প্রিয় হুমায়ূন

image_1473_357321বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষমাত্রই হুমায়ূনকে কোনো না কোনোভাবে জানত, যারা শিক্ষাবঞ্চিত সেই মানুষরাও হুমায়ূনকে জেনেছে টেলিভিশনে তার নাটক দেখে, কেউ কেউ হয়তো অতিরিক্তরূপে জেনেছে তার তৈরি ফিল্ম দেখে। আমার নিজের জন্য হুমায়ূনকে একটু বিশেষভাবেই জানবার সুযোগ ঘটেছিল। কারণ সে লিখত, যেমন আমিও লিখি এবং আমরা উভয়েই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। এই দুই কারণেই তার প্রথম জীবনের এবং আমার নিজের চলাফেরাটা ছিল একই বলয়ের মধ্যে।
ওর সঙ্গে আমার উল্লেখযোগ্য অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় আমরা যখন একই সঙ্গে চীন ও উত্তর কোরিয়া ভ্রমণে যাই। ভ্রমণটি ছিল এক মাসের। বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের ভেতর হুমায়ূন ছিল, আমিও ছিলাম। দলনেতা ছিলেন প্রয়াত ফয়েজ আহমদ। অন্য চারজন সদস্য ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির। দলের ভেতর হুমায়ূন ছিল সর্বকনিষ্ঠ। থাকবার ব্যবস্থা হতো দলনেতা ফয়েজ ভাইয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র কামরা, বাকি ছয়জনের জন্য তিনটি। হুমায়ূন ও আমি একই কামরায় থাকতে পছন্দ করতাম এবং সে সময়ে তার সঙ্গে বেশ কথা হতো। হুমায়ূন স্বল্পভাষী ছিল, কিন্তু অল্প কথায় তার নানা অভিজ্ঞতা ও পেছনের জীবন সম্পর্কে তথ্য সুন্দর ও সরসভাবে বলত।
হুমায়ূনের কৌতুকবোধ ছিল খুব জীবন্ত এবং পাঠকমাত্রেই জানেন যে, সে দুঃখের কথা অনেক লিখেছে। সে সব রচনায় গভীর অনুভূতি আছে, কিন্তু আড়ম্বর নেই। তার সংলাপ বিদগ্ধ ও তীক্ষষ্ট। আর যখন সরাসরি কৌতুক নিয়ে লিখত তখন তো কথাই নেই, পাঠকের পক্ষে হাস্যসম্বরণ কঠিন হতো। তার শালীনতাবোধ ও পিরিমিতিবোধ পরস্পর থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। তার রচনা সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের কাছে অমনভাবে গৃহীত হয়েছে। তার বই মা পড়েন, ছেলে পড়েন, বাবা এবং বোনও বাদ যান না। হুমায়ূনের টেলিভিশন নাটক গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে উপভোগ করতে পারেন। কোনো অস্বস্তির সৃষ্টি হয় না।
হুমায়ূনের স্মৃতিশক্তিও ছিল খুব শক্তিশালী। ঘটনার তাৎপর্য তো বটেই, ঘটনাও সে পরিষ্কারভাবে মনে রাখত। যে কোনো কথাশিল্পীর জন্যই এটা একটা বড় গুণ, হুমায়ূন বলত এবং আমরাও নিশ্চয়ই স্বীকার করব। প্রথম যখন আমেরিকায় যায় তখনকার স্মৃতি খুবই উজ্জ্বল ছিল তার কাছে। এমনিতেই সে লাজুক স্বভাবের, তার ওপর গিয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, বয়স অল্প, অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই। একটি ঘটনা তার খুবই মনে ছিল। আমেরিকায় গিয়ে পেঁৗছবার পর প্রথম কয়েকদিন সকালে সে খেতে যেত একটি রেস্টুরেন্টে। খাবার অপরিচিত, দাম অজ্ঞাত। তাই রোজই সে এগ-অন-টোস্ট খেত। টোস্ট করা রুটির ওপর ডিম। ক’দিন দেখে রেস্টুরেন্টের মালিক পাত্রে করে অন্য একটি খাবার এনে তার টেবিলে রেখে বলছে, ‘এটি রেস্টুরেন্টের পক্ষ থেকে আপনাকে উপহার। এর জন্য কোনো দাম দিতে হবে না।’ হুমায়ূনের ধারণা, লোকটির মায়া হয়েছিল। ছেলেটি, যাকে শিক্ষিত বলেই মনে হয়, সে রোজই এক ও সামান্য একটি খাবার খাচ্ছে দেখে ধারণা হয়েছিল যে, ছেলেটি অর্থকষ্টে আছে। অথবা হুমায়ূন যোগ করেছিল, একই খাবার রোজ রোজ দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে গেছে। শুনে আমি হেসেছি। হুমায়ূন তেমনভাবে হাসেনি, কেবল প্রসন্ন একটি কৌতুকের রেখা তার মুখে খেলা করেছিল। যে রেখা ততদিনে আমার বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। তার নির্মল পরিহাসের পাত্র তালিকা থেকে নিজেকে যে সে সরিয়ে রেখেছিল তা নয়।
হুমায়ূন যে অনেক বই পড়ত সেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না। নানা বিষয়ে তার আগ্রহের কথা জেনেছি। প্রধান আগ্রহটা অবশ্য ছিল সাহিত্য বিষয়েই। চীন যাত্রায় আমরা রওনা হয়েছিলাম আমাদের বাসা থেকেই। আমরা তখন থাকতাম শহীদ মিনারের উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়ির একতলায়। হুমায়ূন থাকত আজিমপুরে। মনে পড়ে সকালে সে আমাদের বাসায় চলে এসেছিল এবং আমরা বিমানবন্দরে গেছি একই সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাড়ায় নেওয়া একটি গাড়িতে। যাওয়ার সময় সে আমাকে বলেছিল, ‘চীন সম্পর্কে আপনার তো অন্যরকম আগ্রহ, আপনি সেখানকার সামাজিক পরিবর্তন দেখবেন, আমার আগ্রহ সাহিত্যে। সেদিক থেকে আমি খুশি হতাম রাশিয়াতে যেতে পারলে।’ দেখলাম চীনের সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ে বেশকিছু বই সে পড়ে গিয়েছে এবং প্রস্তুত হয়েই যাচ্ছে সে চীন ভ্রমণে।
কোরিয়াতে থাকার সময় হুমায়ূন তার নিজের পিতার মৃত্যুর ঘটনাটা বলেছিল। একাত্তরে তিনি শহীদ হয়েছেন। বিস্তারিত বলেনি। বিস্তারিত সে বলত না। সেই দুঃসময় যাঁরা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন সে প্রসঙ্গও এসেছে। একজনের কথা মনে পড়ে, হুমায়ূনের চেয়ে এক-দু’বছর ওপরের ক্লাসে পড়ত, নাম আনিস সাবেত। একই আবাসিক হলে থাকত, খুব ভালো ছাত্র, হুমায়ূনকে স্নেহ করত। অমন ভালো মানুষ হুমায়ূন কম দেখেছে বলে জানিয়েছে। হুমায়ূনের প্রয়োজন কথাটা তার জানা ছিল। এক সন্ধ্যায় অনেকগুলো নতুন শার্ট এনে হুমায়ূনের বিছানায় হইচই করে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘দেখো তো কী মুশকিল, এতগুলো জামা পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে, কিন্তু কোনোটাই আমার গায়ে ঠিক লাগছে না। দেখো তো তোমার গায়ে লাগে কি-না।’ বলে সবগুলো শার্ট রেখে আনিস সাবেত চলে গেছে। হুমায়ূন বলেছে, ‘আমার তো জানতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে, জামাগুলো আমেরিকা থেকে আসেনি, ঢাকা থেকেই কেনা হয়েছে, আমার প্রয়োজনের কথা মনে রেখে।’ কিন্তু ওই যে ছলনা, ওইখানেই ছিল আনিস সাবেতের মহত্ত্ব। দুঃখ করে বলেছে হুমায়ূন, আনিস আমেরিকা গিয়েছিলেন, ফেরত আসতে পারেননি, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তখন কে জানত যে, ওই একই রোগে হুমায়ূনকেও একদিন চলে যেতে হবে। এসব কথা যখন হচ্ছিল তখন আমারও কি জানার কোনো কারণ ছিল যে, এই আলোচনার কয়েক বছরের মধ্যেই আমার স্ত্রী নাজমাকেও চলে যেতে হবে ওই একই মরণব্যাধির আক্রমণে।
হুমায়ূনের সঙ্গে শেষ দেখা তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে। চিকিৎসার ফাঁকে তখন সে ঢাকায়। ব্যবস্থা করে দিয়েছিল মাজহারুল ইসলাম। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জাহেদা আহমদ, অধ্যাপক আহমেদ কামাল ও আমি, এই তিনজন একদিন দুপুরে অল্পক্ষণের জন্য তার ওখানে গিয়েছিলাম, ধানমণ্ডিতে। অনেক বছর পর দেখা। দেখি কথাবার্তায় আগের মতোই আছে। ক্যান্সারের কথা বলল, সে রোগে কী কঠিন বেদনা, কেমোথেরাপিতে কী কষ্ট অল্পকথায় উল্লেখ করল সে। যখন বলছিল তখন মুখের দিকে আমি তাকাতে পারিনি, পাছে রোগের ব্যথায় কাতর হুমায়ূনের মুখে নাজমার মুখটি দেখতে হয়, সেও আমেরিকায় গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। ফিরে এসেছিল, কেমোথেরাপি নিয়েছিল, কিন্তু নিরাময় হতে পারেনি। হুমায়ূন নিরাময় হবে এটা আমরা আশা করেছিলাম, কেননা ২৫ বছরের ব্যবধানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে এবং তার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিতে ভালো ফল পাওয়া গেছে, যা সে নিজেই বলেছিল আমাদের। অপারেশন করা হবে, তাতে ক্ষতস্থানগুলো ফেলে দেওয়া হবে, এরপর আর বিপদ ঘটবে না। নাজমার ক্ষেত্রে অপারেশন সম্ভব হয়নি, ক্যান্সার তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
বের হয়ে আসার সময় বারান্দায় দেখি সাদা-কালোতে একটা ছবি। মাজহারের স্ত্রী বলল ছবিটা হুমায়ূন ভাইয়ের আঁকা। হুমায়ূন বলল, দৃশ্যটা নেপালের। ছবি দেখে আরেকটি ছবির কথা মনে পড়ল আমার। ছোট্ট ছবি, একটি চায়ের কাপের। সেটিও হুমায়ূনেরই আঁকা। আমরা তখন চীনে; এক বিকেলে চা পানের ইচ্ছা হয়েছে; চা তো চীনারা পানির মতোই পান করে, কিন্তু পরিচারিকাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না যে, আমরা চায়ের প্রার্থী। হুমায়ূন তখন চট করে একটা কাগজ নিয়ে পকেট থেকে কলম বের করে চায়ের একটি কাপ এঁকে দিল, অতি দ্রুতবেগে। তারপর কয়েকটি টানে দেখিয়ে দিল কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। আমরা কাপ চাই না, চা চাই, এটা বুঝে পরিচারিকাটি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন গরম চা সংগ্রহ করতে। ছবি আঁকায় হুমায়ূনের দক্ষতার একটা ইশারা সেদিন পাওয়া গিয়েছিল। পরে দেখি সে অসুস্থ অবস্থায় অনেকগুলো ছবি এঁকেছে। ওই প্রতিভাটিও তার ভেতর ছিল। ছিল যে তার প্রমাণ তো আমরা তার গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র সবখানেই দেখতে পাই। অল্পকথায়, ছোট ছোট সংলাপে, ইশারায় সে ছবি এঁকেছে। তার গল্পতে আমরা একের পর এক ছবি দেখতে পাই; সেটি একটি কারণ যে জন্য তার সৃষ্টিকর্মে অতটা জনপ্রিয় হয়েছে।
হুমায়ূন বিজ্ঞানের ছাত্র। তার লেখায় বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখি। কিন্তু সঙ্গে থাকে কল্পনার অসাধারণ শক্তি। সে কল্পনা করে এবং তার কল্পনার কথা অন্যদের জানানোতে আনন্দ পায়। তার প্রথম দিককার একটি উপন্যাস ফেরা, সেটি নিয়ে ছোট একটি আলোচনা করেছিলাম আমি সেই ১৯৮৪ সালে, সাহিত্যপত্র পত্রিকাটিতে। পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর; পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে সমালোচনাটি ছিল। উপন্যাসটির পটভূমি গ্রামের। বিস্তৃত বর্ণনা দেয়নি, কিন্তু অল্পকথায় হুমায়ূন তাতে গ্রামের জীবনে প্রবহমান টানাপড়েন সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিল। সে বিষয়ে আমার মন্তব্য ছিল। হুমায়ূন পড়ে খুশি হয়েছে। কিন্তু চমকে দিয়েছে আরেকটা কথা বলে। বলেছে, সে মামলা করবে। আমি বলেছি হুমায়ূন গ্রামকে চেনে, অন্য একজন নাকি বলেছেন, গ্রাম বিষয়ে সে অজ্ঞ। এখন কোনটা সত্য, এটা মীমাংসা করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। কথাটা সে হুমায়ুন আজাদকে বলেছিল, দু’জনের তখন খুবই বন্ধুত্ব এবং হুমায়ূন আজাদ সেটা আমাকে জানিয়েছে হুমায়ূন আহমেদ এবং আরও কয়েকজনের সামনে। আমরা সবাই হেসেছি। হুমায়ূন আহমেদও হেসেছে হালকা করে। কিন্তু ওই বৈশিষ্ট্যটা তো ছিল তার স্বভাবজাত, চমকে দিতে পারত এবং এসব চিন্তা নিয়ে আসত অন্যরা যা ভাবতেও পারত না।
চীন থেকে ফেরার পর হুমায়ূনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এতটা কাছাকাছি চলে এসেছিল যে, আমরা উভয়েই, একে অপরকে না জানিয়ে পরস্পরকে নিজের লেখা বই উৎসর্গ করেছিলাম, প্রায় একই সময়। কিন্তু সে যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেল তারপর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে খুবই কম। শেষ দেখার আগে একবার দেখা হয়েছিল ওর একটি চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, কেবল সেটির কথাই মনে পড়ে।
হুমায়ূনের মেধা ছিল অসামান্য, কর্মশক্তি অসাধারণ। কাজে তার বিরতি ছিল না। এত অল্প সময়ে এমন বিপুল সৃষ্টিসম্ভার ক’জন রেখে যেতে পেরেছেন? শেষ সাক্ষাতেও মনে হয়েছিল সে আরও অনেক কাজ করবে। সে অগ্রগমনটা থেমে গেল। সান্ত্বনা এই যে, যা সে রেখে গেছে তার মূল্য কম নয়, অনেক। তাকে ভুলবার কোনো উপায় নেই।