ন হন্যতে
অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
এই আত্মা জন্মরহিত শ্বাশত ও পুরাতন
শরীরকে হনন করিলেও ইনি নিহত হন না।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
উপন্যাসের কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই, সে তার নিজের কথা নিজেই বলে। তবু আমাকে একটু কৈফিয়ৎ দিতে হচ্ছে। এ বইতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এমন অনেকের নাম উল্লেখ করেছি যারা একদিন জীবিত ছিলেন। এই কাহিনী গড়ে তোলবার জন্য তাদের প্রকৃত নাম উল্লেখের হয়ত তেমন সার্থকতা নেই। শুধু আমি একটি যুগের ছবি আঁকতে চাইছিলাম, যে যুগ এইসব যুগপুরুষ ও অসামান্যা নারীদের উপস্থিতিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। কোনো কাল্পনিক নাম ব্যবহার করে সেই যুগটি আমার কাছে সত্য হচ্ছিল না।
১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে বইটা লেখা হয়েছে, মাত্র দু’মাস আগে পাণ্ডুলিপি ছাপতে দিয়েছি। খুব শখ হয়েছিল পূজার আগে বইটি প্রকাশ হবে। প্রকাশক মশাই আমায় বলেছিলেন এত দ্রুত কাজ ভাল হয় না। কিন্তু আমার অতি আগ্রহবশত আমিই তাড়া করে দু’মাসের মধ্যে বাইশ ফর্মা বইটা ছাপিয়ে ফেললাম—ফলে দু-চারটি মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেল, যার জন্য প্রকাশক দায়ী নন, দায়ী আমি।
মৈত্রেয়ী দেবী
২রা অক্টোবর, ১৯৭৪
উৎসর্গ
আমার মা
স্বর্গীয়া হিমানীমাধুরী দাসগুপ্তাকে
—১৫ই ভাদ্র, ১৩৮১
১.০১
১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭২
আজ আমার জন্মদিনের উৎসবে তোমরা এসেছিলে পার্বতী ও গৌতমী। তোমরাই উৎসব করেছিলে কিন্তু তোমরা জানতে না, তখনই—ঠিক তখনই, যখন এ ঘরে গান হচ্ছিল, গল্প হচ্ছিল, আমি হাসছিলাম, তখন আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম। সময়ের প্রবাহ আমার মনের মধ্যে উত্তাল, আমাকে তা ছুঁয়েছিল, আমি চলেছিলাম, চলেছিলাম ভবিষ্যতে নয় অতীতে।
এখন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে, হয়তো দুটো বাজে—আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—এখান থেকে পূর্ণ আকাশ দেখা যায় না, আধখানা সপ্তর্ষি অনন্ত প্রশ্নের মতো আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। প্রশ্ন, প্রশ্ন, প্রশ্ন, আজ এই প্রশ্ন কত যুগ পার হয়ে আবার কেন মনে এল? কেন আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটল যার কোনো প্রয়োজন ছিল না? আবার দেখছি এর আরম্ভও নেই, শেষও নেই।
আকাশের তারাগুলি উজ্জ্বল, কত মানুষের কত যন্ত্রণার সাক্ষী ওরা। আমার সমস্ত মন ঐ আকাশটা টানছে—আমি যেন এখানে নেই, এখানে নেই অথচ আমি তো এখানেই। এখান থেকে কি কোথাও যেতে পারি—এই তো আমার পরিচিত সংসার। শোবার ঘরে আমার স্বামী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। কী নিঃসংশয় আমার সম্বন্ধে, আমাকে উনি ভালোমতো চেনেন না, অথচ কী গভীর ভালোবাসেন, কী বিশ্বাস আমার উপরে! আমিই ওর সব। ওঁর পৃথিবীটা ঘুরছে আমাকে কেন্দ্র করেই, কিন্তু উনি যে আমার সব নয় একথা নিশ্চয়ই উনি কোনো একরকম করে জানেন, তবু তাতে ওর কোনো ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ নেই আমারও। আমার জীবন নানাদিক থেকে কানায় কানায় পূর্ণ। সংসারকে যা দেবার ছিল, মনে হয়েছিল তা দিতে পেরেছি, ভালোবাসার যে মহিমা, মনে হয়েছিল তাও জানি, শ্রদ্ধা ও পূজার সঙ্গে মিশে তার অলৌকিক ঊর্ধ্বগামী নিবেদন আমার গুরুর প্রতি, আমাকে কৃতার্থ করেছে। তবু কাল থেকে আমার জীবনের আস্বাদ কি করে এমন বদলে গেল? কী দারুণ অতৃপ্তি, এক ধূ ধূ সাহারার বালির আঁচলের মতো আমার শস্যশ্যামল সুন্দর পৃথিবীর উপর বিছিয়ে গেল! আমি জানি ওর নিচে সব আছে, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনি। এখনও ওর অবচেতনে আমি তেমনি সত্য—আর উপরে মা বাবার কোলের কাছে ঘুমিয়ে আছে আমার নাতি, কাল সকালে সে যখন নেমে আসবে, তখন তার নরম ছোট্ট হাত আমাকে তেমনি করে জড়িয়ে ধরবে—আমার পৃথিবী তেমনি আছে কোমল সজীব সবুজ। তবু এর উপর গলিত লাভা গড়িয়ে আসে কেন, আমার মুখে যে গরম বাতাসের তাপ লাগে। না, না, লাভা নয়, গলিত স্বর্ণও হতে পারে—এ তো ফিরিয়ে দেবার নয়, এতে যে আনন্দ আছে, এর যে মূল্য আছে। আমি জানি, এ ছাই হয়ে যাবে না, কারণ, ‘ছাই হয়ে গিয়ে, তবু বাকি যাহা রহিবে’ এ সেই অবশিষ্ট।
তবু আজ দুদিন থেকে কী কষ্ট, কী ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছি আমি। কি রকম কষ্ট? ‘রম্যাণি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ নিশম্য শব্দান্’ যে রকম মন ব্যাকুল হয়, জননান্তর সৌহৃদানি মনে পড়ে—‘পযুৎসুকী ভবতি যৎ সুখিতোহপি জন্তুঃ’ সেই রকম কি? তাও তো নয়, এ তো জন্মান্তরের কথা নয়—এ তো এই সে দিনের কথা, মাত্র বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। মাত্র বেয়াল্লিশ বছর আমি পার হয়ে ফিরে গেছি—মানুষের কাছে এ অনেক সময়, কিন্তু অনন্তের কাছে?
সময়ের তত অবস্থান নেই, তার সামনেই বা কি, পিছনেই বা কি, পাশেই বা কি? তার উদয় অস্ত কোথায়—শুধু আমার সম্বন্ধে অনাদি অনন্ত মহাকাল খণ্ডিত—শুধু আমাকে প্রকাশের জন্য সে সীমাবদ্ধ, কিন্তু আজ হঠাৎ বেয়াল্লিশ বছরের গণ্ডী সে তুলে নিয়েছে—আমি মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট—আমার সামনে পিছনে নেই—আমি স্থির ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছি এই ১৯৭২-এ পা রেখেও ১৯৩০ সালে।
ঘটনাটা ঘটল কি করে, ঘটল কোন তারিখে?
১৯৭২ সালে ১লা সেপ্টেম্বর সকালে। আগের দিন আমার ছেলেবেলার বন্ধু গোপাল আমাকে ফোন করে বললে, “অমৃতা, তোমার ইউক্লিডকে মনে আছে?”
“হ্যাঁ, একটু একটু—কেন?”
“ওদের দেশ থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছেন, তার পরিচিত, ইউক্লিড তোমার বাবার ছাত্র, তা তিনি তো আর নেই, তাই তোমার সঙ্গেই এ ভদ্রলোক দেখা করতে চান।”
একটা ছোট্ট আনন্দের বিদ্যুৎ আমার শরীর মনের ভিতর এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে গেল।
গোপাল টেলিফোনের ওপার থেকে তাড়া দিচ্ছে—“চুপ করে কেন? ওকে নিয়ে আসব?”
“না আমিই যাব, ওর ঠিকানাটা দাও।”
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। কোনোমতে একটা ট্যাকসি জোগাড় করে গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হলাম। ভাবছি কেন বা এলাম! যে চিঠি লিখলে উত্তর দেয় না, তার খবর জেনে আমার কি হবে? কিন্তু কৌতূহল ছাড়তে চায় না। আমি ভাবছি আমি কৌতূহলী, পরিচিত একজনের খবর জানতে চাওয়া খুব কি অন্যায়?
সত্যভাষণের খাতিরে বলতেই হবে সাধারণ মেয়ের মতো আমি একটু সেজেও নিয়েছি, একটা ভালো কাপড় পরেছি। তবু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, চেহারাটা বড়ই খারাপ হয়ে গেছে। মহাকালের দাপটে কিছুই থাকে না—সব ভেঙ্গে চুরে জীর্ণ করে দেবে—কিন্তু তাই কি? কাল কি শুধু পুরানোই করে, নূতন করে না? চেহারাটা আমার পুরানো হয়ে গেছে বটে, কিন্তু মন? যে-মন আজ মির্চা ইউক্লিডের কথা জানতে চাইছে—সেই কৌতূহলী উৎসুকী মন নূতন, এও কালের সৃষ্টি। একদিন লিখেছি
“যে কাল পিছনে ছিল
সে কাল সমুখে ফিরে আসে—
অনবগুণ্ঠিত মুখে তারকাখচিত পট্টবাসে—
কে তারে ভূষণ দিল, দিল অলঙ্কার
ক্ষণস্থায়ী ঐশ্বর্যের বসন্তবাহার?
স্পর্শহীন স্রোতে তার রূপহীন আবেগে অতুল
কে ফোটাল ফুল?
শূন্যের সমুদ্র হতে নিমেষে নিমেষে ধরে কায়া
বেলাহীন বেলাতটে তরঙ্গের মৃত্যুময়ী মায়া।”
যখন লিখেছিলাম তখন জানতাম না পিছন কি করে সামনে আসে—পুরানো নূতন হয়, বা নূতন পুরানো বলে ভাবাটাই একটা ভ্রম মাত্র!
গাড়িতে বসে আমি হাসছি—আমার বেশ মজা লাগছে, কাণ্ডটা দেখ, আমার সাজবার দরকার কি ছিল? চেহারা নিয়েই বা আক্ষেপের কারণ কি? মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে তো আর আমার দেখা হচ্ছে না, দেখা হবে তার দেশের একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে!
দরজাটা খোলাই ছিল। লোকটি টেবিলের উপর ঝুঁকে লিখছিল। তার রঙ তামাটে, ইয়োরোপীয়দের মতো সাদা নয়, শরীর নাতিদীর্ঘ, মুখে বুদ্ধির ছাপ। আমার সাড়া পেয়ে সে উঠে দাঁড়াল, বললে, “আমি সেরগেই সেবাস্টিন।” তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার ডান হাতখানি ধরে তার পল্লবের উপর চুম্বন করলে, এ ওদের দেশের রীতি। এই অতি পরিচিত ভঙ্গী যেন বহুবিস্মৃত যুগের পদশব্দের মতো মনে হল।
“তুমি অমৃতা?”
আমি জানি এই বিদেশী ব্যক্তিটি যার কথা বলছে, আমার দিকে তাকিয়ে যাকে সে দেখছে, সে আজকের ১৯৭২ সালের অমৃতা নয়। যে বিস্ময় তার ঐ ক্ষুদ্র প্রশ্নে ধ্বনিত, সে আজকের অমৃতাকে দেখে জাগবে না। আজ তার মুখে বলিরেখা, চুলে সাদা রঙ, দেহ সৌষ্ঠবহীন, ও দেখছে স্থির দৃষ্টিতে, আমাকে পার হয়ে সে দেখা চলে গেছে বহুদূর, ও দেখছে ১৯৩০ সালের অমৃতাকে।।
“তুমি আমাকে চেন?”
“তোমাকে আমাদের দেশে সবাই চেনে, তুমি আমাদের দেশে রূপকথার নায়িকা।”
“কেন মির্চার বই?”
“হ্যাঁ, ওর বই। সে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তোমার বাবা দিলেন না, তোমরা হিন্দু-সে ক্রিশ্চান।”
“বাজে কথা।”
“কি বাজে কথা?”
“হিন্দু-ক্রিশ্চান ওসব কিছু নয়। তার দম্ভ।”
“আজ বেয়াল্লিশ বছর হয়ে গেল মাঝে মাঝে শুনেছি ঐ বইয়ের কথা কিন্তু কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি ঐ বইটি কি—উপন্যাস, কবিতা না প্রবন্ধ—আজকে বলো তো বন্ধু—ঐ বইতে কি আছে?” প্রশ্নটা করে আমি হাসছি। এইতো কত সহজে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম, এতোদিন করি নি কেন? ওতো আর এক অমৃতা। চল্লিশ বছর আগেকার মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? তার কর্মফল আমাকে কি আর স্পর্শ করে? বারো বছর পরেই তো আর খুনের অপরাধে দণ্ড হয় না। আমার লজ্জাই বা কেন? লজ্জা এইজন্য যে, আমি মরালিস্ট। ন্যায়-অন্যায় উচিত-অনুচিত নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, আমি কঠিনভাবে বিচার করি। দুর্বলতার প্রশ্রয় দিই না। আমার বন্ধুরাও আমার সামনে তাদের দুর্বলতার গল্প বলে না। আমি সম্মানের উচ্চাসনে বসে আছি, নিজেকেও তো কোনোদিন রেহাই দিই নি। যখনই মির্চার কথা মনে হয়েছে তখনই ভূকুটি করেছি নিজেকে। কেন এমন একটা ঘটনা ঘটল, না ঘটলেই তো ভালো ছিল—তখনই লজ্জা, বিষম লজ্জা আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে, ওর স্মৃতিকে অবচেতনের গভীরে নির্বাসন দিয়েছি। কিন্তু আজ কত সহজে একে জিজ্ঞাসা করলুম ঐ বইটার কথা। মনে কোনো সংকোচ নেই।
সেরগেই বললে, “ও বই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস—”লোকটি ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে থেমে থেমে বলতে লাগল গল্পটা।
“জানো, ঐ বইতে ভারতবর্ষকে জেনে, কলকাতাকে জেনে, আমাদের দেশের লোক অবাক হয়ে গিয়েছিল।” ওর গলা শুনছি আর পরিচিত নামগুলি মনে পড়ছে, বুকে একটু একটু করে ধাক্কা লাগছে। যেন একটা একটা করে খড়খড়ি খুলছে—ঘরের ভিতর অন্ধকার, কিন্তু জানি ওখানে কি আছে। ওখানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভয়ে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে।
“সেরগেই, সত্য বলো ঐ বইতে আমার কথা কি আছে?”
ও মৃদু মৃদু হাসছে, তারপর ওর কন্টিনেন্টাল উচ্চারণে ‘ত’-এর আধিক্য দিয়ে ও বলল, “ফাস্ত শী লাভদ্ এ ত্রি–first she loved a tree.”
আমি চমকে উঠেছি। বুকের ভিতর দপ্ করে একটা স্মৃতির দীপ জ্বলে উঠল। ঠিক, ঠিক, ঠিকই।—“আরো বলো সেরগেই, এমন কি কিছু আছে যাতে আমি লজ্জা পাব?”
সেরগেই মাথা নিচু করে বললে, “সে লিখেছে রাত্রে তুমি তার ঘরে আসতে। অবশ্য আমি তো এতে লজ্জার কিছু দেখছি না।”
আমি তো স্তম্ভিত—“কী সর্বনাশ! কী অন্যায়! বিশ্বাস কর সেরগেই, এ সত্য নয়, একেবারে সত্য নয়।”
ও আমাকে সাহস দিচ্ছে, তা বোঝা যায়, তাই ত তোমায় বর্ণনা করতে পারে নি, লিখেছে তুমি অন্ধকারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ-ওর তো উপায় ছিল না, ওর যে তখন বড় কষ্ট।”
আমি অসহায় বোধ করছি, যেন জলে পড়েছি। অপ্রিয় সত্যকে গ্রহণ করবার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে পারি কিন্তু অপ্রিয় মিথ্যার আঘাত তো অসহনীয়।
অ্যাশ-ট্রেতে সিগারেটটি নির্বাপিত করে এই ভালোমানুষ বিদেশী ব্যক্তিটি বললে, “ক্ষমা কর, আমি তোমায় সবটা বললাম, সত্য কথাই বলতে হল।”
“বলতে পার সেরগেই, কেন সে আমার নাম করে বইটা লিখেছে?”
“তোমার নামের বন্ধন সে এড়াতে পারে নি, তখন যে তার কষ্ট, বড় কষ্ট—তুমি বইটা পড়লে চোখের জলে ভাসবে।”
“তাই বলে এমন একটা মিথ্যা কলঙ্ক দেবে?”
“ওটা তার কল্পনা, তখন তার যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধারের ঐ একটাই পথ ছিল। তোমাকে তো এখনও ভোলে নি।” আমার দিশাহারা লাগছে, কি বলব আমি—“আশ্চর্য যুক্তি তোমার সেরগেই, যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া! আর এতই যদি তার ভালোবাসা ছিল তবে আমার বাবার একটি ধমক খেয়েই আমাকে ফেলে চলে গেল কেন? এমন কখনো হয়? শুনেছ কখনো?”
“হয় না? শুনি নি? এরকম দৃষ্টান্ততেই তো ইতিহাস ভরা। তুমি তখন ষােল বছরের একটি মেয়ে ছিলে, সে তেইশ বছরের তরুণ—আহা তোমার বাবা তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।”
আমার শরীর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল। এ মানুষটা বলে কি! “সেরগেই, তুমি আমার জীবনের কি জাননা! আমার জীবন নষ্ট করে সাধ্য কার! আমার সমৃদ্ধ জীবন। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনী নিয়ে আমার আদর্শ সংসার। কত মানুষের ভাললাবাসা পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি। সর্বোপরি আমার গুরু, যার সম্বন্ধে তোমার বন্ধুর অত ঈর্ষা, তাঁর আশ্চর্য স্নেহে অভিষিক্ত আমার মন এমন অতীন্দ্রিয় ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছে যা বাক্য বা মনের অতীত বস্তু। ঐ একটা তেইশ বছরের ছেলের জন্য আমার এই আটান্ন বছরের জীবনে কোনো স্থান আছে কি?”
আমি খুব উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলছি, আমার মাথার মধ্যে শিরা উপশিরা দপদপ করছে, আর ভয়ও হচ্ছে, আমার যে বয়স অনেক, স্ট্রোক হয়ে যাবে না তো!
সেরগেই বিপন্ন মুখে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। “নানা, জীবন নষ্ট নয়-জীবন অন্যরকম হতো।” “তা বলতে পার। অন্য রকম, এই মাত্র!”
“তোমার প্রথম কবিতার বইখানা আমার কাছে আছে। ওকে যখন দেশ ছেড়ে যেতে হল তখন ওর সমগ্র লাইব্রেরী আমি নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে তোমার বইখানাও ছিল?”
“বল তো কি রকম দেখতে?”
“নীল কাপড়ের শক্ত মলাটে বাধান, বড় একটা সোনালী রং-এর ফুলের নকশা মাঝখানে?”
আমি হাসছি। “কি আশ্চর্য, ঠিক তো। সে যে কতকাল আগের কথা! কি করে জানলে ওটা আমার লেখা বই?”
“শেষের পৃষ্ঠায় তেরছা ভাবে একপাতা থেকে আর এক পাতায় চলে গেছে তোমার হাতের লেখা, তুমি লিখেছ—Mircea Mircea Mircealhave told my mother that you have only kissed me on my forehead—”
সেরগেইর মুখের কথাটা শেষ হয়নি—আমার পায়ের তলা শির শির করে উঠল। আমি একটা নিচু চৌকিতে বসে মাটিতে পা ছুঁয়েছিলাম—আমার মনে হল আমার পা আর মাটিতে নেই—এ ঘরের ছাত নেই। আমি শূন্যে মহাশূন্যে চলেছি—অথচ আমি জানি আমি সেরগেইর দিকে তাকিয়ে আছি, সে মৃদু মৃদু হাসছে, আমিও হাসছি কিন্তু কী আশ্চর্য সেই শারীরিক অনুভূতি—আমি দ্বিধাবিভক্ত! আমি এখানে, অথচ এখানে নেই। আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি ভবানীপুরের বাড়ির দোতালার বারান্দায় বারান্দার মেঝেটা সাদা কালো চৌকো চৌকো পাথরে বাধানো, যেন সতরঞ্চ খেলার ছক, মসৃণ পাথরের মেঝের উপরে আমি উপুড় হয়ে আছি। আমার হাতে ঐ বইটা। ঐ তো আমি, ঐ তো আমি–আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি, আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ জলপ্রপাতের শব্দে সেদিনের কান্না ফিরে এসেছে—কি আশ্চর্য, আমি কিন্তু সেরগেইর সঙ্গে কিছু একটা কথা বলছি। সে তার পরিষ্কার উত্তর দিচ্ছে। আমার হাত চেয়ারের হাতলে কিন্তু আমি সেই পাথরের মেঝের মসৃণ স্পর্শ পাচ্ছি—আমার সামনে খোকা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার নোংরা নখওলা পায়ের আঙুলগুলো দেখতে পাচ্ছি—ময়লা ধূতির একটা অংশ মাটি ছুঁয়ে আছে। এটা তো একটা সকাল! বোধ হয় ২০শে সেপ্টেম্বরের সকাল। ১৮ই সেপ্টেম্বর মির্চা চলে গেছে। খোকা আমায় বলছে, আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি—“রু তাড়াতাড়ি লিখে দাও ভাই”—তারপর একটা মুখভঙ্গী করে ফিস্ ফিস করে বলছে, “চারদিকে স্পাই ঘুরছে” এটা ও ঠাট্টা করে বলছে, ও খুব মজা করতে পারে, হাসাতে পারে।
খোকা আমাদের কেউ নয়। কিন্তু ভাইয়ের মতো। ওরা বড় দরিদ্র, ওর মাকে আমার ঠাকুমা মানুষ করেছেন। তারপর তার বিয়ে দেন। খোকার মাকে তাই আমরা পিসিমা বলি। পিসিমার আঠারটি সম্ভান, তাই ওদের দারিদ্র্য কোনোদিন গেল না। খোকা আর তার বোন শান্তি আমাদের আশ্রিত। যদিও তাদের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব, আমরা বন্ধু, খেলার সঙ্গী—তবু ওদের মর্যাদা নেই—আশ্রিতদের যেমন কপাল, দাক্ষিণ্য পেলেও মর্যাদা পায় না। এমন কি মির্চাও ওর উপর সন্তুষ্ট নয়। সেটা অবশ্য অন্য কারণে কারণ থোকা আমাকে হাসায়। ও সামান্য বিষয়কে এমন করে বলে, এমন মুখভঙ্গী করে যে হাসতে হাসতে আমরা হয়রান হয়ে যাই। মির্চা অর্ধেক কথা বুঝতে পারে না তাই গম্ভীর হয়ে যায়। একদিন লাইব্রেরী ঘরে একটা নতুন পর্দা টাঙ্গিয়েছি, নানা রকম পর্দা দিয়ে ঘর সাজানো আমার একটা শখ। খোকা লাইব্রেরীতে পর্দা সরিয়ে ঢুকছে, এমন একটা ভঙ্গী করে যেন পাথর সরাচ্ছে, যেন ঢুকতেই পারছে না! ওর ভাবভঙ্গী দেখে আমি যত হেসে গড়াই দেখি মির্চার মুখ ততই ভার হয়ে যায়।
“ও লোকটা ওরকম করছিল কেন?”
“ঠাট্টা করছিল। রোজ রোজ পর্দা বদলানো দেখে ও বলে আমার যখন সংসার হবে সেখানে প্রত্যেক দরজায় এতগুলো করে পর্দা ঝুলবে যে একটা সরালেই আর একটা, সেটা সরালেই আর একটা, এমনি করে করে ক্লান্ত হয়ে যাবে মানুষ, কেউ আর ঘরে ঢুকতেই পারবে না। কি রকম অবস্থাটা হবে তাই ও ভঙ্গী করে দেখাচ্ছিল। এতে হাসি পায় না? মুখ ভার কর কেন?”
“এর কি কোনো ভিতরের অর্থ আছে?”
“দেখো একবার, এর আবার ভিতরের অর্থ কি? শুধু মজা করা।” মির্চার এই স্বভাব, সব কিছুর ভিতরে অর্থ খোঁজে!
“তোমার ওকে কি এত ভালো লাগে! বাফুন, জোকার, সঙ”—আহা, কি অদৃষ্ট! আজ মির্চাকে সেই খোকার সাহায্য নিতে হচ্ছে। এখন ওই ওর একমাত্র বন্ধু। ও ছাড়া আর কেউ তাকে আমার খবর দেবে না। আমাকেই বা কে দেবে
“খোকা, ভাই থোকা”–
“রু, তাড়াতাড়ি লেখ ভাই, আমাকে এখানে দেখতে পেলে মামা ভীষণ রাগ করবেন। হয়তো আজই এখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন।”
আমি লেখবার চেষ্টা করছি—কি লিখব ভেবে পাচ্ছি না—মির্চা আমার বইটা চেয়েছে। খোকা বলেছে ওর কাছে তোমার একটা বই নেই, বইটা দাও, তাই আমি বইটাতেই লিখছি, কি লিখব ভয়ে কাপছে আমার ভিতরটা। মির্চা যদি সব সত্যি কথা বলে দেয়? ও জানে আমি সহজে মিথ্যা বলি না। ওকেও তো জানি মিথ্যা বলে না। কিন্তু আমি মিথ্যা বলেছি, ওকে বাচাবার জন্যই বলেছি। এখন বুঝতে পারছি মিথ্যা সব সময়ই খারাপ নয়। কি আশ্চর্য, এমন একটা কথা কি করে আমার মনে এল? মা তাই বুঝি বলেন, একটা অন্যায় আর একটাকে ডেকে আনে—মিথ্যার পিছনে মিথ্যা দৌড়ায়, সত্য আর তার নাগালই পায় না! ছি ছি, আমিও এত খারাপ হলাম। আমার গুরু কি বলবেন? আমি যে সূর্যের আলোতে মুখ তুলে আছি। আমি যে ভেবেছিলাম, শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ থাকব। হল না, হল না। আমি দেখতে পাচ্ছি বইয়ের পিছনের পাতা খুলে আমি লিখছি—আমার হাত কাপছে। অক্ষরগুলো কাপছে। লাইন বেঁকে গেল। যেন কোনো অন্ধকারের ভিতর থেকে আমার ষােল বছরের শরীরটা ফুটে উঠেছে। আমার চুল অবিন্যস্ত, তিন দিন আমি আঁচড়াই নি, এই তিন দিন শরবৎ ছাড়া আমি কিছু খাই নি। খার না। আমি মনে মনে বলছি, কোনো দিন খাব না, চুল কেটে ফেলব, পাড় ছিড়ে ফেলব তবে মার শিক্ষা হবে। দিদিমা এসে যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ওর কি হয়েছে? তখন তো মাকে বলতেই হবে। দিদিমা কি বলবেন? আমি জানি জানি জানি, তিনি মনে মনে বলবেন, এই মেয়ে স্বয়ংবরা হয়েছে, তার আর অন্য পতি হয় না। কিন্তু মুখে একটি কথাও বলতে পারবেন না। বাবার ভয়ে। একজন মানুষকে এত লোক ভয় করে।…মির্চাকে লিখলাম, সাবধান করে দিলাম। এর বেশি যেন না স্বীকার করে। বুঝবে তো? কী জানি। এর বেশি তো আমি লিখতে পারছি না, ইংরেজি কথাই আমার মনে পড়ছে না।
সেরগেই বললে, “মির্চা কিন্তু তোমার চেয়ে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে।”
আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি, আমার চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছে—সেরগেই বুঝতেও পারে নি, এতক্ষণ আমি এখানে ছিলাম না। আমি কি দেখছিলাম? কোথায় থোকা? সে তো এখন বৃদ্ধ জীর্ণ একটা মানুষ কালীঘাটে না কোথায় থাকে, কত বছর তার খবরই রাখি না। এখানে সেই পাথরের বারান্দা কি ভ্রাম্যমান কার্পেটে ভেসে এসে পৌছেছিল? কী আশ্চর্য! কী বিস্ময়! এর ঘোর কাটতে চায় না। সেই গানটা মনে পড়ছে ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে’-আলো ছাড়া দেখা যায় তাহলে? আলোর তরঙ্গ ছাড়া আরো কোনো তরঙ্গ আছে? আছে, নিশ্চয় আছে। আমার অলৌকিকে বিশ্বাস হচ্ছে যদিও আমি নাস্তিক কারণ এতক্ষণ বা একটি ক্ষণে একটি মুহূর্তে কিম্বা সময়ের অতীত কিছুতে যা ঘটল তা স্মৃতি নয়, মনে পড়া নয়, তা বাস্তব অনুভূতি। আমি ১৯৩০ সালের ২০শে সেপ্টেম্বরের সকালে উপস্থিত হয়েছিলাম আমার হাতের নিচে পাথরের ঠাণ্ডা লেগেছিল, অবিশ্রাম কান্নায় আমার চোখ ভারি ছিল, তিনদিনের অনাহারে আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, forehead. লিখতে গিয়ে একটু ইতস্তত করেছিলাম বানান নিয়ে, আমার সন্দেহ হচ্ছিল ‘e’ টা লাগবে কিনা। অতীতকালের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে রূপ দেবার ভাষা আমার নেই। ১৯৭২ সাল ১৯৩০ সালে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। আমি সেরগেই-র সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছি কিন্তু আমার ভিতরটা কাপছে। ঝড়ের মুখে একটা ছোট্ট বিপন্ন পাতার মতো কাপছে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এই এখানে আছি, এখুনি এখানে নাও থাকতে পারি। আমার মনে হচ্ছে আবার এমনি হবে—আবার আমি কালের মধ্যে পিছনে ফিরে যাব। কি করে সম্ভব হচ্ছে এটা? যদিও আমি বুঝতে পারি কালের কোনো উদয় অস্ত নেই, উদয় অস্ত আমারই—কিন্তু আমার এই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে খণ্ডিত জগৎটাকে আমি চিনি, জানি, তার বাইরে পা দিতে আমার সাহস কোথায়? সেই অজ্ঞাত জগতে পা দিতে আমি ভয় পাই। আজকের যে অভিজ্ঞতাটা হল এটা ভয়ানক, এটা কষ্টকর, বিপর্যয়কারী। আমার সমস্ত ধারণা, আত্মবিশ্বাস গোলমাল করে দিচ্ছে। কে আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবে? আমি সেই ১৯৩০ সালের মতোই আবার আমার গুরুকে ডাকতে লাগলাম,—প্রভু আমায় পরিত্যাগ করো না।’ ‘নাথ হে ফিরে এস—আমার সব সুখদুখমন্থন ধন অন্তরে ফিরে এস’–আমি আর কিছু চাই না, কাউকে চাই না, আমার জীবনে আর কিছু নেই, আর কিছু ছিল না, আমার সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ জুড়ে তোমার গানে গানে এক জ্যোতিবিকীর্ণ মহোৎসব—আমার কোনো অভাব নেই দৈন্য নেই। আজ কি হঠাৎ কোথাকার অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি দুটো কথা বলে সব চুরমার করে দেবে! এতদিন পরে কি ধ্রুবতারকার জ্যোতি নিভে যাবে? আমি পথভ্রষ্ট হব?
আমাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে সেরগেই আবার আমার করপল্লব চুম্বন করল আমার পায়ের তলা থেকে একটা তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভূতি উঠে এল। আমি বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে নিলাম। এটা গোলপার্ক—১৯৭২ সাল; ১৯৩০ সালে এ জায়গাটা জঙ্গল ভরা ছিল। আমি গাড়িতে উঠে দরজাটা শক্ত করে ধরে বলতে লাগলাম—“এটা একটা ট্যাকসি, শেভরলে নয়।”
আমাদের প্রথম গাড়িটা ছিল শেভরলে, হুড খোলা, উঁচু। এখনকার রুচিতে সুন্দর নয়, কিন্তু আমাদের তখন কি সুন্দরই লাগত। গাড়ি থেকে নামবার সময় মির্চা সব সময় হাত বাড়িয়ে দেবে।
“কেন এইটুকু নামতে সাহায্য লাগে নাকি?”
“আমাদের দেশের এই নিয়ম, মেয়েদের গাড়ি থেকে হাত ধরে নামাতে হয়। আর অভ্যর্থনা ও বিদায় অভিনন্দন জানাতে করপল্লব চুম্বন করতে হয়।”
“নিয়ম?”
“হ্যাঁ নিয়ম। না করলে লোকে তাকে বর্বর বলবে। তোমাদের এরকম কোনো নিয়ম নেই?”
“না। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। সমবয়সীদের নমস্কার করা আছে। তা বড় একটা কেউ করে না। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসব আদবকায়দা শুরু হয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুর শেখাচ্ছেন ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের। ওরা সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে। ছাত্ররা পরস্পরকে নমস্কার করে। দেশের অন্যত্র সবাই এতে হাসে!”
“ঐ একজন লোকই কি তোমাদের সব কিছু করবেন?”
“হ্যাঁ তাই, তাঁ তাই, ঐ একজন লোকই আমাদের আকাশ জুড়ে আছেন, আমাদের মুখে কথা দিচ্ছেন, আমাদের মনে ভালোবাসা দিচ্ছেন, সে আছে বলে আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে, প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে।”
মির্চা স্তম্ভিতবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে আছে-“এ আবার কি, একজন মানুষ সম্বন্ধে এরকম করে বলছ! আমি তোমায় বুঝতে পারি না।”
“বয়ে গেল?”
বাড়ি এসে পৌঁছেছি। আমার পুত্রবধূ লেখা আমায় বললে, “হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন? আজ‘খ’ বাবুর আসবার কথা ছিল না? কাজের জন্য একজন লোক নিয়ে?”
এই কন্যাটিকে আমি ভয় করি। প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়ে আর সর্বদা আমার কাছে থাকে, কী যে বুঝে নেবে কে জানে! আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।…আমি খুব হাসি হাসি মুখে খবাবুর বক্তব্যগুলো শুনলাম। কিন্তু কোনো কথা আমার কানে ঢুকছে না—আমার চোখে জল আসছে, বুকের ভিতরটা কাপছে। এরকম হলে তো চলবে না। এ আবার কি এতদিন পরে? আমি হাসছি, একটু অসঙ্গত রকমই হাসছি। বিকালে আমার জন্মোৎসব সে সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করছি কিন্তু আমার কোনো কৌতূহল নেই, কিছু জানতে চাই না। আমি বুঝতে পারছি না এত অল্প সময়ে জগৎটা বদলে গেল কি করে! এত কষ্ট কেন?…আমার বন্ধুরা আমার জন্মোৎসব করবে এতে আমার গর্ব নেই—ওরা আমাকে আদর করে কি করবে? আমায় কি শান্তি দিতে পারবে? আমি বুঝতে পারছি সেরগেই এসে আমার শান্ত স্রোতহীন স্থির জীবনের মাঝখানে একটি লোষ্ট্রপাত করে যে তরঙ্গবলয় সৃষ্টি করেছে এ আমাকে সহজে ছাড়বে না, থামবে না এর আবর্ত। শান্তির আশা এখন বহুদূর। আমি চোখ বুজে চেয়ারে পড়ে আছি। কি চাই আমি? কিছু না, কর্ম, সমাজসেবা, দেশের উন্নতি জাহান্নামে যাক্, কিছু চাই না—নিয়ে চল সেই ১৯৩০ সালে আর একবার ওকে দেখব। মির্চা, মির্চা, মির্চা!
হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, লেখা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—“মা আপনার কি চোখে আবার কষ্ট হচ্ছে? জল ভরে আছে কেন? ওষুধ দেব?”
“হ্যাঁ দাও।”
জন্মদিনের বিপজ্জনক সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। নিজের কৃতিত্বে আমি খুশি। আমি নুতন শাড়ি পরেছি, ফুলের মালা পরেছি, কবিতা আবৃত্তি করেছি, গান শুনেছি, কেউ কিন্তু বুঝতে পারে নি আমার ভিতরটা সর্বক্ষণ কিরকম থরথর করে কাপছে! এ কথাটা উপমা দিয়ে বলা নয়—সেই কম্পন যদি শরীরে দেখা যেত লোকে মনে করত আমার পারকিনসন্স রোগ হয়েছে।
রাত্রি দুটোয় বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি—এখন ভোর হয়ে এল। তারাগুলো একদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেছে। এ বাড়িতে ছাতে ওঠা যায় না, এই এক বিপদ। ভালো করে আকাশ দেখতে পাই না। আমি চিরদিন আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে ভালোবাসি। মির্চাও ছাতে বেড়াতে খুব ভালোবাসত। প্রথম দিন ছাত দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
“জানো আমাদের দেশে ছাতে ওঠা যায় না?”
“সে আবার কি! তোমরা সূর্য তারা দেখ কি করে!”
“সূর্য তারা দেখে অ্যানমাররা, সাধারণ লোকে সে কথা ভাবেই না।”
“আমাদের দেশে লোকে সকালে প্রথমেই সূর্য প্রণাম করে।”
“তুমি কর?”
“আমার সূর্য ভিতরেও আছে বাইরেও আছে। আমি সব সময়ই প্রণত। সকাল-বিকাল নেই।”
“তার মানে? বলল, বলল, হাসছ কেন, বলতেই হবে।”
“না বলব না। তুমি বুঝবে না।”
“তুমি আমায় অপমান করছ—বুঝতেই পারব না?”
“বলতেই হবে ভিতরের সূর্য কে।”
“আমার গুরু। তিনিই আমায় এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখাচ্ছেন।”
“তিনি কি শুধু নিজেকেই দেখান, না আরো কিছু দেখান?”
“সমস্তই দেখি তারই আলোকে।”
“যেমন?”
“যেমন এই তোমাকে দেখছি।”
ও সেদিন খুশি হয়েছিল–“আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে হুইটম্যান পড়বে?”
“দুর অত নীরস লেখা বুঝতেই পারি না। তার চেয়ে শেলী পড়ব—সেসেটিভ প্ল্যান্ট।”
যাই গিয়ে শুয়ে পড়ি। কাল কত কাজ আছে—বিকালে মিটিং আছে। বিয়াল্লিশ বছর আগেকার কথা মনে করে লাভ কি! কোথায় বা সে মির্চা, আর সে কোন অমৃতা, দেখলে হয়তো চিনতেই পারব না কেউ কাউকে!
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই আমার বর্তমানে স্থির থাকতে পারছি না। বারে বারে কখনো দিনে কখনো রাতে আমি ফিরে ফিরে চলে যাচ্ছি ভবানীপুরের বাড়িতে, ১৯৩০ সালে।
আমার মনে পড়ে না সেটা কোন মাস যে-দিন মির্চা ইউক্লিড প্রথম আমাদের বাড়ি এল, অর্থাৎ আমি প্রথম লক্ষ্য করলাম তাকে। আমার বাবা পণ্ডিত ব্যক্তি, মাত্র ছয় বছর আগে তিনি পূর্ববঙ্গের একটা মফঃস্বল কলেজে অধ্যাপনা করতেন, তারপর কলকাতায় এসেছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কলকাতা শহরে বিদ্বৎসমাজে সম্মানের উচ্চচূড়ায় পৌঁছে গেছেন। সবাই তাকে চেনে। তিনি পণ্ডিত এবং অসাধারণ পণ্ডিত। সেজন্য। অনেকেই তাকে ভয় করে, ঐ পাণ্ডিত্যের একটা আক্রমণকারী রূপ আছে। যে কোনো ব্যক্তিকে অল্প সময়ের মধ্যে বিতর্কে হারিয়ে তাকে মূর্থ প্রতিপন্ন করে দিতে পারেন এবং এ খেলায় তিনি বেশ আনন্দ পান। কিন্তু এ সত্ত্বেও তার আকর্ষণী শক্তি অদ্ভুত। তিনি যাদের অপমানিত করেন তারাও তাঁর কাছ থেকে পালায় না। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তার জন্য অনেক ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তিনিও তাদের ভালোবাসেন কিন্তু সে ভালোবাসা আমাদের সাধারণ মানুষের ভালোবাসার মতো নয়। তাতে অপর পক্ষের প্রতি সমবেদনা নেই। ভালোবাসাটা তার নিজের জন্যই, যেমন আমাকে ভালোবাসেন, খুবই ভালোবাসেন, সেটা আমার জন্য যত না তত নিজের জন্য—এই দ্যাখো আমার কন্যাটি কী অমূল্য রত্ন, দেখতে কী সুন্দরী, কী চমৎকার কবিতা লেখে, কী সুন্দর ইংরেজী বলে—এ তো আমার মেয়ে, দ্যাখো দ্যাখো তোমরা! আমাকে নিয়ে মেতে আছেন বাবা। কিন্তু জানি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটু নড়লে আমাকে চূর্ণ করে দিতে তাঁর বাধবে না। আমি কিসে সুখী হব সেটা তার কাছে অবান্তর।
আমার মা একেবারে বিপরীত। আমার মা, পরমাসুন্দরী। ঐ সময়ে তার সৌন্দর্য অলৌকিক, স্বর্গীয়। তাতে বাবা খুব গর্বিত কিন্তু মার কোনো খেয়ালই নেই—মা কোনোদিন প্রসাধনে যত্ন করেন না, নিজের কোনো সুখস্বাচ্ছন্দ্য, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই বললেই হয়। বাবাকে সুখী করাই তার একমাত্র কাজ। সেই কাজে বাবা তাকে যথেষ্ট ব্যাপৃত রাখেন—বিশেষ করে সামান্য একটু অসুখ করলে হৈ চৈ করে এমন অবস্থা করে তোলেন যে মার মনে সর্বদা ভয় এই বুঝি তার স্বামীর ভয়ানক একটা কিছু হল। মা বৈষ্ণবসাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, দুটো লাইন তিনি প্রায়ই বলেন—
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে কহি কাম
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।
শুধু যে স্বামীকে প্রীত করবার ইচ্ছা তা নয়। চার পাশের প্রত্যেকটি লোকের জন্য মায়া-মমতার সুধাপাত্র মার হাতে ভরাই আছে।
সে সময়ে আমাদের বাড়িতে সর্বদা বিদেশীরা যাতায়াত করতেন। নানা বিষয়ে আলোচনা হতো, যারা আসতেন তাদের মধ্যে বিদূষী স্টেলা ক্ৰামরিশ ও অধ্যাপক তুচির কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, ফর্মিকিও বোধ হয় এসেছিলেন। অধ্যাপক তুচি পরে ভালো বাংলা শিখেছিলেন—তাকে দেখতে ছাত্রের মতো ছিল—কচি মুখের উপর অবাধ্য চুলগুলো কপালে এসে পড়ত বার বার। তার স্ত্রী বেশ চৌকো চৌকো চেহারা, গলায় মুক্তার মালা। তাঁদের আসা-যাওয়ার জন্য বাড়ির চেহারা ক্রমে বদলে যাচ্ছিল। বাঙ্গালীয়ানার উপর সাহেবিয়ানার ছোঁয়াচ লাগছিল। বছরখানেক আগে আমার ঠাকুমা মারা গিয়েছিলেন তাই এই উন্নতি সম্ভব হয়েছিল, নইলে হতো না। বেশ মনে আছে ১৯২৪ সালে প্রথম যেদিন খাবার ঘরে বিরাট মেহগনি টেবিল এল, ঠাকুমা অনেকক্ষণ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন, তার হাতের সোনার জপের মালা থেমে গিয়েছিল—“কী, এর উপর খাওয়া হবে কেন? শুলে কি দোষ হয়? এটা তো একটা খাট-ই!” তারপর যখন দেখলেন কোনো উপায়। নেই, কথা টিকবে না, তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই। তিনি পারতপক্ষে ও-ঘরের কাছেও যেতেন না। আর যেদিন কাটাচামচ দেখলেন, সেদিনের কথা ভুলব না, ভূকুটি করে মাকে বললেন, ‘ভাত খাওয়ার জন্য অতগুলো যন্তর লাগবে।’ প্রতিশোধস্পৃহা এতদূর বেড়ে গিয়েছিল যে প্রায়ই আশা প্রকাশ করতেন যে ঐ কাটা দিয়ে ‘জেহ্বাটা’ এ-ফোঁড় ও-ফোড় হলে তবে শিক্ষা হয়! ঠাকুমার সংস্কারগুলো যে কত অনড় আর তার পক্ষে কত সত্য তা তিনি তার মৃত্যুশয্যায় দেখিয়ে গিয়েছেন। কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে তিনদিন ভুগে তিনি মারা যান। প্রথম দুদিন মা সমস্ত সেবাটা করলেন, কাকা তাকে সাহায্য করলেন। মা তখন গর্ভবতী ছিলেন—ডাক্তার খুব রাগ করতে লাগলেন, শেষপর্যন্ত বাবাকেও বকাবকি শুরু করলেন, অবশেষে মাকে সরে যেতে হলনার্স এল, ক্রিশ্চান নার্স। তাকে শিখিয়ে দেওয়া হল ঠাকুমা জাত জিজ্ঞাসা করলে বলবে ‘ব্রাহ্মণ’—।
রুগী অধচৈতন্য চোখ ঈষৎ উন্মীলিত করে বললেন, ‘জল’নার্স জল নিয়ে এগিয়ে এল—“এই যে জল খান, মুখ খুলুন”—মুমূর্ষ নারী মুখ খুললেন না, চোখ খুললেন, তার মৃত্যুআচ্ছন্ন কানে গলার স্বরটা অপরিচিত ঠেকেছে, “তুমি কে মা?”
“আমি নার্স।”
“আচ্ছা থাক একটু পরে জল খাব।” কলেরা রোগাক্রান্ত রুগীর মুহুর্মুহু তৃষ্ণা। তিনি আবার বললেন–“জল”…
“এই তো জল এনেছি খান”, ফিডিং কাপটা এগিয়ে ধরেছেন নার্স—
“আমার বৌমাকে ডেকে দাও”—
“তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমার কাছেই জল খান না।”
“তুমি কি জাত?”
“ব্রাহ্মণ।”
“সধবা না বিধবা—”
“বিধবা”—এবারে মৃত্যুপথযাত্রিনী ভালো করে তাকালেন, ইনি সব –র কি রোগ, রোগের গতি কি, এখন কি অবস্থা কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয় কারণ তিনি কবিরাজ বাড়ির বধূ—চিকিৎসকদের সঙ্গেই জীবনের অনেক দিন কেটেছে। “দ্যাখো নার্স আমার পেট ফেঁপেছে, কলেরা রুগীর পেট ফাপলে আর বাচে না—”মুমূর্ষ রুগীর এখন টন্টনে জ্ঞান ফিরে এসেছে। কোমার ব্যাপারই ঐ, মাঝে মাঝে রুগী সজাগ হয়ে যায়। “ও নার্স তুমি খেয়েছ ত? কি দিয়ে ভাত খেলে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো মাছের ঝোল ভাত খেয়ে এসেছি।”
আর বলতে হবে না, যা সন্দেহ হয়েছিল তার নিরসন হল, “দ্যাখো নার্স, তুমি ব্রাহ্মণের বিধবা, মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছ, মৃত্যুকালে তুমি আর আমার মুখে জল দিও না মা, আমার বৌমাকে ডেকে দাও।”
বৌমাও ছুটে এলেন, “সারাজীবন ওর সেবা করলাম। আর এখন এই শেষ সময়ে মনোকষ্ট দেওয়া—আমার যা হয় হবে।”
ঠাকুমা চলে যাবার পর এ বাড়ির চেহারা বদলে গেল ভিতরে ও বাইরে। ব্ৰত পূজা, কালীঘাট, পুরোহিত, ছুঁৎমার্গ, এটো প্রভৃতি বিরাট বিরাট সমস্যা যা সারাদিন মাকে হয়রান করত, সব যেন এক ছুঁয়ে উড়ে গেল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জালের তূপ সরিয়ে আমরা নূতন দিগন্তের দিকে মুখ ফেরালাম।
আমার এ পরিবর্তন খুব ভালো লাগছিল। আমি শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে যতই এগোচ্ছি ততই ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মফঃস্বলের বাড়িঘরের চেয়ে এঁদের বাড়িঘর আচার-আচরণ কত না পৃথক! তখন একটা কথা শুনতাম ‘এলিট’ এখন যেমন শুনি বুর্জোয়া’। বুর্জোয়া’ কথাটার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে, কেমন যেন ঝগড়ার আভাস পাওয়া যায়, এলিট’ তা নয়। আরো একটা কথা শুনতাম ‘ক্রিম অফ ক্যালকাটা’, এখন তো দুধে সরে মিশে একাকার। এই উচ্চ সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার তের বছর বয়স থেকে বাবা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতেন, আমি যাতে তাকে আমার কবিতা দেখিয়ে নিই সেজন্য। আমি কোনোরকমে সেই কাজটা সংক্ষেপে সেরে তার কবিতা তাকে আবৃত্তি করে শোনাতাম, আমি খুব ছেলেবেলা থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসি। আমার মুখে নিজের কবিতা শুনতে রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য তিনি বলতেন, “তুমি আমার চেয়েও আমার কবিতা ভালো পড়”—জানি এ কথা আমাকে খুশি করবার জন্যই তবু আমার মন পূর্ণ হয়ে যেত কানায় কানায়, আমি ভাবতাম, এর কাছ থেকে আমি কত পাই, এখানে একবার এলে এর অস্তিত্বের আস্বাদই কি মধুর—কিন্তু আমার তো ওকে দেবার কিছুই নেই। এই একটি জিনিসই দিতে পারি। তাই যদিও সেই বিরাট প্রতিভার সামনে আমার সঙ্কোচ ও লজ্জার অন্ত ছিল না, অনেক সময় মুখ তুলে কথাও বলতে পারতাম না, কিন্তু কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে আমার লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ কেটে যেত। মনে আছে একবার ‘সোনার তরী’, ‘কৌতুকময়ী’, ‘জীবন দেবতা, ‘হৃদয় যমুনা’ আবৃত্তি করছি পর পর-উনি মৃদু মৃদু হাসছেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—“এসব কবিতা তুমি বুঝতে পার?”
আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘাড় নাড়লাম ‘হা’—তারপর সোনার তরীর নিহিতার্থ, জীবন দেবতার দর্শন, বাবার কাছে যেমন যেমন শুনেছিলাম গড় গড় করে বলতে শুরু করলাম—উনি আমায় মধ্যপথে থামিয়ে দিলেন। আমার কচি মুখে উচ্চ দর্শনশাস্ত্র কি রকম শোনাচ্ছিল এখন বুঝতে পারি। উনি বললেন, “থাক থাক, তুমি শুধু পড়–যখন সময় হবে, অর্থ আপনি বুঝতে পারবে। পাখি যে গান গায় তারও কোনো অর্থ আছে বিশ্ব ব্যাপারে, সে কিন্তু সেটা জানে না। তাতে ক্ষতি নেই, তেমনি মনের আনন্দে তুমি পড়, অন্যের ব্যাখ্যা তোমার কোনো কাজে লাগবে না।”
এ সময় একজন রুশ পণ্ডিত প্রায়ই আসতেন, তার নাম আমার মনে পড়ে না, হয়তো তিনিই বগদানভ—শান্তিনিকেতনে যেসব বিদেশী পণ্ডিতব্যক্তি আসতেন যাবার আসবার পথে তারা একবার আসতেনই আমাদের বাড়িতে। শাস্ত্র-আলোচনায় আমি সাহসের সঙ্গে যোগ দিতাম। তত্ত্বচিন্তার একটা আবহাওয়া, সেটা আমার মত অল্পবয়সীদের কাছে একটা কুয়াশা ছাড়া কিছু নয়—কিন্তু সেই প্রহেলিকাময় নীহারিকা আমার ভালো লাগত। সেই নীহারিকা ভেদ করে সূর্যের আলো অবশ্যই আমাকে উত্তপ্ত ও সজাগ করে রাখত। এক দিকে ব্যক্তিমানুষের জীবন্ত অনুভবের সত্য শিল্পের বেদনায় ঝঙ্কৃত, অন্য দিকে এক নিরন্তর অনন্ত জিজ্ঞাসার প্রহেলিকা আমার সেই উন্মুখ সতেজ নবীন মনের উপর আলোছায়ার খেলা করছিল। আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের পরিবারের থেকে আমাদের বাড়িটা ছিল স্বতন্ত্র—আর আমার সমবয়সীদের কাছে, বিশেষত স্কুলের সহপাঠীদের কাছে আমি ছিলাম দুর্বোধ্য। তারা আমায় ক্ষেপাতো আমি অন্যমনস্ক বলে। অন্যমনস্ক, অর্থাৎ যখন যেটাতে মন দেবার কথা সেটা ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতাম।
আমাদের সময়ে ছেলেমেয়েদের মেশামেশি কম ছিল তবু আমরা পর্দানশীন ছিলাম না। আমার মা, বাবার সহকর্মীদের সামনে সব সময় না বেরুলেও ছাত্রদের সামনে বেরুতেন—আমি তো সকলের সামনেই বেরুতাম। মফঃস্বলে থাকতে মাকে দেখেছি চিকের আড়ালে বসে বসবার ঘরের সাহিত্য-আলোচনা শুনতেন ও আড়াল থেকে জলখাবার পান শরবৎ পাঠিয়ে দিতেন। কলকাতায় এসে সে আড়াল উঠে গেল। আমরা সর্বত্র যেতাম। সাহিত্যসভায় কবিতা আবৃত্তি করতাম, যেখানে একটি মেয়ে নেই। এতটা তখনকার দিনে খুব কম মেয়েই করেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও আমাদের মুখের উপর একটা অদৃশ্য ঘোমটা থাকত। আমরা সহজে কারুর সঙ্গে কথা বলতাম না। হয়তো বাবার কোনো ছাত্র তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাদের সঙ্গে এগিয়ে এল, আমি মাথা নীচু করে হাঁটতাম, তার সঙ্গে কথা বলতাম না। সত্য কথা বলতে কি আমরা পর্দাবিহীন পর্দানশীন ছিলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করত না তা নয়, খুবই করত, আমি জানতাম অপর পক্ষেরও তাই। তবে কথা বলতে বাধা কি? কেউ তো আর আমাদের বারণ করেনি। কিন্তু আমরা পারতাম না। আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য পুরুষ মানুষদের সামনে, বিশেষতঃ যুবকদের সামনে আমরা একেবারে পাথর হয়ে যেতাম। তারাও তাই। যেন কেউ কাউকে দেখতেই পাচ্ছি না। কত যুগযুগের সঞ্চিত নিষেধের প্রভাব আমাদের রক্তস্রোতে বইছে, একে পার হওয়া দুষ্কর, কিন্তু আজকের দিনে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে এই নিষেধটা কেন, এর ভিতরের কারণটা কি সে সম্বন্ধে আমরা, অন্তত আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। এই সব শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে যৌন ব্যাপার সম্বন্ধে কোনো আলোচনা হতো না। আভাসে ইঙ্গিতে, একটা ঢাকনা পরা লুকানো জগৎ আছে, সেটা অবশ্যই আমরা বুঝতাম কিন্তু সেখানকার ব্যাপারটা কি তা জানা ছিল না। আমাদের বেছে বেছে উপন্যাস পড়তে দেওয়া হতো। বিশেষ বিশেষ কতগুলি বিখ্যাত বই একেবারে নিষিদ্ধ, তার মধ্যে কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘চোখের বালি’ ও ‘চরিত্রহীন’। নৌকাডুবি’ পড়বার অনুমতি ছিল। নৌকাডুবি’র মলাটটা খুলে নিয়ে চোখের বালি’তে লাগিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম। অবশ্য কেন বইটা এত নিষিদ্ধ তা বুঝতে পারিনি।
যদিও বাবার বাঙালী ছাত্রদের সঙ্গে বেশি কথা বলার সাহস হতো না কিন্তু বিদেশী ছাত্রদের সম্বন্ধে অন্তরে এ বাধা অনুভব করতাম না। বাবাও অনায়াসে ইয়োরোপীয়দের সঙ্গে মিশতে দিতেন। এই সময়ে এক রুশ-দম্পতি কলকাতায় এসেছিল। তারা গ্লোবে নানারকম জাদুবিদ্যা দেখাচ্ছিল। তাদের নিয়ে শহরে খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বাবা বললেন, “চল, বুজরুকিটা দেখে আসি”—গ্লোব থিয়েটারে স্টেজের উপর চোখে কালো রুমাল বেঁধে আভূমিলুণ্টিত কালো গাউন পরে একটি সুন্দর মহিলা এসে দাঁড়াতেন, আর তার স্বামী দশকদের ভিড়ের মধ্যে নেমে আসতেন। ভদ্রমহিলা দর্শকদের বলতেন প্রশ্ন করতে। দর্শকদের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে উঠে কেউ প্রশ্ন করলে তার সুবেশ তরুণ স্বামী সেই ব্যক্তির নাড়ি ধরতেন, তখন মহিলাটি স্টেজের উপর থেকে তাঁর অনুচ্চারিত প্রশ্ন এবং উত্তর গড়গড় করে বলে যেতেন। প্রশ্নগুলো কখনো ঠকাবার জন্য করা হতো, কখনো বা কোনো মর্মান্তিক গোপন খবর জানবার জন্য। যেমন, একজন উঠে দাঁড়াতেই চোখবাধা মহিলাটি বললেন, তুমি জানতে চাও তোমার পকেটে যে দেশলাইয়ের বাক্সটা আছে তাতে ক’টা কাঠি আছে? বাহান্নটা!’ কিংবা ‘তুমি জানতে চাও তোমার স্ত্রী তোমার প্রতি অবিশ্বাসিনী কি না? তিনি তো ঠিকই আছেন, তুমিই অবিশ্বাসী এই না শুনে সারা হলসুদ্ধ লোকের উচ্চ হাসিতে ভদ্রলোক অপ্রস্তুত। বাবা বললেন, “এই মেয়েটা তো জাহবাজ, একে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।”
আজকাল, অর্থাৎ এই উনিশ শ শতকের শেষের দিকে এদেশে যে রকম অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতের দিকে ঝোক হয়েছে উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সমাজেও, আমাদের সময় যতদূর মনে পড়ে এটা কম ছিল। এখন ঘরে ঘরে ছবি থেকে ভস্ম পড়ে, অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসপত্রর আবির্ভূত হয়, এসব গল্প বিদ্বান বৈজ্ঞানিকেরাও সহজে বলেন, তখন তা হতো না। শিক্ষিত লোকেরা কোনো আজগুবি অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশ্বাস করতে ইতস্তত করতেন, অন্তত মনে মনে যাই হোক মুখে তা স্বীকার করতেন না। আমার বাবাও যে একেবারে কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন তা নয়, কিন্তু তার প্রকাশ্য মন তা স্বীকার করত না। অতএব পরীক্ষা করবার জন্য ঐ রুশ-দম্পতিকে নিমন্ত্রণ করা হল। বাবার ধারণা দর্শকদের মধ্যে ওদেরই লোক ছিল। আমি বললুম, “তাহলে তুমি কিছু জিজ্ঞাসা করলে না কেন?”
“বাবারে, যা জাহবাজ মাইয়া, কি জানি কি কইয়া দিব!”
আমাদের বাড়িতে চায়ের বৈঠকে বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি এলেন, অধ্যাপক, লেখক ইত্যাদি, চায়ের সঙ্গে এই মজার খেলা চলতে লাগল। ভদ্রলোক নাড়ি টিপে ধরেন, ভদ্রমহিলা তার মনের কথা বলে দেন। অবশেষে আমার পালা এল, আমি ভাবলাম একটু ফঁাকি দেবার চেষ্টা করা যাক, বাংলা কথা কি করে বলবে? মনে মনে বললাম, “আমার শেষ কবিতাটার নাম কি?” ভদ্রমহিলা ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে বললেন, “ভোগপাত্র”—উচ্চারণবিকৃতি ছিল কিন্তু বলেছিলেন ঠিকই। একজন তরুণ অধ্যাপক বললেন, “থট্রিডিং ছাড়া আর কিছু নয়।”
বাবা বললেন, “বেশ, তাতেই সব ব্যাখ্যা হয়ে গেল নাকি?”
এই রুশ-দম্পতিকে নিয়ে আমরা একদিন এম্পায়ার থিয়েটারে ইটালীয়ান অপেরা দেখতে গেলাম। বাবা, মা, আমি ও ওরা দুইজন। সেই সময়ে এদেশে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতে কান অভ্যস্ত ছিল না—সাধারণত তা শেয়াল কুকুরের চীৎকার বলেই অভিহিত হতো। এখন ট্রানজিস্টারের কল্যাণে বস্তির রোয়াকেও জাজ সঙ্গীত তো বাজছেই, বীঠোভেনও বাজছে। তখন এটা কল্পনাতীত ছিল। দু-তিন পুরুষ ধরে যারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় তামিল পেয়েছেন, যাদের বলা হতো ইঙ্গবঙ্গ সমাজের লোক, তাঁদেরই বাড়িতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের চর্চা হতো, মেয়েরা টুং-টাং পিয়ানো বাজাতেন—অতিথি অভ্যাগত, বিবাহোপযোগী পাত্র এলে ড্রয়িংরুমে পিয়ানো বাজিয়ে বৃষ্টির পরিচয় দিতেন, কিন্তু সেটা একেবারে শিশুসুলভ ব্যাপার ছিল। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ইটালীয়ান অপেরা আমার কাছে খুব একটা উপভোগ্য হচ্ছিল না। কিন্তু জানি সে কথা কাউকে বলব না, কারণ এই তো সবে এসব জায়গায় আসছি। এতে বড় হয়ে ওঠার গৌরবটা অনুভব হচ্ছে। তাছাড়া নিজেকে বেশ বোদ্ধা প্রমাণ করতেই চাই, অজ্ঞ বলে নয়। যাই হোক, অন্যমনস্কভাবে অপেরা দেখছি যেন ওষুধ খাচ্ছি। হঠাৎ ঐ রুশ ভদ্রলোক, তখন তাকে অ-ভদ্রলোকই বলব, দক্ষিণ হাতটি বাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন। আমি তো আঁতকে উঠলাম। যদিও এসব বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা যথেষ্ট ছিল তবু স্বাভাবিকভাবে আমরা ঠিক মতোই ব্যবহার করতাম। আমি এক ঝাকানি দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিলাম, আবার যেন স্প্রিং-দেওয়া কলের মতো সে ব্যক্তি সেটি ফিরিয়ে আনল। ভাবলুম কি করা যায় এখানে তো চেঁচামেচি করা যাবে না। নিচু হয়ে পায়ের নাগরাটা খুলে আস্তে আস্তে ওর হাঁটুর উপর রাখলাম, এবার সেও আঁতক উঠল, আমি খুব ধীরে ধীরে বললাম, “তোমাকে জুতো মারব।” তখন স্পিংটা অন্যদিকে কাজ করল, সে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল। বাড়ি ফিরে এই গল্পটা বলাতে, মা বাবার উপর ভারি রেগে গেলেন, যাকে তাকে এতটা বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাবা খুব হাসছেন। পাশ্চাত্য জগৎটা তিনি চিনতেন ভালোই, তাই একটুও আশ্চর্য হন নি। মাকে বলতে লাগলেন, “অমৃতাকে নানা অবস্থায় নানা লোকের সঙ্গে মিশতে শিখতে হবে, ও তো তোমার মতো ঘরে বসে থাকবে না। যদি একটু চেষ্টা করে ও একদিন সরোজিনী নাইডু হবে।”
যাই হোক এই কাণ্ডের পরও যে কাজটা তখন মার এবং আমার কাছে ভয়ানক খারাপ এবং অক্ষমনীয় মনে হয়েছিল এবং আমরা দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, বাবা ওদের সঙ্গে কিছু খারাপ ব্যবহার করলেন না। এমন কি রবিঠাকুরের কাছে নিয়ে যাবার যে কথাটা ছিল সেটাও স্থির রাখলেন। আমি তার কাছে এদের জাদুবিদ্যার গল্প করেছিলাম। উনিও এদের দেখবার জন্য ব্যগ্র হয়েছিলেন। অলৌকিক অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস
থাকলেও রবিঠাকুর মনে করতেন সব বিষয়েই পরীক্ষা করে দেখবার চেষ্টা করা উচিত। সেটাই বৈজ্ঞানিক। অনুসন্ধান করব না কেন? তাই একটা দিন ঠিক হয়েছিল রুশ-দম্পতিকে নিয়ে যাবার জন্য।
“বাবা, আমি ওদের সঙ্গে যাব না, লোকটা ভারি বিশ্রী—”
“তা কি হয় মা—সব ঠিক হয়ে আছে এখন তুমি না গেলে কবি কি ভাববেন? তাছাড়া জীবনে কত রকম অবস্থায় কত রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, নিজের শক্তিতে বুদ্ধিতে সব সময়ই তুমি ঠিক পথে স্থির থাকবে, এ তো আমি জানিই। জগতে খারাপ লোক আছে বলে কি তুমি গর্তে ঢুকে থাকবে?”
দুপুরবেলা বাবা ও আমি রুশ-দম্পতিকে নিয়ে কবির কাছে গেলাম—ওদের দোতলার পাথরের ঘরে বসিয়ে আমি তিন তলায় ওকে খবর দিতে গেলাম। পাথরের সেই ঘরটা চোখের সামনে ভাসে—নিচু নিচু চৌকিতে গদীগুলি জাপানী মাদুর দিয়ে মোড়া আর কুশনগুলিও জাপানী মাদুরের। ঐ ঘরের পরে বহু পরিবর্তন দেখেছি—ঐ ঘরেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পড়েছে। উপরে গিয়ে দেখি তিনি তৈরী হয়েই আছেন, একটা কাগজে কয়েকটা প্রশ্ন লিখে নিয়ে কাগজটা বইয়ের মধ্যে পুরে উঠে দাঁড়ালেন, “চল জাদুকরীকে দেখা যাক।” ঘোরান সিড়ি দিয়ে আমরা নেমে এলাম। ওরা অপেক্ষা করছিল, দু-চার কথার পর মেয়েটি চোখে কাপড় বাধল, তার স্বামী এসে ওর নাড়ি ধরল। মেয়েটি কিছু বলতে পারল না কিন্তু সে যে চেষ্টা করছে বোঝা গেল। কবি তো ওদের অপ্রস্তুত করতে চান না, ব্যাপারটা বুঝতে চান, তিনি বলতে লাগলেন—“কি করলে সুবিধা হবে—আমি যদি কাগজে লিখি সুবিধা হবে?” মেয়েটি বললে, “হতে পারে।” উনি তখন কাগজে লিখে কাজগটা উল্টে রাখলেন। তবুও কিছু হয় না। মেয়েটির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হল। সে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারী করতে লাগল—তারপর বারান্দায় চলে গেল—“There is a wall before me, there is a wall before me—আমার সামনে একটা দেওয়াল, সামনে একটা দেওয়াল” বলতে বলতে বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে আরো জোরে জোরে বলতে লাগল—“আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না”, তার কপালের ঘাম ঝরে পড়ল, নিঃশ্বাস দ্রুত হল, তারপর ঐ রকম বলতে বলতে ঘরের বাইরে এসে সিড়ি দিয়ে নেমে গলি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল—ওর হতবুদ্ধি স্বামীও ওর পিছন পিছন ছুটল, চিৎপুরের রাস্তায় সাহেব মেমের এই দৌড় দুপাশের দোকানদারেরা কি রকম উপভোগ করছে ভেবে আমার হাসি পেয়েছিল খুব। আমি মুখে কাপড় দিয়ে হাসছি। বাবা বললেন, “তুই এখানে থাক। আমি ওদের পৌঁছে দিয়ে আসি।” কবি আমাদের পিতা-পুত্রীর বুদ্ধির উপর যথেষ্ট কটাক্ষ করলেন এবং অধ্যাপকদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কি প্রত্যাশা করা যায়, তাও বললেন। এদিকে বাবাও ক্ষুব্ধ, তার ক্ষোভের কারণ ওরা কবির কথা বলতে পারল না, আর তাঁরটা পারল! রুশ জাদুকরের উপাখ্যান এইভাবে শেষ, হল।
***