কালের নিমন্ত্রণে

এখন পৌষালি দিন। বছরের শেষ দিনের প্রহরগুলোর মধ্যে জমে উঠেছে পিঠা-পুলির আমন্ত্রণ। বাতাসে ভাসছে কেমন নতুন এক সুগন্ধ। চিরকালের বাংলাদেশের সঙ্গে তার চিরকালের আত্মীয়তা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পরিচয় কোন সে অনাদিকালে, সে এক বিশাল বিস্ময়। সে কথাই আজ ভাবছি। কারণ ‘বর্ষ হয়ে এলো শেষ, দিন হয়ে এলো অবসান, গাহিতে চাহিছে হিয়া, পুরাতন ক্লান্ত বরষের সর্বশেষ গান।’ নতুন বছরের শুরুতে স্মরণ করছি শতবর্ষ প্রাচীন সেই কবির বাণী যা সময়কে অতিক্রম করে বর্তমানের হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আজ যার বিদায় বেলায় সমস্ত স্মৃতির ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সে আর কেউ নয়, সময় নামের বালুঘড়ি। প্রতিদিন যে আমার বর্তমান, তারপর হয়ে যায় অতীত। কিন্তু হারায় না কিছুই। কুয়াশার মতো রহস্যময় তার অস্তিত্ব। শত শতাব্দী পেছনে ফেলেছি আমরা। আজ মানুষ তার নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের জলে-স্থলে, এমনকি বিশ্বব্রহ্মা-েও। সব অজানা রহস্যের কোনো কোনো বিষয়ে আহরণ করেছে কল্পনাতীত জ্ঞান ও সফলতা। বাংলাদেশের মানুষও পিছিয়ে নেই গতির প্রতিযোগিতায়। মানুষ আবহমানকালের পথিক। বিশ্বপরিবারের সদস্য। ইতিহাস তার চলার পথে সাথী করে নিয়েছে এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশকেও। বড় বিচিত্র তার পশ্চাদপট। আজ থেকে হাজার বছরের ঐতিহ্য তার। যুদ্ধ, দ্রোহ, সভ্যতার সব উপহারই সে অর্জন করেছে। আমি চোখ মেলে দেখেছি ঘটনায়, বিদ্রোহে, ক্ষমতার লড়াইয়ে, সময়ের বিপুল শক্তির হাত ধরে সে বর্তমানকালের সঙ্গে চলেছে। কখনো ভাবী_ কী হবে এই নিরবচ্ছিন্ন পথচলায়? একদিন তো সময়ের দ্রুত ধাবমান বিজয়রথের যাত্রা শেষ হয়ে যাবে। মানুষ অনিবার্য অনন্তে ফিরে যাবে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন দুই হাজার তের সালের অন্তিম যাত্রায় বিদায়ের ধ্বনি। আমরা সময়ের দৌড়ে পেছনে ফেলে যাব গত বছরের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না। মনটা যেন বিষাদের অনুভবে ভারাক্রান্ত। ভেবে দেখতে ইচ্ছা করে, কী করেছি, কী পেয়েছি ফেলে আসা বছরের দিনগুলোয়? হিসাবের খাতায় যেমন অর্জন চোখে পড়ে তেমনই বিসর্জনের ব্যথাও রয়েছে। গত বছরটি ছিল ঘটনাবহুল। আমাদের দেশের তারুণ্য এক নতুন মোড় নিয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বলিষ্ঠভাবে কাজ করছে তারা। খেলাধুলায় চ্যালেঞ্জিং পেশায় তরুণদের আগ্রহ এবং সাফল্য উল্লেখ করার মতো। ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। গলফ খেলায় কৃতিত্বও চোখে পড়ার মতো। দাবা খেলা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তারা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। আমাদের এই দেশে এবং বাইরের দুর্লঙ্ঘ পর্বতারোহণে জীবন বাজি রেখে অংশ নিয়েছে আমাদের প্রতিযোগীরা।
এ বছর আমাদের দেশ ও বিভিন্ন দেশের অনেক প্রবীণ গুণীজনকে আমরা হারিয়েছি। এ ছাড়া পৃথিবীব্যাপী সম্মানিত, দেশপ্রেমিক দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তিতুল্য রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা। মানবতার মুক্তির জন্য সারা জীবন ত্যাগ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে সারা বিশ্ব শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। আমাদের যেসব গুণীজন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে ইতিহাস গড়েছেন তাদের মধ্যে সিরাজউদ্দৌলারূপে বাংলার মুকুটহীন রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় আমাদের দেশপ্রেম জাগিয়ে লাখো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তিনি ছিলেন চিত্রনায়ক আনোয়ার হোসেন। সময়ের ডাকে তিনিও বিদায় নেন সব স্মৃতি পেছনে ফেলে।
গত একটি বছরজুড়ে সারা পৃথিবীতে বন্যা ও ভূমিকম্পে আবহাওয়ার বিচিত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কার্যকারিতায় আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। যোগাযোগমাধ্যম আধুনিক হয়ে বিস্ময়কর উচ্চতা অর্জন করেছে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের বিজ্ঞানীরা যন্ত্রমানব তৈরি করেন জীবনযাত্রায় ও শিক্ষাব্যবস্থায় সাহায্য করার জন্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কৃষি ক্ষেত্রে, শস্য গবেষণায় বিজ্ঞানীরা তাৎপর্যপূর্ণ পদ্ধতি তৈরি করে উৎপাদন ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন আছে, আমাদের জীবনকে কখন আমরা বলতে পারব যে আমরা সুরক্ষিত এবং নিশ্চিন্ত? সব প্রচেষ্টা দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা খুবই জরুরি। কিন্তু দেশের কয়েকটি এলাকায় প্রতিবেশীর সঙ্গে বর্ডার সীমান্ত নিয়ে দুঃখজনক অভিজ্ঞতা চলেছে সারা বছর। বর্ডার পার হতে গিয়ে এক কিশোরীর কাঁটাতারে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ লাশ, সারা দেশকে চমকে দেয়। বড় বেদনায় ভাবী_ কবে মানুষের সহমর্মিতায় মানুষকে অন্যায় মৃত্যুবরণ করতে হবে না?
বছরজুড়ে আমরা ব্যস্ত, ব্যর্থ জীবনস্বপ্নের কারাগার ভেঙে মুক্তি আনতে চাই। কিন্তু আমাদের গার্মেন্ট কারখানাগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাজরিন ও রানা গার্মেন্ট অকল্পনীয় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যায়। দীর্ঘ সময় জুড়ে মৃত্যুর সে মিছিল দেশবাসীর বুকে বিশাল ক্ষতচিহ্ন। সমুদ্রের কবলে পড়েও জাহাজের নাবিকদের প্রাণহানি ঘটে যায়। এত হারানোর বেদনা বাংলাদেশ নামের এ দেশটির ভেতরে গুমরে গুমরে কাঁদে।
আমাদের দেশটি যেমন ধৈর্যশীল তেমনই লড়াকু এ দেশের সাধারণ মানুষ। তীব্র যন্ত্রণা সয়ে লাখো মানুষ একদিন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। একটুখানি আশা আর ভালোবাসাই ছিল তার অস্ত্র। কত দীর্ঘকাল আমাদের মানুষরা সেই স্বপ্ন বুকের মধ্যে গেঁথে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলে সামনে এগিয়ে চলেছে।
তবে এও সত্য যে স্বপ্ন আর বাস্তব এক নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বছরজুড়ে তৈরি করেছে স্থবিরতা। কোথায় যেন কীসের অভাব। বছরজুড়ে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষ, মানুষের জীবনযাপনে যে বাধা তৈরি করেছে তা দুঃখজনকভাবে সার্বিক উৎপাদনের পথে বিরাট বাধা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে আমাদের জনজীবনে বারবার নেমে আসে দুর্ভোগ। অশ্রু ও বিদ্রোহ বারবার হানা দেয়। শান্তির জন্য, একমুঠো প্রশান্তির জন্য আমরা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি। যতবার আঘাত আসে, এ দেশের মানুষ মোকাবেলায় প্রস্তুত। বছরজুড়ে আমরা প্রতি ঋতুকে গ্রহণ করি উৎবের মধ্য দিয়ে। পথঘাট ভরে ওঠে ফুলের সৌকর্যে ও সুগন্ধে। প্রাণের শক্তি দিয়ে অনেক ঘাটতি পূরণ করে নেয় এ দেশের মানুষ।
তবু কোথায় যেন একটুখানি ব্যথা জেগে থাকে। দুই হাতের মুঠোয় যতখানি সম্ভব, এ দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে মানুষ। আরো শক্তি চাই এ দেশকে পড়ে তুলতে। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা লুকিয়ে কর্মযজ্ঞ গড়ে তুলতে হবে। তাই তো হিসাব-নিকাশের আয়োজন। কী পেলাম বিগত বছরটি জুড়ে? কী পেলাম, কী পেলাম না, দেশকে কী দিলাম সে কথাও তো ভাবতে হবে। গড়ে উঠি সাহসী মানুষ সব ফুল, সব সুন্দর, সুবাসিত প্রহরের স্মৃতি নিয়ে স্মৃতিকাতর মানুষকে ঘিরে ওঠে দমকা বাতাসের ঝড়।
নিঃশব্দে বাতাসটা আমাকে ঘিরে একটা বৃত্ত তৈরি করে। কখনো তার আলোড়ন শোনায় দীর্ঘশ্বাসের মতো, আবার কখনো মনে হয় নৃত্যপর কিশোরীর পায়ের নূপুর। বাতাসে বেলোয়ারি ঝড়ের মতো রাগ-রাগিণীর শিঞ্জন। আমরা যারা মানুষের সমাজের অন্তর্গত হয়ে দুঃখে-বেদনায়, ঈর্ষায়-আঘাতে পীড়িত হই; জর্জরিত ও বেদনায় আহত সেই মানুষকে একসময় ফিরে তাকাতে হয়। জীবন্ত প্রতিদিনের প্রয়োজনে মানুষ গভীর মমতায় যে জীবনকে লালন করে, সেই জীবনও আমাদের কাছে মুঠোভরে এনে দেয় স্মৃতির আনন্দ। বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সময়ের বিপরীতে। তার ঋণ স্বীকার করার দিন এলে অসীম ভালোবাসা ও মুগ্ধতায় তাকিয়ে দেখি সামনে দীর্ঘ পথের আহ্বান।
মনে পড়ে, দীর্ঘ একটি বছর পেছনে ফেলে এসেছি। এখন ধূসরকালের সামনে তাকানোর প্রস্তুতি নেয়ার পালা। প্রত্যেক বছরই অভিজ্ঞতার উঁচু-নিচু চড়াইয়ে চলতে গিয়ে ঠোকর খেয়ে ভেবেছি_ এ বছরটা ভারী গোলমেলে। আসলে মানুষই পারে নতুন ইতিহাস গড়তে। ‘বারবার ফিরে তাকাবার, নাই ওরে নাই যে সময়’। তাহলে এবার যাত্রা, নতুন বছরের হাত ধরে কল্যাণ ও মুক্তির নতুন পথে স্বাগত দুই হাজার চৌদ্দ সাল।