দুঃখের দুঃস্বপ্ন ছুঁয়ে

শহরটা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। ভালো-মন্দের ভেদ নেই। মানুষের প্রতি এ শহরটা যেন ভারী বিরক্ত। মাঝে মাঝেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের ছেলেপুলে। অথচ সারাটা দিনজুড়ে কী ভীষণ কাজের তাড়া। রাস্তাজুড়ে ব্যস্ত কর্মযজ্ঞে। এক টুকরো ঢিলের জন্যও জায়গা ছেড়ে দেয় না। এরই মাঝখান দিয়ে রিকশা, সিএনজি, বাস, অফিস-আদালতে ছুটতে থাকা গাড়ি, বড় বড় বাস, সবই চলছে। থামছে, আবার চলছে, কিন্তু বড় কষ্টে।
কপাল খারাপ থাকলে ঘণ্টাভর অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাস্তায় বসে থাকা অবধারিত। এভাবেই চলছে।
স্কুল থেকে ফিরে ব্যাক প্যাকটা টপ করে টেবিলে রেখে হুড়মুড় করে জুতো জামা বদলে নেয় বাড়ির আদরের মেয়েটা।
_তিথি, তোমার খাবার নিয়ে কতক্ষণ বসে আছি জান না? তাড়াতাড়ি এসো খাবে।
মায়ের বকুনি শুনে চটপট করে খেতে বসল তিথি। পাড়ায় অজস্র বাড়িঘর, ফুটপাত ছুঁয়ে। জায়গা নেই। ঘেঁষাঘেঁষি, লাগালাগি ভাড়াটে বাড়ি। সদর দরজা ঘেঁষে ফুটপাত, বেরিয়েই সামনে বড় রাস্তা। নিত্যনতুন মেরামতি চলছে রাস্তাজুড়ে। ওরই মধ্যে পাড়ার ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে বেড়ায়।
এ রাস্তাটার ব্যস্ততা কমে না। জীবনের চলমান স্রোত বাচ্চাদের নিত্য অভ্যাসের ব্যাপার। তবুও একদিন হঠাৎ থেমে গেল সব। খেলায় মেতে ওঠা শিশুরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অথচ একটু আগেও তো এখানেই শোনা যাচ্ছিল অনেক কটি গলার ঢেউ তোলা খেলুড়ে উল্লাস। কিন্তু আজ কী হলো হঠাৎ? কিছু লোক হায় হায় করে ছুটে এলো ফুটপাতের খেলার হুল্লড়ের কাছে। কিছু দিন আগে এলাকায় উন্নয়ন কম হয়ে গেছে। বড় বড় পাইপ সোজা বসিয়ে দিয়ে একটা চৌবাচ্চার মতো গড়ে নিচের আন্ডারগ্রাউন্ডের ড্রেনের সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। শুধু চৌকানা সিমেন্টে বাঁধানো চৌবাচ্চার ওপর একটা ভারী সস্নাব আর বসানো হয়নি। এর পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? কিছুই না। কিন্তু বাচ্চারা খেলার মাঝখানে চৌবাচ্চায় পড়ে যেতে পারে। তখন কী হবে? পাকা চৌবাচ্চার মাঝখানে যে একটা পেল্লায় লোহার মুখ খোলা পাইপ দাঁড় করানো রয়েছে। জেহাদ নামের তিন বছরের শিশুটা যে খেলার মধ্যে ওটার মধ্যেই পড়ে গেল! তার চিৎকার আর কান্নায় সবাই ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ল। ডাক পুলিশকে ডাক ফায়ার সার্ভিসকে। টেলিভিশন ক্যামেরা আর সংবাদকর্মীরা কেউ পিছিয়ে নেই। কেউ বলে একটু আগে বাচ্চার গলা শোনা গেছে। কেউ বলে দড়ি বেঁধে কোমল পানীয় দেয়া হয়েছে। নানা রকম কৌশল। আর তোড়জোড়। ঘরে বাইরে, ঘরে ঘরে শিশুটির জন্য ব্যাকুলতা। কিভাবে তাকে জীবন্ত তুলে আনা হবে, তাই নিয়ে সবাই উদগ্রীব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এত প্রচেষ্টা চালিয়েও শিশুকে তুলে আনার উপায় কেউ খুঁজে পেল না। প্রায় ছয় ঘণ্টার পরে সাভার থেকে দুই যুবক এলো। তাদের নিজেদের তৈরি একটি লোহার পাতলা বাক্স, সঙ্গে টেনে আনার জন্য হুক আর সরু তার। না যথেষ্ট যুদ্ধ চালিয়েও প্রথমে তারা বাচ্চাকে উদ্ধার করার অনুমতি পায়নি। পরে অনুমতি পাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে ওরা দুজন লোহার পাইপের মধ্যে খাঁচাটা পাঠাতে পারল। মৃত শিশুটিকে শেষ অবধি উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। সন্তান হারানো পরিবারের যে কান্না তা আর কোনো দিন থামবে না।

এ বছরের প্রবল বৃষ্টি আর তার হাত ধরে এসেছে বন্যা। দেশের একটা বিশাল অংশে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৈরি করেছে মৃত্যুর ফাঁদ। রোগ এবং শোক। এ সংকট যেন কোনোমতেই মুক্তি দেবে না। কিন্তু মানুষকে তো বাঁচাতেই হবে। যেমন করেই হোক। মানুষ মানুষের জন্য, এ কথা মনে রেখে বাঁচার চেষ্টায় সহায়তা দিতে হবে।
তাই তো আমরা কান্না ভুলে ক্ষেত-খামারের কাছে ফিরে যাই। প্রতিদিনের সূর্যকে বলতে চাই, ‘আমরা মানুষ’।
কিন্তু ওইযে বলেছিলাম, এ শহর ক্ষুধার্ত, প্রতিশোধে মলিন এ দেশের মাটি। অশ্রুজলে, পরাজয়ের গ্লানি মিশে আছে এ দেশের মাটিতে। মাঝে মাঝে জানান দেয়। ঠিক যেমন একদিন চোখে পড়ে যায় শিশুদের নিয়ে নির্মমতা। আমরা যাদের একসময় ডাকতাম টোকাই বলে। কাগজ কুড়িয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে একসময় তাদের চিন্তার বদল হলো। চায়ের দোকানে, কারখানার ছুটকো কাজে মনিহারী দোকানপাটে ফুটফরমাশ খাটে রাজীব রাকিবের মতো নিম্নবিত্ত কিশোর। তখন তাদের গায়ে ওঠে গেঞ্জি আর প্যান্ট। একসময় মালিক আবিষ্কার করেন দোকান থেকে সবজি চুরি করেছে রাজীব। কোনোমতেই তাকে নির্দোষ বলে বিশ্বাস করেননি তার প্রভু। বেধড়ক প্রহার করে আধমরা করে ফেলার পরে অন্য লোক, পাড়া-প্রতিবেশী মিলে তাকে কোনোমতে রক্ষা করে। তার জীবন কোনোমতে বেঁচে যায়। তবে তার মতোই আর একটি কিশোর যার নাম রাকিব সেও চুরি বা ফাঁকি দেয়ার অপরাধে ভীষণ শাস্তি পায়। তার পেছনে গ্যাসপাইপ ঢুকিয়ে তার শরীরের যন্ত্রপাতিগুলো সব ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়। সে তার শোকার্ত মাকে বলেছিল, ‘আমারে লইয়া যাও, আমি বাঁচুম না।’ কিন্তু বোধগম্য নয় প্রভুদের নিষ্ঠুরতা। আমি কেন যেন অনুভব করি আমাদের এ দেশটা কেন যেন, কোনো কার্যকারণবশত হিংস্র আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। বিশাল বিশ্বের সদস্য আমরা বার বার গার্মেন্ট কারখানাগুলোয় আগুন লাগতে দেখি। সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে নারী কর্মীরা নামতে গিয়ে পদদলিত হয়েও মারা যান। অন্য একটির বাইরের সিঁড়ির দরজায় তালা দেয়া ছিল বলে মেয়েরা আটক পড়েন এবং প্রাণ হারান।
আমাদের দেশ সুন্দর শ্যামল একটি মায়াময় দেশ। এ দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছে আমাদের দেশের ছেলেরা। সেই মুক্ত স্বদেশকে ঘিরে কত স্বপ্ন আর সাধ ছিল আমাদের।
কিন্তু সেই সাধের কল্পনার ওপরে মাঝে মাঝেই ছিটকে ওঠে রক্তস্রোত। স্বার্থপর পৃথিবী থেকে আমাদের ভেতরেও জেগে ওঠে হিংসা, লোভ আর মৃত্যু। দুর্বল, আত্মরক্ষায় পটু হয় না কিশোরের দল। এ লেখা যখন লিখছি, মনে পড়ছে সদ্যমৃত আরেক শিশুর কথা। তাকে পেটের ওপর মোটা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। মনে হয় মানুষের মনের মধ্যে বাস করে এক শ্বাপদ। সে শ্বাপদ দুর্বল শিশুদের দেখে প্রহারে জর্জরিত করে। নিষ্ঠুর আঘাতে শিশুর দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়, তা দেখে হয়তো বড় বড় মানুষ অধিকারবোধ থেকে অদ্ভুত আনন্দ পায়। ক্ষমতার বীরত্ব নিয়ে দুর্বলের ওপর অত্যাচারই তাদের আনন্দের কারণ।
কিন্তু সমাজে যারা শান্তি, ধৈর্য এবং সুস্থ জীবনের কথা বলেন, তারা তো অনুভব করেন জীবন মূল্যবান, তাকে রক্ষা করতে হবে। চেষ্টা তো করছেন সবাই। তবুও অন্যকে অত্যাচার করে তৃপ্তি পাওয়ার পাশবিকতা থেকে এ সমাজের মুক্তি কোথায়? বলছিলাম, আমাদের শহরটার প্রচ- ক্ষুধা বড় কষ্টদায়ক। এখানে মাঝে মাঝেই মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে এক অচেনা দানব। সে দানব যেন নিজের ক্রোধ আর বিদ্রোহ ধীরে ধীরে নানা ছদ্মবেশে ঘিরে ধরেছে আমাদের সহজ সরল মানুষকে। মনুষ্যত্ব যেন একটি অপরিচিত শব্দ এখন। সারা বিশ্বের মানুষ অধিকারবোধের আনন্দ থেকে তৈরি করে দেশে দেশে মানুষ হত্যার উৎসব। একসময় ছিল ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, মিয়ানমার। তারপর এলো সার্বিয়া, চেচনিয়া, তারপর ইরান-ইরাক, আফগানিস্তান, তুরস্ক, সিরিয়া। বিগত দিনগুলোর পলায়মান অভিবাসীদের দীর্ঘ মিছিল এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপের দেশগুলোয়। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, হাঙ্গেরির নানা অঞ্চল। অথচ এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? দুঃখ শুধু এইখানে যে, নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যই নানা উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করে, মানুষ এখন ড্রোন নামের ছোট ছোট মারণাস্ত্র বানাচ্ছে।, রাসায়নিক অস্ত্র, জীবাণুবাহিত অস্ত্র তৈরি করছে। কাদের মারার জন্য? রক্ত-মাংসের মানুষের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য।
আমরা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে কোনো স্মৃতিচারণ পড়ি, তখন মানুষের রক্ততৃষ্ণার হিংস্র চেহারা দেখে অাঁতকে উঠি। মানুষ কি প্রকৃত অর্থে মানুষ, নাকি তার ভেতরে তৈরি হয়েছে মহাধ্বংসযজ্ঞের আলোড়ন। মানুষের জীবন যদি প্রত্যক্ষ করি, দেখব এ মায়াময় পৃথিবী কত যত্নে গড়ে তুলেছ তার মাটির সন্তানদের। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশে দেশে রক্তাক্ত হয়ে কত জনপদ পৃথিবীর মধ্যে ধুঁকছে।
তার মধ্যে আমাদের এ প্রিয় দেশে আচমকা দেখা দিচ্ছে হত্যার হোলিখেলা। সবাইকে অহমিকা যখন পেয়ে বসে, তখন তার বিচার করার সুযোগ ইচ্ছা, কোনোটাই দেখা দেয় না।
প্রতিদিনের সংবাদ পড়লে অন্তত দু-তিনটি কিশোর হত্যার খবর থাকবেই।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাশবিক নির্মমতা এসে কিভাবে প্রবেশ করেছে, তার কোনো জবাব বা কৈফিয়ত দেয়ার বালাই নেই। সদ্যোজাত সন্তানকে, ঘুমন্ত সন্তানকে অথবা স্ত্রীকে অনায়াসে গুপ্তহত্যা করে ফেলে পালায় হিংস্র মানুষেরা।
কেন এত নির্মমতা আপন পরিবারের মধ্যে? তাই বলছি, ব্যথিত হৃদয় এসব ভয়াবহ ঘটনার বিচার চায়।
শুনতে পাই কারা যেন নেশার ওষুধ এনে তারুণ্যকে বশ করে নেয়। ঘরে ঘরে বেদনার্ত মানুষ বেড়েই চলেছে। প্রতিটি অপরাধের কঠিন শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। সত্যিকার ঘটনাগুলো ভয়াবহতায় জটিল। কিছু মানুষ, শিশু-কিশোরদের নিয়ে চেষ্টা করে চলেছে। মানুষ দেশের নানা সমস্যায় বিধ্বস্ত।
তাই বলছিলাম, মানুষ বুঝুক না বুঝুক, নীতিহীনতার, লোভ, ঈর্ষা মানুষকে ছেড়ে যেতে পারে না। এই নাম-পরিচয়হীন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার প্রতিরোধ চাই। সমস্ত সমাজ একসঙ্গে কাজে নামতে হবে। ক্ষুধার্ত মানসিকতায় যেন আমরা আক্রান্ত না হই। বাংলাদেশ বহু ধরনের যুদ্ধজয় করেছে। ভাষার লড়াই, স্বাধীতার জন্য লড়াই করে তবেই সে সূর্যের মুখোমুখি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে মাঝে মাঝে রক্তস্রোত বয়ে যায়। চিরপ্রতিবেশীও অচেনা হয়ে যায়।
আমি জানি, আমার মতো এ দেশের সব মানুষই অন্যায় যুদ্ধের চাপে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কত দেশপ্রেমিক, সৎমানুষ কত বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি আজ।
গভীর দুঃখে লক্ষ্য করি অন্যায়ে ভাসছে দেশ। তবুও এ দেশের পরিশ্রমী মানুষের সব ভালোবাসা এ ক্ষুদ্র দেশটিকে কেন্দ্র করেই।
আমার মনে হয়, সব প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হবে আমাদেরই। এ দেশের ঘরে ঘরে দীর্ঘশ্বাস ও অন্যায় আবর্জনা অথচ ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ও অশ্রু লাঞ্ছিত ইতিহাসের স্মৃতি। যদি দেশকে ভালোবাসি, তবে এ বিরূপ অন্ধকারের বিষাদের অন্তরাল ছিন্ন করে আবার যুদ্ধ করতে হবে। সে যুদ্ধে জয়ী আমাদের হতেই হবে।