মৌমিতা

দ্যাখ, আমার ছেলে হাসলে কী সুন্দর গালে টোল পড়ে। তুই হাসলে তো দাঁত সব কেলিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

বুবুর কথায় সজল অল্প হাসতে হাসতে চুপ করে থাকে। দশ বছর বয়স তার। ঠিক বুঝতেও পারে না, কী উত্তর দেবে। কিন্তু সেদিন থেকে বুঝে যায় এই পৃথিবীতে তাকে পছন্দ করবে না এমন লোক থাকবে। বুবুর এই তুলনামূলক কথাটি তাকে বুঝিয়ে দিল আরেকটি দর্শন : জগতের সব কিছু তুলনার ব্যাপার। বুবুদের বাসা নীল রঙের একটা দোতলা বাড়ি। হাজির পাড়ার মোড় থেকে পিচ ঢালা গলিটা দ-এর মতো এঁকেবেঁকে মোগল পাড়ায় ঢুকেছে। সজলের বুবুর মুখে তুলনার অপমান সইবার সময় মোগল পাড়ায় ঐ নীল রঙের দোতলা বাড়িটাই ছিল সবচেয়ে উঁচু নিশানা।

কিন্তু চার দশক পার হয়েছে। সে বুবুও নেই, বুবুর যে ছেলের সঙ্গে তুলনাটা হয়েছিল সে ছেলেও নেই, নীল রঙের বাড়িটা এখন দশতলা ফ্ল্যাট বাড়ি, তারই একটির মালিক সাত তলায় আমাদের গল্পের অন্যতম নায়ক সজল চৌধুরী, যাঁর আসল নাম মফিজুর রহমান চৌধুরী, যিনি এখন ষাট বছর বয়স হলেও মোটেও বুড়ো হননি, উদরের স্ফীতি দাঁড়ান অবস্থায় তাঁর হাঁটু যুগলকে আড়াল করতে পারেনি। সজল ডাকনাম থেকে আসল নাম হয়ে যাবার পেছনে লেখক হবার বাসনাটা কাজ করেছিল। মফিজুর রহমান অংশটি বাদ দিয়ে তিনি সজল লাগালেন চৌধুরীর সঙ্গে, বাস একটা গ্রহণযোগ্য লেখক নাম যেন তৈরি হলো তাঁর। তবে বয়স হওয়ায় তাঁর কেলানো দাঁত আরো খানিকটা বেরিয়েছে যে জন্য মনে হয় সজল চৌধুরী যেন সবসময় হাসছেন।
এতে তাঁর সুবিধা হয়েছে সামাজিক জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে। সবাই মনে করেন হাসিখুশি মানুষ তিনি। আর নিজের পেশা শিক্ষকতা হলেও সজল চৌধুরী চূড়ান্তভাবে আত্মপ্রচারকামী। সে জন্য তিনি সমাজে ওপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজে ছকটা তৈরি করে নিয়েছিলেন এরকম : যেটি তাঁর মন চায় সেটি তিনি করতেন না, কিন্তু যেটি করলে তাঁর সামাজিক ও বৈষয়িকভাবে উন্নতি হবে সেটিই তিনি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রথম জীবনে তিনি যখন শিক্ষক লাউঞ্জে তাঁর সমবয়সী এবং সমপদের শিক্ষকদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, তাঁর সবসময় নজর থাকত লাউঞ্জে বিশিষ্ট প্রবীণ কোনো অধ্যাপক ঢুকলেন কি না। শুধু প্রবীণ হলে হতো না, তাঁদের দেশজোড়া নাম থাকতে হতো। তখন সামান্য উসিলায় তিনি সমগোত্রীয়দের সঙ্গ ছেড়ে আস্তে করে ঐ প্রবীণ শিক্ষকের সোফা ঘেঁষে দাঁড়াতেন। তাঁর মেধাটা ছিল চকমকি পাথরের মতো সদা তৈরি, ঘষা দিলে যেন প্রজ্বলিত হবে। ‘স্যার, সালেমালেকুম, কেমন আছেন, স্যার’। প্রত্যুত্তরে প্রবীণ শিক্ষক হয়তো চোখ তুলে তাকালেন, ভদ্রতা করে হাসি দিলেন, বললেন, ‘ওয়ালেকুম সালাম, কেমন আছো তুমি?’ ‘জি, ভালো স্যার,’ সজলের ত্বরিত উত্তর। তারপর সজলের প্রবীণ শিক্ষককে চমকে দিয়ে মজা দেখার কথা। মানুষকে অপ্রস্তুত করে দেওয়া, তাকে বোকা বানানো, সজলের প্রিয় বিষয়। ‘স্যার, শুনেছেন, বাংলা একাডেমির এবারের সাহিত্য পুরস্কার কে পেয়েছেন?’ প্রবীণ অধ্যাপক আবার মাথা তুলে তাকালেন। ‘না তো,’ পত্রিকা দেখার সময় পাইনি, বিটিভি’র নিউজেও তো কিছু বলেনি’। ‘স্যার, নিউজে এখনো আসেনি, তবে আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি যে এবার পুরস্কারটা শাহিদা খাতুন নামক এক মফস্বলের লেখিকা পেয়েছেন।’

প্রবীণ অধ্যাপক : শাহিদা খাতুন কে? এ নাম তো আগে কখনো শুনিনি! তোমরা শুনেছ নাকি?

সজল চৌধুরী : স্যার, উনি শিশুদের পত্রিকায় লিখতেন। এর মধ্যে একটা ঢাউস উপন্যাস লিখেছেন ‘পারাপার’ নামে। বড় কথা স্যার, উনি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর চাচী।

প্রবীণ অধ্যাপক : বাংলা একাডেমির পুরস্কারেও রাজনীতি? এ্যা হে, এ দেশটার কিচ্ছু হবে না। তো ‘পারাপার’ উপন্যাসটা তুমি পড়েছ?

সজল চৌধুরী : না স্যার, রিভিউ পড়েছি। রিভিউয়ার বলেছেন যে উপন্যাসটিতে কিছুই নেই, সাবানের ফেনা ছাড়া।

প্রবীণ অধ্যাপকের মনে কাটল কথাটা। এ সাবানের ফেনা লিখেও যদি তিনি কোনো একটা পুরস্কার পেতেন!

হতাশা চেপে বললেন, তোমাদের রাজনীতির খবর কি? শুনেছি, পে-স্কেলের প্রতিবাদে নাকি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ?

ছানু ভাইয়েরা তো তাই বলছেন। তবে স্যার, এটা আমাদের কোনো ব্যাপার না। আমরা প্রভাষক, কবে অধ্যাপক হব, তার ঠিক নেই। তাই সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে দল ভারী করার জন্য ঢাকায় যাব। ভিসি স্যার নাকি ইউনিভার্সিটির দুটো বাসের অনুমতি দিয়েছেন।

প্রবীণ অধ্যাপক : এখন তো সামরিক শাসন চলছে, নামকা ওয়াস্তে একটা সংসদ আছে। তাই সিভিল আর সামরিক আমলাদের সমান আমাদের বেতন হবে আমার মনে হয় না।

সজল চৌধুরী : এটা তো আপনি বোঝেন স্যার, কিন্তু ছানু ভাইয়েরা এই যুক্তিটা মানতে চাইছেন না। ধরুন স্যার, সিভিল আর মিলিটারি মিলে সর্বোচ্চ গ্রেড পাবেন ক’জন মাত্র? বড়জোর দশজন। কিন্তু সারা দেশে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সংখ্যা শপাঁচেক হবে। তো শপাঁচেক লোককে কি সর্বোচ্চ গ্রেড দেবে নাকি সরকার? আপনার কথা আলাদা, আপনি সর্বোচ্চ গ্রেড পেতেই পারেন, কিন্তু স্যার, সব অধ্যাপক তো একই রকম যোগ্য নন।

প্রবীণ অধ্যাপকের মনে আবার খটকা লাগল। তাঁরই এককালের ছাত্র, এখন সহকর্মী, কিন্তু কথা খুব সহজভাবে বললেও কোথায় যেন একটা খোঁচা থাকে। তাঁর নিজের যে পিএইচডি ডিগ্রি নেই, প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র একটি, এবং তিনি যে সরকারি কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন এবং সে জন্য যে অন্যান্য সহকর্মীদের উপেক্ষা চাকরিকালীন সহ্য করে যাচ্ছেন, সর্বোপরি তাঁর ক্লাসে যে ছাত্রছাত্রী প্রায় হাজিরই থাকে না, এইসব অনুভূতি থেকে তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে সজল তাঁকে সকাল বেলাতেই খোঁচা দিয়ে যাচ্ছেন।

খানিকটা বিরক্ত হয়ে তিনি সোফা থেকে উঠলেন, কারো সঙ্গে আর সৌজন্য বিনিময় না করে লাউঞ্জ ছাড়লেন।
২.

প্রবীণ অধ্যাপকের নাম সঈদুর রহমান। সজল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সময় বাংলাদেশে সামরিক শাসন চলছিল। তখনই সঈদুর রহমান বাষট্টি অতিক্রান্ত করছিলেন। আর তিনটি বছর হলেই তাঁর অবসর জীবনের শুরু হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চাকরি করছিলেন সেটির প্রথম দিককার শিক্ষকগণের মধ্যে একজন তিনি। সরকারি কলেজ থেকে সহকারী অধ্যাপকের পদ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর পিতা তখন বেঁচেছিলেন। বলেছিলেন, আমার এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এটা তো আমার পরম গর্বের ব্যাপার। সঈদুর পরিশ্রমী ছিলেন, কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করতেন না। বাংলা বিভাগে তাঁর চেয়ে সাহিত্যের ব্যাপারে উৎসাহী অন্য কোনো শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু কী একটা রহস্যের কারণে তিনি ঠিক কেন্দ্র আলোকিত করতে পারতেন না। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা আড়ালে বলত, স্যারের মনোযোগের অভাব; আর তাঁর সহকর্মীরা বলতেন, সঈদুর বই একটা লিখবেন, কিন্তু সেটা যে কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। বিভাগে তাঁর শিক্ষকস্থানীয় সহকর্মীরা বলতেন, তুমি এত ভ্যাচর ভ্যাচর না করে একটু লিখতে পার না। ‘কি যে বলেন স্যার, লিখছি তো, নাটকের ইতিহাসের ওপর একটা বড় বই লিখছি। প্রকাশকও পেয়ে গেছি। ফার্স্ট ড্রাফটটা শেষ করে নিলে, প্রথমে আপনাকে দেখাব স্যার।’ শিক্ষক গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘দেখিও’। সাথে সাথে বললেন, ‘দেখ, তিন মাস পরে আবার একই কথা বল না।’

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, সে তিন মাস কেন, পরে ত্রিশটি বছর তিনি পাক্কা চাকরি করে গেলেও, বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকে পরিণত হলেন, কিন্তু সে নাটকের ইতিহাসের বইটি আর বের হয়নি।

লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে সঈদুর রহমান বাস ছাউনির দিকে গেলেন না। গায়ের খয়েরি রঙের শালটা পিঠের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আরেকটা টান দিলেন। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক হলেও শীত ছেড়ে যায়নি। তিনি কলা ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে একটা মেঠোপথ বেছে নিলেন। উপাচার্য মহোদয়, অধ্যাপক মবিনুল হক ভীষণ বৃক্ষপ্রেমিক, যদিও তাঁর পক্ষে যত লোক তার বেশি তাঁর বিপক্ষে। তাঁর অনুসারী কিছু শিক্ষককে দিয়ে তিনি গ্রিন ক্যাম্পাস নামক ক্যাম্পাসজুড়ে সবুজ বনায়ন কর্মসূচি শুরু করেছেন। মেঠোপথটি শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার দিকে গেছে। উপাচার্য রাস্তার দু’পাশে বনজি গাছ লাগিয়ে একটা ছায়াঢাকা পথ তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু মূল সড়কটি পাকা এবং সেটি অনেকখানি ঘুরে দক্ষিণ দিক থেকে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে। সঈদুর রহমান ক্লান্ত পায়ে হাঁটছিলেন। পথে মেহগনি গাছের কিছু ঝরাপাতা পড়েছিল। সজলের বাংলা একাডেমি পুরস্কারের খবরটা তাঁর বুকটা যেন এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিল। কেন যেন তিনি কবি নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতার দু’টি চরণ আওড়ালেন: ‘আশিটি বছর কেটে গেল প্রভু, ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করো নি কভু।’

শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা রাস্তার দু’পাশে দোতলা বাড়ির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে। গোটা দশেক বাড়ি রাস্তার এ পাশে, গোটা দশেক বাড়ি রাস্তার ওপাশে। প্রতিটা বাড়ির আঙিনা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রতিটা বাড়ির ফটকে লেখা আছে দু’জন করে শিক্ষকের নাম। অধ্যাপক ড. অমুক, ১, অধ্যাপক ড. অমুক, ২। দেয়াল ঘেঁষে আঙিনার ভেতরে ফলদ গাছের চাষ লক্ষ করা যায় কোনো কোনো বাড়িতে। রসায়নের ইসতিয়াক সাহেব আর তাঁর স্ত্রী হুসনেয়ারা দু’জনেই অধ্যাপক এবং বৃক্ষপ্রেমী, তাই উপাচার্য মহোদয়ের খাস লোক বলে বিবেচিত। দু’জনেই তাঁদের বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলাবলি করছিলেন, আর দু’জনের হাতেই একটি করে সাদা ফুল।

হুসনেয়ারার বয়স হলেও আগের মতোই প্রগলভ রয়ে গেছেন। কণ্ঠস্বর ঠিনঠিনে। বললেন, হুর রে, সঈদুর ভাই, আপনিই প্রথম দর্শক যাঁকে আমরা নাইট কুইন ফুল দেখাতে পারছি।

সঈদুর দাঁড়িয়ে গেলেন। অবাক বিস্ময়ে বললেন, এ সে বিখ্যাত নাইট কুইন। চমৎকার তো! দু’জনের হাতে ধরা ফুল দু’টি তিনি পরম স্নেহে ছুঁয়ে দিলেন। বললেন, ভাবী, পারেনও বটে আপনারা। জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই, শেষ পর্যন্ত নাইট কুইনও পেলেন!

-বাসায় যাচ্ছেন, ভাবী অপেক্ষা করছে বুঝি? আমাদের এখানে একটু বসেন, চা-টা খেয়ে যান।

-না ভাবী, বুঝছেন তো গলায় টান পড়েছে। ক্লাস শেষ হয়েছে আমার এগারটায়। এখন বাজে একটা। বুড়ি ভাববে, বুড়োটা গেল কই? তো রশি ধরে টান দেবার আগেই আমি পৌঁছে যাচ্ছি।

-ভাবী টেনশন করবেন? যান, যান। বাহ্্ বা, কী যে প্রেম!!

ইসতিয়াক সাহেব কম কথা বলেন, কিন্তু সারা গালে মৃদু হাসি ছড়ানো। তাঁর এই অভিব্যক্তির জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই জনপ্রিয়। রাজনৈতিক সব শলাপরামর্শের জন্য শিক্ষক নেতা ছানু অর্থাৎ ছানোয়ার আলমসহ সবাই তাঁর সঙ্গে শেষ আলাপটা করবেই।

কিন্তু সঈদুর ইসতিয়াকের এই অভিব্যক্তিকে মনে মনে ফাঁকিবাজি মনে করেন। বিশেষভাবে চিন্তা করলে এটি আসলে সুবিধাভোগী চরিত্রেরই প্রকাশ।

-সঈদুর ভাই, শিক্ষক সমিতি তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছে পে-স্কেল নিয়ে। ভিসি স্যার জ্বালানি সরবরাহের ভিত্তিতে দু’টো বাস দিয়েছেন। যাবেন নাকি ঢাকায়।

-আপনি যাচ্ছেন??

ইসতিয়াক বললেন, আমরা দু’জনেই যাচ্ছি।

সঈদুর বললেন, মন ঠিক করতে পারছি না। ঢাকায় আমার এমনি যাওয়া দরকার। কিন্তু গ্যাদারিংয়ের মধ্যে যেতে চাই না।

-চলেন, চলেন, দলবেঁধে গেলে খারাপ লাগবে না।

-দেখি। সঈদুর আবার পথ চলা শুরু করলেন। বললেন, নাইট কুইন দেখানোর জন্য ধন্যবাদ।।
আনমনে আরো কয়েকটা বাড়ি ছেড়ে তিনি দক্ষিণ ফটক দিয়ে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ছেড়ে বের হয়ে এলেন। এবার মেঠোপথ আবার শুর হলো। বাম দিকে উঁচু একটি টিলা। টিলাটার কিছুই দেখা যায় না। বড় বড় সেগুনগাছের বন। এত ঘন যে ক্যাম্পাসের বাচ্চারা এ টিলাতে খেলতেই ভয় পায়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের দুরন্ত শিশুরা এখানেই সবসময় খেলায় মেতে থাকে। তাদের পাহারায় বিচরণরত গরুগুলো কখন যে ঘাস খেতে খেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ে তা খেলারত রাখাল বালক-বালিকার নজরে থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে প্রতি অপরাধী গরুর জন্য দশ টাকা জরিমানা, আর ছাগলের জন্য পাঁচ টাকা। (প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে সামরিক শাসনের সময় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে জরিমানার হার তাই ছিল।) এটা দেওয়া না দেওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও গ্রামবাসীর মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ইতিহাস কম নয়। বহু কুরুক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার সরাসরি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও যে হয়নি তা নয়। তারপরও সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টা চলছে।

এই টিলার নাম সেগুন টিলা। বলাবাহুল্য সঈদুর রহমানের দেওয়া নাম। যদি জীবনে কখনো তিনি একবার কলোম্বাস হয়ে থাকেন, তা হলে সেই একদিনেই হয়েছিলেন, যেদিন তিনি পুরোনো কলা ভবন ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এখন যেখানে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা হয়েছে, যেটা তখন ছিল একটা খালপাড়ের বালিয়াড়ি শুধু, সেটা পার হয়ে এই টিলার ওপর উঠেছিলেন, সেগুনের চারাগুলো কেবল মাটি থেকে দুই ফুট উঠেছিল, আর টিলার গা বেয়ে একটা স্রোতস্বিনী বালিয়াড়িতে পথ খুঁজে নিয়েছিল, কিন্তু যে স্রোতস্বিনীটি যেদিন তিনি টিলার গা বেয়ে চূড়ায় উঠছিলেন সেদিন ছিল শুষ্ক। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তিনি দিগন্ত দেখলেন, কাছের গ্রাম থেকে দূরের গ্রামগুলো ক্রমশ দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া দেখলেন, এক একটা গ্রামের ফাঁকে ফাঁকে প্রান্তরময় ধানি জমিগুলো যেন তাঁকে ইশারা দিয়ে ডাকছে, আয়, আয়। তিনি পুনরায় এসেছিলেন, ঐ পুরো টিলাটার একটা অংশ কিনে নিয়েছিলেন খুব সামান্য দামে।

বশির আলী, যিনি নাকি দূতিয়ালি করে টিলাটা তাঁকে কিনতে সাহায্য করেছিলেন, যিনি এখন বেঁচে নেই, যাঁর খুব কাশি ছিল, কাশতে কাশতে বলেছিলেন, স্যার, টিলাটা আপনি একটা পোলাপান হইবার মতো করে পাইলেন। তারপর তাঁর কাশি। কাশতে কাশতে তিনি মোড়ার ওপর থেকে যেন মেঝেতে পড়ে যাবেন, আর সঈদুর ভাবলেন তিনি চেয়ার থেকে উঠে তাঁকে ধরবেন কিনা।

বশির আলী কাশি একটু থামাতেই তাঁর খাঁকি শার্টের বুক পকেটের কাছে এক বিন্দু ছোট লাল ফোঁটা দেখা গেল।

চমকে উঠে সঈদুর বললেন, রক্ত নাকি?

বশির আলী কাশির গমক ভিতরে টেনে নিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ পেলেন। মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, রক্ত নয়। ঘড়ঘড় করতে করতে বললেন, পানের পিক।

বশির আলীর বাড়িটা গ্রামের একেবারে মাঝখানে। সঈদুর বশির আলীর পেছনে পেছনে অনেকগুলো বাড়ির সামনে দিয়ে, অনেকগুলো বাড়ির পেছন দিয়ে, আবার দুই বাড়ির মাঝখান দিয়ে এক হিজিবিজি ভ্রমণ শেষ করে বশির আলীর বাসায় পৌঁছেছেন। একটি দু’চালা খড়ের ঘরের দাওয়ায় তাঁকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আর নিজে একটি মোড়ার ওপর বসে টিলাটা কেনার ব্যাপারে আলাপ শেষ করেছিলেন বশির আলী।

সেদিনের ঐ রক্ত-থুতু বের হবার পর বশির আলী দু’মাসও সময় পাননি। পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ডুব দিয়ে আর উঠতে পারেননি। তাঁর লাশ ধোয়ার সময় সঈদুর ছুটে এসেছিলেন যতটা না মৃতের প্রতি সমবেদনা জানাতে, তার চেয়ে বেশি টিলার কাগজটিতে বিক্রেতার সই আছে কিনা সেটি জানতে। বশির আলীর বউ চোখের জল মুছতে মুছতে তাঁর হাতে কাগজখানি দিয়েছিলেন। কাগজখানি পাঞ্জাবির পকেটে পুরে বশির আলীর দাফনসময় পর্যন্ত থেকে তারপর সঈদুর ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে। তারপরদিন থেকে টিলার ওপর তাঁর ইটের দেয়াল টিনের চালার চার কামরাবিশিষ্ট বসতবাটি তৈরি হতে থাকে। সাত দিনের মাথায় সেটি শেষ হলে তিনি তাঁর স্ত্রী জাহিরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে উঠে আসেন টিলার ওপরে বসবাসকারী প্রথম মানুষ হিসেবে। এরপর টিলার ওপর আরো জনা তিনেক শিক্ষক বাড়িঘর তৈরি করেন, এমনকি সেগুন বাগানের ফাঁকে ফাঁকে টিলার খাঁজে খাঁজে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী স্তরের জনা বিশেক পরিবারও নিজ নিজ খরচে ঘর তুলে থাকা শুরু করে, কিন্তু সঈদুরের কলম্বাসের মর্যাদা এতে ঘুচে যায় না।

ক্লান্ত পায়ে সেগুন টিলার কাঁচা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে উঠতে সঈদুর ভাবলেন, পঁয়তাল্লিশ বছর আগের তাঁর এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী মনে হয়েছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন চাকরির এই শেষ প্রান্তে এসে তাঁর মনে হলো সজল চৌধুরীর খোঁচাটা তাঁকে খেতে হতো না, যদি তিনি কোথাও পৌঁছে থেমে না যেতেন।
৩.

সজল চৌধুরী যে কাউকে ইচ্ছা করে খোঁচা মারেন তা নয়। যেমন তাঁর অগ্রজ সহকর্মী দ্বিজেন দাশ একবার বলেছিলেন, আপনি যে মানুষকে ভেতর থেকে অপছন্দ করেন, সেটিই আকারে-ইঙ্গিতে আপনার কথায় বের হয়ে আসে। তখন সজল চৌধুরীর জীবনে তাস খেলার পর্ব যাচ্ছিল। হাতের তাস দান দেবার মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলেন তিনি। বলেন কি, আমি সারা জীবন মানুষকে ভালোবেসে ছন্ন ছন্ন হয়ে যাচ্ছি, আর আপনি বলেন কি না আমি মানুষকে ঘৃণা করি। দ্বিজেন দাশ অকৃতদার, তাঁর ঠোঁটকাটা কথার জন্য এক কথায় ক্যাম্পাসে সবাই যেমন তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, তিনিও সবার তাই। বললেন, আপনি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসেন না, এমনকি আপনার স্ত্রী-সন্তানদেরও না। দ্বিজেন দাশের সঙ্গে এই কথাগুলো হচ্ছিল যখন পে-স্কেলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অসমতা ও অসম্মানজনক হারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শিক্ষকরা দু’টো বাস নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুরূপভাবে শিক্ষকরা জমায়েত হয়েছিলেন ঢাকায়। ঢাকাস্থ সজলদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনা অতিথি ভবনে এই তাস খেলা চলছিল, আর দ্বিজেন দাশের কথায় উদ্বেলিত হয়ে হাতের দান ফেলা থেকে বিরত থেকে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সজল।

চির অকৃতদার দ্বিজেন দাশের চোখে ভারী পুরু চশমা। চোখের মধ্যে সারাক্ষণ নিদ্রাতুর ভাব। গাল আকামানো। শরীরের ওপর অত্যাচারের বহুমাত্রিক চিহ্নবিশিষ্ট দ্বিজেন তাসের টেবিলের প্রাণকেন্দ্র। তিনি যেমন সারাক্ষণ সবার সঙ্গে ঝগড়া করতে ব্যস্ত থাকেন, তেমনি তিনি না থাকলে তাসের আসর থাকে ম্যাড়ম্যাড়া। কিন্তু আজকে সজল চৌধুরী এসপার ওসপার একটা করতে চান। কারণ দ্বিজেনের অভিযোগ তিনি মনের ভেতরে টের পান আসলেই সত্য। সজল চৌধুরীকে তাঁর বুবু যেদিন বলেছিলেন যে কথা বলার সময় তাঁর সব দাঁত বেরিয়ে পড়ে, সেদিন থেকে সজল বুঝে গিয়েছিলেন যে এ জীবনে লোকে তাঁকে ভালোবাসবে না, কাজেই তাঁকেও লোককে ভালোবেসে কাজ নেই। তাই অনেকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, দ্বিজেন দা, প্রমাণ দিন যে আমি মানুষকে ঘৃণা করি।

দ্বিজেন দা বললেন, আমি আপনাকে একদিন বাসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সবচেয়ে প্রিয় কে? আপনি উত্তর দিতে পারেননি। আমি যতটুকু জানি, আপনার একটি ছোট্ট ছেলে রয়েছে। লোকে সচরাচর এসব প্রশ্নের উত্তরে নিজের বাচ্চাদের কথা বলে ফেলে। আরেকটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি, যদি অনুমতি দেন বলি।

তখন দ্বিজেন টেবিলের অন্যদের লক্ষ করে বললেন, দেখুন তো সজল ভাইয়ের চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে, কেমন যেন একটা নিষ্ঠুরতার আভাস পাওয়া যায় না?

সজল ঢোক গিললেন, দ্বিজেন যেন তাঁর মন পড়ছেন। অন্যদিকে হেলাল বংশী পরিবেশ সহজ করার জন্য বললেন, আরে বাদ দেন তো, দ্বিজেন দা, খালি প্যাঁচাল পাড়েন। নিজের তো লাভের লাল গুটি জমতে জমতে পাহাড়, তাই এখন অন্যদের আক্রমণ করা শুরু করেছেন।

যে কজন খেলা দেখছিলেন, কিন্তু খেলছিলেন না, তাঁদের মধ্যে শহীদুল্লাহ রহিম শিক্ষক সমিতির দপ্তর সম্পাদক, তিনি বললেন, দ্বিজেন দা, এভাবে স্ট্রেইট কথা বলতে নেই। আমরা সবাই দোষেগুণে মানুষ। সজলের মতো ভালো আদর্শবান কর্মী আমাদের দলে খুব নেই। শুধু মাঝে মাঝে আপসকামী হয়ে পড়ে, এই যা।

শহীদুল্লাহ রহিম বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর চরিত্রে দু’টো গুণই আছে— খুব সিরিয়াস, আবার খুব রসিক। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। একটা মজার ব্যাপার হলো তিনি সবসময় তাসের টেবিলে উপস্থিত থাকেন দর্শক হিসেবে, কিন্তু কখনো খেলেন না। তাঁকে সবাই সম্ভ্রম করে কথা বলেন। তাই তাঁর মন্তব্যের ওপর সজল ভেবেছিলেন তিনি চুপ করে থাকবেন, কিন্তু দ্বিজেনের খোঁচায় তিনি তপ্ত হয়ে আছেন। বললেন, স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনার এই মন্তব্যের সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। আমি আপসকামী নই, বলতে পারেন বাস্তববাদী।

শহীদুল্লাহ রহিম বুদ্ধিমান এবং জনপ্রিয় শিক্ষক। মুচকি হেসে বললেন, আরে বাদ দাও তো, খেল তুমি, এমনিতেই মার খাচ্ছ, লাল গুটি একটাও নেই। আর কত লস দেবা। খেল।

-না, স্যার, আপসকামিতা আর বাস্তববাদিতার মধ্যে তফাৎ আছে। গতকাল যখন আমরা সংসদ ভবনে গিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছিলাম, তিনি সমস্তক্ষণ শুনে গেছেন, প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বলেননি। চা খাইয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। এতে কী সিগন্যাল পেলাম আমরা! হয়, সরকার আমাদের দাবির ব্যাপারে রেসপন্সিভ নয়, কিংবা সরকার আমাদের আন্দোলনের শক্তিটা দেখতে চায়। ইতোমধ্যে আমরা শুনেছি, শিক্ষা উপমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় শিক্ষকদের ‘স্যার-টার’ ডেকে পটিয়ে ফেলেছেন। দেখেছিলেন, কালকে সংসদে যখন গেলাম, রাস্তাঘাটে সবসময় গলা চড়িয়ে কথা বলেন এরকম প্রফেসর ক’জন উপস্থিত ছিলেন! অথচ আপনারা সুদূর অন্য একটা শহর থেকে সড়ক পথে এসে ঢাকায় কষ্ট করে থেকে সব জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করছেন, কিন্তু ফলাফল কোন দিকে যাচ্ছে? আমি তার কথাই বলছিলাম। আপসের কথা বলি নি, সারা জীবন আমি আপস না করেই বড় হয়েছি, কাজেই আমাকে ঐ অপবাদ দেবেন না, স্যার।

শহীদুল্লাহ বুঝলেন, তাঁর অনুজপ্রতিম সহকর্মীর কোথাও লেগেছে। তিনি চুপ করে গেলেন। খেলা আবার শুরু হলো। এবার আরেকটা গোলমাল লেগে গেল। রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হোসেন আদমানির হাত ছিল ব্লুক। কিন্তু তিনি পয়েন্ট দেখালেন মাত্র পাঁচ। সজল লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বললেন, স্যার, আপনার সেকেন্ড রান কই?

অধ্যাপক হোসেন আদমানি একটু সলজ্জ হাসি দিলেন। তিনি যে পয়েন্ট চুরি করেন এ কথা টেবিলের সবাই জানেন। কিন্তু তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক বিধায় সবাই তাঁর হাতের তাস নিরিখ করেন না। কিন্তু আজকে সজল চৌধুরী তেতে আছেন। সবকিছুতে তিনি আপসবিহীন। হোসেন আদমানি ধরা খাবার পর যখন বললেন, থিভিং ইজ পার্ট অব দ্য গেইম, তখন হঠাৎ যেন সজল ফেটে পড়লেন।

-হ্যাঁ, চুরি খেলার অংশ? তাই? আমি তো মনে করি, যে খেলায় চুরি করে, সে অন্যত্রও চুরি করে। খাতা না দেখে নম্বর দেওয়া এটা তো আপনাদের বিভাগেরই দস্তুর, তাই না?

-শাট আপ। হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন আদমানি। ওয়ান ওয়ার্ড মোর, আইল জাস্ট থ্রো ইউ আউট।

-হোয়াট! লাফ দিয়ে উঠলেন সজল। চুরি করবেন, আর ইংরেজিতে গালি পাড়বেন, হবে না। এসব হবে না। এ বলে তিনি টেবিলের তাসগুলো ছিটকে বাইরে ফেলে দিলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে কোনার একটা সোফায় ঝট করে বসে হাঁপাতে লাগলেন। অন্যরা হঠাৎ কী হয়ে গেল বুঝতে না পেরে যে যাঁর শোবার কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

সজল ঢাকাস্থ অতিথি ভবনে এলেও ঢাকায় এসে তিনি তাঁর চাচা শ্বশুরের বাসায় থাকেন মোহাম্মদপুরে। তাঁর মেজাজ নামতে সময় লাগছিল। কেয়ারটেকার রহম এসে সভয়ে বলল, স্যার, চা-কফি কিছু দেব?

সজল বললেন, গুল্লি মার, চা-কফির, যতসব বদমাশের দল শিক্ষক সেজেছে। যাই আমি।
৪.

সজল ঘর থেকে বের হয়ে লিফট বেয়ে নিচে নেমে মূল ফটক দিয়ে অন্তর্হিত হবার আগেই অধ্যাপক শহীদুল্লাহ রহিম, হোসেন আদমানি আর দ্বিজেন দাশ একটি মিনি বৈঠকে বসলেন।

-সজলের প্রতিক্রিয়া হালকাভাবে নিলে হবে না। শহীদুল্লাহ ভাবগম্ভীর স্বরে আরো বললেন, হয়তো আমাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জুনিয়র শিক্ষকরা তেমন একান্ত বোধ করছে না। বাসে করে ঢাকায় আসার আনন্দে বেশিরভাগ জুনিয়র টিচাররা যোগ দিয়েছে। লক্ষ করেননি, আমরা যে বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছি আমাদের দাবি নিয়ে সেখানে ঢাকাস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষকরা বলতে গেলে নেই।

-সিনিয়র শিক্ষকরাও বা কই? আদমানি বললেন। দেখেননি, সজল এর মধ্যে শিক্ষকরা পটে যাবার তথ্য দিয়েছেন।

-আমাদের আন্দোলনের দু’টো সমস্যা আমি দেখতে পাচ্ছি। এক হচ্ছে, আমরা সর্বোচ্চ গ্রেড দাবি করছি অধ্যাপকদের জন্য, যেটি যাঁরা অধ্যাপক নন তাঁরা খুব সহজে সমর্থন দিচ্ছেন তা নয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যে যাঁরা বেশ প্রবীণ তাঁরা শিক্ষা উপমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বিধায় আন্দোলনের ধার কমে যাচ্ছে। শুনেছি, শিক্ষা উপমন্ত্রী তাঁর এককালীন বিভাগীয় শিক্ষকদের শুধু নয়, অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে অত্যন্ত প্রবীণ এবং দেশবরেণ্য অধ্যাপকদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির একটি সৌজন্য সাক্ষাৎকারের ব্যব¯স্থা এর মধ্যে করে ফেলেছেন।

শহীদুল্লাহর কথা শেষ হলে, দরজায় টোকা পড়ল। দ্বিজেন দরজা খুললে রহম বলল, স্যার, কদম স্যার, ইসতিয়াক স্যার আর হেরেম্ব স্যার আসছেন, এখানে ডেকে আনুম।

আদমানি বললেন, তোমাকে ডাকতে হবে না, আমি ডেকে নিয়ে আসছি।

অধ্যাপক কদম আলী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। আর অধ্যাপক হেরেম্ব মিত্র ঢেঁড়শের পাতায় ছত্রাক ধ্বংস করার পদ্ধতি বের করে আন্তর্জাতিক একটি বিজ্ঞানী সংস্থা থেকে পুরস্কার পেয়েছেন, এবং প্রতিবারই একুশে পদক ঘোষণার আগেভাগে জোর গুঞ্জরন ওঠে যে তিনি শিক্ষকতায় একুশে পদক পাবেন। আর ইসতিয়াক সাহেব নাইট কুইন ফুটিয়ে এর মধ্যে ক্যাম্পাসে নাম কুড়িয়েছেন।

অধ্যাপক কদম আলী স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত জীবনে কখনো দ্বিতীয় হননি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পিইচডি করেছেন মানবসম্পদ বিষয়ক একটি গবেষণা করে। সেখানেও শিক্ষকতা করেছেন বছর দশেক। কিন্তু একদিন দেশের কথা মনে পড়লে, ‘দেশকে তো কিছু দিতে হবে’ এই বিবেচনায় তিনি দেশে ফেরত আসেন। এটি সজল চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার বহু আগের ঘটনা এবং সঈদুর রহমানের যোগদানের কিছু পরের ঘটনা। দেশে ফেরত এসে অধ্যাপক কদম সহসা আবিষ্কার করলেন, যে অর্থে তিনি দেশ সেবা করবেন বলে ফেরত এসেছিলেন, সেরকমভাবে কাজ করবেন তার কোনো পরিবেশ নেই। প্রথমে লাগল তাঁর বিলাতি স্ত্রী ক্যারেনের সঙ্গে। বেচারি বেশ কয়েক মাস চেষ্টা করেছিলেন স্বামীর স্বপ্নের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে থেকে যেতে। তখন তাঁর পেটে বাচ্চা। অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে একদিন তিনি সন্ধ্যার একটি ফ্লাইটে বিলাত চলে গেলেন। সেই যে গেলেন, আর এলেন না।

আর এদিকে দেখা গেল, কদম আলী গবেষণায় সময় না দিয়ে সর্বক্ষণ শিক্ষক লাউঞ্জে বসে আছেন। সবকিছুর বিরুদ্ধে যেন তাঁর বিদ্রোহ। সরকারের সমালোচনায় তিনি মুখর, আর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সহকর্মীদের ওপর যে কোনো বিষয়ে চড়াও হতে তাঁর যেন আপত্তি নেই। তাঁর চরিত্রের এই আক্রমণাত্মক দিকটি সম্পর্কে সজাগ হতে প্রথম প্রথম তাঁর সহকর্মীদের সময় লেগেছিল। কারণ তাঁর বিদ্যার জোরে তিনি এতটা বিখ্যাত ছিলেন যে তাঁর মুখের ওপর সহজে কেউ মুখ খুলত না। পরে পরে বোঝা গেল তিনি তাঁর অধিত বিষয়ে যত না প্রখর তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের জন্য। কঠোর নীতিবান এবং সচ্চরিত্র ও জেহাদি মনোভারে জন্য কদম আলীকে সবাই ভয় পেলেও তাঁর অনুসারীও হয়ে উঠলেন অনেক শিক্ষক। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তিনি প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিশাল ব্যবধানে উপর্যুপরি দু’বার জিতেছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং সে হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনেরও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, ফলে সামরিক সরকারের ঘোষিত বেতন নীতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন বেগবান হতে দেরি হয়নি।

অতিথি ভবনের কক্ষগুলো ছোট ছোট, এক জোড়া খাট, মাঝখানে হেড টেবিল আর দু’টো হাতলওয়ালা চামড়া মোড়ানো চেয়ার। টেবিলের ওপর পানির বোতল আর একটা পুরোনো টেলিফোন সেট, যেটা কোনোদিনই বাজে না। উপাচার্য মবিনুল হকের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব। ভাবলেন যে ঢাকায় ভাড়া করে অতিথি ভবন রাখার দরকার কি। ব্যাস তিনি সিন্ডিকেট-টিনডিকেট না মেনে নিজের পিএস (একান্ত সচিব) এবং এক্স-এনকে (কার্যনির্বাহী প্রকৌশলী) পাঠিয়ে এই ড্রিম ভ্যালি নামক বাড়িটার দু’টো ফ্ল্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কিনে নেন। পরে সিন্ডিকেটে বলেন যে অনুমোদন দিন। কদম আলীর পরিকল্পনাটা এরকম, এই বেতন নিয়ে আন্দোলনটার সমাপ্তি হবার পর তিনি লাগবেন উপাচার্যের বিরুদ্ধে, কারণ তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি যেন চোখের সামনে দেখতে পেলেন একটি বিরাট মানববন্ধনের ছবি, তাতে তাঁরা একটা ব্যানার ধরে আছেন, ‘স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য মবিনুল হকের অপসারণ চাই।’

এরকম একটা মারমুখো ভাব নিয়ে অধ্যাপক কদম আলী ড্রিম ভ্যালির অতিথিশালায় এসেছেন। কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে জোড় চেয়ারের একটিতে বসতে বসতে খুব রাগত স্বরে বললেন, সজল নাকি আপনাদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে?

শহীদুল্লাহ আশ্চর্য হয়ে বললেন, এর মধ্যে কথাটা আপনার কানে চলে গেছে? হ্যাঁ, করেছে একটু, আমি আপসকামী বলেছিলাম তাই।

ক্ষিপ্ত কণ্ঠে আদমানি বললেন, আমাকে চোর ডেকেছে সে। এত সাহস কোথায় পায় ছেলেটা!

অধ্যাপক কদম আলীর মন ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেল।

তখন তিনি দেশের টানে সবেমাত্র হার্ভার্ডের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ছাদনার মোড়ে বাস ছাউনিতে। তাঁর তখন পঁয়ত্রিশ বছর, কিন্তু হাঁটাহাঁটি ব্যায়াম-টেয়াম করেন না বলে ভুঁড়ি তাঁর কালো ট্রাউজারের ওপর ভেসে উঠেছে। খর্বাকৃতির লোক। মাথাভর্তি একঝাঁক চুল। পুরু ফ্রেমের চশমা পরেন। চশমার তলায় চোখ দু’টো অসম্ভব উজ্জ্বল। কপাল ছোট, ফোলা গাল, নাকটা বোঁচা, আর ঘাড়টা খাটো। সমস্ত চেহারা ফুটে বের হয় আত্মবিশ্বাসের দীপ্রতা। তিনি লক্ষ করেছেন একজন খুব তরুণ দেখতে শিক্ষক ঐ একই বাস ছাউনি থেকে ওঠে। ফর্সা গায়ের রঙ। লিকলিকে দেহের গঠন, আর দাঁতগুলো বেশ উঁচু। দেখলে মনে হয় যেন সারাক্ষণ হাসছে। সামান্য পরিচয়ে জেনেছেন তাঁর নাম সজল চৌধুরী, বাংলা বিভাগের শিক্ষক। বাসা আশপাশের কোথাও। কদম আলী হার্ভার্ড ছেড়ে এলেও মার্কিনি অনানুষ্ঠানিকতার কিছুই শেখেননি। ফলে নিজে যেচে ঐ তরুণ শিক্ষকের সঙ্গে কখনো পরিচিত হননি, বরঞ্চ ইংরেজদের কায়দায় একটি ফোল্ডিং ছাতা নিজের বগলে গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর ভাবতেন কবে বিপ্লব এনে জাতিকে আধুনিকতার পথে নিয়ে যাওয়া যাবে।

একদিন জুন মাসের একটি সকাল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বাস ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে তিনি প্রতিদিনের মতো রোগা বেশ্যা রমণীটির কাজকারবার নিবিড়ভাবে লক্ষ করছিলেন। এই দেহপসারিণী মহিলাটি তার নিজের একটি ছোট্ট সংসার পেতেছে বাস ছাউনির তলায়। একটা বড় বাদামি রঙের টিভি বাক্স হচ্ছে তার সংসার। সেখান থেকে একটা ছেঁড়া গামছা বের করে ফুটপাতের ওপর বিছিয়ে সে যে কাজটি করে সেটি হচ্ছে তার নধর দেহের নয় দশ মাসের একটি শিশু কন্যাকে ল্যাংটা শুয়ে দিয়ে তেল মালিশ করা অতি যতেœর সঙ্গে। তার আরেকটি বাচ্চা মেয়ে আছে তিন-চার বছরের। তারও স্বাস্থ্যটি বেশ নাদুস-নুদুস। সেও ন্যাংটা থাকে, কিন্তু কোনো কোনোদিন একটা পাতলা সাদা ফ্রক তার কালো কুচকুচে গায়ের ওপর শোভা পায়। মহিলার শরীর রোগা হলেও সবল পেশিযুক্ত। গায়ের রঙ তেলতেলে বাদামি। এক পেঁচে একটি পুরোনো সিল্কের শাড়ি পরা থাকে। ঐ একই শাড়ি প্রতিদিন। এই মহিলার রাত্রি যাপনের খবর কদম আলী তখনো নেননি। কারণ দেশে ফিরে আসবার অভিযানে তিনি ব্রতী হলেও তখনো সে পর্যায়ে তিনি পৌঁছাননি যে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সহকর্মীদের খবরও তিনি নেবার প্রয়োজন মনে করতেন। মহিলাটি যখন বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে বাসের শেডের তলায় একটি থামের পাশে তার অধিকৃত জায়গাটিতে টিভির বাক্সটি স্থাপন করত, আর প্রতিদিনকার মতো ছেঁড়া গামছাটি পেতে তার ওপর শিশু-বাচ্চাটিকে শুয়ে দিয়ে, আর বড়টিকে শিশু-বাচ্চাটির পাশে বসিয়ে দিয়ে, একটা টিনের মগে করে রাস্তার উল্টো দিকের বড় চায়ের দোকানটি থেকে চা আর কিছু বিস্কুট বা পাঁউরুটি নিয়ে আসত, তখন কদম আলী লক্ষ করেছিলেন যে মহিলাটির পেট যেন আবার স্ফীত হচ্ছে এবং তার সঙ্গে তাল দিয়ে স্ফীত হচ্ছিল তার প্রায় অনাবৃত স্তন জোড়া। কদম আলী জানতেন, মানুষের যৌন রিপুর কোনো শেষ ঠিকানা নেই, কিন্তু তাঁর বেশ্যা মহিলাটির দিকে যে নজর যায় তার মধ্যে অনভ্যস্ততা আছে ঠিক, কিন্তু আসক্তির অভাব ছিল না। আর ঠিক সে সময়ে তাঁর বিদেশি স্ত্রী ক্যারেন তাঁকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান। তাঁর সমাজমনস্ক মন তখনো কার্যক্ষেত্রে গ্রথিত না হলেও, সেটির নিশ্চয় উন্মেষকাল চলছিল সে সময়। ফলে বেশ্যা মহিলাটির দিকে তাঁর— তাঁর ভাষায় অসংযত— দৃষ্টি গেলেও সেটিকে ছাপিয়ে তাঁর মধ্যে মহিলাটির জীবনযাপনের মধ্যে একনিষ্ঠ শৃশৃঙ্খলা দেখে পরম কৌত‚হলের সৃষ্টি হয়। প্রথমে মহিলাটি শিশু বাচ্চাটিকে সযতেœ শুয়ে দেবে। কোনো বাসযাত্রীকে ঐ জায়গাটি থেকে সরে যেতে বলতে তার মুখে আটকাতো না। আর কোনো যাত্রীও তার মাতৃস্নেহের প্রবলতা দেখে তাকে বাধা দিতে সাহস পেত না। কালো কুচকুচে নধরকান্তি শিশুটির গায়ে যে শিশি থেকে মহিলা তেল মাখত, সে শিশির গায়ে কী লেখা ছিল তা আজকে আর কদম আলী মনে করতে পারেন না, তবে তার নিশ্চিত ধারণা ছিল ঐটি সরিষার তেলই হবে। বাচ্চাটিকে প্রথমে চিৎ করে গোটা শরীরে তেল মাখাত সে। ঐ সময়ে বসিয়ে রাখা বড় বোনটি যদি কোনো কারণে দাঁড়িয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে চাইতো মহিলা তা’তে বাধ সাধত না, তার একটি চোখ যেন বাচ্চাটির ওপর কড়া নজর রাখত। আবার মহিলা রাস্তার ওপাড়ের চায়ের দোকানটিতে মগে করে চা আনতে গেলে বড় বাচ্চাটি, তার অতি অল্প বয়স সত্ত্বেও, শিশু-বাচ্চাটিকে সামাল দিত। তার কোমল হাতে মায়ের কাছ থেকে শেখা তেল মাখার কাজটি সে তার ছোট বোনের ওপর করে যেত। তবে বড় বাচ্চাটি খাবার নিয়ে ঝামেলা করত। মা হয়তো কোনোভাবে এক টুকরা পাঁউরুটি চায়ের সঙ্গে সংগ্রহ করে এনেছে, সে খেতে চাইতো পুরোটা, আর সাথে সাথে মায়ের শক্ত হাতের চড় তার গালে পড়ত। তার কান্নাটা ছিল অদ্ভুতরকম আকাশ ফাটানো। এমনকি রাস্তায় চলমান গাড়ির আওয়াজ, হর্নের শব্দ, ফেরিওয়ালার হাঁক, রিকশাওয়ালার সঙ্গে কোনো যাত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ, কিংবা ওপারের চায়ের দোকান থেকে ট্রানজিস্টারে ভেসে আসা হিন্দি গানের আওয়াজকে ছাপিয়ে যেত ঐ শিশু-মেয়েটির কান্না। মায়ের ঐদিকে ভ্রƒক্ষেপ করার কোনো কারণ ছিল না। বাচ্চাটি কান্না থামিয়ে ঠিক মায়ের দেওয়া পাঁউরুটির টুকরোর নির্দিষ্ট অংশটি চায়ের মগে ডুবিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেত। এরকম একটি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি পৌঁছে গেলে অধ্যাপক কদম আলী বাসের ভেতরে সামনের একটি আসনে বসে যেতেন। কেউ যদি সে আসনে বসে থাকতেন, জুনিয়র হলে তো উঠে যেতেনই, সিনিয়র বা তাঁর সমপর্যায়ের হলেও হার্ভার্ডের খাতিরে তাঁকে সকলেই সামনের সারির একটি আসন খালি করে দিতেন। এই স্বতঃস্ফ‚র্ত সম্মানপ্রাপ্তির মাধুর্যে কদম আলী হয়তো ভুলে যেতেন নিত্যদিনের দেখা রাস্তার বেশ্যাটির দিনযাপনের কথা।

তবে সজল চৌধুরীর ওপর তাঁর বিরক্ত হবার দিনটি এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে। তিনি সেদিন কী কারণে যেন বেশ্যা মহিলাটির ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না। লম্বাটে চেহারার এই নারীকে দেখতে দেখতে তাঁর সম্পর্কে যে উৎসাহ জেগে উঠছিল সেটিকে সংলাপের পর্যায়ে নামাবেন কিনা এই চিন্তা তিনি যখন করছিলেন তখন ঐ মহিলা হঠাৎ তাঁকে চমকে দিয়ে বললেন, মামা, আপনে এখানে খাড়াইয়া থাকেন, আমার বড় মেয়েটির জ্বর, হ্যারে আজকে আনি নাই, বাচ্চাটারে শুধু দুই মিনিট চোখে রাখবেন আপনে, আমি আসব আর যাব। হুঁ, হাঁ, কী বলবেন না বলবেন, কদম আলী এক মহা অপ্রস্তুতির সামনে পড়লেন। আর তাঁকে রক্ষা করার জন্য যেন দৌড়ে এলেন ফর্সা দাঁতাল মুখের বাংলা বিভাগের সেই প্রভাষকটি যাঁর নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না। সজল চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন, এই যে বেটি, তুমি কা’কে কী বলবে বোঝো না। যাও, তুমি কাজে যাও, বাচ্চাটাকে আমি দেখব। ফুটপাতে সংসার বসাইছ, তা’তে আবার লোকজন ডেকে হুলুস্থ‚ল বাধাও। কদম আলীর সজল চৌধুরীর ব্যবহার পছন্দ হলো না, তাঁর পশ্চিমে শেখা ভব্যতায় লাগল। বললেন, আহা রে, ও ভাবে কথা বলছেন কেন? শি আসকড ফর হেল্প। উই উইল হেল্প হার। তাঁর প্রতি রুষ্ট ভাব দেখানোর তো কোনো দরকার নেই। সজল চৌধুরী বললেন, স্যার, আপনি তো দুই যুগের ওপর বিদেশে ছিলেন, আপনি জানেন না এইসব স্ট্রিট হোরেরা কত ছলচাতুরি জানে। হয়তো ঐ রাস্তা পার হয়ে সে যে চলে যাবে আর আসবে না। তখন এই শিশু বাচ্চাটির দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। ‘দূর’ বলে সজলের কথা কদম আলী বাতাসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, এতদিন ধরে দেখছি। মা হয়ে সে এ কাজ কখনো করবে না। হতে পারে বেশ্যা।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেদিন অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও বেশ্যা মহিলাটি আর এল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি এলে সজল চৌধুরী উঠে গেলেও কদম আলী উঠলেন না। তিনি ঘণ্টাখানিক পরে আসা পরের শিডিউলের বাসটিও মিস করলেন। বাচ্চাটি ঘুম থেকে উঠে এক প্রস্থ কেঁদেও নিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের পর আশ্চর্য হয়ে গেলেও কদম আলী বাসস্ট্যান্ডের শেডের তলায় অপেক্ষারত রইলেন। আমেরিকা হলে কদম আলী প্রথমে পুলিশে ফোন করতেন। কিন্তু এখানে কী করতে হবে তিনি বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। তিনি রিকশায় উঠে নিজের বাসায় ফেরত চলে যেতে পারতেন। কিংবা রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানটিতে গিয়ে টেলিফোনটি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন তার কী করা উচিত। আকাশে আরেকবার মেঘ হলো, এক পশলা বৃষ্টিও নামল, কদম আলী বাচ্চাটাকে ওই ছেঁড়া গামছার মধ্যে জড়িয়ে কোলে তুলে একটা রিকশা ডেকে নিজের বাসার দিকে যাত্রা করলেন। পেছনে পরে রইল বাদামি রঙের টিভি বাক্সটি।

রিকশায় যেতে যেতে কোলের অচেনা বাচ্চাটিকে নিয়ে তাঁর যত না ভাবনা এল তাঁর চেয়ে আরেকদিন এই বাস ছাউনির তলায় সজল চৌধুরীর বেমক্কা প্রশ্নটি যেন তাঁকে তাতিয়ে রাখল। স্যার, আপনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় মিস করেন না!

জবাবে তিনি প্রায় খেঁকিয়ে উঠেছিলেন। মিস করব কেন? হোয়াই? আই এ্যাম ব্যাক টু মাই কান্ট্রি, আই এ্যাম ফাইন হিয়ার। জবাবটা উদ্ধত ভঙ্গিতে দিলেও, তাঁর কথার কোথাও নিশ্চয় একটা ফাঁক ছিল। তা না হলে সজল চৌধুরী কেন বললেন যে স্যার, যেখানে সবাই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান, সেখানে আপনি এক ব্যতিক্রমী কাজ করলেন। মাঝে মাঝে আপনার হয়ে যেন আমি ভাবি, সিদ্ধান্তটি সঠিক কি না?

-লুক, ইয়াং ম্যান, কদম আলী তাঁর দীর্ঘদিনের প্রবাসের সভ্যতার ছাঁচে ইংরেজিটাকে যতটুকু পারেন পশ্চিমা ঢংয়ে রেখে বললেন, আই হ্যাভ সিন ইনাফ অব লাইফ, আওয়ার ড্রিমস আর ডিফরেন্ট। আপনার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্ন এক নয়।

-সরি স্যার, আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য। আমি আসলে সাদা মনে প্রশ্নটা করেছিলাম, কিন্তু আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।

-না, না, ঠিক আছে। সবারই তো ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। রাগ সামলে কদম আলী বললেন।
৫.

পৈতৃক সূত্রে কদম আলী অনেক সম্পত্তির মালিক। চাচা- জেঠাদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারার পরও তিনি শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে এক বিঘার ওপর জমি পেয়েছেন। তাঁর বিদেশি স্ত্রী ক্যারেনের পছন্দমতো বাংলো প্যাটার্নের একটি বাড়িও করেছিলেন চারদিকে জায়গা ছেড়ে। সীমানা দেয়াল টেনেছিলেন, মাঝখানে লোহার ফটক। বাড়ির আঙিনাজুড়ে ছিল ফলদ এবং বনজ গাছ। তাঁর অন্য ভাইবোনেরা সবাই তাঁর মতোই প্রবাসী ছিলেন, কিন্তু কেবল তিনি ফেরত আসেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর ছ’মাস আগে। সে প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। আজকে অবশ্য সেই পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ডেভেলপার দিয়ে দশতলা সুবিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি করে আছেন তিনি। ফলদ আর বনজ গাছ সব সে উন্নয়নের ধাক্কায় কচু কাটা হয়েছে।

রিকশাটি গেটের কাছে এলে তিনি নামলেন। মায়মুনা নামে তাঁদের পরিবারের পুরোনো ঝিকে ডাকলেন।

-কী ব্যাপার মামা? গামছা জড়ানো কালো কুচকুচে শিশু মেয়েটিকে দেখে মায়মুনার আকাশজোড়া বিস্ময়।

-শোন, এই বাচ্চাটিকে তোকে পালতে হবে। কুড়িয়ে পেয়েছি রাস্তায়। পারবি না।

মায়মুনা তার গভীর কালো চোখ প্রসারিত করে বলল, অসুবিধা হবে না। আমি দেখব।

মায়মুনার জীবনটাও আবার দুঃখে-কষ্টে ভরা। তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে চলে যায় একটি ছোট পুত্রসন্তান রেখে। তখন মায়মুনাকে কদম আলীর এক খালা বড় বোনের সংসারে দিয়ে যায়। মায়মুনার সে ছেলে বড় হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে শ্রমিক হিসেবে গেছে বছর পাঁচেক আগে। মাঝে মাঝে মায়ের নামে টাকা পাঠায়। সে টাকায় মায়মুনা দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একটি জায়গাও কিনেছে। মায়মুনা এক অর্থে কদম আলীর একলা সংসারে সর্বকাজের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন বিশ্বস্ত কর্মী।

মায়মুনা বলল, মামা, পুলিশ-টুলিশে বললে ভালো হতো না?

কদম আলী বললেন, ভেবে দেখি।

সে আর ভেবে দেখা হয়নি। শিশু মেয়েটির নাম রাখা হলো মৌমিতা আলী।

তাঁর এই কর্মকাণ্ড শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় পুরো শহরে চাউর হয়ে গেল। তারপরদিন তাঁর বাসায় বিকেলে দুই বাস শিক্ষক-শিক্ষিকা এলেন। গতকালও যে বাচ্চাটিকে সবাই বেশ্যার মেয়ে বলে জানতেন, তাকে এবার সবাই যেন কোলে নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কদম আলী এটিও দেখলেন যে ওপরে ওপরে সবাই ‘ওহ’, ‘আহ’ করলেও এবং তাঁর মুনষ্যত্বের প্রশংসা করলেও, বস্তুত খুব কম লোকই বাচ্চাটিকে মায়মুনার কোল থেকে নিজের কোলে নিলেন। থানার ওসি এসে কোলে নিলেন এবং অভয় দিলেন বাচ্চাটির মা’কে খুঁজে বের করার জন্য লোক লাগানো হয়েছে। আরো বললেন, পুলিশের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মানবসেবার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে নিবন্ধিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় সমবেত শিক্ষক-নাগরিকের সমাবেশকে বললেন, অধ্যাপক কদম আলী পশ্চিমা সভ্যতার উদার মানবতাবাদকে হৃদয়ে ধারণ করেন বলে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া (লক্ষ করা যাক, তিনি সচেতনভাবে ‘বেশ্যার কন্যা’ পরিচয়টি এড়িয়ে গেলেন।) একটি মানবশিশুকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিলেন। প্রশংসার জোয়ার শেষ হলে চা পানের সময় দেখা গেল সবাই যেন একটি তত্ত্ব প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে গেলেন যে বাচ্চাটি আসলে বেশ্যা মহিলাটির নিজের ছিল না, চুরি করা বাচ্চা ছিল। নিজের বাচ্চা হলে কেউ ওভাবে ফেলে রেখে যেত না। কদম আলীও এ তত্ত্বটি সত্য বলে প্রাণেমনে গ্রহণ করলেন, মনে করলেন বুঝি বা একটি বিরাট গøানিকর ব্যাপার তাঁর কাঁধ থেকে নেমে গেল।

মৌমিতা সহসা হৃষ্টপুষ্ট একটি আদরের শিশু হিসেবে কদম আলীর বৃহৎ দ্বিতল ভবনের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে লাগল। মায়মুনা বাড়ির সর্বরকম কাজের দায়িত্বে থাকলেও, মৌমিতা কখনো তার চোখের আড়াল হতে পারে না। কদম আলীর দোতলা বাড়িটা ছিল সামনে বিশাল বারান্দাসহ লাগোয়া কামরাবিশিষ্ট। নিচের তলায় চার কামরা, ওপরের তলায় ঠিক আর চারটি কামরা। কদম আলী ওপরের তলায় পশ্চিম দিকের ঘরটিতে থাকতেন। মায়মুনা মৌমিতাকে নিয়ে নিচের পূর্বদিকের কামরায় থাকত। বাড়িতে আরো দু’জন লোক ছিল। একজন ফকির নামক দারোয়ান-কাম-সকল ফরমায়েশি খাটা লোক, আর আরেকজন অল্প বয়সের একটি মেয়ে যে অসম্ভব দীর্ঘাঙ্গিনী, নাম যার সায়মা। সে ফায়ফরমাশ খাটে মায়মুনার। মৌমিতাকে নিয়ে আসার পর এ বাড়িতে একটি অন্যরকম চক্র তৈরি হলো, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মৌমিতা। কদম আলী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরত এলে তাঁর কাছে মায়মুনা, ফকির আর সায়মা কোরাসের মতো করে মৌমিতার প্রতিটা উন্নতির ফিরিস্তি দিত। মৌমিতা আজকে ‘কাক’ বলেছে, টুল থেকে নিজে নামতে পেরেছে, বাথরুম পেয়েছে সেটাও ইঙ্গিত করে বোঝাতে পেরেছে, খাবারের সময় দুষ্টুমি করে ভাত ছিটিয়েছে, আর না ঘুমিয়ে সারা বারান্দায় প্লাস্টিকের কুমিরটাকে গলায় রশি বেঁধে এদিক থেকে ওদিক হাঁটিয়েছে। মৌমিতা যখন কদম আলীর কোলে বসে তার প্রশংসা শুনছিল আর কদম আলীর বুক পকেটে হাত দিয়ে কলমটি হাতাতে চাইল, তখন মৌমিতার দু’বছর বয়স, আর তখনই একদিন কদম আলী দ্বিতীয় দার পরিগ্রহণের চিন্তা মাথায় আনলেন।

সাবেরা আহমেদ তাঁরই ছাত্রী ছিলেন বিভাগে। পরে ভালো পাস করে যখন একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন, তখন তিনি যে অবিবাহিতা সে কথাটিই পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কদম আলী যেদিন মৌমিতাকে নিয়ে বাসায় এসেছিলেন, তার পরের দিন যখন শিক্ষকরা মৌমিতাকে দেখতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সাবেরাও ছিলেন। চা পানের অবসরে শিক্ষকরা পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। তাঁর বেডরুমে যখন কয়েকজন এসে ঢুকলেন, তখন হঠাৎ সাবেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্যার এটা কি আপনার বেডরুম? অন্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেন জানি সশব্দে হেসে উঠেছিলেন প্রশ্নটি শুনে। কদম আলীও অনাবশ্যক যেন লজ্জা পেলেন। বললেন, তাই তো জানি। প্রশ্নটি কেন করেছিলেন সাবেরাই জানেন, তাই প্রশ্নটি করার পর তিনিও চুপ করে গেলেন। আর কদম আলী মনে মনে ভাবলেন, এ ধরনের প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে!

সঈদুর রহমান লম্বা-চওড়া মানুষ। খদ্দরের পাঞ্জাবি সবসময়ে গায়ে। কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন পিএইচডি করার মানসে। ডিগ্রি না করে ফেরত আসেন। কিন্তু কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা আর নামেনি। কলা ভবনের তিন তলায় কদম আলীর কামরায় ঢুকলেন তিনি, কারণ কলা ভবনের তিনতলায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আপাতত জায়গা হয়েছে। সেখানে মানবসম্পদ বিভাগ, ইংরেজিতে সংক্ষেপে এইচ আর এম বিভাগ অবস্থিত। কামরায় ঢুকে কদম আলী পাশের একটি চেয়ারে ঝোলা ব্যাগটি রেখে নিজে একটি চেয়ারে বসলেন কদম আলীর মুখোমখি। কম্পিউটারে মনোযোগ দিয়ে কী একটা কাজ করছিলেন কদম আলী। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তিনি সভাপতি হিসেবে প্রার্থী হবেন কিনা ঐ বিষয়ে শহীদুজ্জামান তাঁকে একটা চিঠি দিয়েছেন। সে সম্পর্কে তিনি ভাবছিলেন। এর কিছুদিন আগে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি পেপার পড়ার জন্য সার-সংক্ষেপ জমা দিয়েছিলেন। সম্মেলনের সেমিনার অধিকর্তা ডিন জন পাইক্রফট জানিয়েছেন—অত্যন্ত সুশীল ভাষায়—যে একই বিষয়ে একাধিক লেখা জমা পড়ায় তাঁকে আপাতত বিবেচনায় রাখা সম্ভব হয়নি। হার্ভার্ডের ডিগ্রিধারী লোক কী করে ক্যাম্ব্রিজের সেমিনার থেকে বাদ পড়তে পারেন এর একটি সহজ ব্যাখ্যা কদম আলী নিজের জন্য ঠিক করে নিলেন যে যেহেতু তিনি বাংলাদেশের নাগরিক, সে জন্য তাঁর কল্কে মেলেনি। তিনি বিদেশ থেকে এসেছেন প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল, একটা প্রবন্ধ তিনি এর মধ্যে লিখেছেন বা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর একাডেমিক নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে যে ক্যাম্পাসে জোর সমালোচনা শুরু হয়েছে, এবং এ জন্য অনেকেই যে শহীদুজ্জামান ও তাঁর দলকে দায়ী করছেন, এসব কদম আলীর সম্পূর্ণ জানা থাকলেও, তিনি কিছুতেই যেন হার্ভার্ডের লেখাপড়ার শৃ শৃঙ্খলায় নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। বরঞ্চ মনে হচ্ছিল যে জ্ঞানের চর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজ বা রাষ্ট্রের কিছুতেই মেলে না সে জ্ঞান চর্চা করে লাভ কি? যে বেশ্যা মহিলার মেয়েকে তিনি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বলে লালন করছেন, সে বেশ্যা মহিলার পরিচয় নেবার মতো মানসিক প্রস্তুতি তখন তাঁর ছিল না, কারণ তখন তিনি সবেমাত্র বিদেশ থেকে এসেছেন, তারপর কিন্তু যত দিন গেছে তত তিনি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্যতম শহীদুজ্জামান, হেরম্ব, ইসতিয়াকদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহী চেতনাসঞ্জাত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্রমশ একাত্ম বোধ করছিলেন। সে জন্য তাঁর একাডেমিকমনস্ক সহকর্মীরা যাঁরা পেশাগতভাবে কেবল শিক্ষকতাকেই আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন, যাঁরা হয়তো যে সব রাষ্ট্রিক সমাজে অধ্যয়নিক ভুবন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চার জন্য নিবেদিত, সে সব জায়গায় আরো স্বস্তিতে কাজ করতে পারতেন, অথবা ঘুরিয়ে বললে যাঁরা রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তেমন কোনো জোরালো অবস্থানে ছিলেন না, তাঁদেরই দলনেতা হবার জন্য যাঁর যোগ্যতা এবং অধিকার ছিল সর্বজনগ্রাহ্য, সে তিনি এসব সহকর্মীকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে ক্রমশ প্রতিবাদী দলীয় রাজনীতিমনস্ক শিক্ষক সমাজের নেতাতে পরিগণিত হয়ে যাচ্ছিলেন। এটা ঠিকমতো বলা যাচ্ছে না, কদম আলীর পাঠচর্চা এবং গবেষণা কাজের প্রতি ক্রমঘনীভূত শৈথিল্য লক্ষ করে কি তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী ক্যারেন তাঁকে ছেড়ে চলে যান, নাকি ক্যারেন চলে যাবার ফলে তিনি পড়াশুনায় শৈথিল্য দেখাতে শুরু করেছেন। শহীদুজ্জামানের চিঠিটা পড়ে তাঁর মনে বিভ্রান্তিমূলক চিন্তাগুলো যখন খেলছিল, তখন সঈদুর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, কদম আলী ভাই, একটা কিছু করেন।

শহীদুুজ্জামানের চিঠির প্রিন্ট আউট হাতের মধ্যে মুড়ে কদম আলী সপ্রশ্নে তাকালেন সঈদুর রহমানের দিকে : কী করতে বলছেন? তাঁর চশমাজোড়া কপালে, ফলে তাঁর চোখের ক্লান্তিমাখা পরদ স্পষ্ট।

সঈদুর বললেন, এই যে ক্যারেন ম্যাডাম চলে গেছেন, ঘর খালি, আপনার মাত্র চল্লিশের এদিক-ওদিক বয়স। ব্রিলিয়ান্ট মানুষ, কাজ-কারবারও ব্রিলিয়ান্ট। একটা রাস্তার শিশুকে নিজের মেয়ের মতো করে বড় করছেন। এতে আল্লাহতালা যে কত খুশি হয়েছেন, কী যে সওয়াব আপনার হচ্ছে আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও তো ঘর খালি!

-কী করতাম। রসিকতা ভর করল কদম আলীর গলায়। যেভাবে শিশু কুড়িয়ে পাওয়া যায়, সেভাবে তো স্ত্রী কুড়িয়ে পাওয়া যায় না! আর, ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায় বলুন তো, সঈদুর ভাই!!

সঈদুর বললেন, কদম আলী ভাই, মানে জ্ঞানে আপনি আমার চেয়ে ওপরে হলেও, বয়সে আমি আপনার বড় হব। দেখেন এখন যে আমি ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরব, আমি জানি আপনার ভাবী আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, একত্রে দুপুরে খাব বলে। এই যে একটা প্রশান্তি, এটাও তো জীবনের একটি পাওয়া, তাই নয় কি? কথাটা ঠিক বলেছি কি না?

-ঠিক-বেঠিক আমি বুঝতে পারব না, কারণ ক্যারেনদের সংস্কৃতির মধ্যে স্বামীর জন্য অপেক্ষমাণ স্ত্রী— এ ধরনের কোনো চিত্রকল্প নেই। ।

সঈদুর হো হো করে হেসে দিলেন। টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, শোনেন, আমি বাংলার অধ্যাপক, আমার কথাগুলো গেঁয়ো শোনাবে। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন না, তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও / আমি এ বাংলার পাড়ে রয়ে যাব। ঠিক তেমনি আমি মনে করি ক্যারেন ম্যাডামের সাথে আপনার সংসারটা ছিল একটা মরুভূমি।

-সে জন্য আপনি আমাকে মরুদ্যানে আনতে চান। ঠিক আছে বলুন, পাত্রী কে??

সঈদুর আবার হো হো করে হাসলেন। সেদিন অধিক রোদের দিন ছিল বলে তিনি কালো চশমা পরেছিলেন। তাঁর বিশাল মোছজোড়া কালো চশমার সঙ্গে মানিয়েছিল ভালো। হঠাৎ মনে হবে মাফিয়া লর্ড। তাঁর গলা ভারী এবং আন্তরিক। তিনি বললেন, কিছু মনে করবেন না কদম ভাই, ঘরেতে চোখ ফেরান : ‘বহু দিন ধরে, বহু দেশ ঘুরে . . . একটি শিশির বিন্দু।’ জানেন তো রবি ঠাকুরের এই কবিতাটা। আমরা অনেক সময় কাছের জিনিস দেখি না। দেখেন ঘরেতেই আছেন, আপনি যাঁকে চাইছেন তিনি।

-ঘরেতে আছে মানে? কে??

প্রশ্নটি করলেন বটে। কিন্তু কদম আলীর মানসপটে কোনো ছবি ফুটে উঠল না। কী বলতে চান সঈদুর সাহেব। কাকে মিন করছেন তিনি? কদম আলীর হৃদয়টা যে খুব কল্পনার মধ্যে হাবুডবু খায় সেরকম নয়। তিনি মানবসম্পদের শিক্ষক, সেটি শুধু সামাজিক বা রাষ্ট্রিক সম্পর্ক নিয়ে, হৃদয়ের সম্পদ নিয়ে তাঁর তেমন উৎসাহ নেই।

-যদি অভয় দেন, নামটা বলতে পারি কদম ভাই।।

-বলেন।।

-সাবেরা। সাবেরা আহমেদ। আপনারই ছাত্রী, আবার আপনারই সহকর্মী।

-যাহ্। কী বলেন আপনি! অনূঢ়া মেয়ে, ও কেন আমাকে বিয়ে করবে? আপনারা সাহিত্যের শিক্ষকরা যা ইচ্ছা হয় কল্পনা করেন, তাই না??

সঈদুর এবার নিজের মাথাটা টেবিলের মাঝখান বরাবর এগিয়ে আনেন, কদম আলীও অনুরূপ নিজের মাথাটা এগিয়ে আনেন। দু’টো মাথা কাছাকাছি হলে নি¤œরূপ কথাবার্তা হয়।

সঈদুর : ওটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। রাজি আমি করাতে পারব। আমাদের অঞ্চলে বাড়ি তো। আমি ওদের পরিবারকে চিনি। ওদের মা নেই, বাবা আছেন। বাবার শারীরিক অবস্থা ভালো না। দু’টো বড় ভাই আছে, তেমন কিছু করতে পারছে না।

কদম আলী : তা হলেও সে রাজি হবে কেন?

সঈদুর : কেন আপনার শিক্ষা, পদবী, বাড়ি!

কদম : কিন্তু আমি তো প্রাক-বিবাহিত।

সঈদুর : দূর, বিদেশিনী বিয়ে করাকে কেউ বিয়ে করা মনে করে নাকি আমাদের দেশে। যদি এ দেশের মেয়ে বিয়ে করতেন, তা হলে হয়তো আপত্তিটা স্ট্রং হতো।

কদম : তারপরও ও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ না কেউ হয়তো ওকে বিয়ে করবে। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে কেউ।

সঈদুর : উঁহু হলো না। তাঁরও বয়স কম হয়নি। ত্রিশ তো নিশ্চিত পেরিয়েছে। বিয়ের বাজারে চলবে না।

কদম : নিশ্চয় চলবে। আপনি অপেক্ষা করে দেখুন, সে আমার চেয়েও ভালো বর পাবে।

সঈদুর : কদম ভাই, ভুলে যাবেন না। আমিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক যে টিলার ওপর বাড়ি বানানোর প্রথম সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। আমি সব কিছু বিবেচনা করেই রাস্তায় নামি। এই ব্যাপারেও আমি স্যাংগুইন। আপনি শুধু মত দেন।

কদম : যান, মত দিলাম।

সঈদুর : থ্যাংকস। একটা কথা বললে মত তুলে নেবেন না তো?

কদম : সেটা আবার কেমন কথা!

সঈদুর : আমি জানি, আপনি বড় মনের মানুষ। শোনেন, ইন্টারমিডিয়েটে থাকতে সাবেরার মা বেঁচে থাকার সময় সাবেরার একটা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের তিন দিনের দিন সাবেরা বাপের বাড়ি ফেরত চলে আসে, আর কখনো যায়নি।

যেন শরীরে বিদ্যুতের শক খেলেন এভাবে কেঁপে উঠলেন কদম আলী। কাঁপা গলায় বললেন, বলেন কী? কী হয়েছিল, চলে এসেছিল কেন?

সঈদুর বললেন, কঠিন প্রশ্ন, এর উত্তর আমি জানি না। তবে ভেতরে ভেতরে ওদের পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝতে পেরেছি, ছেলেটা বদ ছিল। বিকৃত রুচির।

কদম আলী বললেন, সে যা হোক, আমি মত যখন দিয়েছি-দিয়েছি, এবার যান, আমাকে একটু ভাবতে দিন।

দু’জনের মাথা পূর্ববৎ অবস্থায় এলে সঈদুর বললেন, চা খাব। পিয়নকে ডাকেন।

কলিং বেল দিলে পিয়ন ভেতরে ঢুকল। কদম আলী চায়ের আদেশ দেবার সাথে সাথে সঈদুর পিয়নকে বললেন, দ্যাখো তো, তোমাদের বিভাগের সাবেরা ম্যাডাম এসেছেন নাকি। থাকলে তাঁকে বল আমি এসেছি, চেয়্যারম্যানের রুমে বসেছি।

কদম আলীর চোখ বড় হয়ে যেন কপাল ছোঁবে। কিন্তু পিয়নের সামনে কিছু বললেন না।

চা এসে গেল। প্রথম চুমুক দিতেই দরজার পর্দা নড়ে উঠল।

-স্যার, সালেমালেকুম, আমাকে খুঁজছিলেন? ওহ্্, সঈদ স্যারও আছেন, সালেমালেকুম, স্যার।

-হ্যাঁ, এসো, বস। চা চলবে??

-না, না, স্যার, এই মাত্র লাউঞ্জে এক কাপ খেয়েছি।

কদম আলী বললেন, জয়েন করেছ তো প্রায় দু’বছর হয়ে গেল, তাই না। এসিট্যান্ট প্রফেসর হতে এখন নিয়ম কী? কিছুটা সাবেরাকে, আর কিছুটা সঈদুরকে প্রশ্নটা ছুড়লেন কদম আলী।

-স্যার, আমার আরেক বছর হলে আপগ্রেডেশনের জন্য এপ্লাই করতে পারব। তবে একটা পাবলিকেশন লাগবে।

-ছাপিয়েছ কোথাও? কদম আলী জিজ্ঞেস করলেন।

-ছাপাব কি স্যার, লিখিনিই এখনো। আমাকে দিয়ে স্যার পাবলিকেশন হবে না।

-কেন, ছাত্রী হিসেবে তো তুমি ভালো ছিলে। শিক্ষক হিসেবেও আস্তে আস্তে পরিচিত হচ্ছো। লিখতে পারবে না কেন? একটা এরিয়া ঠিক করে পড়াশোনা করে লিখে ফেল। অত পণ্ডিতি লেখা লিখতে হবে তা নয়, কিন্তু নিজের ধারণাটা অন্যদের বলার সঙ্গে মিলিয়ে বলাটাই হচ্ছে গবেষণা।

কথাগুলো বলার সময় নিজের ভেতরে কদম আলী ফাঁপা বোধ করতে লাগলেন। শহীদুজ্জামানের চিঠিটা সবেমাত্র তিনি হাত থেকে টেবিলে রেখেছেন।

সাবেরা বসলে সঈদুর হেসে বললেন, দেশি মেয়ে কেমন আছো?

সাবেরা শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর একটু টেনে নিয়ে সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করলেন। তাঁর কাঁধের অনাবৃত অংশে কণ্ঠার হাড় কিছুটা বের করা। তাঁর মুখের শ্রী হঠাৎ করে কোনো কোনো এ্যাঙ্গল থেকে সুচিত্রা সেনের মতো। তাঁর কপাল খুব চওড়া বলা যাবে না, আর ছোট একটা বিন্দু লাল টিপ কপালের মাঝখানে। চোখের ভুরু পুরু এবং প্রায় জোড় লাগার মতো পরস্পরকে ছুঁয়েছে কেবল। গভীর কালো চোখের তারা। চোখের পাতায় কালো কাজল টানা। নাকের সঙ্গে ঠোঁটের এমন সামঞ্জস্য যে সাবেরা মুখ বন্ধ রাখলেও যেমন সুন্দর লাগে, তেমনি ঠোঁট খুললেও সাবেরার সাদা দাঁতের জোড়া পাটি দেখেই সবাই বলবে— ভালো করে দেখলে তো মেয়েটি খুব সুন্দর। সাবেরার মুখের চামড়া ঠিক মসৃণ নয়, হালকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্রনের পলেস্তারা তাঁর চেহারায় একটি গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছে। যেন জীবনের কোনো ব্যাপারে কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। সাবেরার আঁটসাঁট স্বা¯স্থ্য। স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য চোখেমুখে ফুলের বাগানে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। লাল জমিন, কালো পাড়ের সুতির একটি শাড়ি পরেছেন তিনি। মাথার কালো চুলের গোছা মাঝখানে সিঁথি দিয়ে দু’ভাগ করা। খোঁপার মধ্যে দু’টো কাঁটা গোঁজা—একটি লাল, একটি কালো। কদম আলী ভাবলেন, কোনো কারণে নাকি বিনা কারণে সাবেরা এভাবে সেজে এসেছেন। ছাত্রী থাকাকালীনও সাবেরা একটু সাজসজ্জা করে আসতেন। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চাকরিজাত আত্মবিশ্বাস। ভাবলেন কদম আলী, সঈদুর যে প্রস্তাবটি নিয়ে এসেছেন, তা’তে তিনি সম্মত হলে আদৌ কি কোনো কিছু হবে, এই মহিলারও বা তাঁর নিজেরও।

-স্যার, আপনি তো আর কখনো বাসায় এলেন না, বাবা আপনার কথা বলেন।।

কালো চশমাটি চোখ থেকে খুলে নিয়ে সাবেরার দিকে তাকালে হঠাৎ সাবেরার মনে হলো তিনি যেন একজন মৃত মানুষের চোখের দিকে তাকালেন। ভেতরে কুঁকড়ে উঠলেন তিনি। অভিজ্ঞ মানুষের চোখ কি এমন হয়! পায়ের ওপর পা তুলে সাবেরা আরেকটু নড়েচড়ে বসলেন।

-যাব, যাব, তোমাদের বাসায় যাব। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা আছে। দেশে তো একদম যান না তিনি। কেমন আছেন এখন??

-ভালো স্যার, আপনি আসবেন। তারপর কদম স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, আমি কি এখন উঠব?

-হ্যাঁ, যাও। তোমার এসিট্যান্ট প্রফেসর হতে আর কত সময় বাকি আছে এটা জানার দরকার ছিল।

পর্দা সরিয়ে সাবেরা বের হবার সময় অনাবশ্যকভাবে কদম আলীর চোখ যেন স্ন্যাপ তুলে নিল সাবেরার পুরো পেছন ভাগটা।

কিছুক্ষণ কামরার মধ্যে নীরবতা বজায় রইল। একটি কালো বড় ফড়িং পর্দা নড়ে ওঠার কারণে স্থানচ্যুত হয়ে সারা ঘরে পরিভ্রমণ করতে লাগল।

-হুম, মেয়েটি তো দেখতে বেশ ভালো। কিন্তু রাজি হবে কেন?

-সেটি আপনি আমার ওপর ছেড়ে দেন। আপনাদের মতো ডিগ্রি ফিগ্রি করতে পারিনি, কিšন্তু এ লাইনে আমি বহুত পাকা হ্যায়।

দুই সহকর্মী হো হো করে হেসে উঠলেন।
৬.

শহরের ব্যস্ত একটি মোড় থেকে সোজা একটি সড়ক চলে গেছে বাণী বাজারের দিকে। বাজারটা ফেলে হাজী শরাফতউল্লাহ সড়ক খানিকটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে মিলেছে কোহিনুর সড়কের সঙ্গে। অনেক আগে এসেছিলেন সঈদুর এ দিকটাতে। সাবেরার মা মারা গেলে দেখতে এসেছিলেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এত বাড়ি ঘর রাস্তা-ঘাট হয়ে যাবে চিন্তার বাইরে। বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কী পরিবর্তন না আসছে! সঈদুর বাস থেকে নেমে একটি রিকশা নিলেন, বর্ষার চাপে রাস্তার ইট খুলে গেছে গলির। রিকশাটা এ কাৎ ও কাৎ করতে করতে একটি দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। গওহর মঞ্জিল। রং চটা সীমানা দেয়ালের গায়ে চিকার পর চিকা ভরে গেছে। পুরোনো দোতলা বাড়ি, দেয়ালে হলুদ রঙ চটে মাটির রং ধারণ করেছে। লোহার ফটকটি বন্ধ ছিল। সঈদুর ভেতরে খবর পাঠানোর জন্য কোনো লোককে ফটকের প্রহরায় দেখলেন না। কোনোদিকে কলিং বেলও খুঁজে পেলেন না। দু’একবার লোহার গ্রিলে বাড়ি দিয়ে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করলেন। ফল হলো না। সঈদুর কোনো প্রচেষ্টায় সহজে হাল ছাড়েন না। দেখলেন বাসার একটু সামনে একটি ছোটখাটো গ্যারেজ। পুরোনো গাড়ি মেরামতের কাজ চলছে। তিনি গ্যারেজটির সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন। কয়েকজন শ্রমিক একটি মোটরগাড়ি মেরামতের কাজ করছে। গ্যারেজের কোনার দিকে একটি টেবিল, তার এক দিকে মালিকের বসার গদি, আর উল্টো দিকে দু’টো প্লাস্টিকের চেয়ার। টেবিলের ওপর কফি রঙের একটি প্লাস্টিকের শিট চার কোনায় পেরেক দিয়ে আটকানো। সন্ধ্যা তখনো নামেনি। গ্যারেজের ভেতর খানিকটা অন্ধকার নেমেছে, বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। মালিক বা কর্মচারীর বয়স নিতান্ত অল্প। তাঁকে ঢুকতে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সালাম দেবার পর তাঁকে বসতেও বললেন। সঈদুর অচেনা গ্যারেজের ভেতরে এরকম ভদ্রতাবোধের সঙ্গে পরিচিত হবেন আশা করেননি। ফর্সা ভদ্র মুখ মালিকের। পরিষ্কারভাবে গাল কামানো। নাকের নিচে এক জোড়া পাতলা মোছ যতেœর সঙ্গে বিন্যাস করা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ভদ্রলোকের চোখ। পৃথিবীর যাবতীয় শান্তি এসে চোখ দু’টোতে যেন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। একটা নীল ডোরাকাটা ফুল হাতা শার্ট তাঁর গায়ে, আর নিচে লুঙ্গি পরা। কোনো সন্দেহ নেই যে লোকটি স্থানীয়। সঈদুর বসতে যাবেন, তখন দোকানের বাইরে থেকে একজন কামলা শ্রেণির লোক, শুকনো, গায়ের রঙ কালো, ময়লা একটা লুঙ্গি ও ততোধিক ময়লা একটা হাতকাটা গেঞ্জি পরনে, বলল, স্যার, আফা, আপনারে ডাকে। দোকান থেকে বাইরে পা দিয়ে তিনি গওহর মঞ্জিলের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলেন, ঠিকই সাবেরা দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো এবং তাঁকে সালাম দিচ্ছেন। সঈদুর তা দেখে হাত নেড়ে সহাস্যে বললেন, আসছি। আবার গ্যারেজের ভেতরে এক পা দিয়ে মালিক ভদ্রলোকের সঙ্গে হাত মেলালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই তো মালিক, এই গ্যারেজের, তাই না। লোকটি ভদ্রভাবে জবাব দিলেন যে তিনি নন, যে বাড়িতে তিনি যাচ্ছেন সে বাড়িরই বড় ছেলের গ্যারেজ সেটা।

-তাই? লোকটার নাম জেনে নিলেন সঈদুর, মোজাম্মেল হক।

সঈদুর গওহর মঞ্জিলের ফটকের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাবেরা নিচে নেমে এসেছেন। ফটক নিজেই খুলে সঈদুরকে আহ্বান জানালেন সঙ্গে যেতে। বাড়িটির মাঝখানে সিঁড়িঘর, আর দু’দিকে কামরাগুলো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সাবেরা জানালেন যে তাঁর বাবা সে মুহূর্তে বাড়িতে নেই। মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন, এসে যাবেন।

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বৈঠক ঘরে যা যা সজ্জিত থাকে, তার সবই আছে। দুই দেয়াল জুড়ে দুই জোড়া সোফা সেট। গদিগুলো মাখন রঙের কাপড়ের আচ্ছাদন দিয়ে আবৃত। ঘরের দেয়ালের রংও মাখন রঙের। একটি ছোট্ট টেবিলের ওপর একটা সাদা-কালো টিভি। একটা বিশাল আকারের কাচের আলমারি দেয়ালের একদিকে। বাদামি রঙের ছিল হয়তো, এখন রং চটে ছালার রং হয়ে গেছে। আলমারির ভেতরে বিভিন্ন তাকে বিভিন্ন জিনিসে ভরা। একটি তাকে কিছু বই, আবার অন্য একটি তাকে লেপ-তোষক গোঁজা। দেখে মনে হচ্ছিল আলমারিটি উত্তরাধিকারসূত্রে বহু পূর্ব প্রজন্ম থেকে পাওয়া। এই আলমারির একটি তাকের কোনার দিকে সাবেরার একটি ফ্রেম বাঁধানো ছবি, সাদা-কালো এবং সুচিত্রা সেনের ভঙ্গিতে। ‘এ শুধু গানের দিন / এ লগন গান শোনাবার’-পঙ্ক্তিটি যেন সঈদুরের মনে সুর দিয়ে উঠল। তিনি একলা বসে অপেক্ষা করছিলেন আর ভাবছিলেন তাঁর বাবা মসজিদ থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সাবেরা সঙ্গ দেবেন। কিন্তুসেটা হলো না। তিনি ব্যাপারটা বুঝে নিলেন, মা-বিহীন ঘরে সাবেরাই একমাত্র মহিলা, তাঁর জন্য কিছু একটা তৈরি করতে সে রান্নাঘরে নিশ্চয় ব্যস্ত।

এ সময় ভারী মোটা গলার আওয়াজ শোনা গেল পর্দার ওপাশে, কই, প্রফেসর সাহেব কই?

সাবেরার বাবার সঙ্গে সঈদুরের প্রায় বছর পাঁচেক পরে দেখা। গলার আওয়াজটা ভারী থাকলেও ভদ্রলোক শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছেন।

বললেন, স্যার, আপনি এতদিন পরে আসলেন, দেশের লোক হয়েও। আমি তো একবার চলে গিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ দোয়ায় ফেরত আসছি।

এ সময় সাবেরা একটা ট্রেতে করে চা আর ঘরে ভাজা সমুচা নিয়ে আসলেন।

সাবেরাকে সঈদুর বললেন, কই, তুমি তো একবারও বল নাই যে তোমার আব্বার অসুখ।

সাবেরা মৃদু হেসে বললেন, একদিন বাসে পাশাপাশি বসে যাবার সময় একটু করে বলেছিলাম স্যার, আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি।

-ও হ্যাঁ, তাই তো, তুমি বলেছিলে হাসপাতালে নেবার কথা, আমিও বোঝো তো নানা বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি। তারপর সাবেরার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন কেমন আছেন??

-ফিজিওথেরাপি নিচ্ছি, ফলে যে ডান হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল, সেটি এখন নাড়াতে পারছি। আসলে স্যার, এখন দিন গুনছি আর কি। ভাগ্যিস এ বাড়িটা করতে পেরেছিলাম, আর কিছুই করতে পারিনি, তিন ছেলেমেয়ের একটাকেও বিয়ে করাতে পারিনি।

সম্ভবত বাড়িতে অতিথি এলে বাবা কী বিষয় নিয়ে কথা বলেন সাবেরার তা জানা ছিল বলে তিনি অনেকটা বিরক্ত হয়ে সরে গেলেন।

সঈদুর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি অনেকটা ঐ ধরনের একটা আলাপের জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম। সঈদুর পা ছড়িয়ে আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। দু’হাতের মুঠো এক করে আঙুলে আঙুলে জড়িয়ে বললেন, আসলে গওহর সাহেব, কার জীবনে যে কি আছে কিছুই নিশ্চিত বলা যায় না। আপনি তো জানেন, জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এ তিনটের ওপর নাকি মানুষের হাত নেই।

সঈদুর কথা বলছিলেন আর গওহর সাহেব তাঁর কথার ভাবে বুঝতে পারছিলেন না তিনি কি তাঁর জন্য কোনো দ্বিতীয় দার পরিগ্রহণের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন কিনা।

সঈদুর বললেন, সাবেরাকে তো দেখি ক্যাম্পাসে। আপনার মেয়ে মানে তো আমার মেয়ে, তাই না? তো ওর বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

-দিচ্ছি না কেন প্রফেসর সাহেব সেটা তো আপনি জানেন।

-ও, ঐ ব্যাপারটা! ঐটা তো অনেক আগের ব্যাপার। এরকম তো কত হয়? আজকাল যুগ কত আধুনিক হয়ে গেছে, সাবেরার মতো শিক্ষিত সুন্দরী মেয়ে জামাই পাবে না, তা আমি বিশ্বাস করি না।

-না, ঘর আসে তো। খোঁজখবর আমরাও নিই, তারাও নেয়। কিন্তু তারা কিছুদিন পরে চুপ হয়ে যায়। যদি হতো যে মেয়েটা নিজের থেকে একটা ছেলে পছন্দ করল, তা হলে আমি বেঁচে যেতাম। খুব নিজের ভেতরে থাকে মেয়েটা। কারো সঙ্গে কিছু শেয়ার করে মনে হয় না।

গওহর সাহেবের হতাশামাখা রোগা চেহারার দিকে তাকিয়ে সঈদুর বললেন, মেয়ে বড় হয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, ও যখন নিজের থেকে উদ্যোগ নেবে না, তখন বাবা হিসেবে আপনাকেই নিতে হবে।

-কী করতে হবে তার তো কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। মেয়েকে কিছ্ইু জিজ্ঞেস করতে পারি না। কারণ দোষ তো আমার। ছেলে আমেরিকা থাকে। অত খবর তো আর নিতে পারিনি। দেখতে শুনতে ভালো। নামকরা পরিবারের ছেলে। দোষ ধরার মতো কিছু ছিল না। অথচ বিয়ের তিনদিনের মাথায় মেয়ে ফেরত এল। সব শুনলাম। সে যে মেয়ের কাছে মাথা হেট হয়ে গেল আজ পর্যন্ত মেয়ের মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারি না। কর্মফল বলে যে কথাটা আছে সেটাই কি ঘটল কিনা আমার জীবনে আমি জানি না। মেয়ের কষ্ট দেখে ওর মা অশান্তি নিয়ে মারা গেল। আমি পড়ে গেলাম অসুখে। ছেলে দুইটা বড় হয়েছে, বিয়ে থা করেনি, একটা গ্যারেজ চালানোর চেষ্টা করছে, আর ছোটটা গিটার একট নিয়ে সারাদিন টুংটাং টুংটাং। অথচ আমার হার্ডবোর্ডের দোকানটা প্রায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সে যা হোক, আমার কর্মফল। সৎপথে তো আর কিছু আয় করিনি।

-সামনের গ্যারেজটা আপনার ছেলের?

-হ্যাঁ তো, আপনি দেখেছেন নাকি?

-মোজাম্মেল আপনার ছেলে?

-ওহ্্, মোজাম্মেল ছিল? না, সে আমার ছেলে নয়, আমার ছেলের বন্ধু, পড়ালেখা করেনি, ¯স্থানীয় এক কমিশনারের ছেলে। মাঝে মাঝে গ্যারেজে বসে। ব্যাপারটা কী জানেন . . . এ বলে গওহর সাহেব সঈদুরকে ইশারায় কাছে ডাকেন। সঈদুর ঘাড় নুইয়ে তাঁর মুখের কাছে গেলে, তিনি ফিসফিস করে বললেন, কী সাহস দেখেন, ঐ আ-পড়া ছেলেটা আমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিতে চায়। কী সাহস, দেখেছেন? সামান্য কমিশনারের ছেলে, ডিগ্রি নাই, চাকরি নাই, অথচ ইউনিভার্সিটি টিচারকে বিয়ে করতে চায়। তবে ছেলেটি স্বভাবচরিত্রে খুব ভালো, দেখতেও তো ভালো, আপনি তো দেখেছেন।

-তা হলে তো বেশ জটিল। কমিশনারের ছেলে সে যত ভালো হোক, তার অন্য একটা রূপ নিশ্চয় আছে। আমার মনে হয়, আপনার দেরি করা ঠিক হবে না।

-হুঁ তাই-ই। গওহর সাহেব তাঁর রোগা একটি হাত শূন্যে নাড়লেন। তাঁর চোখের চাহনিতে এক ধরনের নিরাসক্ত ভাব বিদ্যুতের আলোয় যেন কেন একটি সংসার হয়েও হয়ে ওঠে না তার বার্তা দিল।

সঈদুর একবার গলা খাঁকারি দিলেন। সোফায় আবার আরামের সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসলেন। আরেকবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আমি আসলে একটা প্রস্তাবই নিয়ে এসেছি। যদি শোনেন . . . ।

গওহর সাহেব নিস্পৃহ কণ্ঠে সায় দিলেন। বলেন . . . ।

-শোনেন, জীবনে আমাদের চাওয়া-পাওয়া যেমন থাকে সে তো একটা কথা, আবার সেগুলো যে পাব না বা পাই না সে বাস্তবতাও আমাদের সজাগ রাখে। অন্য ভাবে নেবেন না কথাটা, কিন্তু আপনি সাবেরার একটা বিয়ে দিয়েছিলেন আমেরিকায় প্রবাসী এরকম একটি ছেলের সঙ্গে, অথচ বিয়েটা তিনদিনও টিকল না। আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন যে ও যে স্বামীর ঘরে খুব কম, মাত্র তিনদিন ছিল, এটা কেউ বিবেচনায় আনছে না। আনছে কি, যে মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, কাজেই তাকে আনকোড়া কোনো ছেলে বিয়ে করবে না। তখন আপনাকে পাত্র হিসেবে বাছতে হচ্ছে আগে বিয়ে হয়েছিল সেরকম ডিভোর্সি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিয়ে হয়েছে, পরে স্ত্রী মারা গেছে সন্তান রেখে সেরকম পাত্রও নিশ্চয় এসেছে। আমি এ ব্যাপারগুলো নিয়ে বহু ভেবেছি, কেন না আমি তো শখের ঘটকালি করি। আমি দেখেছি, মূল সমস্যাটা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক কীরকম যাবে এটা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। মানুষ তো আসলে কেউ কাউকে খেয়ে দেখেনি। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলে যায়। আবার এ কথাটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। যেমন ধরেন প্রেম হলো দীর্ঘদিন ধরে একে অপরকে চিনল এবং এর ফলে হয়তো বিয়ের পরেও সুন্দর দাম্পত্য জীবন কাটালো স্বামী-স্ত্রী। আবার সামজিকভাবে স্থিরকৃত বিয়েই আমাদের সমাজে ভালোবাসা থাক বা না থাক একটা ব্যবস্থা হিসেবে টিকে যায়। তবে আমার মনে হয় বিয়েটা মোটামুটি মানুষ বাস্তব বিষয়গুলো বিবেচনা করে ঘটায়। লাভ-ক্ষতি এভাবে সরাসরি না বললেও জয়-পরাজয় সংক্রান্ত বিবেচনা কাজ করে।

-জয়-পরাজয় মানে? অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন গওহর সাহেব।

-কিভাবে বলব! আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, আমার এক ভাবী বলেছিলেন, সঈদ, তুমি জিতেছোও, আবার হেরেছোও। আমি বললাম, ভাবী বোঝান। তিনি বললেন, তুমি জিতেছো, কারণ তোমার মতো বেঢপ মার্কা চেহারার লোক এমন একটি চোখ-বাহারি বৌ পেয়েছো। আবার ঠকেছো, বৌয়ের তো তেমন লেখাপড়া নাই, বাপের নাই টাকা, কাজেই তোমাকেই এই মহিলাকে ভারবাহী উটের মতো বহন করতে হবে। জয়-পরাজয়ের এই হিসাবটা আমি পরে দেখলাম সব ধরনের বিবাহ-সম্পর্কের ক্ষেত্রে খাটে।

অপমানে যে গওহর সাহেব থরথর করে উত্তেজনায় কাঁপছেন সঈদুর সেটিও লক্ষ করলেন। হো হো করে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আরে, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনি বা সাবেরাকে মিন করে আমি কিছু বলিনি, আমি যেটি বলতে চাইছি, সেটি হচ্ছে বিয়ের সম্পর্কের মধ্যেও কোথাও যেন একটা হিসাব কাজ করে।

গওহর সাহেব রোগে পড়লেও গলার আওয়াজ তাঁর মোটা। প্রায় হুঙ্কারের মতো চিৎকার করে বললেন, স্টপ প্লিজ। প্রফেসর সাহেব, আর কথা বলবেন না।

তিনি আর কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু উত্তেজনায় তাঁর কথা বের হচ্ছিল না। ভেতরের ঘর থেকে সাবেরা ছুটে এলেন, আর্তস্বরে বললেন, কি হলো বাবা, তুমি অমন করছ কেন?

ততক্ষণে গওহর সাহেব নিজেকে সামলে নিয়েছেন। শান্ত হয়ে বললেন, না রে মা, তুই ভেতরে যা, আমরা এমনি কথা বলছিলাম। সাবেরা সম্ভ্রমের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি সঈদুরের দিকে নিক্ষেপ করে কামরা ছেড়ে গেলেন। দরজায় ঝোলানো পর্দা দুলে উঠল।

ঘরের মধ্যে দু’জন বয়স্ক লোক চুপচাপ বসে রইলেন। সঈদুর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে রইলেন। তাঁর ভেতরের লড়াকু তেজ তাঁকে যেন কথা বলতে বাধ্য করল। বললেন, আপনি তো হঠাৎ করে রেগে গেলেন। আমি দুঃখিত যে আমি ভালো করে বোঝাতে পারিনি আমি কি বলতে চাইছি।

গওহর সাহেব তাঁর দুর্বল হাত একটা শূন্যে নাচিয়ে বললেন, প্রফেসর সাহেব, আপনার মেয়ে আছে কি না জানি না। কিন্তু কোনো মেয়ের বাবা কোনো জয়-পরাজয়, লাভ-লোকসানের কথা বিবেচনা করে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে না। সে শুধু ভাবে মেয়ের ভবিষ্যৎ। মেয়ের নিরাপত্তা। একটা মেয়ে যখন শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়, মা-বাবার কলজে যে কতখানি ছেঁড়ে সেটি আপনি মেয়ের বাবা না হলে, কিংবা বাবা হলেও মেয়ের বিয়ে দিয়ে না থাকলে কোনোদিন বুঝবেন না। হ্যাঁ, আপনারা মনে করতে পারেন যে একটি ইন্টারমিডিয়েট পাস করা মেয়েকে কেন আমি অচেনা অজানা ছেলের হাতে তুলে দিলাম। জাস্ট ও আমেরিকায় থাকে বলে? না? প্রফেসর সাহেব, কোনোদিন কি চিন্তা করে দেখেছেন, বাবা-মা শুধু কি মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তা করে তার ভবিষ্যৎ, তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে? তারা কি জানে না, কি নির্মম আমাদের পর্দাপ্রথা, বিশেষ করে মেয়েদের ওপর? কিছু মনে করবেন না . . . আমি আপনার মতো গুছিয়ে কথা বলতে না পারলেও, আমি বলব . . . হ্যাঁ, আপনি কি জানেন না, বহু মা-বাবা আছে মেয়ের শারীরিক দিকটার কথাও বিবেচনা করে মেয়েকে পাত্রস্থ করার কথা চিন্তা করে। হ্যাঁ, যদি সত্যি কথাটা বলি, আমি সাবেরার ওপর মনে মনে খানিকটা বিরক্ত এ জন্য যে কেন সে তাঁর জীবনকে কঠিন অনুশাসনের মধ্যে রেখে এভাবে ক্ষয় করে দিচ্ছে? ওহ, আসলে আমি সাবেরার কথা চিন্তা করলে খেই হারিয়ে ফেলি।

-শুধু মেয়ে বলে নয়, অনেক ছেলেও আছে, বিয়ে না করে কোনোরকম সম্পর্কের মধ্যে না গিয়েও দিব্যি বুড়ো হতে থাকে। সঈদুর খুব সততা নিয়ে বলেন।।

-প্রফেসর সাহেব, এবার গওহর সাহেবের গলাটা আর্দ্র শোনায়। এরকম যদি সাবেরার জীবনে ঘটে থাকে, তা হলে আমি মরেও শান্তি পাব না। কারণ সবসময় আমি ভাবব যে আমার মেয়ের পরিণতির জন্য আমি দায়ী। হ্যাঁ, সত্যি কথাটা বলি, এই মোজাম্মেল ছেলেটা যদি তেমনভাবে প্রস্তাব নিয়ে আসে, আর সাবেরা যদি রাজি থাকে, আমি বোধহয় না করব না।

এতক্ষণে যেন হালে পানি পেলেন সঈদুর। বললেন, শোনেন, গওহর সাহেব। জীবনটা প্রতিমুহূর্তে এক এক জোড়া বাছাইয়ের মুখে আমাদের ফেলে দেয়। যেমন আপনি ভাবছেন, সাবেরা একলা জীবন অতিবাহিত করুক সেটি আপনি জীবন গেলেও মেনে নেবেন না। এখন আপনি ভাবছেন যে বিপাকে পড়লে ঐ আপনার বড় ছেলের সঙ্গী কমিশনারের ছেলে মোজাম্মেলও আপনার চিন্তার বাইরে থাকবে না। তা হলে আপনার বাছাইটা আমরা বড় করতে পারি কিনা দেখি।

-সেটি কেমন? যেন গওহর সাহেব জীবনের সবচেয়ে গূঢ় ব্যাপারটি বুঝতে চাইছেন সেরকম আগ্রহ নিয়ে বললেন।।

-আপনি প্রফেসর ড. কদম আলীর নাম তো শুনেছেন??

-হ্যাঁ, সাবেরারই তো টিচার। এখন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান।

-উনার বিদেশিনী বউটি চলে গেছেন, আর আসবেন তাও না। কোনো বাচ্চাটাচ্চা নেই। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মহিলা এ দেশ ত্যাগ করেছিলেন অবশ্য।

-তো??

-বলছি। সাবেরার বয়স যদি ত্রিশের বেশি হয়, আর উনার চল্লিশের বেশি, তা হলে ধরুন বছর দশেকের ব্যবধান, যা অনেক দাম্পত্য জীবনে আমাদের সমাজে প্রায় স্বাভাবিক দূরত্ব। এটা কি মেনে নিতে পারেন কিনা যে কদম আলী হয়তো সাবেরার জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন। ধরুন আমিই সে প্রস্তাব নিয়ে এলাম।

হঠাৎ গওহর সাহেবের চোখ জল চিকচিক হয়ে উঠল। সাবেরার মুখে কদম আলীর বহু প্রশংসা তিনি শুনেছেন। তাঁর অতি উচ্চ মেধার কথা, তাঁর হার্ভার্ডের ডিগ্রির কথা, তাঁর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি শিশুকন্যাকে পালক নেবার কথা, সর্বোপরি তাঁর পৈতৃকভাবে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হবার কথা। অতি দুঃখের মধ্যেও তিনি যেন ক্ষীণ আশার রশ্মি দেখতে পেলেন। মোজাম্মেলকে নিয়ে যে দুশ্চিন্তা তার মনে ভর করেছিল, সেটি যেন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মতো দূর হয়ে গেল।

তারপরও বললেন, কিন্তু উনার রুচি তো বুঝলাম না। কী করে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়েকে তিনি ঘরে নিয়ে এলেন? হোক না সে শিশু। কিন্তু মেয়েটা তো বড় হবে। সেখানে তিনি যাকেই বিয়ে করুক না কেন, মানিয়ে নেবার প্রশ্নটা আসবেই। ধ্যাৎ, কী যে একটা রুচি? আসলে অনেকদিন আমেরিকায় ছিলেন তো আমাদের মূল্যবোধ তো তাঁর মধ্যে কাজ করে না।

-দেখুন, পুরো ব্যাপারটাই কেমন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আমরা তাঁকে এই কাজটির জন্য প্রশংসা করেছি। বলেছি, মানবতাবোধের মহত্তম পরিচয় তিনি দিয়েছেন। অথচ আপনি ভাবছেন, এটা ইতর রুচির পরিচয়। আপনি হয়তো আমাকে সরাসরি বলে ফেলেছেন, কিন্তু আমাদের অনেকেই ওপরে ওপরে তাঁর মনুষ্যত্বের প্রশংসা করলেও, ভেতর থেকে আপনার মতোই মনে নেয়নি। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বলছি, কিন্তু আমাদের একজন সহকর্মী, সজল চৌধুরী নাম, তিনি আমার বিভাগেরই শিক্ষক, তিনি বলে বেড়াচ্ছেন শিশুকন্যাটি আসলে এক রাস্তার বেশ্যার মেয়ে, যা শুনে অনেকের গা গুলিয়ে যায়।

এতটুকু বলে যখন সঈদুর হাঁপাতে থাকলেন, তখন গওহর সাহেব বললেন, আপনি শান্ত হোন। আমি যে সব কথা বলেছি তা সব সত্য, সত্য হলেও সব সত্য যে ধরে থাকতে হবে তা নয়। খুব বাস্তবভাবে চিন্তা করলে আপনার প্রস্তাবটি ফেলতে পারার মতো নয়। তবুও আমাকে একটু সময় দিন।

-সময় আর দিতে হবে না, বাবা। পর্দার আড়াল থেকে সিনেমায় যেভাবে হঠাৎ করে নায়িকা একটি দৃশ্যের চরম মুহূর্তে প্রবেশ করে, সেভাবে সাবেরা ঢুকলেন। বাবা, আমি কিছু কিছু আলাপ পর্দার আড়াল থেকে শুনেছি। এটা আমার অপরাধ হয়েছে। তারপরও সঈদুর স্যারের হঠাৎ আগমনে আমি দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। আমি বলে না, যে কোনো মেয়ের অবিবাহিত অব¯স্থায় বাবার বাড়িতে ঝুলে থাকা নানাদিক থেকে সংকটের সৃষ্টি করে। বাবা, আপনার বয়স হয়ে গেছে, আপনার অবর্তমানে ভাইয়ারা কী করবেন না করবেন আমি জানি না। তাঁরা নিশ্চয় সংসার পাতবেন, বাচ্চাবুচ্চা হবে, তখন পুরো বাড়িতে আমি গলগ্রহ হয়ে থাকব। সেরকম পরিণতি আমি চাই না, বাবা।

-তা হলে তুই এই প্রস্তাবে রাজি?! বিস্ময়মাখা প্রশ্ন গওহর সাহেবের। কিšন্তু পালিতা কন্যাটি . . ?

-বাবা, ঐটা তো স্যারের মহানুভবতা। আমি স্যারের ছাত্রী হয়ে তা হলে কী শিখলাম? একটাই তো জীবন, মানুষ তো ভুল করতেই পারে, আমি না হয় একটা ভুল করলাম। এক ভুল দিয়ে আরেক ভুলকে কেটে দিলাম। ব্যস, এ্যাজ সিম্পল এ্যাজ দ্যাট।

সঈদুর তাঁর শিক্ষক টিলার বাড়িতে আসতে আসতে মধ্য রাতের কাছকাছি। স্ত্রী জাহিরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, তোমার ফিরতে এত রাত হলো যে। তুমি তো এত রাত কর না।

স্বামীর গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে নিতে সাহায্য করার সময় জাহিরা বললেন, সন্ধ্যায় নাকি ছাত্রদের হলে গোলাগুলি হয়েছে।

প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে সঈদুর বললেন, বাদ দাও তো এসব।
৭.

সঈদুর বাদ দিলেও রাত্রির গণ্ডগোলের সূত্র ধরে তারপরের দিন দু’টি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়ে যায় এবং দুই পাহাড়ের মাঝখানে যে গিরিপথটি আছে, যেটি পরবর্তীতে পাকা রাস্তা হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক পরিবেশকে বহুমাত্রিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেবে, সে গিরিপথের মারিচ কাঁটার ঝোপের মধ্যে ফেলে পরিসংখ্যান বিভাগের শেষ বর্ষের একজন ছাত্রকে কিরিচ দিয়ে জবাই করে হত্যা করে মৌলবাদী একটি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং হলগুলো বিকেলের মধ্যেই খালি করে দিতে বলা হয় এবং সেদিন বিকেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শহরের ক্লাবে ছাত্রটির লাশ আনা হয়, পরিবেশ হয়ে ওঠে ভারী ও বিক্ষুব্ধ। বিশেষ করে শিক্ষকরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে আশকারা দেবার অভিযোগ ওঠায়। শিক্ষকের পর শিক্ষক বক্তব্য রাখতে গিয়ে মূলত নানাভাবে উপাচার্যকে সামরিক শক্তির দালাল, প্রগতির নামে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের চর, এ জাতীয় বিশেষ বিশেষ বিশেষণে অভিধাযুক্ত করছিলেন, ফলে আবহাওয়া এমন হয়ে ওঠে যেন শিক্ষকরা এখনই উপাচার্যকে হাতের কাছে পেলে নিহত ছাত্রটির মতোই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবেন।

এক পর্যায়ে কদম আলী দাঁড়িয়ে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে উচ্চশিক্ষার পবিত্র রাজধানী হওয়া উচিত সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ভরণপোষণ চলছে, ফলে প্রগতির চেতনাধারী ছাত্রদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। হার্ভার্ডে আমি দশ বছর ছিলাম, এরকম পরিবেশ সেখানে স্বপ্নেও ভাবা যায় না। কাজেই আমরা শিক্ষকরা এই হত্যাকাণ্ডের অবিলম্বে বিচার চাই এবং যতদিন এর বিচার না হবে ততদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

তাঁর বক্তৃতা শেষ হলে তীব্রভাবে শিক্ষকরা উত্তেজিত হয়ে উঠলে, এ অবস্থার কোনো একটা হেস্তনেস্ত তৎক্ষণাৎ করতে চাইলে, অধ্যাপক শহীদুজ্জামান, যিনি এই প্রতিবাদ সভার সভাপতিত্ব করছিলেন, তিনি হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে অনুরোধ জানিয়ে যখন সিদ্ধান্তগুলো পড়তে যাবেন, তখন হঠাৎ হাত তুললেন সে সময়কার নবীন শিক্ষক সজল চৌধুরী। শহীদুজ্জামান সস্নেহে বললেন, তুমি কিছু বলতে চাও, বল।

সজল চৌধুরী বললেন, সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ, আপনারা আমার সালাম ও আদাব নিন। আজ খুব দুঃখভারাক্রান্ত মনে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। দুপুরে ক্যাম্পাসে যা ঘটে গেল সেটি কদম আলী স্যার বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার পবিত্রাঙ্গনে ঘটে যাবে এটা কল্পনাই করা যায় না। এখন নিহত ছেলেটির লাশ আমরা কফিনবদ্ধ করে এখানে শুইয়ে রেখেছি। শুনেছি খবর পেয়ে সুদূর চাঁদপুর থেকে তাঁর বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন লাশটি বুঝে নেবার জন্য রওনা হয়েছেন। এখন বিকেল পাঁচটা। তাঁরা হয়তো পৌঁছাবেন দশটার দিকে। এ চার-পাঁচ ঘণ্টা লাশটা এখানেই থাকবে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শহর ক্লাবে। সে যাবৎ আমরা এখানেই অপেক্ষা করব, অনেকে হয়তো যার যার বাসায় ফিরে যাব, আর অনেকে হয়তো লম্বা ছুটি পেয়েছেন বিধায় বাড়ি চলে যাবেন। এখানেই আমার কথাটা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আর যা বলেন সুস্থ বলা যায় না। দলীয় রাজনীতির প্রভাবে ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ এতটাই সন্ত্রাসনির্ভর হয়েছে যে বাবা-মা চিন্তা করেন ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালাম পড়ালেখা শিখে মানুষ হবার জন্য, সেখানে ছেলে ফেরত আসছে লাশ হয়ে। আজকে যে বাবা-মা নিহত ছেলেটির লাশ নিতে আসবেন তাঁদের আমরা কী জবাব দেব? হ্যাঁ, আপনারা বলবেন যে আমরা তো শিক্ষক, আমরা কেবল চাকরি করি, জবাবদিহিতার দায়িত্ব তো আমাদের নেই। সে যা হোক, বলছিলাম কি, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঙ্গামায় এই প্রথম ছাত্র মারা যায়নি, বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও এর আগেও মারা গেছে, এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও একইরকম। প্রতিটা মৃত্যুর সময় প্রতিটা ক্যাম্পাসে আমরা একটি পরিচিত চিত্রপট দেখি। হত্যাকাণ্ডের জন্য তদন্ত কমিটি হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং শিক্ষকরা শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে ক্লাস বর্জনসহ উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলনে নামি। আমরা সবাই সূ² বুদ্ধি নিয়ে চলি, জানি টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার, বা সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা জানি যে তদন্ত কমিটি করে কিছু হয় না বা হবে না, জানি যে শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন কর্মসূচিও কোনো দিক থেকে ফায়দা বহন করে আনে না কেবল সেশন জট তৈরি করা ছাড়া এবং এটাও জানি যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনও একসময়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। আপনারা আমার কথায় কিছু মনে নিয়েন না প্লিজ। আমি বয়সে নবীন, জ্ঞানেও খুব ছোট এবং চিন্তায় ভুল থাকা স্বাভাবিক।

শিক্ষকদের মধ্যে একজন বয়োজ্যৈষ্ঠ শিক্ষক হঠাৎ দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, তুমি থামো তো সজল, তুমি কী বলবে আমরা জানি-ইউ আর আ ফার্স্ট ক্লাস মডারেটর।

কদম আলী সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। রূঢ়ভাবে ঐ প্রবীণ শিক্ষককে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ওকে থামতে বলছেন কেন, আপনার কিছু বলার থাকলে ওর বক্তৃতা শেষ হলে বলবেন। বসেন।

কদম আলীর ধমক খেয়ে ঐ প্রবীণ শিক্ষক বসে গেলে শহীদুজ্জামান সভাপতি হিসেবে রুলিং দিলেন। এ প্রতিবাদ সভা অনেকক্ষণ ধরে চলবে, আপনারা যে যে বলতে চান বলতে পারবেন, তবে একজন বলার সময় তাঁকে বাধা দেবেন না। বল তুমি, সজল।

-দেখেন, আপনারা রাগ করবেন, আপনারা বিরক্ত হবেন, এরকম কিছু আমার বক্তব্যে থাকবে না, তবে আমি যেটি বলতে চাই, সেটি আপনাদের কাছে নতুন শোনাতে পারে। এবং নতুনের চিন্তা করাটাই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ, অন্তত আমি তাই মনে করি। বা হয়তো আমার চিন্তাটা মোটেও নতুন নয়, হয়তো অনেকে এ চিন্তা আগেও করেছেন। আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে নিষ্ফল পুনরাবৃত্তির চক্রে পড়ে যাচ্ছি। এখানেই আমার প্রতিবাদটা। সময়ের মূল্য সম্পর্কে আমরা সবাই পরিজ্ঞাত। নিউটন সময়কে একরৈখিক- অর্থাৎ আদি-মধ্য-অন্ত হিসেবে দেখেছিলেন, আর আইনস্টাইন সময়কে আপেক্ষিক হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। টাইম এ্যান্ড টাইড ওয়েইটস ফর নান-সময় এবং ঢেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এটা নিউটনীয় চিন্তার সঙ্গে মেলে। এখানে রোগের সঙ্গে তুলনা করে সময়ের ব্যাপারটা বোঝাতে পারি। যেমন সর্দি হলো, আপনি হাঁচির পর হাঁচি দিলেন, চোখ লাল হলো, নাকের এবং চোখের অজস্র পানি ঝরল, গা-ও একটু গরম হলো, সবাই দেখল আপনি ভীষণ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। এ্যান্টি-হিস্টামিন ট্যাবলেট খেলেন তিনদিন বা সাতদিনের মধ্যে আপনি ভালো হয়ে গেলেন। কিন্তু যদি কারো মারণব্যাধি হয় তার সিম্পটমই ধরা পড়বে বহু সময় পড়ে। সেরকম পোশাক কারখানায় বিশৃঙ্খলা হলে শ্রমিকের সঙ্গে পুলিশের দাঙ্গা হলো— দু’চারটি লাশ পড়ল, এ কারখানা বা কারখানাগুলো কয়েকদিন বন্ধ হয়ে রইল, ফলে পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানার মালিকের যেমন ক্ষতি হলো, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হলো যার একটা আর্থিক পরিমাণ জানা যেতে পারে- ধরুন, এত বা এত শ কোটি টাকা। এটা গেল দৃশ্যমান ক্ষতি বা পরিমেয়যোগ্য ক্ষতি। এবার আসুন, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে বা শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন কর্মসূচি চালু থাকলে কী ক্ষতিটা হয়। এখানে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সঈদুর স্যার উপস্থিত আছেন। আমি যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি, তখন স্যার ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। তখনো আমার বসার সিট পাইনি বলে সভাপতির রুমেই বসে থাকতাম। তখন একদিন এক ছাত্রী এল স্যারের কাছে একটি আবেদন নিয়ে। কী? অমুক সময়ে অমুক পরীক্ষার দিন তার ডেলিভারি ডেইট, কাজই সে সেদিনের পরীক্ষা পেছাতে চায়, অথবা শরীরের অবস্থা বুঝে সিক বেডে পরীক্ষা দেবার অনুমতি চায়। স্যার তার দিকে নিবিড়ভাবে তাকয়ে হেসে বললেন, তোমরা আধুনিক যুগের ছেলেমেয়ে একটু হিসাব করে ডেলিভারি-টেলিভারির তারিখ ঠিক করতে পারো না? মেয়েটি ঠোঁটে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে বলেছিল, স্যার, আমরা তো প্ল্যান ঠিকমতো করেছিলাম, কিন্তু আপনারা তো পরীক্ষা পিছিয়ে সব উল্টোপাল্টা করে দিলেন।

এ কথা শুনে এত শোকাবহ পরিবেশের মধ্যেও চাপা হাসির হুল্লোড় উঠল সমবেত প্রতিবাদী শিক্ষকদের মাঝে।

সজল চৌধুরী অত্যন্ত আবেগ সহকারে তাঁর বক্তৃতা দিতে থাকেন : আমি এইটাই বলছি। শিক্ষার ক্ষেত্রে লসটা ক্যান্সারের মতো, চোখে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির লসটা আমরা চোখে দেখি, টাকাটা গুনতে পারি, সময়টাও বলতে পারি যে এতদিনের মধ্যে টাকাটা পূরণ হয়ে যাবে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এক মাস নয়, এক দিন নয়, এক ঘণ্টা পিছিয়ে থাকলেও পুরো দেশ, পুরো জাতি যে কতটা পিছিয়ে যায়, তার হিসাব আর কেউ না করুক আমরা শিক্ষকরা তো করা উচিত। ছোটবেলায় যে প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম সেখানে যেতে বাসা থেকে টাউন এরিয়ার বাসে করে যেতে হতো এবং পথের এক পর্যায়ে একটি বাঁক ঘুরলেই চোখে পড়ত একটি একতলা সরকারি ভবন, নাম লেখা ছিল দুর্নীতি দমন অধিদপ্তর। আমি তো ছোট তখন, একবার পাশে বসা এক বাস যাত্রীর কাছে শুনলাম নিজের মনে বলছে, দুর্নীতির আখড়া, আর নাম দিয়েছে দুর্নীতির দমন। যত্তসব। ঐ লোকটার চেহারা আমি আজকে মনে করতে পারি না, তবে তাঁর কথা সব মনে আছে। মুশকিল হলো, যতবারই শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনের কর্মসূচিতে যায়, ততবারই ঐ লোকটার কথা আমার মনে পড়ে। শিক্ষকরা কোথায় শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেখানে তারাই শিক্ষাকে পিছিয়ে নেবার আয়োজনে নামে। এটা গেল নিউটনীয় অর্থে সময়ের অপচয়ের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ যে দিন গেছে, সে দিন আর ফেরত আসে না।

এবার নবীন কয়েকজন শিক্ষক হাততালি দিয়ে সজলকে উৎসাহ দিল, চালিয়ে যাও, দোস্ত। আসল কথা এটাই।

সজল চৌধুরী গলা আরো বড় করলেন, শুনুন, আইনস্টানীয় অর্থে আমরা কিভাবে সময়ের সৃজনশীল ব্যবহার না করে অপচয়ের গাড্ডায় নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছি। আমি একটা ভয়াবহ আত্মপ্রবঞ্চনার কথা বলতে চাই। হয়তো আপনারা সবাই সেরকম না, হয়তো আমিও সেরকম নই। কিন্তু এ ধারণা এ চাকরিতে যোগদান করার পর আমার ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে যে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা গোপনে গোপনে প্রত্যাশা করেন যে কোনো একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা হোক বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাক এবং তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে পড়াশুনা আর গবেষণা ছেড়ে ক্ষেত-খামার করুক, ক্লাবে এসে তাস খেলুক, ক্যারাম খেলুক এবং রাজা-উজির মারুক। নিশ্চয় ব্যক্তিগতভাবে সকল শিক্ষক পাঠ্যানুরাগী ও পরিশ্রমী, কিন্তু যখন একটা উল্টো সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যায় তখন ব্যক্তি আর ঐ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পেরে ওঠে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ঐ অপসংস্কৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয় এবং নিজের অজান্তে ঐ সংস্কৃতির প্রবক্তা হয়ে ওঠে। যিনি গবেষণা করতে সক্ষম, যাঁর ঐ মেধা আছে, তিনি তাঁর ঐ প্রতিভাকে তখন অপসংস্কৃতির পূজায় লাগায়। এখানে সমাজের ও রাষ্ট্রের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়।

একপ্রস্থ নিঃশ্বাস নেবার জন্য সজল থামেন, শিক্ষকদের মধ্যে নানা গুঞ্জরণ শোনা যায়। সন্ধ্যা নেমে পড়েছে। ক্লাব প্রাঙ্গণের সীমানার কাছে দাঁড়ানো নারিকেল গাছের সারিতে বাতাসের দোলা লেগে হিল্লোল উঠেছে। স্নিগ্ধ বাতাসের শিহরণ সবার গায়ে লাগল। ক্লাব প্রাঙ্গণের ব্যাডমিন্টন খেলার লাইটগুলো জ্বলে উঠল। সামনে নিহত ছাত্রের কফিন, শিক্ষকদের শোকসভা, আর ছাত্রদের ভিড়ে ক্রমশ বিশাল একটা জমায়েতে পরিণত হলো সেটা। আর মাইক ছাড়া খালি গলায় এতক্ষণ ধরে কথা বলে যাচ্ছিলেন সজল চৌধুরী। সে বহু বছর আগে তাঁর বুবুর কথায় তাঁর যে অপমান লেগেছিল, যে অপমানের জবাব দিতে তিনি নিজেকে সকল দিক দিয়ে ভাঙছেন আর গড়ছেন, যে কারণে জীবনের যে কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে তিনি প্রায় অকুতোভয়, সেরকম ভীতিহীন একটা পর্যায়ে যেন তিনি চলে গেছেন। আবার তিনি কথা বলতে শুরু করলেন…।

-জানেন, প্রতিটা আন্দোলনের যেমন একটা গভীর উদ্দেশ্য থাকে, তেমনি এর একটা হালকা দিকও থাকে। জিনিসটা আমি কতটুকু পরিষ্কার করে বলতে পারব জানি না। বলতে চাই এটি যে শিক্ষকরা যদি একটা হালকা চালে থাকেন, তা হলে তাঁদের কাছে মনে হবে যে তাঁদের নানারকম দাবি পূরণ, এমনকি উপাচার্যের বিরুদ্ধে পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি এগুলো সব বাস্তবায়নের জন্য মোক্ষম অস্ত্র হলো ক্লাস বর্জন, কিংবা সময়ে সময়ে পরীক্ষাবর্জন; কিন্তু এসব কর্মসূচি যতই কার্যকর কিংবা মহৎ হোক না কেন, আমরা শিক্ষকরা যে বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত থাকি তা নয়। তারপরও এই স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বার্থপর কর্মসূচি আমরা গ্রহণ করি কারণ আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা আমাদের আমাদের অধিকার সম্পর্কে একান্ত উগ্রভাবে তৈরি করে। যদি আমরা একটু ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করি, যদি জীবনের গভীর উদ্দেশ্য মাথায় রাখি যেখানে দেশসেবা, মানবসেবার কথা এসে পড়বে তা হলে দেখব যে ক্লাস বর্জন কর্মসূচির ফলে আমরা নিজেদের যেমন অযোগ্য করে তুলছি, তেমনি শিক্ষার্থীদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করছি, সর্বোপরি দেশের ক্ষতি করছি। রাজনৈতিক বহু লক্ষ্য থাকতে পারে কিন্তু কোনো লক্ষ্যই দেশসেবার ওপরে হতে পারে না।

সজল চৌধুরী হয়তো আরো কিছু বলতেন, সেটি আর হলো না। সবার অলক্ষ্যে কখন যে আকাশে মেঘ জমেছে আর জোরালো বাতাসসহ বৃষ্টি নেমে আসবে তা কেউ বুঝতে পারেনি।

সে রাত্রিতে তারপরও ক্যাম্পাসে একটা বাস যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন সেসব শিক্ষককে নিয়ে ফেরত যাবে। ক্যাম্পাসের থমথমে অবস্থা। হলগুলো খালি হয়ে গেছে। সঈদুর ঠিক আগের রাতে যেমন গভীর রাতে ফিরেছিলেন এবং জাহিরা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করেছিলেন, আজকে তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগ নিয়ে প্রায় মূল ফটকের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি গলির মাথায় রাস্তায় থামল। বাস থেকে নেমে সঈদুর দ্রুত পায়ে বাসার গলিপথ দিয়ে টিলায় উঠছিলেন। অভ্যস্ত পায়ে পিছলা পথে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল না। আর স্বামীর হেঁটে আসার দিকে তাকিয়ে জাহিরা ভাবছিলেন লোকটার সাহস আছে বটে। ক্যাম্পাস ছেড়ে অন্য কোনো শিক্ষক শহরে যাননি, কিন্তু তিনি গেছেন।

আর সঈদুর ভাবলেন, দূর, এই ছাত্রটা মারা না গেলে কদম আলীর সঙ্গে আলাপটা তোলা যেত। জাহিরা তাঁর গা থেকে বৃষ্টি ভেজা পাঞ্জাবিটা খসিয়ে নিতে নিতে বললেন পুরো ক্যাম্পাস তো পুলিশ ঘিরে রেখেছে।

অসীম বিরক্তি নিয়ে সঈদুর বললেন, বাদ দাও তো এসব কথা।
৮.

কদম আলীর সঙ্গে সাবেরার বিয়ের দিন যে আয়োজনটা হলো তা দাড়ি কমায় মনে আছে কদম আলীর। বিয়েটা যেন দু’দিক থেকে দু’রকম হলো। বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল গওহর মঞ্জিলের প্রাঙ্গণে। উঁচু করে শামিয়ানা টানা হয়েছিল সীমানা প্রাচীরের নারকেল গাছগুলো ধরে বাসভবনের কার্নিস পর্যন্ত। ডেকোরেটর খাবার টেবিল বসিয়েছিল প্রতি টেবিল ছয়জন করে। হ্যাজাক বাতির আলোয় পুরো অনুষ্ঠানস্থল সাদা আলোয় ছিল উদ্ভাসিত। প্রাঙ্গণের উত্তর দিকে বর বসার জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। মঞ্চের পেছনে লাল কাপড় টেনে তার ওপর নারকেল গাছের এক জোড়া ডাল কেটে পাতাগুলো সুন্দর করে ছেঁটে আড়াআড়ি একটার ওপর আরেকটা রেখে কাঁটা তার দিয়ে সাঁটানো হয়। ডাল দু’টোর ক্রসের ঠিক ওপরে হলুদ কাগজ কেটে লেখা ছিল সাবেরা-কদমের শুভ বিবাহ। কদম আলী নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ফুলসজ্জিত মোটর গাড়ি আর একটি ভাড়া করা মাইক্রোবাস। বরযাত্রী হিসেবে ছিলেন সঈদুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী জাহিরা বেগম, আর শহীদুজ্জামানসহ শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। কদম আলী যেমন জানতেন এটি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ, সামান্য যে কয়জন বরযাত্রী ছিলেন তাঁরাও ব্যাপারটাকে সেরকম ভেবে নিয়েছিলেন। কদম আলী গাড়ি থেকে নেমে সঈদুর রহমান ও অন্যদের নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে বর বসার মঞ্চে উঠতে গেলে একদল কিশোর-কিশোরী হৈচৈ করতে করতে তাঁদের বাধা দিল। মঞ্চের ভেতরে ঢুকতে গেলে বরকে নগদ টাকা দিতে হবে। গেট ধরার পর্বটি খানিকটা উত্তেজনার সৃষ্টি করল। একটা লম্বা-চওড়া মাথা তোলা ছেলে কিছুতেই যে দাবি তারা করেছে তার চেয়ে একটা টাকাও কম নেবে না। তখন শহীদুজ্জামান তার আবদার ঠেকানোর জন্য একটা বড় বাদামি ঠোঙায় ঠাসা বেলা বিস্কুটের প্যাকেট তার হাতে ধরিয়ে দিল। মুহূর্তে চোখের পলক ফেলার আগে ছেলেটি ঐ বিস্কুটের প্যাকেটটি পায়ের তলায় ফেলে তার জুতোসহ পা দিয়ে লাথি মেরে মেরে গুঁড়িয়ে দিল। বরপক্ষের সবাই উচ্চশিক্ষিত তাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের আচরণ সম্পর্কে তাঁরা অবহিত। এমন কি তাঁদের চোখেও আলোচ্য কিশোরের ব্যবহার অভব্য বলে মনে হলো। ঠাস করে একটা চড় পড়ল ঐ কিশোরের গালে। সঈদুর রহমান চিনলেন তাঁকে। মোজাম্মেল— সেদিন গ্যারেজে যাঁর সঙ্গে ক্ষণিকের পরিচয় হয়েছিল। ‘বেয়াদপ’—আশকারা পেতে পেতে মাথায় উঠেছে। যাও। জি, আপনারা আসেন স্যার। স্যার, ঢোকেন।

মহাহতভম্ব অবস্থায় কদম আলী বরের আসন গ্রহণ করলেন। সঈদুর রহমানরা সবাই মঞ্চের সামনে পেতে রাখা সোফায় বসলেন। করুণ স্বরে গ্রামফোনে বিসমিল্লাহ খানের সানাই বাজতে লাগল। কদম আলী মনে মনে ভাবলেন, এরা তো পুরো বিয়ের মেজাজ রেখেছে দেখি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে তিনি অতিথি অভ্যাগতদের পোশাক-আশাক, বিশেষ করে মহিলাদের অতিরিক্ত সাজসজ্জা, হ্যাজাক বাতির জাঁকজমক আলো প্রদান, খাবার টেবিলে অতিথিদের ভিড়, সাদা এপ্রোন পরা ওয়েটারদের খাবার সরবরাহে ব্যস্ততা, কোথাও কোথাও অতিথি-অতিথি ঘেঁষাঘেঁষি, আর দেখলেন যেখানে বাড়ির সিঁড়ির ঘরটা প্রাঙ্গণের ওপর ছেড়েছে সেখানে ঐ কিশোরকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার জটলা। সে জটলা ছেড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন লাঠি হাতে দুর্বল পদচারণায় গওহর সাহেব। তাঁর পেছন পেছন মোজাম্মেল। পেছনের জটলাটা হালকা হয়ে গেল। ঐ দুর্বিনীত কিশোর প্রচণ্ড শব্দে গালিগালাজ করতে করতে বিয়ের অনুষ্ঠান ত্যাগ করল। গওহর সাহেব মোজাম্মেলকে নিয়ে ঠিক সঈদুর রহমান যেখানে বসেছিলেন সেখানে এলেন। পাশে বসা শহীদুজ্জামান তাঁকে বসার জন্য জায়গা করে দিলেন। এতক্ষণে কদম আলী দেখলেন আরো একটি লোক তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা একহারা গড়ন। সাদা আচকান পরা। মাথায় ফেজ টুপি, আর চিবুকে ছুচোলো এক পশলা দাড়ি। দাড়ির মতো ছুচোলো লোকটির নাক। পরে জানবেন কদম আলী যে এ লোকটা হচ্ছে সাবেরার মায়ের চাচা, অর্থাৎ সাবেরার নানা, ওকালতি পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন, ধর্মকর্ম করে বাকি সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন।

গওহর সাহেব ধীরে ধীরে কিন্তু তাঁর ভারী গলায় বললেন, প্রফেসর সাহেব, উনি আমার চাচা শ্বশুর। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। একটু যদি ভেতরে আসতেন। গওহর সাহেবদের সাথে সঈদুর আবার সেদিনের সে বসার ঘরে ঢুকলেন। কিন্তু অতিথিদের ভিড়ে সে ঘরে বসার কোনো অবস্থা ছিল না। তাঁরা আবার বিবাহস্থলে ফিরে সোফায় বসা লোকজনদের সরিয়ে বসলেন।

গওহর সাহেব বললেন, আমার মেয়ের যে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়েছিলাম তার আইনি কাগজ আমাদের কাছে আছে। প্রফেসর সাহেবেরটা সম্ভবত নেই। সে ক্ষেত্রে আমরা কী করব? গওহর সাহেবের পাশে বসা উকিল শ্বশুর এমনভাবে ঘাড় নাড়ালেন যে যেন এটার চেয়ে ধ্রুব আইনি সত্য পৃথিবীতে আর নেই। কথাটা শুনে সঈদুর খানিকটা বাকহীন হয়ে রইলেন। এরকম একটা বাস্তব কথা তাঁর একবারও মনে হয়নি। অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, তাই তো, এ কথাটা তো আমার একবারো মনে হয়নি। তবে যতটুকু বুঝতে পারছি, কদম আলী সাহেবের কাছে ঐরকম কোনো কাগজ থাকার তো কথা নয়। একে তো বৌটা ছিল বিদেশিনী, তারপরে আমেরিকান। সে দেশের কি রীতি, আমার জানা নেই। তো আপনারা এ প্রশ্নটি আগে তুলেননি কেন? বিয়ের রাতে তুলছেন, এটা কেমন ব্যাপার। গওহর সাহেব বললেন, আমারও তো কখনো এই প্রশ্নটা মনে জাগেনি। চাচা শ্বশুর সকাল বেলায় এসে আমাকে বললেন যে যে কোনো বিয়ের একটা আইনি বৈধতা থাকতে হবে। তখন তিনি সাবেরার বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজটি আছে কিনা জানতে চাইলেন এবং আপনাদেরটাও আছে কিনা সেটিও তাগিদ দিলেন জানতে। কথার মাঝখানে চাচা শ্বশুর মাথা গলালেন, বললেন, প্রফেসর সাহেব, জানেনই তো বাস্তব জীবন বড় জটিল। কোনো ডিসপুট থাকা ঠিক না। কোনোদিন যদি প্রফেসর সাহেবের আগের স্ত্রী ফিরে আসেন আর এই বিয়েকে চ্যালেঞ্জ করেন তা হলে আমাদের জন্য সেটি বিব্রতকর হবে। অসহায় ভঙ্গীতে হাত নেড়ে সঈদুর বললেন, এ সমস্যার তো এ মুহূর্তে সমাধান সম্ভব নয়। বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর দেখা যাবে।

-ঐ তো ঐ কথা জানানোর জন্য, যাতে পরে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। সারা পৃথিবীর সততা মুখে নিয়ে উকিল চাচা বললেন।

-তাতো বটেই। বলে সামান্য অপমানিত বোধ করার কারণে সঈদুর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

খাবার টেবিলে কদম আলী দেখলেন পুরো একটা ছাগলের রোস্ট দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে লোহার একটা থালার ওপর। মসলা-মরিচের গন্ধে তপ্ত হয়ে আছে পরিবেশ। নতুন জামাইকে পাতে পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা আর ডিমের কারি তুলে দেবার জন্য কনে পক্ষের বাছাই করা কয়েকজন তাঁর পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে এমন ব্যতিব্যস্ত হলেন যে কদম আলী তাঁর সিল্কের প্রিন্স কোটের গলার বোতামটা ছেড়ে দিতে চাইলেন। শার্টের নিচে তিনি কুলকুল করে ঘামছিলেন। সঈদুর মনে মনে খুশি। ছাগলের রোস্টটার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, শহীদুজ্জামান ভাই, নেন ছুরি চালান।

-ওরে বাপ, ও কম্ম আমার না। বলে কিন্তু তিনি থালার ওপরে রাখা চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের ছুরিটা হাতে নিলেন। ছাগলটা আগুনে ঝলসানোর সময় যে লোহার শিক ওটির মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে লেজের দিকে বের করা হয়েছিল, সে শিকটি এখনো ঐভাবে আছে। শহীদুজ্জামান মুখের দিকের শিকের অগ্রভাগ বাম হাত দিয়ে ধরে ডান হাতে ধরা ছুরি দিয়ে যে মাত্র রানের দিকে পোঁচ দিলেন, ছাগলটা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ঢলাৎ করে কাত হয়ে থালার ওপর পড়ে গেল। সে ধাক্কায় থালার মধ্যে জমানো তেলের ছিটকা লাগল কদম আলীসহ সবার গায়ে।

-দূর, এটা কি করলেন? যেটা জানেন না, সেটা করতে যান কেন? সঈদুর লম্বা মানুষ। কথাটা বলে তিনি দাঁড়ালেন। ছুরিটা শহীদুজ্জামানের হাত থেকে নিয়ে এবার শুয়ে থাকা ছাগলটার বিভিন্ন অংশে পোঁচ দিয়ে তিনি ঠিকই একের পর এক গোশতের টুকরো সবার পাতে পাতে দিতে লাগলেন। অদ্ভুত এক তৃপ্তি নিয়ে সবাই খাওয়া শেষ করলে সঈদুর বুঝতে পারলেন কেন বারবার কনেপক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয়েছিল যে যেন মৌমিতাকে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা না হয়। এ বিয়েটাকে এ বাড়ির পক্ষ থেকে মোটেও দ্বিতীয়বারের বিয়ে ভাবা হচ্ছে না, প্রথমবারের বিয়েই ভাবা হচ্ছে।

খাওয়া-দাওয়ার পর কদম আলী আর মঞ্চে উঠলেন না, সামনের সারিতে সোফায় বসলেন। পানের সাঁজি নিয়ে এক কিশোরী মেয়ে তাঁর সামনে ধরল। খুব সপ্রতিভ মেয়েটি বলল, দুলাভাই, নেন পান খান।

সঈদুর পাশ থেকে বললেন, শালি? কী নাম তোমার?

মেয়েটি হঠাৎ জিভটা লম্বা বের করে ভেংচি কেটে বলল, শালি, কী নাম তোমার? তারপর হাসতে হাসতে দে ছুট। সঈদুরের সাথে সাথে কদম আলীও নিরাশ হয়ে পড়লেন। ব্যাপারটা কী, এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা কি আদব কায়দা শেখেনি নাকি?

আক্্দের ব্যাপারটা সেরে নেবার পর রুসমতের জন্য কদম আলীকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলে দেখা গেল সেই একই ব্যাপার। মেঝের ওপর একটা লাল রঙের মাদুর পাতা। তার ওপর সাবেরার পাশে বসানো হলো কদম আলীকে। এ সময় কে যেন কদম আলীর মাথার টোপর ধরে পেছন থেকে টান দিল। টোপরটা তাঁর মাথা থেকে খসে যায় প্রায়। সঈদুর ধমক দিয়ে উঠলেন, কী হচ্ছে এসব?

আবারও মোজাম্মেল এসে ভিড়ের সামনে দাঁড়ালো, সব যেন মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। সাবেরার পক্ষে দু’জন মধ্যম বয়সের মহিলা অতিরিক্ত সাজসজ্জার বাহুল্যে যেন হাঁটতে পারছিলেন না। তারপরও এ দু’জন সাবেরা আর কদম আলীর পাশে বসলেন। প্রথমে পাতলা একটা ওড়নার আড়ালে দু’জন দু’জনকে শরবত খাওয়ালেন। উপস্থিত সবাই হাত তালি দিল। একজন যুবক এই গরমেও কোট টাই পরা। প্রচুর ঘামছিল সে। তার মধ্যে একটা ইয়াশিকা-৩৫ ক্যামেরা দিয়ে সে কেবলই ছবি তুলে যাচ্ছিল। মাঝে মঝে শাটার টেপার ফাঁকে ফাঁকে ঘোষণা দিচ্ছিল, তার ক্যামেরার রিলগুলো রঙিন। সিঙ্গাপুর থাকেন তাঁর বড় ভাই। তাঁর কাছে পাঠানো হবে রিলগুলো। তারপর সেগুলো রঙিন ছবি হয়ে আসবে। সবাই যুবকের তৎপরতা পছন্দ করতে লাগল।

শরবত খাওয়ানোর পর বর কনে পরস্পরকে এক নজর দেখার জন্য মহিলাদের একজন একটি আয়না ধরলেন। আয়নার ভেতর দিয়ে বর-কনের চক্ষুমিলন হলো। দু’জন দু’জনকে এতদিন ধরে দেখে এসেছেন, কিন্তু কোনোদিন তো এই সম্পর্কের অর্থে দেখেননি, তাই যেন পরস্পরকে তাঁরা নতুনভাবে দেখলেন। আংটি বিনিময় হবার পর কদম আলী উঠে দাঁড়ালেন। সাবেরাও উঠলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় গওহর সাহেব তাঁর মেয়ের হাত সঈদুরের স্ত্রী জাহিরা বেগমের হাতে সঁপে দিয়ে বললেন, মা-মরা মেয়ে আমার, ভাবী একটু দেখবেন। উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে ক্রন্দন রোল পড়ে গেল। সাবেরার চোখ ভিজে উঠেছে। তবে জল গড়িয়ে পড়ল না। অত্যন্ত ধীর পায়ে প্রচুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি তাঁর সদ্য বিবাহিত স্বামীর পেছন পেছন ঘরের বাইরে পা দিয়ে উঠোন পেরিয়ে ফুল সজ্জিত গাড়িটিতে উঠে গেলেন। ভুলে যেতে চেষ্টা করলেন এভাবে তিনি আরো একবার আরেকটি গাড়িতে উঠেছিলেন।
৯.

বাড়ির মূল ফটকের সামনে পৌঁছামাত্রই গাড়ির চালক হাসেম যেন হর্ন বাজিয়ে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে দিতে চাইল। হেডলাইটের আলো সে বার কয়েক অন এবং অফ করল। আসলে এসবের কিছুই দরকার ছিল না। মায়মুনা মৌমিতাকে নিয়ে একতলার বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। এবার সে মৌমিতাকে হাঁটিয়ে ফটকের কাছে এলে সায়মা ফটক খুলে দিল। বাড়ির প্রাঙ্গণে গাড়ি ঢোকার মতো রাস্তা তৈরি হয়নি। গাড়ি থেকে সাবেরাকে নিয়ে কদম আলীর ফটকের মুখেই নামতে হলো। রাত গভীর। পাড়া-প্রতিবেশী উৎসুক যারা প্রফেসরের দেশি বৌ দেখতে অপেক্ষা করছিল, তারা রাত বেশি হচ্ছে দেখে চলে গেছে। গাড়ির হেডলাইটের আলো জ্বলছে। সাবেরা এক লহমায় দেখলেন বিয়ে বাড়ির আমেজ কোথাও নেই। তাঁর পা যেন সামনে এগুতে চাইছিল না। কিছু একটা বুঝে কদম আলী তাঁর হাতটি ধরলেন। সাবেরা এবার নির্ভরতার সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় যে মাত্র পা দিলেন অমনি তিন বছরের মেয়ে মৌমিতাকে মায়মুনা সাবেরার বুকের ওপর যেন ঢেলে দিল। (পাঠক, বর্তমান ঘটনাটির কাল এবং এটি নিয়ে রচিত কালের মধ্যে প্রায় ৪৬ বছরের পার্থক্য। মৌমিতাকে মায়মুনা যে মাত্র সাবেরার বুকের কাছে ঠেসে দিলেন, এ কালের একটি তুলনা দিলে সাবেরার প্রতিক্রিয়া বোঝানো যাবে। এখন যে টাচ ফোনের প্রচলন হয়েছে সেটির পর্দায় স্পর্শ করা মাত্রই পুরো মোবাইলটা যেভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, ঠিক মৌমিতার শরীর সাবেরার অঙ্গ স্পর্শ করা মাত্রই তাঁর সর্বশরীরের মধ্যে ঐরকম একটি প্রতিক্রিয়া হলো, আর সেটি হলো প্রচণ্ড ঘৃণার)। সাবেরা মৌমিতাকে বাহু দিয়ে আঁকড়ে না ধরার ফলে সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। কদম আলী আর্তস্বরে বলে উঠলেন, কী হলো! সাবেরা অনোন্যপায় হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর মুখে কোনো ভাষা ফুটছে না। পেছন থেকে গাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলো তাঁর পিঠে পড়েছে। সে জন্য তাঁর মুখ অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। সাবেরার চোখ গভীর কালো, সেটা এ রাত্রির অন্ধকারে কোনো ব্যাপার না। তিনি আত্মপ্রত্যয়ী মহিলা, সেটিও এ রাত্রির অন্ধকারে কোনো ব্যাপার না। আচমকা মৌমিতার শরীরের স্পর্শে তাঁর মধ্যে নিজের অজান্তেই যে রি রি ভাবটা জেগে উঠেছিল এবং ঘৃণার এই বিষধর সাপটি যে তাঁর মধ্যে লুকিয়েছিল সেটি তো তিনি জানতেন না। মায়মুনা সাধারণ মহিলা হলেও জীবনের গভীর ব্যাপারগুলো তার বোধের বাইরে নয়। মৌমিতাকে মাটি থেকে লুফিয়ে কোলে তুলে নিয়ে সে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে অনুচ্চস্বরে আহ্বান জানালো, মামি, সালেমালেকুম। আস্তে আস্তে আসেন, কোনো অসুবিধা নেই।

দোতলায় কদম আলীর শোবার ঘরে পা ফেলা মাত্রই সাবেরাকে অতি আদবের সঙ্গে বাউ করে ঘরের ভেতর আহ্বান জানালেন কদম আলী। বললেন, জি, সম্রাজ্ঞী, এটিই আমার বেডরুম। সাবেরা চোখ তুলে তাকানোর আগে তাঁর নাকে তাজা ফুলের গন্ধ অনুভব করলেন।

ঘরের ছাদের সঙ্গে একটি পুরোনো আমলের ঝাড়বাতি ঝুলছিল। সেটিতে আলো জ্বলে না। এক পাশের দেয়ালের গায়ে টিউব লাইটটা জ্বালালে সাবেরার চোখে পড়ল যে পুরোনো আমলের সেগুনের খাটটা তিনি সেদিন দেখে গিয়েছিলেন সেটার মশারি টাঙানোর বাজুর চারপাশ ধরে কিছু তাজা ফুলের মালা ঝোলানো হয়েছে। ফুলের গন্ধটা আরেকবার নাক ভরে টেনে তিনি হাতলওয়ালা একটি পুরোনো সেগুন কাঠের চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলেন। কদম আলী পূবর্বৎ হালকা গলায় বললেন, নো, নো, নট হিয়ার, বাট দেয়ার। এ কথা বলে সাবেরাকে পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে খাটের কাছে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন।

সাবেরা বা কদম আলী তাঁদের নিজ নিজ মনের খবর নেবার আগে যেটি হলো তার জন্য তাঁরা মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলেও শারীরিক স্বয়ংক্রিয়তায় যেন পরের মুহূর্তগুলো কাটল। মনের আগে ক্ষুধার্ত শরীর যেন এগিয়ে গেল, কথার আগে যেন হাত, চোখে পরস্পরকে ভালো করে দেখার আগেই পরস্পরের চোখ বুজে গেল আর দু’জোড়া ঠোঁট শরীরের অমোঘ চাহিদার কাছে হার মেনে চুম্বকের মতো এক জোড়া আরেক জোড়ার সঙ্গে লেগে গেল। টিউব লাইটের আলোয় ছাদের গায়ে এক জোড়া টিকটিকি যে অনুরূপ কর্মে লিপ্ত, সেটি চোখ বুজে থাকার কারণে কদম আলী বা সাবেরা কেউই দেখলেন না। বাইরে রাত আরো গভীর হয়েছে। প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো নিশ্চল নারকেল গাছগুলো হঠাৎ এক প্রস্থ বাতাসে সামান্য দুলে উঠে আবার স্থির হয়ে গেছে। বিকেলে ঝরা এক পশলা বৃষ্টির শীতলতা এখনো রাত্রিজুড়ে বিরাজ করছে। আর সাবেরার উরুর ওপর থেকে পা জোড়া খসিয়ে কদম আলী যখন তাঁর পাশে ঢলে পড়লেন, তখনও সাবেরার নগ্ন বুকে তাঁর হাত স্থাপিত। ঠোঁটের কাজ ঠোঁট করেছে, জিভের কাজ জিভ করেছে, শরীরের হাত, আঙুল, আঙুলের নখ, পা, পায়ের পেশি, কোমর, কোমরের দৃঢ়তা এবং কোমরের নাব্য— এ যুগের টাচ ফোনের মতো যখন দু’জনের শরীরের সকল স্বয়ংক্রিয়তা ক্রিয়াশীল থেকে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল তখন কদম আলী বললেন, তোমার এসব জায়গা বেশ ভরাট, তাই না?

স্বামীর চুলে এক হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে সাবেরা বললেন, তোমার পছন্দ হয়েছে?

-পছন্দ হয়েছে মানে? এ বলতে না বলতে আবার দু’জন দু’জনের শরীরকে খুঁজে নিল।
গভীর প্রশান্তির রাত কেটে গিয়ে প্রকৃতির নিয়মে ভোর ফুটল, আরো পরে একটু সকালও ফুটল, পোলাও ভাতের ওপর ছিটিয়ে দেয়া পোড়া পেঁয়াজের ছিবড়ার মতো আকাশের গায়ে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘও দেখা গেল, তারও এক ঘণ্টা পরে মায়মুনা নবদম্পতিকে ডাকল নিচের তলায় নাস্তা করতে।

এ বাড়ির সবকিছুর মধ্যে পুরোনো দিনের ঐতিহ্যের ছাপ। টেবিলটাও পুরোনো সেগুন কাঠের, চেয়ারগুলোও তাই। দু’জন মুখোমুখি বসলে মায়মুনা এল হাতে এক ট্রে নাস্তা নিয়ে, পেছনে সায়মা আরেকটি ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে। মায়মুনা সব পদগুলো একে একে টেবিলে সাজালে কদম আলী বললেন, মায়মুনা, তুই যে ওকে মামী ডেকেছিস সেটা ঠিক আছে। আমি নাস্তা করে একটু কাজে বের হব, তুই তোর মামীকে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাবি। ঠিক আছে?

মায়মুনা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

মায়মুনা আর সায়মা নিষ্ক্রান্ত হবার পর কদম আলী গতরাতের রসিকতাপ্রবণ মন নিয়ে বললেন, থিংস দ্যাট ম্যাটার। এবার বল, হাউ উইল উই ট্যাকল দিস প্রবেøম?

-কোনটা? প্রশ্নটার কোনো হদিশ না পেয়ে সাবেরার কণ্ঠে পুরো উৎকণ্ঠা।

-এ যে মৌমিতাকে তুমি মেনে নিতে পারলে না!!

-কেন, ওকে মেনে নেয়া না নেয়ার কোনো শর্ত ছিল নাকি আমাদের বিয়েতে??

-তা ছিল না। ওতো এ পরিবারের একজন সদস্য। আমি তাকে খুব আদর করি।

-দেখ, সাবেরার কণ্ঠ খুব কঠিন শোনালো। তোমার কা’কে আদর লাগে না লাগে সেটা তোমার ব্যাপার। আমারটা আমাকে বুঝতে দাও। বিভাগের শিক্ষক ছিলে স্যার ডেকেছি, এখন তো আমি তোমার ঘরের বৌ, তবে এটা ঠিক করে আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি যে তোমার কোনো ব্যাপারে আমি বাধ সাধব না, তুমিও আমার কোনো ব্যাপারে বাধা দেবে না।

কদম আলী মৌলিকভাবে রগচটা একজন মানুষ। অনেকটা ঝাঁঝমাখা গলায় বললেন, সাবেরা, দেখ এক সঙ্গে আমরা সংসার করতে গেলে শুধু যে পরস্পরের স্বাধীনতার কথা বলব তা নয়, মিচ্যুয়ালিটির ব্যাপারটাও আছে। স্বাধীনতা তো স্বীকার করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু এক সাথে থাকতে গেলে ব্যাপারটা আসলে ঠেকে পারস্পরিক সহনশীলতায়। স্বাধীনতা আর সহনশীলতা দু’টো আলাদা জিনিস। স্বাধীনতা মানে আমি আমার স্বার্থ নিয়ে রইলাম, তুমি তোমার স্বার্থ নিয়ে রইলে, আর আমি যে কথাটি বলছি সেটি হলো আমরা আমাদের পরস্পরের যে গুণ বা দোষগুলো পছন্দ করব না, সেগুলো শুধু মেনে নেওয়া নয়, সেখানে অংশগ্রহণের কথা বলছি। এটিই আমার ধারণায় সহনশীলতা বা মিচ্যুয়ালিটি।

-বুঝলাম না।

-না বোঝার কিছু নেই। তোমরা তো সবাই জানো মৌমিতাকে আমি কোন অবস্থায় এ ঘরে নিয়ে এসেছিলাম। আমি চাই, মৌমিতাকে যদি আমি বাবা হিসেবে স্নেহ দিই, তুমিও মা হিসেবে তাই করবে। স্বাধীনতা মানে স্বার্থপরতা, আর সহনশীলতা মানে স্বার্থত্যাগ। আমি সেটাই বলতে চাইছি।

সাবেরা পরোটার একটি অংশ ছিঁড়ে তা দিয়ে ডিমের ওমলেটের শেষ টুকরোটা জড়িয়ে মুখে পুরে আস্তে আস্তে চিবোতে লাগলেন। তাঁর লাল রঙের নাইটির বুকের দিকে অনেকখানি নামানো যার ভেতর দিয়ে তাঁর পুরুষ্ট স্তনের গিরিরেখা উঁকি মারছিল। কদম আলীর চোখ আনমনে সে অংশটি চাখছিল।

সাবেরা মুখ নাড়া বন্ধ করে একটু পানি খেলেন। সামান্য বিষম খেলেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটা সহ্যক্ষমতার। আমি ইনস্টিংকটিভলি পারছি না ওকে গ্রহণ করতে। বিশ্বাস কর, এটি ভাবতেই আমার বমি আসে। তারপরও তোমার কথা যদি আমাকে মানতে হয়, তাকে যদি আদর দেখাতে হয়, সেটাও হবে নিছক মিথ্যে— প্রায় পাগলামির পর্যায়ে পড়বে।

কদম আলী বললেন, তোমার মতো অত সৎ ব্রত নিয়ে আমি জীবনে চলি না। আমার তো মনে হয় পৃথিবীর সকল সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা যে অভিনয় চলে না, তা নয়। এ অভিনয় না থাকলে সম্পর্কই টিকতো না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

-এটা আবার কী বললে। জোর করে সম্পর্ক টেকাতে চাই না বলে আমরা দু’জন— আমিও যেমন, তুমিও তেমন-আমরা দু’জনই তো একটা একটা সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। ম।

-সেটা তুমি করেছ। কৌতুকচ্ছলে বললেন কদম আলী। আমারটা ছিন্ন করে চলে গেছে। আমি যে কথাটি বলতে চাইছি, সেটা হলো আমার যে বয়স, বা তোমারও যে বয়স, সেখানে দু’জন দু’জন থেকে কী পেলাম তার বাইরেও পৃথিবীর অনেক দাবি আমাদের মেটাতে হবে। আমরা সে প্রথম যৌবনের উচ্ছ¡াসের মধ্যে আটকা পড়ে নেই যে একটি শিশু মেয়েকে পালতে আমাদের সংস্কারে বাধবে।

অনেকক্ষণ যেন ভাবলেন সাবেরা হাতের ওপর চিবুক রেখে। তারপর বললেন, না, কদম, আমি পারব না। বরঞ্চ ওকে মায়মুনা নিচের তলায় যেভাবে বড় করছে করুক। আমি ঐ মা-গিরি করতে পারব না। সরি।

কদম আলী এবার উঠে গিয়ে সাবেরার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর দু’হাত সরাসরি সাবেরার নাইটির ভিতরে ঢুকিয়ে তাঁর ভারী স্তনজোড়া চাপতে চাপতে বললেন, লেট আস স্টপ দিস কোয়ারেল হিয়ার। লেট আস হ্যাভ এ্যানদার রাউন্ড।
এরপর থেকে সাবেরার কথাই টিকে গেছে এ বাড়িতে। তাঁর গর্ভে কদম আলীর একে একে তিন তিনটে সন্তান বড় হয়ে বড় দু’টো বিদেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে আর ফেরেনি, আর ছোট মেয়েটা বিয়ে থা করে দেশেই আছে। আর মৌমিতার ব্যাপারটা হয়ে গেল অন্যরকম। চার বছরে পা দিয়ে সে অসম্ভবরকম দুরন্তপনায় মেতে উঠল। মায়মুনার কোনো নিয়ন্ত্রণই তার ওপর খাটছিল না। কিছুদিন স্কুলে পাঠিয়ে কদম আলী চেষ্টা করেছিলেন ওকে পড়াশোনা করানোর। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্কুলে দিয়েও যেন মৌমিতাকে মানুষ করা যাবে না। নিজের একান্ত সময়ে কদম আলী মাঝে মাঝে ভেবেছেন, পরিবেশ বদলালেও কি মানুষ কি তার জন্মবৈশিষ্ট্য থেকে বের হতে পারে না? মানুষ কি প্রকৃতই জিনের দাস! এ ব্যাপারটি তিনি আলোচনার জন্য একবার ইসতিয়াক সাহেবের সঙ্গে তুলেছিলেন। ইসতিয়াক সাহেব বলেছিলেন, ভুলটা আপনারই হচ্ছে, কেন না, আপনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন কেবল, কিন্তু স্নেহটা তো দিচ্ছেন না। স্নেহের প্রগাঢ় ছায়া না পেলে কোনো শিশুই সহজভাবে বেড়ে উঠবে না। ঠিক আছে, আপনি স্নেহ দিতে না পারেন, অন্তত এটি দেখুন যে তার মধ্যে কোন সৃজনশীল প্রবণতাটি স্পষ্ট। সেটিকে পুঁজি করে আপনি তার জন্য একটি ডেভেলপমেন্ট চার্ট তৈরি করতে পারেন। কারণ প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, সে তার জন্ম যেখানে বা যেভাবে হোক না কেন। তারপর ইসতিয়াক সাহেব গলা ভারী করে বলেছিলেন, ভাবী শিক্ষিত মহিলা, নিজেও মা, কিন্তু এ ব্যাপারটা সহজে নিলেন না কেন?

হাত নাড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে কদম আলী বলেছিলেন, সেটাই তো কথা। ভীষণ কড়া তাঁর চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে।

-বুঝতে পেরেছি। স্মিতহাস্যে ইসতিয়াক সাহেব বলেছিলেন।
সেবার বসন্তকাল এসেছিল যত রাজ্যের ফুল নিয়ে। কদম আলীর বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছোট্ট একটি বাগান মায়মুনা দেখাশুনা করত। বেশিরভাগ সময় সেখানে সবজির চাষ হতো, শুধু শীতের শেষ দিকে ফুলের বাগানের চর্চা চলত। একদিন সকালে কী একটা ছুটির দিন ছিল। নরম রোদের মধ্যে একটি প্লাস্টিক চেয়ারে বসে কদম আলী কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছিলেন। ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে’— গানটি শুনতে শুনতে তিনি দেখলেন গোলাপের চমৎকার বাগান করেছে মায়মুনা। তাঁর ক্যামেরা ব্যবহারের অভ্যাস নেই। খুব ইচ্ছা করছিল কয়েকটা ফটো তোলেন অনিন্দ্য সুন্দর ফুলগুলোর। একটি ভারী গোলাপের ঝোপের আড়ালে মৌমিতা খেলছিল। আসলে খেলছিল নয় মনোযোগ দিয়ে কী যেন একটা করছিল। হঠাৎ এক ঝলক স্মৃতি কদম আলীর মনে তীক্ষèভাবে কেটে গেল। সেই নাম না জানা মহিলা, হয়তো রাস্তার বেশ্যা ছিল সে, কিন্তু কী অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে একটি বাদামি রঙের টিভি বাক্স থেকে তাঁর ছোট সংসারটি বের করে পাততো, শুয়ে দিত একটা ছেঁড়া গামছার ওপর নরমনধর দেহের কালো কুচকুচে গায়ের রঙের একটি শিশুকে, আর বাড়ন্ত শরীরের আরেকটি শিশুকে পাশে বসিয়ে রাখত, একটি নামবিহীন শিশি থেকে কী একটা অজানা তেল বের করে ন্যাংটো শিশুটির গায়ে এত যতেœর সঙ্গে মাখত যে সমস্ত বিশ্ব যেন নিবিড় মনোযোগ দিয়ে তার সে কাজটি দেখত। কদম আলী চেয়ার ছেড়ে পায়ে পায়ে গোলাপ ঝাড়টার কাছে গেলেন। মৌমিতা পরম মনোযোগে ঘাসের ওপর তার ড্রয়িং খাতার একটি পাতা রেখে দেখে দেখে একটা গোলাপ ফুল আঁকছে তার ড্রয়িং পেন্সিল দিয়ে।

-কী আঁকছো, মা।

-বাবা, আমি গোলাপ ফুল এঁকেছি, দেখ।

-ও মা, খুব সুন্দর হয়েছে তো। একেবারে হুবহু তাজা গোলাপ। ঠিক আছে মা, আঁকো।
সেদিন আর দেরি করেননি কদম আলী। রফিক সাহেবকে খবরটা দিলেন। তিনিই সন্ধান দিলেন যে এক দেশি খ্রিস্টান বিধবা মহিলা খ্রিস্টান পাড়ায় বাচ্চাদের আঁকা শেখান। কদম আলী সেদিন বিকেলেই খ্রিস্টিনা নামক ঐ টিচারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। মৌমিতার আসা-যাওয়া শুরু হলো। তারপর অনেক বছর পরে মৌমিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টারস পাস করে বের হলো। ‘নিসর্গ’ নাম দিয়ে মৌমিতা আলীর একক প্রদর্শনী ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে প্রদর্শিত হলে গণমাধ্যম তার প্রশংসায় আলাদা আলাদা সচিত্র প্রতিবেদন ছাপালো। মৌমিতার মা হিসেবে সাবেরারও টুকরো-টাকরা সাক্ষাৎকার ছাপা হলো। মা-মেয়ের একসাথে একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকে ছাপা হলো এরকম ক্যাপশন দিয়ে যে মৌমিতার প্রতিভা প্রকাশে তাঁর মায়ের স্বপ্ন ও পরিশ্রম কিনা ভূমিকা পালন করেছিল।
পত্রিকাটি হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে সাবেরা চোখের জল ফেললেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে বিদেশে আছে, একভাবে সুখে আছে যার যার সংসার নিয়ে। তাদের কেউ চেনে না। মৌমিতার জন্য সারা দেশ আজকে পাগল হয়ে উঠেছে। জীবনের কোথায় কী তার হদিশ না পেয়ে সাবেরা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
১০.

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে আদমানির রুমে শহীদুল্লাহ, আদমানি আর দ্বিজেন দাশের সঙ্গে ইসতিয়াক, হেরেম্ব আর কদম আলী যুক্ত হলে, আলোচনার প্রধান অংশগ্রহণকারী হয়ে গেলেন তিনি। অত্যন্ত চড়া মেজাজে বললেন, এই মবিনুল হক নামক ডেড হর্সটাকে সরাতে না পারলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উন্নতি হবে না। দ্বিজেন দাশ তাঁকে সংশোধন করে বললেন, কদম ভাই, আমরা তো আপাতত উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাচ্ছি না। আমরা নতুন ঘোষিত পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য উচ্চতম গ্রেডের সমান বেতন ও মর্যাদার জন্য লড়াই করছি।

শহীদুল্লাহ সরস ভঙ্গিতে বললেন, সাপের ভেতর ব্যাঙ ঢুকে গেছে। সজল চৌধুরীদের মতো পেতনা শিক্ষকরা বলে বেড়াচ্ছে যে এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষকরা থেকে লাভ কি। এটা তো শুধু সিনিয়র শিক্ষকদের ব্যাপার। এখানে আমাদের উত্তর কী হবে। আর একটু গলা নামিয়ে বললেন, কী জানেন, আমার মনে হয় সজল চৌধুরী আসলে সামরিক সরকারের চর।

-না, না, সেটা নয়। দ্বিজেন বললেন, উনি আসলে প্রো-ইস্টাব্লিশমেন্টের লোক। মনে নেই ঐ যে একটা ছাত্র মারা গেল, তখন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতাটি যদি আমরা ডিকনস্ট্রাক্ট করি তা হলে বুঝব তিনি কোনো ধরনের আন্দোলনের পক্ষপাতী নয়।

শহীদুল্লাহ বললেন, ভাবনাটা যেন এরকম যে সবকিছু আপনা আপনিতে এসে যাবে। আরে ব্যাটা জানে না যে শিশু না কাঁদলে দুধ পায় না। তুই যে কিছুটা নাম করা শিক্ষক হয়েছিস আজকে সে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন আন্দোলনের ফসল।

কদম আলী বললেন, পরিবারে, সমাজে বা কোন গোষ্ঠীতে এরকম কিছু কিছু লোক থাকবে যারা নিজের হাতে মাছ মারবে না, কিন্তু মাছটা খাবে। এসব প্রতিবিপ্লবীর কথা মাথায় আনার দরকার নেই। আগে এ্যাকশন প্রোগ্রাম ঠিক করেন।

দ্বিজেন দাশ হাসতে হাসতে বললেন, প্রতিবিপ্লবীর কথা বলছেন, আরেক প্রতিবিপ্লবীর কথা শোনেন। মাস্টার ব্লুাস্টার সঈদুর ভাই ঢাকায় আসার আগে আমাকে লাউঞ্জে পেয়ে ধরে বসলেন। বললেন, এগুলো কী করছেন আপনারা, উপাচার্যকে উঠতে বসতে গালাগাল করেন, অথচ তাঁকে অনুমতি দিতে বাধ্য করেছেন যাতে দু’টো বাস আপনাদের ঢাকায় আনার জন্য রিকুইজিশন দেওয়া হয়। নিয়ম তো সেটা পারমিট করে না। জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কত মাইলের মধ্যে বাসগুলোকে চলাচল করতে হবে তারও নীতিমালা আছে।

-সঈদুর ভাইয়ের কথা কইয়েন না, এ একটা লোক দেখলাম অন্য রকম। সবকিছুর মধ্যে কেমন একটা গ্যাঁড়াকল লাগিয়ে দেন। উত্তেজিত কণ্ঠে আদমানি বললেন।

কদম আলী বললেন, উনার সব কিছু ঠিক আছে, কিন্তু একটু যদি প্রকাশনা টকাশনা করতেন। এটা বলেই কিন্তু তাঁর পুরোনো কামড়টা ফিরে এল। তখন বললেন, আরে, লেখালেখি গবেষণা সবাই করবেন বলে কথা আছে নাকি। আমি সে যে কবে একখানা প্রবন্ধ লিখেছিলাম তা ভুলেই গেছি। আমি বলি কি কালকে যে আমরা ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, সেটা ঠিক রাখি। আর ফেডারেশনের মিটিংয়ে ঠিক করব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করব কি করব না।

সবাই এক বাক্যে সায় দিলেন। দ্বিজেন দাশ আবার বললেন, ও হ্যাঁ, সঈদুর ভাই আরেকটা মাস্টার ব্লুাস্টার কথা বলেছেন। উনি বলছেন যে নতুন পে-স্কেলে সর্বোচ্চ গ্রেড যাঁদের জন্য ধার্য করা হয়েছে তাঁরা তো সংখ্যায় বেশি নয়, কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংখ্যা তো অনেক। তিনি বলতে চান, দাবিটিকে যৌক্তিকতার মধ্যে আনতে হলে অধ্যাপকদের মধ্যে বয়স, মেধা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার বিচার করে খুব কমসংখ্যক অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ গ্রেডের জন্য নির্বাচন করলে সরকার হয়তো দাবিটি মেনে নেবে।

ফোঁস করে উঠলেন আদমানি। উঁ, নিজেদের পায়ে কুড়োল মারা আর কি। ঐ রকম বাছাই হলে তো সর্বোচ্চ গ্রেডের অধ্যাপকের তালিকা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিঃশেষ হয়ে যাবে, তাই না। না, না, খবরদার ঐদিকে যাওয়া যাবে না। সঈদুর ভাইয়ের ধারণা হয়েছে বোধহয় শর্ট লিস্ট করলে প্রবীনতমদের একজন হবার কারণে তিনি সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে যাবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন, দ্বিজেন দা, উনি হলেন এক নম্বরের প্রতিবিপ্লবী।

শহীদুল্লাহ খুব আয়েসের সঙ্গে একটা সিগারেট ধরালেন। দুষ্টামির ছলে ধোঁয়াটা দ্বিজেন দাশের মুখের ওপর ছাড়লেন। দ্বিজেন দাশ তেড়ে বেড়ে উঠলেন : আপনি একটা ধ্যাড়ে ভেড়া ছাড়া কিছু নন। কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিচ্ছু নেই।

কদম আলীও হেসে দিলেন। আদমানিকে বললেন, ধূমপান মৃত্যুর জন্য দায়ী।

কথাটা এমন যে প্রাথমিক হাসির খোরাক জোগালেও সবার মনে মৃত্যুর করাল বদন ছায়া ফেলল।

শহীদুল্লাহ আবারও বড় একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দ্বিজেন দাশের মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, আন্দোলনটাকে কেন দাঁড় করানো যাচ্ছে না জানেন? এটার জন্য দায়ী শিক্ষা উপমন্ত্রী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন। অনেকে বলেন তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্টের গ্রিন আইড বয়। তিনি ভেতরে ভেতরে বন্দোবস্ত করেছেন যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন থেকে চারজন অত্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ কিন্তু দেশবরেণ্য অধ্যাপক চায়ের আসরে নিমন্ত্রিত হবেন। সেখানে সব ফয়সালা হয়ে যাবে, আর আমাদের আন্দোলন মাঠে মারা যাবে।

কদম আলী বললেন, ঐ খবর আমার কাছেও আছে। তবে এটাও শুনেছি যে যাঁদের যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে তাঁরা কেউ রাজি হচ্ছেন না।

-উঁহু, শহীদুল্লাহ মাথা নাড়লেন। আপনার তথ্যটি ভুল। চারজনের মধ্যে তিনজন রাজি হয়েছেন, একজন রাজি হচ্ছেন না। তাঁকে বাদ দিয়েই বৈঠকটা হবে মনে হয়।

তেতে উঠলেন কদম আলী। হলে হোক, টার্নকোটের সংখ্যা তো এ দেশে কম না। মনে নেই, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আমরা বহু চেষ্টা করেও তখনকার শিক্ষক সমিতি দিয়ে একটা প্রতিবাদ সভা পর্যন্ত করতে পারিনি। এভরি আদার টিচার ইজ আ বিট্রেয়ার টু আওয়ার কজ। তা না হলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তানে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ গ্রেডে বেতন পাচ্ছে, সেখানে আমরা কেন বঞ্চিত হব! হোয়াট আ ক্রেজি থিং!

দ্বিজেন দাশ কণ্ঠ নরম করে বললেন, অন্যান্য দেশের কথা বলতে পারি না, কিন্তু ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অনেক তফাৎ। কারণ যখন আপনি রাজনৈতিক কারণে নিয়োগ দিচ্ছেন, তখন আপনি মেধাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে কিন্তু সাধারণভাবে মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে।

-আচ্ছা, আমরা এখন একটা আন্দোলনের মধ্যে আছি, তখন এসব পুরোনো কথা আসছে কেন? যে সমাজ যেরকম। আমাদের সমাজ গরিব, আমাদের সরকার অগণতান্ত্রিক, সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি ছেয়ে গেছে, তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না তো কারা বলবেন! হ্যাঁ! -কদম আলীর কণ্ঠে বোঝা গেল, তিনি বেশ রেগে গেছেন। ।

আলোচনাটা আর বেশিদূর এগোলো না। পাঁচজন অধ্যাপকই ভেতরে ভেতরে অনুভব করলেন যে হালে যেন তাঁরা পানি পাচ্ছেন না। বস্তুত সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে কিভাবে প্রতিপক্ষতা জিইয়ে রাখতে হবে, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না।

অতিথি ভবন থেকে বেরিয়ে কদম আলী একটা ট্যাক্সি নিয়ে ঢাকাস্থ সাবেরার উকিল নানার বাসায় পৌঁছালেন রাত্রি এগারটার সময়। উকিল নানা মারা গেছেন অনেক আগে। চারতলা বাড়িটা তাঁর ছেলেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে থাকছেন। ঢাকায় এলে কদম আলী উকিল নানার বড় ছেলের বাসায় ওঠেন।
১১.

দরজার বোতাম টিপতেই ‘লাইলা হা ইল্লালাহি রসুলাল্লাহ’ বেজে উঠল। সাবেরাই দরজা খুললেন। এসেছ ভালো হয়েছে। মৌমিতা এসেছে, তখন থেকে অপেক্ষা করছে। সাথে ছেলে একটা।

তাঁর গলার শব্দ পেয়ে মৌমিতা নিজেই বসার ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিল। পরক্ষণে ‘বাবা’ বলে কদম আলীকে জড়িয়ে ধরল।

-বাবা, সন্ধ্যায় টেলিগ্রাম পেয়েছি। আমি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চিত্র প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছি। এ আমার বন্ধু সুজিত সেন। সেই খবরটি নিয়ে এসেছে। বাবা, দেখ টেলিগ্রামটি।

মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরেই কদম আলী বসার ঘরে ঢুকলেন। সুজিত এর মধ্যে তাঁর পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

মৌমিতাকে পাশে নিয়েই কদম আলী সোফায় বসলেন। নিবিড় আবেগে মেয়েকে চুমু খেলেন কানের নিচে। ভেজা গলায় বললেন, মা-রে, তোকে আমি কোনোদিন দেখতে পারিনি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় যাবার সময় আর আসার সময় দেখেছি, তুই শুধু আঁকছিস আর আঁকছিস। মাঝে মাঝে তোর মায়ের সঙ্গে অবাক হয়ে আলাপ করেছি, এত কি আঁকে মেয়েটা! বাগানের কোনো ঘাস, ফুল, পাতা, ডাল, গাছ, প্রজাপতি কিছুই তোর আঁকা থেকে বাদ যায়নি। তোর ভাইবোনের সঙ্গে তোর কত না মারামারি হয়েছে। তারা তোর ড্রয়িং খাতা ছিঁড়ে ফেলত, তুলি চুরি করে ফেলত, রঙ পানি দিয়ে নষ্ট করে ফেলত, তোর শেষ করা ছবিও ওরা নষ্ট করে ফেলত। তোর সঙ্গে মারামারিতে ওরা কোনোদিন পারত না। তোর মাও এ জন্য তোকে কতবার মেরেছে, ভাত না খাইয়ে উপোস রেখেছে। যাক স্কুলের গণ্ডি কোনোরকমে পার হয়ে যখন ঢাকায় এসে কলেজে ঢুকলি, তারপরে ইউনিভার্সিটিতে পা দিলি, শিক্ষকদের নজর কাড়লি— তোর জীবনটা রূপকথার মতো হয়ে গেল মা।

-বাবা, ঐসব কথা থাক। এখন আমাকে দিল্লি যেতে দিচ্ছো কি না সেটি বল।

-অবশ্যই মা, তুই যাবি, সাথে আমরাও যাব। তুই সব রেডি কর। টাকা আমি দেব।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কদম আলী আরেকবার কাঁদলেন। সাবেরা চুপচাপ উঠে অন্য ঘরে চলে গেলেন।

রাত হয়ে যাচ্ছে। কদম আলী মেয়েকে আর ধরে রাখতে চান না।

-বাবা, আমার নতুন কাজগুলো দেখবে? একটা এলবামে ফটো তুলে নিয়ে এসেছি।

-দেখা।

কাঁধের ব্যাগ থেকে মৌমিতা ঢাউস একটা এ্যালবাম বের করল। এ প্রথম মেয়ের দিকে ভালো করে দেখলেন কদম আলী। আশ্চর্য, কোথাও যেন ক্যারেনের মতো ভাব আছে। উদাস, বহুদূর দেখছে, চোখের তারায় এরকম স্বপ্ন। দীর্ঘাঙ্গিনী মৌমিতা। শরীরের রঙ কুচকুচে কালো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন আমেরিকার কোনো কৃষ্ণাঙ্গিনী। সে পোশাকও পরেছে ঐরকম। একটি ছাই রঙের ইজার পরা। জিনসের ট্রাউজারের সঙ্গে স্ট্র্যাপট হাই হিল কালো রঙের। চুল বব করা। কপাল, নাসিকা, থুঁতনি সবগুলো মিলে মৌমিতার মুখের ছাঁদ আমেরিকায় গেলে তাকে সহজে কৃষ্ণাঙ্গিনী বলে সবাই ভুল করবে। কদম আলী মৌমিতাকে দেখতে দেখতে বহু বছর আগে দেখা আরেকটি চেহারার কথা মনে করতে পারলেন। তাঁরও মুখ ছিল কিছুটা সুচালো। থুঁতনিটা এরকম লম্বা ছিল। শরীরের গঠনও ছিল শক্ত সমর্থ। মৌমিতার বাহু আর হাতের গঠন লিকলিকে হাড় সর্বস্ব, সেটি ঐ মহিলার সঙ্গে হুবহু মেলে। আহা, সব মিলিয়ে তার প্রকৃত মা যদি আজকে তাকে দেখতে পেত— এরকম সুখকর অনুভূতি কদম আলীর মনে ছড়িয়ে পড়ল।

-এ দেখ, বাবা, আমার হারানো মায়ের পোর্ট্রটে আমি মন থেকে এঁকেছি। তুমি মাঝে মাঝে যেরকম বর্ণনা দিয়েছো, আর আমার নিজেকে দেখে আমি বুঝতে পারি বুড়ির আজকে কী চেহারা হয়েছে।

সুজিত সামান্য নড়েচড়ে উঠল। মৌমিতার জন্মবৃত্তান্ত মোটামুটি কমবেশি সবার জানা। আবার সেটা খুব আলোচিত হবে সেরকম ব্যাপারও না। গণমাধ্যমের লোকজনও এ ব্যাপারটা জানে, তবে মৌমিতার প্রতিভাময় উত্থানকে তারা অপ্রাসঙ্গিক গল্প টেনে মুখরোচক করতে চায়নি। বিশেষত সমাজের মধ্যে কদম আলী আর তাঁর স্ত্রী সাবেরার অসীম মানবতাবোধকে শ্রদ্ধা করে মৌমিতাকে সেভাবেই, অর্থাৎ কদম আলী আর সাবেরার কন্যা হিসেবেই প্রচার দিয়েছে।

-এটা কোন মাধ্যমে আঁকা রে বেটি??

-বাবা, তুমি কি আঁকার কিছু বোঝ যে বললে বুঝতে পারবে। শোন, এটি একটা সম্পূর্ণ নতুন মাধ্যমে আমি আমার এ সিরিজের ছবিগুলো এঁকেছি। এ্যাক্রিলিক। আর সিরিজের নাম দিয়েছি, জননী।

-ও মা, তাই? খুবই এ্যাপ্ট হয়েছে।

মৌমিতার দু’হাতে বড় বড় ব্রেসলেট পরা। কী বস্তু দিয়ে তৈরি কদম আলী ধরতে পারলেন না। তার আঙুলগুলো সরু লম্বা। দু’হাতের প্রতিটা আঙুলে প্রায় একটা না একটা পাথরের আংটি পরা। তার দু’কানে কালো রঙের লোহার বড় বড় চাকের মতো দুল পরা। গলায় মনে হলো রুদ্রাক্ষের মালা।

ছবিটা দেখতে দেখতে কদম আলী এ্যালবাম থেকে চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। অদ্ভুত মিল। আবার সে দূরের মহিলার সঙ্গেও হুবহু মিল। এটা কি জিনের প্রভাব, নাকি কল্পনার, নাকি মনের টান, নাকি মায়া। একটাতে তাঁর পোর্ট্রেটও দেখলেন— ঠিক তিনি যেরকম দেখতে। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, চাপা কপাল, ফোলা গাল, খর্বাকৃতির নাক, দৃঢ়বদ্ধ পুরু ঠোঁটজোড়া, পুরু কালো ফ্রেমের পেছনে চোখের তীব্র উজ্জ্বল চাহনি। কদম আলী খাটো মানুষ, তাঁর গলাটাও খাটো। আর তাই নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে ছবিতে পরনে সাদা শার্টের কলারের ভেতরে। ছবিটার একটা ক্যাপশন নিচে দেওয়া : দেবদূত।

-তুই এত নিখুঁত আঁকিস কিভাবে? বিস্মিত হয়ে বললেন তিনি।

সুজিত এবার খুব নরম গলায় বলল, ওর আঁকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নিখুঁত অংকনের মধ্য দিয়ে সাবজেক্টের ইমোশনটা ধরে ফেলা।

-ঐসব কিছু না, বাবা, ঐগুলো ওস্তাদি কথা। আমি বলি কি, আমি যখন ব¯স্তু দেখি, হোক সে ফুল, পাথর বা নদী, বা মানুষের মুখ, বা নীলাকাশ, আমি বোধ করি সবকিছুরই একটা ভেতরজাত আবেগ আছে, এমন কি মান-অভিমান আছে, কথা তো আছেই। আমার সঙ্গে আমার সাবজেক্টগুলো কতভাবে যে কমিউনিকেইট করে, আবেগ দিয়ে, ভাষা দিয়ে। জানো বাবা, নিথরেরও এক আশ্চর্য ভাষা আছে, আমি সেটা বুঝি, আর আমার রঙ—এ্যাক্রিলিক বল, অয়েল বল, ওয়াটার কালার বল, এমন কি শুধু পেন্সিল বল, আমাকে যেন প্রাণ দেয়। বুঝি না বাবা, কী জিনিস এটা, কিšন্তু আমি তুলি হাতে নিলেই আমার মনে হয় যেন পুরো পৃথিবীটা একটা ছন্দ পেয়ে আমার হাতের ওঠানামার সঙ্গে নাচতে থাকে। কোনো কষ্ট লাগে না আমার আঁকতে। মাঝে মাঝে আঁকতে আঁকতে আমার ক্ষিধা পায়, কিন্তু আমি মনোযোগ হারাই না, বরঞ্চ ক্ষিধা পেলে যেন আমার ভেতরটা আরো মরিয়া হয়ে ওঠে।

পরম আগ্রহ নিয়ে কদম আলী মেয়ের কথা শুনতে থাকে।

-বাবা, তোমাকে বলি আরেকটা কথা। এ কথাটা আমি সেদিন একটা সাক্ষাৎকারে বলেছি, কিন্তু তখন চিন্তাটা আমার গুছিয়ে ওঠেনি বলে ভালো মতো বলতে পারিনি। আমি এভাবে ভাবি কথাটা, আসলে বাবা মানুষ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক বিরাট এক সংযোগরেখা দিয়ে বাঁধা। সে সংযোগরেখাটা, বাবা, হলো কান্না। সবার ভেতরে এই চিরজাগরুক কান্নাটা আছে। জাগতিক জিনিসের মধ্যেও আছে, আবার নিরেট বস্তুর মধ্যেও আছে। আমার এক বাংলার শিক্ষক একবার কবি রুমির কথা বলেছিলেন। তিনি নাকি একটি কবিতায় বলেছিলেন, বাঁশি যে সুর দেয়, আসলে সেটি সুর নয়, সেটি হলো যে বাঁশটি থেকে ঐ বাঁশরিটি বানানো হয়েছে, তার সঙ্গে মিলনের জন্য কান্না। একবার, বাবা, আমার এক বন্ধু মারা গেলে দাফন হয়ে যাবার পর আমি ঐ কবরস্থানের ধারে যাই। আমার পিঠে আঁকার ইজেল, কাঁধে আঁকার সরঞ্জামসহ একটি ব্যাগ। কবরস্থানটি নানারকম গাছে পরিপূর্ণ। আমি সাবজেক্ট খুঁজছি আঁকা শুরু করব বলে। তখন সন্ধ্যা প্রায় লেগে আসছে, কবরস্থানের গাছে গাছে কাকগুলো ফিরে আসছে। তখন হঠাৎ কোনো একটা কাছের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে এল। আমি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম, এত সুমধুর, এত একটানা— তখন হঠাৎ আমার বোধ হলো আরে আজানের সুর তো শুধু সুর নয়, এটা তো সেই একই কান্না, চিরকালের সঙ্গে ক্ষণিক কালের সংযোগের জন্য কান্না। বিশ্ব চরাচর যেন আমার পায়ের কাছে এসে ঘুরঘুর করতে লাগল। এই আজানের কান্না আমি কিভাবে ছবিতে ফুটিয়ে তুলি! বলেছি না আমার সময় লাগে না। ভাঙাচোরা মন নিয়ে আমার খুপরিতে ফিরলাম। তারপর সারারাত ধরে অভুক্ত থেকে এই ছবিটি এঁকেছি, বাবা, দেখ। মসজিদের মিনারটার প্রস্তরময় অবয়বকে দেখ আমি এ্যাক্রিলিকের জোরে কেমন দ্রবীভূত চেহারা দিয়ে দিয়েছি। সংযোগের কান্নার তরলিকৃত প্রকাশ!

মা রে, তোকে যে আমি কোন ভাষায় বাহবা জানাব জানি না। মা রে—প্রায় কণ্ঠরোধ হয়ে এল কদম আলীর।

—বাবা, তবে যে ছবিটা আমি আঁকতে চাই, সেটা এখনো পারিনি। হয়তো কোনো শিল্পী পারে না।

-কী মা, সেটা।

-আমি ক্ষুধার কথা বলেছি না, এ ক্ষুধাটাও আমি ছবির মধ্যে আনতে চাই। না, ঠিক জয়নুল আবেদীন স্যার যেভাবে এঁকেছেন সে ভাবে নয়, সেখানে দারিদ্র্যের একটি মার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যা আছে। শোষিত লোকেরাই দুর্ভিক্ষের শিকার এ কথাটাই সেখানে স্পষ্ট হয়েছে। এটি নিয়েও আমার কোনো বিরোধ নেই। দুর্ভিক্ষ সমাজে মানবসৃষ্ট, স্যারের এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। সমাজে শোষক শ্রেণির লোভের জন্য দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়, এ বক্তব্যের সঙ্গেও আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু এর চেয়েও একটি ধারণা আমার মনের মধ্যে তৈরি হয়েছে, যেটি আমাদের এই ভারত উপমহাদেশের বহু পুরোনো সংস্কৃতি, যেখানে ক্ষুধার একটি স্থায়ী চিত্রকল্প হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা করুণার প্রতিমূর্তি হয়ে নেমে আসবেন এবং ক্ষুধার পরিত্রাণ করবেন। আমি বাংলাদেশের বহু উপজাতির সঙ্গে মিশে দেখেছি, তাদের মধ্যেও এই রকমের মিথ চালু আছে। বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত ইসলামিক সংস্কৃতির মধ্যে মিল এখানে যে সৃষ্টিকর্তার এই পরিত্রাণমুখি অবয়বকে ধর্মবিশ্বাসে পরিণত করা হয়েছে। শোষক শুধু শোষিতকে শোষণ করবে, এটা মানব সমাজের স্থায়ী পরিচিতি হতে পারে না। প্রশ্নটা যদি এভাবে রাখি, শোষিত শোষিত হবে কেন? তার কি হাত পা নেই, বুদ্ধি নেই! বরঞ্চ সমাজে আমরা দেখি কি, শোষিত চালাক চতুর হয়ে নব্য শোষকে পরিণত হয়। কাজেই, বাবা, আমার কথা হয়তো আমি পুরোপুরি বুঝিয়ে বলতে পারছি না, কিন্তু আমি মনে করি শোষক-শোষিতের ব্যবধানের ওপর দাঁড় করিয়ে দারিদ্র্যের সঠিক চেহারাটি আমরা ধরতে পারব না। কারণ এ ছবিতে মানুষের উদ্যমের কথা ফুটে ওঠে না, অনুকম্পার কথা ফুটে ওঠে না, সর্বোপরি সমাজে একজন যে আরেকজনের ওপর নির্ভর করে, সে নির্ভরতার সংস্কৃতির কোনো জায়গা থাকে না। আমি যে সংযোগের কথা বলছিলাম সে সঙ্গে এখন সংশ্লেষের কথাও বলতে চাই। দারিদ্র্যের সঙ্গে এই সংশ্লেষের একটি ইতিবাচক সম্পর্ক আছে। ক্ষুধার এই সংশ্লেষের মাত্রাটা আমি আমার ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চাই। একটি গোলাপ কি এমনিতে ফোটে, বল বাবা, কত রকম, কত মাত্রার সংশ্লেষধর্মী কার্যকারণ একত্র হলেই না কেবল একটি গোলাপ ফুটতে পারে।

কথা বলতে বলতে মৌমিতার চোখ দুটো স্বপ্নীল হয়ে যেন আরো দূরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। কদম আলী টিস্যু বক্স থেকে একটি টিস্যু ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। স্পষ্ট শুনলেন, মৌমিতার কণ্ঠ : বাবা, পানি খাব।

সাবেরা কি পর্দার ওপাশে থেকে সব কথা শুনছিলেন? তিনিই এক গøাস পানি নিয়ে এলেন। কদম আলীকে বললেন, কথা শুনতে শুনতে তোমারও তো তৃষ্ণা পেয়েছে মনে হয়। তোমার জন্যও নিয়ে আসি এক গøাস।

কদম আলী কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে রইলেন। মাথাও তুললেন না। মেয়েকেও আর ধরে রাখলেন না। যেতে দিলেন। চারতলার সিঁড়ি ভেঙে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে আবার উঠে এলেন।

সাবেরাকে বললেন, দিল্লি যাবা?

-না, সাবেরার দৃঢ় উত্তর। তুমি যাও।
১২.

বিকেলের দিকে সঈদুরের শহরে যাবার কথা ছিল। শুক্রবার বলে দুপুরে তিনি শুয়েছিলেন। পত্রিকাটার এ পাতা থেকে ও পাতায় যেতে না যেতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সেগুনটিলার বাড়িগুলোর মধ্যে তাঁরটাই সবচেয়ে উঁচুতে। বাথরুম সেরে তিনি তোয়ালে আনতে যেয়ে উঠোনে পা দিতেই দেখলেন সারা আকাশ থমথমে হয়ে আছে। সেগুন গাছগুলোর মধ্যে কোনো বাতাস খেলছে না। বস্তুত তোয়ালেটা কাপড় টাঙানোর তার থেকে খুলতে না খুলতেই চারদিক আঁধার করে বৃষ্টি নামল। তিনি দ্রুত গ্রিলঘেরা বারান্দায় উঠে এলেন। মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টির তোড় বেড়ে যেন এক থেকে একশতে পৌঁছুলো। বৃষ্টির পাগলামি দেখতে জাহিরা বেগমও ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। স্বামী-স্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে টিনের চালায় বৃষ্টির অঝোর ধারার শব্দ শুনতে লাগলেন। দূরের কলা ভবন, বিজ্ঞান ভবন কোনোটাই আর দেখা যাচ্ছিল না। একটানা আধাঘণ্টা একই গতিতে বৃষ্টি হবার পর যখন একটু কমল, তখন সঈদুর বললেন, একটু তেলেভাজা মুড়ি কর, আর গরম গরম চা।

খাবার ঘরে স্বামী-স্ত্রী মুখোমুখি বসে মুড়ি ভাজা আর চা খাবার সময় সঈদুর বললেন, জানো তো, কদম ভাইয়েরা ঢাকা থেকে ফুটুশ হয়ে এসেছেন।

-আমি না শুনলেও অনুমান করতে পারি। যে আন্দোলনের নৈতিকতা ঠিক থাকে না, সে আন্দোলন আসলে টেকে না।

জাহিরার কথার পিঠে সঈদুর বললেন, আসলে ঘটনাটা হয়েছে শিক্ষা উপমন্ত্রীর ওখানে। সে নবীন লোক হলেও পাকা খেলোয়াড়। ঠিক যেখানে যেখানে যাঁকে যাঁকে প্রলোভন দিতে হবে সেখানে সেখানে সে কাজটা ঠিকমতো করেছে। কানাঘুষো শুনছি, এমনকি আমাদের নেতারাও নাকি ম্যানেজড হয়ে গেছে। এটা অবশ্য আমি বিশ্বাস করি না। তবে মৌমিতার পুরস্কার পাওয়ার পর কদম আলী ভাই আর সাবেরা ভাবী প্লাস মৌমিতার বয় ফ্রেন্ড সুজিত সেনসহ সবার সরকারি খরচে দিল্লি ঘুরে আসার ঘটনাটা কোথাও কোথাও প্রশ্ন তুলবে বৈকি!

—তবে মেয়েটা আঁকে সত্যি চমৎকার। তার ‘জননী’ প্রদর্শনীর কোনো কোনো ছবি দেখে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি।

জাহিরা বেগমের কথায় সঈদুর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ করলেন গ্রিল ঘেরা বারান্দায় চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, দেখ, দেখ, কী সুন্দর চাঁদের আলো ফুটেছে!

আকাশ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলেন পশ্চিম আকাশে ঠিকই চাঁদের গোলা আকাশে ভাসছে। ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না সেগুনটিলার প্রকৃতিতে এক অশরীরী রূপ নিয়ে নামল। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে দু’টো বেতের চেয়ার নিয়ে পাশাপাশি বসলেন। জ্যোৎস্না উপভোগ করার সময় সঈদুর বললেন, আমাদের দু’জনেরই বয়স হয়ে গেছে। আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। সবই আল্লাহ্্র ইচ্ছা। কে আগে যাব জানি না। বহু আগে এ টিলাটা যখন কিনেছিলাম, কী জন্যে কিনেছিলাম মনে নেই। মানুষের জীবন কি দেখলে তো। ভেবেছিলাম বড় লেখক হব। একদিন পুরস্কার-টুরস্কার পাব। কোথায় কী! কোনোদিন টানা লিখতেও ইচ্ছা করল না। কদম আলীটা গবেষণা লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেও শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে মাতামাতিতে আছে। সৃষ্টিকর্তার কী অদৃশ্য খেলা দেখ, একটি রাস্তার বেশ্যার বাচ্চাকে তিনি ঘরে তুলে আনলেন, আর সেই মেয়েটির পরিচয়ে আজকে তাঁর পরিচয়। সাবেরা ভাবী মেয়েটিকে গ্রহণ করতেই পারলেন না কোনোদিন, অথচ সে জন্য কি সাবেরা ভাবী ঠকেছেন না জিতেছেন? কী বল তুমি?

-বলাবলির কিছু নেই, জাহিরা বললেন। আমার চিন্তা সহজ, জীবনযাপনে খুব বেশি কঠিন অবস্থানে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ একটা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবন চালাবে, আর জীবন সে মতো চলবে-এটা হলে নিশ্চয় ভালো। কিন্তু সেরকম না হলে বাঁধা শিথিল করতে অসুবিধা কি?

-তবে জাহিরা তুমি যেটা বলছ, এভাবে শিথিল সহজ জীবনযাপন করবে সব মানুষের এটা কাম্য নয়। আসলে মানুষ এক একটা এক রকম। কোনো মানুষের সঙ্গে কোনো মানুষের তুলনা চলে না।

-আমি সেটা বলছি না। জাহিরা সজোরে বলেন। আমি বলছি, মানুষ তো দেবতা না। সে ভান না করলেই হয়।

স্বামী-স্ত্রী অনেকক্ষণ বসে রইলেন, মশার কামড় সহ্য করে হলেও। আকাশে আবার আষাঢ়ের মেঘ জমে গেছে। চাঁদের আলো অবসিত হয়ে গেছে। হঠাৎ ঝুপঝাপ করে বড় বড় ফোঁটায় আবার বৃষ্টি শুরু হলো। তাঁরা ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।
১৩.

কদম আলীদের আন্দোলন ফুটুশ হবার পর আরো বিশটি বছর কেটে গেছে। সজল চৌধুরী নিজেই ষাট বছর বয়সে পদার্পণ করেছেন। কদম আলী দীর্ঘদিন হলো দেহ ত্যাগ করেছেন। বৃদ্ধা সাবেরা একলা থাকেন সায়মাকে নিয়ে। মায়মুনাও একবার দেশের বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য প্রস্তুতি নেবার সময় সাপের কামড়ে মারা যান। সঈদুর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী জাহিরা বছর দুয়েক আগে তিনদিনের ব্যবধানে মারা যান। তাঁরা হজব্রত সমাপন করতে গিয়েছিলেন। মুজদালেফা প্রান্তরে যেদিন রাত্রিবাস করার কথা সেদিন সঈদুর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। চিকিৎসা সেবা নেবার আগেই তিনি মারা যান। তাঁকে সেখানে দাফন করে তাঁবুতে ফিরে আসার সময় একইরকমভাবে জাহিরাও প্রাণত্যাগ করেন। এর মধ্যে সেগুনটিলার পুরোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় নিয়ে আসা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একটা বিভাগ খোলা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাশূন্য গবেষণা বিভাগ। সেটির ল্যাব বসানো হয় সঈদুরের বাসগৃহটিতে, যেটি এখন পাকা একটি অত্যাধুনিক ভবন। নাম রাখা হয়েছে প্রফেসর সঈদুর স্পেস সেন্টার। ইংরেজিতে সংক্ষেপে পিএসএসএস। অনেকে রসিকতা করে পি ট্রিপল এ্যাস বলতে গিয়ে বলেন পি ট্রিপল এক্স।

সজল চৌধুরীর দাপ্তরিক কক্ষ কলা ভবনের চারতলার পার্ক জোনে। ভবনের পাশে গ্রিন ক্যাম্পাস নামক সংগঠনটির বৃক্ষ সমারোহ পার্ক। এ সংগঠনটির পরিচালনায় আছেন মরহুম উপাচার্য মবিনুল হকের কয়েকজন দুর্দান্ত অনুসারী। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক পদের। গ্রিন ক্যাম্পাস আন্দোলনে তাঁদের নেতৃত্বে চলছে এক বিশাল ছাত্রছাত্রী বাহিনী, যারা সর্বত্র চোখ রাখছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘাসেরও যেন প্রাণহানি না হয়, বৃক্ষলতা তো দূরের কথা।

সজল চৌধুরী জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন বৃক্ষ সমারোহ পার্কের নয়নাভিরাম দৃশ্য। বনজ গাছের চেয়েও ফলদ গাছের মূল্য গ্রিন ক্যাম্পাসের সদস্যদের কাছে বেশি। কারণ পাখি এবং পোকা ফলদ গাছে যত লাভবান হয়, বনজ গাছে তত নয়। সে জন্য পার্কটাতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু এ জাতীয় গাছ বেশি। তাঁর জানলা থেকে মাথা বের করে নিচে তাকালে একটি বেল গাছের মাথা দেখা যায়। ঝিরঝির করে সর্বক্ষণই পাতা নাচাচ্ছে।

সজল চৌধুরী জীবনে কোনো সুযোগ হারাতে দেননি। সে পঞ্চাশ বছর আগে বুবুর তাঁকে দাঁত নিয়ে উপহাস করার অপমানবোধ প্রশমিত করতে যেন তিনি তাঁর জীবন ব্যয় করেছেন। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই একমাত্র শিক্ষক যাঁর সঙ্গে সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের যেমন সদ্ভাব আছে, তেমনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষকমণ্ডলীর সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। আবার সরকারের মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের যাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার দিক থেকে লাভজনক হয়, তাঁদের সবার সঙ্গে সজল চৌধুরী অর্থাৎ মফিজুর রহমান চৌধুরীর সংযোগ আছে। তাঁকে যাঁরা প্রশংসা করেন তাঁরাও যেমন, আবার যাঁরা নিন্দা করেন তাঁরাও বলেন যে লক্ষী আর সরস্বতীর এমন রাজজোটক সাধারণত দেখা যায় না।

তাঁর সম্পর্কে এইরকম নেতিবাচক ধারণা সম্পর্কে সজল চৌধুরী সচেতন। তিনি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দূরে আম গাছের মাথাগুলোর ওপর চোখ বুলোতে বুলোতে নিজেকে নিজে জেরা করলেন এবং নিজেকে নিজে বলতে লাগলেন যে হে সজল চৌধুরী যারা তোমাকে মূল্যায়ন করে তারা ঠিক ঠিক কারণটির জন্য করে না, ভুল ভুল কারণটির জন্য করে। তুমি যে সবসময় ছাত্রছাত্রীদের কাছে আক্ষরিক অর্থে দায়বদ্ধ থাকতে এই কথা তারা বলে না। তুমি যে কখনো শিক্ষক সমিতির ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন জাতীয় কোনো কর্মসূচিতে কখনো যোগ দাওনি, শত টিটকারী, বাধা-বিপত্তির মুখেও ক্লাস নিয়ে গেছ, এ কথা তারা বলে না। তুমি যে কখনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়া ক্লাস নাওনি, এ কথাও তাদের রেকর্ড বইয়ে নেই। তুমি যে পরীক্ষার খাতা সবসময় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে ফেরত দিয়েছ এ কথা তারা বলে না। দেখা যাবে তোমার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে গুরুতর অসুস্থ না হলে কিংবা দাপ্তরিক কাজে বা পরীক্ষার কাজে অন্যত্র না থাকলে তোমার ক্লাস কখনো মিস যায়নি। তুমিই এ কথাটি ক্যাম্পাসে তোমার অনুসারীদের মধ্যে চালু করেছিলে যে শিক্ষার্থীরা জিনিয়াস কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দেয় তার চেয়ে অধ্যবসায়ী, আন্তরিক এবং সময়ানুগ শিক্ষক পছন্দ করে। তারা তোমার নানা সূত্র থেকে পয়সা উপার্জনের কথা বলে, তোমার গাড়ি-বাড়ি নিয়ে ঈর্ষা করে, তোমার বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য ঘন ঘন বিদেশ যাওয়াকে তারা উপহাস করে, কিন্তু তারা এ কথা কখনো বলে না যে তোমার উপার্জনের প্রতিটা পয়সা সৎভাবে উপার্জিত। তোমার পরিশ্রমকে তারা মূল্য দেয় না। তুমি বিভাগের সভাপতি হিসেব দায়িত্ব পালন করার সময় এক সাথে যে আটজন মেধাবী প্রভাষকের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলে সে কথাও তারা কখনো বলে না। অথচ তারা দাঁতাল সজল বলে তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছে। তোমার মনে মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে তুমি সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জীবন কাটালেও, তুমি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর দশজন শিক্ষকের মতো জীবন কাটাওনি। কোনো প্রথাগত পিছুটান চিন্তাকে তুমি তোমার পথ আগলাতে দাওনি। আগে যেমন তুমি সব ধরনের বিপদের চোখে চোখ রেখে ধৈর্য ও সাহস দিয়ে মোকাবেলা করেছো এবারো তুমি পারবে। শুধু তোমার নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে।

সজল জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস টেনে সেটি ছাড়লেন। মনে মনে হালকা বোধ করলেন। গ্রিন ক্যাম্পাসের নেতারা এসে জানিয়ে গেছেন, এ বছর শিল্পী হিসেবে একুশে পদক পাওয়া মৌমিতা আলীকে তাঁরা সংবর্ধনা জানাতে চান। শিল্পীর ‘নিসর্গ’ এবং ‘জননী’ সিরিজের সমস্ত ছবির মূল কিংবা রিপ্রোডাকশানের প্রদর্শনীর সপ্তাহব্যাপী ব্যবস্থা তাঁরা করবেন। এই উপলক্ষে তাঁরা একটি সুভেনিয়ার বের করবেন, এবং তা’তে মূল রচনাটি তাঁকেই লিখতে হবে। গ্রিন ক্যাম্পাসের সভাপতি যিনি চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, যাঁকে দেখলেই মনে হয় বিশাল একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে, তিনি আশফাক আহমেদ, জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, স্যার, আমরা জানি মৌমিতা আলীর জীবনবৃত্তান্ত আপনি যেমন জানেন, তেমন কেউ জানেন না। আপনি সুলেখক, আপনাকে পরামর্শ দেওয়া আমাদের মুখে সাজে না। তারপরও স্যার একটি মারাত্মক লেখা আশা করছি আপনার কাছে।
মারাত্মক লেখা! সজল চৌধুরী ধীরে ধীরে তাঁর ডেস্কে বসলেন। ব্যাগটা খুলে ল্যাপটপটা টেবিলে বসালেন। প্লাগ ইন করলেন। গুগল করলেন মৌমিতা আলী। সাথে সাথে ওয়েব পেজগুলো সূচিপত্রের মতো পর্দায় ভেসে উঠল। তিনি উইকিপিডিয়ারটাতে ঢুকলেন। মৌমিতার একটি পোর্ট্রটে ছবি আর তাঁর পরিচিতি। কেউ হয়তো কাঁচা হাতে লিখেছে। এডিটের অপশন প্রতি অনুচ্ছেদের নিচে সংযুক্ত। মৌমিতার বিভিন্ন ছবিরও রিপ্রিন্ট জায়গা পেয়েছে। বারবার জোর দেওয়া হয়েছে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে তাঁর উত্থানের ওপর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের পর অন্যতম খ্যাতিমান বাঙালি হিসেবে মৌমিতার পরিচয় দেখানো হয়েছে। জন্মের স্থান বলা হয়েছে যে শহরটিতে সজল চৌধুরী কদম আলীর সঙ্গে একত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠতেন, আর বলা হয়েছে শি কামস অব আ মডেস্ট ব্যাকগ্রাউন্ড। অর্থাৎ গুগলের ওয়েব পেজে মৌমিতার প্রোফাইল যিনি লিখেছেন তিনি না জানার ফলে অথবা সচেতনভাবে মৌমিতার জন্ম-পরিচিতির ব্যাপারটি এড়িয়ে গেছেন। শুধু বলে গেছেন, অতি সাধারণ অবস্থা থেকে সে উঠে এসেছে।

এ জায়গায় এসে সজল চৌধুরী একটি নৈতিক সংকটে পড়লেন। তিনি সাহিত্যের ছাত্র। কবি-সাহিত্যিকের জীবনী সত্য ও গল্পে মিশ্রিত থাকে। জীবনীকারদের দায়িত্ব থাকে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা সেটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা। এদিক থেকে পশ্চিমা সাহিত্য বেশ এগিয়ে। তাঁদের ওখানে জানা থাকলে সত্য গোপন করার কোনো রীতি নেই। তবে সত্যের নামে প্রচলিত মিথকে খণ্ডন করার দিকে তাঁদের নজর থাকে। যেমন শেক্সপিয়র সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প যে প্রভাবশালী এক জমিদারের হরিণ চুরি করার কারণে আইনের মুখোমুখি হয়ে তিনি তাঁর জন্মশহর স্ট্রাটফোর্ড ছাড়তে বাধ্য হন, এবং সাত বছর নিরুদ্দেশ থাকেন, সেটি এখন খণ্ডন করে আধুনিক কালের গবেষকরা বলছেন যে তিনি আসলে ঐ সময়ে উত্তর ইংল্যান্ডে একজন লর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন ঐ সাত বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ইদানীং তাঁকে একজন গবেষক জানিয়েছেন যে শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িকে কেন্দ্র করে যে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, তা’তে প্রচার করা হয়েছে যে রবীন্দনাথের এস্টেট থেকে সেখানে বারশ একর জমি দান করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। কিন্তু ঐ গবেষক তাঁকে জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেছিলেন যে ঐ শাহজাদপুর এস্টেটের মালিকানায় কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি ঐ এস্টেটের জমিদার ছিলেন না। তিনি সেখানে আসতেন, থাকতেন, টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলতেন, কিন্তু জমিদারি ছিল গগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবার নামে। সে জন্য, তিনি তাঁকে আরো বলেছিলেন, ঐ জমিদারির কোনো পুরোনো দলিলে কোথাও রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর নেই।

জানলার বাইরে দেখলেন আবার ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজকের মৌমিতা তো ভবিষ্যতে আরো বিখ্যাত হবে। এর মধ্যে একুশে পদক পেয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে, এবং যেভাবে একের পর এক অনবদ্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তাতে তাঁর খ্যাতি আকাশ ছোঁবে— এ ব্যাপারে চিত্র সমালোচক না হয়েও তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন। কাজেই তাঁর জীবনী তো জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষ চাঁদে গেছে, এভারেস্টে উঠেছে, সমুদ্রের অতলে গেছে, ক্যান্সার রোগ প্রতিষেধক আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে, সে মানুষের জন্য পিতৃ-মাতৃ পরিচয়, পারিবারিক প্রেক্ষাপট, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবেশ কোনো কিছুরই তো আবশ্যিকতা নেই। এগুলো থাকলে ভালো, না থাকলেও অসুবিধা নেই। কাজেই পরিচিতিতে সত্য ঢেকে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি চাইবে মৌমিতার প্রকৃত জন্ম পরিচয়টি আড়ালে থাকুক, তা’তে সমাজের কৃত্রিম সম্ভ্রমবোধটা রক্ষা পাবে কেবল, কিšন্তু মৌমিতার কিচ্ছু আসে যাবে না। মৌমিতা তো জানেই তার জন্মপরিচিতি। কদম আলী স্যার অন্তত মেয়ের কাছে এই অংশটি গোপন রাখার মতো ভুলটুকু করে যাননি। তো সে অংশটি গোপন রেখে সমাজের রক্ষণশীলতাকে প্রশ্রয় দেবার উপযোগিতা কোথায়? কেনই বা সেটি সজল চৌধুরীর মতো একজন একনিষ্ঠ শিক্ষক প্রশ্রয় দেবেন!

সজল চৌধুরী ল্যাপটপের কিবোর্ডে প্রথম অক্ষরটা চাপবেন সে সময় দরজার কাছ থেকে জলদগম্ভীর স্বরে ভেসে এল, স্যার, একটু আসব?

-আরে, এসো, এসো। তোমাদের জন্যই তো লিখতে বসেছি।।

বিশাল বটগাছের মতো আশফাক আহমেদ সামনের চেয়ারে বসলেন। বললেন, শুনেছি স্যার, আপনার লেখায় নাকি মৌমিতা আলীর প্রকৃত জন্মবৃত্তান্ত থাকবে। কারণ কালের সাক্ষী আপনি। ‘কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান’ বলা হলেও ‘কার কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া’ সেটির চাক্ষুষ সাক্ষী আপনি। কদম আলী স্যার তো বহু আগে মারা গেছেন। এখন স্যার, আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে এলাম। ঐটা কি এরকম স্পষ্ট করে লেখা ঠিক হবে, স্যার! মানুষ এমনিতে কিছু জানে, কিছু না জানে এরকম অবস্থায় আছে। সব সত্য কি স্যার বলা যায়?

সজল চৌধুরী তাঁর খানিকক্ষণ আগে নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা চেপে রেখে বললেন, তুমি কি সাজেস্ট করছ।

-আমি বলছি কি, আমাদের গ্রিন ক্যাম্পাসের সুভেনিয়ারটি তো আমাদের সংগঠনের যেমন তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রকাশনা। আমরা যদি তাঁকে কদম আলী স্যারের দত্তক নেওয়া কন্যা বা কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে হিসেবে পরিচিত করায় তা হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থাকে এই জন্য যে আমাদেরই একজন শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী মানবতার এরকম ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

-আর প্রকৃত সত্যটা??

-সেটা স্যার আপনি যদি তাঁর ওপর একটি জীবনী লেখেন বা অন্য কেউ যদি লেখেন তাঁরা অবশ্যই লিখবেন। কিšন্তু আমাদের প্রকাশনাতে কি ঐ তথ্য দেবার দরকার আছে, স্যার?

-ঠিক আছে, তুমি যাও এখন, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কথা।।

আবার জানলার পাশে এসে দাঁড়ালেন সজল চৌধুরী। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে। সাথে আষাঢ় মাসের প্রবল হাওয়া। দূরের নারকেল গাছগুলো একটি কঠিন যুগ্ম নাচের সঙ্গত করছে, সেভাবে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে দুলছে। তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ছাড়লেন। সজল চৌধুরী ভাবলেন, মৌমিতার সঙ্গে তো তাঁর কোনোদিন কোনো পরিচয় হবার কথা ছিল না। ঘটনাক্রমে তিনি মৌমিতার জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাত্র। অথচ আজকে তিনিই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন মৌমিতার ওপর একটি সত্যনিষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখতে।

বৃষ্টির তোড় বাড়তে বাড়তে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলল। নারকেল গাছগুলো তো দূরের কথা, কাছের বেল গাছটিও আর দেখা যাচ্ছে না। সজল চৌধুরী ভাবলেন, প্রকৃতি এত আচ্ছন্ন করা, সেখানে মানুষ কিসের হিসাব করে, কিসের ভয় করে, যে দাঁড়াবে সে সত্যের ওপর দাঁড়াবে। ‘কুড়িয়ে পাওয়া’ বললে কদম স্যারের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকে, আর বেশ্যামাতার যে অমর্যাদা হয় সেটি সজল চৌধুরী মেনে নেন কী করে? মৌমিতার জন্মদাত্রী হিসেবে যে মহিলাকে তিনি ফুটপাতের ঐ বাস ছাউনির নিচে প্রতিদিন ভোরে দেখেছেন তাকে তাঁর ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে কেবল, কিন্তু এটি পরিষ্কার মনে আছে কী গভীর মনোযোগ সহকারে শিশু মেয়েটির নগ্ন শরীরে তেল মেজে দিত সে। শিশুটির বয়স তখনো বসার মতো হয়নি। মহিলাকে শাড়ির তলায় লোকচক্ষুর আড়ালে শীর্ণ স্তন থেকে বাচ্চাটিকে মাঝে মাঝে দুধ খাওয়াতেও দেখেছেন। সেই শিশু আজকের মৌমিতা।

বৃষ্টির তোড় খানিকটা কমেছে। নারকেল গাছগুলোতে আবার নতুন হাওয়া লেগেছে। ভীষণ নাচছে সেগুলো। জানলা দিয়ে বৃষ্টিস্পৃষ্ট ঠাণ্ডা হাওয়া এসে তাঁর বুক জুড়িয়ে দিল। তিনি আবার ডেস্কের সামনে বসে ল্যাপটপের কিবোর্ডে চাপতে গিয়ে হাত দিলেন টিস্যুবক্সে। তাঁর চোখ ভিজে উঠেছে। সেই দৃশ্যটি মনে পড়ছে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে একটি নধর হৃষ্টúুষ্ট বাচ্চার ওপর তেল মাখছে তার মা।

আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে ছাড়লেন সজল চৌধুরী। বাইরে মেঘের ওপর মেঘ জমে দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে পরবর্তী প্রহরের দিকে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মোহিত উল আলম- র আরো পোষ্ট দেখুন