কয়েক কাপ চায়ের গল্প

ছোটবেলায় আম্মাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ছিল খুবই একটা আনন্দের ব্যাপার। রিকশায় যেতে হলে তো কথাই নেই। রংপুরের রিকশাগুলো ঢাকার রিকশার মতো খাড়া নয়। যাত্রীর পায়ের কাছে বিস্তর জায়গা। সেখানে পিঁড়ি পেতে আম্মাদের পায়ের কাছে বসে বেড়াতে গেছি কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায়, বেশ মনে পড়ে। সেই বেড়াতে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিল চা-নাশতা। চা জিনিসটা অবশ্য বড়দের জন্য বরাদ্দ ছিল, ছোটদের জন্য নাশতা। হয়তো সেমাই রেঁধে দিলেন কেউ, কেউবা দুটো বিস্কুট আর এক পিরিচ চানাচুর। সেই আমাদের কাছে ছিল অমৃত। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎই কোনো বাড়িতে গেলে দেখা গেল, ছোটদের জন্যও চা বরাদ্দ হয়েছে, জনপ্রতি এক কাপ। গা মুড়িয়ে হাত মুচড়ে বলতাম, আমি চা খাই না। কেন বাবু, আজকে খাও, বানানো হয়েছে তো তোমার জন্য, নষ্ট হবে। সেই চা খেতে গেলে অনিবার্যভাবেই জিভ পুড়ে যেত। তারপর কখন যে বড় হয়ে গেলাম, নিয়মিত এক কাপ করে চা সকালে বরাদ্দ হলো, সেইটা আর মনে করতে পারি না। বুয়েটে পড়ার জন্য ঢাকা আসি ১৮ বছর বয়সে, তখন যে নিয়মিতই চা খেতাম, সেটা স্পষ্ট মনে আছে।
তখন চায়ে দুধ-চিনি বেশি হলেই ভাবতাম এটা ভালো চা। এখন চায়ে দুধ কিংবা চিনি কিছুই খাই না, গরম পানিতে একটুখানি চাপাতা, কিংবা একটা টি-ব্যাগ। আগে চা খেতাম খুব গরম, একটু ঠাণ্ডা হলেই পেট গুলে উঠত, এখন একটুখানি ঠাণ্ডা হলে তারপর মুখ দিই, একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও খেতে মন্দ লাগে না। আশ্চর্য তো, চা-বিহীন একটা দিনও বুঝি আজকাল আর যায় না। সারাদিনে এক কাপও চা খাইনি, চা না হয় কফি, এ-রকম বোধ হয় গত বিশ বছরে হয়নি।
এক কাপ চা আমার নাক বাঁচিয়েছিল একবার, সেই গল্পটা করি। আমার নাক আর কবি ফরিদ কবিরের নাক।
সে অনেকদিন আগের কথা। আমরা তখন কাজ করি ভোরের কাগজে। নেত্রকোনা থেকে আমন্ত্রণ এলো। কবি হেলাল হাফিজের সংবর্ধনা ও পৌষমেলা। আমরা ঢাকা থেকে যাব। অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলা মাইক্রোবাসে রওনা হলাম ভোরের কাগজের বাংলামোটর অফিস থেকে। বিকেল নাগাদ পেঁৗছে গেলাম নেত্রকোনায়। সার্কিট হাউসে একটু জিরিয়ে নিয়ে চলে গেলাম পৌষমেলা প্রাঙ্গণে। কথা ছিল, অনুষ্ঠান শেষে একই মাইক্রোবাসে আমরা ফিরব। যথারীতি অনুষ্ঠান শেষে মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বলা হলো, রাতে সার্কিট হাউসে থাকুন। পরের দিন ভোরবেলার প্রথম বাসে আপনাদের তুলে দেওয়া হবে।
মহাদুশ্চিন্তার ব্যাপার। পরের দিন ফরিদ কবির ভাই আর আমি_ আমাদের দু’জনকেই অফিস করতে হবে। বাসায় বলেও এসেছি রাতেই ফিরব। যাই হোক, রাতটা নেত্রকোনায় কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির। প্রথম বাসেই আমরা উঠব। বাসটা স্টার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা বাসস্ট্যান্ডে দেখি, একটা চায়ের দোকানে কেৎলিতে পানি ফুটছে। একটু পর চা হবে। ফরিদ কবির বললেন, চা খেয়েই যাই, কি বলো।
আমি বললাম, অবশ্যই।
চায়ের দোকানি বলল, পানি ফুটতে টাইম লাগবে। চা খাইতে হইলে আপনাগো পরের ট্রিপ ধরতে হইব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ১০ মিনিট পরেই আরেকটা বাস ছাড়বে।
পৌষমেলার সময় মানে ঘোরতর পৌষ মাস। হাড় কাঁপানো বাতাস বইছে। আর খুব ঘন কুয়াশা। ১০ মিনিট পরের বাসে উঠলেই যদি এক কাপ গরম চা পাওয়া যায়, তাহলে সেই ভালো। আমরা পরের বাসেই যাব।
ফার্স্ট ট্রিপের বাস নেত্রকোনা ছাড়ল। আমরা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কেৎলিতে চায়ের পাতা ছাড়া হলো। আহ, কী সুগন্ধ!
চা খেয়ে ১০ মিনিট পরের বাসে উঠে আমরা রওনা দিলাম। কুয়াশা আর অন্ধকার চিরে বাস চলেছে। আমাদের বাসের সব যাত্রীই প্রায় ঘুমিয়ে পড়লেন।
একটু পরে আমাদের বাস একটা জায়গায় থামল। কী ব্যাপার। আমাদের আগের বাসটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওই বাস নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেছে।
ব্যাপারটা কী দেখার জন্য আমরা বাস থেকে নামলাম। ঘটনা যা জানতে পারলাম, তা হলো, ঘন কুয়াশার মধ্যে আমাদের আগের বাসটা একটা ধীরগামী ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিয়েছিল।
আর সব ঘুমন্ত যাত্রী সামনের সিটে ধাক্কা খেয়েছে এবং সবার নাক কাটা গেছে।
আমি আর ফরিদ ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আগের বাসটা থেকে লোক নামছে, তাদের প্রত্যেকের নাক কাটা।
আর চা একবার আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল।
ঘটনাটা আমি যখন বুয়েটে পড়ি, তখনকার। আমি, তৌকীর আহমেদ, রম্যরহিম চৌধুরী_ আমরা বুয়েটের শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তৌকীর মানে অভিনেতা তৌকীর। সঙ্গে হয়তো শাকুর মজিদ ছিলেন, হয়তো নবি্বর নামে ওদের আরেকজন বন্ধু ছিলেন।
আড্ডা দিতে দিতে আমরা বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনের রাস্তার মধ্যখানে একটা ট্রাফিক পোস্ট ছিল, সেটার ওপরে উঠে বসলাম।
তৌকীর তখন সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য-উপন্যাস থেকে পড়ে শোনাচ্ছে। চোখ ভেসে যায়, চোখ ভিজে যায়, মানুষের চোখ… অন্তর্গত কাব্য-উপন্যাসটা ওর মুখস্থই ছিল প্রায়।
অনেক রাত। দুটো বোধ হয় হবে। আমাদের চায়ের তেষ্টা পেল। বুয়েটের ক্যান্টিন সব বন্ধ হয়ে গেছে। মেডিকেল হোস্টেলের চায়ের দোকান মেলা রাত খোলা থাকে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে মেডিকেল ক্যান্টিনে গেলাম। চা খেয়ে ফিরে আসছি। সেই ট্রাফিক আইল্যান্ডটার সামনে দিয়েই। এসে দেখি, আইল্যান্ডটা আর নাই। একটা দ্রুতগামী ট্রাক পুরো আইল্যান্ডটাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এক কাপ চা আমাদের জীবন রক্ষা করল। রাখে আল্লাহ, মারে কে?
কবিদের চা খাওয়ার গল্প কিছু বলি। আমি যখন ছাত্র, তখন আমাদের কৃষি কলেজে পড়া বন্ধু এজাজ আল মামুনের সঙ্গে আমি যেতাম দৈনিক দেশ অফিসে। সাহিত্য পাতা দেখতেন কবি হেলাল হাফিজ। তার সামনে কবিতা নিয়ে গেলে তিনি বলতেন, বসো। চা খাবে। আমরা মাথা নাড়তাম। খাব। চা খাওয়া মানে খানিকটা সময় তার সামনে বসার সুযোগ পাওয়া। একটুখানি গল্প-গুজব করা। ওই সময় হেলাল হাফিজ ভাই আমার জীবনের একটা বড় উপকার করেছিলেন। আমি আগে লিখতাম আনিসুল হক মিটুন নামে। তারপর মনে হলো, এই নাম ঠিক কবিজনোচিত নয়। তখন ঠিক করলাম, আমার নাম হবে আনিস মিটুন। হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সামনে কবিতা রাখলাম। হেলাল ভাই বললেন, এটা কী করলে। নাম বদলালে কেন? আমি বললাম, মিটুন ছাড়তে পারব না। ওই নামে সবাই আমাকে চেনে।
তিনি বললেন, শোনো, তোমার খুব সুন্দর একটা নাম আছে। আনিসুল হক। তুমি এই নামে লেখো। আমি বললাম, জি আচ্ছা।
সেই থেকে আমি আনিসুল হক নামে লিখি। নামটা খুব সাধারণ, কিন্তু ভদ্রগোছের। হেলাল হাফিজ ভাইয়ের মুখে ‘তোমার খুব সুন্দর একটা নাম আছে, আনিসুল হক,’ কথাটা এখনও আমার কানে বাজে। ভাগ্যিস, আমি তার সামনে এক কাপ চা খেতে বসেছিলাম। তাই তো আনিসুল হক নামটা আমার লেখক নাম হতে পেরেছে।
এখন যে গল্পটা বলব, তা কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ তখন তরুণ। নেত্রকোনায় গ্রামে থাকেন। ঢাকায় এসেছেন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কক্ষে। কবিতা জমা দিতে। কবি আহসান হাবীব নির্মলেন্দু গুণের সামনেই চা খেলেন এক কাপ। একটু পরে পিয়নকে ডেকে বললেন, এই তোমাকে যে চা দিতে বলেছি, দাওনি কেন। পিয়ন বলল, স্যার, একটু আগেই তো চা খাইলেন। কবি আহসান হাবীব কিছুতেই সেই কথা বিশ্বাস করেন না। বলেন, না আমি কখন চা খেলাম। নির্মলেন্দু গুণ বুঝতে পারলেন, কবিদের ভুলোমনা হতে হয়। ভুলে যাওয়া হলো কবিদের অধিকার। কবি হতে চাইলে ভুলে যেতে পারতে হবে।
তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। একদিন নৈশভোজের পরে ঘুমোতে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। মাকে আর বোনকে ডেকে বললেন, এই তোরা তো আমাকে রাতের খাবার দিলি না।
বোন বলল, দাদা, একটু আগে না ভাত খাইলা?
নির্মলেন্দু গুণ বললেন, কখন?
মা কাঁদতে লাগলেন। ছেলের কী হলো? সে কেন পাগলামো করছে।
তখন বোন বললেন, আমি বুঝতে পারছি। দাদা কবি হইতে চায়। আমারে দাদা কইছে ঢাকায় গিয়া দেখছে কবি আহসান হাবীব চা খাইয়া সেইটা ভুইলা গেছল।
কবি শামসুর রাহমানের বাসায় গেলে তিনি জিগ্যেস করতেন, চা খাবেন। কখনও বলতাম ‘খাব’, কখনও বলতাম ‘না’। না বললে রাহমান ভাই জোরাজুরি করতেন না। হ্যাঁ বললে চা-বিস্কুট আসত। তিনি নিজে থেকে গল্প করতেন না। আমিই পুটুরপুটুর করে গল্প করতাম। একদিন বললাম, রবীন্দ্রনাথের গানের এই লাইনটা কেমন দেখুন, ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে… অপূর্ব ইমেজ না? তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি মনে রাখতে পারেন কী করে, আমার তো কিছুই মনে থাকে না। জীবনানন্দ দাশের ওপরে লেখা ক্লিনটন বি সিলির এ পোয়েট অ্যাপার্ট বইটা তাকে উপহার দিয়েছিলাম।
আমার একটা শখ আছে। যেহেতু দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই, তাই বিভিন্ন ধরনের চায়ের পাতা আমি সংগ্রহ করি আর চা খাই। দার্জিলিং টি আমার খুব প্রিয়। কী যে একটা গন্ধ আসে এই পাতা থেকে। আরেকটা কাজ আমি করি, পুদিনা পাতা কিনে এনে ঘরে রাখি। চায়ের কাপে একটা পুদিনা পাতা ফেলে দিলে অপূর্ব একটা স্বাদ হয়। জেসমিন টিও আমার পছন্দ। তুলসী চাও।
কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো চা আমি খেয়েছি অস্ট্রেলিয়ায়। ক্যানবেরায়। সিডনি থেকে সকালবেলা রওনা হয়েছি ক্যানবেরায়। বিকেলে বাংলাদেশ হাইকমিশনে একটা অনুষ্ঠান করলাম। তারপর আমরা গেলাম জিন-বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর বাসায়। রাতের খাওয়া হলো তাঁর বাসাতেই। খাওয়ার পরে ভাবি আমাদের চা দিলেন।
সেই চায়ের কী অপূর্ব গন্ধ, অপূর্ব স্বাদ।
আমি ভাবিকে বললাম, এটা আমার জীবনে খাওয়া সেরা চা।
তিনি বললেন, এই চায়ের পাতা কোত্থেকে এনেছি, জানেন?
আমি বললাম, কোত্থেকে।
তিনি বললেন, সিলেট থেকে।
আমি বললাম, সিলেটে এত সুগন্ধী চা পাতা হয়?
তিনি বললেন, হয়। দেশের মার্কেটে দেওয়া হয় না। বিদেশে চলে আসে। আমি বাগান থেকে নিয়ে এসেছি।

আমি জানি, পৃথিবীর সেরা সব কিছুই বাংলাদেশে আছে। আমাদের দেশটা আসলেই একটা সোনার দেশ।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আনিসুল হক- র আরো পোষ্ট দেখুন