এখন জামগাছটাই শুধু কাঁদছে

untitled-12_105403মান্দারবাড়ি আটই ডিসেম্বর মুক্ত; যুদ্ধ শেষে আকবর হোসেন বাড়ি ফিরে ঘরের কোণে তার বাবার কঙ্কাল পায়; বাবা কিছুতেই গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি, কঙ্কালটি দেখে মনে হয় অন্তত দু’মাস আগে ঘটনাটি ঘটে। দেহ থেকে মাংস খসে পড়ে গেছে; দেহটি যেভাবে অন্তিমকালে বসে পড়েছিল ঠিক সেইভাবে ঠিক সেই কোণে কঙ্কালটি স্থাপিত, আর মাথার খুলি গলার হাড় ভেঙে ঢুকে বসে গেছে তার বুকের পাঁজরে।

এরপর আকবর হোসেনকে শোনা যাবে যুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা সে আপন মনেই বলে যাচ্ছে। বলছে। আকবর হোসেন বলে যাবে দিনের পর দিন তার যুদ্ধের কথা, আর ঘরের কোণে পাঁজরের ভেতরে প্রবিষ্ট মাথার খুলি দিয়ে সেই কাহিনী শুনে যাবে তার বাবা, কারণ কঙ্কাল ছাড়া এখন তার এ কাহিনীর কোনো শ্রোতা নেই আর। যারা জীবিত তাদের জীবন আছে অবশ্যই, কিন্তু সেই জীবনের সঙ্গে আকবর হোসেনের স্বপ্নের কোনো সাদৃশ্য নেই, এখন যারা এ দেশে তুমুল হয়ে আছে আকবর হোসেনের সঙ্গে তাদের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। অতএব, আকবর হোসেন তার কাহিনীর শ্রোতা কঙ্কাল ছাড়া আর কাউকে পায় না; কিন্তু, তবু সে তার কাহিনী বলে যায় বর্ষায়, শীতে, বসন্তে, কারণ সে বিশ্বাস করে শ্রোতা একমাত্র তার বাবা নয়_ বাবার কঙ্কালের বদলে লক্ষ লক্ষ কঙ্কাল, আকবর তাদের কাছেই তার কাহিনী শোনায়। সমস্ত দেশটিকে কঙ্কালের সভা বলে মনে হয় যখন রাত গভীর হয়, যখন গাছ ঘুমোয়, বাড়ি ঘুমোয়, নৌকা ঘুমোয়, মানুষেরাও ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু মানুষের অতীত কখনও ঘুমায় না।
সেই কঙ্কাল সকল তার কাছে আসে। বৎসরের পর বৎসর, গভীর নীরবতার ভেতরে আকবর তাদের কথা শোনে। কলস্বরে তারা তাদের স্বপ্নগুলো ফেরত চায়, কিন্তু ফেরত দেবার প্রতিভা তার আর নেই। ঘরের ভেতর থেকে আকবর হোসেনের উত্তেজিত গলা শোনা যায়, ‘কেন আমার কাছে ওরা আসে? বাবার কঙ্কালের উদ্দেশ্যে সে বলে, ‘তুমি ওদের মানা করে দাও, তুমি তো নিজেই জানো, মৃত্যুও আর যথেষ্ট নয় এই বাংলাদেশে। ওরা যেন আর না আসে।
আকবরের চিৎকার শুনে তার ছোটবোন টুনটুনি ছুটে আসে ঘরে। টুনি জানে তার দাদা কতকাল থেকে আপন মনেই শুধু কথা বলে যায়। ঘরে ঢুকেই টুনি শাসন করে, ‘চুপ করে শুয়ে থাকো তো।’
আকবর হোসেন বলে, ‘বড় দজ্জাল হইছিস তুই।’
‘নিন্দ যাও, দাদা, পায়ে ধরো।’
‘আমি আর চিৎকার করব না, যা তুই, টুনি।’
টুনির হাতেই কতকাল থেকে আকবর হোসেন তার সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে আছে; টুনি তার কাপড় গুছিয়ে রাখে, বিছানা করে দেয়, কুয়ো থেকে গোসলের পানি তুলে দেয়। এখন কত বড় হয়ে গেছে টুনি।
বহুদিন পরে টুনিকে সে লক্ষ্য করে, বড় বিস্মিত হয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে বোনের দিকে। কখন টুনি শাড়ি পরতে শুরু করেছে, সে জানেও না; এই যুবতী তার বোন টুনটুনি কি না, এ সন্দেহ মন থেকে অনেকক্ষণ দূর হয় না।
‘বাবার কথা তোর মনে পড়ে, টুনি?’
টুনি মাথা নাড়ে।
‘সে কী! মনে পড়ে না?’
‘একটু, একটু।’
আকবর হোসেন টুনিকে ঘরের সেই কোণটির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ‘এইখানে, ঠিক এইখানে বাবা বসেছিল। পা দুটো ছড়ানো ছিল সমুখের দিকে। তোর কী মনে হয় টুনি, বাবাকে ওরা যখন গুলি করে, সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল? তোকে খুব ভালোবাসত, টুনি।’
আকবর হোসেন ঘরের কোণের দিকে তাকায়। সেখানে বাবাকে সে খুঁজে পায় না। তার ভেতরটা হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে।
‘বাবা, তুমি আছ?
অন্ধকারে ক্ষীণ একটা আলোর মতো স্বর আকবর হোসেনের।
‘আছ তুমি?’
নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে যেন জোনাকি।
‘আছ?’
বাতাস ফিসফিস করে, ‘আকবর, আকবর, আকবর।’
প্রথমে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার শরীর, ভয় করে, ছমছম করে গা; তারপর সে আবার দেখতে পায় কঙ্কালটিকে, রাজাকারেরা বাবাকে যেভাবে যেখানে হত্যা করে রেখে গিয়েছিল, এখন আবার ওই তো তিনি বসে আছেন সেখানেই।
আকবর উল্লসিত গলায় বলে ওঠে, ‘বাবা, তুমি যে ছোটবেলায় আমাকে তোমার সব জমি দেখাতে নিয়ে যেতে, অনেক দিন পরে, আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুব কাজে লেগেছিল। তুমি সেই যে রাস্তাটার কথা বলতে, যেখানে গেলেই পথ ভুল হয়ে যায়, বিশেষ করে চাঁদনী রাতে। সেখানে এক পূর্ণিমার রাতে আমরাও পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর একটু হলেই আমরা পাকিস্তানে আজরাইলের ডেরায় গিয়ে পড়তাম; হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল তুমি বলেছিলে_ ‘বাঁয়ে দিঘি, ডানে রাজবাড়ী, সোজা রাস্তা মান্দারবাড়ি। সেটা মনে হতেই বিপদ কেটে গেল, হঠাৎ সম্মুখে খুলে গেল পথ, ফিরে গেলাম আমরা আমাদের আস্তানায়।’
টুনিকে নিয়ে আকবর হোসেন বড় ব্যস্ত হয়ে যায়।
‘টুনি, আয়, তোর বই নিয়ে আয়।’
টুনি অবাক হয়ে যায়। জীবনে খুঁটিনাটির দিকে তার দাদার এই উৎসাহ তাকে অবাক করে দেয়। আবার একটু আশঙ্কাও হয় তার, অস্বাভাবিক বলে মনে হয়; যেন এই ছিল স্বাভাবিক। এই ঘরের ভেতরে সারাদিন চুপ করে থাকা, এই একা ঘরে কথা বলে ওঠা।
টুনি বলে, ‘কেন? বই দিয়ে কী হবে?’
‘দেখি কী পড়ছিস।’
‘সে আমি যা পড়ার পড়ছি।’
‘আমি তোকে পড়াব এবার। হ্যাঁ, আমি তোকে পড়াব। আমি কিন্তু জানি টুনি কলেজের খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। অঙ্কে লেটার পেয়েছিলাম। তুই হাঁ করে আছিস যে? সত্যি? শোন, ইংরেজিতে আমার যা নম্বর ছিল, ক্লাসে আর কারোই ছিল না। আইএ-তে লজিকে আমি লেটার পেয়েছি। লজিক জানিস তুই কাকে বলে? বিশ্বাস হয় না যে একদিন আমি কত ভালো ছাত্র ছিলাম? তুই যদি কলেজে উঠে লজিক পেপার নিস, আমি তোকে লজিক পড়াব। তুই ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করবি, টুনি। আমি তোকে দারুণ রেজাল্ট করিয়ে দিতে পারবো রে। মনে করিস, আমি কেবল যুদ্ধ করেছি, লেখাপড়া কিচ্ছু করিনি? আয়, আজ তোকে দেখিয়ে দেব, ইচ্ছে করলে, আজও আমি, কী না করতে পারি?
কথাটা বলেই বিষণ্ন হয়ে পড়ে আকবর। ইচ্ছে করলেই কি আজও সে পারে? সব কিছুই পারে? সব কিছুই পারে? বদলাতে পারে এই নষ্ট ধস্ত দেশটাকে?
বাইরে জামগাছ তলায় মানুষেরা এসে দাঁড়ায়। জীবন্ত, কিন্তু তারাও যেন আজ কঙ্কাল। মানুষ তো কেবল মরে গেলেই কঙ্কাল হয়ে যায় না, স্বপ্ন মরে গেলেও, আশা নিহত হলেও মানুষ পরিণত হয় কঙ্কালে।
দূরদূরান্ত থেকে মানুষেরা আকবার হোসেনের ভিটেবাড়ি বাইরে জামতলায় এসে দাঁড়িয়েছে। তারা যেন বলছে, ‘তোমরা ইচ্ছা কইরলে আবার যদি ইচ্ছা করেন, কি-না কইরবার পারেন। তাকেয়া দ্যাখেন, চাইরোদিকে ভালো করি একবার দ্যাখেন, মানুষ কি আর মানুষ আছে, বাহে? আর তোমরা চুপ করি বসি থাইকবেন? ইয়ার কোনো পত্তিকার কইরবার নন? তয় তোমরা ইয়ার জইন্যে যুদ্ধ কইরছিলেন, বাহে?’ কী উত্তর দেবে আকবর হোসেন? সে নিজেও তো কবেই পরিণত এক কঙ্কালে। ধীরে পা টেনে সে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আঙিনা পার হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দেখে, সন্ধ্যে কখন হয়ে গেছে টুনি এখনও বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়নি।
আকবর হোসেন অন্ধকারের ভেতরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ বাবার গলা সে শুনতে পায়, ‘মানুষগুলো কত দূরদূরান্ত থেকে এসেছিল, তাদের কথার উত্তর দিলে না যে?’
‘কী উত্তর দেব?’
অন্ধকারে তখন বাবার রুষ্টস্বর শোনা গেল, ‘উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, বলতেই হবে, তাহলে এ যুদ্ধ তুমি করেছিলে কেন?’
ষ ৮ পৃষ্ঠার পর
আকবর হোসেন একবার ইতস্তত করে, চিৎকার করে থামিয়ে দিতে চায় বাবাকে, কিন্তু অন্ধকার বড় প্রশস্ত, সেই অন্ধকার তার চিৎকার শোষণ করে নেবে ভয়ে সে চুপ থাকে।
তখন বহনযোগ্য নক্ষত্রের মতো একটি লণ্ঠন এনে ঘরে রাখে টুনি।
‘কে এসেছিল, দাদা?’
‘কেউ না।’
‘দেখলাম যে কথা বলছ।’
‘মাঝিপাড়ার কারা যেন, আমি চিনি না।’
টুনির মনে পড়ে যায়, সে বলে, ‘কালও অনেকে এসেছিল, দাদা। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।’
আকবর হোসেন চিৎকার করে ওঠে, ‘কেন আসে? কেন আসে ওরা? ওরা কেন আসে, টুনি? আমি জেগে থাকলেও বলবি, আমি ঘুমিয়ে আছি। তুই ওদের মানা করে দিবি। আমি তো ঘুমিয়ে আছি। তুই দেখিস না? তুই দেখতে পাস না রে, টুনি? তাহলে আমার কাছে কেন ওদের আসতে দিস আর?’
টুনটুনি জানে তার দাদার এ কথার কোনো জবাব নেই। লণ্ঠনটা টেবিলের ওপর রেখে সে ক্ষণিকের জন্যে চলে যায়। টুনি ঘর ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আকবর হোসেন টের পেয়ে ওঠে, ঘরের কোণে তার বাবা আবার নড়েচড়ে বসেছেন। কঙ্কালের হাড়ের শব্দে ক্রমেই বিচলিত হয়ে পড়ে ছায়া এবং স্তব্ধতা। এই নিয়ে টুনি এসে দেখতে পায়, ঘরটা খালি, তার দাদা নেই। তখন সে লণ্ঠন হাতে আঙিনায় নেমে পড়ে। সদর দরোজার দিকে যেতে থাকে।
দাওয়া থেকে মা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘অ্যাই টুনি, কোনঠে যাইস ভর সানঝের বেলা?’
‘দাদাকে তল্লাশ করি, ঘরে নাই।’
‘ক্যান? ঘর ছাড়ি বিরাইলে ক্যান? ঘর উয়ার কব্বর হইছে, কব্বর ছাড়ি বিরাইলে তাঁই ক্যান? বিরাইছে তো বিরাইছে, তুই তুল্লাশ কইরবার যাইস ক্যান?’
মায়ের অবিরাম বকবক উপেক্ষা করে টুনি তখন দাদাকে খুঁজতে বেরোয়। বাঁশবনের ভেতর থেকে চটচট আওয়াজ ওঠে, আকাশে দু-একটা নক্ষত্র জায়গা নেবার জন্যে এসে দাঁড়ায়। স্তব্ধতা গম্ভীর হয়ে ত্রস্ত পায়ে ছুটে চলা মেয়েটাকে দেখতে থাকে।
মাঠের ও-মাথায় শিমুল গাছের নিচে অন্ধকার একটু ঘন মনে হয়। টুনির ভয় করে গাছটায় নিচে যেতে। যুবতীরা অন্ধকার বৃক্ষকে ভয় করে, একদিন এই বৃক্ষের আড়ালেই একজন তার জন্যে ওঁত পেতে থাকবে, কিন্তু এখনও তা নয়, এখনও সেই ভবিষ্যৎ নয়, ভবিষ্যতের ভেতরেই থাকে কাছের ও দূরের কিছু কাল, কাছের এই কালে এখন টুনটুনির গতি হরণ করে যুবতী নারীর জাতিস্মর ভয়। তখন মাঠ পেরিয়ে শোনা যায় আকবর হোসেনের গলা, ‘আয় এত্তি আয়, টুনি।’
টুনি তবু মাঠের এপারেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
শিমুল গাছের নিচে জমাট অন্ধকারের ভেতর থেকে অচিরে শোনা যায় ‘আয়, টুনি আয়। শেষ যুদ্ধটা আমি এখানে করেছি, এই শিমুল গাছের দিকে শেষ গুলিটা এখানে আমার হাত থেকে বেরিয়েছিল, দু’জনকে আমরা বন্দি করেছিলাম, টুনি, আয়, টুনি, আয়, দেখে যা, এখনও হয়তো গুলির দাগ পাবি গাছে, ভালো করে দেখলে এখনও হয়তো খুঁজে পাবি।’
কিছুই আর কেউ খুঁজে পায় না এই দেশে।
টুনি বলে, ‘ওখানে বড় অন্ধকার, খুঁজবে কে? ঘরে চলো, দাদা।’
আকবর হোসেন সে কথায় কান না দিয়ে বলেই চলে, ‘এখানে খুব বাতাস, টুনি, এখানে আয়, দেখে যা, ঠিক কোন জায়গায় ওরা লুকিয়েছিল, দেখিয়ে দিই, এখানে যুদ্ধের পর বাড়ি গিয়ে বাবাকে দেখলাম, টুনি; বাবা তখনও বসে আছে আর কারও নয় আমারই ঘরের কোণে।’
আকবর হোসেন বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পাড়ি দিয়ে টুনির কাছে এসে দাঁড়ায়, সে বলেই চলে, ‘তখনও আমাদের ঠিক সেইভাবেই বসে আছেন। তোকে দেখতে দিইনি। তুই তখন কত ছোট।’
আকবর হোসেন টুনির কাঁধে হাত রাখে। ‘তোর বিশ্বাস হয়, টুনি, আমার হাতে একদিন বন্দুক ছিল? ঠিক এই হাতে এভাবে, এই আমার হাতের ভেতরে, দ্যাখ।’
আকবর হোসেন তার হাতের ভেতরে বন্দুকের শূন্যতা অনুভব করে কিন্তু মন থেকে ঝাড়া দিয়ে ফেলতে চায় সে অভাব; সে আরও শক্ত করে চেপে ধরে টুনির কোমল কাঁধ।
এইভাবে বহুদিন বহুরাত এখন আকবর কতকাল থেকে ঘুরে বেড়ায় তার পুরনো সেই জায়গায়, যেখানে সে যুদ্ধ করেছে, যেখানে সে শত্রুর জন্যে ফাঁদ পেতেছে একদিন, যেখানে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, যেখানে সে সঙ্গীকে কবর দিয়েছে, যেখানে সে শত্রুর প্রতীক্ষা করে থেকেছে, সেই তখন যখন আকবর হোসেন বন্দুক হাতে নিয়েছিল। সে কখন? সে কোন কাল? সে কোন অতীত?
মানুষ যদি হাজার হাজার বছর ধরে বলে থাকে যে, মানুষ মৃত্যুর পর তার ভালোবাসার জায়গাগুলোতে ফিরে ফিরে আসে, তাহলে আকবর হোসেনও তো ফিরে এসেছে।
আকবর হোসেন টুনির হাত ধরে বলে, ‘গাছে জাম ধরেছে রে! জামের ঘ্রাণ পাচ্ছিস তুই?’
টুনি অবাক হয়ে ভাবে, এই কি জামের সময়, কোথায় জাম?
‘তুমি কিচ্ছু জানো না, দাদা, জাম কি এখন?
‘তুই কিচ্ছু জানিস না, টুনি, জামের স্পষ্ট ঘ্রাণ আমি পাচ্ছি।’
টুনি অবাক হয়ে বলে, ‘কই, আমি তো পাই না।’
‘তোর নাকই নেই।’
‘আমার নাক নিয়ে কথা বলবে না, দাদা।’
টুনির একটু অভিমান হলেও মনে মনে সে খুশি হয় বহুকাল পরে তার দাদার গলায় উৎসাহ এবং সংগীত লক্ষ্য করে, তাই সে আরও খানিকটা বকাতে চায় তার দাদাকে। বলে, ‘জামের ঘ্রাণ পাচ্ছ তো, চলো দেখি জামতলায়, জাম কি-না দেখি।’
আকবর হোসেন নীরবে হাসতে থাকবে, বলবে, ‘মোক তুই চ্যালেঞ্জ করবু না, কয়া দিলোম।’
বহুকাল পরে সে আবার যুদ্ধের একটি শব্দ উচ্চারণ করে_ চ্যালেঞ্জ!
টুনি বলে, ‘করিলোম চ্যালেঞ্জ।’
‘করলু?’
‘হয়, মুই করিলোম, চলো যাই বকুলতলায়।’
দু’জনে তারা জামগাছটার কাছে যায়। লণ্ঠনের আলো জামের ডাল পর্যন্ত পেঁৗছোয় না, তবু সে উঁচু করে ধরে। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, ‘কোনঠে তোমার জাম? এলাও দ্যাখো কুঁড়িই ধরে নাই।’
অপ্রস্তুত হয়ে যাবে আকবর হোসেন, বলবে, ‘ভালো করি দ্যাখ না ক্যানে, টুনি।’
‘মুই দেখিছো, তোমরা দ্যাখো।’
‘তবে যে আমি জামরে ঘ্রাণ পেলাম, টুনি? রসালো সেই ঘ্রাণ! আবার যেন সব আগের মতো।’
দাদার গলায় মৃদু আর্তনাদ লক্ষ্য করে টুনি, লক্ষ্য করে মুহূর্তের জন্য তার মন মরে যায়। তারপর, হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠে দাদার হাতখানি ধরে টুনি কান্নাধরা গলায় বলে, ‘হয়, দাদা, হয়। তুমি ঠিক বলেছ, জাম!’
‘বলিনি?’ উজ্জ্বল চোখ আকবর হোসেনের।
তার সাথে পাল্লা দিয়ে টুনিও তখন, ‘সত্যি তো জাম।’
‘আয় তবে, এখানে একটু বসি রে!’
কতকাল পরে টুনি আর আকবর হোসেন, দুই ভাইবোন, একজন যে যুদ্ধ করেছে, একজন যে যুদ্ধ দেখেনি, দু’জনে বসে সেই গাছতলায় বাঁধা বাঁশের পুরনো বেঞ্চের ওপর।
অনেকক্ষণ পরে টুনি বলে, ‘দাদা, আমার হাউস করে।’
‘কিসের হাউস?’
‘ভাবি আনি দ্যাও।’
‘কী করবু ভাবি দিয়া রে?’
হাসতে হাসতে টুনি বলে, ‘ভাবিকে লাঙলে জুতি দিয়া হালচাষ করিম। আর কী করিম?’
আকবর হোসেনকেও হেসে উঠতে দেখে আরও একটু ভরসা পায় টুনি, দাদার কড়ে আঙুলে ছোট মোচড় দিয়ে সে বলে, ‘দাদা, বিয়ে করো।’
আকবর চুপ করে থাকে।
টুনি উৎসাহ নিয়ে বলে, ‘মেয়ে দেখব, দাদা?’
বসে থাকে নিশ্চল আকবর।
‘দু-একজন দেখেই রেখেছি। তুমি বললেই হয়। দেখবে তুমি মেয়ে?’
আকবর হোসেন ঝট করে উঠে দাঁড়ায়।
বড় ব্যাকুল হয়ে পড়বে টুনটুনি; ত্রস্ত পায়ে দাঁড়িয়ে পড়বে সেও। আকবর হোসেন তখন ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে, তার সঙ্গে টুনিও হাঁটতে হাঁটতে করুণ চোখ করে বলবে, ‘এভাবে কতদিন থাকবে তুমি, দাদা? বিয়ে করবে না?’
‘না।’
‘সংসার করবে না?’
‘না।’
‘সবার মতো সংসার করতে পারো না তুমি?’
‘না।’
‘তোমার জীবন নাই?’
‘না।’
‘এভাবেই তবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘একা একা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন, দাদা, কেন?’
আকবর হোসেন তখন চুপ করে থাকবে।
‘কোন দুঃখে?’
আকবর হোসেন তখন ত্রুক্রদ্ধ বোধ করবে।
টুনি ধমক দিয়ে বলে, ‘সব দুঃখ একার তোমার?’
আকবর হোসেন তখন বহুদিন পরে প্রান্তরে তার যুদ্ধের জায়গাগুলোতে আবার হাঁটবার জন্য ছটফট করে ওঠে।
টুনটুনি তার হাতখানা শক্ত করে ধরে রেখে তীব্রস্বরে বলে, ‘সবাই ভালো আছে, সবাই সুখে আছে, সবাই সবকিছু ভুলে গেছে। তোমার কী হয়েছে, দাদা? তুমি ভুলতে পারো না কেন? তুমি কেন সুখে থাকতে পারো না? তুমি কেন সংসার করতে চাও না? তুমি কেন কাজ করতে চাও না? তুমি কেন হাসতে পারো না, দাদা, কেন তুমি আবার আগের মতো হেসে উঠতে পরো না? আবার সেই আগের মতো হয়ে উঠতে পারো না?’
টুনির হাতের ওপরে স্নেহের একটা হাত রাখে আকবর হোসেন। অনেকক্ষণ পরে বলে, ‘কথা বলিস না, টুনি। কথা বলিস না তুই। চুপ কর তুই। চুপ কর টুনি।’
বাড়ির ভেতরে যাবার জন্যে আকবর তার বোনের হাত ধরে টান দেয়। দু’ভাইবোন, একজন যে যুদ্ধ করেছিল, একজন যে যুদ্ধ দেখেনি বাড়ির আঙিনায় পা রাখে।
রান্নাঘরের দাওয়া থেকে মা চিৎকার করে ওঠেন, ‘যুদ্ধটা না করিয়া হালচাষ কইরলে তো বাপ-দাদার নাম থাকিলো হয়। এলা রতো সমুদয় গেইছে কী পাইছেন তোমরা? কোন বেহেশত আনি দিচেন যুদ্ধ করি!’
তখন এক বিকট রাত সন্ধ্যার গর্ভ থেকে বেরিয়ে বাড়িটাকে দাঁতে কামড়ে ধরে। আকবর হোসেনের পা টলে ওঠে। টলমলো পায়ে সে আঙিনা থেকে আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। পা টলছে খুব। একটুখানি অবলম্বনের জন্য আর কোনো মানুষের কাছে নয়, আকবর হোসেন তারই ভিটার বাইরে জামগাছটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। জামগাছ থেকে তার কাঁধের ওপর টস করে এক ফোঁটা পানি পড়ে। মান্দারবাড়ি আটই ডিসেম্বর মুক্ত হয় আকবর হোসেনের হাতে। যুদ্ধ শেষে এই গাছটার নিচেই তো সে এসে দাঁড়িয়েছিল।