জুলেখা বলল, তুই একটা আজিব পোলা।
বিজু মার দিকে তাকাল। ক্যান, কী করছি আমি?
এত রাত্র হইল তাও জাইগা আছস!
পড়তাছি দেখ না! ক্লাস থ্রির পড়া কি কম!
রেললাইনের বস্তির এদিকটায় আজ ইলেকট্রিসিটি নেই। জুলেখা একটা কুপি জ্বালিয়েছে। কুপির আলোয় বই খুলে বসে আছে বিজু। পড়ছে বলে মনে হয় না। নাড়াচাড়াই সার।
জুলেখা হাসল। তয় ভাত খাইয়া আবার পড়।
বাবায় আসুক।
এইটা হইল আসল কথা। তুই তোর বাবার লেইগা জাইগা আছস।
বিজু ফিক করে হাসল। কথা বলল না। কুপির আলোয় ছেলের মুখটা ভারি মিষ্টি লাগল জুলেখার।
বদরুলকে সবাই বদু বলে ডাকে। বদু এলো রাত্র সোয়া দশটার দিকে। প্রতিদিন যে রকম ফুর্তি নিয়ে ফেরে আজ তেমন না। একটু ম্লান, বিষণ্ণ। আজ বোধহয় পরিশ্রম বেশি হয়েছে।
পরিশ্রম রোজই হয়। ডকইয়ার্ডের কাজ। লোহালক্কড় টানাটানি। জানের কিছু থাকে না। তবু বস্তিতে ফেরার সময় আনন্দ নিয়ে ফেরে। ছেলে আছে, ছেলের মা আছে। তাদের কাছে ফিরে আসার চেয়ে আনন্দের কাজ আর কিছু নেই জীবনে। বস্তির ঘরে এক চৌকিতে ছেলেটাকে মাঝখানে রেখে ঘুমিয়ে থাকা, সুখের তুলনা হয় না। ছেলেটা বাপ ন্যাওটা। বাপের গলা জড়িয়ে তার কোমরে পা তুলে ঘুমায়। সময়মতো দুধের দাঁত ফেলা হয়নি বলে দাঁত উঠেছে উঁচু হয়ে। ঘুমালে মুখটা হাঁ হয়ে থাকে। এই নিয়ে জুলেখার খুব রাগ। এমুন পোলা জিন্দেগিতে দেখি নাই। দাঁত নড়বড় করে তাও হাত দিতে দেয় না। ফালাইতে দেয় না। অখন যে দাঁত উচা হইয়া উঠল, এই দাঁত তো আর ঠিক হইব না। সারাজীবন থাক অখন উচা দাঁত লইয়া। সুরত মন্দ আছিল না। অহন সুরত গেছে বদসুরত হইয়া।
বিজু এসব বোঝে না। পাত্তাও দেয় না। ফিক ফিক করে হাসে। বদু মুগ্ধ হয়ে দেখে তার ছেলের হাসি খুব সুন্দর। উপরের পাটির দাঁত উঁচু না হলে এত সুন্দর হাসি বোধহয় ছেলেটা হাসতে পারত না। জুলেখাকে মৃদু ধমক দেয়। বাজে প্যাচাইল পাইরো না। আমার পোলা সোন্দর আছে। হাসিটা দেখ কী সোন্দর। আয় বাজান, আমার কাছে আয়।
ছেলেকে কাছে টেনে আদর করে বদু। জুলেখা মুখ ঝামটে বলে, ইস! আল্লাদ দেইখা বাঁচি না!
বদুর পরনে ময়লা ঢোলা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। টিশার্টের রং আকাশি আর থ্রি কোয়ার্টার খাকি রংয়ের। আলকাতরা আর তেল ময়লা লেগে যাচ্ছেতাই হয়ে আছে জামাকাপড়। গা থেকে আসছে ঘামের গন্ধ।
এত দেরি করলা ক্যান বাবা?
বদু ক্লান্ত গলায় বলল, আড়াই হাজার টনের একটা কারগো নামলো আইজ। বিরাট খাটনি গেছে রে বাজান। এত খাটনির পর পানগাঁও থিকা এতদূর হাইটা আইলাম। বিজুর মা, ভাত বাড়ো, নাহাইয়া আহি।
বদু ধোয়া লুঙ্গি গামছা নিয়ে পচা পুকুরটার দিকে চলে গেল।
রাত্রে কাঁপিয়ে জ্বর এলো বদুর। গলার কাছে মুখ রেখে ঘুমিয়ে আছে বিজু। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে। হাঁ করা মুখ থেকে গন্ধ আসছে। গন্ধটা খারাপ লাগে না বদুর। সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীরের কাঁপনে ঘুম ভাঙলো। কাতর গলায় জুলেখাকে ডাকল। বিজুর মা, ও বিজুর মা।
জুলেখার ঘুম হালকা। এক ডাকেই শুনল। কী হইছে?
কপালটায় একটু হাত দেও তো! মনে হয় জ্বর আইছে। শইল্লে বিষম ব্যথা।
ছেলের মাথার উপর দিয়ে বদুর কপালে হাত দিল জুলেখা। দিয়ে চমকে উঠল। তোমার তো বেদম জ্বর! আতকা এমুন জ্বর আইল ক্যান?
পয়লা বুঝি নাই, অহন বুঝতাছি জ্বর আইল ক্যান?
কী হইছে? ও বিজুর বাপ!
আস্তে কথা কও। পোলা জাইগা যাইব।
জুলেখা গলা নামিয়ে বলল, কী হইছে কও আমারে।
বুকে রডের খোঁচা লাগছে।
কও কী? কেমনে লাগল?
এইসব কামে খোঁচাখাঁচি লাগে। কত ব্যথা পাই! আইজ ইকটু বেশি পাইছি। অনেকখানি রক্ত বাইর হইছে।
বদু কাতর শব্দ করল।
দুইটা নাপা কিন্না খাইতা।
খাইছি। তয় আবার মনে হয় খাইতে হইব।
দিমু বাইর কইরা?
বদু উৎসাহী হলো। আছে?
আছে। আমার ঘন ঘন মাথা ধরে দেইখা আইনা রাখছিলাম।
তয় দেও দুইটা।
নাপার সঙ্গে কাঁথাটাও বের করে দিল জুলেখা। ছেলের গলার উপর দিয়ে বদুর গায়ে একটা হাত দিয়ে রাখল। বিজু এসবের কিছুই টের পেল না।
ভোররাতের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল বদুর। খোঁচা খাওয়া জায়গাটায় বেশ ব্যথা। সকালবেলা আবুল ডাক্তারকে দেখাতে হবে। কাজে বোধহয় যাওয়া যাবে না। ব্যথা বাড়ছে। ব্যথার জন্যই জ্বর।
আবুল হোসেন ডাক্তার না। একটা ওষুধের দোকান চালায় বহু বছর ধরে। বড়বোন নামকরা ডাক্তার। ওষুধের দোকান চালাতে চালাতে সেও হাফ ডাক্তার হয়ে গেছে। সাধারণ অসুখ বিসুখের ওষুধ খারাপ দেয় না। কাজ হয়। বদুর খোঁচা খাওয়া জায়গাটা স্যাভলন দিয়ে মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিল। নাপা খেতে হবে তিনবেলা। অসুবিধা নেই। ঠিক হয়ে যাবে।
বদুর সঙ্গে বিজুও এসেছিল আবুল ফার্মেসিতে। ফেরার সময় টং দোকানটায় প্লাস্টিকের লাল বলটা সে দেখল। কদিন ধরে ঘুরেফিরে দোকানটার সামনে বিজু আসে। লোভী চোখে বলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। দোকান চালায় কাশেম। এক ফাঁকে কাশেমকে জিজ্ঞেস করেছে, চাচা, বলের দাম কত?
ষাইট টেকা। তুই নিলে পঞ্চাইশ।
এত টাকা বিজু পাবে কোথায়? পাঁচ দশ টাকা হলে বাবাকে বলা যেত। মাকেও বলা যেত। তবে মা দিত না। বাবা দিত। কিন্তু পঞ্চাশ টাকা!
গতকাল বদু কাজে যাওয়ার সময় তার পিছু নিয়েছে বিজু। এখন স্কুল নেই। ছুটি চলছে। বিজু সারাদিন বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাদের মতো সময় কাটাচ্ছে। ছেলেকে সঙ্গে আসতে দেখে বদু বুঝেছে কোনও মতলব আছে। সকালবেলা খিচুড়ি আর ডিমভাজা খাওয়া হয়েছে। খিচুড়িটা দারুণ করে জুলেখা। ও রকম খিচুড়ি খাওয়ার পর এককাপ ঘন দুধের চা আর একটা সিগারেট হলে সেই গানটা মনে আসে বদুর। ‘দুনিয়াকি মাজা লে লো, দুনিয়া তুমহারি হায়।’ গানের কলিটা গুনগুন করে, সিগারেটে টান দিয়ে বদু বলল, কী বাজান?
পঞ্চাশটা টাকা দিবা?
কী? কয় টেকা?
পঞ্চাশ টেকা।
হায় হায় কও কী? পঞ্চাশ টেকা? এত টেকা দিয়া কী করবা?
বলের কথাটা বলল বিজু। বদু বলল, দশ টেকা হইলে অখনই তোমারে দিতাম বাজান। পঞ্চাশ টেকা পামু কই?
বিজু মন খারাপ করল।
মন খারাপ কইরো না বাজান। দুই তিনদিন বাদে দিমু নে। একদিন একটু বেশি কাম করলে বিশ পঁচিশ টেকা বেশি পাওয়া যায়। দুই দিন বেশি কাম কইরা তোমারে দিমু নে।
বিজু খুশি। তয় মারে কইয়ো না বাজান। মায় শোনলে রাগ করব। টেকা দিতে দিব না।
ছেলের মাথায় হাত দিল বদু। আইচ্ছা বাজান, কমু না। তয় আমি যাই। তুমি যাও, খেল গিয়া।
রেললাইন ধরে দক্ষিণ দিকে চলে গেল বদু। হাতে সিগ্রেট। বিজু ফিরে এলো বস্তিতে।
কালরাতে বদুর বেশি রাত করে ফেরার কারণটা বিজু জানে। এজন্য সে জেগেছিল। বেশি কাজ করে কয় টাকা বেশি পেয়েছে বদু সেকথা জানা হয়নি। আজ কাজে গেলে কাল হয়তো কথাটা শোনা যেত। আজ তো বদু যেতেই পারল না। বেশি কাজ করতে গিয়ে রডের খোঁচা খেয়েছে। বিজু খুবই মন খারাপ করে বদুর সঙ্গে হাঁটতে লাগল। বস্তিতে ফিরে এলো।
এগারোটার দিকে ডক থেকে ফোন এলো। বদু তার সস্তা মোবাইল ধরল। হ্যালো?
ডক সুপারভাইজার আলী আহমেদ বললেন, কী রে বদু, আসতাছিস না কেন?
আমার জ্বর।
থো তর জ্বর। কাম দেখলেই তোদের জ্বর আসে। জ্বরফর আমি বুঝি না। তাড়াতাড়ি আয়।
এভাবে কথা বললে বদুর মেজাজ খারাপ হয়। কঠিন গলায় বলল, আসতে পারুম না। একশো চাইর জ্বর।
একশো চার জ্বরের রোগীর গলা এত পরিষ্কার হয় না। আলী আহমেদ বুঝলেন বদুকে ম্যানেজ করতে হবে অন্যভাবে। গলার স্বর বদলালেন তিনি। একটু কষ্ট করে আয় বাবা। তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব। পঞ্চাশটা টাকা বেশিও দেব। আয়। দেলওয়ার সাহেবের বারোশো টনিটা ডকে উঠবে। আয় বাবা, আয়।
সকালবেলা পাউরুটি আর চা খেয়ে দুটো নাপা খেয়েছে বদু। আবুল ডাক্তার ঘা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দেওয়ার পর আরাম লাগছে। ছেলে পঞ্চাশটা টাকা চেয়েছে। আলী আহমেদ বলছেন, পঞ্চাশ টাকা বেশি দেবেন। বদু কাজে রওনা দিল।
জুলেখা মানা করল। এই শইল লইয়া যাইবা?
যাই। সুপার সাবে ডাকছেন। না গেলে দেখা গেল পরে আর কামে ডাকলেন না। কাম না থাকলে বিপদে পড়–ম। ছেলে বড় হইতাছে।
সাবধানে থাইকো।
আজ বেশি রাত হলো না ফিরতে। তবে বদু ফিরল একেবারে মুমূর্ষু ভঙ্গিতে। ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়ল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কোনও রকমে বলল, বিজুর মা, আমার মাথায় পানি দেও। যত পারো পানি দেও।
জুলেখা স্বামীর মাথায় পানি দিতে লাগল। বিজু বসে রইল বাবার পাশে। বাবার এই অবস্থা দেখে তার মন খারাপ। বাবা তাহলে পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবে না। লাল বলটা আর কেনা হলো না।
বিজুকে অবাক করে সকালবেলা তাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিল বদু। জুলেখা গেছে বাজারে। এই ফাঁকে ছেলের হাতে নোটটা দিল। জ্বর এখনও আছে। ঘায়ের ব্যথাটা বেড়েছে। হয়তো ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। হয়তো হাসপাতালে যেতে হবে। কদিন কাজে যাওয়া হবে না কে জানে। ছেলে আশা করে আছে। বলটা সে কিনুক।
টাকা পেয়ে বিজু যে কী খুশি! প্রথমে তার বিশ্বাসই হয়নি সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকার নোটটা বাবা তাকে দিয়েছে। জুলেখা বলে গেছে বাবাকে একলা রেখে সে যেন কোথাও না যায়। সে কথা মনে রইল না বিজুর। দৌড়ে এলো কাশেমের টং দোকানে। চাচা, বলটা দেও।
কাশেম পিড়িক করে পানের পিক ফেলল। পঞ্চাইশ টেকা আনছস? এক পয়সা কম হইলেও দিমু না।
না কম না। এই যে টেকা।
টাকাটা রাখতে গিয়ে কাশেম একটু চমকালো। কী রে, টেকায় দাগ কিয়ের?
কিয়ের দাগ? আমি তো জানি না। বাবায় দিল আর আমি লইয়াইলাম।
নোটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কাশেম। বিজুও দেখল। বুড়ো আঙুলের ছাপের মতো লালচে থ্যাবড়ানো একটু দাগ একপাশে। বিজু বুঝল না কিসের দাগ। কাশেম বুঝল। বুজছি, রক্তের দাগ।
হইতে পারে। বাবায় রডের খোঁচা খাইছিল।
সেই রক্তের দাগই নোটে লাইগা আছে রে ফাজিল। সমিস্যা নাই। টেকা চলব। গরিব মানুষের টেকায় রক্তের দাগ থাকেই। কোনওটা দেখা যায়, কোনওটা দেখা যায় না। নে, এই তোর বল।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে বল নিয়ে ফিরে এলো বিজু।
বাজার সেরে ফিরেছে জুলেখা। অল্প দামে একটা আধপচা নলামাছ এনেছে। একটু বেগুন, একটু আলু। এখন মাছ কুটতে বসেছে। বদু কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে চৌকিতে।
ছেলেকে দেখে খেঁকিয়ে উঠল জুলেখা। কইলাম বাপের কাছে থাক। তুই গেছিলি কই?
বলে একটা ড্রপ দিল বিজু। মার কথার জবাব দিতে ভুলে গেল।
জুলেখা অবাক। বল পাইলি কই?
পঞ্চাশ টেকা দিয়া কিনা আনলাম।
জুলেখা চোখ কপালে তুলল, পঞ্চাশ টেকা? এত টেকা পাইলি কই?
বদু উঠে বসল। ওরে বইকো না। আমি দিছি। পোলায় শখ করছে!
জুলেখা রাগে গজ গজ করতে লাগল। বদু মুমূর্ষু চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। বস্তি ঘরের সঙ্গে এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। পিছনের তেঁতুলগাছ ছায়া ফেলে রেখেছে। সেই জায়গায় লাল বলে ড্রপ দিচ্ছে বিজু। বদুর আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। জ্বরে ধীরে ধীরে অচেতন হচ্ছে সে। জ্বরের ঘোরে দেখতে পাচ্ছে বুক থেকে গলগল করে ঝরছে রক্ত। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট আছে পকেটে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে সেই নোট। লাল টক টক করছে।