সূর্যের ফেরার অপেক্ষায়

সূর্যটা তার নিয়মমাফিক এভাবেই ওঠে আবার শেষ বেলায় এভাবেই কুয়াশার ধূসর একটা মখমলের পর্দা নামিয়ে দেয়। স্নিগ্ধ কান্তি নেমে আসে চার দিকে। গাছপালায়, নমিত ফুলের ডালে ভেজা ভেজা শিশির ঝরতে শুরু করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হাত রাখেন শরাফত আলী। একা একা বুকের ভেতরে উথলে ওঠা নিঃশব্দ কান্না তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা বছরগুলোতে। ঘরের মধ্যে রোজকার মতোই নাতি-নাতনিদের কলরব মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবী এভাবেই চলে আসছে। যত কিছু অনিয়ম হোক, বেঁচে থাকা জীবন স্রোতের প্রধান নিয়মই হচ্ছে একঘেঁয়েমি। পেছন থেকে আসেফা বলেন,
এখনো দাঁড়িয়ে আছো? ঠাণ্ডা লাগবে। ভেতরে যাবে না?
চাদরটা এনে স্বামীর গায়ে দিয়ে দেন। শরাফত একটা মৃদু হুঁ শব্দ করেন। কয়েকটি নিঃশব্দ মুহূর্ত কেটে যায়। তারপর আসেফা ভেতরে ফিরে যান। দীর্ঘ দিনের বুকের যন্ত্রণার কতটুকুই বা বলতে পারে মানুষ? হারানো দিন, হারানো মানুষ, হারানো জীবন, কেবল স্মৃতির আয়নায় উঁকি দিয়ে যায়। ডিসেম্বর মাস এলেই মেয়েটা এসে মায়ের কাছে বসে, তার ছেলেমেয়েরা নানীর আদর নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। জানে, মানুষের নিঃসঙ্গতা দূর করা কঠিন, তবু কাছাকাছি থাকলে ভালো লাগবে। সবাই মিলে মা-বাবার নৈকট্য পাওয়া যাবে, কষ্টগুলো ভাগ করে নেয়া যাবে। এই টুকুই তো অনেক দামে পাওয়া। আসেফা বলেন,
কোনো কিছুরই বেশি দাবি করতে নেইরে। নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে গেলেও অনেক কিছুই হারাতে হয়। ছেলেবেলায় তুই বড় গোল চাঁদ ধরে আনবার বায়না করতিস। তোকে যতই বোঝাই, তুই বুঝতে চাস না। কেঁদে কেটে একেবারে হয়রান। তখন তোর মন খুশি করার জন্য তোর ভাইয়া বলতো ‘আমি গুলতি দিয়ে চাঁদটাকে একেবারে নামিয়ে আনবো আর তোর হাতে তুলে দেবো। ঠিক আছে? চল এখনকার মতো জ্যোস্নায় বেড়িয়ে আনি তোকে। তারপর সাইকেলের রডে বোনকে বসিয়ে হো হো করে সোজা বেরিয়ে যেতো সবুজ। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে সেই ছয় বছর বয়সের বায়না নিয়েই বড় হলো তিতলি।
মায়ের আদরের সাথে সাথে মিলিয়েই জীবন কাটছিল দুই ভাইবোনের। মাঝখানে সব কিছু যেন একটা দুঃস্বপ্নের ঝড়। সারা দেশ তছনছ হয়ে গেল। ঘরে ঘরে মৃত্যু আর শূন্যতা। সবুজ কারো কথা শোনেনি। বলে গেছে,
‘ফিরে আসবো স্বাধীন দেশে। আব্বা আমাকে দোয়া করবেন। আমি ঠিক অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আপনার আশা পূরণ করব। কিন্তু যুদ্ধ জয় না করে নয়। একটু চুপ করে থেকে আসেফার পা ছুঁয়ে ছিল সবুজ।
আম্মা, তুমি দোয়া করো…না না কান্নাকাটি চলবে না। এই তিতলি, এখন তো তোর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। আমি না ফেরা পর্যন্ত তোকেই আব্বা আম্মার খেয়াল রাখতে হবে। অনেক কথা একবারে বলে থেমে ছিল সবুজ। কষ্ট করে, জোর করেই থেমেছিল কথার আবেগ। ছেলের চলে যাওয়ার সে মুহূর্তগুলো বুকের মধ্যে কেটে বসে আছে। সারা দিন থেকে থেকে ছবিটা ফিরে আসে। ওই তো সবুজ হেঁটে যাচ্ছে…বাগানের কাঠের গেটটা খুললো। মাথার চুলটা একটা ঝাপটা দিয়ে সরাবার ওই ভঙ্গি, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছে ছেলেটা।
এই সবুজ… ঠাণ্ডা লাগাস না বাবা, ওষুধগুলো হারাস না…
ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। এক পলকের জন্য মনে হয়, ফিরে আসবে। কিন্তু না, জায়গাটা শূন্য। প্রতি মুহূর্তে ভুলতে চান আসেফা। মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর মনকে নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। অনেক কাজ ফিরে ফিরে করেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। বাড়ির কোথাও ধুলোবালির চিহ্নমাত্র নেই। একসময়ে খুব উলের জামা বুনতে ভালোবাসতেন আসেফা। সেসব দিনও এখন মনের চোখে পুরনো লাগে। এখন ঘরে ঘরে মেশিনে বোনা গরম কাপড়ের চল হয়েছে। এখানকার গরম পোশাক বিদেশেও খুব যায়। ফলে মনের দিক থেকে তেমন তাগিদ পান না। তিতলি এসে হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে করে দেয়। পুরনো কাগজপত্র বেছে দেয়। বলে
আর কত জঞ্জাল জমাবে আম্মা? ফেলে দাও, বিক্রি করে দাও। আসেফা বলেন
জামাই কখন আসবে তিতলি? তুই সন্ধ্যার মুখে এলি?
সব গুছিয়ে এসেছি আম্মা। সোনালিকে কোচিং থেকে সাথে নিয়ে ওর বাবাকে এখানে আসতে বলেছি। তুমি চা খেলে বলো, করে আনি।
দু’জনে চা খেতে খেতে পুরনো দিনের গল্প করে। ডিসেম্বর মাস এলে এ বাড়িটা যেন অন্যরকম লাগে। বিকেলের বেড়ানো শেষ করে ফিরে আসেন শরাফত আলী। মেয়েকে দেখে মুখটা হাসিখুশি হয়ে ওঠে তার। মেয়ে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে স্বামী আর ছেলের জন্য নাশতা বানাতে যায়। ঠিক এই সময় শরাফত আলী সূর্যডোবা ধূসর, রক্তাক্ত আকাশকে নিঃশব্দে নেমে আসতে দেখেন। মনে হয় কারো ব্যাকুল, ছটফটে গলার আওয়াজ। শুনতে কান পেতে অপেক্ষা করেন। তিনি একা নন। চার পাশের পুরনো গাছপালা, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ওপর শিশির ঝরে পড়তে তাকে। দু’একটা পাখি যেন ত্রস্তব্যস্ত হয়ে গাছের ডালের ওপর বসে উদ্বিগ্ন গলায় ডেকে ওঠে। আস্তে আস্তে বারান্দায় রাখা আর্মচেয়ারে গিয়ে বসেন শরাফত আলী। এই সময়টায় ছেলেটা কাস করে ফিরে আসত। হাত দিয়ে বাগানের দরজাটা সরানোর শব্দ পর্যন্ত শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকেন শরাফাত আলী, একসময়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে নিজের সাথে নিজেই কথা চলে তার। নিজেকে বলেন
ওই সময়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না কেন বলো তো? এত বছর পার হয়ে গেল। বছর বছর চাকরি করলাম, বাড়ি রঙ করালাম। সবুজ আসবে, তাই। বাইরের পৃথিবী প্রতিদিন নতুন নতুন ঘটনা, নতুনত্ব নিয়ে আসছে তো আসছেই। নতুন নতুন ভাবনা, টেকনোলজির জয়যাত্রা। আমি কেন বছরের শেষ মাথায় পৌঁছে কেবলই এক ষোলো বছরের তরুণের চলে যাওয়া, ফিরে আসা, তার কণ্ঠস্বর শোনার আশায় দিন গুনতে থাকি? ও তো বলেছিল, ও ফিরবে। তবে ফিরল না কেন? ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলেন শরাফত আলী। বুকের মধ্যে বসে এক অবুঝ শিশু যেন অভিমানে ভেঙে পড়ে। কেবলই উচ্চারণ করে
কেন কেন, কেন, কেন? আসেফা নিজের ঘরে পুরনো খাতাপত্র বাছাবাছি করছিলেন। ছোট আলমারি ভর্তি বই। প্রাণে ধরে, ফেলে দিতে পারেননি। সবুজের কলেজের নতুন বই, খাতা আরো কত শখের জিনিস। নিচের দুটো ড্রয়ারে দুই ভাই বোনের প্রিয় ডাক টিকিটের খাতা। বাক্স ভরা জরির ঝালর, না ফোলানো বেলুন, একগুচ্ছ কলম। রঙের টিউব, শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। সব কিছু যতœ করে রেখেছে তিতলি। আসেফা ওগুলো ধরেন না। তিতলিই মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করে। আবার গুছিয়ে রাখে। সবুজের প্রিয় সাইকেলটা শরাফত আলী নিজেই এক অভাবী যুবককে দিয়েছেন। বলেছেনÑ এটা আমার ছেলের খুব শখের সাইকেল। একজন মুক্তিযোদ্ধার জিনিস। যত্ন করে রাখবে। কোনো অসম্মান যেন না হয়। বুঝেছো? ছেলেটা কৃতজ্ঞতায় ভেঙে পড়েছিল। তারপর থেকে মধ্যে মধ্যেই ক্ষেতের সবজি, পেঁয়াজ নিয়ে আসত। আসেফা কখনো কখনো রাগ করেন। বলেন
কেন বাপু এসব নিয়ে আসছ? সবুজ থাকলে খুব রাগ করত। শরাফত সাহেব বলেন
সাইকেলটা ঘরে পড়ে পড়ে জং ধরে যেত, তার চেয়ে তোমার কাজে লাগল। আসেফা, ও শখ করে সবজি এনেছে, হাসিমুখে রেখে দাও। তো, এভাবেই দিন কাটছে। তিতলির জামাই অবশ্য মাঝে মধ্যে বলে
বাড়িটা এরপরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে আব্বা। পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে পড়লে মহাবিপদ নেমে আসবে। শরাফত আলী রোজ বিকেলে লম্বা ওয়াকিং সেরে ঘরে ফেরেন। ঘরে ঢুকেই এ কথা শুনলে তার ভ্র কুঁচকে ওঠে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন
আমার বন্ধু কোথায় রে তিতলি? অর্থাৎ তিতলির ছেলে। সে তো তোমার মতোই বইয়ের পোকা, আব্বা। কী একটা যুদ্ধের ইতিহাস পেয়েছে, বিশ্বভুবন ভুলে ওঠা নিয়ে ডুবে আছে কিসের যুদ্ধ? স্বাধীনতার যুদ্ধ? ওকে ওর বাবার কাছে বসতে বলিস। তুমি ওকে বলো না? শরাফত আলী জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন। ভারী গলায় শাহেদ বলে,
‘জ্বী, বলি তো।’ জামাই বাস্তববাদী মানুষ। স্বাধীনতার পরে অর্থাভাবে দারুণ কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে অনটনের সাথে লড়াই। দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করতে হয়েছে। আদর্শের মৃত্যু। কলেজে পড়তে পড়তে যুদ্ধে গিয়েছিল। ফিরে এসে জীবনের সাথে সাফল্যের হিসাব মেলাতে পারেনি। নিজেকে বড় বেশি বেমানান মনে হতো। একসময় ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছিল। বছর কয়েকের মধ্যে পেয়ে গেল সোনার চাবি। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঘরসংসার পেতে জমিয়ে বসেছে শাহেদ। তিতলি খুব ভালো মেয়ে। চার দিক সামলে নিতে পারে সহজেই। ইস্কাটনে আলিশান বাড়ি। প্রতি বছর মানুষ পাঠায় বিদেশে। গার্মেন্টসও আছে দুুটো। দীর্ঘকাল পেরিয়ে এসে কবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সে স্মৃতি বর্তমানের প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ফিকে হয়ে আসছে। নিজের ভীষণ ব্যস্ততার কারণে অফিসিয়াল পার্টিগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধের আসা যাওয়া একটা প্রতীকের মতোই দূরগামী স্বপ্ন, যা মাঝে মধ্যে ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে জানান দেয়। ওর ছায়াশরীর একটা গভীর ক্ষতের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে বুকের গভীরে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে মনে পড়লেও, উচিত অনুচিতের প্রয়োজনে সামনের দৌড় তাকে দূরে টেনে নিয়ে যায়, যার সবটাই পরিচ্ছন্ন নয়। তবে সংসারে তিতলির কাছে অনেক কৃতজ্ঞ থাকে শাহেদ। জানে, নিরিবিলি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিতলি যে মুহূর্তে তার দুঃখ আর বইতে পারবে না, কোনো দাবিও রাখবে না। সরে যাবে। ভাইয়ের স্মৃতি ওদের পরিবারে আজো কাঁচা, ঠিক যেন কালকের ঘটনা। রক্তের কোনো দাগ নেই। শুধু বুকের মধ্যে অবিরাম প্রাণোচ্ছল একটি তরুণ মুখ। এত জীবন্ত, এত ছটফটে যে, সেই স্বপ্নটাই রেখে গেছে ওদের মূলধন হিসেবে। শাহেদ জানে বর্তমানের সাথে যুক্ত থাকলেও তিতলিদের পুরো পরিবার স্মৃতিতে ডুবে আছে। শাহেদ তাকে সম্মান করে। এক সময় উঠে দাঁড়ায় সে। বলে, চলো তিতলি রাত হচ্ছে। বাবনকে ডাকো। পাড়ায় মুরুব্বিরা বিজয় দিবসের দিনটি সুন্দর করে পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উৎসাহ আর আনন্দ নিয়ে রিহার্সাল চলছে। শরাফত আলীর কাছে সবুজের একটা ছবিও চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। এসব কাজে খুব আগ্রহ নেই তার। কিন্তু সহযোগিতা করতে সর্বদা প্রস্তুত। আলমারিটায় ক’দিন ধরে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায় তিতলি। তার দুখী মুখটা দেখে খারাপ লাগে আসেফার। কী খুঁজছিস বল তো? ওই ড্রয়ারে তো তোদের দু’জনের সব জিনিস। কে আছে বাড়িতে, যে সব কিছুতে হাত দেবে, বল? চাবিটা, আম্মা, চাবিটাই পাচ্ছি না! কোথায় যে ফেলেছি! অস্থির হয়ে গেলাম। Ñতিতলি, আমার কাছে আয়। শরাফত আলী ডাকলেন। একটা চাবি তুলে দিলেন মেয়ের হাতে, বললেন
ভুল করে ফেলে গিয়েছিলি খাওয়ার টেবিলে। আমি অবশ্য ড্রয়ারটা খুলে দেখিনি। কী এমন দুর্লভ ধনরতœ রেখেছিস। মৃদু হাসেন শরাফত। কয়েক মুহূর্তেই পরিবেশটা পাল্টে যায়। হাতে ধরা বড় একটা খাম নিয়ে হাসতে হাসতে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় তিতলি। আম্মা, দেখ না দেখ, কী ভীষণ জিনিস লুকিয়ে রেখেছিলাম!
কী এমন জিনিস, দেখি? খাম খুলে তিতলি কত ছবি ছড়িয়ে দিলো ডিভানের ওপরে। বিচিত্র বিহ্বল কয়েকটি মুহূর্ত। সামনে ছড়ানো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার ছবি। সবুজ জমিনে স্বাধীন বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র। খুব যত্নে আঁকা পতাকাগুলো। সেলোফেন দিয়ে সযত্নে রাখা রয়েছে, এতটুকু ধুলোর মলিনতা নেই। যেন সদ্য আঁকা। কোনো জানান না দিয়ে আসেফার চোখ থেকে ঝরে পড়ল কান্নার ধারা। বুকের মধ্য থেকে ডুকরে ডুকরে উঠে আসছে। আমি আর ভাইয়া মিলে এগুলো শুরু করেছিলাম। স্বাধীন দেশে ভাইয়া ফিরলে তখন এগুলো মেলে দেবো, ওর জন্য উপহার। তিতলি ধরা গলায় বলল। Ñকখন আঁকলি এতসব? শরাফত আলী বলেন। যুদ্ধের মধ্যেই। সুযোগ মতো এঁকেছি, আর লুকিয়ে লুকিয়ে রেখেছি, যেন কেউ টের না পায়। তা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যে
ত। ‘ঠিক সময়মতো খুঁজে বের করলি তো! গোটা একাত্তর স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা কাজ করেছিস মা। আমি তো ভাবতেও পারি না। চোখ মুছে বলেন শরাফত। তিতলির ছবি আঁকা মানচিত্রের প্রদর্শনী গভীর সুখ, গভীর দুঃখ আর আবেগে বিজয় দিবসের আয়োজনে একেবারে বদলে দিলো। তিতলির তেরো বছর বয়সের খুশি খুশি মুখটা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। সবার স্নেহ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে, এখনই সেই মুক্তিযোদ্ধা নিঃশব্দে এসে দাঁড়াবে বোনের পাশে। সভাপতি বললেন
‘ঘোর যুদ্ধের মধ্যে এরকম দুঃসাহসী একটা কাজ করার কথা আমরা ভাবতেও পারি না। এই নীরব মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা সালাম জানাই। এখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লুকিয়ে আছে।’ পুরো সভা উঠে দাঁড়িয়ে শরাফত আলীর পরিবারকে সম্মান জানাল। আসেফা মেয়ের হাতটা জোরে ধরে রাখলেন। শরাফত আলীর সামনে সূর্যটা রোজকার মতোই আবছা হয়ে আসা কুয়াশার মখমলের পর্দাটা মেলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, একসময়ে গোটা আকাশে অচেনা অন্ধকার এসে সব পরিচয় ঢেকে দেবে। শরাফত আলী ছেলের জন্য কখনো চিৎকার করে শোকের মাতম তোলেননি। আজো তুললেন না। জানেন, ওই কুয়াশার অন্ধকার পেরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য অনেকের মতো তার সবুজও অপেক্ষা করে আছে। পেছনে পায়ের শব্দ টের পান। আসেফা, তিতলি, সবশেষে ছোট বাবন আর তার বাবা শাহেদ। বাবনের বুকে জড়িয়ে ধরা তার মায়ের আঁকা পতাকা। বাংলাদেশের বুকের মধ্যে জ্বল জ্বল করছে সবুজের তারুণ্যভরা হাসিমুখ। হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে বলছে,
আসছি আব্বা। তোমাদের কাছেই।