জনার্দন কৈবর্ত

জনার্দন কৈবর্তের এখন-তখন অবস্থা। যমে-মানুষে টানাটানি যাকে বলে। পাঁঠার মাংসই তার এই মরো-মরো অবস্থার জন্য দায়ী।

জনার্দন স্বভাবলোভী নয়, কিন্তু পাঁঠার মাংসের কথা বললে ভরাপেটেও তার খিদে লেগে যায়। জনার্দন খুব যে হালুম-হুলুম করে খায়, এমন নয়। কিন্তু পাতে পাঁঠার মাংস পড়লে ভাতের হাঁড়ি উজাড় হয়। কৈবর্তপাড়ার কেউ যদি বলে, ‘জনার্দনদা, আমার এই গেরো গুঁড়িটা ফালা ফালা করে লাকড়ি করে দেও তো। বাড়িতে পাঁঠার মাংস হচ্ছে। দ্বিপ্রহরে আমাগোর লগে খাবা।’

ওই ঠিকদুপুরে কোমরে গামছা বেঁধে গুঁড়ি ফাড়তে কুড়াল হাতে লেগে পড়ল জনার্দন।

কেউ যদি বলে, ‘অ জনার্দন, বর্ষাকাল আইসা পড়ল। ঘরওঝা পাচ্ছি না। আমার ঘরটা ছাইয়া দে বাপ। তোরে পাঁঠার মাংস খাওয়ামু।’ জনার্দন অমনি ছনের বোঝা নিয়ে অহল্যা বুড়ির চালে উঠে গেল।

পাড়ার কোনো দুষ্টযুবক ভালো মানুষের মুখ করে যদি বলে, ‘কাকু, আজ পাশের গ্রাম ছিপাতলির নিরঞ্জন বহদ্দার তাইনের মায়ের চেরাদ্দ অনুষ্ঠানে পাঁঠার মাংসের বেবস্থা করিছে, যাবা নাকি।’ জনার্দন অমনি ছিপাতলির উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়।

জনার্দন হালদার কিন্তু এলনা-ফেলনা মানুষ নয়। তার বউ আছে, ছেলেমেয়েও আছে একটি করে। বাপের রেখে যাওয়া ভিটেতেই থাকে সে। ঘরটিও তার শক্তপোক্ত। টিনের ছাউনি। খাবারের কোনো টানাটানি নেই ঘরে। রাস্তার পাশে কয়েকটি দোকান ভাড়া দিয়েছে জনার্দন। নিজেও কম আয় করে না। যখন যা পায়, তা-ই করে। কেউ যদি বলল, ‘চল জনার্দন, সমুদ্রে চল। আজ ছাওয়ালডার অসুখ। তার বদলে তুই চল।’ জনার্দন গেল। কেউ যদি বলে, ‘অ কৈবর্তের ছাওয়াল জনার্দন, আমার জমিটা কোপাইয়া দে, পারিশ্রমিক পাবি।’ জনার্দন কোপাল। এই করে করে জনার্দন দৈনন্দিন কিছু না কিছু রোজগার করে।

জনার্দনের যে খাবারের অভাব, তা-তো না, তারপরও পাঁঠার মাংসের জন্য সোয়ামির এই লোভের হদিস পায় না বউ সরস্বতী।

কোনোদিন যদি বউ জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা তুমি এমন ক্যান!’

জনার্দন বলে, ‘কিসের এমন ক্যান? কী কইতে চাও, কাঁইশ্যা কও না!’

সরস্বতী ভয়ে ভয়ে বলে, ‘না বইলছিলাম কী, পাঁঠার মাংসর জইন্য তুমি এমন কর ক্যান?’

রাগী চোখে জনার্দন বলে, ‘কেমন করি?’

বউটা ভয় পেয়ে যায়। চুপ থাকে।

জনার্দন বলে, ‘খাই খাই করি ক্যান, এই ত জিগাইতে চাইতাছ? পাঁঠার মাংসর কথা শুইনলে আমি পাগল হইয়া যাই ক্যান, এই ত জাইনতে চাইতাছ?’

সরস্বতী ভয়ে স্বামীর পাশ থেকে উঠে যায়। দাওয়ায় বসা জনার্দন উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনটা বহু বছর পিছিয়ে যায়।

ঊনিশশ চুয়াত্তর। দেশে তখন আকাল। হুহু করে চালের দাম বাড়ল। গরিবরা চাল কেনার ক্ষমতা হারাল। গরিবদের হাতে চাল কেনার টাকা কই? কৈবর্তপাড়াতে রাঢের ধাক্কা এসে লাগল। কৈবর্তরা মাছ ধরলে কী হবে, কেনার লোক তো নেই! কৈবর্তরা মাছমারা ছেড়ে দিল। চুপি চুপি দূরের পাড়ায় গিয়ে অনেকে ভিক্ষা করতে শুরু করল।

নিত্যানন্দ কৈবর্তের আট আটজন ছেলেমেয়ে। ছয় ছাওয়াল, দুই কন্যা। জনার্দন ভাইদের মধ্যে পঞ্চম। কত বয়স তখন তার! পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ। নিত্যানন্দ খালে-নালে টাউঙ্গা জাল ঠেলে সের-দেড় সের মাছ মেরে আনত। এর-ওর হাতে-পায়ে ধরে মাছগুলো গছিয়ে সেরখানেক চালের টাকা পেত। ওই এক সের চাল দশজন মানুষের দুবেলার খাবার। মা-পুকুরপাড় থেকে বোঝাই করে শাক তুলে আনত। কোনো কোনো বেলা শাকের সঙ্গে খেসারি ডালের পাতলা পানি থাকত। অধিকাংশ বেলাতে শাকের পাহাড় পাতে। মা সবার পাতে পাতে এক মুষ্টি ভাত আর থালাবোঝাই শাক দিত। জনার্দনরা ভাত দিয়ে শাক খেত, শাক দিয়ে ভাত খেতে পারত না কোনো বেলা। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গেছে। জনার্দন শাক খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছে। সে সময় খুব মাংস খেতে ইচ্ছে করত জনার্দনের। মাংস মানে পাঁঠার মাংস। সেই সময়ে কৈবর্তবাড়িতে মুরগি খাওয়ার চল ছিল না। মুরগি যে রামপক্ষী! অবতার রামের খাস-পক্ষী খাওয়া মহাপাপ ছিল তখন। পাঁঠার মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, খাওয়ার স্বপ্ন দেখার কথাও ভাবতে পারত না জনার্দনরা।

সেই ছোটবেলা থেকে পাঁঠার মাংস খেতে না-পারার দুঃখ জনার্দনের মনে জমা হয়ে ছিল। সেই দুঃখ ক্রমে ক্রমে বাসনায় পরিণত হয়েছে। বয়সক্রমে পাঁঠার মাংস খাওয়ার বাসনা লোভে পরিণত হয়েছে। এখন জনার্দন পাঁঠার মাংস খাওয়ার লোভে উন্মাদ হয়ে ওঠে। ঘরে যে মাঝেসাঝে পাঁঠার মাংস রাঁধে না, এমন নয়। কিন্তু সবসময় তো আর রাঁধা হয় না! প্রতিবেলা মাংস খেতে চাইলে তো টাকার দরকার! অত টাকা জনার্দনের হাতে কোথায়?

জনার্দনের যত বয়স বাড়ে, পাঁঠার মাংসের প্রতি লোভও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। তাই মাংস খাওয়ার প্রস্তাব পেলে জনার্দন যে-কোনো কাজ করতে রাজি হয়ে যায়।

একদিন হরনাথ জেঠা বলে, ‘জনার্দন, গোমদণ্ডীর গোবর্ধনের বড় ছাওয়ালের জইন্য আমার ছোড মাইয়া সুরমার বিয়ার পরস্তাব এইসেছে। আজ পাকা কথা গোমদণ্ডীতে। যাবি নাকি আমার লগে? বিয়ার কথায় বয়সী মানুষ লাগে। তোর তো বয়স কম হলো নারে জনার্দন!’

জনার্দন লজ্জার মাথা খেয়ে বলে, ‘পাঁঠার মাংস খাওয়াবে তো জেঠা?’

জেঠা আমতা আমতা করে বলে, ‘তা কী করে কই জনার্দন! নতুন সম্বন্ধ হইতে চইলছে, মুখে কি আর কওন যায়- পাঁঠার মাংস খাওয়াইতে হইবে? তয়…।’ বলে থেমে যায় হরনাথ জেঠা।

গভীর আগ্রহে জনার্দন বলে উঠে, ‘তয় কী জেঠা?’

হরনাথ জেঠা বলে, ‘বইলছিলাম কী, নতুন সম্বন্ধ হইতে যাইতেছে, গোবর্ধন দাদা কি আমাদের জইন্য একটু মাংসের বেবস্থা কইরবে না?’

‘আমি বুইঝতে পারছি। তই আমি যামু জেঠা। তোমার মাইয়ার পাকা কথার অনুষ্ঠানে আমি না যাইয়া কি পারি!’ খুশিতে আটখানা হয়ে বলে জনার্দন।

কিন্তু হরনাথের মাইয়ার সঙ্গে গোবর্ধনের ছাওয়ালের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। হয়নি জনার্দনের জন্য।

পাকা কথা শেষ করে খেতে বসেছে অতিথিরা। হরনাথ জেঠার সঙ্গে জনাদশেক এসেছে। জনার্দনও আছে এদের মধ্যে। গোবর্ধনের পক্ষেও নয়-দশ জনের মতো। উঁচুবাড়ির বড় বারান্দায় পাত পড়েছে। জনার্দন বসেছে হরনাথ জেঠার পাশে। ডাল আসে, কচু শাক আসে, বেগুনভাজি আসে, ঘণ্ট আসে। রুইমাছও আসে। জনার্দন অধিকাংশ তরকারি পাতের পাশে সরিয়ে রাখে। ডাল-মাছ দিয়ে দু-এক গ্রাস মুখে দেয়। সে অধীর আগ্রহ নিয়ে পাঁঠার মাংসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু মাংস আসে না, অম্বল আসে।

জনার্দন ক্ষিপ্ত হয়ে পাশে বসা হরনাথ জেঠাকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘মাংস কই জেঠা!’

জেঠা বিরক্ত কণ্ঠে ধমকে ওঠে, ‘আহ জনার্দন আস্তে! শুনতে পাইবে ওরা!’

জনার্দন গোলমেলে কণ্ঠে বলে উঠে, ‘শুইনতে পাইলে পাক জেঠা। বলি- মাংস খাওয়ানোর মুরদ নাই, ছাওয়াল বিয়া করাচ্ছে!’

গোবর্ধন অনতিদূরে অতিথি-তদারক করছিল, দৌড়ে এলো। বলল, ‘কী হইছে বিয়াই! লোকটা এই রকম কইরতাছে ক্যান? তরকারি রান্না খারাপ হইছে নি!’

হরনাথ লজ্জায় মরে গিয়ে বলল, ‘ও কিছু না দাদা। আমি সামাল দিতাছি। আপনি অন্যদের দেখেন।’

জনার্দন গর্জে ওঠে, ‘কিছু না মাইনে! কিছু তো বটেই! বলি-ছাওয়াল বিয়া করাইতেছেন, অতিথির জন্য এক বাটি পাঁঠার মাংসর বেবস্থা কইরতে পাইল্লেন না?’

ভ্যাবাচ্যাকা চোখে গোবর্ধন জনার্দনের দিকে তাকিয়ে থাকল। মুখ থেকে কথা হারিয়ে গেছে তখন তার। এরকম লোক তো দেখেনি কখনো! পাঁঠার মাংসের জন্য হইচই করছে! জনার্দন কিন্তু থামল না। চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘পয়সাওয়ালা বলে! ধনী! অতিথিদের পাঁঠার মাংস খাওয়ানোর ক্ষেমতা নাই, ও আবার পয়সাওয়ালা!’

গোবর্ধনের বড় ছেলেটা তেড়ে এলো। এ কী অশোভন কথাবার্তা! কথা কাটাকাটি থেকে বিতণ্ডা। হরনাথ জেঠা জনার্দনকে থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল। জনার্দন থামল না। সে অবিরাম চিৎকার-চেঁচামেচি করে গেল। গোবর্ধনের বড় ছেলে বেঁকে বসল-এ বিয়ে করবে না সে। যে-পরিবারে এত বড় লোভী আছে, সে-পরিবারে কিছুতেই বিয়ে করবে না সে। হরনাথ যতই বলছে, জনার্দন তার পরিবারের কেউ নয়, পড়শী। বড় ছেলের এক কথা- হরনাথের মেয়েকে বিয়ে করবে না।

জনার্দনের পাঁঠার মাংসের লোভের জন্য জোড়ালাগা বিয়েটা ভেঙে গেল। গ্রামে ফিরে জনার্দনের কী হাল হয়েছিল, তা না হয় পাঠকের অজ্ঞাতই থাকুক।

এই সেদিন হলধর এসে বলল, ‘আমার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বোশেখের তিরিশ তারিখ বিয়া। মোহরা গ্রামে। বরযাত্রী যাওনর লোক পাই না। তুই চল জনার্দন আমাদের লগে।’

জনার্দন বলে, ‘তুমি কি আমারে পাগল পাইছ হলধরদা, এই করোনার সময় বরযাত্রী যাইতাম! চাইরদিকে দলে দলে মানুষ মইরতাছে, শুইনতে পাইরতাছ না!’

হলধর বলে, ‘আমি নিরুপায় রে ভাই! এই বোশেখে বিয়া না হইলে আগামী তিন বছর নাকি পোলার বিয়া নাই। গণকঠাকুর পঞ্জিকা দেইখা কইছে! আত্মীয়স্বজনদের হাতে-পায়ে ধইরে এত কইরে কইলাম, কেউ যাইতে রাজি হইতাছে না। কইতাছে- কে করোনার হাতে মইরতে যাইব! তুই চল ভাই। তুই গেলে পোলাসহ সাতজন হইমু। সাতজনের কম বরযাত্রী হওন অমঙ্গল- গণকঠাকুর কইছে।’

‘না হলধরদা, আমি যামু না। নিজে যাঁইচ্যা মরণের কাছে ধরা দিমু না।’ বলে জনার্দন।

হলধর এবার পাকা চালটি চালে, ‘মাইয়ার বাপে পাঁঠার মাংসর আয়োজন কইরেছে। আমারে খবর পাডাইছে পাঁচখান পাঁঠা কিনছে তাইনে!’

জনার্দনের জিহ্বা লকলকিয়ে উঠে। বলে, ‘পাক্কা তো!’

হলধর জনার্দনের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘পাক্কা মাইনে পাক্কা। আমি হরনাথ জেঠা না, মিছা কথা কইতাম!’

জনার্দন বলে, ‘তা যাইবা কেমনে? পথে তো পুলিশ-মেলেটারির চেক!’

হলধর বলে, ‘ও নিয়া তুমি ভাইব না জনার্দন। গাড়ির বদলে এম্বুলেন্স ভাড়া করুম। পোলারে রোগী সাজাইয়া শোয়াইয়া নিমু। আমরা সকলে রোগীর আত্মীয় সাজুম।’

সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিল জনার্দন।

হলধরের ছেলের বিয়েতে জনার্দন গিয়েছিল। পেটভর্তি করে পাঁঠার মাংসও খেতে পেয়েছিল। রাতের বেলা গাদাগাদি করে ছয়-সাতজনকে এক রুমে শুতে দিয়েছিল কনেপক্ষ। ঘরভর্তি আত্মীয়-কুটুম্ব ছিল বলে জনার্দনদের এ রকম করে রাত কাটাতে হয়েছিল।

দুপুরের খাবারেও পাঁঠার মাংসের ঘাটতি ছিল না।

ঘরে ফিরলে সন্ধের দিকে পেটব্যথা শুরু হয়েছিল জনার্দনের। সঙ্গে জ্বর, কাশি। দু’দিনের মধ্যে বমিও শুরু হলো।

সরস্বতী স্বামীকে মেডিকেলে নিয়ে গেল। ডাক্তার টেস্ট করে বলেন, ‘করোনা হয়েছে। কোনো করোনা রোগীর কাছাকাছি ছিলে বোধহয়!’

জনার্দন কঁকিয়ে বলে, ‘হ, এক বিয়াবাড়িতে ছয়-সাতজনের লগে শুইছিলাম। রাইতের বেলা।’

ডাক্তার বিরক্তির মাথা নাড়েন।

সেই থেকে জনার্দন কৈবর্তের মরণদশা! মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই!

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
হরিশংকর জলদাস- র আরো পোষ্ট দেখুন