কেরানিও দৌড়ে ছিল

image_1305_324838
২১
মঙ্গলবার! মঙ্গলবার! মাথার ভেতরে বোঁ করে ওঠে কেরানির। কোথায় কবে যেন কোন মঙ্গলবার? কিছুতেই তার মনে পড়ে না। কিন্তু ভাবনার চাকা থেমেও থাকে না। কী যেন কবেকার সেই মঙ্গলবারে! দিনের এই বারটা তার পিছু ছাড়ে না। মঙ্গলবার! মাথার ভেতরে অবিরাম কটকট করতে থাকে।
শ্রীপুর থেকে ফিরে সোনারগাঁও হোটেলের ঝর্ণা রেস্টুরেন্টে আবার সেই লবস্টার ডিনার। মঙ্গলবার! আবার সেই প্রিমিয়াম হুইস্কি আকণ্ঠ পান। মঙ্গলবার! আবার সেই রাজহাঁসের মতো শাদা ঝকঝকে গাড়িতে গভীর রাতের রাজপথ দিয়ে ছুটে চলা। মঙ্গলবার! গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজারের নিঝুম নিশ্চুপ পাশ দিয়ে সদরঘাটের দিকে কেরানি। মঙ্গলবার! মাথার ভেতরে বনবন করে মঙ্গলবার!
সে এই নর্থ সাউথ রোড দিয়ে খাম্বা সামাদের সাথে কত যাতায়াত করেছে। আজ কী হয় তার, মনে পড়ে। বুকের ভেতরে ছাঁৎ করে ওঠে, গাড়িটা যখন মাজার কাটিয়ে মার্কেট পেরিয়ে বংশালের মুখ পেরিয়ে সুরিটোলার পাশ দিয়ে যায়। সুরিটোলা! সেই সুরিটোলা। বুলবুল মিয়ার বাড়ি। গলির সেই বাড়িতে রুহিতন!
রুহিতন! রুহিতন! মনের মধ্যে ডাক ভেঙে ওঠে। জজ মিয়া! ও জজ মিয়া!
খাম্বা সামাদ সিটের পাশে নেতিয়ে বসে ছিলো। কেরানির ভাবগতিক লক্ষ্য করে খাড়া হয়ে বলে, ভাই, কী চিন্তা করেন?
কেরানি উত্তর দেয় না।
খাম্বা সামাদ তখন নিজেই একটা কারণ অনুমান করে নিয়ে বলে, ডোন্ট ওয়ারি। এই আপনের শুরু। ইয়োর লাইফ উইল চেঞ্জ। মঙ্গলবার থিকাই বদলায়া যাবে। ঠিকমতো যদি খেলতে পারেন, দুনিয়া আপনের হাতে বান্দর নাচ করবে।
কেরানি আবার সেই মঙ্গলবারের ফেরে পড়ে যায়। মঙ্গলবার! মঙ্গলবার! কী যেন মঙ্গলবারে ছিলো তার অতীতে! অতীতে কি আর একটা জীবনেই! মঙ্গলবার!
সুরিটোলার পাশ দিয়ে যেতে না যেতেই গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে থেমে যায়। থামতে হয়। দুটো মালবাহী ট্রাক রাস্তাজুড়ে আছে। একটা ট্রাক খারাপ হয়ে পড়েছে। আরেকটা ট্রাক এনে, পাছায় পাছা ঠেকিয়ে, সেই খারাপ ট্রাকের মাল তাতে তোলা হচ্ছে।
আহ্! এখানেই গাড়িটা থামলো। একেবারে সুরিটোলার মুখেই। কেরানির প্রাণ কেঁদে ওঠে। হুইস্কির ঘোরে মনের দিকদিশা নাই। রুহিতনকে ফোন করতে ইচ্ছা করে। ও রুহিতন, তুমি কেমন আছো? তুমি ঘুমিয়ে থাকলে বালিশে তোমার লালা পড়ে। এখনো কি পড়ে? যখন ঘুম থেকে ওঠো তখন তোমার গালের পাশটা যে সারারাত বালিশের চাপে লাল হয়ে থাকে, এখনো কি থাকে? তুমি যে চুমো দিতে দাঁতে গাল কাটো, এখনো তোমার দাঁতে কি সেই মিছরির মতো ধার আছে?
হুইস্কিটা তাকে আজ খুব বেশিই ধরেছে। কল্পনা আর বাস্তব একাকার হয়ে গেছে। নতুন আর পুরানো ঢাকা বেমালুম কখন মিশে গেছে! কেরানি মনের মধ্যেই রুহিতনের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। বলে বলে শান্তি হয় তার। রুহিতনকে আশ্বাস দেয়, আবার তোমার কাছেই আমি ফিরে আসবো, রুহিতন। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। করবে না, রুহিতন?
খাম্বা সামাদ গাড়ি থেকে নেমে ধমকে ধামকে ট্রাক একটাকে সরিয়ে নিজের গাড়ি যাবার পথ করে। শালার শালা, চুৎমারানি, তর মায়েরে_ খাম্বা সামাদ খিস্তি কেটে গাড়িতে উঠে কেরানিকে ঝিম মারা দেখে বলে, ভাই যে পোতায়া গ্যালেন! কলাম তহন, অ্যাতো খাইয়েন না! তও খাইলেন! এই আয়া পড়ছি। আর পাঁচ মিনিট।
নিউ ঢাকা বোর্ডিং। এত রাতে ম্যানেজার জগদীশ ডাইনিং হলের বারান্দার কল ছেড়ে গলায় এক মুখ পানি নিয়ে সশব্দে গড়গড়া করছিলো। খাম্বা সামাদকে দেখেই ত্রস্ত লোকটা নিঃশব্দ হতে গিয়ে গলায় পানি আটকে কেশে উঠে আলুথালু হয়ে পড়ে।
কেরানিকে ঘরে পেঁৗছে দিয়ে খাম্বা সামাদ গুড নাইট বলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। কেরানি বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে। লম্বা হতে না হতেই প্রবল বমি পায় তার। দিশে না পেয়ে উঠে সে বারান্দায় ছুটে গিয়ে এক প্রস্থ বমি করে। তখন খেয়াল হয় বাথরুমে যাওয়া তার উচিত ছিলো। বারান্দা সে বমিতে ভাসিয়ে ফেলেছে! কাল ভোরে ময়না যখন এসে দেখবে, তাকে যে কী বকাবকি করবে! এটাও কেরানির ভালো লাগে। মুখে পাতলা একটা হাসি ফুটে ওঠে তিরস্কারে রাঙা ময়নার কচি মুখখানা মনে করে।
বারান্দার রেলিং ধরে মাথা তুলে দাঁড়ায় কেরানি। চোখে পড়ে রাতের অন্ধকারে কালো পানি। বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা। বয়ে চলেছে কি, আয়নার কাচে আঁকা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে। পানির বুকে ভেসে আছে নিঝুম ঘুমন্ত কয়েকটা লঞ্চ। পাড়ের থামে দড়ি দিয়ে বাঁধা গোটা কয় কেরায়া নাও। লঞ্চঘাটের মুখে কুণ্ডলী পাকানো কুকুর। আকাশে লক্ষ তারা। আগুনের ফুলকি নিয়ে খেলা করছে ফেরেশতারা। নিচে বিশাল এই জগৎ নিঃশব্দ নিশ্চল।
হঠাৎ ফুকরে ওঠে সিকিউরিটি গার্ডের তীব্র বাঁশী।
চৈতন্য ফেরে কেরানির। বাঁশীর ওই তীব্র তীক্ষষ্ট শব্দটা যেন সতর্ক করে দেয় ঘুমন্তকে_ জাগো! জাগো হো! তখন কেরানি জেগে ওঠে তার ভেতরে, যেন এক স্তূপ পাতাপত্রে ঢাকা ছিলো তারা মাথা। সব ঠেলে সে হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। বড়বুবুর হাতের লেখায় বাবার জবানে সেই চিঠির পাঠ তখন তার মনে পড়ে গেছে। মঙ্গলবার!
তোমার বিবাহ স্থির করিয়াছি। আগামী শুক্রবার বাদজুম্মা শুভকাজের দিন ধার্য হইয়াছে। পত্রপাঠ চলিয়া আসিবা। মঙ্গলবারের মধ্যে পঁহুছাইবা।
মঙ্গলবার! মঙ্গলবার! এই এতক্ষণে পাওয়া গেছে তবে, কেন মঙ্গলবারটা তাকে এত তাড়া করছিলো সেই সোনারগাঁও থেকে। মঙ্গলবারে সে পেঁৗছেছিলো হস্তিবাড়িতে। মদিনার সঙ্গে বিয়ের জন্যে।
মদিনা! নবীর শহর মদিনা! না, মদিনাকে সে স্পর্শ করতে পারে নাই। কলমা পড়েও স্পর্শ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই।
কলমা? কলমা! কলমা কি সে ভুলে গেছে? কেরানি টালমাটাল পায়ে বিছানায় ফিরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে মনের ভেতরে সন্ধান করে। না, সে ভোলে নাই। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। কেরানি ঘুমিয়ে পড়ে কি হুঁশহারা তলিয়ে যায়।
ভোরের আজানের শব্দ। ঘুমন্ত কানের ভেতরেও পশে। পাশ ফেরে কেরানি।
আচ্ছন্ন তার চৈতন্যের ভেতর থেকে জেগে ওঠে কবেকার সেই কবেকার একটি মুখ।
রুপাই! পুতুলের মতো মাটি টেপা নাক। চোখ দুটো মাছের মতো নীলচে। গালে-মুখে মাটির গন্ধ_ বৃষ্টিভেজা মাটির। হস্তিবাড়ির বিলের পাড়ে বাদাড়। বাদাড়ের মধ্যে রুপাই আর সে। খেলার পুতুল হাতে কিন্তু খেলার কৌশল বালকের তখনো জানা নাই। সেই যে রুপাই তাকে মরণের এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে বিলের পাড় ভেঙে বাড়ির দিকে ছুটে গিয়েছিলো, আর ফিরে আসে নাই।
আজ ফিরে আসে। কেরানি ব্যাকুল হয়ে ওঠে ঘুমের ভেতরে। রুপাই কোথায়? এখন সে কোথায়? রুপাইয়ের বিয়ের দিন জলেশ্বরী থেকে সে হস্তিবাড়ী এসেছিলো। ইশকুল ছুটি ছিলো। এসে শোনে রুপাইয়ের বিয়ে। ঝাউ কেটে গেট! গেটের মাথায় লাল-নীল-সবুজ কাগজ কাটা মালা। অপটু অক্ষরে লেখা ‘শুভবিবাহ’। সন্ধ্যাকালে কবুল হওয়ার কথা। তার আগেই সে ফিরে গিয়েছিলো জলেশ্বরীতে তার লজিং বাড়িতে! সব তার মনে পড়ে যায়। রুপাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় জয়নালের। সেই জয়নাল ভাই যে একদিন বলেছিলো, কী করে নিজেকেই নিজে আরাম দিতে হয়! শাবানার কথা মনে করিয়া করিবেন, আবার আরেকদিন ববিতাকে, উয়ার বইন চম্পাকেও একদিন! তবে না জমিবে!
সেই কবে সে কী অপূর্ব সুখ পেয়েছিলো এতে!
হুইস্কির ঘোর তখনও কাটে নাই। মাথার ভেতরে পাথরের ভার। কিন্তু শরীরে তার পাখা লাগে। সে উড়ে যায় হস্তিবাড়িতে। রুপাই! রুপাই!
ভোরে তখনো আলো ভালো করে ফোটে নাই। বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে পায়। সে ফোন করে নান্নাকে।
নান্না! নান্না! স্যরি, তোমাকে এত ভোরে ফোন করছি।
কী, বিষয় কী দোস্তো? না মুই জাগিয়াই আছি। বর্ডার হতে এই সবে আসিয়া গোসল দিনু। চা খানু। সম্বাদ কী? হঠাৎ ফোন করিলে?
রুপাই! তার কোনো খবর আছে?
অবাক হয়ে যায় নান্না। কিছুক্ষণ সে কথা বলতে পারে না। কেরানি মনে করে, নান্না বুঝি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না সে কার কথা জানতে চাইছে।
কেরানি বিছানার ওপর উঠে বসে বলে, আরে সেই রুপাই! মনে আছে, তার সাথে সেই ছোটকালে আমার যা হয়, একদিন তোকে বলেছিলাম?
ফোনের ওপার থেকে নান্না বলে, মনে তো আছে। মুই আচ্চজ্য হয়া গেনু, এত জলদি তোর কাছে খবর পেঁৗছি গেছে! তার যে বড় বিপদ।
বিপদ!! খুলিয়া কও, খুলিয়া কও কী তার হইছে! তারে জন্যে পরান বড় অস্থির হয়া আছে কাইল রাইতের থেকি।
বন্ধুর মুখে দেশি ভাষা ফুটতে শুনে নান্নার মনে সন্দেহ থাকে না যে, রুপাইকে নিয়ে কতখানি উদ্বেগ তার হয়েছে। সে বলতে থাকে।
জয়নাল ভাইকে অপহরণ করা হইছে! মুক্তিপণ পাঁচ লক্ষ ট্যাকা দাবি করিছে! বিষ্যুতবারের সইন্ধাকালে তাকে অপহরণ করা হয় জলেশ্বরীর বাজারে তার দোকান হতে। কাঁই তাকে কী কথা আছে বলি দোকান থেকিয়া ডাকি নিয়া যায়। বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার পর্যন্ত যায় সেই মানুষটার সাথে। অনেকে কয়, মাজারের সিঁড়িতে বসিয়া কার না কার সাথে জয়নালভাইকে আলাপ করিতেও দেখা গেইছে। তারপর সারা রাইত তাঁই আর ঘরে ফেরে নাই। বিয়ানকালে রুপাইর কাছে সম্বাদ দেওয়া হয়, তোমার স্বামী সুস্থয় আছে। হামার কাছে আছে। পাঁচ লক্ষ ট্যাকা দিলে তবে তাঁই বাড়ি ফিরিবে! না দিলে কাফন পিন্দিবে তাঁই। হত্যা করা হইবে। যা হয় মঙ্গলবারের মইধ্যেই করিবে।
আবার সেই মঙ্গলবার! কেরানি গুম হয়ে যায়। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় তার। এত বারবার মঙ্গলবার ফিরে আসছে কেন? অবশ কণ্ঠে সে জানতে চায়, কারা জয়নালভাইকে অপহরণ করেছে।
নিশ্চয় করি কিছু কওয়া যায় না। জয়নালভাই জলেশ্বরীতে ছোটখাটো পলিটিক্স করিতো! হবার পারে, বিরোধী দল তাকে গুম কইরছে। হবার পারে পলিটিক্স নয়, সন্ত্রাসী কেউ! রাজধানী থাকো, তোমার তো জানা আছে_ দ্যাশ আইজকাল সন্ত্রাসীতে ভরি গেইছে। তা তোমার কাছে রুপাইর বিপদের সম্বাদ দিলে কাঁই? তোমার তো এলা বোলবোলাও অবস্থা। তোমার কোন্ বড়ভাই আছে বলিলে, তার গাড়ি নিয়া হস্তিবাড়ী ঘুরি গেইলে তুমি চাচাজানের দাফনের কালে। সম্বাদ যদি এতদূর হতে বিজলির মতো নগদে পায়া থাকো তবে দ্যাখো না কেনে কিছু যদি করিবার পারো!
ফোনে আরো অনেকক্ষণ কথা হয় দুই বন্ধুর। নান্না অবাক হয়ে বারবার জানতে চায়, দূর রাজধানীতে বসে জয়নালভাইয়ের অপহরণের কথা কেরানি এত দ্রুত জানলো কীভাবে। আর কেরানি ভাবে, কী আশ্চর্য! রুপাই তবে তার ভেতরে এতটাই এতকাল ছিলো গভীর মূলে! আর তাই তার মনের কাছে অজানা থাকে নাই যে রুপাই এমন একটা বিপদে পড়েছে! পারে না সে রুপাইকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে?
বিদ্যুত ঝলকের মতো কেরানির তখন মনে পড়ে একজনেরই কথা। খাম্বা সামাদ! যত সে ভাবে ততই তার মনে হয়, না, তার নিজের এই বাদশাহী জীবনের জন্যে নয়, রুপাই যে বিপদমুক্ত হবে তারই জন্যে নিয়তি তাকে খাম্বা সামাদের নেকনজরে আনে!
আমরা এখানে একটু থামি। আমরা লক্ষ্য করি আমাদের কেরানির মনোভাবটা। কেরানির বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, খাম্বা সামাদের কাছে সে যা চাবে তাই পাবে। তাকে সে যা করতে বলবে সে তাই করবে। এটি তার ভুল ধারণা কিনা অচিরেই আমরা দেখতে পাবো।
এত ভোরে খাম্বা সামাদকে ফোন করা ঠিক হবে না। নাসিরকে সে ফোন করে।
আপনি একটু আসতে পারবেন, ভাই? আসেন না, দুইজনে নাশতা করি।
না, নাসির এখন আসতে পারবে না। তবে, দুপুরের দিকে আসতে সে চেষ্টা করবে।
দুপরেও নয়, বিকেলে আসে নাসির। সারাটা দিন বড় উদ্বেগে কেটেছে কেরানির। নাসির আসতে না আসতেই তাকে পুরো বিবরণ দেয় কেরানি। বলে, আপনার কি মনে হয়, খাম্ভাই কিছু করতে পারবেন? একটু বাড়িয়েই বলে, জয়নালভাই আমার আপন মামাতো ভাই। না হলে এত ঘাবড়াতাম না।
নাসির কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে বসে থাকে। তারপর বলে, সরাসরি ভাইয়েরে কিছু না বইলা আপনে ভালোই করছেন। উনি ব্যস্তও আছেন। আচ্ছা, আমি কয়া দেখি। তবে, জলেশ্বরী! বড় দূর! তারপরও ভাইয়ের হাত! অনেক লম্বা। দেখি! এ লিয়া আপনে আর বেচইন থাইকেন না। আমি যাই।
সন্ধ্যা পার হয় নাই, এখনো হুলারহাট রাঙাবালির লঞ্চ ছাড়ে নাই, এখনো সদরঘাটে যাত্রীর ভিড় কমে নাই, ঘাটের কলরব বিরাম পায় নাই, কেরানি রুমের বাইরে বারান্দায় বসে ছিলো, দড়াম করে রুমের দরোজা খুলে যায়। কেরানি চমকে উঠে ফিরে দেখে_ খাম্বা সামাদ!
খাম্বা সামাদ এসেই একটা চেয়ার টান মেরে নদীমুখো করে বসায়, নিজে বসে, তারপর বিনা ভূমিকায় তীব্র রুষ্ট গলায় বলে, আপনি আমাকে সন্ত্রাসী মনে করেন? অ্যাঁ? সারা দেশে আমার নেটওয়ার্ক? বাংলাদেশ আমার বাপের? আমার কথায় ওঠে বসে?
এতগুলো ধমকের সমুখে কুঁকড়ে যায় আমাদের কেরানি। ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে থাকে। সদা প্রফুল্ল সদা উদগ্রীব সদা আমুদে এই লোকটি, সদাই যে তাকে খুশি রাখবার জন্যে ব্যস্ত, সেই লোকটিরই এমন পরিবর্তন দেখে ভীত হয়ে পড়ে কেরানি।
আর একটিও কথা না বলে পর মুহূর্তেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় খাম্বা সামাদ। টান মেরে চেয়ারটা সরিয়ে দেয়। টানের চোটে চেয়ারটা চিৎ হয়ে পড়ে যায়। কেরানিও উঠে দাঁড়ায়।
না, খাম্ভাই, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি সিরিয়াসলি কথাটা বলি নাই। মানে, যদি পারতেন আর কি!
খাম্বা সামাদ দরোজা ঠেলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও কী ভেবে থমকে দাঁড়ায়। বলে, নিজেরটা চিন্তা করেন। নিজেরটা!
হ্যাঁ।
সখেদে খাম্বা সামাদ বলে, কার জন্যে আমি কী করি! রাস্তা থিকা উঠায়া আনি!
কথাটা যে তাকেই বলা, বুঝতে পেরে কেরানির পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যায়।
খাম্বা সামাদ বেরিয়ে যাবার জন্যে পা ফেলে। আবারও কী ভেবে থমকে যায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, আর একটা কথা। নো দিস ভেরি ক্লিয়ারলি। নো পলিটিকস। রাজনীতি আনবেন না। রাজনীতি টানবেন না। আপনার মামাতোভাই পলিটিক্যাল কারণে কিডন্যাপ হইছে। আপনে এই ডেঞ্জারের ভিতরে যাইবেন না। দূরে থাকবেন। কেমুন! আর মঙ্গলবারে যেইখানে নিয়া যাবো, পলিটিকসের কথার ধারেকাছে যাইবেন না। মঙ্গলবার আপনি মালছামান গুছায়া রেডি থাকবেন।
আমাদের কেরানি ঠাহর করে উঠতে পারে না কথাটা। মালছামান? তার মানে কী?
আপনের কাপড়চুপোড়, সুটকেস। এইখানে শ্যাষ। হেইখানে থাকবেন।
কোথায়?
বাগানবাড়ি!
দড়াম করে দরোজা বন্ধ হয়ে যায়। ঘাটের মসজিদ থেকে এশার নামাজের আজান পড়ে। পরেপরেই লঞ্চের ভোঁ বাজে। রাঙাবালির লঞ্চ ছাড়ছে। ঠনঠন করে ঘণ্টা পড়ছে। মাল্লারা ওই দেখা যাচ্ছে বালতি বালতি পানি তুলে লঞ্চের গলুই ভিজিয়ে দিচ্ছে। আল্লা গো, আমরা আগেই ডুইব্বা আছি, আর ডুবাইও না।
লঞ্চের প্রপেলারের আঘাতে বুড়িগঙ্গার বুকে পানির তোড় জেগে ওঠে। ফেনা ছড়াতে থাকে। পানির বুকে শাদা শাদা ফুল ফুটতে থাকে যেন। ধন্দলাগা চোখে কেরানি তাকিয়ে থাকে। পায়ের নিচে লঞ্চযাত্রার সরসরানি টের পায় সে। এমন কতদিন সে নীল সাগর-৩ লঞ্চের বুকে অনুভব করেছে ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা যাত্রাকালে।
তার বড় আশা ছিলো, সুযোগ বুঝে খাম্ভাইয়ের কাছে দশ হাজার টাকা সে চাইবে। দেনমোহরের টাকা। মদিনাকে দশ হাজার টাকার দেনমোহরে সে কবুল করেছিলো। শোধ করা হয় নাই। বাসর রাতে মাফ চেয়ে নেয়ার কথা। মাফ চাওয়া হয় নাই। মদিনা নাম শুনেই সব তার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু খাম্বা সামাদের যে রূপ সে দেখে ওঠে, টাকা চাওয়ার প্রশ্নই আর ওঠে না। কেরানির মনটা অঝোর অশ্রুতে ভিজে ওঠে। এ অশ্রু চোখে দেখা যায় না। ছবিতে আঁকা বৃষ্টির ছবির মতো বর্ষণ হয়ে থাকে।
ময়না নাশতা নিয়ে আসে।
ময়না, তুই কিছু খাইছস?
মেয়েটা মাথা নাড়ে।
আয়, আমার লগে বয়। নাশতা কর।
ময়না অবাক হয়ে যায়।
আপনে খান তো!
পরশু মঙ্গলবার না? পরশু আমি চলে যাচ্ছি।
কী কন! এইখান থিকা যাইবেন গা?
হ্যাঁ। যাবো।
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে ময়না বলে, হ, জানি। জানিই তো। এইডা হোটেল। কেউ এইখানে থাকবার আসে না। দুই-চাইর দিন। তারপর যায় গা।
কেরানির মনে কথাটা গভীর মূলে গিয়ে ধাক্কা দেয়। কেউ এখানে থাকতে আসে না। দু’দিন চারদিন, তারপর চলে যায়। কে কবে দুনিয়ার বুকে চিরকাল থাকে!
[চলবে]