ছোট ছোট ভুলগুলো

সেই কোন শিশুকালে পরিবারের সযত্ন স্নেহ-আদর নিয়ে এক পা এক পা করে বেড়ে উঠেছি। শুধু আদর-আবদার নয়; বড়দের কাছ থেকে প্রতিদিন পদে পদে নির্দেশ এবং অনুশাসন ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কী বলব, কী বলব না; কীভাবে চলব অথবা চলব না; কার সঙ্গে মিশব বা মিশব না_ সব কিছুতেই মা-বাবা, ভাই-বোনদের উপদেশ শুনে শুনে একটা রুটিন লাইফ যাকে বলে, তা নিয়েই বড় হয়েছি আমি এবং আমাদের সমবয়সীরা। তাতে আমাদের কখনো বিরক্তবোধ হয়নি। মাঝেমধ্যে দলবেঁধে বন্ধুরা সিনেমায় গিয়ে মুগ্ধ হওয়ার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। তার জন্য অবশ্য অনেক দেনদরবার করতে হতো। আসলে বড়দের যৌক্তিক শাসনটা ছিল খুব প্রয়োজনীয়। আমাদের কখনো মনে হয়নি বড়রা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন অথবা স্বাধিকারে আঘাত করছেন। আমাদের চলাচল, আচার-ব্যবহার মনে রেখেই তারা আমাদের তৈরি করে দিতেন। সামনে অনেক বিপদ-আপদ থাকতে পারে; তাকে মোকাবেলা করা যেন আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় এটাই ছিল মুখ্য।
এখন সময় অনেক বদলে গেছে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জাগতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ধাক্কাও সারা পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে লাইফ স্টাইল। তার ফলে ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবির এ কথা আমাদের প্রাণসম্পদে পূর্ণ তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে। এ প্রতিবাদী চেতনার পাশাপাশি অনেক পরিবর্তন ধীরে ধীরে আমাদের জীবনকে ঘিরে একটা অন্যরকম চেহারা তৈরি করে দিচ্ছে; যা ধীরে ধীরে কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠছে। জীবনযুদ্ধে নেমেই ছেলেমেয়েরা এখন হাতে মোবাইল পাচ্ছে; যা একসময় কল্পনাও করা যেত না। মানুষের মুখের ভাষাও যেন বদলে যাচ্ছে। আমি জানি, এ কথা শুনে আমাদের অনেকেরই ভালো লাগবে না। কিন্তু একসময় যেমন ভিসিআরের মারাত্মক প্রভাব এ দেশে অনেক দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল; তেমনই মোবাইল নামের ছোট্ট যন্ত্রটির কারণে ঘটে চলেছে নানা দুঃখজনক ঘটনা। ছোট ছোট কিশোরদের মধ্যে একটি জাদুকরী প্রভাব দেখা দিয়েছে। ফলে মারামারি করা, কেড়ে নেয়ার এমনকি হত্যার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ যন্ত্রটি উন্নতির সহায়ক হিসেবেই জীবনযাপনে বিপদের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। তবে মোবাইল খুলেই প্রিয় নায়িকার ছবি অথবা মারামারির ভয়াবহ চিত্র দেখার প্রবণতা এখন অনেক বেশি। একে তো সম্প্রতি বিনোদনের আকাশ ভ্রমণের ফলে সারা পৃথিবীর ভালোমন্দ ও হিংস্রতার ছবি দেখে ছোট-বড় সবাই শিহরিত হয়। তার সঙ্গে সারা পৃথিবী থেকে প্রচুর হরর, ছবি, হিংসা ও প্রতিশোধের চলচ্চিত্র টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে সর্বত্র পেঁৗছে যাচ্ছে। মোবাইলও সেখানে সদা প্রস্তুত।
এ কথা সত্যি যে গতির মারাত্মক প্রভাব সমাজের সব বয়সী মানুষকে আকৃষ্ট করে। ভালো করে ভেবে দেখলে লক্ষ্য করি, হিরোর ব্যক্তিত্ব দেখাতে হলে সেই সঙ্গে তাকে হতে হয় বলশালী ও সহসাই ক্রুদ্ধ এবং হিংস্র স্বভাবের অধিকারী।
কিছু দিন আগে এই ঢাকা শহরের এক নরমসরম মেয়ে তার বাবা ও মাকে ভয়াবহভাবে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, অতিরিক্ত স্বাধীন জীবনযাপন। অত্যধিক টাকা-পয়সা খরচের জন্য হাতে পাওয়া এবং সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে ড্যান্স ক্লাব থেকে রাত করে বাড়ি ফেরা_ এ সবই ছিল তার উগ্র স্বভাবের কারণ। প্রথমে স্বাধীনতা পেয়ে, পরে বাবা-মা যখন রাশ টানলেন তখনই তার মধ্যে জেগে ওঠে ভয়াবহ ক্রোধ। কী মর্মান্তিক! অথচ সারা পৃথিবীর তুলনা করে আমরা এ দেশের বয়সের ধর্ম বা অতি স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিই; তখন কি ভেবে দেখি, কাজটা কতটা সঙ্গত হবে? সব দেশের নিজস্ব পরিবেশ রয়েছে; রয়েছে সামাজিক রীতিনীতি। আমার মনে হয়েছে এ কথাটি স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমরা কি রক্ষণশীলতার বাড়াবাড়ি দেখতে চাই? মোটেও নয়। আমাদের যে সম্পদ আছে, তাকে মূল্যবান করে তোলার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের তৈরি হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলেও আমাদের প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। গতানুগতিকভাবে বলা হয়, সময় বদলাবে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে ছিটকে পড়তে হয়। কিন্তু ভেবে দেখলে দেখতে পাই, আমাদের শৈশবের যে জগৎ তাও সময়ের অনুসারী ছিল। তখনো যান্ত্রিক অগ্রগতি পৃথিবীকে বদলে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবী অনেক বেশি বদলে গেছে। তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল দেশগুলোকে অনেক বেশি চেষ্টা করতে হয়েছে। যন্ত্রসভ্যতার কঠিন লড়াইয়ে সে চেষ্টা ছিল সীমিত। এর কারণ হলো, বড় বড় দেশের মধ্যে ছিল আধিপত্যের লড়াই। ক্ষমতার যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ধনবাদী দেশগুলোর মধ্যে এটাই ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তাদের বিপরীতে পূর্বদেশীয় অঞ্চলে জীবনের মধ্যে যে মূল্যবোধ যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে তার প্রতি আমাদের ছিল অটুট আনুগত্য।
কিন্তু পৃথিবীজুড়ে মানুষের যাতায়াত, বন্ধুত্বের দেয়া-নেয়া ভেতর থেকে মানুষকে বদলে দেয়। আমরা প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গর্বিত। গর্বিত স্বাধীনতা নিয়ে। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের যে ঢেউ লেগেছে আমাদের জীবনে, তার সঙ্গে অনেক আকাঙ্ক্ষায় আমরাও যুক্ত হতে চাই। কিন্তু কতখানি? এখানেই আমি বুঝতে চাই, যা আমার প্রজন্মকে কৌতূহলী, আগ্রহী করে তুলেছে তার কতখানি আমাদের কাজে লাগানো সঙ্গত?
আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্বিত। বিশ্বের সামনে আমাদের ভাষা, আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মূল শক্তি। তবুও কোথায় যেন একটু খটকা লাগে। আমাদের ভাষা, সম্বোধন মাঝেমধ্যে যেন বদলে যেতে চায়। শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়; যেসব বিদেশি প্রকাশভঙ্গি আমাদের জিহ্বাকে তিক্ত করে তোলে_ মাকে মম বলে ডাকা বা প্রিয়জনকে বেবি বলা, বাবাকে ড্যাড বলা, খানিকটা সে রকম বিজাতীয় অনুকরণ। আসলে আমি অনুভব করি, ছেলেমেয়েরা অতি আধুনিকতায় নিরাপদ তো?
আমরা সারা বিশ্বের সদস্য। কিন্তু যা আমার নয়, তাকে জীবনের অংশীদার করে তুলে আমাদের শেষ রক্ষা হবে তো? আমি আমার সন্তানকে ঐশীর মতো বিশ্বায়নের স্রোতে ঠেলে দিয়ে তার জীবনকে বিপন্ন হতে দিচ্ছি না তো? তারুণ্যের একটা প্রধান বিপদ নিঃসঙ্গতা। সেই নিঃসঙ্গতাকে দূর করার জন্য তারা ইয়াবা বা অন্য কিছুর আশ্রয় নিচ্ছে কি না তা প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হবে। মানুষের মুখের ভাষা তার গর্বিত পরিচয়। আমরা তো আমাদের একুশের শহীদদের আত্মদানে পবিত্র এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক সম্মানের জায়গায় বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি। সেই সৌভাগ্যকে মনে রেখেই বলছি, দ্রুত বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের ছোট ছোট ভুলগুলো যেন আমাদের ক্ষতি করতে না পারে। আজ নিজেদের গভীর সত্তাকে খুঁজে পেয়ে তাকে যেন রক্ষা করতে পারি এই হোক আমাদের ব্রত।