আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি

মায়ের মুখের সামনে কাগজের তাড়া এনে ছুঁড়ে দেয় সুর্মা। বিবর্ণ রক্তহীন মুখে মেয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো রুবাইয়াত।
তোমাকে বাঁচিয়ে এনেছি বলে ভুলেও ভেবো না যে তোমাকে রত্তিভর মায়া করবো আমি। তুমি আমার বাবার খুনী। তুমি আমার বাবাকে খুন করেছো। রুবাইয়াতের ঠোঁট কাঁপে। এই মেয়েটি তারই বুকের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। তার রক্তে মাংসে গড়া আদরের ধন।

ওর বাবা বলতো কি বলতো তা এই মুহুর্তে মনে করতে পারে না সে। কিন্তু ব্যাকুল একটা আকুতি তাকে ঠেলতে থাকে। ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ হয় না। মনে পড়ে বিচারকের রায় আসামীর নিজের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করলেও আদালত তার মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে কঠোর শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থেকে মনোচিকিৎসার নির্দেশ প্রদান করছেন।’

সুর্মা তাকে ঘৃণা করে। এই ঘৃণা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? সে তো নিজেও এক কঠিন ঘৃণার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। সেই যখন থেকে শাফাত আহম্মদের মুখ থেকে মুখোশটা খসে পড়েছিলো, চেনা মানুষটা হয়ে গিয়েছিলো সম্পূর্ণ অচেনা, তখন থেকেই।

-আমাকে ক্ষমা করো- বলেছিলো শাফাত। এখন তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো।
-তোমাকে? কি কর্কশ, কি কঠিন এক প্রশ্ন উচ্চারণ করেছিলো রুবাইয়াত।
কি করে ক্ষমা করা যায় শাফাতকে?

এই তো সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে টেলিফোনে স্বামীকে কারো সঙ্গে আলাপ করতে শুনে চমকে উঠেছিলো রুবাইয়াত। পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে শুনেছিলো কথোপকথন- আরে ইয়ার আই ডাউট, শি উইল নট গো আইদার, অর এলাউ মি টু গো। আমি একাই যাবো।

-কোথায় যাচ্ছো তুমি? কার ফোন? পর্দা সরিয়ে প্যাসেজে দাঁড়িয়েছিলো রুবাইয়াত। শাফাত এক মুহূর্ত চমকে উঠে সামলে নিয়েছিলো নিজেকে। বলেছিলো-আমাকে অফিস থেকে করাচীতে যেতে বলছে। তোমার আর সুর্মার কথা বলে যেতে চাচ্ছি না। কিন্তু বস জোর করছে।

-এরকম একটা ভীষণ অবস্থায় যখন কেউ দেশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারছে না, তুমি তখন অফিসের দোহাই দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?
-পালিয়ে? হোয়াট ডু ইয়ু মীন? তোমাদের জন্য আমি বর্ডারের ওপারেও যাইনি। সব রকম সাহায্য করে যাচ্ছি। টাকা-পয়সা, ইনফরমেশন, ওষুধপত্র-ছি:! শাফাত, আর কোন কথা বলো না। আমি জানি তুমি তাদের ইনফরমার।

রিজভী নামে তোমার যে বন্ধু অফিসারস ক্লাবে তোমার সঙ্গে টেনিস খেলে, সে হল তোমার সোর্স। এখন যুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে, ওরা পাততাড়ি গুটানোর চেষ্টায় আছে। তুমিও এই সুযোগে চলে যাবার পথ খুঁজছো।

-তবে তুমি সব খবরই রাখো তাই না রুবাইয়াত? ভেরী ক্লেভার! রিজভী ঠিকই বলে দেখছি। অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে শাফাত। তার পর ক্রমশ: ঝুঁকে আসে স্ত্রীর দিকে। ফিস্ ফিস্ করে বলে- লক্ষ্মীটি, কাউকে কিছু বলো না। তাহলে তোমার আর আমার আদরের মেয়েটি শুদ্ধ তোমাদের মাটিতে পুঁতে ফেলবো আমি।’

-আমি আমি তোমাকে ’ স্বামীর নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে রুবাইয়াত বলেছিলো,
-তোমাকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি!

চোখ ফেটে পানি এসেছিলো তার। শাফাত তাকে নিষ্ঠুরভাবে টেনে এনেছিলো। চোখে চোখ বিঁধিয়ে হাড়ের গভীর পর্যন্ত কি যেন দেখেছিলো, খুঁজেছিলো শাফাত। ধীরে ধীরে বলেছিলো
-একদিন এর জন্য হয়তো তুমি অনুতাপ করবে রুবা- নাউ ইউ ইফ এলাউ মি-’ মুখটা নামিয়ে এনেছিলো শাফাত।

-না, না, না ! রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করেছিলো রুবাইয়াত।
মাই ফাদারস্ ডেথ ওয়াজ নট এ্যান একসিডেন্টাল ডেথ। মাই মাদার কিলড্ মাই ফাদার। বিকজ শি সাসপেকটেড হিম টু বি এ ট্রেইটর !

আ: কম্পিউটারে হাত রেখে আতঙ্কিত চোখ মেলে নিজের স্টেটমেন্টটা বার বার পড়ে সুর্মা।
ওয়াজ হি এ প্যাট্রিয়ট? অর এ ট্রেইটর? সুর্মার চোখ ব্যথা করে। বুক জুড়ে যন্ত্রণার ঢেউ। মনে পড়ে বড় মামা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছে-

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি ইয়োর অনার। শাফাত আহমেদ একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আমরা পাশাপাশি এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত থাকার সুবাদে সে আমাদের আহত যোদ্ধাদের ওষুধ-পথ্য যোগান দিয়েছে শেষ দিকে আমরাই ওকে দেশের মধ্যে কাজ দিয়ে পাঠাই। আমাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে সে ভীষণভাবে ফেঁসে যায়। আমার বোন আর ভাগনীকে সামনে রেখে তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে রিজভী। পালানো অসম্ভব জেনে শাফাত চালাকী করে বাঁচার চেষ্টা করে।
কিন্তু

-কিন্তু আপনার বোনই তাকে ওভার ডোজ ঘুমের ওষুধ দিয়ে হত্যা করেন।
সরকারি উকিলের এ মন্তব্যে আদালত চিৎকারে কোলাহলে উত্তাল হয়ে ওঠে।

-আপনারা থামুন। আমার কথা শুনুন! আমি, আমি, এই হাতে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। শাফাত বলেছিলো- আমাকে ক্ষমা করো রুবা! মেয়েকে নিয়ে পালাও। আমি ওদের ঠকিয়েছি ওরা তোমাকে রেহাই দেবে না। আমি জানতে চেয়েছিলাম এটা তার একটা চালাকী কিনা।

-কি বলছো শাফাত? কি বলছো? আর একটু পানি খাও। সে বলেছিলো,
-তুমি যেন কোনদিন স্বীকার করো না যে তুমি, তুমি আমাকে মৃত্যু এনে দিয়েছো!
-বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী, তোমাকে হারিয়ে আমার একটুও দুঃখ হবে না!

-তুমি যা বুঝেছো, যা জেনেছো, সব ভুল রুবা, সব ভুল। একদিন তোমার দেয়া এ কলঙ্ক মুছে যাবে
রুবা সেদিন সত্য বেরিয়ে আসবে আ, আ
রুবাইয়াত চোখের সামনে দেখছিলো, অসীম ক্লান্তিতে নিদ্রাতুর স্বামীর শেষ মুহূর্ত গুলো। “ম্যাকবেথ মাস্ট ডাই”! হাসতে ইচ্ছে হলেও একটা কর্কশ আর্তনাদই কেবল বেরিয়ে এসছিলো তার মুখ দিয়ে-শাফাত, শাফাত, কথা বলো, কথা বলো— কিন্তু ও কথা বললো না।’

আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন শাফাতের মা। বলেছিলেন, আমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। জাতির দুর্ভাগ্য যে, তাদেরই জীবন হারাতে হয় ঘরের মধ্যে খুনীদের হাতে।’ রুবাইয়াতের দিকে তাকাননি শাফাতের মা। সংবাদপত্র গুলো ভরে গেল তর্ক বিতর্কের ঝড়ে।

-কি অদ্ভুত মহিলা! নিজের হাতে স্বামীর প্রাণ নিলো কি করে? বললো এক দল।
-দেশদ্রোহী হলে আমি সেই মহিলাকে স্যালুট করি। অন্যদের মন্তব্য।
-কিন্তু মহিলার ভাই তো গোটা মামলা উল্টে দিলেন!

নিজে আদালতে আবেদন করে মহিলা জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করছেন জেনে স্বামীকে হত্যা করেছেন তিনি। স্বাধীনতার দশ বছর পরে বিবেকের তাড়নায় নিজেকে আইনের কাছে সোপর্দ করেছেন।
-কিন্তু প্রমাণ কোথায়?

-হাস্যকর প্রশ্ন। এসব কাজ কেউ দলিল দস্তাবেজ রেখে করে নাকি? তাছাড়া তিনি স্ত্রীর কাছে স্বীকার করেছিলেন।
-কিন্তু কোলাবরেটরের ছদ্মবেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্যই কাজ করছিলেন। স্ত্রী কে আভাসে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টাও করেছিলেন।

পৃথিবীর বাতাসে বিষাক্ত সন্দেহ অণু-পরমাণুর মতো মিশে যাচ্ছে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস আর ভাল বাসায় ঘোলাটে বিবর্ণ বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অর্থহীন কথা বলে চলেছিলো সেদিনের রুবাইয়াত। বড় ভাই যখন সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো,- একি করেছিস তুই রুবা? সব কিছু না জেনে-
তখনও বিড় বিড় করে বলে চলেছিলো,

-দেশদ্রোহী, বিশ্বাস ঘাতকের শাস্তি মৃত্যু, মৃত্যু— মৃত্যু—!
দিনের পর দিন মাথা কুটেছে রুবাইয়াত। শাস্তি কামনা করেছে। তারপর একদিন আবেদন জানিয়েছে আদালতের কাছে।

মামাবাড়ির স্নেহে-যত্নে মানুষ হয়ে সুর্মা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। মা, —– মাগো, তুমি নির্দোষ। তুমি খুন করোনি। আমার বাবা নিজেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের জীবন নিয়েছিলো। তুমি আর এমন করে নিজেকে কষ্ট দিওনা মা!

রুবাইয়াত হেসে উঠেছিলো। বিকৃত হাসি। স্বাধীনতার দীর্ঘ বত্রিশ বছর পরে। মানসিক ভারসাম্য হীনতার চরম অবস্থা। ডাক্তাররা তাকে বিশ্রাম, মানসিক সহায়তা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করবেন।

আদালতের কাগজ পত্র, স্বীকারোক্তি, বিচারকের রায়। এতদিন পরে একটা ফাইল এনে মায়ের মুখের ওপরে ছুঁড়ে দিয়েছে সুর্মা। যাকে বুকে করে স্বামীর অপরাধ ক্ষমা করতে চেষ্টা করেছিলো রুবাইয়াত। সেই সুর্মা আজ তাকে বলে গেছে- তুমি খুনী। হোক সে অন্যায়কারী। এ কথা যদি সত্যিও হয়, তবুও সে আমার বাবা। তোমাকে আমি তিলে তিলে যন্ত্রণা দিযে মারবো।

নিজের স্বেচ্ছা বন্দী ঘরে আজ বড় ভয় করে রুবাইয়াতের। জটিল এক মহাজাল তাকে ঘিরে ধরেছে।- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- সে একজন দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলো।

-সে ফেঁসে যায়-স্ত্রী কন্যাকে বাঁচাবার জন্য — শেষ চেষ্টা করে, কিন্তু
-একদিন তুমি হয়তো অনুতাপ করবে। কোনটা সত্যি? মানুষ শাফাত, না বিশ্বাস ঘাতক? এতদিন রুবাইয়াত কেবল চিৎকার করেছে। অভিশাপ দিয়েছে কিন্তু আজ যেন, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় রুবাইয়াতের। সে কি শাফাতকে ভালো বাসেনি? অনেক অনেক বছর পরে একটু কাঁদে রুবাইয়াত।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে তার সন্তান। সময়ের শিকার, অবস্থার শিকার ঐ নারী তার মা। কতদিন পরে, বুঝি বা ছেলে বেলার পরে এই প্রথম সে তার বাবার জন্য কাঁদতে দেখছে তার মাকে। মহাকালের খেলার মধ্যে হারিয়ে ফেলা অতীতকে কাঁদতে কাঁদতে খুঁজে বেড়ানো শিশুর মতো এই মাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সুর্মা।

-এই তো আমি মা— এই তো আমি —
তারপর একসময় গুমরে গুমরে কাঁদে দু’জনেই।