স্রোতের মোহনায়

কপোতাক্ষ মাহমুদার প্রিয় নদ। গাঁয়ের চারদিকে কত কিছু আছে, তার মধ্যে নদী কেন প্রিয়—এ নিয়ে নিজেকে কোনো দিন প্রশ্ন করেনি ও। নিজের ভালো লাগাই প্রধান হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় নদী ওকে স্রোতে ভাসিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যায়। এই যাওয়া এক গভীর আনন্দ।

কোনো খুশির খবর হলে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ছুটে আসে, দুঃখের খবর হলেও। নদীর সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে। ভাবে, নদী ওর সব কথা শুনতে পায়। নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসলে সেই ভাবনা আরও বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে গড়গড়িয়ে কথা বলে। মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে বলে, ‘শুনতে ভালো লাগেছে রে কপোতা? আমি গান গাইতে পারি না কিন্তু তোর কাছে এলে আমার গানের গলা খুলে যায়।’ নদীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ও নির্জন জায়গা বেছে নেয়। যেখানে নদীর পাড় বুনো ফুলে ভরে থাকে। বুলবুলি উড়ে এসে বসে কাছাকাছি কোনো ডালে। ঘাসের ওপর বসে কখনো পা ছড়িয়ে দেয়, কখনো গুটিয়ে রাখে। ভেবে নেয়, স্বপ্ন দেখার সময় এখন। স্বপ্নের ভেতর গুটিয়ে থাকবে কপোতাক্ষ নদের বয়ে যাওয়ার গুনগুন ধ্বনি। মাহমুদা নিজের ভেতর নদীর টান অনুভব করে। মনে করে নিজের ভেতরে বয়ে যায় নদী। ওকে নিয়ে যায় বড় কোনো ঠিকানায়।

এর মধ্যে ওর ভাই ফখরুল নিজে নিজেই বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসে। মা ভাবে, বিয়ে হয়েছে ভালো হয়েছে। ওরা দুজনেই সংসারটা দেখুক। নতুন ভাবি পেয়ে ওরা তিন বোনও খুশি হয়েছিল। বউয়ের নাম আয়েশা। বাবার এক মেয়ে। আদর–যত্নে বড় হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে এসে শাশুড়ি-ননদের ঝামেলা দেখে সাত দিনের মাথায়ই ওর মেজাজ বিগড়ে যায়। বলে, এত ঝামেলা আমি সহ্য করতে পারব না। বাপের বাড়িতে আমি কুটোটি নাড়িনি। মা আমাকে কিচ্ছু করতে দিত না।

‘ঠিক আছে বউমা, আমরা তোমাকে কিছু করতে দেব না। তুমি হেসেখেলে ঘুরেফিরে থাকো।’

‘তাহলে তো সংসার আমার থাকবে না।’

‘সে আবার কী কথা বউ। সংসার তোমার আর তোমার স্বামীর। আমরা তো ঠেকে তোমাদের সঙ্গে আছি।’

‘আপনারা তো আলাদা থাকতে পারেন। আমার সংসার নাহয় আমিই করি।’

মাহমুদা রেগে বলে, ‘ভাবি আমরা কি তোমার বোঝা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বোঝা।’ আয়েশা রাগ সামলায় না।

মাহমুদার বড় খোদেজা বলে, ‘বাড়িটা তো আমার বাবার। আমরা বাড়ি থেকে বের হব কেন? গেলে আপনি আর ভাইজান যান।’

‘কী, ছোট মুখে বড় কথা। আসুক, তোমার ভাই। দেখে নেব।’

‘দেখে নিয়ো। বেশি আর কী করবে, না হয় জবাই করবে। করো জবাই। কল্লা কেটে ফেলে দাও।’

ওদের মা মেয়েদের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। বাড়ির বাতাস গুমোট হয়ে থাকে। আয়েশা দুপদাপ পা ফেলে তোলপাড় করে নানা জিনিস। রান্নাঘরের আগুন নিভে যায়। ভাত আর ফোটে না।

দুদিন পর পরীক্ষা শেষ হলে দুটো পোঁটলা নিয়ে মা-মেয়ে দুজনে পথে নামে। মাহমুদার চাচা সোহরাবের বাড়িতে যায় দুজনে। চাচি মারা গেছে, চাচার ছেলেমেয়ে নেই। ছন্নছাড়া জীবন তার। ওদের দেখে বলে, ‘এই বিরান সংসারে তোমরা কেন এসেছ? কী চাও?’

মাহমুদা বলে, ‘আমরা আপনার কাছে থাকতে এসেছি, চাচা। আমাদের থাকার জায়গা দেন।’

চাচা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভাবি বুঝি ছেলে আর ছেলের বউয়ের সঙ্গে টিকতে পারলেন না?’

মাহমুদার মা চুপ করে থাকে। মাহমুদা বলে, ‘আপনি তো সব জানেন, চাচা।’

‘হ্যাঁ, জানি তো। তোদের কপাল মন্দ আর কী!’

মাহমুদার মা ভীরু কণ্ঠে বলে, ‘আমাদেরকে দয়া করেন সোহরাব ভাই।’

শুরু হয় মা-মেয়ের নতুন জীবন। অন্যের সংসারে কুঁকড়ে থাকা।

দুই.

চাচারা মাহমুদার বিয়ে ঠিক করে।

অতঃপর মাহমুদার বিয়ে হয়ে যায়।

অতঃপর মাহমুদা স্বামী পায়।

অতঃপর মাহমুদার শ্বশুরবাড়ি হয়।

কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মাহমুদার বুক ভেঙে যায়। স্বামী একদমই গণ্ডমূর্খ। লেখাপড়াই শিখেনি। কোনো দিন স্কুলেও যায়নি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মাহমুদার এসব মানিয়ে নিতে খুবই কষ্ট হয়। শ্বশুরবাড়িতে অভাবের শেষ নেই। খুবই গরিব ওরা। স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় মাহমুদার। ওর চোখের জল ফুরোয় না। সারাক্ষণ কাঁদে।

মাহমুদার স্বামী দুলাল বলে, ‘তোমার কী হয়েছে বউ? কাঁদো কেন?’

ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আমি মায়ের কাছে যাব।’

‘আচ্ছা, আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাব। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বউ। আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’

মাহমুদা কথা বলে না। কাঁদতে থাকে।

দুলাল ওর দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি?’

দুলালের মিনতিভরা দৃষ্টি ওকে ভালোবাসার ছোঁয়া দেয়। ও আস্তে করে বলে, ‘হয়েছে।’

‘সত্যি? সত্যি বলো।’

‘তিন সত্যি।’

মাহমুদার মনে হয় দুলালের মায়াভরা কণ্ঠে জাদু আছে। ভালো স্বামীই হবে। কিন্তু পড়ালেখা না–জানা একটি লোকের সঙ্গে কি ঘর করা যায়? এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

মাহমুদা জানে নদীর বয়ে যাওয়ার ধ্বনি ওকে শান্ত করে না। ওর মনে হয়, নদীটা মরে গেছে। কোথাও যেন আটকে গেছে স্রোত। ওর মন খারাপ হয়। ঘাসের ওপর বসে থাকার ইচ্ছা হয় না। কেবলই মনে হয় নদীর কাছ থেকে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। ও আর কোনো দিন বাবার জন্য ফুল ভাসাতে পারবে না। ও কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে। ফিরতে ফিরতে কোঁচড় ভরে বুনো ফুল তোলে। ফুলের পাপড়ি চারদিকে ছড়াতে ছড়াতে বলে, ‘বাতাস, ফুলের গন্ধ বাবার কাছে নিয়ে যাও। আমার কপোতার স্রোত ফুরিয়েছে। কপোতাকে নষ্ট করেছে লোকেরা। ভরাট হয়ে গেছে কপোতার কত অংশ।’ মাহমুদা নিজের ভাগ্যের দিকে তাকায়। ভাবে, এমন ভাগ্য নিয়ে দিন চালানো কঠিন। দুলালের লেখাপড়া হয়নি—এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয় ওর। বেঁচে থাকার সাধ ফুরিয়ে যায়। বিয়েটাকে বিয়ে বলে মানতে ইচ্ছা করে না। তারপরও চারদিকে তাকিয়ে দমে যায়।

মা বলে, ‘কাঁদবি না। দুলাল পড়ালেখা না জানলে কী হবে ওকে আমার ভালো ছেলে মনে হয়েছে, মা।’

মাহমুদার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় ওর বাড়ি থেকে আসার সময় দুলালের চোখে পানি ছিল। জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘তুমি না থাকলে বাড়িটা আমার খালি মনে হয়।’

ওকে দুবার নিতে এসেছিল দুলাল। ও যায়নি। বলেছে, ‘মাকে একা রেখে যাব না।’

দুলাল সেদিন কিছু বলেনি। নীরবে চলে গেছে। জোর করেনি। হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলেনি, ‘তোকে আমার সঙ্গেই যেতে হবে। নইলে তোর মুখ আর দেখব না।’

দুলালের এমন শান্ত আচরণ সেদিন ওকে ভালো লাগার টান দিয়েছিল। এখন ভাবে, ভালো মানুষই সংসারের জন্য দরকার। দুজনে মিলে সংসার গড়বে। না জানুক লেখাপড়া, মানুষটাই আসল।

মাহমুদা ফিরে আসে পুটিয়াখালী গ্রামে। এই গ্রামে আসার পরে দেখেছে কপোতাক্ষ নদের ওপরে মানুষের ঘটানো দুর্যোগ। কতভাবে নদী দখলের চেষ্টা হয়েছে। মানুষের দস্যুতার শিকার হয়ে থুবড়ে পড়েছে কপোতাক্ষের স্রোত। হায় নদী, মাহমুদা নিজের কপাল চাপড়ায়। কপোতাক্ষ নদ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বছরের পাঁচ-ছয় মাস এই গ্রামে পানি আটকে থাকে। এটা ও প্রথমবার এসেই জেনে গেছে। কপোতাক্ষ নদের যে স্রোতটুকু ও দেখে, যার সঙ্গে ওর গভীর হৃদ্যতা, সেটুকুই এ নদীর সব নয়। নদীর ভরাট হওয়ার ফলে যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, সে দুর্ভোগ ও এখানে এসে দেখেছে। ওর শ্বশুরবাড়িসহ দশ-পনেরোটি ঘরের ভিটা উঁচু বলে পানিতে ডোবে না। বাকি আরও এক শ পরিবার এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে। এ সময় দুলালের এক টুকরো জমি পানির নিচে থাকে। বড় কষ্ট তখন। শামুক খুঁজে বিক্রি করে, শাপলা–শাক তুলে আনে রান্নার জন্য, কচু-ঘেঁচু তো আছেই। মাছ ধরে দুলাল। কোনোরকমে দিন কাটে মাহমুদার। এর মধ্যে কোলে বাচ্চা আসে। শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর শৈশব-কৈশোরের কপোতাক্ষের পুরোনো চেহারা নিয়ে নতুন ভাবনায় জড়িয়ে ফেলে নিজেকে। ভাবে, আটকে থাকা কপোতাক্ষকে জয় করতে হবে। বলতে হবে, বাবার জন্য ফুল ভাসাতে পারছি না। কিন্তু আমার এই মানিকের জন্য জমে থাকা পানিকে আমি জয় করব কপোতা। আমি ঠিকই পারব। আমি তো হেরে গিয়ে গুটিয়ে থাকার মেয়ে না। তুই তো আমাকে ভালো চিনিস কপোতা। তোকে সঙ্গে নিয়েই তো আমি বড় হয়েছি রে। মাহমুদা ছেলেকে বুকে নিয়ে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দেয়। খিলখিলিয়ে হাসে ছেলে। মাহমুদা বুঝে যায়, জীবনের এ এক বড় পাওয়া। তোলপাড় ওঠে মাথায়। স্রোতের মতো গড়ায় শরীরের সবখানে। উচ্ছ্বাসে বলতে থাকে, ‘বাবা সোনা, আমার বাবা সোনা।’

এমন চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধারা গোছায় মাহমুদা। বাচ্চাকে শাশুড়ির কাছে রেখে শুরু হয় ওর কাজের জীবন। গ্রামের ফসল প্রকল্পের সদস্য হয়। ওদের কাছে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে শ্যাওলা থেকে জৈব সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। পানিতে ভাসমান সবজি চাষ করতে শেখে। বিলে ঘের দিয়ে মাছ চাষ করার নিয়মটা শিখে নেয়। মাঝে মাঝে নিজের একান্ত সময়ে বলে, কপোতা, তোর স্রোতে আমি বাবার জন্য ফুল ভাসাতে পারি না। এখন তোর পানি আমাকে ভাত খাওয়ায়। তোর পানিতে সাঁতার কেটে আমার ছেলে বড় হবে। ও নদীকে ভালোবাসতে শিখবে। দুষ্ট লোকের মতো নদী ভরাট করে জমি বানাবে না। কপোতা, তোর বেঁধে রাখা স্রোত আমার বেঁচে থাকার সাধ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আর দুঃখ থাকবে না।

দুলাল দেখতে পায় নদীর ভরাট পানিতে নানা কাজ করে সংসারের অভাব তাড়িয়েছে মাহমুদা। দুলালের মা–ও ওর কাজে খুবই খুশি। গ্রামের লোককে বলে, ‘আমার বউটা একটা কাজের মেয়ে।’ দুলাল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ‘তুমি এত কিছু শিখে রোজগার করছ। আমাদের ঘরের অভাব তাড়িয়েছ। বউ তুমি আমার ঘরের জ্যোৎস্না। তুমি এত কিছু না শিখলে আমি তো এই মাঠঘাটের পানির মধ্যে ডুবে থাকতাম। একদিন দেখতে আমি পানির নিচে ডুবে মরে আছি।’

‘ধ্যাৎ কী যে বলো না। শোনো, ছোটবেলায় কপোতাক্ষ আমার সুখ-দুঃখের সাথি ছিল। পুটিয়াখালীতে এসে দেখলাম কপোতাক্ষ অন্য রকম। পানির ঘেরে আটকে গেছে। এই কপোতাক্ষকে আমার নদী করার জন্য এত কিছু শিখেছি। দুষ্টু লোকের হাতে বন্দী হওয়া কপোতাক্ষকে আমি ভুলে যেতে চাইনি। নদী এখন থেকে আমার কাছে তোমার ভালোবাসা।’

‘তুমি আমার কপোতাক্ষ। আমার নদী। তোমার স্রোতে এখন আমার সুখের সংসার। আমরা দুজনে স্রোতের মোহনায় ঘর বেঁধেছি। বড় হয়ে আমাদের ছেলেও ঘর বাঁধবে।’

মাহমুদার স্বপ্ন দুলালকে প্রবলভাবে তাড়িত করে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে মাহমুদাকে। বলে, ‘আমাদের বুকের মানিক কপোতাক্ষ নদে পঙ্খিরাজ ভাসাবে গো—।’

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন