রক্তের দামে

চিলটা ধূসর আকাশে ঘুরছে। অনেক ওপরে এক বিশাল বৃত্ত তৈরি করে চক্রাকারে উড়ে উড়ে তীক্ষè আওয়াজ তুলে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। ওর পিছনে পিছনে আরও দু’একটা পাখি উড়ে আসছে। নিচে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে কি যেন একটা ঘটেছে নিচের গ্রাম-জনপদে। কোনো উৎসব কি? না। মহাভোজের অপেক্ষায় মানুষেরা প্রায়ই তৈরি করে বধ্যভূমি। পশুর দল তাদের প্রাণ দিয়ে মানুষের খাদ্য জোগায়। তখন চিলদের উড়ে উড়ে তাদের নিজেদের খাবার সংগ্রহের পালা। মানুষেরা কিন্তু সহজ জীব নয়। মাটি, মানুষ, জীবন সব কিছু ভাগাভাগি করে তবে ওদের শান্তি। এমন কি মাথার ওপরের আকাশকেও ওরা বুঝি ভাগ করে নেয়। মানুষ মাত্রই অধিকার প্রিয়। দুর্বলের ওপরে সবলের শক্তি চিরকাল টিকে থাকে। কিন্তু এখন তো কোনো যুদ্ধ নেই। তবে গ্রামগুলোর নীরব ঘুমন্ত মানুষেরা বুঝতে পারছে না যে, হঠাৎ কোথায় কি ঘটলো। শান্ত লোকালয় আচমকা কেঁপে ওঠে। ভোর সকালে আসেফ আলীর ছেলেটা সবেমাত্র মুখ ধুয়ে মুড়ি-গুড় দিয়ে খেয়ে ছাগল দুটোকে নিয়ে মাঠে যাবে বলে তৈরি। এমন সময় চেঁচামেচি-কান্নাকাটির একটা হাহাকার উঠলো অব্যক্ত বেদনায় শিহরিত আতঙ্কে সংসারের স্বাভাবিকতার বুকে আছড়ে পড়লো। সীমান্তঘেঁষা কাঁটাতারের সূচালো কাটা গেঁথে যে লম্বা লম্বা দেয়ালটা দাঁড়িয়ে আছে এখান থেকে দেখা যায় কিন্তু গ্রামের ঘর-গিরস্তির মানুষেরা সহসা ওটার হুমকির সামনে পড়তে চায় না। নিজেরাই অন্য দেশের অলিখিত নিষেধ মেনে নিয়েছে তারা। তবুও কিছু অঘটন ঘটেই যায়। নিয়াজ আলীর ১০ বছর বয়সের ছেলেটা ছোটোখাটো প্রশ্ন করে বাপ-মাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ লিখে খাতাটা ভরে ফেলেছে মনু। সে জানতে চায়
বাজান, আমাদের মাথার উপরের আসমানডা তো একটা বিরাট ছাতার মতন। এইডাও কি ভাগ হইছে?
তাইলে ওইডা নিয়েও মারামারি হবে বাজান?
পাগলের মত কথা বলিসনে মনু! আকাশ তো অনেক বড়। আল্লার দুনিয়ায় সবই কি আর ভাগ করা যায়। ওসব তোদের জানার দরকার নেই। আমরা বর্ডারের দিকে তোদের যেতে নিষেধ করিছি। এইডেই শেষ কথা।
ছেলেকে হাত ধরে গ্রামের শিশুদের জন্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে চলে যায় নিয়াজ আলী।

ভারী সুন্দর নিয়মে পাশের দেশের সঙ্গে এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। ওদিক থেকে পছন্দসই কাপড়ের গাঁইট মন্ত্রবলে এদিকে চলে আসে। কদিন সংবাদপত্রজুড়ে কেবল নানা রহস্য কথা। দুষ্ট লোকের সন্ধানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। আবার সবাই চুপচাপ।
কিন্তু মাঝে মাঝে গ্রাম-গঞ্জজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। কথাটা নিয়ে গ্রামজুড়ে, এলাকাজুড়ে মানুষ কখনও লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধে নামে না। কিন্তু তাতে করে দুর্ঘটনা বন্ধ হয় না। এই দেশের ব্যবসায়ীরা দুটো ভালো পয়সা বাজি রেখে কপাল ঠুকে কাঁটাতারের ওপার থেকে বড় বড় গরু নিয়ে আসে। একদিন সকালবেলায় লস্কর বাড়ির বড় ছেলে কাঁটাতারের নিয়ম-কানুন মেনেই ওপার থেকে গরু নিয়ে এপারে আসছিল। আচমকা পেছন থেকে গুলি লাগলো। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ¯্রােতবর্তী ছোট্টো নদীতে একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল কাদের। ভাসতে ভাসতে চলে গেল উজানে। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে দরজায় দরজায় হাত পাতলো আবু লস্কর। কিন্তু শীতল নিস্প্রাণ দেহটি নিয়ে দু’পক্ষের মিটিং হলে মালিকানার বিষয়টা পরিষ্কার না হলে তো নিষ্পত্তি হবে না। হতে হতে আড়াই দিন। পরে কর্তা ব্যক্তিদের সমঝোতা মিটিং আস্তে-ধীরে হলো, তারপর কাদেরের লাশটা গ্রামে ফিরলো। হ্যাঁ, ঝকঝকে হাস্যমুখ যুবকটি চাটাই মোড়া একটি বস্তার মতো আত্মীয়-স্বজনের কাঁধে চড়ে মাটির নিচে চলে গেল। তখন দুপুরটা ঢালে নেমে যাচ্ছে। গ্রামের বিশাল মখমলের মতো সবুজ গালিচায় ছুঁয়ে যাচ্ছে বেলা শেষের ¯িœগ্ধ বাতাস। যাওয়ার আগে সূর্যের রং থেকে ঝরে পড়ছে আলোর বিচিত্র লুকোচুরি। গ্রামীণ মানুষেরা যার যার খেত-খালা থেকে লাঙল-গরুগুলো নিয়ে ঘরে ফিরছে। তাড়াতাড়ি সাফসুতরো হয়ে গ্রামের ছোটো মসজিদে নামাজে দাঁড়াবে। মা তখন রান্না শেষ করে শোবার ঘরে খাবারগুলো গুছিয়ে রাখছে। দুরন্ত কিশোরের দল খোলা খাস জমিতে বাতাবি লেবু দিয়ে বল খেলে। গ্রামের শেষ মাথায় অন্য দেশের দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া। ওপার থেকে মাঝে সার্চলাইটের তীব্র আলো এসে ধাক্কা মারে। এ পাড়ের জনপদে ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে মানুষ ভাবে, এতো ভারি মজা! শান্তি করে ঘুমোতেও দেয় না। কি যন্ত্রণা।

এ গ্রামের মেয়ে মরিয়ম বেশ ক’বছর আগে বাপ-মায়ের সঙ্গে বর্ডার পেরিয়ে কাজের জন্য ওপারে গিয়েছিল। বা’জান ওখানে ভালো একটা কাজ পেয়েছিল। দু’পাড়ের লোকজন এ গ্রাম, ও গ্রাম- এ পার-ওপার হর-হামেশা চুপচাপ যাতায়াত করে। একথা সব মানুষজন জানে, প্রয়োজন বুঝে এ যাতায়াত সবসময়ই ছিল। আইন-কানুনের চোখ এড়িয়ে যেতে নিষেধ আছে। তবে মানুষের কত প্রয়োজন। ও পাড়ের গগণ কাকা, এ পাড়ের করিম মিয়ার একটুখানি সময়ের জন্য যেতে-আসতে দিনটাই ফুরিয়ে যায়- এরকম তো ঘটেই থাকে। মুস্কিল হয় যখন থেকে পেল্লায় এক কাঁটাতারের বেড়া খাড়া দাঁড়িয়ে যায় নিষেধের কঠিন চেহারায়। মরিয়ম বেশ কিছুদিন ওপাড়ে ছিল। অনেক নকশার কাজও শিখেছে। দেখতেও হয়েছে বেশ ডাগর-ডগরটি। বাপ-মায়ের কথা হলো- এবার মেয়েটাকে ঘর-বসত করিয়ে দেয়া দরকার। বাবা বললো, মেয়েকে নিয়ে আসবে। ছেলে মরিয়মের খালার ছেলে। ঘরগিরস্তি নিয়ে মা রয়েছে ঐ পাড়ে। মেয়েটার বিয়ের জন্য জোগাড়যন্তুর করতে ব্যস্ত। সুযোগ মতো কাঁটাতারটুকু পেরিয়ে যেতে পারলেই হলো। কাগজপত্র সই-সাবুদ নিয়ে ঝামেলা করার দরকার নেই। রাতের বেলায় বাজানের হাত ধরে রওনা হলো মরিয়ম। গলায় সরু একটা সোনার চেইন, কানে মাকড়ি। ওগুলো পরে নিয়েছে মরিয়ম- বিয়ের গয়না। অন্ধকারে একটা মই বেয়ে কাঁটাতার পার হয়ে বাজান বললোÑ চট করে কাঁটাতারটা পার হয়ে ও পারে নেমে আয়। বাজানের কথামতো মই বেয়ে শেষ মাথায় উঠে শুধু লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা। কাঁটাতারে আটকে যায় মরিয়মের পরনের কাপড়। ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মরিয়ম বাজান গো…
নেমে আয় মরিয়ম, লাফ দে। বাজান বলে ওঠে।
পারতিছি না বাজান, আটকে গিয়েছে কাপড়। ওপারে নেমে পড়ার জন্য ধড়ফড় করে মরিয়ম কিন্তু কাঁটাতারের কাঁটায় কাপড় আরও বেশি জড়িয়ে যায়। প্রাণপণ চেষ্টা করেও দাঁড়াতে না পেরে কেঁদে ওঠে আরও জোরে। পাহারায় ছিল যারা, কান্নার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে। কিছু বোঝার আগেই নিষ্ঠুর ধাতব শব্দটা মরিয়মকে থামিয়ে দেয়। তার বাবার আর্তচীৎকারে অনেক মানুষ দৌড়ে আসে। মরিয়মের মায়ের বুকফাটা কান্নায় ফিকে হয়ে আসা রাত্রীর শেষ প্রহর যেন থর থর করে কেঁপে ওঠে। মরিয়ম হাত নাড়ে না, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে না। নিস্পন্দ দেহটা ঝুলে থাকে অনেকটা উঁচু কাঁটাতারের সঙ্গে বিদ্ধ হয়ে।
মরিয়ম… আমার মা… রে এ এ এ…। ছুটে গিয়ে মেয়েকে নামিয়ে আনতে যায় মরিয়মের বাবা। তাকে থামিয়ে দেয় গ্রামের মানষ। কাঁটাতারের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য পক্ষের সৈনিকরা। সেই সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠে এপাড়ের শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও।

না। ঝুলে থাকা মরিয়মের শরীরটা এত সহজেই নামিয়ে আনা যায় না। বিরাট একটা প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে সে। সে তো চোরাচালানি নয়। তাহলে ওভাবে কাঁটাতার পেরিয়ে আসছিল কেন? নিয়ম-কানুনের জন্য অপেক্ষা না করে আসাটা বেআইনি তা কি লোকে জানে না? কিন্তু এভাবে যে মানুষ সর্বদাই চুপচাপ যাতায়াত করছে। তা তো কারো অজানা নয়। এখন যখন ঘটনা ঘটেই গেল তখন বিচারের জন্য অপেক্ষা করে কি মেয়েটাকে ওভাবে ঝুলিয়েই রাখবে? এ পাড় থেকে বাজান কাঁদাকাটি করে বলে, ওদেশে তারা আত্মীয়ের সঙ্গে ছিল। মেয়েটার বিয়ে দু’দিন পরেই ঠিক হয়েছে, মরিয়ম এলে বিয়ে হবে। তাই এই চেষ্টা।
এসব কথায় দু’পক্ষেই মৌখিক সহানুভূতি জানায়। লম্বা মিটিং চলে দু’দেশের মধ্যে। মোটমাট আটচল্লিশ ঘণ্টা পার করে তবে ওরা মরিয়মকে নামিয়ে আনে। কান্নায়, মাতমে তাদের গ্রামটি ডুকরে ডুকরে ওঠে। একেবারে চিন্তার বাইরে এমন নিষ্ঠুরতা। তাকে দেখায় এক অপার্থিব ভাস্কর্যের মতো। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা দীর্ঘ প্রহরগুলোর একটি ঝুপসী বকুল গাছ তলায় বসে থাকে বাজান, মা আর আত্মীয়-বন্ধুরা। সাংবাদিকরা ছবি তোলেন। স্তম্ভিত স্তব্ধ বেদনায় থেকে থেকে মা আর বাজান বুক চাপড়ে হাহাকার করেন। বিচার চান আল্লাহর কাছে।
মরিয়মের শেষ শয্যা হয় বাড়ির এক কোণায় একটা শিউলি গাছের নিচে। ছেলেবেলায় ঐখানেই ও পুতুল খেলা খেলেছে। শিউলি ফুলের মালা গেঁথেছে। এক ধরনের বেদনা গোটা গ্রামটাকে ঘিরে রাখে। গ্রামের শিশুরা মুখে আঙুল পুরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। কাঁটাতারের বেড়াটা যেন এক চোখো দৈত্যের মতো।
মানুষের পৃথিবীতে চলে হানাহানি। হরিণ ছানার ওপর লাফিয়ে পড়ে সিংহ যেমন রক্ত পান করে, তেমনই দেশে দেশে ঘটে যায় নৃশংস নিষ্ঠুরতা। মানুষের জীবনের স্বপ্ন আর আশাকে দলিত মথিত করে চলে তথাকথিত নিয়ম-কানুনের ষ্টিমরোলার। বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকেরা কাগজে-কলমে দিনরাত হিসাব করেন। ফাইল ভরে যায় যুক্তি-তর্কের আদান-প্রদানে। মাঝখানে পড়ে যায় সাধারণ মানুষেরা। তারা যুক্তি-তর্ক বোঝে না। হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে দু’মুঠো ভাত খেয়ে সংসারের সুন্দর ছবি তৈরি করে। তাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো বাইরের পৃথিবীর অর্থহীন নির্মমতায় মুখথুবড়ে পড়ে। শিউলি গাছের পাতা চুঁইয়ে শিশিরের ফোঁটা পড়ে কবরের মাটি ভিজিয়ে দেয়।
শেষ রাতে হুহু করে হাওয়া ওঠে। সে যেন বিহ্বল হয়ে জানতে চায়
মরিয়ম… মরিয়মরে… বাড়ি ফিরবি না?
-কেমন করে যাবো বলো? ওরা ফিরতেই দিলো না। কোথা থেকে যেন কান্নার শব্দ ওঠে। ছোট্ট গ্রামটা বেদনায় মুহ্যমান হয়ে থাকে। শোকে কাতর জনপদ।

চিলটা চক্রাকারে উড়তে থাকে। কোথায় যেন কি অঘটন ঘটেছে। শোকার্ত মানুষদের জমায়েত দেখে বারবার ফিরে আসে চিলটা। ভাবে, ঐখানে মানুষরা কিভাবে মেয়েটাকে মেরে ফেললো? দু’দিনের বেশি ঝুলিয়ে রাখলো? খানিকটা ঘৃণায় ডানা ঝাপটে ঝাপটে সান্ত¦না জানায় চিলটা। ওর তীক্ষè চিৎকারটাও যেন কারও কাছে বিচার চায়। তারপর উড়ে যায় ওপরের বিস্তীর্ণ নীল আকাশে।