চার
দারোয়ান বরকত, ড্রাইভার সালামকে সুট আর শার্ট দেয়ার পর দুই জোড়া সুট আমেনার মাকে দিয়ে এনায়েতুল্লা বললেন, তোমার ছেলে আর জামাইকে দিও।
আমেনার মা বুঝতে না পেরে বললো, তাদের দিমু? কি করবে তারা?
তিনি বললেন, তারা পড়বে। শীত এলে। বলবে -আমি দিয়েছি।
আমেনার মা জয়নাবের দিকে তাকাল। যেন ভরসা পাচ্ছে না অথবা বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
জয়নাব হেসে বললো, নাও। বাবা খুশি হয়ে দিচ্ছেন। সবাইকে দিচ্ছেন। তোমার জামাইকে বলবে বাবা তাকে পরতে দিয়েছেন। তাকে দোয়া করতে বলবে আব্বার জন্য। তোমার ছেলেকে
দিয়েও দোয়া করতে বলবে।
এনায়েতুল্লা বললেন, না, দোয়া করার জন্য দিচ্ছি না। এমনি দিচ্ছি। ওই যে বললে খুশি হবে। তারাও খুশি হোক। সেটাই বড় দোয়া। আমরা অন্যকে খুশি করতে ভুলে গিয়েছি। তারপর জয়নাবের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন চারদিকে বড় কঠিন প্রতিযোগিতা। আমাদের সময়ে এমন ছিল না। তখন অবশ্য এত লোক ছিল না। আমাদের ছোট দেশ, অনেক মানুষ। খুব কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।
ধাক্কাধাক্কি করছে কে কার আগে যেতে পারে তার জন্য। ভয়ঙ্কর অবস্থা। তোমাদের জন্য দুঃখ হয়। কি পৃথিবী, কি দেশ রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য। বলে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
জয়নাব বলে, আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না আব্বা। আমরা ঠিকই থাকব।
তিনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তোমরা ঠিক থাকতে পারবে। কিন্তু তারপর? পরের জেনারেশন? তাদের কি হবে? সেনসাস্ রিপোর্টে বলছে ২০৪০ সালে জনসংখ্যা ৩০ কোটি
হবে। ৩০ কোটি? চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলের দেশে। ভাবা যায়? হাঁটতে গেলে ধাক্কা লাগবে। বসতে গেলে জায়গা খুঁজে হয়রান হতে হবে। না, বউমা তোমাদের জন্য ততটা না, তার পরের জেনারেশনের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয়।
জয়নাব বলে, তারাও ভালো থাকবে। সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রযুক্তির উনড়বতি হবে।
তিনি বললেন, হ্যাঁ, তা হবে। কিন্তু মানুষের ব্যবহার? চরিত্র, তার কি উন্নতি হবে? এই যে দেখ ছাত্রদের ডাকাত ভেবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। ইন্টারনেটে বান্ধবীর ফটো থাকলেই তাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে ক্রসফায়ারের নামে। রাজনৈতিক কলহে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। উগ্রবাদীরা বোমা-গ্রেনেড হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব এবং আরো সহিংসতা কি বাড়বে না ভবিষ্যতে? আমার ভয় হয় ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
জয়নাব বলে, ভাববেন না। আপনিই তো কতবার বলেছেন যা হওয়ার তা হবে। তাহলে এত ভাবছেন কেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে?
তিনি স্বর নামিয়ে বললেন, বলেছি। নিজের সম্পর্কে, নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে। আমার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। আমি এ রকম বেপরোয়া কথা বলতে পারি নিজের সম্বন্ধে। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যাপারে একই উপদেশ কিংবা বেপরোয়া ভাব দেখাতে পারছি না। চারদিকে যা হচ্ছে, দেখে খুব হতাশ হয়ে পড়েছি বউমা। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, সান্ত¡না দিতে যেওনা। সান্তনার কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
জয়নাব বলল, চিন্তা করে, টেনশন করে কি ভবিষ্যৎটা বদলাতে পারবেন আপনি কিংবা আপনার মতো অন্যেরা যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন? পারব না। আমাদের ক্ষমতা নেই। সময় নেই। কিন্তু
যাদের সময় আছে, ক্ষমতা আছে তারা পারে এই সর্বনাশা পরিণতি ঠেকাতে। ঠেকাতে না পারলেও এর তীব্রতা, ভয়াবহতা কমাতে। খুব পারে।ক্ষমতার বিচক্ষণ ব্যবহার করা হলে এটা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু দুঃখের বিষয় যাদের হাতে ক্ষমতা, যাদের সময় রয়েছে তারা এসব নিয়ে ভাবছে না।
দাউদ ঘরে ঢুকে দুজনকে দেখে বলল, কি নিয়ে কথা হচ্ছে, সিরিয়াস বিষয় মনে হয়।
জয়নাব বলল, বাবা…।
তাকে থামিয়ে দিয়ে এনায়েতুল্লা বললেন, শোনো একটা কথা ভাবছি। চলো দেশের বাড়ি যাই সবাই। দেশের বাড়ি? বুঝতে না পেরে আব্বার দিকে তাকায় দাউদ।
হ্যাঁ। দেশের বাড়ি। মানে আমাদের পৈতৃক এনসেস্ট্রাল হোম। বেলায়েতপুর।
বেলায়েতপুর? সেখানে কেউ আছে আমাদের? দাউদ তাকায় তার আব্বার দিকে।
অবশ্যই আছে। তোমরা খবর রাখো না। কিন্তু আমি রাখি। দেশ থেকে লোক আসে মাঝে মাঝে।
দাউদ বলে, তারা তো এসে সাহায্য নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, তারা কলাটা, মুলোটা, লাউ, কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠালও নিয়ে আসে। কখনো পুকুরের মাছ।
দাউদ বলে, মনে পড়ছে না। দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন আপনার? আর এই শরীরে?
তিনি অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, শরীর কেন, আমার কি মন নেই? মনের দিক দিয়ে খুব সুস্থ আমি। সব সময়ই বলে আসছি। তোমরা কানে নাও না। সামনের শুক্রবার চলো বেলায়েতপুর যাই।
দাউদ কাছে এসে বলল, আপনার শরীরের কথা না হয় তুললাম না। কিন্তু বেলায়েতপুর কোথায় যাবেন? সেখানে আমাদের বাড়িঘর নেই। শুধু দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয় আছে। সেখানে যাওয়া ঠিক হবে?
আছে। আছে। বাড়ি আছে। তোমার দাদার বাড়ি, পুকুর, আমার চাচাতো ভাইদের ভোগ করতে দিয়েছি। বলেছি আমরা গ্রামে যাব না। তোমরাই থাকো, ভোগ কর। তারাই মাঝে মাঝে শাকসবজি,
পুকুরের মাছ, জমির চাল নিয়ে আসে। আমরা গেলে তারা খুশি হবে। আমি অনেক বছর হলো যাইনি। তোমরা বলতে গেলে কখনোই যাওনি। গিয়ে কি করবেন? একটা উদ্দেশ্য থাকবে তো?
দাউদ তাকায় তার আব্বার দিকে।
চাচাতো ভাইদের দেখব। পৈতৃক ভিটেবাড়ি দেখব।নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলব।
দাউদ চারদিকে তাকিয়ে বললো, আপনার পক্ষে এই পরিশ্রম করা ঠিক হবে? যাওয়া-আসা? এত লোকের সঙ্গে কথা বলা? জরুরি কিছু তো নেই।
এনায়েতুল্লা বলেন, আমার জন্য চিন্তা কর না। বলে বলে তোমরা আমাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলছ। আই অ্যাম অলরাইট। মনে হচ্ছে তোমরাই অসুস্থ হয়ে পড়েছ। বাইরে যেতে চাও না আরাম-আয়েশের
কথা ভেবে।
দাউদ বলল, বেশ চলেন। আপনার জেদের সঙ্গে পারব না।
পরের শুক্রবার একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে এনায়েতুল্লা রওনা হলেন পৈতৃক গ্রামের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে দাউদ, জয়নাব, আমেনার মা আর রাজু। তুলি এলো না, তার পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা করবে।
কোচিং ক্লাসে যাবে।
মহানগরীর ফ্লাইওভারে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হলো।এনায়েতুল্লা বিরক্তির সঙ্গে বললেন,
ফ্লাইওভার করে এই অবস্থা!
দাউদ বলল, এটা ছোট হয়ে গেছে।ছোট মানে? মাত্র ফোর লেন? হ্যাঁ। তাছাড়া এটা আরো লম্বা হওয়া উচিত ছিল। ফার্মগেট থেকে ক্যান্টনমেন্টের রেলক্রসিং পর্যন্ত। তাহলে কিছুটা ট্রাফিক জ্যাম কমতো।
করা হলো না কেন? এনায়েতুল্লা সামনে তাকিয়ে বললেন।
বিলবোর্ডে রিয়েল এস্টেটের ছবি দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে, ছিমছাম, রঙিন।
দাউদ বলল, প্লানিংয়ের অভাব। হয়তো টাকারও অভাব।
এনায়েতুল্লা বললেন, যখন করার কথা ছিল করা হয়নি। দুর্নীতির কথা বলে বন্ধ করে দিয়েছিল। এরশাদের সময় ছিল সেটা। সেই কাজই যখন করা হলো তখন খরচ বেড়ে গেছে। না হলে ওই একই টাকায় বড় করে করতে পারতো। সর্ট সাইটেড হলে না হয়। আরে বাবা দুর্নীতি হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও। কিন্তু কাজ বন্ধ করতে হবে কেন? হবে না, হবে না। কিছু হবে না এখানে। রাজনীতিই সমস্যা। বুঝলে দাউদ। এনায়েতুল্লাকে খুব বিরক্ত দেখায়।
এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে গাড়ি দ্রুত যাচ্ছে। বাঁ দিকে তাকিয়ে এনায়েতুল্লা বললেন, গলফ কোর্স এখানে নিয়ে এসেছো দেখছি। পাশে হোটেল, সেই জন্য?
দাউদ বললেন, এটা নতুন গলফ কোর্স।।
এনায়েতুল্লা বললেন, চমৎকার। দেশে জমির অভাব। আর একটার পর একটা গলফ কোর্স হচ্ছে। যাই বলো দাউদ, দেশের উনড়বতি হচ্ছে। বিদেশিদের এসব দেখিয়ে গর্ব করা যায়। বলা যায়, আমরা পিছিয়ে নেই হে।
দাউদ বলল, আপনি কি ব্যঙ্গ করছেন?
না, না। ব্যঙ্গ করতে যাব কেন? এসব নিয়ে ব্যঙ্গ করা যায়। ইনডেক্স অফ ডেভেলপমেন্ট। জমি কম তাতে কী? লেট ডেভিল টেক দ্য হাইন্ড সাইড।
জয়নাব পেছনের সিট থেকে বলল, বাবা আপনি বেশি কথা বলছেন। একটু শান্ত হোন। স্ট্রেইন হচ্ছে।
দাউদ বলল, এ জন্যই আপনাকে নিয়ে বের হতে চাইনি। জানতাম শুধু কথা বলবেন। এটা-ওটা দেখে উত্তেজিত হবেন।
এনায়েতুল্লা সিটের পেছনে হেলান দিয়ে বললেন, বেশ। একটু রেস্ট নিচ্ছি। তোমরা শান্ত হও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই তাহলে। একটু পর তিনি সত্যি
হাই তুলতে শুরু করলেন।
টঙ্গি বাইপাস দিয়ে যাওয়ার সময় এনায়েতুল্লার তন্দ্রা ভাঙল। তিনি চারিদিক দেখে বললেন, এ ফ্লাইওভারটা বেশ লম্বা। ভালো করেছে। কিন্তু রাস্তার পাশে এত কম জায়গা। কিছুটা বড় করতে পারল
না?
দাউদ দুদিকে দেখে বলল, সব দোকান। মনে হয় ভাঙতে দেয়নি। পাওয়ারফুল গ্রুপ।
এনায়েতুল্লা আবার সিটের পেছনে হেলান দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আপস। সব জায়গায় তাই। সবার সঙ্গেই। এটাই মূলমন্ত্র। আপস।
গ্রামের কাছে মাইক্রোবাস যেতে পারল না। বড় রাস্তার পর মিনিট পনেরো হেঁটে যাওয়ার রাস্তা। একটা রিকশা পাওয়া গেল। এনায়েতুল্লাকে উঠতে
বলায় তিনি বললেন, না না। হেঁটেই যেতে পারব। এইটুকু তো পথ। অর্থাৎ অসুস্থ ভেবেছ আমাকে তোমরা। দেখাতে চাই তোমরা নিজেই অসুস্থ, শুধু আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কর।
একটু দূর হেঁটে যেতেই গ্রামের কিছু লোক এসে গেল। এনায়েতুল্লাকে দেখে কাছে এলেন বয়স্করা। তারা খুশি হলেন, মুখে হাসি। কিছুক্ষণ পর তার চাচাতো, ফুপাতো ভাইরাও দৌড়ে এলেন। তারাও
অবাক হয়েছেন। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তোমাদের দেখতে এলাম। পিতৃ পুরুষের গ্রাম। এখানকার বাতাসই আলাদা, বলে তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন।
তারপর দাউদকে বললেন, সবকিছু পিওর। বাতাস, পানি, মাটি। এখানে থাকলে আয়ু দশ বছর বেড়ে যাবে। তারপর হেসে বললেন, আমার অতো বাঁচার ইচ্ছা নেই। তুমি ভেবে দেখতে পার। তোমাদের বয়স কম।
পৈতৃক বাড়িতে এসে এনায়েতুল্লা পুকুর পাড়ে পুরনো আম গাছের নিচে বসলেন। বেশ ঝাকড়া, অনেক আম ধরেছে। তার সামনে বেঞ্চ আর টুল এনে বসলেন গ্রামের বয়স্করা, কম বয়েসীরা দাঁড়িয়ে
থাকল। একদল ততক্ষণে পুকুরে জাল নিয়ে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। উঠোনে মুরগির পেছনে দৌড়াচ্ছে কয়েকজন। একটা ছাগলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দুই চাচাতো ভাই। সেদিকে তাকিয়ে
এনায়েতুল্লা চোখ টিপলেন দাউদকে দেখিয়ে। তাকে খুব প্রসন্ন দেখাচ্ছে।
গ্রামের বয়স্করা তাদের সমস্যার কথা বললেন, রাস্তাটা পাকা হওয়া দরকার। স্কুল এমপিওভুক্ত হয়নি এখনো। পোল পোঁতা হলেও বিদ্যুৎসংযোগ হয়নি। এমপি সাহেব ভোট না পাওয়ায় এখানে দৃষ্টি দিচ্ছেন না। তিনি যদি শহরে কর্তৃপক্ষকে কিছু বলেন, তাহলে উপকার হবে। সবাই তাকে একই কথা বলে। এক সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। একজন বললেন, আগামী নির্বাচনে গ্রাম থেকে দাঁড়ালে তিনি অবশ্যই জয়ী হবেন। শুনে তিনি হেসে বললেন রাজনীতিতে তিনি নেই। তবে গ্রামের জন্য যতটুকু করার দরকার তা তিনি করবেন। কথা বলবেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তারপর বললেন আগেই গ্রামে আসা উচিত ছিল তার। তাহলে এর মধ্যেই কিছু করা সম্ভব হতো। যাই হোক দেরিতে হলেও কাজ শুরু করে দেয়া যাবে। শুনে উপস্থিত সবাই খুশি হলো।
খাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে বসে গেল। ভূরিভোজ। দাউদ যত বলে আব্বা খাসির মাংস খাবেন না, মাছ আছে, তিনি হেসে বলেন, একদিন খেলে কিছু হবে না। তাছাড়া সবই পিওর। তিনি
তৃপ্তির সঙ্গে খেতে থাকেন।
বিকেলে ঢাকা রওনা হওয়ার আগে পুকুর পাড়ে যেখানে বসেছিল সবাই সে জায়গা দেখিয়ে
এনায়েতুল্লা বললেন, এখানে একটা একতলা ঘর করব। মাঝে মাঝে গ্রামে আসব যখন এখানে রেস্ট নেয়া যাবে। থাকাও যাবে। বলে তিনি দাউদের
দিকে তাকালেন। দাউদ কিছু বলল না, অবাক হয়ে তাকাল। গ্রামের সবাই শুনে খুশি হলো। গাড়িতে উঠার আগে সঙ্গে আনা সুটগুলো চাচাতো, ফুপাতো ভাইদের দিলেন তিনি। বললেন, খুব মোটা উলের। শীতে পড়বে।
গাড়িতে উঠে দাউদ বলল, সত্যি সত্যি ঘর বানাতে চান গ্রামে? পুকুর পাড়ে?
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ। পৈতৃক ভিটে বাড়িতে চাচাতো ভাইরা থাকছে, থাক। একটা নতুন ঘর তৈরি করব। পাকা ফ্লোর, টিনের ছাদ। আমরা আসব মাঝে মাঝে। তোমরা আসবে আমি যখন
থাকব না। গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। এর সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। ভুলে যেওনা। আমি ভুলে যাইনি কিন্তু খুব একটা আসিও না। এখন আসব। যতদিন পারি বলে তিনি হাসলেন।
দাউদ অবিশ্বাসের চোখে তাকে দেখল।
ফেরার সময় রাস্তাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, তখনো ঢাকার অর্ধেক দূরত্ব বাকি। নতুন তৈরি রাস্তার চার লেনে অনেক গাড়ি, বাস, ট্রাক যাওয়া-আসা করছে।সবগুলোর সামনে এখন হলুদ আর পেছনে ছোট
আকারের লাল বাতি জ্বলছে। রাস্তার দু’পাশ ন্যাড়া, কোনো গাছপালা নেই; নয়ানজুলির ওপাশে ক্ষেতের জমিতে চাষ করা মাটি উপুর হয়ে আকাশ দেখছে। গ্রামের বাড়িগুলোর চার পাশে গাছপালায় অন্ধকার ঘন হচ্ছে, দূরের লোকজনকে দেখাচ্ছে অস্পষ্ট। মাইক্রোবাসে বসার পর পরই ঢুলতে শুরু করেছেন এনায়েতউল্লা, পাশে বসে দাউদ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন পথ কতটা বাকি তার হিসাব করছে। এনায়েতউল্লার তদ্রা ভাঙল গাড়ি ব্রেক করার শব্দে। তিনি প্রায় ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসে দেখলেন একটা পেট্রলপাম্পে থেমেছেন তারা,
ড্রাইভার বলল গাড়িতে সিএনজি নেবে। পেট্রলপাম্পটার পাশে বেশ বড় একটা রেস্তোরাঁ, আধুনিক ডিজাইনের ভবন, বাইরে লাল-নীল নিয়ন বাতি জ্বলছে, ভেতরটা হলুদ আলোয় ঝলমল করছে। তিনি দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, দাউদ চলো চা-নাস্তা খাওয়া যাক।
শুনে প্রায় আঁতকে ওঠার মতো হলো দাউদের। সে তার বাবার দিকে সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, রাস্তায় চা খাবেন? দোকানে? না, ঠিক হবে না। খুব আনহাইজেনিক এরা।
মাইক্রোথেকে নিচে নামতে নামতে এনায়েতউল্লা হেসে বললেন, তোমরা বড় বেশি শুচিবাইগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। আনহাইজেনিক হবে কেন? দেখছ না কেমন ঝকঝকে নতুন রেস্তোরাঁ, কাচের বড় বড় জানালা, ভেতরে উজ্জ্বল আলো। সব দেখা যাচ্ছে। লোকজন খাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে। তারা খেতে পারলে আমরা পারব না কেন?
দাউদ বলল, আপনার কথা ভেবে বলছি আব্বা। আপনাকে সাবধানে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ডাক্তার বলেছেন।
এনায়েতুল্লা ততক্ষণে নিচে নেমে গেছেন, রেস্তরাঁর ভেতরে তাকাচ্ছেন কৌতুহল আর আগ্রহ নিয়ে।
দাউদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আমাকে জোর করে অসুস্থ করে ফেলো না তোমরা। এত ডাক্তার, ডাক্তার করো কেন? আই অ্যাম অলরাইট। এই যে সারা দিন গ্রামে থাকলাম একটুও কাহিল হতে দেখেছো কিংবা অসুস্থ? হ্যাঁ, ক্লান্তি এসেছে ফেরার সময়। সে তো আসবেই। সবারই আসে লং জার্নিতে। চলো ভেতরে যাওয়া যাক। দেখি কি স্ন্যাকস পাওয়া যায় ভেতরে। ঢাকা পৌঁছাতে বেশ রাত হবে মনে হচ্ছে।
দাউদ গাড়ি থেকে নেমে তার আব্বার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ক্ষীণ স্বরে বলল, সঙ্গে খাবার ছিল, টিফিন ক্যারিয়ারে। ফ্ল্যাস্কে চাও আছে। বাইরে খাবার দরকার ছিল না।
এনায়েতুল্লা রেস্তরাঁর দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, জানি। সেসব বাসি হয়ে গেছে। ঠান্ডা তো বটেই। এক ধরনের গন্ধও পাওয়া যাবে নাকের কাছে আনলে। তার চেয়ে রেস্তরাঁয় গরম
গরম খাওয়া অনেক ভালো। মজারও। রেস্তরাঁয় বসে অন্যদের সঙ্গে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। হোক না তারা অপরিচিত।
তারপর এক হাতে গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমরা খুব সাবধানী হয়ে পড়েছ। লাইফ এনজয় করতে পারবে না এই স্বভাব না বদলালে।
তার পেছনে পেছনে দাউদ আর জয়নাব রেস্তরাঁর ভেতরে ঢুকল। চারদিক দেখে নিয়ে জয়নাবের উদ্দেশে এনায়েতুল্লা বললেন, ওকে একটু বদলাও মা। এই বয়সেই নিজের ভেতরে গুটিয়ে নিতে চায়।
একটুও ঝুঁকি নেবে না। ওভার কনসাস। ভেরি ব্যাড।
তারপর হেসে বললেন, এই আমাকে দেখ। কে বলবে বায়াত্তরের বুড়ো। আই হেট দ্যাট ওয়ার্ড। বুড়ো বলে কিছু নেই, বয়স মনের ব্যাপার।আলিয়া বলে এক আমেরিকান গায়িকার গানের
একটা লাইন মনে পড়ছে : এজ ইজ নাথিং বাট এ নাম্বার। তারপর দাউদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউ আর এজ ইয়াং এজ ইউ থিঙ্ক। বুঝলে?
এনায়েতুল্লা বড় বড় পা ফেলে খাবার সাজিয়ে রাখা কাউন্টারের দিকে গেলেন; তার চোখে-মুখে উত্তেজনা আর উৎসাহ। শোকেসের ভেতরে সাজানো খাবারগুলো দেখতে দেখতে বললেন, এসো দেখবে। অনেক কিছু আছে। প্রায় সবকিছু। ভাত, পোলাও থেকে স্যান্ডউইচ, সমুচা। প্রত্যেকটার পাশে দাম লেখা। বেশ রিজনেবল। আর দেখছ একটাও মাছি নেই, খাবারের ওপর কিংবা পাশে
পিঁপড়ে ঘুরছে না। ভেরি হাইজেনিক। তারপর তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো একটা টেবিল নিয়ে বসি আমরা। কোনো তাড়া নেই।ধীরে-সুস্থে খাওয়া যাক। যার যা খুশি অর্ডার দাও।
আমি সমুচা আর কফি খাব। তোমরা কি খাবে ঠিক কর। ড্রাইভার সালামের জন্যও কিছু খাবার কেনা দরকার। তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখ কি খেতে চায়।
কথা শেষ করে তিনি চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন; তার চোখে-মুখে প্রসন্নতা তিনি উৎফুল্লস্বরে বললেন, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছনড়ব। বয়-বেয়ারারাও পরিষ্কার ইউনিফর্ম পরে সার্ভ করছে। কোনো হইচই নেই, দৌড়াদৌড়ি করছে না কেউ। অথচ কত লোক খাচ্ছে, বসে আছে টেবিলে। আনবিলিভেবল। গ্রামের মধ্যে, রাস্তার পাশে এমন রেস্তরাঁ! উন্নতি হচ্ছে দাউদ, উন্নতি হচ্ছে। নিচের দিকে লোকেরা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। তোমরা যাকে বলো তৃণমূল, সেখানে সব ঠিক আছে। সমস্যা ওপরের দিক নিয়ে, সেখানেই সব গন্ডগোল। না হলে দেশটা আরো এগিয়ে যেতে পারত। তারপর তিনি
স্বগতোক্তির মতো হতাশ স্বরে বললেন, দুই মহিলার ঝগড়া কবে যে শেষ হবে!
যখন তারা ঢাকায় বনানীর বাড়িতে ঢুকল রাত ১০টা বেজে গেছে। বসবার ঘরে ঢুকতে দেখা গেল সোফায় তুলি বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে; ফ্যাশন ম্যাগাজিন, নাম ‘এল’। জয়নাব
তাকে দেখে অসন্তুষ্ট স্বরে বলল, তুমি পড়াশোনা থুয়ে ফ্যাশনের বই নিয়ে পড়ছ? কি কান্ড তোমার! সামনে পরীক্ষা মনে নেই বুঝি? আমাকেই সব সময় মনে করিয়ে দিতে হবে?
তুলি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, এতক্ষণ পড়ছিলাম। এখন একটু রিল্যাক্স করছি। হোয়াট ইজ রং উইথ দিস? তারপর ম্যাগাজিনের পাতার দিকে মুখ নামিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল, ডোন্ট বি এ বোর।
তার কথা শুনে এনায়েতুল্লা একটু অপ্রস্তুত হলেন।
তারপর স্নেহের ভঙ্গিতে বললেন, তুলি তোমার আম্মা ভালোর জন্যই বলে। হয়তো একটু বেশিই বলে। বাবা-মারা এমন করেই থাকে। তার জন্য তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের কারণ নেই।
তুলি ম্যাগাজিনটা সোফায় রেখে উঠে দাঁড়াল।
এনায়েতুল্লার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, তোমার ঘরে চলো।
এনায়েতুল্লা কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, কিছু বলতে চাও? বাবা-মার সামনেই বলতে পারো। এমন কি হতে পারে যা শুধু আমাকেই বলা যায়?
তুলি তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে অসহিষ্ণু স্বরে বলল, আহা দাদু, কথা বাড়াবে না। চলো তোমার ঘরে। প্রথমে তুমি, তারপর আব্বা-আম্মাকে ডাকা যাবে।
এনায়েতুল্লা তুলির সঙ্গে তার ঘরের দিকে গেলেন, ঘরের দরজা খুলে তুলি বলল, ভেতরে ঢোকেন।
আমি পেছনে আছি।
এনায়েতুল্লা দরজা পার হয়ে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। মাথা নেড়ে বললেন, ভুল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিংবা তুমিই চালাকি করে অন্য ঘরে নিয়ে এসেছ। তারপর তুলির দিকে হেসে বললেন, এর
উদ্দেশ্য কি? আমার ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে নিয়ে এলে কেন?
তুলি হাসিমুখে বলল, অন্য ঘর না, এটা তোমারই ঘর। ভালো করে তাকিয়ে দেখ।
এনায়েতুল্লা এবার ঘরটার ভেতর চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। নিজে নিজেই বললেন, আমার ঘর! এটা আমার ঘর।
তুলি এবার জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তোমার ঘর।
এনায়েতুল্লা ঘরের সবকিছু তীক্ষ চোখে দেখলেন।আসবাব। মেঝের কার্পেট। দেয়ালে তার স্ত্রীর ছবি। ড্রেসিং টেবিল। ওয়ার্ডরোব। রাইটিং টেবিল।কোণায় টেলিভিশন, সামনে রকিং চেয়ার। সবই
তার পরিচিত।
দেখার পর তিনি বললেন, আসবাবপত্র তো ঠিকই আছে দেখছি। কিন্তু সব সরানো হয়েছে, আগের জায়গায় নেই। সরানোর জন্য মনে হচ্ছে এটা নতুন ঘর, অন্য কারো।
তুলি বলল, ওইটাই ম্যাজিক। নতুন মনে হওয়া।অথচ সবকিছু পুরনো। শুধু লম্বা আয়নাটা নতুন টাঙানো হয়েছে। কেমন মনে হচ্ছে তোমার এই সব বদলানোর ফলে? ফুর্তির ভাব আসছে না মনে? নতুন জায়গায় গেলে যেমন হয়? ক্ষিধে পাচ্ছে না? বেশ হাঁটাহাঁটি করার পর যেমন হয়?
এনায়েতুল্লা তুলির দিকে তাকিয়ে বললেন, এসব তোর কাজ? আমরা যখন বেলায়েতপুর গ্রামে, সেই সময় তুই এইসব করেছিস? কিন্তু কেন? এত দিন আছি এই ঘরে, খারাপ লাগেনি। কিছু না বদলালেও খারাপ লাগত না। বরং এখন একটু অস্বস্তি লাগছে।
তুলি বলল, অস্বস্তি লাগছে কিন্তু খারাপ লাগছে এটা নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে না। বরং আস্তে আস্তে ভালো বোধ করবে। মানে আগের তুলনায়। নতুন অ্যানার্জি ঢুকে যাচ্ছে তোমার ভেতর। কসমিক অ্যানার্জি, চিং। ফেং সুই? এনায়েতুল্লা গম্ভীর হয়ে তাকালেন তুলির দিকে।
হ্যাঁ, ধরে ফেলেছ। মনে আছে তাহলে কথাটা। ইউ আর শার্প। ইয়েস এ নিউ মেকওভার অফ দ্যা রুম। আর ঘরের মাধ্যমে তোমার মনেরও মেকওভার। জানো তো এনভায়রনমেন্টের সঙ্গে মানুষের মনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ ধরনের এনভায়রনমেন্টের মানুষ বেশি অ্যানার্জেটিক ফিল করে। মনে ফুর্তি আসে। ক্ষিধে বাড়ে। কাজে উৎসাহ জাগে। ফেং সুই সেই ধরনের এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করে।
এনায়েতুল্লা ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এ কথা বলেছিস তুই সেদিন। কিন্তু আমার ঘরটা যে সত্যি এভাবে বদলাবি তা ভাবতে পারিনি। বলে তিনি আবার ঘরটা জরিপ করেন,
যেন অন্যের ঘরে এসেছেন। তারপর বলেন, দেয়ালে এতবড় আয়না টাঙানোর কি মানে? ড্রেসিং টেবিলে আয়না আছে, বাথরুমে বেসিনের ওপরও আয়না রয়েছে। এত আয়না দিয়ে আমার কি হবে?
তারপর দেয়ালে টাঙানো লম্বা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফেং সুইয়ের সঙ্গে এর সম্পর্কটা কি?
তুলি বলল, আয়নাটা দেয়ালকে সরিয়ে দিয়েছে। ফলে ঘরটা বড় হয়ে গেছে। তুমি বাড়তি স্পেস পেয়ে গেলে। অথচ ঘরের আয়তন আগের মতোই আছে। একটা অপটিক্যাল ইল্যুশন সৃষ্টি করেছে ওই
আয়না। ওদিকে তাকালে দেয়ালে চোখ আটকে যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ঘরটা আরো বড়। তাকিয়ে দেখ, তাই মনে হচ্ছে না?
এনায়েতুল্লা আয়নার দিকে তাকান। তার ভ্রু কুঞ্চিত; কি বলবেন ভাবছেন।
তুলি বলল, বাড়তি স্পেস দেখতে পাচ্ছ না? দেয়ালটা সামনে নেই, মনে হচ্ছে না?
এনায়েতুল্লা ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না। তুই সব গোলমাল করে দিয়েছিস।
উহহো। এত ব্যস্ত হবে না দাদু। ইফেক্টটা আসার সময় দাও। স্লোলি। স্লোলি ফিলিংটা আসবে। সবকিছুর একটা রিদম আছে। ইউ উইল ফিল দা চেঞ্জ বাই অ্যান্ড বাই। নতুন অ্যানার্জি তোমাকে
ইলেক্ট্রিফাই করবে। স্লোলি বাট স্টেডিলি।
এনায়েতুল্লা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওইসব লতাপাতা? আগে ছিল না। এত লতাপাতা ঝোলানো হয়েছে কেন?
তুলি বলল, গ্রিন প্ল্যান্ট। মানি প্ল্যান্ট ঝুলছে। বুগেনভেলিয়ার ডাল বাইরে থেকে টেনে আনা হয়েছে জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে। অক্সিজেন দিচ্ছে তারা। নতুন অ্যানার্জি ছড়াচ্ছে ঘরের ভেতর,
তোমার ভেতরও ঢুকবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন জানালা দিয়ে সবুজ আলো ঢুকেছে ভেতরে। সমস্ত ঘর ভরে যাবে গ্রিন অ্যানার্জিতে। সূর্যের আলো আর গাছের সবুজ মিলে তৈরি হবে
গ্রিন অ্যানার্জি।
এনায়েতুল্লা আবার ঘরের চারদিক দেখলেন। তারপর বললেন, বাথরুমের ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে গেছে। রাতে সেখানে যেতে অসুবিধা হবে আমার। ভুল করে বাইরে যাওয়ার দরজা খুলে ফেলব।
প্রথম প্রথম হতে পারে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে আর ভুল করবে না।
তুলি তারপর তার দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো বলে, তাই বা হবে কেন? বাথরুমে যেতে হলে বেল টিপবে। রাজু আসবে শব্দ শুনে। সে তোমাকে নিয়ে যাবে বাথরুমে।ক’দিন পর তুমি নিজেই যেতে পারবে, একা একা।কারো সাহায্য লাগবে না।
এনায়েতুল্লা বিছানায় বসে আবার ঘরের চারিদিক দেখলেন, যেন তার দ্বিধাগ্রস্ততা এখনো যায়নি। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ঘরটা বেশ নতুন লাগছে। অপরিচিত। রাতে ঘুম হবে না।
নতুন কোনো ঘরে এলে আমার ঘুম হয় না। হবে। ঘুম হবে। ইউ জাস্ট ট্রাই ইট দাদু। এখনি কোনো কনক্লুসনে আসবে না। দরকার নেই। গিভ ইট এ ট্রাই।
জয়নাব ঘরে ঢুকল টেবিলে রাতের খাবার দেয়া হয়েছে জানাতে। সেও ঘরটা দেখে চমকে উঠল।একবার শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে সে সপ্রশ্নে তাকাল মেয়ের দিকে।
তুলি গর্বের সঙ্গে হাসিমুখে বলল, কেমন হয়েছে মা? ডোন্ট ইউ থিঙ্ক ইট ইজ নাইস? ইউজার ফ্রেন্ডলি?
জয়নাব শ্বশুরের দিকে তাকাল, তাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। তারপর ইতস্তত করে তুলিকে বলল,
তোর দাদু এভাবে বদলাতে বলেছেন?
তুলি বলল, না। তবে তাকে একটা ধারণা দেয়া হয়েছিল। ফেং সুইয়ের কথা বলেছি তাকে। ঘরটা ফেং সুই অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। নতুন অ্যানার্জি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। দাদু এ অ্যানার্জি ফিল
করবে। হি ক্যান্ট মিস ইট। ক’দিন দেখবে কেমন লাগছে। তারপর আমাকে বলবে তার মতামত।তাই না দাদু? বলে সে তার দাদুর দিকে তাকায়।
এনায়েতুল্লা কিছুটা অসহায়ের মতো মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। তাই আরকি। এত কষ্ট করে বদলে যখন ফেলেছে দেখতে হয় ব্যাপারটা কি। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
তুলি শুধরে দিয়ে বলে, ব্যাপারটা না, ফেং সুই বলো। ব্যাপারটা বললে কেমন যেন শোনায়। ফেং সুই ইজ এ সায়েন্স অ্যান্ড আর্ট। কয়েক হাজার বছরের পুরনো। শুধু চীন দেশে কেন, ইউরোপ-
আমেরিকায় অনেকেই ফেং সুই প্রাকটিস করে। আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেং সুই পড়ানো হয়। ফেং সুইয়ের শিক্ষক আর কনসালট্যান্টরা কাড়িকাড়ি টাকা কামায়। বলে সে একটু থামে।
তারপর বলে, আমি ঢাকায় একটা ফেং সুই সেন্টার খুলব।
জয়নাব এবার কড়া স্বরে বলল, তুমি ও লেভেল পরীক্ষা দাও। তারপর এ লেভেল। ফেং সুইটুই নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না বেশি। শখ থাকা ভালো কিন্তু বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ওটা তুমি মাথা থেকে নামাও। তারপর রুষ্টস্বরে বলল, এত টাকা-পয়সা খরচ করে পড়াচ্ছি তুমি ফেং সুই সেন্টার খুলবে বলে না।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, বাড়াবাড়ি কিছু করেনি তুলি। ঘরের পুরনো আসবাবগুলোই নতুন করে সাজিয়েছে। ডিরেকশন চেঞ্জ করেছে। নতুনের মধ্যে একটা লম্বা আয়না। দেখি না ক’দিন কেমন
লাগে। তুলি এত কষ্ট করল আমার জন্য, আমি ট্রাই না করলে হবে কেন?
তার কথা শুনে তুলির মুখ উজ্জ্বল হলো। সে দাদুর কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ দাদু। ইউ আর গ্রেট। রিয়েলি গ্রেট। নতুন কিছুতে ভয় পেও না, চ্যালেঞ্জ ফেস করতে ইতস্তত করো না।
ইউ আর নট অ্যাফ্রেড অফ চেঞ্জ। দ্যাটস্ রিয়েলি গ্রেট। আই লাভ ইউ দাদু।
ভোর বেলায় এনায়েতুল্লার ঘুম ভাঙল পাখির ডাক শুনে। জানালার দিকে তাকালেন তিনি মুখ ঘুরিয়ে। লতানো গাছগুলোর পাতার ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকেছে ঘরে। সবুজ আভায় ভরে যাচ্ছে
ঘরের ভেতরটা একটু একটু করে। অর্ধেক জায়গায় তখনো ছায়া, রাতের বাসি অন্ধকার। তিনি শুয়ে শুয়ে মুগ্ধ চোখে সবুজ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। জানালার কাচ বন্ধ, একটা পাইপ দেখা
যাচ্ছে। বাইরের শব্দ আসছে সেই পাইপ দিয়ে ভেতরে। তিনি পাখির ডাক শুনতে পেলেন আবার। আগে কোনো দিন এই ডাক শোনেননি; জানালা বন্ধ থাকত, টানা থাকত পর্দা। ঘরটা অনেক বেলা হয়ে গেলেও অন্ধকার হয়ে থাকত। একটা বোটকা গন্ধ ছিল ভেতরে, এখন নেই। তার জায়গায় সবুজ গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। হ্যাঁ, তাই তো। এ গন্ধকে সবুজ ছাড়া আর কি বলা যায়? ভাবলেন তিনি।
তুলি এলো একটু পর, দরজায় নক করে, তারপর খোলে। তিনি তখনো বিছানায় শুয়ে ঘরের ভেতর আলো-ছায়ার খেলা দেখছেন। সবুজ রঙ জমে উঠতে দেখছেন সূর্যের আলোয়।
তাকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে দেখে তুলি উল্লাসের সঙ্গে বলল, দাদু হাউ ডু ইউ ফিল? অ্যানার্জেটিক মনে হচ্ছে না? ঘরের সবুজ আলো দেখে মনে ফুর্তি আসছে না? আরেন্ট ইউ ফিলিং ডিফারেন্ট?
এনায়েতুল্লা তুলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর প্রশ্রয়ের সঙ্গে বললেন, সুন্দর দেখাচ্ছে। সবকিছু বেশ ফ্রেশ।
এই তো। নতুন অ্যানার্জি ফিল করতে শুরু করেছ দাদু। আরো করবে। ইয়ান আর ইং ব্যালান্সড হলে এমন হতেই হবে।
ইয়ান আর ইং? এনায়েতুল্লা সপ্রশ্নে তাকালেন তুলির দিকে।
ওহহো। ভুলে গেল এরই মধ্যে? ইয়ান হলো অন্ধকার, ইং হলো আলো। প্রথমটা স্ত্রীলিঙ্গ, দ্বিতীয়টা পুরুষ। হ্যাঁ, চাইনিজরাও বেশ বায়াসড জেনডারের ব্যাপারে। দেখ না অন্ধকারকে বলছে
স্ত্রীলিঙ্গ। যাকগে দুটোর রাইট কম্বিনেশন হলে কসমিক অ্যানার্জি ক্রিয়েট হয়। তোমাকে বলিনি? মনে হয় বলেছি। তোমার এই ঘরে এখন সেই অ্যানার্জি ক্রিয়েট হয়েছে। সেই জন্য ফ্রেশ মনে
হচ্ছে তোমার। ইট ইজ ওয়ার্কিং দাদু। বলে সে দৌড়ে এসে এনায়েতুল্লার গালে সশব্দে চুমু খায়।
দাউদ ঘরে ঢোকে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে তুলিকে বলে, কি হচ্ছে এই সকালে? দাদুকে ডিসটার্ব করছ। এখন তোমার ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার কথা।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, ও দেখতে এসেছে আমার ঘরে ফেং সুই কেমন কাজ করছে।
ফেং সুই? দাউদ বুঝতে না পেরে তুলির দিকে তাকাল।
তুলি পাত্তা না দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, আম্মুর কাছ থেকে শুনে নাও। তাকে সব বলা আছে।
তারপর সে ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলল, আমি স্কুলের জন্য রেডি হবো এখন। আমার মনে আছে, সব সময় আমাকে স্কুল আর পড়াশোনার কথা বলে মাথা খারাপ করে দাও তোমরা দু’জন। তুমি আর আম্মা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে তার দাদুকে দেখিয়ে সে হাসি মুখে বলল, ইট ইজ ওয়ার্কিং দাদু। ফেং সুই ইজ ওয়ার্কিং। আই অ্যাম সো হ্যাপি দ্যাট ইউ আর ফিলিং ইট। বলে সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
এনায়েতুল্লা দাউদের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাগলি। একটু চঞ্চল কিন্তু খুব ইন্টেলিজেন্ট আর ক্রিয়েটিভ। নতুন নতুন আইডিয়া ঘোরে ওর মাথায়। ওকে তোমরা একটু এনকারেজ করো।
দাউদ অসন্তুষ্ট স্বরে বলে, পড়াশোনা করছে না মনোযোগ দিয়ে। সব পেপারে এ প্লাস না পেলে চলবে কেমন করে? এখন খুব কমপিটিশন।
পারবে। তুলি পারবে। বললাম না, ও খুব ইন্টেলিজেন্ট। ও বাজে ভাবে সময় নষ্ট করার মেয়ে না। ওকে উৎসাহ দিতে হবে। শুধু পরীক্ষার জন্য বই পড়লেই তো হবে না। ক্রিয়েটিভিটি বাড়াতে
হবে। তারপর একটু থেমে বললেন, মডার্ন এডুকেশনের সমস্যা কি জানো? মুখস্থ করার ওপর জোর দেয়া, পরীক্ষা পাস করা মাইক্রোসফটের বিল গেটস কি পরীক্ষা পাস করেছে? ফেসবুকের মার্ক
জুকারবার্গ? তারা কেউ মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়নি, ডিগ্রি নেয়নি। অথচ দেখ তারা কত ক্রিয়েটিভ আর ওই ভাবেই নাম করেছে। টাকাও অগাধ কামিয়েছে। তোমরা তুলিকে ক্রিয়েটিভ হতে দাও,
সে হয়তো বিল গেটস বা জুকারবার্গ হবে না কিন্তু উন্নতি করবে। এই যে দেখ আমার ঘরটা। পুরনো সবকিছু রেখেই অদলবদল করে আর জায়গা বদল করে সম্পূর্ণ নতুন করে ফেলেছে। প্রথমে চমকে
উঠেছিলাম দেখে, অস্বস্তি লাগছিল। এখন বেশ ভালোই লাগছে, ফ্রেশ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যিই ঘরের ভেতর বাড়তি স্পেস তৈরি হয়েছে। দেয়ালের ওই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখ।দেয়ালটা সরিয়ে গেছে মনে হচ্ছে না?
দাউদ স্তম্ভিতের মতো দেয়ালের আয়নার দিকে তাকাল; নিজেকে দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করল। তার কপালে কয়েকটা ভাঁজও পড়ল। তাকে বেশ অপ্রসন্ন মনে হচ্ছে। কিছুটা কনফিউজডও। সে তার
বাবাকে কি বলবে ভেবে পেল না।