২২
পুরান ঢাকা, তারপর নতুন ঢাকা, তারপর টঙ্গী ছাড়িয়ে, আরো উত্তরে গজারি বনের ভেতর দিয়ে জয়দেবপুর, রাজেন্দ্রপুর, তবে শ্রীপুর! খাম্বা সামাদ কেরানিকে বলে_ ভাই, এই যে গজারি বন দ্যাখেন, উই যে জয়দেবপুর, বিটিশ আম্বলে এই রাজত্ব আছিলো ভাওয়াল রাজাদের। শোনেন নাই ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কথা? বিষ খাওয়াইয়া রানী মারছিলো মধ্যম কুমাররে। তারপর বহু বচ্ছর বাদে সেই কুমার ফিরা আসে সন্ন্যাসীর বেশে।
রানী বিভাবতী কয়, এই হালা সাধুব্যাটা ভেক ধইরা আইছে। হে আমার সোয়ামি না! সন্ন্যাসী কয়, না কেমনে? কী কও তুমি? আদালতে খাড়ায়া সন্ন্যাসী কয়, হাকিম হুজুর, আপনে রানীর শাড়ি তুইলা দ্যাখেন, হেইখানে তিল আছে একখান! মাছির সাইজ! লাল! সোয়ামি না হইলে তার স্ত্রীর অঙ্গে মাছির মতো লাল তিল আছে, আমি জানলাম কেমতে?
কোনো মহিলার, বিশেষ করে রানীর মতো একজনের কাপড় তুলে দেখার কথাটা কেরানিকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত করে রাখে। লজ্জা এসে ভর করে। সন্ন্যাসীর ইতিহাস জানবার সাধ হয় না তার। সে চুপ করে থাকে। তার মনজুড়ে থাকে বাগানবাড়িটি, না জানি কেমন!_ যেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরই জন্যে যে এতদিন ধরে খাম্বা সামাদ তাকে লালন করছিলো, সেই কথাটা তার মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে। কী হয়! সেখানে বা কী আছে! আর আজ থেকে তো তাকে ওই বাগানবাড়িতেই থাকতে হবে।
কিন্তু দুশ্চিন্তা কেরানির ধাতে নেই। সে তুমুল ছমছমে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে অকুস্থলে কখন গিয়ে পেঁৗছুবে। জিপ অনেকক্ষণ চলবার পর, শ্রীপুর পেরিয়ে, লালমাটির অনেকটা গলিপথ ভেঙে ভেতরে, কেরানিকে নিয়ে গন্তব্যে পেঁৗছোয় খাম্বা সামাদ।
বাগানবাড়ি! লোহার সেই কারুকার্যময় গেট। দিলি্ল কি লাহোরেই এমন গেট দেখা যায় মোগল কোনো সৌধে। লোহার মোটা পাত আর নল বাঁকিয়ে ফুলের কী অপরূপ নকশাই না ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! আর মানুষেরও মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে গেটের উচ্চতা। নকশায় সোনালি আর বাদামি রঙ। চোখ জুড়িয়ে যায়। দেখে বিশ্বাস হয় না_ বাংলাদেশ। এমন গেট কেরানি আগে কখনো দেখে নাই। গেটেই যদি এই, ভেতরে তবে না জানি কী!
আজ মঙ্গলবার। এই মঙ্গলবারেই তো খাম্বা সামাদের তাকে নিয়ে এখানে আসবার কথা। আমরা এরই অপেক্ষা করছি আজ দু’দিন ধরে। আমাদেরও কৌতূহল_ এবার কী হয়, কী হয়! কেরানি এসেছে। তার বুক কাঁপছে। অভাবিত অনেক কিছুই তার জীবনে ঘটেছে। সকল অভাবিতকেই সে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। নদীতে নামলে পানির ঢল কাঁধের ওপর দিয়ে বহে যেতে দিতে হয়। এতকাল সে তাই-ই করেছে। তবু আজ যেন তার আলাদা একটা অনুভূতি হয়। তার মনে হয়, এবারে যা ঘটবে সেটি তার কল্পনাতেও নেই।
আমরা দেখিই না কেন কী ঘটে।
সদরঘাটের নিউ ঢাকা বোর্ডিংয়ের পাট চুকিয়ে কেরানি আজ বেরিয়েছে। আসবার সময় মনটা তার ভারী হয়ে যায় অকস্মাৎ। তবে এই সদরঘাট ছেড়ে সে চললো? সদরঘাট! বুড়িগঙ্গা! লঞ্চের পর লঞ্চ। ওই ঘাটে নোঙর করে আছে! ওই ঘাট ছেড়ে যাত্রা করছে! ওই পানির তোড়! ওই লঞ্চের গগনবিদারী ভোঁ! তবু তো একটা যোগ ছিলো কেরানির অতীতের সঙ্গে। আজ সেটিও তবে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
কেরানি চলে যাচ্ছে বলে ময়নার বিকার নাই। বড় স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটা তার চলে যাওয়াকে গ্রহণ করে। চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি নাই। আমাদের কেরানির চোখে আমরা অশ্রু লক্ষ করি। এই অশ্রু কেন, নির্ণয় নাই। অশ্রু তো অশ্রুই। আসবার কালে বুড়িগঙ্গার দিকে তাকিয়ে কেরানির একবার মনে হয়, মাটি যে কাঁদে, মাটি যে মানুষের এত দুঃখ এত মৃত্যু সহন করে, তারই চোখের অশ্রু বহে বহে বুঝি নদীর ধারা সৃষ্টি হয়। আর তারই মনের কথায় সায় দিয়ে বুঝি বিকেলের রাঙা আকাশ ছিঁড়ে হঠাৎ বেজে ওঠে লঞ্চের ভোঁ।
ওই নীল সাগর লঞ্চ-৩ ছেড়ে যাচ্ছে। ওই লঞ্চেই তো চাকরি করতো সে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেইসব স্মৃতি। কেরানি বলে, খাম্ভাই, আপনি জিপে বসেন, আমি আসছি। এই এক মিনিট।
কেরানি দৌড়ে পাটাতন বেয়ে নীল সাগর লঞ্চে ওঠে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ব্রিজে। সারেং তাকে দেখেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই সেই কেরানি! সেই খাকি জামা-প্যান্ট পরা? আর এই সেই সাহেব যার পরনে সাফারি সুট আজ? চোখে সানগ্গ্নাস?
কেরানি বলে, ওস্তাদ, দোয়া করবেন। দূরে চললাম। আর বোধহয় দেখা হবে না।
আমরা কেরানির মুখে ওই দূরে চললাম কথাটা টুকে নিই। আমরা তো জানিই না, কেরানিও এখনো জানে না যে কী অমোঘ সত্যটাই সে উচ্চারণ করেছে। দূর মানে দূর, সে কতদূর? শত আলোকবর্ষ দূরত্বে যে নক্ষত্র, সেও যেমন দূর, ঢাকা থেকে শ্রীপুরও আরেকটা দূর। দূর আর দূরের খেলা। দূরের টান। যখন দূরে যাবার সময় আসে, মানুষ রক্তের ভেতরে টান পায়।
সদরঘাট ছেড়ে, বাহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে, রায়সাহেব বাজার বাঁয়ে রেখে, ইংলিশ বাজার ভেদ করে লাল জিপটা গোলাপ শাহ মাজার ছুঁয়ে মহানগরে ঢুকে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে কেরানির মন থেকে অতীত মুছে যায়। না ময়না, না রুপাই, না রুহিতন, না মদিনা, না টঙ্গীর হোটেলে ম্যানেজারি, না নীল সাগর লঞ্চে তার চাকরি_ চোখের পলকে চাপা পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায় মহানগরের সড়কে দ্রুত ধাবমান যানবাহনের চাকার নিচে। হর্নের অবিশ্রান্ত উচ্চনাদে কানের পটাহ ছিঁড়ে যেতে থাকে।
খাম্বা সামাদের লাল জিপ কেরানিকে নিয়ে এসে দাঁড়াতেই বাগানবাড়ির গেট খুলে যায়। কেরানি জানে, আজ থেকে সে এই বাগানবাড়িতে থাকবে। আমরাও তার সঙ্গে বাগানবাড়িতে ঢুকে পড়ি। কেরানির মতো আমরাও অবাক হয়ে যাই বাগানে ময়ূর দেখে। একটা ময়ূর পেখম বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। ময়ূর আমরা ছবিতে ভিন্ন জীবন্ত কখনো দেখি নাই। কেরানিও দেখে নাই।
জিপের শব্দ পেয়েও ময়ূরটি নড়ে না, পেখম গুটিয়ে পালায় না। বুঝি মানুষের সাড়া তাকে আর বিচলিত করে না। ময়ূর পেরিয়ে আমরা হরিণ দেখি। একটি মা হরিণ দুটি শিশু হরিণ নিয়ে কচি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। তারাও জিপের শব্দে ভীত হয়ে পড়ে না। ছুটে পালায় না। ঘাস খেয়েই চলে। পশুও এমন নিঃশঙ্ক, এ কেবল বেহেশতেই বুঝি সম্ভব।
বেহেশতের আরো বাকি আছে। জিপ থেকে নামতেই শাদা প্যান্ট-শার্ট পরা দুজন কর্মচারী তাদের নীরবে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে গিয়েই চোখ জুড়িয়ে যায় কেরানির। লাল কার্পেট পাতা বসবার ঘর। দামি সোফা। মাথার ওপরে ঝাড়বাতি, যেন আকাশ থেকে একগুচ্ছ তারা নামিয়ে তোড়া বানিয়ে রাখা হয়েছে। এয়ার কন্ডিশনার থেকে কুলকুল করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মিষ্টি একটা টুংটাং বাজনার স্বর চারদিক থেকে নিচু পর্দায় বেজে চলেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
কর্মচারী দুজন তাদের রেখে নিঃশব্দে ভেতরে চলে যায়। কেরানি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে খাম্বা সামাদের দিকে তাকায়। কিন্তু খাম্বা সামাদ উত্তর দেবার জন্যে মুখ খোলে না। তবে মুখ সে খোলে সিগারেট ধরাতে। ধরাতে গিয়েই তার মনে পড়ে যায়। খপ করে সিগারেটটা সে প্যাকেটে আবার পুরে ফেলে। জিভ কাটে। বলে, ভুইলা গেছিলাম, লেডি সিগারেট পছন্দ করেন না!
লেডি!
কেরানির কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ধ্বনি ফুটে ওঠে।
খাম্বা সামাদ ফিসফিস করে বলে, দেখবেন! ইউ উইল বি ওয়ার্কিং উইথ হার। আপনে বসেন ভাই, আমি আইতাছি।
খাম্বা সামাদ চলে যায়। ঘরের ভেতরে কেরানি এখন একা। মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় একটা শব্দ। লেডি! কোনো মহিলা যদি খুব সম্মানের জায়গায় থাকেন তবে তাঁকে ইংরেজি কেতায় লেডিই বলা হয়, তাই তো? ভাবতেই কেরানির দম বন্ধ হয়ে আসে। তবে এক লেডির সঙ্গেই তাকে কাজ করতে হবে। তারই জন্যে খাম্ভাই তাকে এখানে এনে ফেলেছে!
কতশত ভাবতে ভাবতে কেরানির হঠাৎ মনে পড়ে যায়_ লাল তিল! রানী বিভাবতীর স্ত্রী অঙ্গে! জিপের ভেতরে খাম্বা সামাদের মুখে শোনা সেই কথাটি আঠার মতো কেরানির মনে সেঁটে বসে যায়। তখন অতটা ভাবে নাই, এখন মনে হয়, রানীও তো এক লেডি, নাকি? কেরানির মনটা ছিঃ ছিঃ করে ওঠে। এসব কী ভাবছে সে? তবু পেছন ছাড়ে না বদখেয়াল। রুহিতনের কোমরজুড়ে লাল একটা দাগ। বিছের মতো দগদগে। মনে পড়ে কেরানির।
ওটা তোমার কী? জন্মের দাগ?
না, ছায়া পিন্দি। ছায়ার নেওয়ারের দাগ। টাইট কইরা তো! বইসা গ্যাছে!
তাই? দেখি, দেখি।
আহ্ ছীক্কো, দ্যাখতে হইবো না!
মনে পড়ে, কিন্তু মন থেকে মুছে যায় না। চোখের ভেতরে রুহিতনের লাল দাগটা বিছিয়ে থাকে। কেরানি চোখ বোজে। এমন একটা সুন্দর জায়গায় এ রকম বদচিন্তা কেন ফিরে ফিরে আসছে তার? সে ঘরের চারদিকে তাকায়, দেয়ালে ছবি দ্যাখে, ঝাড়বাতির আলো দ্যাখে, মিষ্টি বাজনাটার দিকে মন ফেরাতে চেষ্টা করে। এমন সময় শাদা প্যান্ট-শার্ট পরা কর্মচারী একজন ফিরে আসে ঘরে।
এসেই সে কেরানির পাশ থেকে তার সুটকেসটা হাতে নেয় নিঃশব্দে। ইশারায় তাকে জানায় অনুসরণ করতে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেরানি উঠে দাঁড়ায়।
লোকটি তাকে একটি বেডরুমে নিয়ে যায়। কেরানির চক্ষু স্থির! বেডরুম যে এতবড় হতে পারে তার ধারণায় ছিলো না। মাঝখানে খাট। ডবল খাট। খাটের ওপর বালিশ বিছানা ঢেকে নকশিকাঁথা বিছানো। খাটের পায়ের কাছে ডবল সোফা। ডানে-বাঁয়ে নিচু টেবিল। টেবিল ল্যাম্প। দেয়ালের একটা পাশজুড়ে ওয়ারড্রোব। সমস্ত ঘর নিমীলিত ঘুম-ঘুম হয়ে আছে স্তিমিত আলোয়।
লোকটি কেরানির সুটকেসটা ওয়ারড্রোবের পাশে টেবিলের ওপর রাখে। ঠিক এই সময়ে খাম্বা সামাদ ঘরে এসে উপস্থিত হয়। এতক্ষণ কেরানি যে সন্ত্রস্ত হয়ে ছিলো, খাম্বা সামাদকে দেখে তার জানে পানি আসে।
খাম্বা সামাদ বলে, লন, গোসলটা সাইরা লন। লেডি আর্লি ডিনার করেন। তারে ওয়েট করান ঠিক না।
গোসল তো আমি করে এসেছি।
খাম্বা সামাদ কেরানির পিঠে আদরের ঠেলা দিয়ে বলে, আরে, হইছে! দুইবার করতে অসুবিধা কী? গোসল কইরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পইরা লন।
তখন কেরানির চোখে পড়ে খাটের পায়ের কাছে ডবল সোফার ওপর রাখা পাজামা-পাঞ্জাবির সেটটা। ধবধবে শাদা, ফিনফিনে। পাঞ্জাবি তো বটেই, পাজামাটাও। কেরানি অপ্রতিভ হয়ে ভাবে, এত ফিনফিনে পাজামা পরলে শরম-ভরম থাকবে?
ম্যাজিকের মতো খাম্বা সামাদ একটা সেফটি রেজর কেরানির সমুখে তুলে ধরে। রেজরটা কোথায় ছিলো? পাজামা-পাঞ্জাবির ওপরেই কি? না, বাথরুম থেকে এনেছে খাম্ভাই? নাকি পকেট থেকেই বের করে সে? বলে, আর শেভটাও কইরা লন।
শেভ তো আমি করেইছি সকালে।
আবার করেন! গালের দাড়ি নিচের দাড়ি দোনোটাই! বলেই ঠেলা দিয়ে কেরানিকে বাথরুমে পাঠায় খাম্বা সামাদ। কেরানির কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেমন থমকানো ধমকানো বলে ঠেকে। তার নিজের যেন কোনো ইচ্ছে বা বলশক্তি আর নেই। সবই এখন অপরের। যেন কোরবানির ছাগল। তাকে গোসল করানো হচ্ছে, মালা পরানো হচ্ছে, কিন্তু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জবাইয়ের ছুরির দিকে।
ওই নিচের দাড়ি কথাটা_ বাথরুমে গিয়ে কাপড় ছেড়ে উলঙ্গ হয়ে পানির ধারার নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পরে_ হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে যায় কেরানির কাছে। এটাও শেভ করতে হবে! তার মনের ভেতরে তখন যদি কোরবানির ছাগল ভ্যাঁ করে ওঠে, সেটা আমরা শুনতে পাই, কেরানি পায় না।
কেরানি গোসল করে বেরোয়, ফিনফিনে পাজামা-পাঞ্জাবিটা পরে। পায়ের কাছেই নতুন এক জোড়া চপ্পল ছিলো, পরে নেয়। অবাক হয়। আরে, এরা দেখি আমার পায়ের সাইজটাও জানে। চপ্পলটা ভারী ফিট করেছে। পা ফেললেই মিচমিচ করে আওয়াজ করছে।
খাম্বা সামাদ বলে, আসেন, ডিনারের টাইম। আমি অবশ্য থাকবো না। আই শ্যাল লিভ ইউ নাউ। ইন্ট্রিডিউসটা করায়া দিয়াই আমি ভাগুম। আর হ্যাঁ, একটা কথা!
বলেন।
নো রাজনীতি।
মানে?
ভুইলা যান দ্যাশে গোলমাল, গলতন্ত্র কি মিলিটারি, কি বঙ্গবন্ধু জিয়া, কি রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা, মোটে তুলবেন না।
কেরানির মনে পড়ে যায় এই তো মাত্র দুদিন আগেই রুপাইয়ের স্বামীকে অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে যখন সে খাম্বা সামাদের সাহায্য চেয়েছিলো, তখন তেড়ে উঠে লোকটা বলেছিলো_ নো দিস ভেরি ক্লিয়ারলি। নো পলিটিকস। রাজনীতি আনবেন না। রাজনীতি টানবেন না। আর, মঙ্গলবারে যেইখানে নিয়া যাবো, পলিটিকসের কথার ধারেকাছে যাইবেন না।
খাম্বা সামাদ কেরানিকে নিয়ে বেরোয়। বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। কেরানি ভেবে পায় না কোথায় যাচ্ছে ডিনারে? এ তো কেবল গাছের পর গাছ, পুকুরের পর পুকুর, কুঞ্জবনের পর কুঞ্জবন! মাঝে মাঝে দুধের মতো আলো। মাঝে মাঝে লাল-নীল বিন্দু বিন্দু আলো। ওই তো এক বিরাট খাঁচা। পাখির খাঁচা। মানুষের ঘরের সমান বড় খাঁচা। ভেতরে ঝটপট করছে কয়েকটা পাখি। আর কিছু পাখি ধ্যানে বসে আছে খাঁচার ভেতরে শুকনো গাছের ডালে।
রূপকথার মতো মনে হয় কেরানির। জেগে নয়, স্বপ্নের ভেতরে এসব, তবে এর একটা অর্থ হয়! নইলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মুহূর্তেই। ঘোরের মধ্যে কেরানি হেঁটে চলে খাম্বা সামাদের পেছন পেছন।
বনের মধ্যে হঠাৎ একটা গোলঘর চোখে পড়ে। অন্ধকারের ভেতরে কড়া শাদা আলোয় উদ্ভাসিত ঘর। মাথায় শনের ছাউনি, চারদিক খোলা। লাল টকটকে মেঝে। একটা টেবিল। গোল টেবিল। দু’পাশে দুটি চেয়ার। গোল চেয়ার। আর? আর মাথার ওপরে তখন বনের গাছে আগুন ধরিয়ে উঠে পড়েছে গোল পূর্ণিমার চাঁদ।
আজ বুঝি পূর্ণিমা? দুধের ধারা ঝরে পড়ছে পৃথিবীতে।
কেরানি মুগ্ধ হয়ে যায়।
তার ঘোর ভাঙে সুরেলা একটি নারীকণ্ঠে। সুরেলা, কিন্তু তিরস্কারের।
আহ্! এমন জোছনা! চোখে দ্যাখো না? এত কড়া আলো জ্বালিয়ে রেখেছো?
সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের উজ্জ্বল আলো দপ করে নিভে যায়। পূর্ণিমার আলো তখন আরো প্রখর হয়ে ওঠে। গোলঘরে তখন টেবিল আর চেয়ার দুটো ভিজে ওঠে ঠাণ্ডা দুধের মতো আলোয়।
নারীর ওই সুরেলা তিরস্কারের কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে কেরানি ঝটিতি চোখ ফেরায়।
কিন্তু চোখে পড়ে না কাউকেই। আরে আশ্চর্য!
খাম্বা সামাদের দিকে নীরব প্রশ্ন চোখে এঁকে তাকায় কেরানি।
খাম্বা সামাদ কোনো উত্তর তো করেই না, তাকে তার বরাবরের আত্মবিশ্বাসেও দেখতে পায় না কেরানি। তাকে চেনাও যায় না আর। উৎকণ্ঠিত, ভীত-সন্ত্রস্ত, লাথি খাবার জন্যে পিঠ যেন প্রস্তুত হয়েই আছে এখন খাম্বা সামাদের।
আর ঠিক তখন! তখন গোলঘরের ওপারে অন্ধকার ডোবা মলি্লকা বনের ভেতর থেকে যে নারীটি বেরিয়ে আসে, তাকে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় আমাদের কেরানির।
লেডি!
এ যে তার স্বপ্নেরও অতীত। ইনিই তিনি! এই মানুষটি! সারাদেশে কে না চেনে তাঁকে! কে না তাঁর দাপট জানে! টাকা! ক্ষমতা! তাঁর আঙুলের ডগায়! এই কি তিনি! কেরানি ভুল দেখছে না তো?
গোলঘরের লাল মেঝের ওপর হালকা গোলাপি প্রায় স্বচ্ছ শাড়িতে যেন এক রূপ প্রতিমা। কুমারীর নয়, কিশোরীর নয়, যুবতীর নয়, সধবারও নয়। এ সবকিছুর ঊধর্ে্ব এক রূপ তাঁর বয়সী চন্দনবৃক্ষের মতো।
খাম্বা সামাদ সালাম করে গদগদস্বরে বলে, আমি তবে আসি? বলেই সে চোখের পলকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
লেডি আঙুল ঈষৎ তুলে কেরানিকে বলে, কাম, সুইটবয়, টেক ইয়োর সিট।
আসন গ্রহণ করবে কি, কেরানির চোখ ফেরাতে পারছে না। লেডির মাখন মোলায়েম মুখ। আর তাঁরই কি-না ওই আঙুল, শীর্ণ, হাড় উত্তল, যেন এক বুড়ির!
[চলবে]