শিকারের ছুরি

যমজ দ্বীপের মত দুটো ভেলা বাঁধা উপকূলে। সৈকত থেকে সাঁতরে যাওয়া-আসার জন্য নিখুঁত দূরত্বে ওগুলো — গুনে গুনে পঞ্চাশবার হাত-পা ছুড়ে যাওয়া যায় যেকোন একটায়, তারপর একটা থেকে আরেকটায় তিরিশবার হাত-পা চালনা। আনুমানিক চোদ্দ ফুট চৌকো, প্রতিটা ভেলায় একটা করে ধাতব সিঁড়ি, আর ওপরটা কৃত্রিম ঘাসের কার্পেট। পানি, এখানে দশ বা বারো ফুট গভীর, এত টলটলে যে আপনি ভেলাগুলোর সঙ্গে বাঁধা শেকল অনুসরণ করে অনায়াসে তলদেশের কংক্রিটের নোঙর দেখতে পাবেন। সাঁতারের জায়গাটা প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা, ঢেউ বলতে যৎসামান্য, ফলে ভেলাদুটো ঈষৎ দুলছিল মাত্র। দিনের পর দিন প্রখর খরতাপের নিচে ওখানে বাঁধা অবস্থায় কেমন যেন হালছাড়া মনে হতো ওগুলোকে।

ওখানে দাঁড়িয়ে তীরের দিকে ফিরে তাকাতে পছন্দ করতাম আমি, প্রসারিত সৈকত, লাল লাইফগার্ড টাওয়ার, সবুজ পামগাছের সারি — সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, বলা চলে অনেকটা ছবির মত নিখুঁত। ডানে, বেলাভূমি শেষ হয়েছে কালো একসারি শৈলশ্রেণির কাছে যেটা চলে গেছে হোটেল কটেজগুলোর দিকে যেখানে আমার স্ত্রী আর আমি উঠেছিলাম। ওটা ছিল জুন মাসের শেষ, সবে পর্যটন মরশুমের শুরু, হোটেলে বা সৈকতে বিশেষ লোকসমাগম ছিল না।
অদূরে আমেরিকান সেনা ছাউনি ছিল একটা। ভেলাদুটো পড়ে ছিল হেলিকপ্টার ফিরে আসার উড়ানপথে। উপকূলে দেখা দিয়ে, হেলিকপ্টারগুলো বেরিয়ে যেত দুই ভেলার মাঝের জায়গাটা চিরে, তারপর সোজা পামগাছগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে অদৃশ্য হত। এত নিচু দিয়ে উড়ে যেত ওগুলো যে আপনি একরকম পাইলটদের মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পেতেন। এরপরও, মাথার ওপর গোঁত্তা খাওয়া ওই হেলিকপ্টারগুলো বাদ দিলে, সৈকতটা ছিল ঘুম-ঘুম, নিরিবিলি — ছুটির সময়ে একা থাকার জন্য আদর্শ স্থান।
প্রতিটি কটেজ শাদা দোতলা দালান, চার ইউনিটে বিভক্ত, দুটো একতলায় আর দুটো দোতলায়। আমাদের কামরাটা ছিল একতলায়, সাগরমুখী। আমাদের জানালার ঠিক বাইরে শাদা প্লুমেরিয়ার ঝাড়, আর এর ওপাশে নিখুঁত করে ছাঁটা লন। সকালে আর রাতে, ঘাসের ওপর ঝিম ধরা কলরোল তোলে স্প্রিংকলারগুলো। বাগান পেরিয়ে সুইমিং পুল আর একসারি দীর্ঘ পামগাছ, যাদের বিশাল পত্রপল্লব উপকূলীয় হাওয়ায় মৃদুমন্দ আন্দোলিত হয়।
আমার স্ত্রী আর আমি যেটায় উঠেছিলাম তার পাশের কামরায় ছিল একটা আমেরিকান পরিবার, মা আর ছেলে। আমাদের আসার বহু আগেই মনে হয় ওরা থিতু হয়েছিল। মা-টার বয়স ষাটের মত, আর ছেলেটা আমাদের বয়সী, আটাশ কি উনত্রিশ। আমার দেখা যেকোন মা-পুত্রের চেয়ে ওদের পারস্পরিক চেহারার মিল ছিল অনেক বেশি — দুজনেরই অবিকল লম্বা, সরু মুখাবয়ব, চওড়া কপাল, দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট। মা দীর্ঘকায়, দেহভঙ্গি ঋজু, চলাফেরা সদাসতর্ক ও ক্ষিপ্র। ছেলেটাও লম্বাই মনে হয়, তবে সে হুইলচেয়ারে আটকে পড়ায়, আপনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। সঙ্গতকারণেই মা পেছনে থাকত সবসময়, চেয়ার ঠেলে নিয়ে যেত।
অসম্ভব চুপচাপ ওরা, ঘরটা জাদুঘরের মত। কখনো টিভি চালু করত না, যদিও ওদের কামরা থেকে দুবার সঙ্গীত শুনতে পেয়েছিলাম — প্রথমবার মোৎসার্টের বাঁশি পঞ্চন্দি, আর দ্বিতীয়বার কোন অর্কেস্ট্রা সঙ্গীত যা আমি চিনতে পারিনি। আমার অনুমান রিচার্ড স্ট্রাউসের হবে। এছাড়া, কোন শব্দই না। এয়ার কনডিশনার ব্যবহার করেনি ওরা — এর বদলে সামনের দরজা খোলা রাখত, যাতে সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকতে পারে। তবে, দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও, আমি কখনো ওদের কথা বলতে শুনিনি। যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে ওদের — ধরে নিচ্ছি কখনো কখনো কথা বলতে হয়েছে — নিশ্চয় ফিসফিস করে হয়ে থাকবে। আমার স্ত্রী এবং আমার মধ্যে এর ছোঁয়াচ লেগে থাকবে, যখনই নিজেদের কামরায় থাকতাম, আমরা খুব নিচুস্বরে কথা বলছিলাম।
মা আর ছেলের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত, রেস্তোরাঁয় নয়ত লবিতে, কিংবা বাগানের পায়েচলা পথে। ছোট হোটেল, আরামদায়ক, ফলে আমার ধারণা আমাদের পথ কাটাকাটি করতই, আমরা সেটা চাই বা না চাই। পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে একে অপরকে মাথা দোলাতাম আমরা। মা আর ছেলের আদাব জানাবার ভঙ্গিতে পার্থক্য ছিল। মা জোরাল, ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা দোলাত; ছেলে ঈষৎ ঘাড় কাত করত। এ দুই ধরনের আদাবই, অবশ্যি, অভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করত: উভয় অভিবাদনের শুরু ও শেষ ওখানেই হত, এর বেশি কিছ থাকত না ওতে। আমরা কখনো ওদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করিনি। নিজেদের মধ্যে বলার জন্য আমার স্ত্রী এবং আমার অনেক কথা ছিল — বাড়ি ফিরে আমরা নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠব কিনা, কাজের ব্যাপারে কী করব, বাচ্চা-কাচ্চা নেব কিনা এইসব। আমাদের বয়স যখন বিশের কোঠায় শেষ গ্রীষ্ম উদযাপন করছে এটা তখনকার কথা।
নাস্তার পর, মা আর ছেলে সবসময় লবিতে বসে খবরকাগজ পড়ত — প্রত্যেকেই খুব নিয়ম মেনে এক পাতা থেকে আরেক পাতায় যেত, ওপর থেকে নিচে, যেন পুরো জিনিসটা পড়তে কার বেশি সময় লাগে ওরা তার কঠিন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কোন কোনদিন খবরকাগজের পরিবর্তে শক্তমলাটের ঢাউস বই হত ওটা। মা-ছেলে না হয়ে ওদেরকে বিবাহিত বুড়ো-বুড়ির মত লাগত যারা অনেক আগেই একে অপরের প্রতি হাঁপিয়ে উঠেছে।

রোজ সকালে, দশটা নাগাদ আমার স্ত্রী আর আমি একটা কুলার নিয়ে যেতাম সৈকতে। গায়ে ভাল করে রোদনিরোধ মাখতাম আমরা, তারপর বালুতে মাদুরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তাম। ওয়কম্যানে স্টোন নয়ত মার্ভিন গে শুনতাম আমি, আর আমার স্ত্রী একটা সুলভ সংস্করণ গন উইদ উইন্ড-এর পাতা উল্টে যেত। ও দাবি করত ওই বইটা থেকে ও জীবন সম্পর্কে অনেককিছু শিখেছে। আমি কখনো পড়িনি ওটা, তাই ধারণা সেই ও কী বোঝাত। রোজ, সূর্যটা টুক করে উদিত হত স্থলভাগে, দুই ভেলার মাঝ দিয়ে — হেলিকপ্টারগুলোর বিপরীত দিকে — ধীরগতিতে অনুসরণ করত একটা পথ, তারপর অলসভাবে ডুবে যেত দিগন্তের নিচে।
রোজ দুপুর দুটোয়, সৈকতে আবির্ভূত হত মা আর ছেলে। মা-টা সবসময় পরত হালকারঙা সাদামাঠা পোশাক আর চওড়া ব্রিমের স্ট্র হ্যাট। ছেলেটা হ্যাট পরত না কখনো; এর বদলে ও রোদচশমা লাগাত। পাম গাছের ছায়াতলে বসে থাকত ওরা, চারপাশে হাওয়ার মর্মর, অনিমেষ চেয়ে থাকত সাগরপানে, কার্যত কিছুই করত না। মা একটা ফোল্ডিং বিচ চেয়ারে বসে থাকত, কিন্তু ছেলেটা কখনই তার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠত না। খানিক পরপর জায়গা বদল করত ওরা যাতে ছায়ায় থাকা যায়। মায়ের সঙ্গে একটা রুপোলি থার্মোস থাকত, মাঝেমধ্যে পেপার কাপে নিজের জন্য পানীয় ঢেলে নিত বা ক্র্যাকার চিবোত।
কোন-কোন দিন আধঘণ্টা বাদেই চলে যেত ওরা; অন্যান্য দিন তিনটে অবধি থাকত। আমি যখন সাঁতার কাটতাম তখন টের পেতাম ওরা আমাকে লক্ষ করছে। পাইনসারি থেকে ভেলাদুটোর দূরত্ব বেশ অনেকটাই ছিল, ফলে ওটা আমার কল্পনাও হয়ে থাকতে পারে। কিংবা আমি বেশি অনুভূতিপ্রবণও হয়ে থাকতে পারি, তবে যখনই কোন একটা ভেলায় উঠেছি আমার পরিষ্কার মনে হয়েছে ওদের দৃষ্টি আমার দিকে ফেরান। কখনো কখনো রুপোলি থার্মোসটা রোদে ছুরির ফলার মত ঝিকিয়ে উঠত।
একটা ম্যাড়মেড়ে দিন অনুসরণ করে আরেকটাকে, একটা থেকে অন্যটাকে তফাত করার মত কোনকিছুই ঘটে না। আপনি অনায়াসে দিনগুলির ক্রম বদলে দিতে পারেন, কেউ কিছু ঠাহর পাবে না। সূর্য পুবে ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়, জলপাই-সবুজ হেলিকপ্টারগুলি গোত্তা মেরে নেমে আসে, আর আমি গ্যালন গ্যালন বিয়র ঢেলে আমার হৃদয়ের গল্পকথায় সাঁতার কাটি।

হোটেলে আমরা শেষ যে পুরো দিনটা ছিলাম সেই অপরাহ্নে আমি শেষবারের মত সাঁতার কাটতে বেরোলাম। আমার স্ত্রী সুখনিদ্রা যাচ্ছিলেন, তাই আমি একাই সৈকতের উদ্দেশে বেরোই। সেদিন শনিবার, ফলে সাধারণত যা থাকে তারচেয়ে বেশি লোক ছিল। কদমছাঁট চুল আর বাহুতে উল্কি আঁকা, রোদেপোড়া তরুণ সৈনিকরা ভলিবল খেলছিল। ছোট ছেলেমেয়েরা পানির ধারে ঝাঁপাঝাঁপি করছিল, বালুর প্রাসাদ তৈরি করছিল, আর বড় বড় ঢেউয়ের উদ্দেশে আনন্দে চিৎকার করছিল। কিন্তু পানিতে প্রায় কেউই ছিল না; ভেলাগুলি খাঁ খাঁ করছিল। আকাশ নির্মেঘ, সূর্য মাথার উপরে, বালু তপ্ত। এটা বেলা দুটোর পরে, কিন্তু মা আর ছেলে তখনো দর্শন দেয়নি।
পানি বুকে ওঠা অবধি হেঁটে গেলাম আমি, তারপর হামা শুরু করলাম, বাঁয়ের ভেলাটার দিকে। ধীরে, হাতের তালুতে পানির বাধা পরখ করে করে, সাঁতরে চললাম, প্রতিটা বাঁও গুনছি। কন্কনে পানি, আমার রোদেপোড়া ত্বকে আরাম বোধ হচ্ছে। অমন টলটলে পানিতে সাঁতারের সময়ে নিচের বালুতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি নিজের ছায়া, যেন আমি একটা পাখি, আকাশের বুক চিরে এগিয়ে চলেছি। চল্লিশ বাঁও গোনার পর মাথা তুললাম, ভেলাটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম সামনে। গুনে গুনে দশ বাঁও বাদে আমার বাম হাত ওটার ধার স্পর্শ করল। একমুহূর্ত ভেসে রইলাম ওখানে, সামান্য দম নিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম উপরে।
সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম ওখানে আগে থেকেই রয়েছেন একজন — মেদবহুল এক স্বর্ণকেশী। সৈকত থেকে রওনা হওয়ার সময়ে ভেলায় কাউকে দেখিনি আমি, অতএব নিশ্চয় ও ওখানে এসেছে যখন আমি ভেলাটার দিকে সাঁতার কেটে এগোচ্ছিলাম। মহিলার পরনে হ্রস্ব বিকিনি — ওই পতপতে লাল জিনিগুলোর একটা, জাপানি কৃষকেরা ক্ষেতে মাত্র রাসায়নিক দ্রব্য ছিটান হয়েছে এই হুঁশিয়ারি জানাতে যেরকম ব্যানার ওড়ায় সেরকম — উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ও এতই স্থূলাঙ্গী, সাঁতারের পোশাকটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছোট মনে হয়। মনে হয় সম্প্রতি এসেছে — ত্বক এখনো পাণ্ডুর, তামাটের লেশমাত্র নেই।
একঝলক উপরে তাকাল সে, তারপর আবার চোখ মুদল। ভেলার উল্টো প্রান্তে বসলাম আমি, পানিতে পা দোলাচ্ছি, তাকিয়ে রয়েছি তীরের দিকে। মা আর ছেলে এখনো তাদের পামগাছের নিচে আসেনি। অন্য কোথাও নেই ওরা, কোত্থাও না। ওদেরকে আমার না দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না; রোদে চিকচিক করা ধাতব হুইলচেয়ার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে বাধ্য। একধরনের হতাশাবোধ করলাম। ওরা না থাকায়, ছবির একটা অংশ অনুপস্থিত। হয়ত চলে গেছে হোটেল ছেড়ে, ফিরে গেছে যেখান থেকে এসেছিল সেখানে — সেটা যে জায়গাই হোক না কেন। খানিক আগে যখন দেখেছিলাম ওদের, হোটেলের রেস্তোরাঁয়, মনে হয়নি ওরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আয়েশ করে দিনের বিশেষ খাবার খেয়েছিল ওরা এবং পরে নীরবে এক কাপ কফি পান করেছিল — বরাবরের মত।
স্বর্ণকেশীর মত মুখ গুঁজে শুয়ে দশ মিনিটের মত নিজেকে রোদেপোড়া করলাম আমি, ভেলার কিনারে ছোট ছোট ঢেউয়ের আঘাত শুনতে শুনতে। আমার কানে জলবিন্দু তীব্র রোদে তেতে উঠছে।
‘গরম বটে,’ মহিলা বলল ভেলার আরেক প্রান্ত থেকে। তীক্ষ্ম, মিহি কণ্ঠস্বর।
‘ঠিক,’ জবাব দিলাম আমি।
‘কটা বাজে বলতে পার?’
‘আমার কাছে ঘড়ি নেই, তবে আড়াইটার কাছাকাছি হবে। দুটে চল্লিশও হতে পারে।’
‘তাই?’ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল মহিলা, যেন আশা করেনি বেলা এত গড়িয়েছে। সময় নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই এমনও হয়ে থাকতে পারে।
উঠে বসল ও। সারা শরীরে স্বেদবিন্দু ফুটে রয়েছে খাবারের উপর মাছির মত। কানের ঠিক নিচে থেকে চর্বির দলা শুরু হয়ে ধীরেসুস্থে নেমে গেছে কাঁধে, তারপর একটানে থল্থলে বাহু দুটোয়। এমনকি কবজি আর গোড়ালিও চর্বির ভাঁজে ঢাকা পড়েছে মনে হয়। আমি মিশেলিন ম্যান-এর কথা না ভেবে পারলাম না। মহিলাকে অবশ্যি, যত ভারীই দেখাক, আমার অসুস্থ মনে হয়নি। দেখতেও খারাপ না। স্রেফ হাড়ের উপর অতিরিক্ত মাংস, এই যা। অনুমান করলাম ওর বয়স ত্রিশের ওপর দিকে হবে।
‘তুমি নিশ্চয় অনেকদিন এখানে, এত তামাটে লাগছে।’
‘নয় দিন।’
‘কী চমৎকার তামাটে’’ বলল ও। জবাব দেয়ার পরিবর্তে আমি গলা সাফ করলাম। কাশির দমকে আমার কানের পানি কুলকুল আওয়াজ করল।
‘আমি মিলিটারি হোটেলে উঠেছি,’ বলল মহিলা।
জায়গাটা চিনি আমি । সৈকত অল্পটাক তফাতে।
‘আমার ভাই নেভি অফিসার, সেই আমাকে আসতে বলেছিল। নেভি খুব খারাপ না, জান? ভাল বেতন দেয়। তোমার যা চাই, ঘাটিতে সব আছে। উপরি এধরনের রিসোর্ট। আমি যখন কলেজে তখন অন্যরকম ছিল। ওটা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। পরিবারে সেনাবাহিনীতে কাজ করে এমন কেউ থাকাটা তখন বিব্রতকর ছিল। তোমাকে লুকিয়ে বেড়াতে হত। দুনিয়াটা সত্যিই অনেক বদলেছে সেই সময় থেকে।’
আমি অর্থহীনভাবে মাথা দোলালাম।
‘আমার প্রাক্তনও নেভিতে ছিল,’ ও বলে চলে। ‘ফাইটার পাইলট। ভিয়েতনামে দায়িত্বপালন করে দুবছর, তারপর ইউনাইটেডের পাইলট হয়। আমি সেসময় ইউনাইটেডের বিমানবালা, এভাবেই আমাদের পরিচয় হয়। আমরা কোন্ বছর বিয়ে করলাম মনে করতে চেষ্টা করছি… উনিশো সত্তর কিছু একটা হবে। যা-হোক, আনুমানিক ছয় বছর আগে। সবসময়ই হয় এরকম।’
‘কী হয়?’
‘জানই তো — এয়ারলাইন ক্রু উদ্ভট সময়ে কাজ করে, ফলে ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করে। কাজের সময় আর জীবনযাত্রা একেবারে সৃষ্টিছাড়া। যা-হোক, আমরা বিয়ে করলাম, আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম, আর তারপর ও আরেকজন বিমানবালার সঙ্গে প্রেম করল এবং তাকে বিয়ে করল। এটাও হয় সবসময়।’
বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টা করলাম আমি। ‘তুমি কোথায় থাক এখন?’
‘লস অ্যানজেলেসে,’ বলল। ‘তুমি গেছ কখনো?’
‘না’’ বললাম।
‘আমার জন্ম ওখানে। তারপর আমার বাবা সল্ট লেক সিটিতে বদলি হলেন। তুমি ওখানে গেছ?’
‘না।’
‘আমি সুপারিশ করব না,’ বলল ও, মাথা নেড়ে। হাতের তালুতে মুখের ঘাম মুছল।
এই মেয়ে বিমানবালা ছিল ভাবতেই অবাক লাগে। আমি অনেক পেশল বিমানবালা দেখেছি যারা পাহলোয়ান হতে পারত। আমি অনেক মাংসল বাহু আর ঝুলে থাকা পেলব ওষ্ঠ্য দেখেছি। কিন্তু কখনো ওর মত এত বিশাল দেখিনি। ইউনাইটেড সম্ভবত পরোয়া করে না তাদের বিমানবালারা কত গুরুভার। কিংবা প্রথম যখন কাজ পেয়েছিল তখন ও এত মোটা ছিল না।
‘তুমি কোথায় উঠেছ?’ ও জিজ্ঞেস করল আমাকে।
আঙুল ইশারায় হোটেলটা দেখালাম।
‘একা?’
ব্যাখ্যা করলাম কীভাবে আমার স্ত্রী ও আমি ছুটি কাটাতে এসেছি।
‘হানিমুন?’
‘না,’ জবাব দিলাম। ‘আমরা ছয় বছর হল বিবাহিত।’
‘সত্যি?’ বলল ও, বিস্মিত। ‘তোমাকে বয়স্ক লাগে না।’
সৈকতে নজর বোলাই আমি। মা আর ছেলের কোন চিহ্ন নেই এখনো। সৈনিকরা এখনো ভলিবল লোফালুফি করছে। টাওয়ারে কর্তব্যরত লাইফগার্ড ভারি বাইনোকুলার দিয়ে গভীর মনোযোগে কী যেন দেখছে। উপকূলে অবশেষে দেখা দিল দুটো সেনা হেলিকপ্টার এবং, গ্রিক ট্র্যাজেডির ভগ্নদূতের মত, গম্ভীর গর্জনে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে, স্থলভাগে অদৃশ্য হল। দূরে সবুজ যন্ত্রগুলির মিলিয়ে যাওয়া নীরবে লক্ষ করি আমরা।
‘বাজি ধরে বলতে পারি ওই ওপর থেকে মনে হচ্ছে আমরা দারুণ সময় উপভোগ করছি,’ বলল মহিলা। ‘এই ভেলায় রোদ পোয়াচ্ছি, দুনিয়ার কোন খেয়াল নাই।’
‘তোমার কথাই হয়ত ঠিক।’
‘উঁচু থেকে বেশিরভাগ জিনিসই সুন্দর দেখায়,’ বলল ও। গড়ান দিয়ে আবার পেটের উপর শুয়ে চোখ বুজল।
নীরবে বয়ে চলল সময়। বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে অনুভব করে উঠে দাঁড়ালাম আমি, মহিলাকে বললাম আমাকে যেতে হচ্ছে। পানি চিরে সাঁতরে সরে এলাম। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর, থেমে, পানিতে পা ছুড়তে ছুড়তে, ভেলাটার উদ্দেশে ফিরলাম। আমাকে লক্ষ করছিল মহিলা, হাত নাড়ল। আমিও জবাবে সামান্য হাত নাড়লাম। দূর থেকে ওকে ডলফিনের মত লাগছিল। শুধু একজোড়া ফ্লিপার দরকার ছিল, তাহলেই লাফিয়ে সাগরে ফিরে যেতে পারত।
ঘরে এসে হালকা ঘুমোলাম আমি, তারপর সন্ধ্যা নামলে আমার স্ত্রী আর আমি রোজকার মত রেস্তোরাঁয় গিয়ে ডিনার খেলাম। মা আর ছেলে সেখানে ছিল না। রেস্তোরাঁ থেকে আমাদের কামরায় ফেরার সময় ওদের দরজা বন্ধ পেলাম। দরজার ঘষা কাচের ছোট্ট ঘুলঘুলি গলে মৃদু আলো আসছে, কিন্তু আমি বলতে পারব না ঘরে তখনো মানুষ আছে কিনা।
‘ওরা ইতিমধ্যে চলে গেছে কিনা কে জানে,’ বললাম আমার স্ত্রীকে। ‘বিচে বা ডিনারেও দেখিনি ওদের।’
‘সবাইকেই শেষমেশ চলে যেতে হয়,’ আমার স্ত্রী বলল। ‘তুমি এভাবে চিরকাল থাকতে পার না।’
‘সেটাই,’ একমত হলাম আমি, কিন্তু প্রত্যয় হল না। ওই মা আর ছেলেকে ওখানে ছাড়া অন্য কোথাও আমি কল্পনা করতে পারি না।
আমরা গোছাতে শুরু করলাম। স্যুটকেসগুলি ভরে বিছানার পায়ের কাছে রাখার পর, সহসা কামরাটা নিরুত্তাপ আর বেখাপ্পা মনে হল। আমাদের অবকাশের সময় শেষ হয়ে আসছে।

জেগে উঠে বিছানার পাশে রাখা টেবলের উপর ঘড়িটা চকিতে দেখলাম আমি। একটা কুড়ি। আমার বুক ভীষণ ধড়ফড় করছিল। গড়িয়ে কার্পেটে নামলাম, আসনপিঁড়ি হয়ে বসে বার কয়েক বুক ভরে শ্বাস নিলাম। তারপর নিশ্বাস ধরে রেখে, এলিয়ে দিলাম কাঁধ দুটো, টানটান বসে মনঃসংযোগ করতে চেষ্টা করলাম। নিশ্চয় বেশি সাঁতরেছি, ভাবলাম, কিংবা বেশি সময় রোদে ছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে, নজর বোলালাম ঘরের চারপাশে। বিছানার পায়ের কাছে আমাদের স্যুটকেস দুটো নিঃশব্দসঞ্চারী জীবের মত পড়ে আছে। তাইতো, মনে পড়ল আমার — কাল আমরা আর এখানে থাকছি না।
জানালা গলে আসা ম্লান চাঁদের আলোর মাঝে আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর শ্বাসপ্রশ্বাস একটুও শুনতে পাচ্ছিলাম না, যেন সে মৃত। কখনো কখনো ওভাবে ঘুমোয় ও। আমাদের যখন প্রথম বিয়ে হল, আমাকে একরকম ঘাবড়ে দিয়েছিল এটা; মাঝে মাঝে, আমার মনে হত ও হয়ত সত্যিই মৃত। আসলে ওটা ছিল সেরকম নীরবতা, অতল নিদ্রা। ঘামে ভেজা পাজামা খুলে ফেললাম আমি, একটা পরিষ্কার শার্ট আর শর্টস পরলাম। টেবলের উপর রাখা ওয়াইল্ড টার্কির ক্ষুদ্রাকৃতি বোতলটা পকেটে পুরে আস্তে করে খুললাম দরজাটা, বাইরে পা রাখলাম। রাতের হাওয়া শীতল, বাতাসে আশেপাশের গাছগাছালির সোঁদা গন্ধ। থালার মত চাঁদ, চরাচর ধুইয়ে দিচ্ছে এক অপার্থিব রঙে যা আপনি কখনো দিনের বেলায় দেখতে পান না। এটা অনেকটা বিশেষ রঙের ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে দেখার মত, আসল রঙকে যেটা আরো বেশি উজ্জ্বল করে দেখায়, আর অন্যগুলোকে লাশের মত নিষ্প্রভ আর নিস্তেজ করে রাখে।
আমি মোটেও নিদ্রালু ছিলাম না। কস্মিনকালেও ঘুমের লেশমাত্র ছিল না এমন একটা অবস্থা, আমার মাথা এতই পরিষ্কার আর সজাগ তখন। নৈঃশব্দ্য রাজত্ব করছে। কোন হাওয়া নেই, কোন পোকামাকড় নেই, কোন রাতের পাখি ডাকছে না। কেবল দূরাগত ঢেউয়ের শব্দ, তাও সেটা শুনতে আমাকে কানখাড়া করে রাখতে হয়।
ধীরপায়ে কটেজটাকে পাশ কাটিয়ে, লনের ওপাশে রওনা হলাম। চাঁদের আলোয়, গোলাকৃতি লনটাকে অনেকটা বরফে ঢাকা পুকুর মনে হয়। সাবধানে পা ফেলছি, চেষ্টা করছি বরফ না ভাঙতে। লনের ওপাশে সরু একটা পাথরের সিঁড়ি, যার মাথায় গ্রীষ্মম-লীয় সাজে সজ্জিত একটা পানশালা ছিল। প্রত্যেক সন্ধেয়, ডিনারের ঠিক আগে, এই বারে একটা ভোদকা-টনিক পান করতাম আমি। এত রাতে, স্বাভাবিকভাবেই, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পানশালা, প্রতিটা টেবলের ছাতা ঘুমন্ত টেরোডেকটাইলের মত নিখুঁতভাবে ভাঁজ করা।
হুইলচেয়ারবাসী যুবকটা ছিল সেখানে, একটা টেবলে কনুইতে ঠেস দিয়ে বসে, পানির দিকে তাকিয়ে। দূর থেকে, ওর ধাতব হুইলচেয়ারটাকে চাঁদের আলোয় একান্তভাবেই রাতের গভীর ও অন্ধকারতম সময়ের জন্য তৈরি কোন সূক্ষ্ম যন্ত্রের মত দেখাচ্ছিল।
লোকটাকে এর আগে কখনো একা দেখিনি। আমার ভাবনায়, সে ও তার মা সবসময় এক অভিন্ন সত্তা ছিল — ও নিজের চেয়ারে, আর ওর মা সেটা ঠেলছেন। ওকে এভাবে দেখে অদ্ভুত — এমনকি অশোভনও — মনে হল। একটা কমলারঙা হাওয়াই শার্ট পরনে, যা আমি আগে দেখেছি, আর শাদা সুতি প্যান্ট। স্রেফ অনড় বসে আছে, মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে।
একটুক্ষণ ওখানে দাঁড়িযে থাকি আমি, ভাবছি আমার উপস্থিতির সংকেত ওকে দেব কি-না। তবে, আমি কর্তব্য স্থির করার আগেই, আমার উপস্থিতি টের পায় সে এবং ঘাড় ফেরায়। আমাকে দেখতে পেয়ে স্বভাবসুলভ সংক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে সে মাথা দোলাল।
‘শুভ সন্ধ্যা,’ বললাম আমি।
‘শুভ সন্ধ্যা,’ নিচুস্বরে জবাব দিল সে। এই প্রথম ওর কথা শুনলাম। কণ্ঠস্বর ঈষৎ নিদ্রালু, এছাড়া একদম স্বাভাবিক। খুব বেশি চড়া না, আবার একেবারে খাদেও না।
‘মাঝরাতের পায়চারী?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘ঘুম আসছিল না,’ বললাম।
আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল ও, ঠোঁটে আবছা হাসি ফুটে উঠল। ‘আমারও,’ বলল। ‘বোসো, যদি ইচ্ছা করে।’
একমুহূর্ত দ্বিধা করলাম আমি, মাথা ঝাঁকালাম, তারপর ওর টেবলে গেলাম। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম বিপরীত দিকে। ও যেদিকে তাকিয়ে ছিল আমি সেদিকে তাকাবার জন্য ঘুরলাম। সৈকতের শেষপ্রান্তে খাঁজ-কাটা পাথরসারি, দ্বিখণ্ডিত চিতইপিঠার মত, নিয়মিত বিরতিতে ঢেউ আছড়ে পড়ছে গায়ে। পরিপাটি, রাজকীয় ছোট ছোট ঢেউ — যেন গজফিতে দিয়ে মাপা। এর ওপাশে, দেখার বিশেষ কিছু নেই।
‘তোমাকে আজ বিচে দেখিনি,’ বললাম আমি।
‘আজ সারাদিন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম,’ যুবক জবাব দিল। ‘আমার মা ভালবোধ করছিলেন না।’
‘কথাটা জেনে খারাপ লাগছে।’
‘শারীরিক কিছু না। অনেকটাই আবেগের ব্যাপার, মানসিক অবস্থা।’ ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে চিবুক ঘষল সে। অনেক রাত, তারপরেও ওর চিবুক পোর্সেলিনের মত মসৃণ, জঙ্গলের চিহ্নমাত্র নেই। ‘এখন ভাল তিনি। গভীর ঘুমোচ্ছেন। ব্যাপারটা আমার পায়ের মত না — এক রাতের ভাল ঘুম; ব্যস, ঝরঝরে হয়ে গেলেন। পুরো ভাল হয়ে গেলেন এমন না, কিন্তু নিজেকে ফিরে পান আবার, এই আর কী। সকালে ঠিক হয়ে যাবেন।’
ত্রিশ সেকেন্ড নীরব রইল ও, কিংবা এক মিনিট। টেবলের নিচে পায়ের ভাঁজ খুললাম আমি, ভাবছি চলে যাওয়ার জন্য এটা ঠিক সময় কিনা। যেন আমার সারা জীবন এই একটা প্রশ্ন ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে, কোন আলোচনায় বিদায় নেয়ার সেরা মুহূর্তটা বিচার করাই যার উদ্দেশ্য। কিন্তু আমি আমার সুযোগ হারালাম: ঠিক যে মুহূর্তে বলতে যাব আমাকে যেতে হচ্ছে, ও কথা বলে উঠল।
‘অনেক ধরনের ¯স্নায়ু দুর্বলতা আছে। এগুলোর কারণ যদি একও হয়ে থাকে, লক্ষণ নানা হতে পারে। অনেকটা ভূমিকম্পের মত — অন্তর্গত শক্তি এক কিন্তু, কোথায় হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে, ফলাফল আলাদা হয়। এক জায়গায় হয়ত একটা দ্বীপ ডুবে গেল, আবার আরেক ক্ষেত্রে নতুন দ্বীপ জেগে উঠল।’
হাই তুলল ও। দীর্ঘ, আনুষ্ঠানিক ধাঁচের হাই। প্রায় রাজোচিত। ‘দুঃখিত,’ পরে বলল। অবসন্ন দেখায় ওকে; চোখ ঝাপসা, যেন যে কোন মুহূর্তে ঘুমে ঢলে পড়বে। আড়চোখে ঘড়ি দেখলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম পরিনি — ঘড়িটা যেখানে ছিল সেখানে এক চিলতে শাদা ত্বক দেখা যাচ্ছে।
‘আমাকে নিয়ে ভেবো না,’ বলল ও। ‘দেখে মনে হতে পারে আমার ঘুম এসেছে কিন্তু আসলে তা না। রাতে চার ঘণ্টাই আমার জন্য যথেষ্ট। সাধারণত ভোরের ঠিক আগ দিয়ে সেটা সেরে নিই। তাই রাতের এই সময়টা আমি মূলত এখানেই থাকি, স্রেফ ঘুরঘুর করি।’
টেবল থেকে সিনজানো অ্যাশট্রেটা তুলে নিল ও, একটুক্ষণ এভাবে খুঁটিয়ে দেখল যেন ওটা দুষ্প্রাপ্য কিছু, তারপর রেখে দিল।
‘যখনই মায়ের নার্ভাস অবস্থাটা হয়, তার মুখের বাম দিকটা জমে যায়। চোখ বা মুখ নড়াতে পারেন না। তুমি যদি তখন তার মুখ দেখ, মনে হবে একটা ফাটা ফুলদানি দেখছ। অদ্ভুত, তবে মারাত্মক কিছু না। এক রাতের ঘুম, ঠিক হয়ে যাবে।’
বুঝে উঠলাম না কী বলা যায়, তাই আনমনে মাথা দোলালাম কেবল। ভাঙা ফুলদানি?
‘মাকে বলো না তোমাকে বলেছি, ঠিকাছে? তার অবস্থা নিয়ে কেউ কিছু বলুক তিনি চান না।’
‘নিশ্চয়,’ বললাম। ‘তাছাড়া আমরা কালই চলে যাচ্ছি। সুতরাং মনে হয় না তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে।’
‘চলে যাচ্ছ, খুব খারাপ,’ বলল ও, যেন সত্যি ওটা ওর মনের কথা।
‘ঠিক, কিন্তু আমাকে কাজে ফিরতে হবে। তাই কী আর করা বল?’ বললাম আমি।
‘কোথায় থেকে আসছ তোমরা?’
‘টোকিও।’
‘টোকিও,’ আপনমনে আউড়াল ও। চোখজোড়া সরু করল আবার, তাকিয়ে রইল মহাসাগরের দিকে, যেন এভাবে যথেষ্ট কষ্ট করে তাকিয়ে থাকলে দিগন্তের ওপারে টোকিওর আলো দেখতে পাবে।
‘তোমরা আরো কিছুদিন থাকবে এখানে?’
‘বলা কঠিন,’ জবাব দিল ও, হুইলচেয়ারের হ্যান্ডগ্রিপে আঙুল বোলাতে বোলাতে। ‘আরো এক মাস, বা দুই। নির্ভর করছে। আমার বোনের স্বামীর শেয়ার আছে এই হোটেলে, ফলে আমরা এখানে প্রায় বিনে পয়সায় থাকতে পারি। ক্লিভল্যান্ডে আমার বাবার বিরাট টাইল কোম্পানি, এবং কার্যত আমার ভগ্নিপতি নিয়ে নিয়েছেন ওটা। লোকটাকে আমি পছন্দ করি না, কিন্তু তুমি তো তোমার আত্মীয়স্বজন বেছে নিতে পার না, পার কি? জানি না, হয়ত লোকটা অত খারাপ না যতটা আমি ভাবছি। আমার মত রুগ্ন মানুষেরা সাধারণত সংকীর্ণমনা হয়ে থাকে।’ পকেট থেকে রুমাল বের করল ও, ধীরে ধীরে এবং দুর্বলভাবে নাক ঝাড়ল, তারপর রুমালটা পকেটে পুরল আবার। ‘যাই হোক, অনেক কোম্পানিতে তার স্টক আছে। অনেক লগ্নি প্রতিষ্ঠানেও আছে। ধূর্ত লোক, ঠিক আমার বাবার মত। তো আমরা সবাই — মানে আমার পরিবার — আমরা দুধরনের মানুষে বিভক্ত: সবল আর দুর্বল। কেজো এবং অকেজো। যারা সবল তারা টাইল বানায়, নিজেদের সম্পদ বাড়ায়, আর ট্যাক্স ফাঁকি দেয় — তবে কাউকে বোলো না যেন আমি বলেছি, ঠিকাছে? — আর যারা দুর্বল তাদের দেখভাল করে। নিখুঁত শ্রম বিভাজন।’
কথা থামিয়ে গভীর শ্বাস টানল ও। টেবলের ওপর নখ দিয়ে তাল ঠুকল কিছু সময়। আমি চুপ করে রইলাম, ওর কথার অপেক্ষায় আছি।
‘আমাদের হয়ে ওরাই নেয় সব সিদ্ধান্ত। আমাদের বলে দেয় এক মাস এখানে থাকতে, আরেক মাস ওখানে। আমরা হলাম বৃষ্টির মত, আমার মা আর আমি। এখন এখানে বর্ষিত হচ্ছি, এরপর তুমি দেখবে অন্য কোথাও বর্ষিত হব।’
শিলাখণ্ডে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, পেছনে রেখে যাচ্ছে শাদা ফেনা; ফেনা অদৃশ্য হতে হতে, নতুন ঢেউ হাজির হচ্ছে। আনমনে প্রক্রিয়াটা দেখছিলাম আমি। পাথরগুলোর মাঝে জ্যোছনা অনিয়মিত ছায়া তৈরি করেছে।
‘যেহেতু ব্যাপারটা শ্রমবিভাজন,’ বলে চলে ও, ‘অবশ্যই আমার মা আর আমারও ভূমিকা থাকে পালন করবার জন্য। দ্বিমুখী রাস্তা এটা। বর্ণনা করা কঠিন, তবে আমার মনে হয় আমরা নিষ্ক্রিয় থেকে ওদের বাড়াবাড়ি পরিপূরণ করি। এটাই আমাদের অস্তিত্বের হেতু। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?’
‘হ্যাঁ, কিছুটা,’ জবাব দিলাম, ‘তবে পুরো নিশ্চিত নই যে বুঝেছি।’
নিঃশব্দে হাসল ও। ‘পরিবার এক অদ্ভুত বস্তু,’ বলল। ‘একটা পরিবারকে তার নিজের নিয়মে টিকে থাকতে হয়, নয়ত ব্যবস্থাটা কাজ করে না। সেই অর্থে, আমার অকেজো পা দুটো এক ধরনের ব্যানার যার চারপাশে আমার পরিবার সমবেত হয়। আমার মৃত পা দুটো হচ্ছে খুঁটি যার চারপাশে সবকিছু আবর্তিত হয়।’
টেবলের পিঠে আবার টাট্টু বাজায় ও। বিরক্তিভরে নয় — আঙুলগুলো নাড়াচ্ছিল শুধু আর আপন সময়বলয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা করছিল।
‘এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অভাব আরো বড় অভাবের দিকে, আর বাড়াবাড়ি মাত্রা-ছাড়া বাড়াবাড়ির দিকে যায়। একটা অপেরার স্বরলিপি তৈরি করতে গিয়ে ডেবুসি যখন কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি বিষয়টা এভাবে বলেছিলেন: “আমি আমার দিনগুলি অতিবাহিত করি ওটা যে শূন্যতা – rien — সৃষ্টি করে তার পেছনে ছুটে।“ আমার কাজ ওই শূন্যতা, ওই rien, তৈরি করা।‘
এক উন্নিদ্র নীরবতায় নিমগ্ন হয় ও, মন কোন দূরবর্তী অঞ্চলে হারিয়ে গেছে। হয়ত ওর ভেতরকার শূন্যতায়। শেষমেশ ওর মনোযোগ ফিরে আসে বর্তমানে, যেখানে প্রস্থান করেছিল সেই বিন্দু থেকে সামান্য তফাতে। নিজের চিবুক ডলতে চেষ্টা করলাম আমি। দাড়ির আঁচড় বলল, হ্যাঁ, সময় এখনো বয়ে চলেছে। পকেট থেকে হুইস্কির খুদে বোতলটা বের করে রাখলাম টেবলে।
‘গলা ভেজাবে? আমার কাছে গ্লাস নেই যদিও।‘
মাথা নাড়ল ও। ‘ধন্যবাদ, আমি পান করি না। নিশ্চিত নই, করলে আমার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে, তাই করি না। তবে অন্যরা করলে কিছু মনে করি না — তুমি স্বচ্ছন্দে করতে পার।’
কাত করলাম বোতলটা, আমার গলা দিয়ে ধীরগতিতে হুইস্কি গড়িয়ে নেমে যেতে লাগল। চোখ বুজে আছি, তারিয়ে তারিয়ে তাত আস্বাদন করছি। টেবলের ওপাশে বসে পুরো প্রক্রিয়াটা ও লক্ষ করে।
‘প্রশ্নটা অদ্ভুত মনে হতে পারে,’ বলল, ‘কিন্তু ছুরি সম্বন্ধে কি তোমার কোন জানাশোনা আছে?’
‘ছুরি?’
‘ছুরি। শিকারের ছুরি আরকি।’
ক্যাম্পিংয়ে ছুরি ব্যবহার করেছি, বললাম ওকে, তবে ওগুলো সম্পর্কে তেমন বেশিকিছু জানি না। এতে ও হতাশ হয়েছে মনে হল। তবে বেশি সময়ের জন্য না।
‘সমস্যা নাই, বলল। ‘আমার একটা ছুরি আছে যেটা তোমাকে দেখাতে চাইছিলাম। মাসখানেক আগে একটা ক্যাটালগ থেকে কিনেছি। কিন্তু ছুরি সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণাও নেই। জানি না জিনিসটা কাজের নাকি পয়সা পানিতে ফেলেছি। তাই চাইছিলাম কেউ জিনিসটা দেখে বলুক তারা কী ভাবছে। তোমার যদি আপত্তি না থাকে।’
‘না। কোন আপত্তি নেই,’ বললাম ওকে।
সন্তপর্ণে পকেট থেকে পাঁচ ইঞ্চি দীর্ঘ, সুন্দর বাঁকান একটা বস্তু বের করল ও, টেবলে রাখল।
‘ভয় পেয়ো না। আমি এটা দিয়ে অন্যকে, বা নিজেকে আঘাত করার মতলব আঁটছি না। হঠাৎ একদিন মনে হল, আমার একটা ধারাল ছুরি থাকতে হবে। একটা ছুরির জন্য মারা যাচ্ছিলাম আমি। ব্যস, এটুকুই। তাই কয়েকটা ক্যাটালগ দেখে একটার ফরমায়েস দিই। আমার সঙ্গে সবসময় ছুরিটা থাকে কেউ জানে না — এমনকি আমার মাও না। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে জানলে।’
‘এবং আমি কাল টোকিওর উদ্দেশে রওনা হচ্ছি।’
‘ঠিক,’ বলল ও, স্মিত হাসল। হাতে তুলে নিল ছুরিটা, একমুহূর্তের জন্য ওটাকে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দিল তালুতে, এভাবে ওজন পরীক্ষা করছে যেন বিষয়টা তাৎপর্যমণ্ডিত। তারপর টেবলের এপাশে আমার দিকে ঠেলে দিল ওটা। আসলেই অদ্ভুত ওজন ছুরিটার –যেন নিজের ইচ্ছাশক্তি আছে এরকম একটা সপ্রাণ বস্তু ধরে আছি। পেতলের হাতলে বসান কাঠের বাঁট, ঠাণ্ডা ধাতব একটা বস্তু, যদিও জিনিসটা সারাক্ষণ ওর পকেটেই ছিল।
‘খোল ফলাটা।’
বাঁটের ওপরের অংশে একটা গর্তে চাপ দিয়ে ভারী ফলাটা খুললাম আমি। খাপখোলা অবস্থায়, তিন ইঞ্চির মত দীর্ঘ। ফলা বের করায় ছুরিটা আরো ভারী মনে হয়। শুধু ওজনটাই আমাকে বিস্মিত করেনি; ছুরিটা যেমন নিখুঁতভাবে আমার তালুতে এঁটে গিয়েছিল সেটাও করেছিল। বারকয়েক চারপাশে ঘোরাতে চেষ্টা করলাম ওটা, ওপরে এবং নিচে, এপাশ থেকে ওপাশে, আর ওই নিখুঁত ভারসাম্যের কারণে, যাতে হাত পিছলে না যায় সেজন্য, জিনিসটাকে কখনই আমার শক্ত করে ধরতে হয়নি। বাতাস কাটতেই, ইস্পাতের ফলাটা, রক্ত ঝরার তীক্ষ্মধার খাঁজসহ, একটা খাস্তা বক্ররেখা তৈরি করল।
‘যেমনটা বলেছিলাম, ছুরির ব্যাপারে আমি তেমন কিছু জানি না,’ বললাম, ‘তবে এটা দুর্দান্ত একটা ছুরি। ধরেও ভারি আরাম।’
‘কিন্তু শিকারের ছুরি হিশেবে জিনিসটা কি ছোট না?’
‘জানি না,’ বললাম। ‘মনে হয় তুমি কী জন্য ব্যবহার করছ তার ওপর নির্ভর করছে।’
‘সেটাই,’ বলল ও, তারপর এভাবে মাথা দোলাল কয়েক বার যেন নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইছে।
ফলাটা হাতলে ভরে জিনিসটা ফেরত দিলাম ওকে। যুবক ওটা খুলল আবার, ক্ষিপ্রহাতে ছুরি ঘোরাল একবার। তারপর, যেন রাইফেলের নিশানা করছে, বন্ধ করল এক চোখ, ছুরিটা সোজা পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাক করল। ফলায় চাঁদের আলো ঠিকরে মুহূর্তের জন্য ওর মুখের একপাশে ঝলকে উঠল।
‘আমার একটা উপকার করতে পারবে,’ বলল ও। ‘এটা দিয়ে কাটতে পারবে কিছু?’
‘কিছু কাটব? কী সেটা?’
‘যা ইচ্ছা। যা-ই আছে আশেপাশে। আমি স্রেফ কিছু একটা কাটতে চাই। আমি এই চেয়ারে বন্দি, ফলে আমার কাটাকাটির তেমন সুযোগ নেই। আমি সত্যিই খুশি হব তুমি যদি কিছু একটা কাট আমার হয়ে।’
না করার মত কোন কারণ খুঁজে পেলাম না, তাই ছুরিটা তুলে অদূরের একটা পামগাছের গোড়ায় কয়েক ঘা বসিয়ে দিলাম। কোনাকুনি পোঁচে বাকল কাটলাম। এরপর পুলের কাছেই পড়ে থাকা একটা স্টাইরোফোমের কিকবোর্ড তুলে নিলাম, ওটাকে দু টুকরো করলাম। যা অনুমান করেছিলাম ছুরিটা তার চাইতে ধারাল।
‘দারুণ ছুরি,’ বললাম।
‘হাতে বানান,’ বলল যুবক। ‘দামিও।’
ওর অনুকরণে ছুরিটা চাঁদের দিকে তাক করলাম আমি, একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম ওটার দিকে। আলোয়, জিনিসটাকে মাটি ফুঁড়ে বেরোন কোন হিংস্র লতাগুল্মের শাখার মত দেখায়। এমন কিছু যেটা শূন্যতা আর অমিতাচারকে যুক্ত করেছে।
‘আরো কিছু কাট,’ অনুনয় করল ও।
নাগালে যা কিছু পেলাম তার উদ্দেশে ছুরি চালালাম। ভূপাতিত নারকেলের দিকে, ক্রান্তীয় লতাগুল্মের অতিকায় পাতাগুলির দিকে, বারের প্রবেশপথে লটকান মেন্যুর দিকে। সৈকতে ঢেউয়ের রেখে যাওয়া গুটি কতক কাঠের গুঁড়িতেও কোপ বসালাম। যখন কাটার মত কিছুই অবশিষ্ট রইল না আর, তখন ধীর ও সতর্ক পায়ে চলতে শুরু করলাম, যেন তাই চি করছি, ছুরি দিয়ে নিঃশব্দে রাতের বাতাস কাটছি। কোন কিছুই আমার পথ আটকে নেই। রাত গভীর, সময় সুনম্য। পূর্ণিমার আলো সেই গভীরতায়, সেই সুনম্যতায় বাড়তি মাত্র যোগ করেছে মাত্র।
বাতাসে ঘাই মারতে মারতে, সহসা সেই স্থূলাঙ্গী, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের প্রাক্তন বিমানবালার কথা মনে পড়ল। দেখতে পাই ওর পাণ্ডুর, স্ফীত মাংসপিণ্ড ভেসে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে, নিরাকার, ফিকে কুয়াশার মত। সবকিছু রয়েছে ওই কুয়াশার ভেতর। ভেলা, সমুদ্র, আকাশ, হেলিকপ্টার, পাইলট। ওগুলোকে দ্বিখণ্ডিত করতে চেষ্টা করলাম আমি, কিন্তু ভুল হল দূরত্ব হিশেবে, সবকিছুই আমার ছুরির অগ্রভাগের নাগারের বাইরে রয়ে গেল। এর সবকিছুই কি বিভ্রম ছিল? নাকি আমিই হলাম সেই বিভ্রম? হয়ত এতে কিছুই যায় আসে না। আগামীকাল এলেই, আমি আর এখানে থাকছি না।
‘মাঝে মাঝে এই স্বপ্নটা দেখি আমি,’ হুইলচেয়ারে বসা যুবক বলল। ওর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক প্রতিধ্বনি, যেন কোন গহিন গহ্বরের অতল থেকে উঠে আসছে। ‘আমার মাথার নরম অংশে একটা ধারাল ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, যেখানে স্মৃতি থাকে। গভীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওটা। আমাকে ব্যথা দিচ্ছে না বা ভারাবনত করছে না — কেবল গেঁথে আছে ওখানে। আর আমি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছি, যেন ওটা অন্য কারো বেলায় ঘটছে। আমি চাইছি ছুরিটা কেউ টেনে বার করুক, কিন্তু কেউ জানে না ওটা আমার মস্তিষ্কের ভেতরে গেঁথে আছে। এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত। আমি নিজেকে আঘাত করতে পারি, কিন্তু বের করে নেয়ার জন্য ছুরিটার নাগাল পাই না। আর তারপর সবকিছু মিলিয়ে যেতে শুরু করে। আমিও ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করি। শুধু ছুরিটাই সবসময় রয়েছে ওখানে — একবারে শেষ অবধি। সৈকতে পড়ে থাকা কোন প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর হাড়ের মত। আমি ঠিক এই ধরনের স্বপ্ন দেখি।

অনুবাদরওশন জামিল