তাঁর রঙ, তাঁর ক্যানভাস

untitled-3_102831কাইয়ুম আমার কতদিনের বন্ধু; মৃত্যুর অনতিপরে সেই হিসেবে মন সায় দেয় না। দশকের পর দশক আমরা একসঙ্গে পথ হেঁটেছি; একত্রে স্বপ্ন দেখেছি। এখন ঢাকা মহানগরীর যে অংশকে অনেকেই খানিকটা করুণা করে পুরনো ঢাকা বলেন, সেখানেই একদা ছিল মূল শহর, আর ছিল ঢাকার প্রথম চারুকলা ইশকুল; ব্রিটিশ আমলের ভিক্টোরিয়া পার্ক লাগোয়া, লাল পানির ট্যাংকের ছায়ায়, ব্রিটিশ আমলেই স্বদেশি উদ্দীপনায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলের এক পাশে যে ইশকুল জয়নুল আবেদিন গড়ে তোলেন পাকিস্তান হওয়ার বছর দুয়েকের মাথায়; আর সেখানেই আজকের দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর প্রথম চিত্রপাঠ শুরু হয়; বলেছি চিত্রপাঠ, বললে ভালো হয়_ সেই সঙ্গে তাঁর জীবনপাঠ, দেশপাঠ, ঐতিহ্যপাঠ; এবং কেন নয়?_ যখন জয়নুলের মতো আচার্য তাঁর পাঠদাতা, আর কামরুল হাসানের মতো পটুয়া কাইয়ুমের সমুখে।
সমুদ্রদ্বীপ হাতিয়ায় জন্ম নিয়ে পিতার চাকরিসূত্রে কাইয়ুম দেশের বহু শহর আধা-শহরে বেড়ে ওঠেন, একটি দেশের ভেতরেই সংস্কৃতির যে-বৈচিত্র্য আছে তাঁর বালক-চোখ তা পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখে নিতে থাকে_ মেলায়, পূজায়, ঈদে, মহররমের মিছিলে, হাটে-বাজারে; আর ইতিহাসের দিকে তাঁর দৃষ্টি ফেরে সেই দেশভাগের সময় মানুষের উত্তাল বিহ্বল মথিত উৎপাটিত মুখরেখায়।
কাইয়ুমের দীর্ঘ-দীর্ঘ দিনের সাহচর্যে_ আমার নিবিড়তম এই বন্ধুটিকে আমি জেনে উঠি, কিশোরকালেই তাঁর হাতে ফুটে উঠতে থাকে চোখের দেখা জগতের একেকটি ছবি_ পেনসিলে, কালিতে, খাতার পাতায়_ অপটু, ভগ্নাংশ, অপরিকল্পিত; সেকালেই যে তাঁর চঞ্চল আঙুলে উঠে আসতে থাকে ওই সব দৃষ্টলিখন, পরে আমরা দেখব এ সবই আরও মেধা ও কুশলতা পেয়ে যাবে, প্রতিভার স্পর্শে জেগে উঠবে ভাষাহীন চিত্রভাষায় বাংলার প্রতি গভীরতম গাঢ়তম মমতা নিয়ে, একান্ত নিজস্ব রূপবিন্যাসে ইতিপূর্বে আর দেখিনি এমন চিত্রকল্পমুখর হয়ে_ মেলার শোলাপাখি, পুতুল, হাতপাখা, নাগরদোলা_ বাজারে দোকান ও গদিতে আসীন মহাজন_ কলাপাতার আড়ালে সলজ্জ যুবতী_ গ্রামবাংলার সবুজে উৎসুক বালক ও বালিকারা_ সোনালি রোদে ধোয়া কুটির, ঘন বনে আধোদৃষ্ট পথ, রূপকথাকল্প মাছ_ আর নদী, নদীর বিভঙ্গ তরঙ্গ, বৈঠা, বাদাম_ আর নৌকো!
অচিরে আমরা ওই নৌকো দেখব, নৌকোর গলুই দেখব, গলুইয়ে খোদাই করা চোখ দেখব_ যা বারবার কাইয়ুমের ছবিতে ফিরে আসবে, হয়ে উঠবে তাঁর প্রধান এক রূপকল্প; কখনও সে নৌকোর চোখ স্থির অবলোকন করে চলেছে মানব-সংসার, কখনও তা নদীজলের ঝাপটায় সিক্ত, যেন ক্রন্দন করছে, কখনও মায়াময়_ যেন বলছে এমন মানব-জনম আর হবে না। কাইয়ুম চিত্রকর হয়ে উঠবেন বাংলার হাজার বছরের রূপগন্ধবর্ণ তুলিতে ধারণ করে। আর, একদিন বাংলার মানুষ দেখবে গণহত্যা_ আগুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, লাশ; কাইয়ুমের চোখের সমুখেই তাঁর এক স্বজন তরুণকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে পাকিস্তানি মিলিটারি, আর সে ফিরবে না, তার লাশ পাওয়া যাবে না;_ মুক্তিযুদ্ধে যাবে মানুষেরা;_ কাইয়ুমের ছবিতে লাল ও সবুজ আছড়ে পড়বে, বৈঠার বলিষ্ঠ ও প্রত্যাঘাতী চিত্রণে বাংলার চেতনা মূর্ত হয়ে উঠবে, জীবনানন্দের রূপসী বাংলার ক্রন্দন ফেটে পড়বে কাইয়ুমের ঘন নীল ব্যবহারে; কাইয়ুম মুক্তিযোদ্ধাকে আঁকবেন, ক্রমাগত এঁকে যাবেন পটে, পোস্টারে, স্যুভেনিরে, স্মারকপত্রে_ ঈষৎ পাশ ফেরা মুখ, মাথায় গামছা বাঁধা, সমুুখে প্রত্যয়ী দৃষ্টি, হাতে রাইফেল, কিংবা কখনও কেবলি সেই শক্ত করে গামছা বাঁধা মাথাটুকু_ কাইয়ুম এভাবেই আমাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধার মুখটিকে আমাদের জন্য একমাত্র ও চিরকালের করে যাবেন; আমরা তাঁর এই মুখটির ভেতর দিয়েই বাংলার প্রাণশক্তিকে দেখে উঠব ইতিহাসে; এভাবেই হাতের তুলি আর থাকবে না তাঁর নিজস্ব হয়ে, হয়ে যাবে সমগ্র জাতির।
কাইয়ুমের ছবির সমুুখে দাঁড়িয়ে কী আমরা হয়ে উঠি?_ আমি সচেতনভাবেই বলিনি যে কী আমরা দেখে উঠি। আমি বিশ্বাস করি, কারও আঁকা ছবি, কিংবা কোনো আঁকার বিষয়ে কেবল উপরিতলেই কথা বলা যায়। যেমন আমরা বলতে পারি, কাইয়ুমের ছবিতে মৌলিক তিনটি রঙ_ লাল, নীল ও সবুজের ব্যবহার অধিক দেখি; এ কেন? উত্তরে, কেন আবার?_ কবির ভাষাভঙ্গির মতো চিত্রকর তাঁরও যে ওটাই বর্ণভঙ্গি! ওতেই তাঁকে তিনি বলে চেনা যাবে!_ ব্যস, এত দূরই। যেমন, কাইয়ুমের পটের মাপটি প্রায় সব সময় ও অনিবার্যভাবে বর্গক্ষেত্রের; বিপুল দৃশ্যমানতা ও দৃশ্যকল্পতাকে যখন তিনি আপন দৃষ্টিপথে তথা তাঁর পটে বন্দি করতে চান, তখন তা বর্গাকারে তিনি বাঁধেন কেন, বর্গাকারেই তা আসে কেন_ দুই-দুই তিন-তিন কি এক-একই_ তা তিনিও বলতে পারবেন না!_ বারবার জিজ্ঞাসিত হলে ঈষৎ হেসে হয়তো বলবেন_ ওভাবেই যে আসে!_ ওভাবেই যে দেখে উঠি! আমরা হয়তো তাঁর এ বিশেষতাকে এভাবে ব্যাখ্যায় আনতে পারি, আকারের সব ধরনই প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে_ আয়ত, গোল ইত্যাকার, কিন্তু একমাত্র বর্গক্ষেত্রই মানবের সচেতন জ্যামিতি-কল্পনায় রচিত; অতএব আঁকার নিজস্বতায় শুধু নয়, কাইয়ুম চাইছেন আঁকা বন্দি করার আকারটিতেও তিনি সচেতনভাবে নিজস্বতা প্রার্থনা করেন_ এর অধিক কী বলা যাবে? মনে হয় না। যেমন, কাইয়ুমের ছবিতে বাংলার লোকশিল্প থেকে নেওয়া নানা কল্পবস্তু_ পুতুল, পাখা, কাঁথা, শীতলপাটি, শখের হাঁড়_ কেন? তিনি বলবেন, বহুবার আমাকে বলেছেন_ কই না তো! ওসবই আমার কাছে দৃশ্যজগতের উপকরণ মাত্র; কাঁথায় সোনামুখী সুচের ফোঁড়ে যে পুতুলটি ফোটে তা কাপড় ও সুচের কারণেই ওই-রূপে ফোটে, পটের ওপর তুলিতে যখন সে পুতুল তখন তার রূপ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন_ টানাসাপেক্ষ তুলি আর বিস্তারমান নমনীয় রঙ মাধ্যমের কারণে, পটের ওপর সেই টানা ও নমনীয় প্রয়োগ-কারুর কারণে; একইভাবে মাটি বা কাঠ বা খড়ে যে লোকশিল্পের কল্পবস্তু সেটিও ভিন্নতা পায়, আমার হয়ে যায়, একান্তই আমার কল্পবস্তু হয়ে যায় পটে; তখন তারা আমার দেখা আমার গড়া আমার চিত্রভাষা হয়ে যায়। শুনেছি বটে, তাঁর মুখে_ কিন্তু এ সবই কারিগরির কথা, শিল্পের জন্য শিল্পের সমুখে আমাদের দাঁড়াতে হবে, তবেই শিল্পীকে চেনা যাবে, বোঝা যাবে, তবেই তিনি অনুভবে আসবেন।

বস্তুত, শব্দব্যবহৃত ভাষায় শব্দহীন ভাষার কাজ নিয়ে কেবল প্রান্তই ছুঁয়ে যাওয়া যায়, পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ সম্ভব হয় না। ওই প্রবেশের জন্য রয়েছে আমাদের মরণশীল দুটি চোখ এবং চোখের দেখা নিয়েই তো ছবির যা-কিছু!_ ছবি যদি শব্দভাষাহীন, তবে তার গ্রহণ ও বর্ণনও শব্দভাষাহীন নিশ্চিতই। উচ্চাঙ্গ বিশুদ্ধ ধ্বনিময় কণ্ঠ বা যন্ত্রসঙ্গীতও আমাদের কাছে এমনটিই দাবি করে, শ্রবণকালে কোনো চিত্র কল্পনা করা নয়, যথা মেঘমল্লারে মেঘঘন আকাশটিও নয়, এ মেঘ বিমূর্ত ও চেতনামাত্র, যথা ভৈরবীতে ভোরের আলো ফোটা নয়, ভোরের শান্ততা নয়, ঘুম থেকে জাগরণ নয়, কেবল সেই মহামুহূর্তটির অনুভব আত্মা যখন জেগে ওঠে অন্ধকার থেকে সব তমসা সরিয়ে; পাশ্চাত্য সিম্ফনি শ্রবণকালে তো স্পষ্ট নিষেধই আছে_ না, মূর্ত কোনো কিছুই কল্পনায় দেখে ওঠা চলবে না, এমনকি রঙিন আলোকরেখার কোনো কম্পন উল্লম্ফন বা নৃত্যপরতাও যেন কল্পনায় না আসে!_ তাহলেই ঠকতে হবে। আত্মার ধমনীতে, শরীরের রক্তপ্রবাহেই তাকে ধরে তুলতে হবে, অনুভব করতে হবে। আঁকা ছবির বেলায়ও আমি এটি মান্য করে থাকি।
শুরুতে পুরনো ঢাকার কথা বলছিলাম; মনে পড়ছে, সেই পুরনো ঢাকায় ছিল শরবত আর সহবত_ পানীয় আর সৌজন্য; দুটিই এখন অস্তগত। চকবাজারে তখন সন্ধ্যাকালে খুশনবীস রইসেরা আসতেন; চকে শরবতের দোকান ছিল কয়েকটি; কী বিচিত্র স্বাদের স্বর্গীয় শরবতই না কারিগরেরা বানাতেন_ না, তাঁদের শিল্পীই বলতে হয়! মনে পড়ছে, মীর্জা কাদের সাহেবকে দেখেছি_ এসে বসলেন চকবাজারের মজলিশে, তাঁর সমুখে শরবতের খাঞ্চা এলো, খাঞ্চায় অনেকগুলো গেলাশ, সবাই চান মীর্জা চেখে দেখে তারিফ করুন কোনটি উম্দা ছে উম্দা। মনে পড়ে, একটা একটা করে গেলাশ শুঁকে দেখেই তফাৎ করতেন, তারপর যে গেলাশটিতে তিনি ঠোঁট ছোঁয়াতেন, চোখ বুজে একটা মাত্র চুমুক, তারপর চোখ খুলতেন_ সমুখে দাঁড়ানো শরবতওয়ালা; মীর্জার মুখে একটিও তারিফ শব্দ নেই, চোখ দুটিতে শুধু আলোর ঝিলিক হাতের আঙটিতে হীরের মতো; ওই আলোর ঝিলিকটুকুই ছিল শরবত বানানেওয়ালার জন্য শাহি পুরস্কার। একদিন কিশোর আমার দিকে ফিরে মীর্জা বলেছিলেন, মিয়া, কী চিজ আত্মারে পাঠাইলাম, কওন যায় না! শরীরে একটা লহর খেইলা যায়! কথাটা আমার আজও মনে আছে। বহুদিন পরে ইউরোপের এক আড্ডায় ওয়াইন সম্পর্কে আমি এই একই কথা শুনেছিলাম; আর মাত্র সেদিন লন্ডনের এক চিত্রপত্রিকায় পড়লাম_ সেই একই সমাচার_ গ্যালারিতে ভালো একটা ছবির সমুখে দাঁড়ালে_ আ ভাইব্রেশন গোজ থ্রু দ্য বডি! সেই তরঙ্গ! সেই ঝিলিক! কেবল চোখে নয়, আত্মায়! মহৎ ছবি আরও কিছু করে_ আমাদের দেখার চোখটিকে চিরকালের মতো বদলে দেয়।
কী দিয়েছেন? আমার বলতে দ্বিধা নেই, কাইয়ুম তাঁর ছবির পর ছবিতে আমাদের চোখ বদলে দিয়েছেন; জগৎকে-জগৎ কেন, এই আমাদের জন্মভূমি বাংলার কথা বলি_ বাংলাকে নতুন চোখে দেখার দৃষ্টি কাইয়ুম আমাদের দিয়েছেন। আর এভাবেই তিনি বাঙালির হয়ে উঠেছেন তথা প্রকৃত এক বাঙালি চিত্রকর, প্রধানতম একজন। শব্দভাষার মতো চিত্রভাষা দেশবন্দি নয় বলেই আন্তর্জাতিক; কিন্তু এখানেই যে কথাটি মনে রাখার, বিশাল বিপুল আকাশে পল্লব মেলেও বৃক্ষ যেমন শেকড়ে স্থাপিত, বিশেষ একটা মাটি থেকেই তার উদ্গম ও উত্থান_ চিত্রকরও তেমনি, আন্তর্জাগতিকে তার অধিগম্যতা, কিন্তু আপন দেশটি নয় বিস্মৃত কিংবা চিহ্নরহিত। কাইয়ুমের ছবিতে এটি স্পষ্ট_ ছবির ছবি, কত মাধ্যমেই না তাঁর কাজ_ তেল, জল, কালি, কলম, মোমরঙ, রেশম-ছাপ, এমনকি তাঁর ব্যবহারিক শিল্পকাজগুলো_ বইয়ের প্রচ্ছদ, সড়ক বিজ্ঞাপন, নানা প্রতিষ্ঠান ও সমাবেশ সম্মেলনের জন্য আঁকা ভাবসংকেত-নক্শা_ এবং অনেক কিছুর ভেতরে বাংলা অক্ষরের রূপ_ এ ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবন বাংলালিপির হাজার বছরের ইতিহাসে অনন্য ও এখন পর্যন্ত অনতিক্রম্য; প্রতিটি কাজেই কাইয়ুম তার দৃষ্টিতে বাংলাকে রেখেছেন। তিনি বলেনও, বেশ গৌরব নিয়েই বলেন এবং এই-ই তাঁর লক্ষ্য_ বিশ্বের যেখানেই তাঁর ছবি প্রদর্শিত হোক না কেন যেন বাঙালি হাতের কাজ বলে চেনা যায়।
বাংলার নিসর্গ থেকে ঋণ করা_ জল মেঘ গাছ মানুষ মাছ রোদ্দুর, বাংলার ঐতিহ্য থেকে পাওয়া উপকরণ_ পুতুল পাটি নকশিকাঁথা শখের হাঁড়ি পোড়ামাটি, বাংলার ইতিহাস থেকে উঠে আসা মুক্তিযুদ্ধ, আর শৈশব-কৈশোরে বাংলার দিকে দিকে পিতার চাকরিসূত্রে বসবাস, বাঙালির পেশি থেকে পাওয়া বলিষ্ঠতা-কোমলতা কাঠিন্য-নমনীয়তা তুলিতে ধারণ করে বর্গাকার পটে উজ্জ্বল রঙে, সপাটে চাপানো রঙের আছাড়ে কাইয়ুম চৌধুরী যে-চিত্রমালা রচনা করেছেন, যুগ যুগ আমরা অনুভব করব আমাদের শরীরে সেই শিল্পতরঙ্গের অভিঘাত। আমরা বিমোহিত থাকবো, কাইয়ুমের রঙে ক্যানভাসে, কাইয়ুমের শিল্পে।