহলে সে পাপ আমি করেছি! আপনি রিবিকাকে হায়নার মুখে ফেলে রেখে গেছিলেন।

ইহুদ বললেন-তোমার সৈন্য আমাদের আক্রমণ করে। হায়নার চেয়ে তোমার লোভ অনেক কদর্য। আমার হাতে লাঠি দেখেও তোমার সেপাই আমাকে রেয়াত করেনি। তুমি তোমার চোখের সামনে আমাকে দেখেছ কখনও মনে করনি এ অন্যায়!

–আমায় ক্ষমা করুন!

সাদইদের গলা কেঁপে উঠল।

–ইয়াহোর কাছে ক্ষমা চাও সাদইদ! রুহার মৃত্যুর কৈফিয়ত তোমায় দিতে হবে। বন্ধু লোটা তোমার নারী-সৌভাগ্যে পীড়িত হয়ে ঘরের বশে রুহাকে বলাৎকারের চেষ্টা করে। অথচ লোটাকেই তুমি মৃত্যুদণ্ড দিলে! ইয়াহোর বিচার অনেক সূক্ষ্ম সাদইদ! তুমি শাস্তি পাবে!

মাথা নিচু করে ইহুদের কথা শুনতে শুনতে সাদইদ বলল–আজ পর্যন্ত রাজা হিতেনের সঙ্গে আমার কোন সন্ধিপত্রই ছিল না মহাত্মা ইহুদ! একজন সামান্য সৈনিক, ভাড়াটে সৈনিকের সঙ্গে কোন রাজা কখনওই সন্ধিপত্রের চুক্তি করেন না। অতি সম্প্রতি সেই সন্ধিপত্র হয়েছে! কালই আমি সেটা হাতে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, লোটা সম্পর্কে আমার কখনও কোন অভিসন্ধি ছিল না। এই সন্ধিপত্রও রাজার কাছে আমি প্রার্থনা করিনি।

ইহুদ বললেন–তুমি কী করেছ না করেছ সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এখানকার কারুরই নেই, সেকথা তোমার জানা দরকার। সমস্ত রাত্রি আমরা আলোচনা করেছি। তোমার সন্ধিপত্রের নকল মাটির ফলক আমরা উপড়ে ফেলেছি। তুমি জেনে রাখো, তুমি হিতেনের দাসত্ব করতে পারো, আমরা নই। আমরা নেই তোমার সঙ্গে!

–আমি জানি। হঠাৎ এই সন্ধিপত্র করে রাজা আমাকে দুর্বল করতেই চেয়েছেন।

–সে বুদ্ধি তোমার আছে?

–আমায় এভাবে বলবেন না মহাত্মা ইহুদ!

–আমি মহাত্মা নই সাদইদ। তাই যদি হতাম, তাহলে এত হীন পেশায় নিয়োগ করে তুমি আমায় অপমান করতে না। তবে এই লাঠির কোন ক্ষমতা

আছে কি নেই তুমি এবার প্রমাণ পাবে। লোটাকে মারবার জন্যই চালবাজ রাজা এই সন্ধিফলক সোনায় মুড়িয়ে তোমার হাতে তুলে দিয়েছে! যাতে সারা জীবন তুমি এই মরুভূমিতে ঘুরে মরো! তবে তুমি যা খুশি করতে পারো–আমার কিছু এসে যায় না। মধুদুগ্ধের দেশে আমার পোঁছনো দরকার।

–আপনার স্বপ্ন সফল হোক মহাত্মা ইহুদ!

–তুমি আমাকে ব্যঙ্গ করছ?

ইহুদের এই আকস্মিক আঘাতে সাদইদ বিমূঢ় হয়ে যায় এক মুহূর্ত! সে অতিকষ্টে চোখ তুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিবিকার মুখের দিকে চায়। এই সেই নারী, যাকে সে নগ্নাবস্থায় বস্ত্র দান করেছিল, ক্ষুধা তৃষ্ণা কাতর মুমূর্ষ দেবদাসী, যাকে সে মধু রুটি আর তৃষ্ণার জল দিয়েছিল–যাকে সে মন্দিরে ঠেলে দিতে পারেনি, যার সীমাহীন রূপ তাকে মুগ্ধ করেছে, লোভী করে তুলেছে, সেই নারী ভেবেছিল সাদইদ বুঝি রাক্রান্ত পুরুষ, তার কাছে সে জানতে চেয়েছিল তার ভবিষ্যৎ! কী পরিহাস জীবনের ওই শিশু অবধি আজ বুঝে ফেলেছে সাদইদ তার নিজেরই ভবিষ্যৎ জানে না।

সাদইদ বলল–একটা সামান্য শিশুকে ব্যঙ্গ করার সাহসও আমার নেই!

বলেই সাদইদ রিবিকার ম্লান চোখ থেকে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করল।

ইহুদ বললেন–তোমার সাহস যথেষ্টই আছে। লোকে তোমায় সারগন বলে ডাকে। আমি স্বপ্নদ্রষ্টা, আমার হাতে মসীহের ‘আঁসা’–এই জাদুদণ্ড! এই মহাবিদ্যার নামে শপথ করে বলছি, তুমি ব্যর্থ হবে! আমি স্বপ্ন দেখেছি, নিনিভের পতন হয়েছে! মারী আর মড়কে ফতুর হয়ে গেছে নগরী! ক্রমাগত এই স্বপ্ন! ক্রমাগত!

বলতে বলতে ইহুদের দুই চোখ কেমন ঘোর হয়ে আসে! যেন তিনি মুহূর্তে স্বপ্নবিষ্ট হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে স্থির রইল জুম পাহাড়।

হঠাৎ মন্দ্রস্বর ভেসে উঠল–তুমি ঈশ্বরের ভাষার উপর খোদকারী করেছ সাদ। এই এক পাপ। ক্ষমা নেই।

–নতুবা মানুষ কীভাবে কথা বলত! একটা ভাষা তো লাগে! এইভাবে মানুষ মিলিত হয়!

–এই চেষ্টা হাস্যকর কোমলমতি সাদ। পৃথিবীতে ধর্ম ছাড়া ঐক্য হয় না। তোমার সাহসকে বলিহারি যে, তুমি নিজের মূর্খতা বুঝতে পারো না। ঈশ্বর ভাষার সাহায্যে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেন। ধর্মের সাহায্যে একত্রিত করেন। মসীহের ধর্মে একথার বারংবার উল্লেখ আছে। তুমি ভাষার চর্চা করলে অথচ লোটার মুখে ভাষা যোগাতে পারলে না। কবিতা গেয়ে ধর্মের শক্তিকে খর্ব করা যায় না। ইয়াহহ! ইয়াহো! তাঁর ইচ্ছেয় সব হয়।

মাদইদ নরম সুরে বলল–ক্ষমা করবেন মহাত্মা ইহুদ! আপনার আদর্শের জয় হোক। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আলাদা। অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষ যে একটি ভাষার তলে মিলিত হয়েছিল সেই ইতিহাস ধর্ম এসে মুছে দেবে কিন্তু এই সত্য।

–এ সত্য নয় সাদইদ! লোটাই তার প্রমাণ!

–সে তো ধর্মও ছাড়েনি।

–ছাড়বে। আমি যা পারি তুমি তা পারো না। তোমার ভিতর ঈশ্বরের কোন প্রত্যাদেশ নেই। তুমি অভিজ্ঞতাবাদী। আমি প্রত্যাদেশবাদী, ধার্মিক! আমি জড়ো করি, তুমি জড়ো করার মন্ত্র কখনও পাবে না। চলো মা রিবিকা–আমরা উঠি!

–কোথায় যাব বাবা!

–ইয়াহো যেখানে নিয়ে যেতে চাইছেন! যে লোক লুঠ করে, সে কখনও গুছিয়ে তুলতে পারে না। এখানে থেকো না! সাদইদ এবার একা নিনিভে লুঠ করতে যাবে। একা। একদম একা।…

বলেই ইহুদ হা হা করে হেসে উঠলেন। রিবিকা অত্যন্ত করুণ চোখে সাদইদের দিকে চাইল। শিশুকে গভীরভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরল।

গম্ভীর সুরে ইহুদ বললেন–যার শিশু তাকে ফেরত দাও রিবিকা!

–এ শিশু যে আমার বাবা! একে ফেরত দিতে বলো না!

হাহাকার করে উঠল রিবিকা!

সাদই অত্যন্ত ধরা গলায় ঢোক গিলে বলল–আমি এই শিশু আর নারীকে লুঠ করিনি মহাত্মা ইহুদ! আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আপনিই তাদের ছিনিয়ে নিচ্ছেন!

অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন ইহুদ। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। বললেন–আমার ধর্ম কখনও ছিনিয়ে নেয় না সাদ। সে-ধর্ম দেয়। রিবিকা আমার কন্যা! ওই শিশু তোমারই রইল। দাও মা, দিয়ে দাও! দেরি করো না। সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে! তুমি লোটার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করবে। লোটা শুনবে।

ঘোড়ার পিঠে তখনও খেলা করে চলেছে লোটা। সেদিকে একবার চেয়ে দেখে আর্তনাদ করে উঠল রিবিকা-বাবা তুমি আমায় এমন নির্দেশ দিচ্ছ কেন! আমি কী অন্যায় করেছি!

–এ নির্দেশ আমার নয় রিবিকা। হিতেনের নির্দেশ। রাজার হুকুম!

–আমি পারব না! এ আমি পারব না কিছুতে।

–পারতেই হবে মা! ধৈর্য ধরো। মন শক্ত করো!

ছেলেকে বুকে করে কাঁপতে কাঁপতে রিবিকা মেঝেয় বসে পড়ে, সাদইদের ঠিক পায়ের তলায়। ভয়ে সাদইদ পা টেনে নেয়।

–আমার তো আর কোনওই আশ্রয় রইল না সাদইদ!–সরে যাওয়া সাদইদের পায়ের দিকে চেয়ে বলে উঠল রিবিকা। সাদইদ অনড় পাষাণের মত স্থির।

এই প্রথম সাদইদের নাম ধরে ডাকল রিবিকা। বুকের ভিতরটা সাদইদের কেঁপে উঠল।

–বাদশার বাদশা ইয়াহহ, তিনিই তোমার আশ্রয় রিবিকা। সমস্ত দেবদাসী, তামাম ক্রীতদাস, সকল সৈন্য তাঁরই বান্দা। ফেরাউনের আইন, হিতেনের আইন, অসুরদের আইনের চেয়ে বড় তাঁর আইন । তিনি যা জানেন, আমরা কেউ তা জানি না। নইলে লোটার ভাষা একমাত্র তুমিই কেন জানবে। এ ঘটনা তিনিই ঘটিয়েছেন। তাঁর অভিপ্রায় বোঝা আমার কর্তব্য! লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার কথা তুমিই তাকে বলবে।

–পারব না! কিছুতেই পারব না! সাদইদ তুমি আমায় বিষ দাও সারগন! এই শিশুকে তুমি হত্যা কর!

–আজ তোমার বিবাহ রিবিকা!

মহাত্মা ইহুদ যেন আকাশ থেকে বলে উঠলেন। রিবিকার কান্না মুহূর্তে জমাটবদ্ধ পর্বততুষারে আবৃত হল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা একটি শীর্ণ দীর্ঘ গাছে এসে বসল একটি ভয়ানক কালো মরু-ঈগল। তার ভারে নুয়ে পড়ল বৃক্ষের একটি ডাল। ঈগলের পাখার ঝাঁপটে কেঁপে উঠল মরু-প্রান্তর!!

মহাত্মা ইহুদ বললেন–লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা ঘোষণা করা নিশ্চয়ই খুব কষ্টের রিবিকা। তার মত সৈনিক শত অশ্বের চেয়ে, শিক্ষিত ঘোড়ার চেয়ে দামী। অথচ ইয়াহো সেই নিষ্ঠুর কাজের জন্য তোমাকেই নির্বাচন করেছেন। কিন্তু সেই নিষ্ঠুরতা সহনীয় করার জন্য সেই লোটাকেই তোমাকে বিবাহ করতে হবে। বিয়ের পর তুমি লোটাকে মৃত্যুর কথা বলবে! সমস্ত শিবির দেখবে নগর নির্মাতা মানুষ, যুদ্ধবাজ রাজারা কীভাবে এই সংসারকে মারছেন। মৃত্যু তো ক্রীতদাসের মুক্তি রিবিকা–তুমি সেই মৃত্যুকে বরণ করো মা গো!

মহাত্মা ইহুদের কণ্ঠস্বর ভাবাবেগে বুজে এল। দাড়ি গোঁফে আচ্ছন্ন মুখে চোখ দুটি সিক্ত হয়ে উঠল।

সাদইদ বলল–তোমার চোখের জল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার রিবিকা! এই শিশু আমার সম্পদ। দাও আমাকে! কখনও ধর্ম বুঝিনি। যে ঈশ্বরকে কখনও দেখিনি, তার অস্তিত্ব কেমন তাও জানি না–তবে কুড়িয়ে পাওয়া আমার ভালবাসার আজ সম্মতি হবে এই আনন্দ একজন সৈনিকের পক্ষে যথেষ্ট রিবিকা। তুমি সম্মত হও। লোটা মৃত্যুর আগে যদি একথা বিশ্বাস করে মরে যে সে পেয়েছিল। সেই শক্তির জোরেই আমি বেঁচে থাকব।

–এই সৌভাগ্য ইয়াহোর দান। তোমার এবং লোটার! যে ঈশ্বরকে তুমি চেনো না, সব তাঁরই অভিপ্রায় মাত্র। চলো রিবিকা।

বলে উঠলেন ইহুদ! রিবিকা তার শিশুকে সাদইদের কোলে অর্পণ করে বলল–আজ আমি দেবতা সূর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি, দেবদাসী হবে কনে! তুমি যাকে আমনের বউ বলে ডাকতে, তার আজ মৃত্যু হল সারগন! দেবদাসীর ভাগ্যকে নিশ্চয়ই তুমি ঈর্ষা করছ! কুড়িয়ে পেয়েছিলে তো তাই এত সহজে ফেলে দিতে পারলে! তোমার লুঠ করা হাত দু’খানি এত দুর্বল সাদইদ!

কালো ঈগল পাখা ঝাঁপটে উঠল। তার পাখায় মরুভূমির শুকনো বালি, পায়ের নখে ধরা ধ্বস্ত নগরী নিনিভের রক্তাক্ত ইঁদুর! রিবিকা দ্রুত পাহাড় ছেড়ে মরুভূমিতে নেমে গেল। মরুকণ্ঠ তৃষ্ণার্ত ঈগল চিৎকার করল।

মরুভূমিতে একা ঘুরে ফেরাই কি তবে নিয়তি। ভিস্তির কোলে যে মানুষ হয়েছে, যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যাকে মা ত্যাগ করে চলে গেছেন অমরাবতী–যে শিশু পিচ আঁটা ঝুড়িতে ভেসেছে কুফর দ্বীপের কোলে, যে দ্বীপ তলিয়ে গেছে সমুদ্রে, জিব্রিল ছাড়া যার জন্য কেউ অশ্রুপাত করেনি, তার নিয়তি কি আকাশের মত নিঃসঙ্গ? শুভ্র শ্বেত, উল্লসিত অগ্নিশিখার মত প্রখর অশ্বের দিকে চেয়ে ছিল সাদইদ।

আপন হাত দুখানির দিকে চেয়ে ছিল সে। দুমুঠো বালুর মত এ জীবন–যতই আঁকড়ে ধরা যাক, ঝরে পড়ে। এ তো কোন মৃত্তিকা নয়। দেশ নয়। তবু ভাল যে,মহাত্মা ইহুদের আশ্রয়েই চলে গেল রিবিকা। লোটার সঙ্গে তার বিবাহ–এ যে সত্যিই ঘটতে চলেছে ভাবলে চোখের পলক পড়তে চায় না। যাকে সাদইদ ছাড়তে পারছিল না, আপনিই সে চলে গেল ইয়াহোর ইশারায়। মরুমর্তের সেই ঈশ্বর কী মারাত্মক কুশলী! কখন দেয় আর কখন নেয়, সামান্য মানুষ বুঝতেই পারে না।

একজন দীন দেবদাসীর সেবক রাতারাতি হয়ে ওঠেন দিব্যজ্ঞানী মহাত্মা মসীহ। মরুজন্ম কী বিচিত্র! দুখানি হাতে ধরবার মত আর কিছু নেই, শুধু লাগাম ছাড়া! ভাবতে ভাবতে স্বর্ণালী বৈকালিক মরুরৌদ্রে সাদা অশ্বের কাছে নেমে এসে দাঁড়ায় সাদইদ। কোলে তার শিশু। শিশুই হাত বাড়িয়ে লাগাম টেনে ধরে। কী অবাক! হা থোকা! তুমি যদি রিবিকাকে এমন করে আঁকড়ে ধরতে পারতে!

সাদইদ শিশুকে নিয়ে অশ্বে উঠে বসে। হঠাৎ আকাশে শিঙার তুরীয় তীব্র নিনাদ ভেসে ওঠে। মহারাজা হিতেনের রথ আসছে দিগন্তের পারে স্বর্ণবিস্ময় ছড়াতে ছড়াতে। ধাতু বলয়ের ঘর্ষণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মরুপথকে ফুলঝুরির মত বর্ণালী করেছে কল্পনা করা যায়। তার চোখের সামনে লোটার মরদেহ লটকানো হবে–বর্শাবিদ্ধ করার পর। তক্তার একটি যোগচিহ্নের কাঠামো খাড়া করা হয়েছে মরুভূমির উপর। লোটাকে গাঁথা হবে সেই দৃশ্যে। তার আগে তার বিবাহ সম্পন্ন হবে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে এসে যোগচিহ্নবৎ তক্তার কাঠামোটির কাছে চুপচাপ দাঁড়ায়। সবচেয়ে নিঃস্ব বঞ্চিত ক্রীতদাসের জন্য, নারীকে পেতে চাওয়ার, ভাষা ও ধর্মের অধিকার চাওয়ার দণ্ড এখানে, বধ্যভূমির মরুচিহ্ন এটি, এখানে আমি কী করছি, ভাববার চেষ্টা করে সাদইদ। কাঠামোর দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে হাত থেমে যায়। বিবাহের পর মৃত্যুর উৎসব। ইয়াহোর ধর্ম কি জীবনের এই নিরাশ্রয় নিষ্ঠুরতার ভিতর উপ্ত হয় উদ্ভিদের মত?

মন্দির আর তাঁবুর এলাকায় এই মরুপ্রান্তরে এই প্রথম একটি বিবাহের মন্ত্র উচ্চারিত হবে। বিবাহ মাত্রই এখানে অতি কল্পনার একটি দৃশ্য। এ জিনিস কখনও হয় না। এখানে যেমন নদী নেই, তেমনি এখানে বিবাহ নেই। সমুদ্র যেমন এখানে বাতাসকে আড়াল করেছে, তেমনি আড়াল করেছে দাম্পত্য। এখানে প্রতিটি শুকনো বালুকণার মধ্যে যুদ্ধের দানা ছড়ানো, বিচ্ছেদ যেন লু। অশ্বের চমকিত দেহের কাঁপুনিতে রয়েছে যুদ্ধের আবেগ। আকাশের শূন্য হাওয়ার ভিতর ঝাঁপটা দিচ্ছে মরু-ঈগল।

তবে বিবাহ কিসের! ভাড়াটে সৈনিকের তাঁবুতে, নকল মন্দিরে, বিবাহ তো হাস্যকর! মন্দিরগুলি না হয়েছে মিশরের পাষাণ-ভাস্কর্যের সমতুল কোন বিপুল নির্মাণ, এখানে না আছে নিনিভে নগরীর ডানাঅলা বৃষের মানুষমুখো দুর্দমনীয় ঐশ্বর্যের মূর্তি কোন–এ যেন হিদ্দেকলের তীরের এঁটেল মাটির দৃঢ়তা নিয়েও দাঁড়াতে পারেনি। সবই আসলে ছায়ামাত্র–এ বসতি জীবনের নকলী প্রচ্ছায়া শুধু। সৈন্য বটে, কিন্তু সকলেই তো পলাতক দাসদাসী। কোন সম্রাট বা রাজা এদের বিশ্বাস করে না। এরা মিশরের পক্ষে ভাড়া খাটছে, যে কোন সময় অসুরদের পক্ষ অবলম্বন করতে পারে–রাজা হিতেন সাদইদকে তার বাহিনী নিয়ে যে কোন শক্তির তরফে যুদ্ধে যোগ দেবার স্বাধীনতা দিয়েছে–এ স্বাধীনতা হিতেনের খেয়ালিপনা মাত্র। আবার সন্ধিপত্র রচনাও সেই রাজারই পাগলামি। এই পাগলামি নিঃসন্দেহে ভয়ানক নিষ্ঠুর। সাদইদ যে অতি ক্ষুদ্র একজন রাজা নয়, দু পাঁচটি গ্রামের অধিকর্তা সামন্তও নয়, ভূস্বামী পুরোহিত নয়–হিতেন সে কথা সন্ধিপত্রে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

তক্তার কাঠামো ছেড়ে পাথর মেশানো মরুপথ ভাঙতে লাগল সাদইদ। আজ দেবী ইস্তারের জন্মদিন। প্রেমের দেবী ইস্তার। জমিজমার দেবী, বীজের গর্ভস্থানের দেবী, মৃত্তিকার দেবী। আজ বড় শুভদিন। মড়কের দেবী নয়, যুদ্ধের দেবতা নয়, জলের দেবতা কুমীরের জন্মদিন নয়–আজ চাষীদের উৎসবের দিনে রিবিকার বিবাহ, শুকনো মরুস্থলী আজ স্বপ্নবিষ্ট। কিন্তু আজ মৃত্যুরও দিন।

শিঙার আওয়াজ শোনা যায় বাতাসে। এ ধ্বনি-বিভ্রমও হতে পারে। সাদইদ হয়ত সবই ভুল শুনছে। সবই ভুল দেখছে। সামনে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিটি দাস সৈন্য এবং দেবদাসীর হাত বা শরীর থেকে পাথর ঘষে ঘষে দাসমালিক এবং সম্রাটদের এঁকে দেওয়া উল্কি মুছে ফেলা হচ্ছে, শরীরে রক্তপাত হয়ে যাচ্ছে তবু এই দৃশ্য থামছে না। রক্তপাতের পর ভেষজ দাওয়াই লাগানো হচ্ছে। এই উল্কি মুছে ফেলার অপরাধের দণ্ড হল আঙুল কর্তন।

এক ধরনের অম্নরস উল্কিস্থানে লেপন করে তীক্ষ্ণ পাথর বা ছুরির সাহায্যে চামড়া চেঁছে তোলা হচ্ছে দাসমালিকের ছাপ, নাম-ঠিকানা। মানুষ চিৎকার করে উঠছে যন্ত্রণায় আর আনন্দে। কিশোর-কিশোরীর চোখে জল টুপিয়ে পড়ছে। এ কোন আশ্চর্য ছবি! সৈনিকদের অনেকেই ছিল কৃষক, দাসমালিক তাদের পায়ে দলেছে, বেগার খাঁটিয়েছে, বাধ্যতামূলক কাজে নিয়োগ করেছে–তার নিজের জমি ফেলে কৃষক তার মালিকের জল তোলার কপিকল চালিয়েছে ভোররাত্রি থেকে মধ্যরাত অবধি। তার দেহ ধনুকের মত বেঁকে গেছে। তার জমির গম পুড়ে গেছে মরু লু-তে, গমের শিষ বালির স্তরে ছোপ ধরে শুকিয়ে গেছে, তার সেচের নালা বুজে গেছে ধূলায়, তার কুটিরখানি উড়ে গেছে ঝড়ে, নলখাগড়ার চালা উধাও। একদিন সে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে এসেছে গৃহে, রাজার আমলারা তার বউ আর বাচ্চাদের ফিনিসীয় জাহাজে তুলে দিয়েছে, ফিনিসীয় ধূর্ত বণিকদের দাসব্যবসা কখনও বন্ধ হয়নি–জাহাজ ভেসে গেছে কোথায় কেউ জানে না। যে ফিনিসীয়রা বাইশটি বর্ণ আবিষ্কার করে বর্ণমালা প্রস্তুত করেছে, ভাষাকে করেছে উন্নত, তাদের মূল ব্যবসাই ছিল দাসদাসী কেনাবেচা।

সাদইদ বুঝে পায় না একটা সভ্য জাত কী নিষ্ঠুর হয়! বউ হারিয়ে, সন্তান হারিয়ে সেই কৃষক তবু বাঁচতে পারেনি। তার হাতে উল্কি আঁকা–চাষী বর্ণমালা বোঝে না। দাসমালিকের বাইশী ভাষা আয়ত্ত তিনি উল্কির নকশায় তাঁর নাম ঠিকানা লিখে ছেড়ে দিয়েছেন–মানুষ পালাবে কোথায়! সেই সব-হারানো কৃষক ধরা পড়ে গেছে অতঃপর–আত্মগোপন করেও থাকতে পারেনি। দাসমালিক আর ফেরাউনের চোখের আড়ালে। ফেরাউনের চোখ পিরামিডের মত আকাশ থেকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। ধরা পড়ার পর সেই কৃষক হয়েছে চিরস্থায়ী সৈনিক। তারপর শেষবারের মত পালিয়ে এসেছে হেথায় মরুমর্তে! সাদইদ কখনও জোর করে তাদের দেহের উল্কি মুছে ফেলার নির্দেশ দিতে পারেনি। অথচ ইহুদ নিজে হাতে সেই উন্নত ভাষার ছাপ মুছে দিচ্ছেন। চাষীর মনের উপর চলেছে অতীতের স্মৃতির প্রহার। তার বউকে, সন্তানকে মনে পড়ছে।

চাষী কেঁদে উঠছে আনন্দে। ভয় করছে, আনন্দ হচ্ছে। তার দীর্ণ কান্নায় আর উল্লাসে মথিত হচ্ছে অপরাহু। একদিকে বাঁটা মেহেদিপাত্র মুঠোয় চেপে ধরে বসে আছে সজ্জিত রিবিকা, চোখে সুর্মা, গলায় ঝুলছে বনকুসুমের মালা, বাহুতে জড়ানো পুষ্পবন্ধ, পরনে জড়ানো মেসোপটেমিয়ার রেশমী বসন, সূক্ষ্ম বস্ত্রের আড়ালে তার দেহাবয়ব স্পষ্ট রাঙা। বসনের তলায় কোন পরিধান নেই। তার হাতের উল্কি আগেই তোলা হয়েছে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে এসে অনেকখানি তফাতে একটি ছায়ানিবিড় বৃক্ষের তলে দাঁড়াল। কেউ তাকে একবার ভাল করে চেয়েও দেখল না। এই প্রথম সাদইদ অদ্ভুতভাবে অনুভব করল, সে এই জনমণ্ডলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। এরা তার উপস্থিতির কোন পরোয়া করে না। যেন এরা তাকে কখনও দেখেওনি। সে বড়জোর একজন বহিরাগত পলাতক সৈনিক। তার দিকে কেউ কেউ পরম করুণার চোখে চাইল।

একজন সৈনিক সকৌতুকে বলে উঠল–এসো মুছে নাও! রাজার ছাপটা গা থেকে ছাড়িয়ে ফেলে স্বাধীন হও বাছা! রক্ত কিছুটা ঝরবে বটে, কিন্তু হৃদয়ে তাম পাবে। মরুভূমিতে কতকাল ঘুরে মরছ–একটু আহ্লাদ, একটু মুক্তির কথা ভাবো। কী হে, শুনতে খুব মন্দ লাগে বুঝি?

এক বুড়ি বলল–বাছার কী আর সাধ আহ্লাদ আছে! মহাত্মা পয়গম্বর যে কনের বাবা, তা জানলে কী আর লোটার দোস্ত নিবিকের সাথে ফস্টিনস্টি করে–সেই শরমে দেইড়েই আছে, ঘোড়াটি তেনার বিবশ হয়েছেন গো!

এই কথায় গায়ে টোনা মেরে গালের টোল নাচিয়ে হি হি করে হেসে উঠল দঙ্গলবাঁধা দেবদাসীরা। মরুমর্তে এ এক বিষম মর্মান্তিক দৃশ্য–আহ্বাদে দিশেহারা, দুঃস্বপ্নেভরা এ ছবি, তবু কান্নায় বিষণ্ণ, রক্তপাতে, রঙে উচ্চকিত মধুর। সেই মাধুর্যে কাঁপছে হৃদয়, রাঙা ঠোঁট, ফের মৃত্যুর গন্ধে বাতাস উতলা।

ইয়াহোর ধর্মের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ইস্তারের জন্মদিনে। এই মরু তার ক্রোড়, তার গর্ভস্থান, ইহুদের দণ্ডখানি তার নির্ভরতা। দণ্ডখানি নেড়ে নেড়ে সকলের সঙ্গে কত কথা বলে চলেছেন ইহুদ। সাদইদের ইচ্ছে হল, সে ভয়ানক আর্তনাদ করে ওঠে।

কিন্তু কী বলে সে আর্তনাদ করবে? কী হবে তার মুখের ভাষা? এখানে যে তার কেউ নেই। কে শুনবে তার কথা! সাদইদ বিড় বিড় করে উঠল–এ ভারী অন্যায় মহাত্মা ইহুদ! বিয়ের নামে, মুক্তির নামে এ আপনি কী করছেন! এই মানুষেরা সকলে লোকটাকে ঘৃণা করত! কোন দেবদাসী ওকে আশ্রয় দেয়নি। তার মৃত্যুর দিনে কিসের আয়োজন করেছেন আপনি! রিবিকাকে এভাবে কাঁদিয়ে তার ভাগ্যকে পরিহাস করছেন কেন? ওগো, তোমরা থামো!

সাদইদের স্বর ফুটল না। চোখ বহে গণ্ডদেশ প্লাবিত করে সাদইদের অশু গড়াতে চাইছিল, সাদইদ জানে এই মরু-বাতাসে সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না, চোখের পাতার আড়ালে কেবল চিক চিক করে সূর্যবিম্বিত বালুকণার মত তীব্র।

অথচ ইয়াহোর ধর্ম এক অবিনাশী উদ্ভিদ! ইয়াহো বলেন–হোক! শুধু হউক’ বলাই যথেষ্ট, সৃষ্টি পুরাণে মরুমর্তে, জীবকুলে এক অমৃত মন্থন শুরু হয়।

মহাত্মা ইহুদ বললেন–আমার কন্যার হৃদয়ের বেদনা জয়ী হোক।

কথাটা শুনে সাদইদ কেঁপে উঠল। সে সহসাই চিৎকার করে উঠল–লোটা! এ হতে পারে না লোটা! তোমার কালো ঘোড়া কোথায়? নিনিভের পতন হয়েছে, এসো আমরা যাত্রা করি। থেকো না, ওভাবে পড়ে থেকো না দোস্ত!

এই মুহূর্তে সাদইদের সাদা অশ্ব এক বেগার্ধ স্বরে হেষাধ্বনি করে ওঠে আকাশে মুখ তুলে। সাদইদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়–এ মিথ্যা! এ অন্যায় লোটা! যুদ্ধ তোমার নিয়তি, তুমি উঠে এসো!

লোটার দুই চোখ তন্ময় ছিল। সে চেয়ে ছিল তার কনেটির দিকে। সাদইদের মুখে ‘লোটা’ নাম উচ্চারণ শুনে একবার চকিতে চোখ তুলে সাদইদকে দেখে স্মিত হাস্য করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অশ্বের হেষাধ্বনিতে রিবিকার মুষ্টিবদ্ধ দু’ হাত শিথিল হয়ে খুলে গেল। তৃষ্ণাকুল দুটি চোখ তার, সুর্মার নদীতে ছল ছল করতে লাগল। সে সাদইদের দিকে নয়ন মেলে চাইতে পারল না। তার সাধ হচ্ছিল সে একবার শিশুকে দেখে।

মহাত্মা ইহুদ বললেন–আমার কন্যার হৃদয়ের বেদনা তোমার পাহাড়ের চেয়ে উচ্চ সাদ। পিরামিডের চেয়ে মহৎ। রাজার আইন টলে পড়ে, কিন্তু মেষশিশুর চেয়ে পবিত্র হৃদয় কর্তব্যে বিচলিত হয় না।

রিবিকার বিবাহ ইয়াহোর নির্দেশ মাত্র। বঞ্চিত লোটার জন্য ঈশ্বরের একমাত্র উপহার। সাদ, তুমি পাগল হয়ে গেছ!

সকলে উচ্চহাস্যে বিদ্রূপ করে উঠল। কিসের মাতমে এরা সব বধির হয়েছে, সাদইদ ভেবে পেল না। আবার বলে উঠল–আমরা এখনও চলে যেতে পারি লোটা! রিবিকা তুমি বলে দাও–সব কথা বলে দাও নোটাকে।

রিবিকা শিহরিত হয়ে উঠল। তার প্রাণ বলল, সে বলে দেয়। সে চোখ তুলে কতজনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল, কোথাও সে কণামাত্র সমর্থন পেল না। সবাই যেন এক পাষাণের মত স্থির, চোখে এক মদির স্বপ্ন জমাট বেঁধে আছে, কিন্তু কোন তরঙ্গ নেই। রিবিকা হতাশায় ভেঙে পড়ল আপন হৃদয়ে। তারপর সে মহাত্মার দিকে চোখ তুলল।

ইহুদ বললেন–আমার ধর্মে কোন প্রতিমাপূজা নেই। আমার ধর্ম দেবতা সামাশ বা আমনের চেয়ে শক্তিশালী। ইয়াহো নিরাকার। তাঁর কোন শরিক নেই। তিনি অদ্বিতীয় ঈশ্বর। বলল, তিনি যা তিনি তাই। তুমি এই কথাগুলি লোটাকে বলিয়ে নাও। এই মন্ত্রই বিবাহের মন্ত্র। এখানকার সমস্ত পুরুষ তোমার মত নারীর স্বপ্ন দেখে। আমি সকলকে সেই স্বপ্নের দিকে নিয়ে চলেছি। তোমরা সকল বিগ্রহ বর্জন কর। ইয়াহো সূর্যকে অবধি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাতাস তাঁরই নির্দেশে চলে, মেঘ বৃষ্টি, সমুদ্র নদী তাঁরই ইশারায় আন্দোলিত হয়। বৃক্ষের একটি পাতাও তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কাঁপে না।

ঠিক এই উচ্চারিত মন্ত্র রিবিকা বলে উঠবে, তখনই হিতেনের রথকে দুটি ঘোড়ায় টেনে আনল মরুপথ বিদীর্ণ করে তীব্র বেগে। শিঙা নিনাদিত হল।

মহাত্মা ইহুদ রাজার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোটা আর রিবিকার বিবাহ নিষ্পন্ন করলেন। বিবাহের দৃশ্য দেখতে দেখতে হিতেনের দুই চোখ মহাক্রোধে চকচক করে উঠল। রাজা এসেছে লোটাকে বধ করতে আর সুন্দরী রিবিকাকে রথে তুলে নিতে। এ দৃশ্য তার কাছে অভাবিত, অপমানজনক। সে হুংকার দিয়ে উঠল। বলল–সৈনাধিপতি সাদইদ, এ কী দেখছি আমি! সুন্দরীকে টেনে আনো আমার কাছে! লোটাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে চলো!

একজন সৈনিক বলে উঠল–সাদইদের আধিপত্য আমরা স্বীকার করি না। রাজা হিতেন। তুমি ফিরে যাও।

–এতবড় স্পর্ধার কথা কী করে বলছে লোকটা!

–যে ফেরাউন আমাদের সর্বস্ব ধ্বংস করেছে–আমার জমিজমা, বউ, সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে, তারই হয়ে ভাড়া খাটছি আমরা–এই অপমান কত সইব বলতে পারো! তোমার তদারকির পরোয়া করি না রাজা। তুমি ফিরে যাও। ফেরাউন আমার হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে, এই দ্যাখো!

দু’ হাত মাথায় তুলে দেখালো সেই সৈনিক।

–অসম্ভব! ওই সুন্দরীকে আমার চাই! বলল রাজা হিতেন।

ইহুদ বললেন–মা রিবিকা, তুমি এবার লোটাকে বলে দাও, রাজা তাকে বধ করতে এসেছে!

রিবিকার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। সে কিছুতেই এতবড় মর্মান্তিক কথা উচ্চারণ করতে পারছিল না। তার কেবলই মনে পড়ছিল তার মায়ের ভাষা ছিল লোটারই মত বিচ্ছিন্ন,সকলে তাকে ঘৃণা করত। মা ছিল বাবার উপপত্নী! লোটার মুখটা তেমনই সরল।

ইহুদ এবার রিবিকাকে ধমক দিয়ে উঠলেন। রিবিকার চোখ দুটি এমন অসহায় মুহূর্তে সাদইদকে খুঁজছিল। সে নিজেও অবাক হল, তার চোখ কেন সাদইদকেই খুঁজছে!

হিতেন গর্জন করে উঠল–সাদইদ লোটাকে বাঁধো–আমার হুকুম!

সাদইদ তার সাদা অশ্ব রাজার রথের কাছে হাঁকিয়ে নিয়ে এল। তারপর বলল–আপনার সঙ্গে রয়েছে সারথী আর মাত্র একজন ঢাল ধরা সৈনিক-তাই সম্বল করে এত হাঁকাহাঁকি ঠিক নয় মহারাজা।

রাজা হিতেন উচ্চ হাস্য করে উঠল। বলল–তুমি বড় মূর্খ সাদ। তোমায় সন্ধিফলক মাগনাই দিয়েছি দেখছি।

এই সময় দূরে থেকে প্রখর তূর্যনাদ ভেসে এল। দেখতে না দেখতে সমস্ত তল্লাট রাজা হিতেনের অশ্বারোহী সেনায় ভরে গেল। লোটার কোমরে দড়ি বাঁধা হল শক্ত করে–দুহাত বাঁধা হল। সন্ধ্যার আগের সূর্যালোকে নীল আকাশ রক্তে প্লাবিত। সেই দিকে দু চোখ মেলে লোটা হাঁটতে থাকল বধ্যভূমির দিকে।

রিবিকা লোটার ভাষায় আর্তনাদ করে উঠল–যেও না লোটা, রাজার লোক তোমায় হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে! মহাত্মা ইহুদ, এ আপনি কী করলেন।

প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল রিবিকা। দুহাত মুখ ঢেকে মাটির উপর বসে পড়ল। যে ক্রীতদাস সৈন্য দু হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে মিশরের দাসমালিক বলেদু হাত তুলে দেখাচ্ছিল সেই সৈনিকটি রিবিকার কাছে এগিয়ে এসে বলল–কেঁদো না বউ! তুমি কাঁদলে মানুষের সংসার কাঁদে!

লোটা আকাশে চোখ মেলে এগিয়ে চলেছে, তার পিছু পিছু সমস্ত মানুষ ধীরে ধীরে দীর্ঘ সারির মিছিলে চলতে শুরু করেছে। সাদইদ সেই প্রবাহের দিকে বিষাদপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েই রয়েছে। তার করার কিছুই নেই।

লোটা প্রায়ই বলত, যা রিবিকা অনুবাদ করেছিল সেদিন আমি একদিন বৃষ্টি ঝরা ভোরে ঝাঁপসা দিগন্তে উটের পিঠে চড়ে চলে যাব, আর ফিরব না।

কিন্তু এখন তো সন্ধ্যাকাল। সবাই চলে গেছে বধ্যভূমির দিকে। ভয়াবহ আর্তনাদ করে উঠলেন মহাত্মা ইহুদ। ইয়াহো! ইয়াহো। …

তারপর হঠাৎ তিনি স্বয়ং বধ্যভূমির দিকে পাগলের মত ছুটতে শুরু করলেন। রাজার রথ ধীরে ধীরে তাঁর পিছু পিছু এগিয়ে চলল। বাবার পিছনে ছুটে গেছে রিবিকা–তার ছুটে যাওয়ার দিশে ছিল না।

এমন সময় বধ্যভূমির কাছে মিছিল থামলে এই মরুমর্তে এক আশ্চর্য দৃশ্যের ঘটনা দেখা যায়। নোটাকে আঁকড়ে ধরেছে রিবিকা। মহাত্মা ইহুদ বলছেন–এই কান্নার শেষ কি নেই? ঈশ্বর!

লোটার বুকে লুটিয়ে পড়েছে রিবিকা।

সাদা অষের পিঠে হেরার পুত্রকে কোলে করে ছুটে এসেছে সাদইদ। তার মনে হল, সামনের এই ছবিই পৃথিবীর শেষ ছবি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। তার দেখা প্রজাপতি অধিকৃত নারীই লোটার বুকে আরো সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। এবং এর পরই পৃথিবীর নৃশংসতম দৃশ্যটি সে দেখবে।

কিন্তু দৃশ্যান্তর হল ইয়াহোর নির্দেশে। কেননা মহাত্মা আকাশে মুখ তুলে ইয়াহোর নামে আতশব্দ করে উঠলেন মুহুর্মুহু ।

দিগন্ত সহসা কালো হয়ে উঠল। মনে হল দিগন্তজুড়ে কী যেন কালো মতন ভেসে আসছে। রাজা হিতেন সুন্দরী রিবিকাকে ধরবার জন্য রথ ছেড়ে নেমে পড়েছিল। সে কেবল সম্মুখে এগিয়ে এসেছে মাত্র দুটি ধাপ ফেলে, এমন সময় দিগন্ত সমাচ্ছন্ন হল! অজস্র ঈগল নিনিভের দিক থেকে উড়ে আসছে।

প্রত্যেকটির পায়ে ধরা ইঁদুর। মাথার আকাশ ভরে গেল মুহূর্তে।

রাজার পায়ের কাছে ঈগল তার শিকার ফেলে দেয়। ইঁদুরের মুখ টুকটুকে লাল। পেট মোটা। ধপ ধপ শব্দে ইঁদুর পড়তে থাকে আকাশ থেকে। মানুষ আর্তনাদ করে ওঠে–মড়ক! মড়ক! মানুষের মড়ক! নিনিভে মানে মড়কের নগরী! সব শেষ হয়ে গিয়েছে।

রাজার দেহ সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে যায়। সে হাত বাড়িয়েছিল কিন্তু পা আর নড়াতে পারল না। রাজা রথে গিয়ে চড়ল।

মহাত্মা ইহুদ লোটার দড়ি গা থেকে দ্রুতহাতে খুলে দিলেন। লোটা ছাড়া পেয়ে তার কালো অর্থের দিকে দৌড়ে গেল। সমস্ত মরুভূমিতে পা ফেলা যাচ্ছে না। ভয়ে রাজার সৈন্যরা অশ্ব ছুটিয়ে দিয়েছে অন্য দিগন্তের দিকে। পা আর ফেলা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রচুর ইঁদুর দৌড়চ্ছে। লাল মুখ। পেট ফোলা। কোনটির ভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে। লোটা লাফিয়ে উঠল কালো ঘোড়ার পিঠে।

তেড়ে গেল রথ লক্ষ্য করে। রাজার বুক ভেদ করে গেল লোটার ছুঁড়ে দেওয়া বর্শা। রাজার দেহ রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর এক দণ্ডে কালো অশ্ব কোথায় হারিয়ে গেল দেখা গেল না।

সমস্ত রাত কম-বেশি সকলেই জেগে থাকল লোটার অপেক্ষায়। লোটা এই বুঝি ফিরে আসে। সবাই ভয় করছিল সমস্ত মরুভূমিতে লালমুখো মড়কের ইঁদুর ছড়িয়ে গেছে। জুম পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। মহাত্মা ইহুদ রাত্রির আকাশে আর্তনাদ ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন মাঝে মাঝে ইয়াহো!

মানুষের হৃদয় সেই আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তারা শেষ রাত্রের লাল চাঁদের আলোয় দিগন্তে চেয়ে ভাবছিল–একটি কালো অশ্ব তারা দেখতে পাবে। সমস্ত রাতের প্রতীক্ষা ব্যর্থ করল লোটা। ফিরে এল না। মহাত্মা ইহুদ ভোরের সূর্যকে লাঠি তুলে শাসন করে বললেন–হ্যাঁ সামাশ! তুমি আবার এসেছ! তোমাকে ইয়াহোর নির্দেশে বারবার আসতে হবে! রানী ইসাবেলা তুমি দেখে যাও, ইয়াহোর হুকুমে শত শত ঈগল উড়ে এসেছে। সূর্য এসেছে। লোটা তাঁরই নির্দেশে হারিয়ে গেল! ইয়াহো চাইলে সে আবার ফিরে আসবে! নতুবা সে আর ফিরবে না। চলো আমরা মধুদুগ্ধের দেশে যাত্রা করি!

রিবিকা এ সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সকালের দিগন্তে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মনে হল, কালো ঘোড়া ওই বুঝি দেখা যায়! কিন্তু সে দেখল একটি সাদা অশ্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে। সে তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল উচ্চকিত সুরে।

এরপর সব প্রবল প্রবাহ এল নানা দিগন্ত থেকে। মহাত্মা প্রস্তুত। বিশাল এক জনসমুদ্র মহাত্মাকে অনুসরণ করবে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। সূর্যের কুসুম আলো লাল বালুতে পড়ে জ্বলজ্বল করছে। জুম পাহাড় একা দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাষা কেউ আর শুনবে না।

সাদা অশ্ব থেকে ছেলে কোলে করে নেমে এল সাদইদ। তার চোখে সমস্ত রাত্রির জাগরণ। সে লোটাকে খুঁজে ফিরেছে তামাম রাত্রি। সাদইদ মাথা নিচু করে রিবিকার দিকে শিশুকে এগিয়ে ধরে বলল-একে বাঁচিয়ে রেখো রিবিকা। আমি লোটাকে খুঁজতে গেলাম।

জনস্রোত চলতে শুরু করল। রিবিকা হঠাৎ শিশুকে কোলে নেবার সময় লক্ষ্য করল সাদইদের হাতের উল্কি রক্তাক্ত, সদ্য ছুরিতে কেটে ফেলেছে সে। রক্ত ঝরে পড়ছে। সাদইদ চিৎকার করে উঠল

–কেউ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে না? অন্তত একজন কেউ? আমার ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই?

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন