স্বদেশ পাঠালো চিঠি

চলেছিলাম আবিষ্কারের নেশায়। কিসের আবিষ্কার? এই মাত্র পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ থেকে ভেসে এলো সাত সুরের সরগম। কেউবা উদাস বেদনায় আচ্ছন্ন, কেউ বা বাজিয়ে দেয় আনন্দের স্রোতধারা। কেউ বা নিঃসঙ্গ এক পথিকের মত পথ ভোলায়। আমাদের নিত্যদিন জড়িয়ে যায় কখনও হঠাৎ পাওয়া খুশিতে অথবা না বলা কষ্টের কুয়াশায়। কখনও আবার সব হারানো বিবাগী সুরের পাশাপাশি স্বপ্নের জলনূপুর। এইতো ক’দিন আগেই কিশোরী হেমন্তের আঁচল ভরা শিউলিফুলের গন্ধে, মেতে উঠেছিলো প্রকৃতির নিরন্তর বয়ে যাওয়া চপল হাওয়া। এখন আরও কোনো খেলার সাথীর জন্য অপেক্ষা। ছয় ঋতুর চলাচলের শেষ প্রান্তে সে আসবে বলে দিন গুনছে।
আসল কথা হলো, ঋতুর পর্বে পর্বে প্রকৃতিই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সে আমাদের নিত্যদিনের বন্ধু। গ্রীষ্মকালের আগুনঝরা দিন-রাত্রি, বর্ষার অঝোর ধারার মাতামাতি, শরতের ফুল ফোটানো, ফুল ফসলের হৈমন্তী আশীষÑ এসব কিছু মিলিয়েই বড় আপন হয়ে ওঠে আমাদের প্রকৃতি। কিছু তার চিনতে পারি, কিছু অজানাই থেকে যায়। তাইতো এই যাত্রা।
বছর ঘুরে তারপর আসে শীতের মন-কেমন করা দিন। শীতের হাওয়ায় আমলকীর বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় হু হু করা বাতাসের চঞ্চল পায়ের শব্দ।
আগে আমরা শীতকে চিনতাম ভয় দেখানো বুড়োর মতোই। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তার সঙ্গে ছুটোছুটি করতে গিয়ে দেখি, শস্যক্ষেতের দারুণ রঙ বদলানো, সরষে ফুলের উল্লাস তার খুশির মধ্যে ঝরে পড়ছে। সেই সঙ্গে দেখতে পাই মৌমাছি আর প্রজাপতির খেলায় মেতে ওঠা।
শীত এলে অনেক গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়। কিন্তু শীত যে উপহার নিয়ে আসে, তাকেও তো বুঝে নিতে হবে আসাকে। ব্যাপারটা হলো, শীতের শুরুতেই গ্রামগুলো খেজুর রসের হাঁড়ি ভরে ভরে খুশি নিয়ে হাজির হয়। কী সুন্দর তার স্বাদ আর গন্ধ! সারা বছর পথ চেয়ে থাকি টাটকা রসের জন্য। সেই সঙ্গে এসে যায় রস থেকে তৈরি খাঁটি গুড়। ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে ধান ভানা আর ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো করতে মেতে ওঠেন গ্রামের মায়েরা, বোনেরা।
আমাদের জীবনের যত আশা, স্বপ্ন আর সাধ দিয়ে তৈরি অনেক রকম পিঠা-পুলি, পায়েস। আচ্ছা, সকাল বেলা চোখ মেলে মাঝে মাঝে গায়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরও ঘুমোতে ইচ্ছে করে, তাই না? কিন্তু নরম নরম রোদ্দুর এসে চোখের সামনে হাজির হয় আর এক ছুটে ওর সঙ্গে বাইরে যাবার জন্য ডাক দেয়। ও হ্যাঁ তাইতো, মনে পড়ে যায় নতুন বছরটা দুই পাশে কত নতুন আয়োজন নিয়ে আসে যে, ভাবতেই ভালো লাগে। বেরিয়ে পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। বাতাসের ধাক্কায় পড়ে ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠি। কিন্তু শিশিরে ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে শুরু করেই কী যে ভালো লাগে! এই শিশিরের ফোঁটাগুলো যেন টলটলে মুক্তোর মতো মুঠো মুঠো রঙধনু ছড়িয়ে রাখে।
গ্রামীণ পুকুরে ফুটে থাকে শাপলা ফুলের দল। অনেক দূরের ক্ষেত থেকে ভেসে আসে উদার আকাশ বেয়ে ছুটে আসা আলোর ঝরনা। আসলে, গোটা বছরজুড়ে শেষের এই ঝলমলে আয়োজন নিজেকে তৈরি করে। দিগন্ত ছুঁয়ে খেলে বেড়ায় চড়–ইপাখির ঝাঁক। মহান এক শিল্পীর আঁকা ছবি যেন চোখের সামনে। কিষান ভাইয়েরা চলেছে ক্ষেতের কাজে, গ্রামের কিশোর চলেছে ইস্কুলে। অন্য দিকে আমি যেন ডুরে শাড়ি পরা ছোট্টো মেয়েটির হাত ধরে চলতে থাকি। সমস্ত বিশাল খোলামেলা প্রকৃতিতে চোখ মেলে দিই।
বছরের পর বছর গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে মায়েরা মেয়েরা শীতের কাঁথা বুনে তোলেন। সে এক আশ্চর্য শিল্প আর কারুকাজ। এই মাত্র যে প্রকৃতিকে ছড়ানো দেখেছি, সেই শাপলাফুলের দল, শস্যক্ষেতের রামধুন রঙ, প্রজাপতি, ফড়িং আর মৌমাছির লুকোচুরি খেলা এক দারুণ ব্যস্ত পৃথিবীকে আমার মুগ্ধ চোখের সামনে মেলে দেয়। মনে করিয়ে দেয় আমাদের এই ঐশ্বর্য ভুলে থাকার দিন পেরিয়ে প্রকৃতির বন্ধুতা গ্রহণ করার সময় হলো। অর্থাৎ শীত মওসুম সঙ্গে করে আনে নকশিকাঁথার ওম, পিঠেপুলি, আর সেই সঙ্গে বসন্ত ঋতুর অপেক্ষা। তখনই মনে পড়ে আমার দেশটাকে পুরোপুরি জানা হয়নি।
সারা বছর ঋতুতে ঋতুতে ঝড়, বন্যা, নদীভাঙন আর খরা আমাদের জীবনের পাশে পাশে বয়ে আনে বেদনার দুঃস্বপ্ন। জীবনকে নিয়ে আমাদের অনেক অভিযোগ। কিন্তু যখন একলা হয়ে প্রকৃতিকে ভালো করে চেয়ে দেখি, তখন আমার মনে পড়ে যায়, এমন অভিযোগহীন একটি মাটি আমাদের? এমনটি আর কোথাও আছে?
মাটি নয়, সে যেন আমাদের দুঃখিনী মায়ের মতোই করুণ কান্না লুকিয়ে রাখা জীবনের প্রতীক। তাকে যদি চিনতে না পারি, তার সম্মান রাখতে না পারা আমাদেরই ব্যর্থতা।
আজ তাই আবার নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। সারা বছর কেবল নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকা নয়, আমরা যেন প্রকৃতির প্রতিটি ঋতুকে আলাদা করে চিনতে পারি। জীবনটা ঠিক একটা মস্ত বইয়ের মতো। সেই গ্রন্থটি মেলে ধরে দেখি না, কেমন নতুন দিন ধরা দেয় আমাদের সামনে! প্রত্যেকটি পর্বে পর্বে নতুন করে পরিচয় খুঁজতে হবে না।
প্রকৃতি তো হাত বাড়িয়েই আছে! এখন দরকার নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া আর গড়ে তোলার ইচ্ছে। নতুন বছরকে জানাতে চাই সেই আমন্ত্রণ।