শাহীন রেজা চিরচেনা সত্যনগর

শাহীন রেজা
(জন্ম : ২৯ মে ১৯৬২) যেসব তরুণ প্রতিভাবান কবি আমার মতো প্রায়ান্ধ দৃষ্টিশক্তির মানুষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শাহীন রেজা তাদের অগ্রগণ্য কবি-প্রতিভা। তিনি মূলত প্রেমের কবি। তা সত্ত্বেও শাহীনের কবিতায় যে নিগর্স চিত্র পরিস্ফুট হয় তা মনোমুগ্ধকর। আগ্রহ সৃষ্টি করে এমন কবি-তারুণ্য সময়ে না খুঁজলে সহজে আবিষ্কার করা যায় না। শাহীন রেজা স্পষ্টতই প্রতিভাত হয়েছেন একজন মননশীল কবি-প্রতিভা হিসেবে। তার কবিতা আমার ভালো লাগে। প্রতিভাবান মানুষ সচরাচর অনেক দেখা যায়, কিন্তু এর মধ্যে কবিত্বশক্তির অধিকারী মানুষ কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়। শাহীন রেজাকে আমার তেমনটি বলেই মনে হয়। তার লেখা আমাকে স্পর্শ করে।
শাহীন রেজার অনেক কবিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি, পুলকিত হয়েছি। ভালো লাগা যাকে বলে তা একটা অনুভবের বিষয়। আমি সারা জীবন পড়তে পড়তে এসেছি। আয়ু ঝরিয়ে ঝরিয়ে গড়িয়ে পড়েছি এই দেশে। এই মাটিকে আমি মাতৃতুল্য গরীয়সী মনে করি। আমার কবিতায় এই মায়ের গন্ধ আছে, শাহীন রেজার কবিতায়ও সেই মাকে আমি শনাক্ত করেছি। একজন তরুণ কবির জন্য এটা কম কথা নয়। শাহীন রেজার কবিতা আমার মনে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি এনে দিয়েছে। কবিদের কাজ এ রকমই হয়। কখনো নেশা ধরিয়ে দেয়, কখনো আশা জাগিয়ে তোলে আবার কখনো ভাষার বিবৃতিতে বিষণ্ন হয়। শাহীন এ ক্ষেত্রে সফল, তা বলাই চলে। আমার একান্তজন হিসেবে বলছি না। কবিতায় তার চাষবাস যে নিরলস তা আমি দীর্ঘদিন ধরে দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সর্বদা কবিতা সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তার কবিতা সহজ-সাবলীল গতিসম্পন্ন। তিনি শব্দে-গন্ধে পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন।
তার একটি কবিতায় আছে এ রকমই পঙ্ক্তি_
‘দাঁড়াও মধ্যরাত
কুয়াশার ছায়াপথে বাতাসেরা
অবিরাম নদীর চেরাগ’
মধ্যরাতকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা সে তো একজন কবিই রাখেন। নদীর চেরাগ আবিষ্কার করার ক্ষমতা, তাও তো একজন কবিরই দক্ষতা।
শাহীন আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তার ‘সত্যনগর’ কবিতাটি, যেটি আমাকে নিয়ে লেখা তা যে একটি অতিউৎকৃষ্ট কবিতা; তা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। করতলে প্রভাত অাঁকার যে অদম্য স্পৃহা তিনি এ কবিতাটিতে ব্যক্ত করেছেন তা তার আপন কবিস্বভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।
আমি বাংলা ভাষার একজন নিগূঢ় পাঠক। শাহীনের কবিত্বশক্তি আমার মতো একজন প্রবীণ প্রায়ান্ধ কবিকে যে ছুঁয়ে গেছে একেই আমি অনেক বড় একটি বিষয় বলে মনে করি এবং এর কৃতিত্ব যে শাহীন রেজার তা স্বীকার করতেও কোনো কুণ্ঠা নেই। আমি বিশ্বাস করি, শাহীন রেজা তার কবিতা দিয়ে আমার মতো বিদগ্ধ পাঠককে যেভাবে মুগ্ধ করেছেন সেভাবে বাংলা ভাষার অগণিত পাঠককেও মুগ্ধ করবেন।
আমি চিরকাল বলে এসেছি, কবিতা কষ্টের কলা। একে আয়ত্তে আনতে কষ্টমালা পরে কষ্টের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হয়। শাহীন রেজার মধ্যে আমি সে প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি লক্ষ্য করেছি। যদি একাগ্রভাবে তিনি সেই কষ্টকলায় প্রবিষ্ট হতে পারেন তবে তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।
শাহীন রেজার একটি কবিতার শিরোনাম ‘পথ এবং ঋতুবতী নারীদের গল্প’। এ কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন_
‘বেরুবার পথ নেই
যেদিকেই যেতে চাই মাকড়সা বসে আছে
পেতে রেখে সময়ের জাল’
এ কবিতায় মূলত বর্তমান তরুণ সমাজের চিত্রই ধ্বনিত হয়েছে। শাহীন তার লেখনীর মধ্যদিয়ে তারুণ্যের যে অসহায় চিত্র তুলে ধরেছেন তা সময়োপযোগী এবং প্রশংসার দাবিদার। মূল্যবোধের অবক্ষয় আর বিজাতীয় সংস্কৃতির তীব্র ছোবলে দিশাহারা আমাদের তারুণ্যকে সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব আমাদেরই। শাহীন শুধু সেই সত্যটিকেই আমাদের সামনে প্রস্ফুটিত করেছেন মাত্র। একই কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন_
‘নদীর নাভীর কাছে জ্যোৎস্নার যত ক্ষত’
নদীর নাভীতে জ্যোৎস্নার ক্ষত আবিষ্কার করা খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। এটি একজন প্রকৃত কবির পক্ষেই সম্ভব।
আমি সব সময় কবিতার পক্ষে থেকেছি। আমার জীবনে যা কিছু অর্জন তা কবিতা দিয়েই। কবিতার জন্য আমি সব সম্ভাবনা, লোভ ও বাসনাকে পরিত্যাগ করেছি। কবিতাই আমার ইবাদত, একমাত্র আরাধনা। সারা জীবন কবিতায় নিমগ্ন থেকেছি বলেই আজ এই জীবনসায়াহ্নে ‘কবি’ ডাক শুনলেই কেমন যেন আত্মহারা হয়ে উঠি_ আমার হৃদয় শ্রাবণের ঘন দেয়া বরিষনের মতো নেচে ওঠে। শাহীনের মধ্যে আমি সেই উন্মাদনা, সেই উচ্ছলতা খুঁজে পেয়েছি যা শুধু একজন কবির পক্ষেই সম্ভব। সকালের আলো দেখলেই যেমন দিবসটিকে শনাক্ত করা যায় তেমনি তার মধ্যে আমি এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করছি।
শাহীন রেজা আমার ৭০তম জন্মদিন পালন করেছেন সাড়ম্বরে। এ উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউটের হলরুমে আয়োজন করা হয়েছিল আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের। তদানীন্তন সরকারের দুজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে অজস্র মানুষের সমাগম আমাকে উৎফুল্ল করে তুলেছিল। মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় আমাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তাতে আমি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে নিয়ে প্রায় অর্ধশত কবির নিবেদিত কবিতা পাঠ আমার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় ঘটনা। অনুষ্ঠানের পর আমি শাহীন রেজার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন_ ‘আমি তো কবিতার জন্য, কবির জন্য কাজ করেছি মাত্র। এখানে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই।’ এই বিনয় একজন কবির ধর্ম, যা আমি শাহীন রেজার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাকে ঘিরে এত বড় আয়োজন আর ঘটেনি। সে ঘটনাটি এখনো আমার মনে প্রজ্বলিত হয়ে আছে।
শাহীন রেজা এরই মধ্যে জীবনের অর্ধশত বসন্ত পার করে এসেছেন। একজন কবির জন্য এ অনেক দীর্ঘ সময়। আমার দৃষ্টিতে তিনি তরুণ হলেও কবিতার কর্ষভূমিতে তার বিচরণ মোটামুটি দীর্ঘ।
যদিও একজন কবিকে পুরোপুরিভাবে শনাক্ত করার জন্য এ সময় যথার্থ নয়। আমি প্রার্থনা করি তার কাব্যাকাশ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠুক এবং জীবনের বাকিটা সময় যেন তিনি পুরোপুরিভাবে কবিতার ইবাদতে মশগুল থাকতে পারেন।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন