রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পরই সৈয়দ হক

বাংলা সাহিত্য অতীতে এবং বর্তমানে প্রতিভাবান অনেক লেখকের সৃষ্টিসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন কবি, কেবল ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার, কেউবা প্রসিদ্ধ হয়েছেন নাটক লিখে, কারও খ্যাতি অর্জিত হয়েছে প্রবন্ধকার ও সমালোচক হিসেবে, কারও ভাগ্যে খ্যাতি জুটেছে অনুবাদক হিসেবে। একই সঙ্গে এসব সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যচর্চায় সফল হয়ে অমরতা লাভ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ সৃজনশীলতার বিচিত্র বিকাশে ছবিও এঁকেছেন এবং গীতিকার ও সুরকার হিসেবে অমর হয়ে আছেন। তাঁর চিঠি সাহিত্যও উল্লেখের দাবি রাখে সাহিত্যগুণের জন্য। রবীন্দ্রনাথের মতো সবগুলো ক্ষেত্রে না হলেও নজরুল ইসলাম সাহিত্যের অনেক শাখায় সফলভাবে বিচরণ করে জনপ্রিয় হয়েছেন এবং স্মরণীয় হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের পর বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে যিনি বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর তার সঙ্গে তুলনীয় লেখক পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আর কেউ জন্মাননি। অনেকে তাকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে অভিহিত করেন। এতে তার অর্জন ও সফলতাকে খর্ব করা হয়। সব্যসাচী দুই হাতে অস্ত্র নিক্ষেপ করে পুরাণে খ্যাত হয়েছেন। সৈয়দ হক দুই হাতে নয়, দশ হাতে লিখে চলেছেন; যার জন্য তার প্রতিভার প্রতি বিচার করা হবে ‘বহুমাত্রিক লেখক’ বলে সম্মান ও স্বীকৃতি জানানো হলে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং অনুবাদ করে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা এখন পর্যন্ত তুলনাহীন। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্যের বাইরে চিত্রকলার চর্চা করেছেন। একসময়ে চলচ্চিত্রও তাকে আকর্ষণ করেছিল, যেমন করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। এমন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ বাংলাদেশে জন্মেছেন এবং আশি বছর অতিক্রম করেও নিরলসভাবে সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন, এর জন্য আমরা বাংলাদেশের মানুষ তার কাছে কৃতজ্ঞ। ‘বাংলাদেশের মানুষের’ কথা বলা হলো এই জন্য যে, তিনি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে সকল নর-নারীর জন্য তার সৃষ্টিশীলতাকে নিবেদন করেছেন।
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার পরিচয় গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন আমি কলেজে পড়ি। তখনও তাকে চোখে দেখিনি। তার লেখা কয়েকটি গল্প এবং ধারাবাহিক উপন্যাস অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ‘স্পন্দন’ ও ‘রসনা’তে ছাপা হওয়ার পর তার মুগ্ধতায় মগ্ন থেকেছি। তিনি তখন রোমান্টিক মেলবন্ধের গল্প ও উপন্যাস লিখতেন। যেমন ‘অন্যজন’ এবং ‘দেয়ালের দেশ’ উপন্যাস। রোমান্টিকধর্মীয় ছোটগল্পের মধ্যে ছিল কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন, ‘অনুপম দিন’। কিন্তু তারপরই তার সাহিত্যচর্চায় মোড় ফিরে এলো। তিনি লিখলেন ‘জনক ও কালো কফি’, ‘রক্ত গোলাপের’ মতো বাস্তবধর্মী গল্প। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’ অর্ধেক রোমান্টিক, বাকিটা বাস্তবতার স্পর্শে ইস্পাত কঠিন। এই উপন্যাস তাকে খ্যাতি এবং নিন্দা দুই-ই এনে দিয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে নবোকভের ‘ললিতা’র ছায়া দেখতে পেয়েছেন। হয়তো এই প্রভাব ছিল, কিন্তু সৈয়দ হকের মৌলিকতার প্রতি নিষ্ঠা উপন্যাসটিকে নিজস্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। যারা এর মধ্যে অশ্লীলতার গন্ধ পেয়েছেন, তাদেরকে কূপমণ্ডূক বলা ছাড়া উপায় নেই। কেবল চাঞ্চল্য সৃষ্টির জন্য সৈয়দ হক এই উপন্যাসটি লেখেননি, এমন কাহিনী যে বর্ণনা গুণে সাহিত্যমর্যাদা পেতে পারে, সেই বিষয় প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সৈয়দ হকের সাহিত্য চর্চায় বিশাল বাঁক ফেরা দেখা যায় সত্তরের দশকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিলেতে প্রবাস জীবনে তিনি লেখেন ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘অন্য এক আলিঙ্গন’। উপন্যাসগুলোতে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে হাস্য-রসিকতা। এই উপন্যাসগুলোর চেয়েও যে উপন্যাস তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়, তার নাম ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা এটিই তার প্রথম উপন্যাস। এখানে বিষয়ের মাহাত্ম্য ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিস্তৃত হয়েছে অন্তরঙ্গ ন্যারেটিভ, যার উৎস চেতনা থেকে। বর্ণনার কৃপণতায় কাহিনী এখানে ক্ষুদ্র পরিসরে এপিকের মর্যাদা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি পরবর্তীকালে লিখেছেন ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, যা এপিকধর্মী। এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একীভূত হয়েছে লোকজ কাহিনী ও ধর্মবিশ্বাস। উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ সমকালীন সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে অন্তরঙ্গ হয়ে।
সত্তরের দশকে তখন শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টিশীলতার জোয়ার বয়ে চলেছে, সেই উর্বর সময়ে তিনি হাত দেন নাটক লেখায়। তার লেখা কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, কথ্য ভাষায় মূর্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাজেডি। এর পরই তিনি যখন লেখেন ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ তখন হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাসের চরিত্রের মতো ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এক সময়ের সৃষ্টি হয়। এরপর সৈয়দ হক আরও নাটক লিখেছেন এবং এখনও লিখে যাচ্ছেন। তার সর্বশেষ নাটক ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ বাঙালি সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি ও বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি এক মরমি নিবেদন।
সাহিত্যচর্চায়, বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোট গল্প লিখতে গিয়ে তিনি শৈশব এবং কৈশোরের স্মৃতিসমৃদ্ধ গ্রামীণ জনপদ জলেশ্বরীকে পাঠকের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রনে তৈরি জলেশ্বরী সিরিজের লেখাগুলো টমাস হার্ডির ওয়েসেক্স অঞ্চল এবং উইলিয়াম ফকনারের আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলভিত্তিক উপন্যাসগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জলেশ্বরীকে পটভূমি করে তিনি শিকড়ের গভীরে পেঁৗছাতে চেয়েছেন। জলেশ্বরী তাকে নিজস্ব সত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সৈয়দ হক এখন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কবি। গল্প, উপন্যাস এবং নাটকের মতোই তিনি কবিতায় আধুনিকতামনস্ক। চিত্রকল্প ও উপমাসমৃদ্ধ কবিতাগুলো নকশি কাঁথার মতো বিচিত্র এবং অর্থবহ। বাংলাদেশের দীর্ঘতম কবিতা ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ তার অনবদ্য সৃষ্টি। বিদেশি ভাষায় লেখা অনেক কবিতা তিনি অনুবাদও করেছেন। তাকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, যিনি মৌলিক লেখেন, তাকে কেন অনুবাদে সময় ব্যয় করতে দেখি। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এসব আক্ষরিক অনুবাদ নয়। অনুবাদে এরা আমার লেখা কবিতাই।
হালকা মেজাজে, পাণ্ডিত্য না দেখিয়ে অনেক গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘কথা সামান্যই’। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অনেক কথার তিনি ব্যুৎপত্তি থেকে ব্যবহারিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রাঞ্জল ভাষায়। ‘মার্জিনে মন্তব্য’ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাহিত্য সমালোচনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রোজনামচার মতো লেখা ‘হৃৎকলমের টানে’ লেখকের ভেতরের মানুষকে অবারিত করে দেয়।
প্রচারের জন্য নয়, নিজের সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তিনি অনেক ছবিও এঁকেছেন। ছবিতে রয়েছে আধুনিকতার নন্দনতাত্তি্বক পরিচয়। সৈয়দ হককে সব্যসাচী বলা হলে খর্ব করা হয়। তিনি বহুমাত্রিক, যার তুলনা তিনি নিজেই। দোষে-গুণেই মানুষ। সৈয়দ হকেরও কাদামাটির পদযুগল রয়েছে, যেখানে তার দুর্বলতার প্রকাশ। এই দুর্বলতা এক ধরনের সীমাবদ্ধতা, যার জন্য তার প্রতি অনুযোগ করা যায়। তিনি অন্যের প্রশংসায় কুণ্ঠাবোধ করেন, এমন মনে হয়। যিনি এত বড় মাপের মানুষ, তার কাছ থেকে হৃদয়ের ঔদার্যই আশা করে সবাই।
সৈয়দ হক দীর্ঘজীবী হোন। বাংলা সাহিত্য তার অবদানে আরও ধন্য হোক।