মানুষ ফিরবে আবার

কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল

ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,

নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই

এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায়

বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়

যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো…

জীবনের এই যে এত বিষয়-আসয়- আমি ছাড়া এর কিছুইতো আমার কাছে নাই। সবই দূরে, একমাত্র কষ্ট ছাড়া। কষ্টই আমার সবচেয়ে আপন। সবচেয়ে প্রিয়তম পাতা। জীবনের বাকি যা কিছু তাদের সবই যেন না থেকেও আছে; মনের ভিতরে, স্মৃতির মধ্যে। আমি তাদের বেদনার প্রলেপ দিয়ে রাখি।

প্রিয় মুখ, প্রিয় সময় কিংবা জীবনের ফেলে আসা স্থান- এসবই আমাদের কাছে একসময় কেবল স্মৃতি হয়ে যায়। এরা যেন না থেকেও থাকে। আমরা এদের ইচ্ছেমত ডেকে ডেকে আনি। আজ পৃথিবীই এক গভীর বেদনা-আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ, কারো না কারো আপনজন মারা যাচ্ছে। মানুষের প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

জীবনে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এ এক আকালের দেশ, এখানে শৈল্পিক দুঃখ দেওয়ার মানুষের বড্ড অভাব। আমি সমস্ত জীবন সেই মানুষের সন্ধান করে গেছি। না পেয়ে নিজেই তৈরি করে নিয়েছি, বেদনার নিজস্ব সংসার। বেদনা যেহেতু আমার কবিতার একটি মুখ্য বিষয়; কষ্ট, বেদনা, বিচ্ছেদ, দুঃখ- এই বিষয়গুলো আমি খুব উপভোগ করি এবং দ্রোহ ও প্রতিবাদের মতোই প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ আমার কবিতার মৌলিক উপকরণ। শৈল্পিক দুঃখ দেওয়ার মানুষ যখন নেই, তখন আমি নিজেই আমার নিজের ভেতর অনেক কষ্ট তৈরি করে নিই, যে কষ্ট আমাকে কবিতা লিখতে সাহায্য করে, যে কষ্ট আমাকে নির্লোভ-নির্মোহ অবস্থানে দাঁড়িয়ে সমাজকে পর্যবেক্ষণে সহায়তা করে। আর বেদনা- আমার প্রিয় বেদনা, তাকে আমি শিল্পে রূপান্তরিত করতে চেয়েছি।

এই যে মানুষের এত ভালোবাসা কবিতার প্রতি- শারীরিকভাবে একদিন তো আমি থাকব না, প্রকৃতির নিয়মেই আমাকে চলে যেতে হবে। তখন সবাই রাতারাতি কী আমাকে ভুলে যাবে? নাকি কিছুদিন মনে রাখবে? এটা একটু যাচাই করার জন্য, এই যে আমি নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেলাম। সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে উইথড্র করে নিলাম। একটা সময় এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, অনেকে মনে করত আমি বোধহয় বেঁচে নেই। কিছু মানুষ মনে করতেন উনি হয়তো জীবিত থাকলেও, বিদেশে থাকে। কোথাও যেতাম না, কেবল এই প্রেসক্লাবে কিছুটা আসতাম।

এই যে একটা সময় আমি গেমব্লিঙে ঢুকে গিয়েছিলাম- জুয়াই হয়ে উঠেছিল আমার দিনরাতের প্রিয় কারবার।

জুয়ায় আমি অসম্ভব সফল ছিলাম। আর সে কারণেই আরও বেশি করে তাতে ডুবে গিয়েছি। পত্রিকা আফিসে যা বেতন পেতাম, তার চার-পাঁচগুণ বেশি আয় ছিল জুয়ার টেবিলে। একরকম রাজকীয় হালে জীবন কাটাচ্ছি জুয়া খেলে। জীবনে তখন ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, অতীতও পলাতক। আসলে অনিশ্চিত জীবনকেই আপন করে নিয়ে আমি একদিন কার্ডরুমে ঢুকলাম। এই প্রেস ক্লাবেই।

আরেক দিকে এক কাব্যগ্রন্থেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া- এই সফলতা আবার এক ধরনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে। ভেতরে এক ধরনের ভীতি, আর তো পারি না, তখন লিখতে বসলে হাত কাঁপে। আবার বই বের করব ভাবতে গেলেই গা শিউরে ওঠে। এই করতে করতেই বত্রিশ বছর কেটে গেছে দ্বিতীয় বই প্রকাশের অপেক্ষায়। শিল্পে সফলতার ভার বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন আমি পারিনি। এ ছিল আরেক জুয়া। আমার নিজের সঙ্গে নিজের জুয়া। প্রায় ছাব্বিশ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেছি। কিন্তু আজ বসে বসে সেসব দিনের কথা যখন ভাবি- দিনগুলো আমার কাছে নিবিড়ভাবে ধরা দেয় এখনও। তবে জীবনে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। অনুশোচনা নেই- এই যে এত সময় অপচয় করলাম! বরং অপরাধবোধ আছে।

তারপর একদিন ফিরে এলাম। দীর্ঘ অন্তরীণ জীবনের গুহা থেকে মানুষের কাছেই একদিন ফিরে এলাম। এই যে প্রত্যাবর্তন- এর পেছনে রয়েছে বেদনাবিধৌত এক জীবনের ইতিহাস। এসব নিয়েই হয়তো একদিন লিখেছিলাম-

প্রত্যাবর্তনের পথে

কিছু কিছু ‘কস্টলি’ অতীত থেকে যায়।

কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনও ফেরে না।

কেউ ফিরে এসে কিছু কিছু পায়,

মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায়।

জন্মস্থান নেত্রকোনার ছেড়ে আসা দিনগুলো, স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তাল ঢাকার দিনগুলো, মাতৃমমতা হারা দ্বারে দ্বারে ফেরা জীবনের দিনগুলো- এসবের সবই আমার কাছে না থেকেও আছে।

যেন জীবনবৃক্ষের ঝরে যাওয়া আজন্ম সবুজ পাতা। এরা কখনও ম্লান হয় না। কোনোটা সুখের, কোনোটা বেদনার।

আজ আমি গ্লুকোমায় আক্রান্ত। অতীত দেখতে দেখতে একদিন যেন চোখের এই রোগ আমার আপন হয়ে গেছে। গ্লুকোমা পুরোপুরি কখনই সারে না। যত দিন যাবে চোখ দুর্বল হতে থাকবে। কিছু করার নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানও সম্ভবত এ পর্যন্তই।

এই তো বছর দশেক চলে গেল কর্ণফুলী হোটেলে। সারাদিন তো বাইরেই থাকি, মানে প্রেসক্লাবেই। রাতে একটু অসুবিধা হয় এখন। মনে হয় যেন পাশে একজন থাকলে ভালো হতো। এক ধরনের নির্ভরতার একটা জায়গা। যেহেতু ক্রমশ বয়স বাড়ছে। শরীর দুর্বল হচ্ছে। এবং রোগবালাইয়েও ধরে ফেলছে। এসব মিলেই একটু অসুবিধা তো হয়ই। শারীরিক চাহিদা হয়তো নেই, কিন্তু পাশে তাকালে একজন নির্ভরতার মানুষের অভাববোধ হয় সত্যি। এরমধ্যে করোনার কাল এসে আমাকে উচ্ছেদ করেছে কর্ণফুলী হোটেল থেকে, প্রেসক্লাব থেকে; মানে আমার ‘একার সংসার’ থেকে। হোটেলে কেউ নাই, দুয়ার বন্ধ- প্রেসক্লাবও তাই; একি কাল এলো; আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে অগ্রজের নীড়ে। করোনার কাল আমাদের প্রত্যেকের নিজস্বতা নষ্ট করে দিচ্ছে।

আমার মৃত্যুভয় নেই, ভয় হয় আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলে আমাকে তো কেউ দেখার নেই। এটি এখন একটি বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়।

তবে আমি মানুষের কাছে অসম্ভবরকম ঋণী। ঋণের একটা হচ্ছে, আমার এই সমস্ত কবিতা লেখার পেছনে সবচেয়ে বড় উপাদান তো মানুষই। তাদের অবদানই বেশি। নানাভাবেই সেটা। যদি কেউ কষ্ট দিয়ে থাকে সেটাও আমার প্রেরণা, জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। সেই কষ্ট যদি ওই মানুষটা না দিত তাহলে হয়তো সেই কবিতাটা লেখাই হতো না। এখানেও আমি ঋণী। ওই যে আমি বলেছি, ‘আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে/ মানুষের কাছে এওতো আমার এক ধরনের ঋণ’। আবার কবিতায়, যে ভালোবাসা পেয়েছি মানুষের- সেই ঋণের তো আর অন্ত নেই। এত ভালোবাসা আমার মনে হয় না কোনো একটি বই লিখে কোনো লেখক পেয়েছে। এত অল্প লিখে এত ভালোবাসা পাওয়া! সে জন্যও মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার দ্বিতীয় বইটি- ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’- ২০১৯ এর অক্টোবরে বাজারে এসেছে। এটিও পাঠকেরা পছন্দ করছেন।

প্রিয়তম পাতার কথা আরও বলবো?… আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উত্তাল দিন; কবিতাময় তখনকার দিনগুলোকে আজ স্বপ্নের মতো মনে হয়। কত দিন কত রাত উদ্ভ্রান্ত কেটেছে তার সীমা-পরিসীমা নেই। সেই জীবনটাও এখন ফিরে ঠিরে আসে। অতীত হয়েও তারা আছে, আমার ভেতরেই। আমার প্রেম ও বিচ্ছেদের প্রিয় বেদনাগুলোর মতোই।

আমার প্রথম প্রেমের সেই সবিতা মিস্ট্রেস। সবিতা সেন। সেও আছে প্রিয় পাতা হয়ে। হেলেনের কথা সবাই জানলেও আমার প্রথম এবং বড় প্রেম সেই সবিতা মিস্ট্রেস। তার সঙ্গে আমার প্রথম সম্পর্কটা হলো মা-ছেলের মতন। উনি তো আমার থেকে বারো-তেরো বছরের বড়। আমি যেহেতু ছেলেবেলাতেই মাতৃহীন। সবিতা মিস্ট্রেস আমাকে খুব আদর করতেন। আর হেলেন আমার সমবয়সী বা দু-তিন বছরের ছোট। আসলে আমার কবি জীবনকে বেশি প্রভাবিত করেছেন, সবিতা সেন। শুধু কবি জীবন নয়, ব্যক্তি জীবনকেও।

তারও জীবন আসলে ছিল কষ্টেরই জীবন। তিনি যাকে ভালোবাসতেন, তার সঙ্গে তার তো আর সংসার হয়নি। যে জন্যে তিনি সারা জীবন একাই থেকেছেন। আট-ন’ বছর আগে মারা গেছেন সবিতা সেন। আমার সমস্ত জীবন বিস্তৃত কৈশোরের প্রেম।

হেলেনের সঙ্গেও পরবর্তী সময়ে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। আমিও দূরে থেকেছি।

বেদনাগুলোকে যতটুকু আমার সামর্থ্যে কুলিয়েছে, আমার কবিতায় আমি বের করে দিয়েছি। এবং আমি খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি, যে আমার কোনো প্রেমের কথা, আমার কোনো বিরহের কথা, আমার কোনো দুঃখের কথা, আমার কোনো রাজনীতির কথা- এগুলো যখন আমি কবিতায় রূপান্তর করব, তা পড়ে প্রত্যেক মানুষ যেন মনে করে, আরে এটা তো আমারই কথা। সে কারণেই হয়তো আমার কবিতার কাছে যিনি রাজনীতির মানুষ তিনিও গিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন। যে প্রেমিক সেও আশ্রয় পেয়েছে। যিনি বিচ্ছেদে আক্রান্ত, জর্জরিত তিনিও আমার কাছে গিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।

প্রিয়? সবচেয়ে প্রিয় তো মানুষ- মানুষের জীবন। এটাই আজ বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত। মানুষের অসহায় মৃত্যু দেখব এই জীবনে, ভাবনার অতীত ছিল। দুনিয়াজুড়ে মানুষ আজ ঘরবন্দি- এ-ও কি ভাবতে পেরেছি চার মাস আগেও!…তবে মানুষের অফুরান সম্ভাবনায় কবিমাত্রই আস্থাশীল। আমিও তাই। মানুষই জয়ী হবে। মানুষ ফিরবে তার প্রিয় যা কিছু- তার কাছে। আমিও ফিরতে চাই। আমার একাকিত্বের কাছে। আমার নির্জনতা, আমার বেদনার কাছে। মানুষ ফিরুক মানুষের কাছে। সবাই ফিরে পাক তার যা কিছু প্রিয়। বেঁচে থাকুক পৃথিবী আর তার মানুষ।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
হেলাল হাফিজ- র আরো পোষ্ট দেখুন