আমাদের ফুটবল পাগলামি

[গত ফুটবল বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন। এবার নেই! এই বিশ্বকাপে হুমায়ূন আহমেদের মুগ্ধ পাঠকেরা নিশ্চয়ই অনুভব করেছে তাঁর শূন্যতা। ফুটবল নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের পূর্বপ্রকাশিত তিনটি লেখার শেষ পর্ব আজ। এটি ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় লেখা]
চার বছর আগের কথা। ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক নাটকের চিত্রায়ণ হচ্ছে ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে। ক্যামেরা নিয়ে সবাই বসে আছি। শিল্পীরা তৈরি। পরিচালক নওয়াজিশ আলী খান ‘অ্যাকশান’ বললেই অভিনয় পর্ব শুরু হয়। এমন সময় ঝামেলা শুরু হলো। মিছিলের প্রচণ্ড স্লোগানে চারদিক কাঁপতে লাগল। আমাদের দেশটা মিটিং-মিছিলের দেশ। স্লোগান কোনো নতুন ব্যাপার না। কিন্তু সেদিনের মিছিলের স্লোগান অতি বিচিত্র। সাধু ভাষায় বলা যেতে পারে ‘অশ্রুতপূর্ব’। স্লোগান হচ্ছিল—‘ওয়াল্ড কাপ সিদ্ধান্ত। মানি না। মানি না। আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন। করতে হবে, করতে হবে।’
নওয়াজিশ আলী খান বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তাঁকে বললাম—লোকজন আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন না হওয়ায় ক্ষেপে গেছে। এই জন্যেই মিছিল, স্লোগান, আন্দোলন।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, আন্দোলন করে লাভ কী? আমি বললাম, আমরা ময়মনসিংহের লোক, আমরা লাভ-লোকসান বিচার করে আন্দোলন করি না। আমাদের ফেবারিট টিম আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা হেরে যাবে আর আন্দোলন করব না, তা হয় না।

নাটকের ইউনিটের সবাই কৌতূহলী হয়ে মিছিল দেখতে গেল। বিশাল জঙ্গি মিছিল। গলায় রুমাল বাঁধা এক যুবক আকাশ ফাটিয়ে চিত্কার করছে—আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন না বানালে—
বাকি সবাই ধুয়া ধরছে,—জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
নওয়াজিশ আলী খান বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন যে, তিনি এই জীবনে অনেক পাগল দেখেছেন। ময়মনসিংহের লোকের মতো পাগল দেখেননি।
এই ঘটনা আমি জাতিগতভাবে বাঙালির ফুটবলপ্রীতির নমুনা হিসেবে উপস্থিত করলাম। সাম্প্রতিক আরেকটি নমুনা দিচ্ছি। ডামফা কাপ ফাইনাল কিছুদিন আগে হয়ে গেল। আবাহনীর হয়ে খেলছে ইরাকি খেলোয়াড় নজর আলী। তিনি গোল করলেন। টিভিতে এই দৃশ্য দেখে এক দর্শক ‘নজর আলী’ বলে বিকট চিত্কার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। দ্বিতীয় দিনও তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। এই খবর পত্রিকার মারফতে আমি জানি। ও আচ্ছা, আরেকটি ঘটনা মনে পড়েছে। গত ওয়ার্ল্ড কাপের সময় আমার এক দূরসম্পর্কের ফুপুকে বিশেষ বিশেষ খেলার দিনে রোজা রাখতে হয়েছে। ভদ্র মহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। ফুটবল খেলা নিয়ে তাঁর কোনো রকম মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। তার পরও তাঁকে রোজা রাখতে হয়েছে। কারণ তাঁর ছেলের ফেবারিট টিমের খেলা। ছেলে নিজে রোজা রাখতে পারে না, কষ্ট হয়। মাকে দিয়ে রাখাচ্ছে।
আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি নয়—ফুটবল। মজার ব্যাপার হলো এই ফুটবল আমরা কিন্তু খেলতে পারি না। গত সাফ গেমসে আমাদের ফুটবলাররা শরীর ফিট রাখার জন্য এক মণ মধু খেয়ে কী খেলা খেলেছিলেন, তা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আমাদের খেলোয়াড়েরা বিদেশে খেলতে গিয়ে দশ-বারোটা করে গোল হাসিমুখে খান। আমরা দল বেঁধে এয়ারপোর্টে তাঁদের আনতে যাই। তাঁরা সেখানে গম্ভীরমুখে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। গলটিলা কাঁপিয়ে ভাষণ দেন।
‘আমাদের টিম অত্যন্ত ভালো খেলেছে। পাসের আদান-প্রদান এবং দলীয় সমঝোতা ছিল অসাধারণ পর্যায়ের। আমরা প্রতিপক্ষকে বেশির ভাগ সময়ই কোণঠাসা করে রেখেছিলাম। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তারা ছিল প্রবল চাপের মুখে। আমরা যে পরাজিত হয়েছি তা নিতান্তই ব্যাড লাক। আমরা আসলে ভালো খেলে পরাজিত। তবে এই পরাজয় বৃথা যায়নি। পরাজয় থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। সে শিক্ষা ভবিষ্যতে বিদেশের মাটিতে জয়লাভ করতে আমাদের সাহায্য করবে।’
পরাজয়ের শিক্ষা মনে হয় তেমন কাজে আসে না। কাছে এলে অসংখ্য পরাজয় থেকে এরই মধ্যে আমরা অনেক কিছু শিখে ফেললাম। কিছু শিখতে পারিনি। পারব এমন লক্ষণও দেখছি না।
তার পরও আমরা ফুটবল ভালোবাসি। বাঙালি বাবারা তাঁদের পুত্রদের প্রথম যে খেলনা কিনে দেন, তার নাম ফুটবল। কেন?
আজ পত্রিকায় দেখলাম—পলিটেকনিকের ছেলেরা ওয়ার্ল্ড কাপের সময় পরীক্ষা পড়েছে এই রাগে তাদের কলেজের চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা সব ভেঙে একাকার করেছে। ভালোবাসা নামক এই অবসেসানের কারণ কী?
মনস্তত্ত্ববিদেরা কারণ হয়তো জানেন। আমার নিজের ধারণা, আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা খানিকের জন্যে উত্তেজিত হতে ভালোবাসি। উপদেশ এবং গালি দিতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়। খেলার মাঠে যত ইচ্ছা উপদেশ এবং দেওয়া যায়। নমুনা—
‘কানা তুই দেখস কি? পাস দে। তোর বাপের বল, ‘পায়ের চিপায়’ রেখে দিয়েছিস?’
(শব্দটা পায়ের চিপা নয়, অন্য এক স্থান। শালীনতার কারণে পায়ের চিপা বললাম। বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিন)।
‘ল্যাং মার। ল্যাং মার। আরে কুত্তার বাচ্চা, ল্যাং মেরে ফেলে দে না।’
‘ভ্যাবদা মেরে বসে আছিস ক্যান রে চান্দি ছোলা? শট দে। শট দেওয়া ভুলে গেছিস?’
(এই খেলোয়াড়ের মাথায় চুল কম বলেই আদর করে চান্দি ছোলা বলা হচ্ছে)।
‘ঐ শুওরের বাচ্চার চোখ তুলে ফেল।’
‘চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে দে।’
‘টান মেরে—ছিঁড়ে ফেল।’
(কী ছিঁড়তে বলা হয়েছে পাঠক বুঝে নিন)।
খেলা শেষ হওয়ার পরপর রেফারিকে ধোলাই দেওয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে। নতুন কোনো ব্যাপার না। আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। বাঙালি রেফারিরা এতে কিছু মনেও করে না। ধোলাই খাওয়াটাকে তারা কপালের লিখন হিসেবে মেনে নিয়েছে। অবশ্যি রেফারিকে ধোলাই দেওয়ার এই প্রবণতা শুধু বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য নয়, এটা সর্বজনীন। ‘পাঞ্চ’ পত্রিকায় একটা কার্টুন দেখেছিলাম। কার্টুনে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে একটা বেড সাজানো হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হয় ব্যাপার কী? হাসপাতালের অ্যাটেনডেন্ট বলল, আজ ফুটবল খেলা আছে না? এই বেড রেফারির জন্যে।
যা-ই হোক, চার বছর পর আবার আসছে ওয়ার্ল্ড কাপ। এই সময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা এবং আশ্চর্যজনক ঘটনা।
বাতাসভর্তি চামড়ার একটি গোলকের দিকে সারা পৃথিবীর মানুষ তীব্র উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে—এর চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আর কী হতে পারে? আমরা বাঙালিরা খেলা দেখতে দেখতে কিছু সময়ের জন্যে হলেও আমাদের শৈশবে ফিরে যাব। তার মূল্যও বা কম কী? ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ভিজে ন্যাতা ন্যাতা। বৃষ্টিভেজা মাঠে জাম্বুরা নিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি। পায়ের নিচে পানি ছপ ছপ করছে। কে যেন গড়িয়ে পড়ল কাদায়। দেখার সময় নেই। বল নিয়ে দৌড়াতে হবে। ওই তো দেখা যায় গোল পোস্ট।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহুমায়ূন আহমেদ- র আরো পোষ্ট দেখুন