সাড়ে তিন হাত ভূমি

বোনটি
১৪.
বকুল, ওই যে বছরে একবার বাঁধা জ্বর হতো তোর, সে কথা তোর মনে আছে!
চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে?
তখন স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি হয়ে যেত! আমাদের বাড়ির বৈশাখী আমগাছগুলোতে পাকতে শুরু করত আম।
বৈশাখী আম মানে বৈশাখ মাসে যে আম পাকে?
দাঁড়কাক, পাতিকাক- দুই রকমের কাকই পাকা আমে ঠোকর দিত। দু-এক ঠোকর হয়তো খেতও। আম পাকতে শুরু করলে বোঁটা নরম হয়। কাক-পাখির ঠোকরে বোঁটা আলগা হয়ে পাকা আম পড়ে যেত তলায়।
আমরা কুড়ুতে যেতাম।
তুই, আমি। তুই তখন বেশ ছোট। তাও আমার সঙ্গে যেতি। বারেক পালিয়ে যাওয়ার আগে সেও যেত।
বৈশাখী আম পাকতে শুরু করেছে, এটা আসলে আমাদের জানিয়ে দিত বাড়ির কাকগুলো। আমতলায় হলুদ রঙের আম পড়ে থাকতে দেখলেই তুই আর আমি লাফালাফি শুরু করতাম। সন্ধ্যাবেলা বারেক বলত, কাইল বিয়ানে ম্যালা আম পাওয়া যাইবো। বৈশাখী আমগাছের বেবাক আম পাইকা গেছে!
বাড়িতে যেন একটা উৎসব শুরু হতো। বৈশাখের পর একে একে পাকত সব গাছের আম। আর তখনই হয়তো তুই জ্বরে পড়লি।
তোর জ্বরের কথা বলার আগে একটা মজার ঘটনা বলি। গ্রীষ্মের ছুটির ঘটনা।
যেদিন গ্রীষ্মের ছুটি হবে, সেদিন ক্লাস হতো না স্কুলে। ছাত্ররা সবাই দু-চার আনা পয়সা জোগাড় করে স্যারদের জন্য মালা বানাত। ছুটি ঘোষণার পর স্যারদের গলায় মালা পরিয়ে দিত।
মালাগুলো ফুলের না।
কিসের মালা?
মালা হচ্ছে বিস্কুটের।
কাঞ্চনপুর বাজারে এক ধরনের গোল গোল খুব মিষ্টি বিস্কুট পাওয়া যেত। রমেশ মুদির দোকানে টিনভর্তি থাকত সেই বিস্কুট।
বিক্রমপুরের ভাষায় মুড়ি কিংবা বিস্কুটের ওই ধরনের টিনকে বলে ‘জের’। রমেশের জের ভরা থাকত ওই বিস্কুট।
নাম যেন কী ছিল বিস্কুটটার?
না, মনে পড়ছে না।
‘কুকিচ’ নামের একটা বিস্কুটের কথা মনে পড়ছে। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দেখতে। বেশ বড় সাইজের বিস্কুট। গ্রামের অনেকেই গোবিন্দর চায়ের দোকানে বসে এক কাপ দুধ-চিনি দেওয়া ঘন চায়ে কুকিচ বিস্কুট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেত।
বাড়িতে আমরাও অনেকবার খেয়েছি। বাবা কিনে আনতেন। অনেক সময় কদম গিয়েও কিনে আনত।
কী যে মজার কুকিচ বিস্কুট! চায়ে ভিজিয়ে একটা খেলেই পেট ভরে যেত। সকালের নাশতা হয়ে যেত।
কিন্তু ওই বিস্কুটটার নাম মনে পড়ছে না। গোল গোল মাঝারি সাইজের বিস্কুট। ছোট ছোট অনেক ছিদ্র বিস্কুটে। ওই ছিদ্র দিয়ে সুতা ঢুকিয়ে বিস্কুটের মালা বানাতাম আমরা। স্যারদের গলায় পরাতাম।
প্রতিটি ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই তাই করত।
এক আনা দু আনা যে যা পারে বাড়ি থেকে নিয়ে আসত। সব পয়সা একসঙ্গে করে হয়তো একটা টাকা হলো। এক টাকার বিস্কুটে তিন-চারটা মালা হয়ে যেত।
যাদের অবস্থা একটু ভালো, অর্থাৎ সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়ে, তারা কেউ কেউ সিকি (চার আনা, এক টাকার চার ভাগের এক ভাগ), কেউ আধলি (আট আনা, এক টাকার অর্ধেক) নিয়ে আসত। কোনো কোনো বছর দু-তিন টাকাও হয়ে যেত আমাদের। মালা বেশি বানানো যেত।
আমাদের ক্লাসে মোশারফ নামের একটা ছেলে ছিল। খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। কিন্তু বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো না ওদের। বাবা কৃষিকাজ করেন। ফসল ইত্যাদি বিক্রি করে, ক্ষেতের ধান, পুকুরের মাছ আর গোয়ালে দুটো গাই গরু, ওই দিয়ে সংসার চলে।
গ্রীষ্মের ছুটির দিনে এক-দু আনার বেশি পয়সা মোশারফ কখনো দিতে পারে না।
একবার সে এক টাকার পাঁচটা নোট নিয়ে হাজির। ক্লাসে ঢুকে বীরদর্পে বলল, এবার রমেশ মুদির দোকানের পুরা জের কিনা ফালামু। কুড়ি-পঁচিশটা বিস্কুটের মালা বানামু। একেক স্যারকে দুই-তিনটা কইরা মালা পরামু।
এটা ছুটির আগের দিনের ঘটনা।
পয়সাটা আমরা আগের দিনই তুলতাম। মালা বানিয়ে রাখতাম আগের দিন। পরদিন একসঙ্গে স্যারদের শুধু গলায় পরাব।
মোশারফের কথা শুনে আমরা অবাক।
বাচ্চু বলল, এত পয়সা আমরা কোথায় পাব?
বেবাক আমি দিমু।
আমি বিস্মিত। তুই!
হ। ক্যান, বিশ্বাস হয় না?
বাদল নামের একটা ছেলে বলল, না। তুই তো এক-দুই আনার বেশি দিতে পারছ না।
এইবার দিমু পাঁচ টেকা!
আমরা সমস্বরে বললাম, কী, তুই পাঁচ টাকা দিবি!
হ, দিমু। এই যে টেকা।
এক টাকার পাঁচটা নোট পকেট থেকে বের করল সে।
আমরা হতভম্ব হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। মোশারফের মতো ছেলে পাঁচ টাকা পেল কোথায়?
পাঁচ টাকা ওই বয়সে আমরা চিন্তাই করতে পারি না।
আমাদের মধ্যে বুলু একটু ট্যাটন টাইপের। বলল, ঘটনা কী রে মোশারফ? পাঁচ টেকা পাইলি কই?
কই পাইছি ওইটা জানবার তোর দরকার কী?
দরকার আছে।
কিয়ের দরকার?
তুই তো এক-দুই আনাও অনেক সময় দিতে পারছ না। এইবার পাঁচ টেকা। পাইলি কই?
আমার দুলাভাইয়ে দিছে।
কিছুদিন আগে মোশারফের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। গরিব গৃহস্থবাড়ির মেয়ের যেভাবে বিয়ে হয়, সে রকম বিয়ে। জামাই দর্জি। বিক্রমপুর এলাকায় দর্জিকে বলে ‘খলিফা’। খলিফার কাজ করে মোশারফের বোনজামাই। ঢাকার সদরঘাটে। দু-তিন দিন আগে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছে।
বজলু বলল, তোর দুলাভাই তোরে পাঁচ টেকা দিল?
হ, দিল। আমি একমাত্র শালা। কইলাম ইসকুলে মালা দিমু স্যারগো। কোনো দিন এক-দুই আনার বেশি দিতে পারি না। কোনো কোনো বছর ওই এক-দুই আনাও দেয় না বাবায়। দুলাভাই, আপনে আমারে এইবার একটা টেকা দেন। ইসকুলের বেবাকতেরে আমি একটু দেখাইয়া দেই আমার কলিজা কত বড়।
বুলু বলল, তোর কথা আমার বিশ্বাস হয় না।
আমি মিছা কথা কই না।
মনে হয় মিছা কথাই কইতাছস।
তয় আমি পাঁচ টেকা পাইলাম কই?
তুই তো দুলাভাইর কাছে চাইলি এক টেকা!
হ, এক টেকাই চাইছি। শুইনা সে কইলো, তুমি আমার একমাত্র শালা। তোমার মান-ইজ্জতের ব্যাপার। এক টেকা না, আমি তোমারে পাঁচ টেকা দিলাম। বেবাক মালা তুমি একলা দেও গিয়া। যাও।
বাদল বলল, খলিফা কামে এত টেকা রুজি হয়?
হয় বেডা, হয়। নাইলে দিল কই থিকা। আর প্যাঁচাইল পারিচ না। ল, বাজারে ল। বিস্কুট কিনা আনি। মালা বানাইয়া ফালাই। বিয়ানবেলা আর সময় পাওয়া যাইবো না।
বাজারের দিকে রওনা দেওয়ার আগে বুলু বলল, তোর কথা অহনও আমার বিশ্বাস হয় না, মোশারফ। আমার মনে হয়, টেকা তুই চুরি করছস!
শুনে বেদম খেপা খেপল মোশারফ। রেগে গেলে সে একটু তোতলায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল, দে দে দেখ বুইল্লা, আ আ আমারে যুদি চো চো চোর কছ, তয় ক ক কইলাম ঘুষা দি দিয়া তো তোর দাঁ দাঁ দাঁত আমি ভা ভাইঙ্গা ফা ফা ফালামু।
দুজনের মারামারি প্রায় লেগে যায়।
এইসব মারামারি সামলানোর ওস্তাদ বাচ্চু। সে দুজনকে থামাল। আমরা দল বেঁধে কাঞ্চনপুর বাজারে চলে গেলাম।
রমেশ মুদি জানে গ্রীষ্মের ছুটি শুরুর দিন তার ওই বিস্কুট কিনতে যাই আমরা। এ জন্য আগেভাগেই দীঘিরপাড় বাজার থেকে দু-তিন জের বিস্কুট পাইকারি দরে কিনে আনে সে।
সেবারও তা-ই করেছে।
মোশারফ তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলল, পুরা এক জের বিস্কুটের দাম কত, রমেশ কাকা?
রমেশ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, সেইটা জাইনা তোমার কাম কী? তোমরা কয় ছটাক নিবা সেইটা কও।
আমি পুরা জেরের দাম জানতে চাই।
ক্যান, পুরা জের কিনবা?
হ, কিনুম। আপনে দাম কন।
সাড়ে চাইর টেকা।
কিছু কম হইব না?
কত কম?
তিন টেকা।
না।
সাড়ে তিন টেকা।
না, চাইর টেকা হইলে দিমু।
দেন।
রমেশ মুদি হতভম্ব। সত্যই দিমু?
তয় কি মিছা নি?
রমেশের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মোশারফের কথা। সে ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকাল।
বুলু বলল, হ, দিয়া দেন। ওর কাছে টেকা আছে।
চার টাকা দিয়ে এক জের বিস্কুট মোশারফ কিনে ফেলল।
ও, জের সমন্ধে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মাথার ঠিক নেই তো, আগের কথা পরে, পরের কথা আগে এসে পড়ছে। জেরের তিন দিকে পাতলা টিন, পরিষ্কার সাদা টিন। অনেক সময় টিন আবার নীল রঙে রং করা থাকে। মুখের দিকটাও রং করা। তবে সামনের দিকে কাচ লাগানো। চকচকে পরিষ্কার কাচ। যেন বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় জেরে কী আছে।
পুরো জেরের বিস্কুট তারপর পাঁচটা ঠোঙায় বেঁধে দিল রমেশ। আমাদের একেকজনের হাতে একেক ঠোঙা।
বুলু বলল, আরো একটা টেকা তো রইয়া গেল রে মোশারফ?
হ, এক টেকা রইয়া গেছে।
এই টেকা কী করবি?
ল, জিলাপি খাই। সাধনের দোকানে বৈকালবেলা জিলাপি ভাজে। এক টেকায় বেবাকতে খাইতে পারুম।
বজলু বলল, তয় খাওয়া জিলাপি।
আমি কি না করছি। ল, যাই সাধনের দোকানে।
মোশারফের কাজকারবারে আমরা থ হয়ে আছি। বাচ্চু আর আমি প্রায়ই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।
এটা কী করে সম্ভব!
মোশারফের মতো ছেলেকে তার দুলাভাই দিয়েছে পাঁচ টাকা!
দর্জিগিরির কাজে পাঁচ টাকা তখনকার দিনে এক-দু দিনেও রোজগার করা যায় না। আর শ্যালককে পাঁচ টাকা দিয়ে দিয়েছে দুলাভাই! মোশারফও দুহাতে উড়াচ্ছে সেই টাকা। যে রকম গরিব ঘরের ছেলে সে, ব্যাপারটা একদমই মানায় না তাকে।
আমাদের নিয়ে মোশারফ তারপর সাধনের মিষ্টির দোকানে এলো। তখন এক টাকায় কতবেল সাইজের কুড়িটা রসগোল্লা পাওয়া যায়। জিলাপি পাওয়া যায় সেরখানেক।
সাধনের দোকানের রসগোল্লারও বিরাট কদর। দেশগ্রামে সাধনের রসগোল্লার নামডাক আছে।
মোশারফ বলল, জিলাপি খাবি, না রসোগোল্লা?
রসগোল্লাকে আমরা বলতাম ‘রসোগোল্লা’।
জিলাপির চেয়ে রসোগোল্লা বেশি স্বাদের। আমরা একত্রে বললাম, রসোগোল্লা, রসোগোল্লা।
মোশারফ বুক ফুলিয়ে সাধনকে বলল, আমরা কয় দোস্ত আছি?
সাধন হাসিমুখে বলল, পাঁচজন।
এক কুড়ি রসোগোল্লার দাম কত?
এক টেকা।
একদাম?
হ। আমার দোকানে দামাদামি নাই।
ঠিক আছে। একেকজনরে চাইরখান কইরা রসোগোল্লা দেন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
আমরা বড়দের কায়দায় সাধনের দোকানের বেঞ্চে বসলাম। চিনামাটির মাঝারি আকারের প্লেটে চারটা করে কতবেল সাইজের রসোগোল্লা সাধন অতি যত্নে তুলে দিল। ওই সাইজের চারটা রসোগোল্লা…।
আচ্ছা শোন বকুল, তুই খেয়াল করেছিস, আমিও মোশারফের সেই বয়সের মতো রসগোল্লাকে রসোগোল্লা রসোগোল্লা বলে যাচ্ছি!
না, মাথাটা আমার সত্যি ঠিক নেই রে।
আমি এলোমেলো, একদম এলোমেলো!
তো, চারটা ওই সাইজের রসগোল্লা কিন্তু ঠিকই খেলাম আমরা। খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাচ্চুদের বাড়িতে ফিরলাম। ওই বাড়িতে বসেই মালাগুলো আমরা বানাব।
মোশারফের আসল ঘটনা জানা গেল পরদিন বিকেলে।
[চলবে]