একতারাটার মনের কথা

আশেপাশে যারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, তারা চমকে তাকালো। ঝন্ ন্ ন শব্দ করে ছিটকে পড়েছে একটা একতারার মতন জিনিস। ও, খেলনের জিনিষ! পোলাপানের কাম হইবো। দারোয়ান চাচা এসে ভাঙ্গাচোরা টুকরোগুলো কুড়িয়ে তুললো। ঠিক এই মুহূর্তে কানে এলো, কে যেন দৌড়ে আসছে। কেন এলো কারো কচিগলার আওয়াজ দারোয়ান চাচা, দারোয়ান চাচা… ওগুলো আমার … আমাকে দেন।
ও! তয় লইয়া যান বাবু! পড়লো ক্যামনে উপরের থন?
খেলানাটার কয়েকটা খ- দু’হাতে অাঁকড়ে ধরে ছোটো দোলন। চোখের কোলে কান্নার দাগ স্পষ্ট। ধরা গলায় কিছু বলার চেষ্টায় তার গলার আওয়াজ ভাঙা ভাঙা কোনায় এমনি। ধাপ ধাপ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় দোলন।
বাচ্চা মানুষ! শখের খেলনা ভাইঙ্গা গেছে তয় কানবো না? নিশ্চয় কানবো। মাথার টুপিটা ঠিক করে বসাতে বসাতে আপন মনে বলে দারোয়ান ভাই।
ব্যাপারটা আদতে শুরু হয়, ফলে শিল্পকলা একাডেমীর মেলা থেকে চমৎকার একতারাটা কিনে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলেন দোলন। কিন্তু ছুটির দিনে ওটা বাজাতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। কোনোমতেই মনের মতো সুর বাজাতে পারছে না দোলন। কিন্তু কিনেছে তোমারই মতন একটা বাচ্চা দোকানির কাছ থেকে। সে যখন বাজাচ্ছিলো, তখন রীতিমত ভিড় জমে গিয়েছিলো। ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ বাংলাদেশের মাটি আমার সোনার চাইয়া খাঁটি…।’ কি সুন্দর হাত ছেলেটির। ৭/৮ বছর বয়স হলে কি হবে, একেবারে পাকা হাত। পাশেই বসে ছিলো তার বাবা। কেউ কেউ জানতে চাইলে- এত সোন্দর বাজাইতে শিখলা কোথায়?
বাজানের কাছে। বাজান খুব ভালো বাজায়। বাবার কাছে সব দেশি গানের সুর তুলেছে সে। পথের পাশে বাজিয়ে রোজগার, সামান্য হলেও মন্দ নয়।
‘নাও ভাসাইয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’ এসব সুর শুনে দোলন দারুণ মুগ্ধ। ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে বললো- আচ্ছা, আমি কি এটা বাজাতে পারবো?
হ… আ… খুব সোজা। আসেন, আমি আপনেরে দেহাইয়া দেই। দোলন দিব্যি টুংটাং শব্দ নিজের কৃতিত্বে নিজেই খুশি হয়ে উঠলো।
শখ করেছো বাবা, কিনে দিচ্ছি। কিন্তু বাজনা যে কি বাজাবে, তা জানি না। লেখাপড়া রয়েছে না? বললেন তার আব্বা।
দোলনের ছোট্টো খেলার ঘরে একটা আলমারিতে সাজানো আছে হরেক রকমের খেলনা, সারি সারি বই, স্ট্যাম্প এর অ্যালবাম। নতুন কোনো জিনিস পেলে সেগুলো গুছিয়ে দেন আম্মু। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলনা, রোবট আর মেকানো, রুবিক কিউব নিয়ে সময় কাটায় দোলন। বারান্দায় বাস্কেট বলের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে আব্বু। বন্ধুদের সঙ্গে, এমনকি আব্বু আম্মুর সঙ্গেও বাস্কেট বল নিয়ে খেলে দোলন।
কিন্তু এখন যে মহা মুস্কিল ঘটছে প্রতিদিন। সাধের একতারাটা যে মোটেই দোয়েলের কাছে ধরা দিচ্ছে না। খেলনা গিটার নিয়ে সুন্দর বাজনা বাজাতে পারে দোলন। আশা ছিলো, একতারার বেলায়ও পারবে সে। কিন্তু না। সামনে আসছে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি। দোয়েল তার ইস্কুলের নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সবাইকে অবাক করে দেবে বলেই তো ভেবেছিলো দোয়েল। তবে কি ছেলেটা তাকে ভুল বলেছে? মনটা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে দোলনের।
ঘর গোছাতে এসে ভারী বিরক্ত হয়ে গেলেন আম্মা। কি নিয়ে এত মেতে উঠলো ছেলেটা? পড়াশোনাও ঠিকমতো করছে না। দোলন স্কুলে চলে গেলে তার ঘর গোছাতে ঢুকে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সব কিছুতে ধুলো ভর্তি। হু ছেলেটা তা হলে সব নিয়ম মানছে না। ওদিকে আবার চেয়ারের ওপরে যত্ন করে সাজানো রয়েছে তার সাধের একতারা যা মোটেও সুর তুলছে না। ‘আচ্ছা, এই বিদঘুটে যন্ত্রটাকেই তাড়াতে হবে। নইলে ওর লেখাপড়ারও ক্ষতি হয়ে যাবে।’ ভাবলেন মা।
পরদিন স্কুল ছুটি। আর ছুটির দিনটায় ভারী একটা গোলমাল বেধে উঠলো আব্বা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন,-না; আর এই বিড়ালের ডাক সহ্য হয় না। গলা তুলে ডাক দিলেন- দোলন, দোলন, …. কোথায় তুমি?
জ্বী আব্বু… ডাকছো? দৌড়ে এলো দোলন।
সারাদিন ওই ঘ্যান ঘ্যানে বাজনা নিয়ে কি করো তুমি? শুনতেও তো বিশ্রী লাগছে!
আব্বু, আমি তো শিখতে চেষ্টা করছি। বললো দোলন।
সব জিনিস সবাইকে পারতে হবে, এমন কোনো কথা আছে? ওটা সরিয়ে রাখো। শিখতে হবে না।
না আব্বু, আমি শিখবো। জোর দিয়ে বললো, দোলন। বাবা ভ্রু কুচকে বললেন, একতারা যন্ত্রটা সবার জন্য নয় দোলন। পড়ালেখাটা বেশি জরুরি। যাও। আমার কথা শোনো। কিন্তু কি যে হলো! দুষ্টু ছাগল ছানার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দোলন বললো- না, আমি শিখবোই?
আবার মুখে মুখে কথা। এগিয়ে এসে জোরে ছেলের হাত থেকে একতারাটা কেড়ে নিল তার আব্বু। তারপর, কেউ কিছু ভাববার আগেই ছুড়ে ফেলে দিলো বারান্দা থেকে। চারতলা থেকে পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল যন্ত্রটা। দোলন চোখ বড় বড় করে দেখলো, তারপর কেঁদে উঠে দৌড় দিলো সিঁড়ি ধরে।
ভাঙা টুকরোগুলো কোলের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো দোলন। বিছানায় শুয়ে রইলো সারাদিন। মা বললেন- এরকম করলে কেন তুমি? ছেলেটার মন ভেঙে দিয়েছো। বুঝিয়ে বললে…
বুঝিয়ে বললে? রূঢ়ভাবে বললেন দোলনের বাবা। ইস্কুল আছে। ওর ভবিষ্যৎ আছে। এসব নিয়ে মেতে থাকা চলবে না। তার চেয়ে কাদুক দু’দিন। পরে নিজেই বুঝবে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন- অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিওনা। একতারা এখন শখ নয়, অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতসব উদ্ভট কা-!
ইস্কুল থেকে ফেরার জন্য দোলনদের বাস আছে। সেই বাস থেকে কোন ফাঁকে নেমে দোলন গুটি গুটি হাঁটা দিলো শিল্পকলা একাডেমীর দিকে। ছেলেটা বলেছিলো, ওরা ওই খানেই একটা ঘরে থাকে। ছোটো চা এর দোকানিকে ট্রাফিক পুলিশকে, রাস্তার ধারের চুড়িওয়ালিকে, সবাইকে ডেকে ডেকে জানতে চাইলো দোলন- এখানে একতারা বাজায় রইস নামের ছেলে আর তার আব্বু ওরা কোথায় থাকে বলতে পারেন?
এত বড় একটা শহরে কোথায় হারিয়ে গেছে সেই ছোট্ট ছেলেটি, যে বাবার হাত ধরে পথে পথে ঘোরে আর একতারা বাজিয়ে শোনায়, তাকে কে মনে রাখে? কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু দোলনের যে তাকে খুব দরকার। তাকে জানতে হবে, তার হাতে একতারায় গান বাজেনা কেন? আব্বু কেন তার শখের বাজনা ভেঙে দিলো? এসব জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পথ হারানো দোলনের ভীষণ, ভীষণ খারাপ লাগছিলো। এক সময় দেখলো, ইস্কুল ইউনিফর্ম পরা দোলনকে এলোমেলো পায়ে ঘুরতে দেখে এগিয়ে আসছে ট্রাফিক পুলিশ।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো দোলনের বাবার। দোলনকে বাসায় ফিরতে না দেখে দু’জনে যখন পুলিশের কাছে যাচ্ছিলেন তখন ফোন এল। মা, বাবা দু’জনেই ছুটে গেলেন স্কুলে। গিয়ে দেখেন, প্রিন্সিপালের ঘরে সোফায় শুয়ে আছে দোলন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল। পাগলের মতো ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো আব্বু- বাবা, দোলন, তুই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বাবা? কেমন করে, … কি জন্য।
আব্বু, … আমাকে মেরো না। দু’হাতে মার ঠেকানোর জন্য হাত দুটো দিয়ে মুখ আড়াল করলো দোলন।
মারবো কেন? তোকে কি কখনও মেরেছি? দুঃখে বাবার গলা ভেঙে এলো।
তুমি আমার একতারাকে মেরেছো! তুমি আমার গানের সাথীকে মেরেছো… ভেঙে ফেলেছো… ও প্রলাপ বকছে। ওর যে কত খেলনা, বন্ধু, সাথী, তার হিসেব নেই। বললেন মা। ও তো হারমনি, কীও বাজাতে পারে। শুধু একটা একতারার জন্য এত কা-।
আপনারা ভুল করছেন। ওর মনটা বোঝার চেষ্টা করেননি। বললেন প্রিন্সিপাল।
ভাগ্যিস ট্রাফিক পুলিশ ওর ড্রেস দেখে, ব্যাগ খুলে ফোন নাম্বার খুঁজে স্কুলে জানিয়েছিলেন, তাতেই আমরা গিয়ে ওকে ইস্কুলে নিয়ে আসি। তবু ভালো যে আমরা সাহায্য করতে পারলাম। নইলে কি হোতো, কে জানে। ছেলে তো আপনার লক্ষ্মী ছেলে। এখন বাড়ি নিয়ে যান। শিউরে উঠে চোখ মুছলেন দোলনের মা।
একতারার এক শিল্পীকে খোঁজখবর করে ধরে আনলেন দোলনের বাবা। অবাক কা- ছেলেটা যেন কেন বোবট পুতুল, বাস্কেট বল, ব্যান্ডমিন্টন র‌্যাকেট, কোনো কিছু ছুঁয়েও দেখছে না। মন দিয়ে কেবল অঙ্কই করছে। চুপচাপ নিয়ম মেনে চলছে। তবে আব্বার সঙ্গে দু’একটার বেশি কথাও বলে না দোলন। সেদিন বিকালে বারান্দায় বসে কি যেন ভাবছিল সে। আশ্চর্য, রইস কি তাকে মিথ্যে বলেছিলো? কিন্তু ও যখন একতারাটা বাজিয়ে দেখালো, তখন তো খুব সুন্দর বেজেছিলো। দোলনকে আব্বা আর আম্মা ছেলেবেলা থেকে শিখিয়েছেন, মিথ্যা কথা বলা চলবে না কোনোমতেই। এসব নিয়েই দোলন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠে। একতারার ভাঙা টুকরোগুলো ফেলে দেবো। মনে মনে ঠিক করে দোলন।
দোলন কি করছিস বাবা? দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দেন আব্বু। দোলন ফিরে তাকায়। তারপর এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।
আমার? আব্বু? আব্বার হাতে একটা নতুন একতারা যেন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
হ্যারে বোকা ছেলে, তোরই তো।
কিন্তু আমি কিছু পারি না। ফেলে দাও ওটা।
আমার সঙ্গে আয়। বসবার ঘরে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ। তার কাছে নিয়ে গিয়ে আব্বা বলে, এই যে ওস্তাদ, আপনার সাগরেদ।
তিনি হাসি মুখে তাকালেন। তারপর দোলনের হাতটি মুঠোয় ধরে জোরে চাপ দিলেন। হেসে বললেন- এও তো একটা লড়াই।
লড়াই? কিসের। অবাক চোখে তাকায় দোলন। একুশের ফাল্গুনে ভাষার লড়াইটা যেমন ছিলো, ঠিক তেমনই বুঝেছ দাদু? নাও এবার একতারাটা ধরো দেখি? দোলনের মনটা সুখে ভরে গেল। কি চমৎকার এই দাদু।
একুশের মঞ্চে ওই যে ছোট্টো ছেলেটা একতারা বাজাচ্ছে না? ওটাই আমার ছেলে দোলন। বললো দোলনের গর্বিত বাবা।
কি সুন্দর বাজাচ্ছে। শিখলো কেমন করে? জানতে চান শ্রোতা। সেটা একটা যুদ্ধ ছিলো। বললেন তার মা। একটা বাতাসের ঘূর্ণি উঠলো। পাতার রাশ নুপুর বাজিয়ে চরকী তুলে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেন তাল দিচ্ছে শিশুর সুরের সাথে সাথে। দোলন এক মনে বাজিয়ে চলেছে-
একতারা তুই দেশের কথা, বলরে এবার বল,
আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল
জীবন মরণ পাশে তোর সুরে যেন বাজে…
একবার মুখ তুলে দেখলো নিমগ্ন শ্রোতাদের। তার মুখে মৃদু হাসি ফুটলো। বন্ধুর মতোই একতারায় সুর উঠছে। কানে বাজছে, ওস্তাদ দাদুর কথা_ কষ্ট পেলে, তবে তো সুর ফুটবে দাদু। শুধু যুদ্ধ করে ছিনিয়ে নিয়ে লাভ কি? নাও, ভাব করো একতারার সাথে।
সুরের সঙ্গেও তবে যুদ্ধ করতে হয়। ভাবেন দোলনের বাবা। ছেলেটা যে দারুণ বাজাচ্ছে। মাত করে দিয়েছে একেবারে। ওর যুদ্ধটাও যে ছিলো ভয় পাইয়ে দেয়া। ভয় আর ভালোবাসা, সুর আর অসুরের যুদ্ধে জিতে তো সুরেরই হতে হবে। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই হাতটা শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হলো তার।