সাড়ে তিন হাত ভূমি

সাড়ে তিন হাত ভুমি বোনটি
১৩.
বকুল, বকুল রে, আমার বোন, আমার হৃদয়জুড়ে থাকা বোনটি, এই বাড়িতে ঢুকে যে দৃশ্য আমি দেখেছি, এ রকম দৃশ্য দেখে কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না তার মাথা ঠিক রাখা।
বাবার লাশ পড়ে আছে উঠানে।
মায়ের লাশ পড়ে আছে বসার ঘরে।
বোনের ছিন্নভিন্ন লাশ তার ঘরে।
স্ত্রীর লাশ ভেতর দিককার উঠানে। বেয়োনেট চার্জ করে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে তার গর্ভের সন্তান।
এই দৃশ্য কেমন করে সহ্য করে মানুষ!
কেমন করে তাকিয়ে দেখে!
আমি দেখেছি। আমি সেই মানুষ, আমি দেখেছি। দেখার পরের অনুভূতি তোকে আমি বলতে পারব না।
এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এই অনুভূতি প্রকাশের কোনো ভাষা নেই।
এ রকম দৃশ্য যে দেখে, শুধু সে-ই জানে তার অনুভূতি কেমন। মনের অবস্থা কেমন! এ রকম দৃশ্য দেখে কেমন করে বেঁচে থাকে সে! কেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে না! কেন হার্টফেল করে মারা যায় না!
না, আমি অজ্ঞান হইনি।
আমি হার্টফেল করে মরে যাইনি।
আমি বেঁচে আছি।
আমি তোদের জন্য বেঁচে আছি। আমি বেঁচে আছি দেশের সাত কোটি মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী আর সন্তানের জন্য! দেশের বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য আমি বেঁচে আছি।
যোদ্ধার বেঁচে থাকতে হয়!
দেশের স্বাধীনতার জন্য বেঁচে থাকতে হয়।
মুক্তির জন্য বেঁচে থাকতে হয়।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমি বেঁচে আছি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য। সাত কোটি মানুষকে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আমার বাবা দেখে যেতে পারলেন না, আমার মা পারলেন না। আমার আদরের বকুল ফুলটি পারল না, আমার মায়া পারল না। আর স্বাধীন দেশের আলো-হাওয়ায় জন্মাতে পারল না আমার সন্তান।
আমার বুকজুড়ে এখন এই হাহাকার।
তবে ধাক্কাটা আমি অনেকখানি কাটিয়ে ফেলছি, বুঝলি!
বুঝলি আমার পাগলি বোন!
আমার বকুল।
আমার বকুল ফুলটি!
প্রথমে অবস্থাটা হলো কী জানিস, উঠানে বাবার লাশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, কে যেন লোহার খুব ভারী একটা ডাণ্ডা দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মারল।
এমন বাড়ি!
মাথাটা কিন্তু আমার ফাটল না। থ্যাঁতলাল না। চূর্ণবিচূর্ণ হলো না। অর্থাৎ বাইরে কিছুই হলো না। যা হওয়ার হলো ভেতরে। মাথার ভেতরে। মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। চিন্তাচেতনা এলোমেলো হয়ে গেল।
আমার বাবাকে এইভাবে মেরে ফেলে রেখেছে উঠানে!
তারপর দেখি মাকে।
তারপর দেখি তোকে।
তারপর দেখি মায়া আর আমার সন্তান!
কিন্তু চারজন মানুষের রহস্য আমি উদ্ঘাটন করতে পারছি না! কদম বুয়া পারুল আর বারেক।
বারেক কি এই বাড়িতে ছিল?
নাকি সে আছে নারায়ণপুরে, মোসলেম মিয়ার বাড়িতে!
কদম কি বিলের ওদিক থেকে উধাও হয়ে গেল?
বুয়া?
পারুল?
এই দুজন মানুষের কী হলো? গোলাগুলির শব্দে এত বড় বাড়ির কোনোদিকে পালাতে গিয়ে গুলি খেল! ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে পড়ে আছে তাদের লাশ! নাকি বর্ষার পানিতে গিয়ে পড়েছে! এতক্ষণে ফুলেফেঁপে ঢাউস হয়ে গেছে তাদের লাশ।
বল্টু কুকুরটাকে নিয়ে যেমন ভেবেছি বুয়া আর পারুলের ক্ষেত্রেও কি ও রকমই ঘটেছে!
পারুল তো ছিল দশাসই তাগড়া ধরনের মেয়ে!
নাকি তার অবস্থাও হয়েছে তোর মতো!
নাকি বুনো কুকুরের দল তাকে খাবলেখুবলে খেয়েছে। হয়তো বা তখনো বেঁচে আছে বলে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন আটকে রাখবে ওদের ক্যাম্পে আর চালাবে নির্যাতন!
এলোমেলো মাথায়ও আমি তারপর কয়েকটা কাজ করেছিলাম, জানিস! অবচেতন মন থেকেই বুঝি করেছিলাম! নিজের অজান্তেই বুঝি করেছিলাম।
ওই যে বললাম, বাড়ির কিছুই নেই আমাদের। আসবাবপত্র সব লুটপাট হয়ে গেছে। ঘরের দরজা-জানালার কপাট, লোহার শিকগুলোও খুলে নিয়ে গেছে। কোনো ঘরে কিচ্ছু নেই। মায়ার ঘরে ছিল পুরনো ছেঁড়া খবরের কাগজগুলো। বুয়া পারুলের ঘরে ছিল একটা একেবারেই ছেঁড়া মাদুর আর দু-তিনটা ছেঁড়া কাঁথা।
ওগুলো কে নেবে?
ওই দিয়ে কী হবে!
তোর ঘরের পালঙ্কটা নিয়ে গেছে। দরজা কপাট আলমারি আর পুরনো আমলের ড্রেসিং টেবিলটা- কিচ্ছু নেই তোর ঘরে।
তোর ঘরে আছিস শুধু তুই।
মেঝেতে পড়ে আছিস।
তোর দিকে আমি তাকাতে পারিনি। আমার বকুল ফুলটি, আমি তোর দিকে তাকাতে পারিনি।
এই ঘরে ছুটছি।
ওই ঘরে ছুটছি।
তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। তখন আমার মাথায় আর কিছু নেই। আর কিচ্ছুটি নেই। তোকে যেন আমার রক্ষা করতে হবে। শুধু তোকেই যেন আমার রক্ষা করতে হবে।
কী রকম রক্ষা?
কিন্তু বাড়ির কোথাও কিছু পাই না।
কী দিয়ে রক্ষা করব তোকে?
কী দিয়ে ঢাকব তোকে?
বুয়া পারুলের ঘর থেকে নিয়ে এলাম ছেঁড়া মাদুর আর কাঁথাগুলো। কী রকম বোঁটকা একটা গন্ধ আসছিল কাঁথাগুলো থেকে!
আশ্চর্য ব্যাপার, জানিস।
আশ্চর্য ব্যাপার!
ওই অবস্থায়ও বহুদিন ধরে ব্যবহার করা, না ধোয়া কাঁথা থেকে আসা বোঁটকা গন্ধটা আমি ঠিকই পেলাম।
এটা কী করে সম্ভব, বল তো?
এমন হয়?
এই অবস্থায় এমন হতে পারে?
আমার ক্ষেত্রে হলো। বুয়া পারুলের কাঁথার বোঁটকা গন্ধে বমি আসতে চাইল।
তবে মুহূর্তের জন্য।
তার পরই সব ঠিক। আর কোনো অনুভূতি নেই।
মাদুর, কাঁথা নিয়ে তোর ঘরে এলাম। কাঁথাগুলো দিয়ে পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলাম তোকে। শুধু মুখটা খোলা।
কিন্তু মাদুরটা আনলাম কেন?
মাদুর দিয়ে কী করব?
মাদুরটা ফেলে রাখলাম তোর মাথার কাছে।
এখন সেই মাদুরে এসে বসেছি আমি। তোর মাথার কাছে। এই তো বুয়া পারুলের কাঁথায় ঢাকা তুই পড়ে আছিস তোর ঘরের মেঝেতে, আর তোর ভাইটি বসে আছে তোর মাথার কাছে।
কিন্তু তোর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না, বকুল।
তোর মুখ আর মুখ নেই।
তোর গোলাপের মতো গাল আর গাল নেই।
তোর চিবুক আর চিবুক নেই।
ঠোঁট আর ঠোঁট নেই।
শুধু চোখ দুটো ঠিক আছে। ভয়ংকর আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল তোর চোখ। বুয়া পারুলের কাঁথায় তোকে ঢাকার সময় আমি তোর চোখ দুটো বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তোর চোখ বন্ধ হচ্ছিল না।
কেন বল তো!
যতবার বন্ধ করতে যাই, খুলে যায় তোর চোখ!
এমনই কি হয়!
মৃত্যুর দীর্ঘক্ষণ পর খোলা চোখ কি বন্ধ হতে চায় না!
বন্ধ হয় না!
কিন্তু বাবার চোখ তো বন্ধ হয়েছিল!
নাকি বাবার চোখও বন্ধ হয়নি! আমি ভুল দেখেছি। ভুল ভেবেছি!
আমার অবস্থা এখন কেমন, জানিস!
এই পাগলী, জানিস তোর ভাইয়ের অবস্থা এখন কেমন!
আমি তোর কপালে আর মাথায় হাত বুলাচ্ছি। তোর গালে-মুখে হাত বুলাচ্ছি। নাকের ডগাটা একটু ছুঁয়ে দিলাম। ছোটবেলার সেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো।
আমাদের পুরনো আমলের এই বিল্ডিংটা এমন, প্রতিটা ঘরে কোনো না কোনো দিক দিয়ে ঢোকে প্রচুর আলো-হাওয়া। তোর ঘরে চাঁদের আলো যেন গলগলিয়ে ঢুকছে। রাতের হাওয়া ঢুকছে তিরতির করে। তোর মুখও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। যেমন পাচ্ছিলাম মা-বাবার মুখ।
আহা রে, তোর মুখটা কী সুন্দর ছিল!
আমার বোনের মুখের মতো সুন্দর মুখ কি এই পৃথিবীর আর কারো আছে?
আছে।
এই দেশেই আছে।
বাংলার প্রতিটি বোনের মুখ তোর মুখের মতো সুন্দর। বাংলার প্রতিটি বোন তার ভাইয়ের জন্য সমান কাতর। অমন ভালোবাসা প্রত্যেক বোনের তার ভাইয়ের জন্য। শচীন কর্তার সেই গানটির কথা তোর মনে আছে?
কে যাস রে ভাটিগাঙ বাইয়া
আমার ভাই ধনরে কইয়ো
নাঐর নিতে আইয়া
নদীর ভাটিতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছে মাঝি। নদীতীরের শ্বশুরবাড়িতে আছে এক বোন। ভাইয়ের জন্য তার মন আকুল। মাঝির উদ্দেশে সে এই গান করে! ভাই যেন তাকে এসে নিয়ে যায়।
এই তো আমার বাংলার বোন!
এই তো আমার দেশের প্রতিটি বকুল।
ও, আমার অবস্থার কথা তোকে বলতে চাইলাম! আমার অবস্থা এখন কেমন সে কথা বলতে চাইলাম!
কেমন একটা গন্ধ আসছে, বুঝলি।
মার সামনে যখন বসেছিলাম, তখনো এই গন্ধটাই পাচ্ছিলাম!
মনে হচ্ছে কোনো একটা ফুলের গন্ধ! কী ফুল বুঝতে পারছি না। বুনো ফুল হবে। অচেনা বুনো ফুল। এই বাড়ির কোনো ঝোপ-জঙ্গলে ফুটেছে বর্ষার বুনো ফুল। রাতের বেলাই বুঝি গন্ধ ছড়াচ্ছে সেই ফুল।
নাকি গন্ধটা অন্য কিছুর!
আমার মা বাবা বোন স্ত্রী আর সন্তানের রক্তের গন্ধ!
পচন ধরা মাংসের গন্ধ!
আমি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি, আমার মাথা কাজ করছে না। আমার হাত-পা লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে মা-বাবার রক্তে, শার্ট লুঙ্গিতে লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে।
এ তো এক রকম ভালোই হয়েছে। আমার শরীরজুড়ে আমার পরিবার। আমার অন্তরজুড়ে আমার পরিবার।
ওই যে আমার অবস্থার কথা বলতে চাইলাম, সেটা শোন।
পঁচিশে মার্চের নৃশংস ঘটনার পর লাখখানেক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ওপারে। কেরানীগঞ্জ থানার বিভিন্ন গ্রামে, জিঞ্জিরায়। ওই এলাকা বলতে গেলে স্বাধীন। কেরানীগঞ্জ থানা দখল করে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা। মোস্তফা মুহসিন মন্টু ভাইয়ের নেতৃত্বে হয়েছে থানা দখলের কাজ। খসরু ভাইও আছেন তাঁর সঙ্গে।
এপ্রিলের ২ তারিখে ওই এলাকায় আক্রমণ চালাল পাকিস্তানি বুনো কুকুরগুলো। ফজরের আজানের সময় থেকেই শুরু করল হত্যাকাণ্ড। গান পাউডার দিয়ে জ্বালাল জিঞ্জিরা বাজার। মেশিনগানের গুলি ছোটাল বৃষ্টির মতো। মর্টারের শেল উড়ে আসতে লাগল শিকারি বাজপাখির মতো। ঘুমভাঙা দিশেহারা মানুষ জান বাঁচাতে যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল আর গুলি খেয়ে পড়তে লাগল মাঠঘাট রাস্তা আর ফসলের ক্ষেতে। হাজারখানেক মানুষ এক সকালে মেরে ফেলল জন্তুরা।
একজন মানুষ প্রাণভয়ে ছুটছে। মর্টারের শেল এসে লাগল তার ঘাড়ে। মাথাটা ছিটকে পড়ে গেল রাস্তার ধারে। মানুষটার ছোটার গতি তখনো থামেনি। সে ছুটছে।
ভাবা যায়, মাথা উড়ে গেছে মর্টার শেলের আঘাতে, তবু মানুষটা ছুটছে।
কিন্তু কয়েক পা মাত্র। তার পরই মাথাহীন দেহ তার লুটিয়ে পড়ল রাস্তার পাশের ডোবায়।
এই জিনিসের নাম গতি।
আমি কি এখন তেমন এক গতির মধ্যে আছি!
আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের।
আমার মাথা হচ্ছেন আমার বাবা।
কলিজা হচ্ছেন আমার মা।
চোখ দুটো হচ্ছিস তুই, আমার বোন। আমার বকুল ফুলটি।
হৃদয় হচ্ছে মায়া।
আর আমার হাত-পা!
আমার হাত-পা চালিকা আর শক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আসতে চাইছিল একজন মানুষ। আমার সন্তান। সব- সব চলে গেছে আমার। তবু আমি বেঁচে আছি।
এই অবস্থায় কেমন করে বেঁচে থাকে মানুষ!
[চলবে]