হাসপাতালে কারা কখন তাকে নিয়ে এসেছিল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, এনায়েতুল্লা খান বিছানায় শুয়ে মনে করতে পারছেন না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়, যার জন্য খুব কাছে যারা ছিল, তাদের চেহারা ঝাপসা দেখিয়েছে। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছে, বহু দূরের। কথাগুলো মনে হয়েছে ভাঙা-ভাঙা, সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার মতো। জড়ানো স্বরের কথা শুনতে শুনতে তিনি চেতন আর অচেতনের সীমানা কখন পেরিয়েছিলেন, জানতে পারেননি। একসময় মানুষের স্বর ছাপিয়ে শুনতে পেয়েছেন মায়াবী এক সুর অনেকটা বাঁশির মতো, একটানা। একটা সিড়বগ্ধ নরম নীল আলোয় ঢেকে গিয়েছিল চারদিক, যার ভেতর দিয়ে তিনি হালকা পালকের মতো উড়ে যাচ্ছিলেন ধীরে। তার শরীরের কোনো ভার ছিল না, মনে ছিল গভীর প্রশান্তি, যেন বহুদূর পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। তারপর একসময় দেখতে পেয়েছিলেন, অশরীরী ছায়া তার যাওয়ার পথের দুই দিকে মৃদু মৃদু নড়ছে; কখনো হাতের ছায়া খুব কাছে এসে ডাকার ভঙ্গিতে উঠছে-নামছে। হালকা নীল রং, ময়াবী বাঁশির সুর। আর সেসব ছায়ার ভেতর তিনি উড়ে যাচ্ছেন। এই সময় উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, শুয়ে আছেন সাদা চাদরঢাকা বিছানায়, পাশে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন মুখ নিচু করে তাকে দেখছে। হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তার এই প্রথম আসা নয়, আগেও এসেছেন একবার। তার ছেলে আর ছেলের বউই নিয়ে এসেছে। সেবারও হাসপাতালে আসার আগে তার পূর্ণ জ্ঞান ছিল না। আচ্ছনেড়বর মতো চেতন-অচেতনের মাঝখানে থেকে সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে ছিল। শুধু একটা গতি অনুভব করেছিলেন যখন তাকে বিছানা থেকে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে হাসপাতালে আনা হয়েছে, সেখানে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইমার্জেন্সিতে। তিনি অবশ্য অর্ধচেতন হয়ে থেকে বুঝতে পারেননি কোথায় নেয়া হচ্ছে, কে তার পাশে। শুধু গতির বেগটা অনুভব করেছিলেন। তখনো অবচেতনে অথবা অচেতন হয়ে যাওয়ার পর একই বাঁশির মায়াবী সুর শুনতে পেয়েছিলেন আর তার চারদিকে ছিল স্বচ্ছ রং। সেই কথা শুনে পরে ডাক্তার হেসে বলেছেন, অচেতন হয়ে গেলেই বোধশক্তি হারিয়ে যায় না, কিন্তু তখন চেনা পৃথিবীর রূপ-রং-গন্ধ না থাকে, অন্য এক জগতের দৃশ্য, শব্দ, বর্ণ। ডাক্তার বলেছেন, অনেকের মতে, সেই জগৎটা পৃথিবী আর অপার্থিব স্থানের মাঝখানে। কেউ কেউ সেই মাঝখানের জগতের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসে চেতনার জগতে। স্বপেড়ব দেখা দৃশ্য পরে স্পষ্টভাবে মনে করা যায় না, অস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তারপর একসময় রিয়ে যায় স্মৃতি থেকে। তিনি মরে যাননি, কিন্তু মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমবার যখন হাসপাতালে এসেছিলেন তখন, আর এখন এই দ্বিতীয়বার। দু’বারই তিন দিন কোনো চেতনা ছিল না, চোখ খোলেননি, নাকে অক্সিজেনের মাস্ক থেকে নিঃশ্বাস নিয়েছেন। মনিটরে সরলরেখাটা খুব ধীরে এগিয়ে গিয়েছে সামনে উঁচু-নিচু হয়ে, সমান হতে হতেও হয়নি, যা দেখে বোঝা গিয়েছে, তিনি বেঁচে আছেন, নড়ছেন অচেতন হয়ে থেকে। সেই সময় যে তিনি হালকা নরম নীলরঙা জগতে মায়াবী বাঁশির সুর শুনে ভেসে যাচ্ছেন, অশরীরীর ছায়া দেখছেন, প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছে তার মন, এ কথা বাইরের কেউ জানতে পারেনি। জানতে পেরেছে, তিনি চোখ খুলে অচেতন হয়ে ওঠার অনেক পর যখন তিনি কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন, স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসার উপক্রম হয়েছে, সেই সময়। সিসিইউতে কতদিন ছিলেন, তা তার মনে নেই। প্রথমবার ছিল না, এবারো মনে নেই। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে এসে তিনি সময়ের হিসাব করতে পেরেছেন, বিছানায় শুয়ে দেখতে পেয়েছেন, ডাক্তার, নার্স, তার ছোট ছেলে দাউদ, দাউদের বউ জয়নাব এদের। মামার কাছে ছোট মনিটরে সরলরেখা উঁচু-নিচু হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে, দেখতে পেরেছেন। ডাক্তার হাসিমুখে জানিয়েছেন, তিনি আউট অব ডেঞ্জার। নার্স চার্ট করা বোর্ড হাতে নিয়ে নীল
বলপেন দিয়ে লিখেছে মাথা নিচু করে। দাউদ তার বিছানার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উদ্বিগড়ব চোখে তাকিয়ে থেকেছে। জয়নবের দৃষ্টি ভাবলেশহীন, যেন কেমন করে তাকাবে, ভেবে উঠতে পারছে না।বেচারি! পুত্রবধূর অসহায় ভাব দেখে তার বেশ হাসি পেল। সরল মেয়ে, তাই অভিনয় করতে জানে না। জানলে মুখে এক টুকরো মেকি হাসি বানিয়ে রাখত অনায়াসে।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর এনায়েতুল্লা খান ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন হাসিমুখে। বললেন, আমাকে শুধু শুধু নিয়ে এসেছো হাসপাতালে। যা হওয়ার, তা হবেই। এত টানাহেঁচড়া করার মানে হয় না। তারপর হেসে বললেন, আমার জ্ঞান থাকলে নিষেধ করতাম। দাউদ নার্সের দিকে তাকাল। নার্স কিছু ইঙ্গিত করছে। সে তার আব্বাকে বলল, কথা বলবেন না এখন। রেস্টে থাকতে হবে ক’দিন।
জয়নাব এবার বিছানার কাছে এসে বলল, হ্যাঁ, বাবা। ডাক্তার বলে গিয়েছেন সাবধানে থাকতে। আপনি বেশি কথা বলবেন না। তিনি তাকালেন দুজনের দিকে। তারপর বললেন, যখন জ্ঞান ছিল না, কথা বলতে পারিনি। এখন জ্ঞান ফিরেছে, কথা না বললে অসুস্থ হয়ে যাব। তা হয় না, মা। যতক্ষণ জ্ঞান আছে, কথা বলে যাব। দাউদ কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, আব্বা, তুমি ছেলেমানুষি করছো। ঠিক হচ্ছে না। এনায়েতুল্লা বললেন, বুড়ো বয়সেই তো ছেলেমানুষি করা যায়। খুব ভেবেচিন্তে, হিসাব করে কিছু করার দায় নেই এখন। তোরা যা-ই বলিস, আমার ছেলেমানুষি বন্ধ হবে না। তারপর ঘরের চারদিক
দেখে বললেন, তুলি কোথায়? তাকে দেখছি না। জয়নাব বলল, তাকে আনিনি। আসতে চেয়েছিল। দাউদ বলল, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আসা নিষেধ। তাই আনিনি তাকে। এনায়েতুল্লা বললেন, এসব নিষেধের কোনো মানে হয় না। ডাক্তারদের জানা উচিত, বুড়ো বয়সে ছোটদের সঙ্গেই বেশি বন্ধুত্ব হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়া যায়। বলে তিনি জয়নবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুলি আসতে চেয়েছিল? খুব স্বাভাবিক। সে এখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি যেমন তাকে মিস করছি, সেও মিস করছে আমাকে। তারপর বললেন, তুলি বাচ্চা না, তার বয়স ষোলো। দাউদ বলল, আপনি কেবিনে গেলে নিয়ে আসব। সেখানে তার যেতে নিষেধ থাকবে না। আবার কেবিন? কেন, একবারেই বাড়ি যাওয়া যাবে না? আমার হাসপাতালে থাকতে ভালো লাগে না। মনে হয়, মনে হয় অচেনা-অজানা জায়গায় পড়ে আছি। কাউকে চিনি না। দাউদ বলে, ডাক্তার যেতে দেবেন না। আমাদের নিয়ে যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার অসুখের কথা ভেবে জোর করে বলিনি ডাক্তারকে।
এনায়েতুল্লা একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, বলেছি তো যা হওয়ার তা-ই হবে। আমার বয়সে অসুখ হওয়ারই কথা। এর জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে কেন? এখানে থাকার কী প্রয়োজন?
জয়নাব বলে, তা হয় না বাবা। অসুস্থ হলে হাসপাতালে আনতে হয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। এটা আমাদের দায়িত্ব। আর আপনিই তো একমাত্র বয়স্ক লোক নন, যাকে হাসপাতালে আসতে
হয়। সবাই আসে। যারা বয়স্ক নয়, তারাও আসে অসুস্থ হলে। এনায়েতুল্লা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, চিকিৎসা এখন বিরাট ব্যবসা। আমরা না এলে এই ব্যবসা চলবে না। তাই আসতে হয়। আমাদের বাঁচিয়ে রাখা মানেই ব্যবসাটা চালু রাখা। আমার এটা পছন্দ হয় না। দাউদ বলে, আপনি আপনার মতো করে ভাবছেন। সবাই তেমন করে ভাবে না। হাসপাতালে এসে স্বস্তি বোধ করে। রোগীর আত্মীয়-স্বজনও ভরসা পায়। এনায়েতুল্লা বলেন, জানি। কিন্তু আমার পছন্দ হয় না। নিজের বাড়ির ঘরটাতেই শান্তি রয়েছে বলে মনে করি। জয়নাব বলে, সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, যন্ত্রপাতি নেই, ডাক্তার-নার্স নেই। এনায়েতুল্লা ছেলের বউয়ের দিকে তাকান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলেন, থাকার দরকার কী? বলছি না, যা হওয়ার তা-ই হবে। দৌড়াদৌড়ি, টানাহেঁচড়া করে কষ্ট পাওয়ার মানে হয় না। দাউদ আর জয়নাব চুপ করে থাকে। তারপর দাউদ বলে, আপনি খুব ব্যতিক্রমী। আপনার মতো করে কেউ চিন্তা করে না। আমরাও না। তাই সবাই যা করে, আমরাও তা-ই করি। হাসসপাতালে নিয়ে আসি, চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। না হলে অস্থির হয়ে যেতাম আমরা। কেন, অস্থির হবে কেন? দাউদ বলে, মনে হতো, দায়িত্ব পালন করছি না। এনায়েতুল্লা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, আমার প্রতি তোমাদের কোনো দায়িত্ব নেই। থাকা উচিত নয়। তোমাদের দায়িত্ব নিজের জীবনের প্রতি। তোমাদের মেয়ের প্রতি। আমার প্রতি দায়িত্ব থাকতে যাবে কেন? আমি তোমাদের ওপর নির্ভরশীল নই। নিজের আয়ে চলি, নিজের বাড়িতে থাকি। আমি সেলফ রিলায়েন্ট। জয়নাব বলে, নির্ভরশীল নন, কিন্তু আপনার বয়স হয়েছে। নিজে সবকিছু করতে পারেন না। আমাদের
কিছু করতেই হয়। না হলে খুব স্বার্থপর হয়ে যাব। সেটা ভালো দেখাবে না। আমাদের কাছে ভালো লাগবে না। এনায়েতুল্লা দাউদের দিকে তাকিয়ে বলেন, অনেক ছেলেমেয়ে আছে, তাদের কথা কাগজে পড়ছি। সেসব ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে দেখে না, ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দেয়। বিদেশে যেমন হয়। তারপর আর খোঁজ-খবর নেয় না। খুব নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে সেই হতভাগ্য বাবা-মা। আমার অবস্থা তো তেমন না। তোমরা দুজন আছো, তুলি আছে। আমাকে সঙ্গ দিচ্ছো। এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করি না আমি। এর চেয়ে কম করলে তোমাদের ভুল বুঝব না, দুঃখ পাব না। ছেলেরা বুড়ো বয়সে আমাকে দেখবে, সেজন্য তাদের জন্ম দেইনি। তোমাদের জন্মের পেছনে তেমন কোনো হিসাব ছিল না। দাউদ বলল, বাবা, অনেক কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, আমরা এখন যাই। আপনি রেস্ট নিন।
আবার আগামীকাল আসব। এনায়েতুল্লা বললেন, কাজ ফেলে এখানে এসো না। এরা আমার ভালো দেখাশোনাই করছে। বলে তিনি নার্সের দিকে তাকালেন। কালো শীর্ণ দেহের মেয়েটা হাসল। খুশি হলো প্রশংসা শুনে।