সূর্যোদয়ের দিনে

এক.
পরীক্ষা এলেই পড়াশোনায় ছেলেরা মনোযোগী হয়ে ওঠে, এ কথাটা আর যার সম্বন্ধেই হোক, রঞ্জু সম্পর্কে কেউ বলতে পারবে না। সময়টাই এমন যে, ছোটদের এখন দম নেয়ার সময়ই নেই। সারাটা দিন ভাগ করে করে এক একটা শেখার পর্ব চলতেই থাকে ছোটদের। স্কুল, পিটি, কোচিং, সুইমিং আরও কিছু থাকলে তাও। তারপর বাসায় ফিরে পড়া, তারপর ঘুম। মাঝে মধ্যে স্কুল ছুটি থাকে বটে, সেখানেও নানা ধরনের কাজকর্ম এসে জায়গা জুড়ে বসে। ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রোগ্রাম, স্কুল বিতর্ক। সকাল থেকে ছেলের পেছনে সময় দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন রঞ্জু, রনি, বিলটু সোনিয়ার আম্মারা। মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন আর সাধ তাদের। ছেলেরা চায় ব্যতিক্রম কিছু করবে, তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে। ডিঙিয়ে যাবে একে অন্যকে। এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়ানোর, ভাবার সময় নেই কারো।
তো, এভাবেই রুটিন বাঁধা জীবন চলছে ওদের। ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা শেষ হয়েছে রঞ্জুর। আবার ক’দিন বাদেই মিডটার্ম এসে হাজির হবে। এসবের মাঝখানে রঞ্জুর আব্বা ছেলেকে নিয়ে যান বাইরে। সারাদিন অফিস করে ফিরলেও ছেলেকে একটু সময় দিতে ভোলেন না তিনি। সেদিনই আব্বার সঙ্গে দোকানে গিয়েছিলো রঞ্জু। বড় সড় একটা মেকানো সেট দেখে পছন্দ হয়ে গেল দু’জনেরই। মেকানোটা হাতে নিয়ে রঞ্জু খুব খুশি হয়ে উঠলো।
আব্বু এটা দিয়ে আমি যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু সব বানাতে পারবো। তাই না?
– হ্যাঁ বাবা, সব পারবে। দেখ না, এ সেটটা খুব ভালো। অনেক কিছু বানানো যায়। ফেরার পথে বাপ-ব্যাটা দোতলা বাসে চেপে শহরের রাস্তা দিয়ে বেড়ালো।
– বুঝলি? ওটা হল ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিল্ডিং। কী বিশাল দেখেছিস? চল এখানে নামি। ছেলের হাত ধরে নামেন ইলিয়াস সাহেব। চারপাশে বিকেলের ছায়া নামছে, ডিসিসির সামনে বিশাল বিশাল গাছ ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে। সামনেই ওসমানী উদ্যানের পাশে বিরাট বাগান। ছেলেরা বল নিয়ে লোফালুফি করছে। বলটা এক সময় ওদের সামনে এসে পড়লো। আব্বা বলটায় পা ছুঁইয়ে বললো,
– চল, একটু খেলা যাক। খেলবি?
– আব্বু, ওরা কী ভাববে ইয়ে …
– তোমরা কি আমাদের একটু খেলায় নেবে?
– হ .. অ … আ.. , দাঁত বের করে জবাব দেয় ছেলেগুলো। চমৎকার খেলতে থাকেন ইলিয়াস সাহেব। রঞ্জু অবাক হয়ে যায়। আব্বু এত ভালো ফুটবল খেলতে পারে? রঞ্জু মনের খুশিতে খুব জোরে হাততালি দেয় আর কখন যে চিৎকার করে হইচই করতে থাকে, তা মনেও থাকে না।
– দেখেছিস, কত মজা লাগে খেলতে? শার্টে লেগে যাওয়া ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে আব্বু।
– তুইতো দেখি এক নম্বরের ভিতু! খেলতে চাইলি না কেন? ওই দ্যাখ, ওরা এখনও হাত নাড়ছে… মহাখুশি!
– ‘আরেকদিন খেলবো আববু।’ মুগ্ধ চোখে বাবার দিকে তাকায় রঞ্জু। বাগান থেকে বেরিয়ে সামনে পড়ে ভুট্টার গাড়ি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভুট্টা পুড়িয়ে খায় বাপ-ব্যাটা। বেছে বেছে কচি দানার ভুট্টা দেয় আব্বু, রঞ্জুর আম্মার জন্যও নেয় দু-তিনটা। মাঝে মাঝে রাস্তার মাঝে পড়ে থাকা ইটের টুকরোয় জুতোর ডগা দিয়ে টক্কর লাগায় দু’জনেই। আব্বুর মধ্যে এই ছেলেমানুষিটা খুব ভালো লাগে রঞ্জুর। এই রকম সময়ে রোজকার দেখা আব্বুকে যেন একেবারে অন্যরকম লাগে।
বাসায় ফিরে আম্মার হাতে ভুট্টাগুলো দিয়ে আব্বা বলে,
– কই মালা, এই নাও ভুট্টা এনেছি। আর পকেট হাতড়ে পথে কেনা। কাঁঠালিচাঁপার থোকাটা আম্মার হাতে দেয়, আব্বু পায়ের জুতা মোজা খুলতে খুলতে বলে- আজকে আমরা দারুণ দারুণ সব কাণ্ড করেছি! তুমি তো বাড়ি ছেড়ে বেরুতেই চাও না। আজ গেলে বুঝতে কী মজা! না কি রঞ্জু? ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসেন ইলিয়াস সাহেব।
– হয়েছে হয়েছে। আর গল্প করতে হবে না। হাত মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
হর্লিকসের পেয়ালা সামনে নিয়ে সারা বিকেলের বেড়ানোর গল্প শোনাতে থাকে রঞ্জু।
– উম্ মা! দোতলা বাস! হাছা রঞ্জু ভাই? আমরাও একদিন বেড়াইতে যামু। নাগো আম্মা? গালে হাত দিয়ে বুয়া বলে।
– হ্যাঁ, যাওয়া যায়। দোতলা বাস তো চিড়িয়াখানা আশুলিয়া পর্যন্তও যায় তাই না গো? ফুলগুলো খাওয়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলেন রঞ্জুর আম্মু। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– হোম ওয়ার্কটা শেষ করতে হবে রঞ্জু, তাড়াতাড়ি ওঠ। এখন আবার মেকানো নিয়ে বসো না যেন।

কম্পিউটারে কতকগুলো হিসাব নিয়ে কাজ করছিলেন ইলিয়াস সাহেব। মাঝে মাঝ কাজ করতে করতে আনমনা হয়ে ভাবছিলেন অনেক কিছু। জানালার ওধারে পর্দা উড়ছে হাওয়ায়। হাল্কা মেঘ জমেছে আকাশে। ইলিয়াসের মনে পড়ে ছেলেবেলায় এমনি মেঘলা রাতে পরীদের দেখার লোভে কত রাত দাদীর কাছে শুয়ে শুয়ে কত না গল্প শুনতেন। দাদীর অনেক সাহস ছিলো। কত রাতে দাদা বেরিয়ে যেতেন তদন্তের কাজে, আর দাদী ছেলেমেয়েদের কাছে নিয়ে রাত জেগে থাকতেন। চোখে ঘুম আসতো না, চুপি চুপি চোখের পানি মুছতেন। সকাল বেলায় দাদা হয়তো ফিরতেন খুব ক্লান্ত হয়ে, তখন মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যেতো না। তাড়াতাড়ি উঠে বাড়ির বুয়াদের দিয়ে পানি গরম করে দিতেন। গরম চা, ডিম সিদ্ধ, খাবার তৈরি হলে তাড়াতাড়ি খেয়ে আবার অফিসে যাওয়া। হোক দূরের একটা ছোটো থানা, ওসি সাহেবের নামে সারা এলাকা তটস্থ থাকতো। দীর্ঘ দিন চোর ডাকাতের পিছু তাড়া করে এক সময় সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন কৃতিত্বের জন্য।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধের কথা ভেবে শহর এলাকায় শেষ দিকে চলে এসেছিলেন দাদাজান। ইলিয়াসের আব্বা ডাক্তার হলেন, বোনদের বিয়ে হলো খুব শান্তিতেই শেষ দিনগুলো নাতিদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন দাদাজান। কিন্তু ইলিয়াসদের ছেলেবেলার দিনগুলো একেবারে বদলে গেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেসব কী ভীষণ দিন গেছে! সেই যে ইলিয়াস পালিয়ে গিয়েছিলেন সবজির গাড়ির বস্তার মধ্যে লুকিয়ে, চোখের সামনে গাড়িটা রাস্তার ধারের ঢালু জলাভূমিতে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। কতগুলো অদ্ভুত পোশাকপরা লোক এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে কয়েকটা লোককে মেরে ফেললো। যুদ্ধে যাবো আম্মা, আমি যুদ্ধে যাবো।
সবাই যাচ্ছে। বলে সকাল বেলাতেই বন্ধুদের সঙ্গে পালিয়ে ছিলো ইলিয়াস। বস্তার নিচে চাপাপড়ায় কোনমতে বেঁচে গেলেও বের হতে পারছিলো না। তার ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ শুনে রাস্তা থেকে ছুটে আসা মানুষগুলো তাকে টেনে বের করেছিলো। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলো, এ ছেলে তো তাদের পরিচিত ডাক্তার সাহেবের ছেলে। তারাই তাকে পৌঁছে দেয় বাসায়। ইলিয়াস নিজের অবস্থা ভুলে গিয়েছিলো বাড়িতে বা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়েছিল যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই ঘরে ঘরে মৃত্যুর ছায়া পড়েছে। তাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আব্বার সে কী কান্না!
এর ক’দিন আগেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল তাদের জীবনে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতো ইলিয়াস। এক রাতে তার ঘুম ভাঙে ভাইয়ার নড়াচড়ায়। ভাইয়া তখন সদ্য কলেজে পড়ছে। দু’জনে যখন একসঙ্গে পড়তে বসতো তখন ভাইয়া তাকে দুনিয়ার বড় বড় অভিযানের গল্প শোনাতো। মানুষের চাঁদে যাওয়ার অদ্ভুত কাহিনী, উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুর অদ্ভুত সব কাহিনী।
– তুই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে নে ইলিয়াস। আমরা যাবো নতুন নতুন আবিষ্কারে। উৎসাহে টগ বগ করতো ভাইয়া। সেই ভাইয়া কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বন্ধুর হাত ধরে চলে গেল। ঘুম চোখে বিছানায় উঠে বসে অবাক চোখে দেখেছিল ইলিয়াস।
– ভাইয়া কোথায় যাচ্ছে আম্মা? আম্মা কথা না বলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়েছিলেন। বড় ভাই এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ফিস ফিস করে বলেছিলো, ‘আম্মা, বুঝলি আম্মাকে দেখে রাখিস। তুই কিন্তু এখন বাড়ির বড়।’
সেই দশ বছর বয়সে আমি হঠাৎ করে হয়ে গেলাম বাড়ির বড়। কম্পিউটারে লিখলেন ইলিয়াস। মনে মনে বললেন, সেদিন তোমার জন্য ভীষণ কষ্ট হাচ্ছিলো ভাইয়া, না গিয়ে পারিনি। আমি, বাবুল, রূপম সবাই মিলে যুদ্ধে যেতে রওনা দিয়েছিলাম, তারপর সবজির গাড়ি পড়ে গেল… লোকগুলো যেন হিংস্র বাঘ! এলোপাতাড়ি গুলি করে দিলো! বাবুলটা তো তখনই চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকেন। ইলিয়াস নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, টের পাননি। দুটো ছোটো ছোটো হাত তার গলা জড়িয়ে ধরে।
– আব্বু, তোমার মন খারাপ?
– না, বাবা, এইতো তুমি এসেছো, আর আমার মনটা খুশি হয়ে উঠলো। হেসে ছেলের দিকে তাকালেন ইলিয়াস। পেছন থেকে আম্মা বললেন, তোমার ছেলে সে যমুনা সেতু তৈরি করেছে মেকানো দিয়ে। দেখবে না? সত্যি? কই চল তো দেখি? এবার তো তুই আর আমি গ্যাস রিগ বানাবো। কী বলিস?
ছেলে যখন মোকানো আনতে গেল, তখন আম্মা বাবার কাছে গিয়ে বললেন,
– আজ তোমার মন খারাপ। তাই না? কাঁদছিলে?
– না, না, মালা, তুমি ভেবো না। আমি ঠিক আছি।
– ছেলেটা তোমার কাছে শুনে শুনে ওর বড় চাচাকে এতো ভালবাসে যে, তোমাকে এরকম দেখলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়।
– ওর বড় চাচার গল্প ওর দাদার কাছে শুনলে ওর আরও ভালো লাগবে। এবার যখন বাড়িতে নিয়ে যাবো, ওকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবো।
– বাব্বা! এমনিতে তো ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, তার মধ্যে ফুটবল খেলা, মাছ ধরা! স্বপ্নও দেখতে পারো বটে! যাও এখন দেখ গিয়ে ছেলেও এবার বাবার মতো নদী বাঁধতে শুরু করেছে! হাসতে হাসতে ছেলের ঘরের দিকে গেলেন রঞ্জুর আম্মা।
দুই.
রঞ্জুদের স্কুলে বিজ্ঞান মেলা নিয়ে খুব হইচই চলছে। বিজ্ঞান সার আসাদ সাহেব ছেলেদের গ্র“প ঠিক করে দিয়েছেন। বিষয়ও ঠিক ঠাক হয়ে গেছে। হোম ওয়ার্ক, পিটি, এসব ছাড়াও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান জাদুঘরে যাওয়া, বিজ্ঞানবিষয়ক বই পড়া। সাজ সরঞ্জাম জোগাড় করা। রঞ্জুরা ভেবে পাচ্ছে না কোন বিষয়ে তারা প্রোজেক্ট তৈরি করবে। এমন সময় আতিক বললো,
– চল আমরা শহর জুড়ে ওভার ব্রিজ আর রাস্তা বানাই।
– ওরে বাবা সে তো খুব কঠিন হবে! কোথা থেকে শুরু কোথায় বা শেষ! এত বড় শহর!
– বেশ তোমরাই বল কী করবে? গাল ফুলিয়ে বললো আতিক।
আহা রাগ করিস কেন? চল আমরা বানাই শহর রক্ষা বাঁধের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজ। আমার দাদার বাড়ির কাছে পদ্মা নদী। প্রত্যেক সময় বর্ষায় বাঁধ ভেঙে খুব কষ্ট হয়। একটা কিছু করতে আমার খুব ইচ্ছে হয়। বললো রঞ্জু।
– ঠিক আছে, সেটাই করা যাক না।
চল আসাদ স্যারের কাছে যাওয়া যাক।
একটা কাগজে গোটা প্রোজেক্টটা লিখে, এলাকার ম্যাপ, যেটা ওরা ভূগোল ক্লাসে শিখেছে, সেটা এঁকে যথাসাধ্য সুন্দরভাবে প্রস্তাব নিয়ে ওরা গেল স্যারের কাছে।
– আরে! এতো ভারী সুন্দর চিন্তা। তোরা পারবি তো পদ্মা নদীর ওপরে সেতু বানাতে? জিনিসপত্র জোগাড় করতে হবে তো। কঠিন প্রজেক্ট নিয়েছিস তোরা।
– ‘পারবো স্যার। জোগাড় করবো।’ এক সঙ্গে জবাব দিলো তিন বন্ধু।
– তো, যা। আবেদনপত্র লিখে তোদের ক্লাস টিচারের কাছে জমা দিয়ে দে। আমি হেড স্যারকে বলে পাস করিয়ে দেবো।
তিনজন মহাখুশিতে ক্লাসে ফিরলো। আবেদনপত্রও ক্লাস টিচারকে দিয়ে দিলো। ঠিক হলো রঞ্জু, আতিক আর মঈন মিলে তিনজনের টিম। এবার কোমর বেঁধে কাজে নামার পালা। সুবিধের ব্যাপার এই যে ওদের তিনজনেরই বাসা কাছাকাছি। পথে যানজটে আটকা পড়ার ভয় নেই, মোবাইলে যোগাযোগ করে নিয়ে একজন আরেকজনের বাসায় যায়। সে হোম ওয়ার্কই হোক বা স্কুলের কোন অনুষ্ঠান হোক ওরা একসঙ্গে কাজ করে। রঞ্জুর ঘরে আব্বু একটা মস্তবড় টেবিল বানিয়ে দিয়েছেন। সারা বছর রঞ্জু আর তার আব্বা টেবিল টেনিস খেলে।
টেবিল টেনিসে আম্মাও খুব পাকা।
কলেজে পড়ার সময় কয়েকবার ইন ডোর কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কাজেই রঞ্জুও ভালো-ই খেলে। তো, প্রজেক্টের ব্যাপারে আব্বা একটা টেবিল না বানিয় টেবিল টেনিসের টেবিলেই জায়গা করে দিয়েছেন ওদের। স্কুল থেকে ফিরেই বন্ধুরা ছুট দেয়। আতিক এর মধ্যেই জোগাড় করেছে লোহার ফ্রেম, তার, আর ছোটো ছোটো সিমেন্টের ব্লক। শুধু ব্রিজ বানালেই তো হবে না, টেলিগ্রাফের তার, এপারে ওপারে বিদ্যুতের যোগাযোগ, গাড়ি, বাড়ি কত কি-ই না চাই ওদের। মাঝে মধ্যে ওদের উৎসাহ দেবার জন্য তিনজনের আব্বা আম্মাই এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখেন। খুবই ধীরস্থিরভাবে কাজ করে ছেলেরা। কমিক বা কার্টুন দেখতেই মনে থাকে না ওদের। একদিন আতিকের আব্বা বললেন,
– ‘নদীর গতিপথটা জেনে নেবে তোমরা। আমার বন্ধু ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সে তোমাদের ভালোভাবে নদীর স্রোত, বন্যা, নদীভাঙন বিষয়ে বলতে পারবে। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নিয়ে যাবো।’ তিনি একজন আবহাওয়াবিদ। ফলে ওরা রাজি হয়ে গেল। মঈনের আব্বা দিলেন তার গাড়িটা। শেষে আবার শরীরটা খারাপ করে বসিছ না তোরা। বলেন বিজ্ঞান স্যার।
সব কাজ কর্ম যখন জমে উঠেছে, তখনই ঘটে যায় একটা দুঃখজনক ঘটনা। চিঠি হাতে করে এসে হাজির হয় দাদাবাড়ির পুরনো মানুষ জহির মিয়া। তার চিঠি পড়েই গুম হয়ে যান ইলিয়াস।
– কী হয়েছে গো? কোন খারাপ খবর আছে নাকি? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চান রঞ্জুর আম্মা।
– হ্যাঁ মালা, ভীষণ খারাপ খবর। বৃষ্টির মধ্যে কারো কথা না শুনে টিউবওয়েল থেকে পানি তুলতে গিয়ে আব্বা পা ভেঙে ফেলেছেন। প্রথমে তো চুন-হলুদ দিয়েই মেরামত করেছিলেন। কিন্তু পরে সরকারি ডাক্তারকে কল দিয়ে আনা হয়। ধরা পড়ে ফ্র্যাকচার। আম্মা লিখেছেন, আমি নিজে গিয়ে না আনলে আব্বা বাড়ি থেকে নড়বেনও না। ঠিকই তো বলেছেন। তুমি যাও, আব্বা আম্মা দু’জনকেই নিয়ে এসো গিয়ে। বাড়ি ছেড়ে তো নড়ানোই যায় না উনাদের। কত বলি যে ঢাকায় এসে এখানে থাকেন। তা কথা শুনলে তো! আম্মা ক্ষুব্ধ গলায় বলেন আর রঞ্জুর আব্বার ব্যাগ গোছান।
– দাদার কী হয়েছে আম্মা? ভয়ে ভয়ে জানতে চায় রঞ্জু।
– আর কী। তোমার দাদাজান পা ভেঙে ফেলেছেন।
হেসে ফেলে রঞ্জু- দাদাজান তো বুড়ো মানুষ। তার পা ভেঙে গেল কেমন করে? কারো সঙ্গে কম্পিটিশনে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল বুঝি?
– চুপ কর অসভ্য ছেলে। ওকি কথা? দাদাজান টিউবওয়েলে পানি তুলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাই তোমার আব্বা যাচ্ছেন তাদের আনতে। দাদা আর দাদু দু’জনেই আসবেন। এ একরকম ভালোই হলো। এখানে বসে আমরা ভেবে মরতাম। পায়ের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে উনাদের একটু জায়গা বদল হবে।
– আচ্ছা আম্মু, দাদাজান কি খুব রাগী?
আস্তে আস্তে জানতে চায় রঞ্জু?
কেন রে ? রাগী হবেন কেন? জানিস না, উনি তো ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। তখন উনার আব্বাকে হারান। টাকা পয়সার অভাব, তিন চারটা বাইবোন মানুষ করবে কেমন করে? তখন উনি পড়া ছেড়ে দিয়ে পুলিশের চাকরি নিয়ে নেন। ভেবেছিলেন, পরে ডাক্তারি পড়াটাই শেষ করবেন। তবে সেটা আর সম্ভব হয়নি। অবশ্য পুলিশের চাকরিতেও উনার খুব সুনাম হয়েছিলো। খুব রাগী অফিসার ছিলেন তো!
– ওরে বাবা! তাহলে যদি আমার ওপর রাগ করেন তখন যদি মারেন, তবে?
– না, তোকে নিয়ে আর পারি না। তোর দাদাজান খুব মজার মানুষ, আর দাদীজান একেবারে মাটির মানুষ। তবে হ্যাঁ রঞ্জু বাড়িতে মুরুব্বিরা এলে কিছু নিয়ম কানুন তো মানতেই হবে। যেমন, হো হো করে হাসা, ব্যাগ ছুঁড়ে চেয়ারে ফেলা, ক্ষিধে পেলে চেচাঁমেচি করা বিছানায় উঠে লাফানো…
– আরে আরে। হচ্ছে কী? ছেলেটাকে ওভাবে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো কেন? ঘরে ঢুকে ইলিয়াস বললেন,
– না রে রঞ্জু, তোর দাদাজান খুব ভালো। তবে এখন যেহেতু তুমি উনার একমাত্র নাতি, আর উনি অসুস্থ। তাই তোমাকেই তো উনার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই না? আর উনারা এলে সবারই ভালো লাগবে। দেখিস। তোমার দাদাজান অনেক ডাকাত ধরেছেন। সেসব গল্প তোমাদের এখনকার ডিটেকটিভও গল্পের চেয়েও ভয়ের।
আচ্ছা, চলো এখন খেয়ে নিই। গাড়ি রাত ১১টায় সকাল নাগাদ ঈশ্বরদী পৌঁছে যাবো। আশা করি দ্রুত ফিরে আসবো। জহির ওর মামার বাসায় গেছে। ও এলেই আমরা রওনা দেবো।
তিন.
এখানে সূর্যটা ওঠে একটু বাঁকা হয়ে। রঞ্জুর দাদা বলেন।
– ঢাকার সবই দেখছি বাঁকা রে দাদু?
– যাও দাদাজান, তুমি মজা করছো। বলে রঞ্জু ব্যাগ কাঁধে নেয়। দাদী পেছনে দাঁড়িয়ে বলেন, এতো বই বয়ে নিতে পারবি তো দাদু? দেখেছো এখন বাচ্চারা কত বই পড়ে?
রঞ্জু একটু লজ্জা পায় দাদীর কথায়। ব্যাগটা সামলে বলে, হ্যাঁ আসি আম্মু, আমি আব্বু দাদাজান … বলতে বলতে লিফটে উঠে যায় রঞ্জু। ওদিকে তাদের বাড়িতে ক’দিন রীতিমতো নাভিশ্বাস অবস্থা যায় সবার। এক্সরে, প্লাস্টার খোলা, ওষুধ-পত্তর সে এক এলাহি কাণ্ড! এর মধ্যে রঞ্জুদের দুটো ক্লাস পরীক্ষাও হয়ে গেল। একটু একটু করে ওদের প্রজেক্টও এগিয়ে চলছে। দাদার শরীরটা এখন বেশ ভালোর দিকেই। ঢাকায় যারা থাকেন, সেসব আত্মীয়স্বজন তাকে দেখতেও আসেন। বাড়ি একেবারের সরগরম। এসবের মধ্যে নিজেদের কাজে ডুবে থাকার কোন উপায় নেই। বলতে গেলে, সারাটা সময়ই আম্মা আব্বা, সবাই ব্যতিব্যস্ত দাদা-দাদীর সেবায়। রঞ্জুর খুব অভিমান হয়, আবার মজাও লাগে। গল্প শোনার সময় বেশি পায় না রঞ্জু। স্কুল থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়েই দৌড় দেয় কাজের টেবিলে। বন্ধুরা মিলে বেশ এগিয়েছে কাজটা। একটা বড় বোর্ডের ওপরে এপার ওপার করে অ্যালুমিনিয়ামের রড লাগিয়ে দিয়ে একটা ব্রিজের কাঠামো দাঁড় করিয়েছে তারা। দু’পাশে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে ছোট ছোট কাঠের টুকরো, পিচবোর্ড এসব দিয়ে। নদীটা তৈরি করাই হলো সবচেয়ে কঠিন।
বিজ্ঞান স্যার একদিন এসে দেখেও গেছেন। তিনি বলেছেন- তোদের দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছে রে, পানির মেশিনটা তৈরি করে দিতে। কিন্তু তোদের বেশ কষ্ট হলেও তোরা নিজেরাই করবি। বড়দের কাছে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি, ব্রিজের খুঁটি কমজোর হলে, বা দু’পাশের বাঁধানো জায়গায় কী দোষ থাকলে নদীর পাড় ভেঙে পড়ে, আর বন্যা হয়।’
আব্বার সঙ্গে গিয়ে কয়েকবার বড় বড় সেতু দেখে এসেছে রঞ্জু। এখন সে একটু একটু বুঝতে পারে, কোন নদীতে ভাঙন হয়, সেতুর চারপাশটা রক্ষা বাঁধই বা কী কাজে লাগে।…

মঈন বলল, আমি তোমাদের জন্য মরিচ বাতি এনেছি। নতুন ব্রিজের ওপরে লাগালে সুন্দর হবে না?
সেদিন মহা উৎসাহে বাতি লাগিয়ে সুইচটা টিপে দিতেই বেশ ঝলমল করে উঠলো। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো রঞ্জু,
– আব্বা, …. আম্মু… দাদী …. দেখে যাও, …’। সবাই আলোর মালা দেখে খুশি হয়ে গেলেন। ইলিয়াস বললেন,
– তোদের ব্রিজটা যে একেবারে সত্যিকার সেতু হয়ে উঠেছে রে রঞ্জু,
– তোমাদের দেশের ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারদের দেখে নাও বিল্লু…, দরজায় লাঠি হাতে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে দাদাজান বললেন,
– বিল্লু? ….বিল্লু কে দাদাজান? রঞ্জু অবাক খুশিতে জানতে চায়।
– তোর বাবাকেই জিজ্ঞেস কর না। দাদা হেসে বলে ওঠেন। তারপর দাদাজানের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, টুলু আর বিল্লু। টুলু আর বিল্লু দুই ভাই। ছিলো তোর দাদার জান।
– আর তোমার বুঝি নয়?
ছেলেদের কথা উঠলেই তুমি টুলুর জন্য চোখের পানি ফেলতে শুরু কর টুলুর বাপ, চলো, ঘরে চলো।
দু’হাতে চোখ কচলে দাদাজান বলতে থাকেন- দেখেছো, নাতিটা একেবারে ওদের বড় চাচার মতো হয়েছে। সেই রকম স্মার্ট, সেইরকম অভিমানী…।’ ওদের প্রজেক্টের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক মুগ্ধতা নিয় সব কথা শোনে তিনটি কিশোর। আব্বার চোখ দুটোয় যেন মেঘের ছায়া নেমেছে। মৃদু গলায় বলেন,
– দেখেছো, আজকে আমার ছেলেবেলার নামটা বেরিয়ে পড়লো, কত কষ্টে লুকিয়ে রেখেছিলাম! হেসে ওঠেন রঞ্জুর আব্বা।
স্কুলের বিজ্ঞান মেলা প্রতিযোগিতা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। বড়দের গ্র“প অনেক কঠিন কঠিন কাজ করছে। আর মাত্র একদিন বাকি।
সেদিন রঞ্জুদের বাড়িতে এলেন আব্বার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির সবাই। রঞ্জু তখন স্কুলে। হঠাৎ মেহমানদের দুই বাচ্ছা হইচই করতে করতে রঞ্জুর ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়লো। বুয়া আর রঞ্জুর আম্মা বাধা দিতে দিতে দু’জনে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়লো ওদের প্রজেক্টের ওপরে। বুয়া একটা চিৎকার দিলো আয় হায়! কী করলো এইডা? আম্মাগো, ভাইয়া যে কাইন্দা শেষ হইবো!
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবাক! আম্মা ফুঁপিয়ে উঠলেন,
– এখন কী হবে গো! ছেলেরা কতদিন ধরে কাজ করে চলেছে।…
এত অস্থির হইও না মালা! দেখি কী করা যায়।
এরকম একটা কাণ্ড করে বাচ্চা দুটোও ভড়কে গিয়েছে। প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন তাদের আব্বা।
– মানা করছে, তবু এ ঘরে ঢুকলে কেন তোমরা? দেখেছো, কি সর্বনাশ হয়েছে?
সর্বনাশ যে হয়েছে, তাতে আর সন্দেহ কী? বাড়িতে ঢুকে এত চুপচাপ দেখে রঞ্জু একটু অবাক হয়ে গেল। সবাই কি বেড়াতে গেছে? ব্যাগটা চেয়ারে রেখে রান্নাঘরে দাঁড়ালো রঞ্জু।
– বুয়া…? আম্মা কোথায়?
– ঐ যে, আম্মা গো, রঞ্জু ভাইয়া আসছে। কেমন যেন কান্নায় ডুকরে উঠলো বুয়া। আম্মা দৌড়ে নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিলেন।
– আয় রঞ্জু। আয় বাবা, আমার ঘরে হাত মুখ ধো। চল তোকে খেতে দিই। আম্মার কাণ্ড দেখে একটু অবাক হয় রঞ্জু। তবে কি দাদাজানের কিছু হয়েছে? আম্মার কাছ থেকে নিজেকে একটু আলগা করে নিয়ে সরে দাঁড়ায় রঞ্জু। গম্ভীরভাবে জানতে চায়,
– আম্মা, কী হয়েছে?
– ‘কিছুই হয়নি বাবা! আগে তুই কিছু খা।’ রঞ্জু বুঝতে চেষ্টা করে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে যায় প্রজেক্টের ঘরে। হাতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে টেবিলের সামনে।

– আরে! রঞ্জু, তুই কি পুরুষ মানুষের নাম ডোবাবি? এত সামান্য জিনিস নিয়ে এত অস্থির হতে হয়? সব ঠিক করে দেবো আমরা… বাবা আমার, তুই শান্ত হয়।
কিন্তু রঞ্জু কারো কথাই শুনছে না। তার আব্বা যে তার বন্ধু, সে কথা আজ তার মনেই নেই। চোখ দিয়ে খালি পানি পড়ছে, আর মাথা নাড়ছে। তিন বন্ধুর গলাগলি করে কান্না দেখে এমনকি রাগী বিজ্ঞান স্যারও ধমক ধামক দিতে ভয় পাচ্ছেন। ছেলেটি কিছু খায়নি পর্যন্ত। শেষ অবধি তিনজনকে ধরে নিয়ে বড়রা গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের উপদেশ অনুযায়ী চাইনিজ বেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। শিশু পার্কে নেমে হাঁটলেন। ছেলেগুলো যেন বোবা হয়ে গেছে, কলের পুতুলের মতো চলছে ফিরছে। গত তিন সপ্তাহের এত শখ, এত কষ্ট করার পরে এরকম ঘটনা ঘটে যাওয়ায় ওদের যেন হাত-পা দুমড়ে আসছে। ইলিয়াস সাহেব এক সময়ে বলেছেন,
দেখ বাবু, এরকম দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু করার নেই। আবার তৈরি করবে।
এত মন খারাপ কেন করবে? মঈন, আতিক, তোমরা বলো, এখন তো তোমরা ছোটো। আরও তো কত কিছুই ঘটতে পারে জীবনে। তাই না? তোমাদেরকে সাহসী হতে হবে। তোমরা তো মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ো। আমরা সবাই কত খুশি হয়েছি তোমাদের এত সুন্দর কাজ দেখে। এত সহজে ভেঙে পড়লে কি চলে?
– ঠিকই তো বলছেন ইলিয়াস সাহেব। কেউ তো আর ইচ্ছে করে ওটা ভাঙেনি। পাঁচদিন যথেষ্ট সময়। আমরা তোমাদের সাহায্য করবো। বললেন মাঈনের আব্বা।
– চলো এবার বাসায় ফিরি। আব্বা আম্মা একলা আছেন।

চার.
লিফটে ওঠার আগে বন্ধুরা তিনজন এক অন্যের গলা জড়িয়ে ধরলো।
– আহারে বড় কষ্ট পেয়েছে ছেলেরা! ভাবলেন ইলিয়াস। তারপর লিফটে ঢুকে পড়লেন।
ওপরে ওঠে নিজেদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে গেল বাবা আর তার ছেলে। দরজাটা হাট করে খোলা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে কথাবার্তা, হাসির শব্দ। আর …. আর একি? এক লাফে এগিয়ে গেল রঞ্জু। আলোর মালায় সেজে ঝলমল করছে তাদের সাধের সেতু। সেতুর রেলিং, লোহার খাম্বা, সিমেন্টের পিলার, কী নেই? এতদিন ধরে ঠিক যেমনটি ওরা বানিয়েছিলা, ঠিক তেমনটি। তবে সেতুর মাথার ওপরে জ্বলছে একটা বড় সড় আলো। তার নিচে সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে ‘নদীর ভাঙন রোধ করে আপনার শহরকে বাঁচান।’
দু’পাশে মঈনের আনা সারি সারি গাড়ি ওপারে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপরে টেলিগ্রাফের ইলেকট্রিক তার। নিচে ঘর বাড়ি নিখুঁত সাজানো। এখন শুধু নদীর স্রোত তৈরির অপেক্ষা। ছেলেকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদাজান বলেন,
– ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, একটা ছোটো মোটর মেশিন আর মোটা পাইপ হলে নদীটাও পেয়ে যাবেন। তবে এ নদী বাঁধ ভাঙবে না।
কিরে তুই যে একবারে বোকা হয়ে গেলি। বিল্লু? আম্মা জোর গলায় হেঁকে উঠলেন। আম্মা … আমি … আমি বুঝতেই পারছি না কী বলবো। থতমত খেয়ে বলেন ইলিয়াস।
– দেখেছো? বৌমা, দেখ দেখ আমার ছেলে বিশ্বাসই করতে পারছে না। ও ভেবেছে বুড়োবুড়ি আবার কী করবে। তাই না?
– আমার দাদুভাইয়ের কষ্ট দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি রে। ভাবলাম, এক কালে তো তোর আর টুলুর সঙ্গে লেগো আর মেকানো দিয়ে কত কিছু বানাতে শিখিয়েছি। হোয়াই নট নাউ? তোর মাকে বললাম, চলে এসো পার্টনার, কাজের লেগে পড়ি। তোর বউ তো ভয়েই মরে, বুঝি আরও খারাপ কিছু করে বসি। এখন দ্যাখ, বাড়াবাড়ি কিছু করিনি নাতিভাই, বাকিটুকু তোরাই করতে পারবি। তোদের ক্ষতিটুকু শুধু মেরামত করার চেষ্টা করে দেখলাম।
– দাদাজান… দাদাজান … দাদু দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো রঞ্জু।
– আরে বোকা ছেলে, কাঁদিস কেন?’ রঞ্জুর মাথায় হাত রেখে হাসলেন তার দাদা।

রাতটা কোনমতে কাটলো। সকাল হতে না হতেই মঈন আর আতিক বাবাদের সঙ্গে নিয়ে হাজির। বুয়া মনের খুশিতে থালা ভরে পিঠা পুলি হাজির করলো।
– ভাইয়ারা আহন মন খুশি কইরা খাইবা আর সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাইবা। দাদাজানে দেহাইয়া দিছে জাদুর খেইল!
অনেক দিন পরে নিজের ছোটো ঘরটা খুলে টেবিলে বসলেন ইলিয়াস। অনেক দিনের ঝড় ঝাপটায় নিজের সঙ্গে একলা হওয়ার সুযোগ তার হয়নি। আজ মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো একটু বসি নিজের কাছে। তাকের ওপরে ধুলো পড়েছে। ছেলেবেলার খেলনা, মালার লেপের তোরঙ্গ ছেলেবেলায় মেলা থেকে কেনা বাঁশের বাঁশি …. আর…. কাঠের একটা বা…স। ছেলেবেলার খেলার একটা বল। ভাইয়ার সঙ্গে খেলতো ইলিয়াস… না… ছোটো ভাইটা যার নাম ছিলো বিলু।
বলটা ফেটে গেছে। ভেতরে হাত দিলেন ইলিয়াস। বের করে আনলেন এক টুকরো কাগজ। হলদে হয়ে যাওয়া কাগজে পেন্সিলে দ্রুত হাতে লেখা কয়েকটি কথা- ‘বিল্লু, আব্বা আম্মাকে দেখে রাখিস। আমি যদি ফিরতে না পারি, … তুই-ই তখন বাড়ির বড় এ কথা ভুলিস না … তোদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। … ইতি টুলু।’ বন্ধুর হাতে পাঠানো এই চিরকুট ছিলো তার সম্বল। রক্ষাকবচের মতো রক্ষা করেছেন ইলিয়াস। কাউকে বলেননি, কাউকে জানতে দেননি, এমনকি রঞ্জুকেও না। কতক্ষণ এমন বসেছিলেন জানেন না। মাথার ওপরে কারো স্নেহমাখা হাতের ছোঁয়ায় নড়ে উঠলেন। ফিরে তাকালেন।
– আম্মা তুমি?
কেন? আমার ছেলেটা কত একলা। কত দুঃখ সে লুকিয়ে রাখে, আমি তার মা, আমি জানবো না? তোর হাতে ওটা কী রে? টুলুর চিঠি? দেখি, কী লিখেছে? চিঠির টুকরোটা হাতে নিতেই তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ে কান্না। সে কান্না মা কাউকে দেখতে দেননি, সেই কান্না আজ কোন বাধা মানে না। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ইলিয়াসও কাঁদেন, বুকটা যেন হালকা হয়ে যায়। জানালার বাইরে চাঁদটা উঁকি দিয়ে তাদের দেখছে, ঠিক যেন টুলুর চোখের মতো।
– আব্বু … তোমার জাদুঘর দেখ ফেলেছি। ছেলের গলার হাসি শুনে হেসে তাকায় তার আব্বা। একটু চমকেও ওঠে রঞ্জুর আব্বা। গলাটা নিজের অজান্তেই রুক্ষ শোনায়।
– কি দেখেছো বলতো? জানতে চায়।
কেন? তোমার আর চাচ্চুর খেলার ফুটবল? চমকে ওঠেন ইলিয়াস। ফুটবল! ওটা কোথায় পেলো রঞ্জু? ছেলের দিকে কড়া চোখে তাকান তিনি।
– কবে ঢুকেছিলে এখানে তুমি?
রঞ্জুও বাবার রেগে যাওয়া মুখের দিকে তাকায়। ভয়ে ভয়ে বলে,
আম্মা বললো, এটা তোমার একার জাদুঘর। এখানে তোমার আর বড় চাচ্চুর জিনিসপত্র থাকে। তাই এখানে কোন কিছুতে হাত দেয়া নিষেধ। তাই আম্মা একা এসে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখে যায়। আমি বলটা মাত্র একবার ধরেছিলাম। আম্মা কেড়ে নিয়েছিলো।
কেন আব্বা? ঐ বলটা দিয়ে তুমি আর চাচ্চু খেলতে, তাই?
– হ্যাঁ, ইলিয়াস যেন কথা বলতে পারেন না। বলতে পারেন না, শোন রঞ্জু, আমার ভাই দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলো। আর ফিরে আসেনি। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। আমি পাহারা দিয়ে রেখেছি তার বল, গায়ের জামা, তার ছবি- তাহলে কি হতো আব্বু, তুমিও যদি চাচ্চুর মতো যুদ্ধে গিয়ে- থেমে যায় রঞ্জু। কী বলবে ভেবে পায় না।
– ঠিক আছে বাবা, যদি আমিও না ফিরতাম তাহলে আমাদের রঞ্জুর আব্বু আসতো কোথা থেকে?
এইতো তোর মনের কথা?
– আব্বু, রঞ্জু আব্বার কোমর জড়িয়ে ধরে- আব্বু, তুমি সব কথা আগেই বুঝে ফেলো কেমন করে?
আজ মনে হয় ছেলের সঙ্গে সব গল্প করে ফেলবে! অফিসের কথাও বুঝি মনে নেই?
– আম্মা হাসতে হাসতে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলেন। দরজায় তালা দিয়ে হেসে বেরিয়ে আসেন ইলিয়াস। তোর মার হিংসে হচ্ছে রঞ্জু! চলো নাশতা দেবে। আয় রঞ্জু। খাবার টেবিলে বসে খবরের কাগজে চোখ রাখেন ইলিয়াস।
– কাগজটা দেখেছো? ১৯৭১ এর কতিপয় তরুণ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এই শিরোনামে কে একজন নিবন্ধ লিখেছেন … একটু থেমে রঞ্জুর মা বলেন,
– ওখানে একটা গ্র“প ছবিতে বড় ভাই আছেন। কাগজটা সামনে টেনে আনেন ইলিয়াস। বুকটা গর্বে ভরে ওঠে তার। একাত্তরের জুন মাসে যুদ্ধে নিহত তরুণ যোদ্ধার হাসি মুখের ছবি তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
– ‘যাক, দেশটা এখনও গোল্লায় যায়নি তাহলে। কেউ কেউ সত্যিকার যোদ্ধাদের মনে রেখেছে।’ আস্তে আস্তে বলেন ইলিয়াস।
– কেন আব্বু, আমাদের বইয়ে পাঁচজন বীর শ্রেষ্ঠর ছবি আসছে, আমরা শিখছি।
– হ্যাঁ বাবা, হাজার হাজার শ্রেষ্ঠর নাম তো ইতিহাসে পাবে না তোমরা। কিন্তু তারাও তো দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তোরা যখন বড় হবি, ঘরে ঘরে গিয়ে শুনে আসবি সত্যিকার দুঃখ কষ্ট আর যুদ্ধ কী ভীষণ! কত মা শুধু চুপি চুপি কেঁদেছে আমার মায়ের মতো।
আস্তে আস্তে টেবিল ছেড়ে উঠলেন আব্বা। বারান্দায় গিয়ে দেখলেন টুলু বিলুর বাবাকে। খবরের কাগজটা হাতে তুলে দিয়ে বললেন- আব্বা, দেখেন বড় ভাইয়ের ছবি।
– ওটা আমিই লিখে পাঠিয়েছিলাম বিলু! বড় ভয় করে, এ দেশের মানুষেরা ওসব অজানা শহীদদের যেন ভুলে না যায়, তাই।

পাঁচ.
স্কুল বিজ্ঞান মেলায় যেমন বিরাট আয়োজন তেমনই বিরাট মেলা। প্রায় বারোটা নামকরা স্কুল থেকে তিনটি গ্র“পে ভাগে হয়ে ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়েছে। রঞ্জুরা সবচেয়ে জুনিয়র গ্র“প। অন্য সবাই অনেক কিছুই বানিয়েছে। সবাই তাদের প্রজেক্ট দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। বিচারকরা গম্ভীর মুখে প্রত্যেক দলের কাছে যাচ্ছেন, নোট নিচ্ছেন, তারপর অন্য দলের কাছে। সব শেষে রঞ্জুদের পালা। চারদিকে লাইট জ্বলে উঠেছে। তার মধ্যে মস্ত বড় একটা টেবিলে জ্বলে উঠেছে অনেক ছোটো ছোটো বাতি। লম্বা ব্রিজ আর বাঁধ নিয়ে কথা বলে উঠলো তিনটি কিশোর।
– সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ আর যমুনা নদীর ব্রিজে।
মৃদু গুঞ্জনে মোটর চলতে শুরু করলো। আর বড় ড্রাম থেকে মোটা পাইপের মধ্য দিয়ে পানির স্রোত দৌড়ে এলো নদীর অংশে। মনে হচ্ছে শহরের বাড়িগুলোয় যেন জোরসে ধাক্কা দিচ্ছে রাগী নদী।
কিন্তু আমরা তা হতে দেবো না। তাই আমরা পিলার তৈরির দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি… এ ব্যাপারে অবশ্য আমরা বড়দের কিছু সাহায্য নিয়েছি…
রঞ্জুদের প্রজেক্টের সামনে বেশ ভিড় জমে গেল। অনেকেই জানতে চাইলো অনেক কথা।
এখন অপেক্ষার পালা। দাদাজান খুব আসতে চাইলেও তাকে আনা সম্ভব হয়নি। আব্বা একাই এসেছেন রঞ্জুদের সঙ্গে। আম্মু তো ভয়েই আসেনি। যদি রঞ্জুদের প্রজেক্ট ভালো না হয়?
– ‘বাচ্চাগুলোর কষ্ট আমি সইতে পারবো না।
তার চেয়ে তুমিই যাও।’ আব্বাকে ঠেলে পাঠিয়েছে আম্মা।

মেলার হইচই কমে এসেছে। সন্ধ্যার পরে। মাঠ জুড়ে শামিয়ানা টাঙানো। ছেলেমেয়েরা বসে আছে। বসে আছেন অন্য স্কুলের শিক্ষক আর অভিভাবকরা। প্রতিযোগিতায় যারা অংশ নিয়েছে তারাও দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। রঞ্জুর আব্বা বললেন, দেখেছিস রঞ্জু, তোদের তৈরি ব্রিজটা কি গুরুগম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে?
এখন রেজাল্ট কী দাঁড়ায় … মঈনের আব্বা বললেন, ছেলেরা তো ডেমনস্ট্রেট করেছে খুব সুন্দরভাবে। আপনি কী বলেন ইলিয়াস সাহেব?
– এক্কেবারে প্রফেশনাল। অর্থাৎ বড়দের মতো।
পাশ থেকে বলে ওঠেন আতিকের আব্বা।
– আপনি ওদের যেভাবে সাহায্য করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। আপনার আব্বা তো আমাদের একেবারে চমকে দিয়েছেন, নইলে ওরা এতটা করতে পারতো না।
– রেজাল্ট দিচ্ছে, রেজাল্ট ঘোষণা করছে মনজুর সাহেব শোনেন…!
একে একে তিন গ্র“পের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান ঘোষণা করার পর একটু থামলেন বিজ্ঞান স্যার। তারপর তিনি সামনে তাকিয়ে খুঁজলেন তার ছাত্রদের।
– সমস্ত বিচারকের সম্মিলিত বিচারে জুনিয়র গ্র“প চ্যাম্পিয়ন হয়েছে…, পিনপতন স্তব্ধতার মধ্যে ঘোষণা হলো,
– যমুনা নদীর তীরে পলাশবাড়ি ব্রিজ আর সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ প্রজেক্ট, আমি তাদেরকে মঞ্চে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। ক্লাস ফোর এর গ্র“প রঞ্জু আতিক, এবং মঈন … তোমরা কোথায়? মঞ্চে চলে এসো…। বিজ্ঞান স্যার আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন তিনজনকে। মস্ত বড় চ্যাম্পিয়ন এর প্রতীকটা তুলে ধরলো ওরা তিনজন। উল্লাসে ফেটে পড়লো সারা স্কুল। হেড স্যার বললেন, তোমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছো আমরা গর্বিত। আমি দোয়া করি, এমনি করে দেশের গৌরব বাড়ানোর যোগ্য হয়ে ওঠো।
গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলো ছেলেরা। প্রজেক্টটা আপাতত স্কুলে একটা মস্ত কাচের বাক্সে রাখা হচ্ছে। চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিটা ওরা তিনজন এক সপ্তাহ করে নিজেদের কাছে রাখবে, তারপর স্কুলে জমা দেবে। আব্বুর হাত ধরে বাসায় ফিরলো ওরা।
বিদায় নেয়ার আগে কোলাকুলি করে হাত নাড়লো এক অন্যকে। মোবাইলে খবর পেয়ে সব বাড়িতেই মিষ্টির ধুম পড়ে গেছে।
আজও দরজায় থমকে দাঁড়ালো রঞ্জু আর তার বাবা। বড় দরজাটা হাট করে খোলা। দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছেন রঞ্জুর দাদা, দাদী, আর মা। পেছনে উঁকি দিচ্ছে বুয়া।
বসার ঘরে গিয়ে বসতেই দাদী আসেন এগিয়ে। নাতিটাকে বুকের মধ্যে টেনে নেন- তুই নাকি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিস?
– হবে না? কার নাতি, সেটা তো দেখতে হবে। দাদা মন্তব্য করলেন।
আবার ঝগড়া? হেসে ফেলেন রঞ্জুর মা। তারপর এগিয়ে গিয়ে ছোটো টেবিলটার ওপরে রাখা ছবিটার ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিলো রঞ্জুর আম্মা।
– আরে! বিস্ময়ে, আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন ইলিয়াস,
– এ ছবি এতদিন কোথায় ছিলো আম্মা? আমি কত খুঁজেছি।
– আমার কাছে ছিলোরে। দাদী ধরা গলায় বলেন।
– আজকের দিনের মতো একটা দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আয় রঞ্জু আমার কাছে আয়।
মস্ত বড় ফ্রেমে বাঁধানো। একটা ছবির দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে রঞ্জু। ঠিক তার মতো একটা ছেলে, তার বড় ভাইয়ের হাত ধরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে ধরা আছে একটা বড় সড় ফুটবল। ইলিয়াস ছেলের দিকে তাকান। তার চোখ ভেঙে পানি আসে। মনে মনে বলেন,
– ভাইয়া, আমি তোমাদের কথা মতোই সবার দিকে লক্ষ্য রেখেছি। আজ তোমাকে পেয়েছি, এতেই আমার আনন্দ।
রঞ্জু … এদিকে আয়। এই দ্যাখ, এই তোর বড় চাচা টুলু। আজকে খুশির দিনে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। ছবিটার হাসি হাসি চোখের সামনে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন ইলিয়াস। না ইলয়াস নয়। সেই ছেলেবেলার বিলু, সে বলতে চায় ভাইয়া, আমি তোমার কোন কিছু নষ্ট করিনি, সব কিছু মনে রেখেছি… রঞ্জুদের জন্য। আমাদের সবার জন্য।

One thought on “সূর্যোদয়ের দিনে”

Comments are closed.