ক্যাঙ্গারু দেখার দিন

image_1312_326337বেষ্টনীর ভেতরে চারটি ক্যাঙ্গারু ছিল। একটা পুরুষ, দুটো মেয়ে আর একটা নবজাতক শিশু ক্যাঙ্গারু। বাইরে বেষ্টনীর ঠিক সামনে শুধু আমি আর আমার মেয়ে ছিলাম। চিড়িয়াখানাটা খুব একটা বিখ্যাত ছিল না।
এটা ছিল সোমবার সকাল। পশুপাখি দর্শকের সংখ্যাও ছিল সীমিত। আমাদের মূল দৃষ্টি ছিল ক্যাঙ্গারু শিশুটির ওপর। অন্যকিছুর ওপর দৃষ্টি দিতেও আমরা তেমন আগ্রহী ছিলাম না।
সংবাদপত্রের স্থানীয় খবরে আমরা জানতে পারি, মাসখানেক আগে একটা ক্যাঙ্গারু জন্ম নিয়েছে। ফলে ক্যাঙ্গারু শিশুটিকে দেখতে আমরা দু’জন এক মাস ধরেই একটা সুন্দর সকালের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
এক সকালে দেখা গেল খুব বৃষ্টি হচ্ছে। পরদিন সকালেও ছিল একই অবস্থা। তার পরদিন মাটি খুব কাদা হয়ে যাওয়ায় বাইরে যেতে পারলাম না।
এর পরের দু’দিন টানা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল। খুবই বিরক্তিকর অবস্থা। এরপর মেয়েটার পেটে ব্যথা, আমার কাজের ভীষণ চাপ_ এভাবেই এক মাস পার হয়ে গেল।
কীভাবে যে একটা মাস হারিয়ে ফেললাম! যখন চিন্তা করি এই সময়ে কী ঘটেছিল_ কিছু মনে করতে পারি না। আমার মনে হয়, আমি অনেক কাজ করেছি। আবার যখন ভাবি, তখন দেখি কিছুই করিনি।
মাস শেষে সংবাদপত্রের ছেলেটা যখন পত্রিকা সংগ্রহ করতে এলো_ তখনই আমি বুঝতে পারলাম, একটা মাস পার হয়ে গেছে। যাই হোক, অবশেষে ক্যাঙ্গারু শিশু দেখার সুন্দর একটা সকাল হাজির হলো। আমরা সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য আজকের দিনটাই সবচেয়ে চমৎকার। মুখ ধুয়ে সকালের নাশতা সেরে বিড়ালটাকে খাবার দিয়ে, কিছু কাপড় ধুয়ে রোদে নেড়ে দিয়ে আমরা ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য বের হলাম।
আমরা যখন ট্রেনে চড়লাম তখন আমার মেয়েটি বলল_ ‘শোনো, ক্যাঙ্গারু শিশুটিকে যদি আমি জীবিত দেখি, তাহলে খুব অবাক হব।’
_’হুম, আমার মনে হয় সে রকম হতে পারে। তবে এ রকম কিছু হলে সংবাদপত্রে একটা খবর পেতাম।’
‘আমি তোমার সঙ্গে বাজি ধরতে পারি, ক্যাঙ্গারু শিশুটি অসুস্থ আর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
_’এ রকম কিছু হলে সংবাদপত্রে নিউজ হতো।’
‘এটার হয়তো মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে।’
_’বাচ্চাটার?’
‘না। মা ক্যাঙ্গারুর। কারণ তারা হয়তো মা আর তার শিশুটিকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিল।’
_’মেয়েদের কথার সম্ভাবনার সীমানা দেখে আমি প্রায়ই খুব অবাক হই।’
‘আমার কেবল মনে হচ্ছে, আমি যদি ক্যাঙ্গারু দেখার এই সুযোগটা মিস করি তাহলে হয়তো আর কখনোই সেটাকে দেখতে পাব না।’
_’তুমি সত্যিই এ রকম মনে কর?’ ‘হ্যাঁ। তুমি কী মনে কর? তুমি কি এর আগে কখনও ক্যাঙ্গারু শিশু দেখেছ?’ _’না।’
‘এখন পর্যন্ত তুমি কি বিশ্বাস করছ যে, তুমি একটা ক্যাঙ্গারু শিশু দেখতে যাচ্ছ?’
_’আমি আসলে জানি না। কারণ এ রকম কখনও আগে ঘটেনি।’
‘এ জন্যই আমি একটু চিন্তিত।’
_’দাঁড়াও এক মিনিট। আমি তো আগে কখনও জিরাফের সন্তান হওয়া দেখিনি, এমনকি কোনো তিমি মাছেরও। তাহলে এই ক্যাঙ্গারুর ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?’
‘কারণ এটা ক্যাঙ্গারু শিশু।’ _মেয়েটা বলল।
_আমি হাল ছেড়ে দিলাম। পত্রিকার ওপর চোখ বুলালাম।
ক্যাঙ্গারু শিশুটি অবশ্য বেঁচে এবং সুস্থ ছিল। বাচ্চাটিকে [সেটি হয়তো ছেলে কিংবা মেয়ে] পত্রিকার ছবিতে যেমন দেখাচ্ছিল, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি বড় লাগছে। মায়ের পাশে তাকে খুব উৎফুল্ল আর শক্তিশালী মনে হচ্ছে।
একটা ছোট্ট ক্যাঙ্গারুর মতো তাকে মোটেই মনে হচ্ছে না। এ বিষয়টাই আমার মেয়েকে একটু হতাশ করল।
_’এটা দেখতে মোটেই বাচ্চা মনে হচ্ছে না।’
‘এটা আসলেই দেখতে একটা বাচ্চার মতোই মনে হচ্ছে।’ _আমি তাকে আবারও আশ্বস্ত করলাম।
_’আমাদের খুব শিগগির আবারও আসা উচিত।’
আমি ছোট্ট একটা দোকানে গিয়ে চকোলেট আইসক্রিম কিনে মেয়েটার কাছে ফিরে এলাম। দেখি, সে তখনও বেষ্টনীর ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে ক্যাঙ্গারুর দিকে স্থির তাকিয়ে আছে।
‘এটা কিছুতেই শিশু না।’ _সে আবারও বলল।
‘সত্যি?’ আমি তার কাছে গিয়ে আইসক্রিমটা দিয়ে বললাম।
‘এটা যদি শিশুই হতো, তাহলে সে তার মায়ের ঝোলার ভেতর থাকত।’
_’আইসক্রিমে মুখ দিয়ে আমি মাথা ঝাঁকালাম। কিন্তু এটা সে রকম নয়।’
আমরা অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম কোনটা মা ক্যাঙ্গারু।
বাবা ক্যাঙ্গারুটিকে আমরা দ্রুতই চিনতে পারলাম। সে ছিল অন্যগুলোর চেয়ে বেশ বড় এবং শান্ত।
বাকি দুটো দেখতে একই রকম, একই চাহনি, চলার ঢং_ সবকিছু। সে দুটো ছিল মেয়ে ক্যাঙ্গারু। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে কোনটা মা ক্যাঙ্গারু। বিষয়টা খুব হাস্যকর হয়ে উঠল।
_’তাহলে ওই দুটোর মধ্যে একটা মা ক্যাঙ্গারু আর একটা নয়।’ _আমি বললাম।
‘তুমি ঠিক বলেছ।’
_’তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো কোনটা মা ক্যাঙ্গারু নয়?’
‘আমি জানি না।’ _সে বলল।
যে কোনোভাবেই হোক বাচ্চা ক্যাঙ্গারুটা তার মায়ের প্রতি কোনো দুর্বলতা না দেখিয়ে মাঠের চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সামনের পায়ের খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। বাচ্চাটা ছেলে কিংবা মেয়ে হতে পারে। সে তার বাবার চারপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, তারপর মাটিতে শুয়ে থাকল, আবার উঠে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ দৌড়াল।
‘ক্যাঙ্গারু কেন এত জোরে জোরে লাফিয়ে চলে?’ _মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
_’তার শত্রুদের কাছ থেকে সে দূরে থাকতে চায়।’
‘শত্রু? কী ধরনের শত্রু?’
_’মানুষ।’ _আমি বললাম। ‘মানুষ ক্যাঙ্গারুকে মেরে তাদের মাংস খায়।’
‘বাচ্চা ক্যাঙ্গারুগুলো কেন মায়ের ঝোলার ভেতর থাকে?’
_’যাতে তারা একসঙ্গে দৌড়াতে পারে। বাচ্চারা অত জোরে দৌড়াতে পারে না।’
‘ও, এটা তাহলে তাদের রক্ষা করার জন্য এমন করে?’
_’হ্যাঁ।’ আমি বললাম। ‘সবাই তাদের শিশুকে রক্ষা করতে চায়।’
‘তারা কতদিন এইভাবে রক্ষা করবে?’
_ক্যাঙ্গারু বিষয়ে প্রায় সব রকম তথ্যই আমি আগে জেনে নিয়েছিলাম। _’এটা এক কি দুই মাস হতে পারে।’
‘তাহলে ওই ক্যাঙ্গারুটার বয়সও এক মাস। সে নিশ্চয়ই তার মায়ের ঝোলার ভেতর এখনও থাকতে পারে?’
আমি বললাম, ‘হতে পারে।’
‘না, অবশ্যই এটা হবে।’
সূর্যের আলো বেশ তীব্র হয়ে উঠছে। পাশেই পুকুরের কাছে বাচ্চাদের খেলাধুলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। খুব নিচ দিয়ে মেঘের দল উড়ে যাচ্ছিল।
_’তুমি কিছু খাবে?’ _আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘একটা হটডগ আর কোক।’ _সে বলল।
এক কলেজছাত্রী হটডগ বিক্রি করছিল। তার বক্সের পাশ থেকে মিউজিকের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি যখন হটডগ নিয়ে ফিরে এলাম তখন আমার মেয়ে একটা মেয়ে ক্যাঙ্গারুর দিকে ইশারা করে বলল, ‘দেখো, ওই ক্যাঙ্গারুটা তার বাচ্চাকে নিজের ঝোলার ভেতর নিয়েছে।’
সত্যিই তাই। আমি তাকিয়ে দেখলাম বাচ্চা ক্যাঙ্গারুটা তার মায়ের ঝোলার ভেতর বসে আছে। ওপর থেকে কেবল বাচ্চাটার কান দেখা যাচ্ছে।
‘আমার ধারণা বাচ্চাটা বেশ বড়।’
_’ক্যাঙ্গারুরা খুব শক্তিশালী হয়।’
‘সত্যি?’
_’এ জন্যই তারা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে।’
মা ক্যাঙ্গারুটা রোদের তীব্র আলোতে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মাথা থেকে এক ফোঁটা ঘামও ঝরে পড়ছিল না। তাকে দেখে আমার এক মায়ের কথা মনে পড়ে গেল; যিনি একটা দোকানে গিয়ে কিছু কিনে একটা কফির দোকানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
‘কেননা, তারা তাদের শিশুদের যত্ন নেয়?’
_’হ্যাঁ, ঠিক তাই।’
‘বাচ্চাটাকে যদি ঘুমাতে দেখি তাহলে আমি খুব অবাক হব।’
_’হতে পারে।’
হটডগ আর কোক খেয়ে ক্যাঙ্গারুর খাঁচার সামনে খাওয়ার কিছু ঝুলিয়ে রাখলাম। চলে আসার সময় দেখলাম পুরুষ ক্যাঙ্গারুটা খাওয়ার বক্সের সামনে তখনও কিছু খাবার খুঁজছে।
মা ক্যাঙ্গারুটা বাচ্চাটাকে তার ঝোলার ভেতর ভরে একসঙ্গে চুপচাপ বসে আছে। অন্য মেয়ে ক্যাঙ্গারুটা খাঁচার ভেতর লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। মনে হয় সে তার লেজের শক্তিটা পরীক্ষা করছিল।
দীর্ঘদিন পর খুব লম্বা একটা উষ্ণ দিন আমরা দু’জন একসঙ্গে কাটালাম।
‘তুমি কি বিয়ার খেতে যাবে?’ _মেয়েটা আমাকে বলল।
‘খুব ভালো।’ _আমি বললাম।

লেখক পরিচিতি :হারুকি মুরাকামিকে ২০১২-এর সাহিত্যে সবচেয়ে সম্ভাব্য নোবেল জয়ী বলে মনে করা হচ্ছে। ‘বরফমানব’ হারুকির ‘আইসমেন’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি তাঁর সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন’ গ্রন্থের। গল্পগুলো ১৯৮১-২০০৫-এর মধ্যে লেখা। ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গল্পগ্রন্থটি লিখে হারুকি মুরাকামি বলেন, উপন্যাস লেখা আমার কাছে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ। সে তুলনায় গল্প খুব স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। কারণ উপন্যাস লেখা হলো বিশাল একটা বন তৈরি করা। আর গল্প হলো ছোট্ট শৌখিন বাগান তৈরির মতো। জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯-এ জাপানের কিয়োটয়। এ গল্পটি ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
ভাষান্তর: রাফিক হারিরি