পুষ্প বিহনে পয়লা বৈশাখ

e5e8beef63efbbc38ccbe8a2054587f2-15পুষ্প নাই তো কিছুই নাই, উৎসব নাই, সংগীত নাই; নারীর খোঁপায় বিলাস নাই, কালীবাড়ির মন্দিরে দেবীর পায়ে শোভা নাই, ডাকবাংলার বাগানে যদি পুষ্প নাই তবে বালকদের দস্যুতারও ঘটনা নাই, ইতিহাস বইয়ের পাতায় তবে শাহজাহান বাদশার চিত্রে তাঁর হাতে ধরা পুষ্পটি নাই; আমাদের পুষ্পও জলেশ্বরীতে আর নাই; নাই মানে এ নয় যে যেমন লোকে চলিত কথায় বুঝে থাকে—মৃত্যু। অর্থাৎ সে আর এই জগতের ধুলার ওপরে নাই; পুষ্প যে জলেশ্বরীতে নাই তার মানে সে আর এখানে নাই; এ শহরে নাই; তাই আমরা কাতর ও বিমর্ষ, তাই আমাদের শহরটিও অবিরল এক সূর্যাস্তেই যেন, তাই ইশকুলের বাংলা টিচার জগমোহনবাবুরও যেন ডানাভাঙা পাখির হাল, সুরহারা বাণীর দশা তার, সমস্বরে গাইবার এক কোকিল সঙ্গীহারা জগমোহনবাবু, তার দুঃখে সংক্রান্তির শেষেও যেন নতুন বছরের দেখা নাই কিংবা নতুন বছর যদি আসেই—আসবেই তো! কে কবে কালের গতি ঠেকাতে পেরেছে—সেই বৈশাখ যে সুরলহরী বেয়ে আসবে না, আবাহনে সে পা ফেলবে না এখানে, এই শোকে শহর যেন আগাম মুহ্যমান; আমরা নদীপারে কাশেম চাচার চায়ের দোকানে যে বসি, আমাদেরও চায়ে কোনো স্বাদ নাই, চায়ের রংটিও দুধে আর তেমন ফোটে না যে বেহেশতি জাফরানি রং হয় তার; আমরা পুষ্পের বড় ভাই আমাদের সহদেবদাকে নিয়ে নদীর পাড়ে বসি, ম্রিয়মান তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে, যেন সে ভেঙে না পড়ে, তাই তাকে আমরা কিছুদিন থেকে ছায়ার মতো রাখছি, আমরা কাশেম চাচার হাতে বানানো অপূর্ব চা-ডালপুরি খাই, সহদেবদাকে আশ্বাসে বিশ্বাসে চাঙা করতে চাই, কিন্তু তিনি উদাস চোখে নদীর বহমান জলের দিকে তাকিয়েই থাকেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে এক জগৎভাঙা ঔদাসীন্য নিয়ে বসে থাকি, নদীর যাত্রা দেখি সম্মুখ পানে, কিন্তু আমাদের আর কোনো সম্মুখযাত্রাই যেন নাই, কেননা পুষ্প আর জলেশ্বরীতে নাই। নদীর জলে সূর্য বিদায়ের রং প্রায় ধরো-ধরো, এখন বেগুনি, অচিরে লাল হয়ে উঠবে রক্তজবার মতো, লোকেরা কেউ বলবে কারবালায় হোসেনের রক্ত, কেউ বলবে পরশুরামের কুঠারে ছিন্ন তার মায়ের রক্ত, আমাদের কারও কারও মনে একাত্তরের রক্তও উঠে আসবে, কেননা আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মহীউদ্দিনের ছেলে শামসুদ্দিন আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেবে একাত্তরের তিরিশ লাখ শহীদের কথা; আমরা আকাশের দিকে তাকাই, জলের দিকে তাকাই, হঠাৎ একটি বিশাল ডানার পাখিকে জল ছুঁয়ে বোঁওঁওঁ করে উড়ে যেতে দেখি, জলে তার ডানা ভিজেছে কি ভেজে নাই এ আমাদের ক্ষণেকের রহস্য-বিষয় হয়ে থাকে; পরমুহূর্তেই আকাশটি অসংখ্য চোঁচ পাখিতে ছেয়ে যায়, ঝপাৎ করে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সহদেবদা নিজের জানুতে একটা চাপড় মেরে বলেন, যাহ্, একটা বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি এমন খেদ নিয়ে কথাটা বলেন, যেন মৃত্যুশয্যায় কেউ, তার চলে যাওয়া মানে জগৎ থেকে তার বিদায় নেওয়ার কথা বলছেন, বছরটাই যে মুমূর্ষু, সেটাও আমাদের কারও কারও কাছে মনে হয়। তবু একটা বছরের মৃত্যু হয় এবং আরেকটি বছরের জন্ম হয়, এভাবে আমরা চৈত্রের শেষ দিন ও বৈশাখের প্রথম দিনটিকে কখনোই কল্পনা করে উঠি নাই। আমরা বরং প্রবহমান একটি নদীর মতোই, আমাদের এই আধকোশার মতোই নিরবচ্ছিন্ন বহমান এক জলধারা রূপে তিরিশে চৈত্রের পয়লা বৈশাখে পৌঁছানোকে দেখে এসেছি; আমাদের স্মরণ হয়, আজ তিরিশে চৈত্র; আমাদের ভেতরে সঞ্চরণ জেগে ওঠে, আগামীকাল এই নদীতীরেই পূর্বমুখী হয়ে নতুন বছরটিকে গানে গানে আবাহন করে নেওয়া হবে; আমরা আমাদের নিজেদের মনোঘোরে পড়ে না থাকলে খুব পরিষ্কার করেই লক্ষ করতে পারতাম যে কিছুটা দূরে এখনই কয়েকজন যুবককে দেখা যাচ্ছে, কলেজের যুবক, শহরের প্রেমিক বয়সের উঠতি কিশোর, তারা পূর্বমুখী জায়গাটি রেকি করছে যে ঠিক কোথায় চৌকিটি পাতা হলে সরাসরি পুবের সূর্য ওঠার আলোটি চৌকির ওপরে বসা গায়কদের মুখে এসে পড়বে, তাদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে, আমরা দূর থেকেই তা অনুমান করতে পারি। কারণ, তারা বিতর্কটি হাত তুলে ও আঙুল তুলে তুলে পূর্বদিক দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছিল, যদিও কথা তাদের আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম না; আমাদের স্মরণ হয় গতবারের পয়লা বৈশাখের আগে চৈত্রের শেষ দিনে কি শেষ দিনেরই সন্ধ্যায় আমরা সহদেবদাসহ ওই পূর্বমুখী চৌকি পাতা শুরু করছিলাম, আমরা বলাবলি করছিলাম ঠিক কোন কোণটি নিরিখ করে বসলে ভোরের প্রথম অরুণ আলো তিরের মতো এসে পড়বে গায়কের মুখে এবং সেই তিরবৃষ্টিতে যেন গায়কেরই মুখমণ্ডল থেকে রক্ত নয়, সোনা ঝরতে থাকবে, আর সেই সোনাঝরা কথাগুলো সুরের ধাবনে নদী ও শহর, দিগন্ত ও গ্রামগুলোকে ভূমি থেকে স্বর্গপানে উড্ডীন করবে, ভবিষ্যৎকে নির্বিঘ্ন আসনে বসিয়ে বৃক্ষপত্র ও পুষ্পদল অর্চনা শুরু করে দেবে—‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুকে দাও উড়ায়ে,…’ পুষ্প, আমাদের পুষ্পই তো গাইবে বাংলার টিচার আমাদের শহরের এক মাননীয় কাকাবাবু জগমোহনবাবু; বছরে ওই একবার আর পঁচিশে বৈশাখে একবার জগমোহনবাবুর ডাক পড়ে গান গাওয়ার জন্য, রবীন্দ্রনাথের গান; টাউন হলের মঞ্চে তিনি পঁচিশে বৈশাখে হারমোনিয়াম ধরে চোখ বুজে হারমোনিয়ামের ওপর মাথাটিকে প্রায় ছুঁইয়ে গেয়ে চলেন—‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার, জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’— এটি তিনি একাই গান, কিন্তু পয়লা বৈশাখের ভোরে এসো হে বৈশাখটি যুগলে তিনি পরিবেশন করেন, তাঁর সঙ্গী কণ্ঠ সহদেবদার ছোট বোন পুষ্পর; সেই পুষ্প আর নাই, শহরে নাই, এবার নতুন বছর আসছে পুষ্প বিহনে। যখন পুষ্প ছিল, এই সেদিনও তো ছিল, মাত্রই দশ কি এগারো মাস আগেও সে জলেশ্বরীতে ছিল, আমরা তাকে ছোট বোন জানলেও আমাদের শরীরে একটা ঢেউয়ের ছলছলানি টের পেতাম পুষ্পর সাক্ষাতে, তার জন্য কিছু একটা করতে পারলে কি তুচ্ছ একটা ফাইফরমাশ খাটতে পারলে আমরা অনেকেই বড় আপ্লুত বোধ করতাম, বিশেষ করে আমাদের মধ্যে কম বয়সী হারুন মুস্তফা শফিরা তো পুষ্পর জন্য বুঝি প্রাণটাই দিতে তৈরি; অনুমান ভিত্তিহীন নয় যে পুষ্প ছিল অসামান্য রূপবতী; অমন রূপ লয়ে আমাদের শহরে ইদানীং আর কাউকে জন্ম নিতে দেখা যায় নাই; তবে পুষ্প যতটা রূপবতী ছিল তার অধিক ছিল লাজুক, ফলে কামনার চোখ তাকে আরও আকর্ষণীয় দেখতে পেত, কিন্তু ওই লাজুকতাটির জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরে বলেই তাকে মনে হতো; তারপরও পুষ্প যে পয়লা বৈশাখে নদীর পাড়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের চৌকিতে পূর্বমুখী হয়ে বসবে, ঠিক কতটা এগিয়ে-পিছিয়ে বসবে কি কতটা ডানে না বামে, জগমোনবাবুরই বা কোন পাশে তার আসনটি হবে, এ নিয়ে আমাদের তর্কটি তিরিশে চৈত্রের দুপুর রাত পর্যন্ত মীমাংসায় পৌঁছাত না; এই যে বছরটা আসছে, আসছে যে পুষ্প বিহনে, এর আগে পাঁচ-পাঁচটি পয়লা বৈশাখে আমাদের পুষ্প জগমোহনবাবুর সঙ্গে এসো হে বৈশাখ সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়েছিল। আমাদের স্মরণ হবে, একাত্তরে খোকা নামে সেই যুবক গায়ক, যাকে আমরা চোখে দেখি নাই কিন্তু যার কথা আমরা অনেক শুনেছি, সেই খোকা গাইত রবীন্দ্রসংগীত এবং পল্লিসংগীত, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আর একাত্তরের প্রথম মাসগুলোতে এই খোকাই ছিল জলেশ্বরীতে গণসংগীতের একমাত্র কণ্ঠ—সেই খোকা পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হওয়ার পর শহরে হয়তো গণসংগীত কি পল্লিগানের জন্য কণ্ঠ অনেকই পাওয়া গেছে বা হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে একটিও ভালো কণ্ঠ আসে নাই, ভালো কি ভালোমন্দ কোনো, কণ্ঠই জলেশ্বরীতে এ যাবৎ রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা দেখি নাই। এই কালে, বছর পাঁচ কি ছয় আগে, আমাদের শামসুদ্দিন ভাই বললেন, বর্ষবরণে এসো হে বৈশাখ গাওয়া চাই-ই চাই; কিন্তু কে গায়? কে গাইবে? তখন ইস্টিশন রোডে মিষ্টি দোকানের মালিক প্রৌঢ় হানিফ ভাইয়ের মনে পড়ে যে ইশকুলের বাংলা টিচার জগমোহনবাবু যখন যুবক ছিলেন, সেই পাকিস্তান আমলের কথা, কতকাল আগের কথা, তিনি গান জানতেন এবং রবীন্দ্রনাথের গানই তিনি গাইতেন; কিন্তু একাত্তরে সেই যে পাকিস্তানি মিলিটারি তাণ্ডব সৃষ্টি করল, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করে দেশটাকে শ্মশান করে তুলল, তখন জগমোহনবাবু সেই যে সস্ত্রীক সীমান্ত পেরিয়ে কুচবিহারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, পথে হস্তিবাড়িতে রাজাকারেরা যে তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যায়, আর তার সংবাদ পাওয়া যায় না, আমরাও বিস্তারিত আর কিছু শুনি নাই বা জগমোহনবাবু বলেন নাই, দেশ স্বাধীনের পরে তিনি যে আবার জলেশ্বরী ফিরে এলেন, আবার ইশকুলে ওই বাংলাই পড়াতে লাগলেন, গান আর গাইলেন না, কেউ তাঁকে আর গান গাইতে শুনল না, ক্রমেই হানিফ ভাইয়ের মতো পুরোনো দু-চারজন মানুষ ছাড়া আর কারও মনেও রইল না যে তিনি রবীন্দ্রসংগীত করতেন দূরের কথা, একদিন গাইতেন এবং গায়ক বলে শহরে তাঁর নাম ছিল। সেই জগমোহনবাবুকে গিয়ে ধরলেন আমাদের শামসুদ্দিন ভাই; একে শামসুদ্দিন ভাই কলেজের অধ্যাপক, অতএব ইশকুলের টিচার জগমোহনবাবুর চেয়ে পদমর্যাদাটি কিঞ্চিৎ অধিক, তারও পর অমন এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পুত্র শামসুদ্দিন, নষ্ট-ভ্রষ্ট কতিপয় কুলাঙ্গার ছাড়া সবাই তাঁকে মানে, গোনে; অতএব জগমোহনবাবু তাঁকে ফেরাতে পারলেন না, মিনমিন করে বললেন বটে, সে কবে গেয়েছি, কবে ভুলে গেছি, গলায় কী আর সুর আছে, বয়স হয়েছে, ইত্যাকার অনেক কিছুই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন পয়লা বৈশাখের ভোরে নদীর পাড়ে পূর্বাস্য হয়ে এসো হে বৈশাখ গাইতে। তারপরও একটা বিঘ্ন তিনি উপস্থিত করলেন, আমার হারমোনিয়াম নাই! তারও জোগাড় হলো। শামসুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন সহদেবদা। তিনি বললেন, আমার বোন পুষ্প গান করে, ইন্ডিয়া থেকে এক নম্বর হারমোনিয়াম তাকে আনিয়ে দিয়েছি, পাকড়াশি হারমোনিয়াম। আর কথা কী! হারমোনিয়ামের সঙ্গে লাজুক সেই রূপবতী মেয়েটিও এল; জগমোহনবাবু তাঁর চল্লিশ বছরের অনভ্যাসের গলা এত দিন পরে আবার খোলার আগে পুষ্পকে বলেন, তুমি একটু ধরো তো মা! নবীন কালের তোমার গলায় শুনি রবীন্দ্রনাথকে! শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন জগমোহনবাবু। সামনের পয়লা বৈশাখ উৎসব ভুলে তিনি ডেকে পাঠালেন পুষ্পর ভাইকে। ও সহদেব! এই আগুন তুমি লুকায়া রাখছ? এই পাখি তুমি খাঁচায় কম্বল ঢাকা দিয়া রাখছ? খুব তিরস্কার করলেন তিনি সহদেবকে। বললেন, আমাকে যদি গান করতে হয়, এসো হে বৈশাখ একা গাওয়ার গান না, পুষ্প আমার সঙ্গে গাইবে, আমরা দুজনে মিলে গাইব, নারী আর পুরুষ কণ্ঠ, অর্থাৎ কিনা নারী-পুরুষের একত্র আবাহন—এসো হে বৈশাখ! শুনেই সহদেবদা মাথা নাড়েন। বলেন, না, ওরে গান গাইতে কইয়েন না—তারপরেই চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে তিনি বলেন, মাস্টারমশায়, এই অনুরোধ রাখতে পারব না, আপনি বোঝেন তো সব! কথাটা শামসুদ্দিন ভাইয়ের কানে যায়; তিনি আমাদের বলেন, সহদেবকে দোষ দেওয়া যায় না, একে যুবতী মেয়ে, তদুপরি সুন্দরী, সুন্দরী মুসলমান যুবতী মেয়েরই দ্যাখো আজকাল কী হাল, তাকে নষ্ট করার তালে মানুষ ঘুরছে, আর এ তো হিন্দু ঘরের! সহদেবের ভয়টা আমি বুঝি। কিন্তু ভয়টাকে প্রশ্রয় দেওয়াও উচিত নয়। ভয়কে উপেক্ষা করেই ভয়কে জয় করতে হবে। পুষ্প গাইবে, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সে মঞ্চে আসবে, বসবে, গাইবে, বাকি আমি দেখব, তোরা দেখবি, কুনজরকে জয় যদি করতে না–ই পারিস তো দেশটাকেই দেশবিরোধীদের কুনজর আর ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাবি কী করে? আমাদের চৈতন্য ফেরে; আমাদের নিজেদের কারও কারও মনে পুষ্পকে নিয়ে কিছু কল্পনা-টল্পনা থাকলে তা কবরচাপা দিই; আমরা বুক চিতিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে দিই। রোজ একবার করে জগমোহনবাবুর বাড়ি যাই, সেই টিনের চালে লাল মোরগফুলে ছাওয়া তাঁর বাড়িটি, বাড়ি এখন নির্জন পুরী, মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী রাজাকারদের হাতে পড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর—মাস্টারমশাই আজও স্ত্রীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নাই। তিনি বলেন নিখোঁজ নিরুদ্দেশ—আমাদের বুক ভেঙে যায়—এ বাড়ি শ্মশানপুরী। তিনি বলেন গীতাকে তো চিতায় দিতে পারি নাই, বাড়িটাকেই চিতা বানায়া নিয়েছি! আমরা এখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে সন্ধ্যার আবছা আড়াল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাস্টারমশাই ও পুষ্পর যুগল মহড়া শুনি—যাক পুরোনো স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক। মাস্টারমশাই ফিরে ফিরে এই পদটি গান আর পুষ্পকে ঘন ঘন বলেন, আরও মন দিয়ে, একেবারে মনের ভেতর থেকে গাও তো, মা! আমাদের জয়নাল আবার মানুষের আবেগ অনেক বেশি বোঝে, অনেকটা তল অবধি যেতে পারে। সে বলে, দ্যাখ, ওই যে পুরোনো স্মৃতি, ওই যে ভুলে যাওয়া গীতি, ও কি শুধু বছরের? না, ব্যক্তিজীবনেরও? ওই যে অশ্রুবাষ্প মুছে যাওয়ার কথা, একবার চিন্তা করে দ্যাখ মাস্টারমশাইয়ের অশ্রুবাষ্প সেই কবেকার আর কতটাই! আমরা সরে আসি জগমোহনবাবুর ঘর, মোরগফুলে ছাওয়া ঘরের পাশ থেকে, নেমে পড়ি সড়কে; কিন্তু অধিক কাল স্থায়ী হয় না জয়নালের কথায় আমাদের মনের বাষ্প বা কান্নার সম্ভাবনা। আমরা নতুন বছরের অপেক্ষায় বছরের শেষ দিনটিতে খুবই হুল্লোড়প্রবণ হয়ে উঠি, অধিক রাত অবধি পথে পথে হররা ছুটিয়ে বেড়াই, রক্তরাঙা চোখে ভোরের অনেক আগেই নদীর পাড়ে জমায়েত হই, পুষ্পর প্রতীক্ষা করি, মাস্টারমশাই একটু পরেই আসবেন, সহদেবদা হারমোনিয়ামটি আনছেন, তাঁর পেছনে অজয় ছোকরা আনছে তবলার বাঁয়া ডাইনা জোড়া, তবলা বাজাবেন আর কে? সহদেবদা! এই করে করেই আজ পাঁচ বছর, পাঁচ-পাঁচটা বছর জলেশ্বরীতে আমরা পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করেছি। ছায়ানটের মতো নাম নাই আমাদের, কিন্তু বাংলার জন্য, বাঙালির জন্য ছায়ানটের চেয়ে কিছু কম ভালোবাসা আমাদের মোটেই নয়! আমরা গ্রামবাংলায় থাকি, কে আমাদের খবর রাখে! কিন্তু দুঃখ কিসের! আমরা যে পয়লা বৈশাখে নদীর পাড়ে ওই অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরি, মাস্টারমশাইকে নিয়ে পুষ্পকে নিয়ে সহদেবদা যে অর্জুনের দোকানে যাই, জিলিপি হুল্লোড় করে জিলিপি বাতাসা কদমা খেতে, এতে যে আত্মার স্নান আমরা অনুভব করে উঠি, তা যে কোনো তীর্থজল গাহনের চেয়েও স্নিগ্ধ ও পাপতাপহর। কিন্তু স্নিগ্ধতা আর পাপতাপহরণের অনুভবটা মনেরই, নয়কি? অনুভব করলেই অনুভব, না করলে নয়। সহদেবদা এবার পুজোয় গেলেন কুচবিহারের দীনহাটায় মামাবাড়িতে, মামারা সেই কবে পঁয়ষট্টি সালে ইন্ডিয়া চলে গেছেন দেশ ছেড়ে, সহদেবদা পুজোয় গেলেন বোন পুষ্পকে নিয়ে; গেলেন দুজনে, দুই ভাইবোন, ফিরে এলেন একা। মামারা পুষ্পকে জোর করে রেখে দিয়েছে ইন্ডিয়ায়।—তুই কস কী, সদেব! হিন্দুর মাইয়া! বাংলাদ্যাশে ছিঁড়াখুইড়া খাইব! সহদেবদা বলেন, দেশে কি শুধু মন্দ মানুষই থাকে? ভালো মানুষও আছে!—রাখ তর ভালা মানুষ! পুষ্পরে দিমু না! নারীর সেই চিরকালের ভয়—ধর্ষিত হওয়ার, এর হিন্দু-মুসলমান নাই, নারীর রক্তেই এটা সেই আদিম কাল থেকে; অতএব, মামাদের কথায় পুষ্প নরম হয়ে পড়ে, মামিদের শঙ্কার কথা শুনতে শুনতে ভীত হয়ে পড়ে, সে বলে, দাদা, তুমি যাও, আমি থাকি যাব। একা ফিরে আসেন সহদেবদা, পুষ্প বিহনে তাঁর বাড়িটিও শ্মশানপুরী হয়ে ওঠে, বউদিও ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে সহদেবদাকে তাড়না করতে থাকে, সহদেবদা বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ান; না, এই দ্যাশ ছাড়ি মুই যাবার নঁও! উচ্চারণ করেন না তিনি মুখে, আমরা অন্তরের ভেতরে তাঁর এই কথা শুনতে পাই; আমরা শোকগ্রস্ত হয়ে থাকি—পুষ্প আর নাই; পুষ্প নাই তো সংগীত নাই; পুষ্প নাই তো উৎসব নাই; নারীর খোঁপায় বিলাস নাই, মন্দিরে দেবী পায়ে শোভা নাই, ইতিহাস বইয়ের পাতায় তবে শাহজাহান বাদশার চিত্রে তাঁর হাতে ধরা পুষ্পটিও নাই; ছবিতে পুষ্প ছবি হয়ে থাকলেও তার ঘ্রাণ নাই; আমাদের পুষ্পও ছবি হয়ে আমাদের মনের মধ্যে কিন্তু তার সাক্ষাতে যে মৃদু সুবাসিত উপস্থিতি রচিত হতো, তা আর নাই; এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে পুষ্প আর গাইবে না মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, এসো হে বৈশাখ! আমরা নদীর পাড় থেকে সড়কে নামি। সড়কের পাশে নাবাল জমিতে মেলা জমবে কাল সকালে, নাগরদোলাটি এর মধ্যেই বসানো হয়ে গেছে, তারাভরা আকাশের দিকে উঁচু হয়ে নাগরদোলার রঙিন বাকসোগুলো দুলছে। আমরা পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাগরদোলার শব্দ পাই, বাজিকরেরা চাকায় তেল দিয়ে চক্কর ঘুরিয়ে পরীক্ষা করছে, শব্দ উঠছে কোঁও কোঁও ওঁওঁওঁ কেঁ। করুণ বিষাদে যেন কেউ অব্যয়ধ্বনি রচনা করে চলেছে, কিন্তু ভাষা এখনো ফোটে নাই বা পায় নাই। অচিরে আমরা জগমোহনবাবুর সেই লাল মোরগফুল ছাওয়া টিনের বাড়িটির পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনি তিনি গলা সাধছেন, এসো হে, বৈশাখের রবীন্দ্রবাণী নয়, কেবল সুরটাই; আমাদের মনে পড়ে, আমরা যেন মিলিয়ে দেখে উঠি বা শুনে উঠি ঈষৎ আগেই শোনা নাগরদোলার কোঁ কোঁ কোঁওঁওঁওঁ। সুরটি বাণী ধরে উঠত যদি পুষ্প থাকত। পুষ্প নাই। নাগরদোলাটি ঘুরেই চলেছে। কালের অসীম অতল সমুদ্রে যে সূর্য অস্ত যায়, পরদিন সে উঠে আসে সোনার মুকুট পরে; মানুষ যে চলে যায়, তারা আর ফেরে বলে আমাদের জানা নাই। পুষ্প বিহনে পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয় আমাদের প্রত্যেকের মনে এক ব্যক্তিগত গোপন সূর্যাস্ত হয়ে থাকে হোসেনের কারবালা, কি বাংলাদেশের একাত্তরের, কি পরশুরামের জননীহত্যার কুঠারের রক্ত লয়ে।