রাশিয়ার চিঠি -২

মস্কৌ
স্খান রাশিয়া। দৃশ্য‚ মস্কৌয়ের উপনগরীতে একটি প্রাসাদভবন। জানালার ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখি‚ দিক্প্রান্ত পর্যন্ত অরণ্যভূমি‚ সবুজ রঙের ঢেউ উঠেছে– ঘন সবুজ‚ ফিকে সবুজ‚ বেগনির সঙ্গে মেশামেশি সবুজ‚ হলদের-আমেজ-দেওয়া সবুজ। বনের শেষসীমায় বহু দূরে গ্রামের কুটিরশ্রেণী। বেলা প্রায় দশটা‚ আকাশে স্তরে স্তরে মেঘ করছে‚ অবৃষ্টি সংরম্ভ সমারোহ‚ বাতাসে ঋজুকায়া পপ্লার গাছের শিখরগুলি দোদুল্যমান।
মস্কৌয়েতে কয়দিন যে হোটেলে ছিলুম তার নাম গ্র্যান্ড্ হোটেল। বাড়িটা মস্ত‚ কিন্ত অবস্খা অতি দরিদ্র । যেন ধনীর ছেলে দেউলে হয়ে গেছে। সাবেক কালের সাজ সজ্জা কতক গেছে বিকিয়ে‚ কতক গেছে ছিঁড়ে; তালি দেওয়ারও সঙ্গতি নেই; ময়লা হয়ে আছে‚ ধোবার বাড়ির সম্পর্ক বন্ধ। সমস্ত শহরেরই অবস্থা এইরকম– একান্ত অপরিচ্ছন্নতার ভিতর দিয়েও নবাবী আমলের চেহারা দেখা যাচ্ছে‚ যেন ছেঁড়া জামাতেও সোনার বোতাম লাগানো‚ যেন ঢাকাই ধুতি রিফু-করা। আহারে ব্যবহারে এমন সর্বব্যাপী নির্ধনতা য়ুরোপের আর কোথাও দেখা যায় না। তার প্রধান কারণ‚ আর-আর সব জায়গায় ধনী দরিদ্রের প্রভেদ থাকাতে ধনের পুঞ্জীভূত রূপ সব চেয়ে বড়ো করে চোখে পড়ে– সেখানে দারিদ্র্য থাকে যবনিকার আড়ালে নেপথ্যে; সেই নেপথ্যে সব এলোমেলো‚ নোংরা‚ অস্বাস্খ্যকর‚ দু:খের দুর্দশায় দস্কর্মের নিবিড় অন্ধকার। কিন্তু বাইরে থেকে গিয়ে আমরা যেখানে বাসা পাই সেখানকার জানালা দিয়ে যা-কিছু দেখতে পাই সমস্তই সুভদ্র‚ শোভন‚ সুপরিপুষ্ট। এই সমৃদ্ধি যদি সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেত তা হলে তখনই ধরা পড়ত‚ দেশের ধন এত কিছু বেশি নয় যাতে সকলেরই ভাত কাপড় যথেষ্ট পরিমাণে জোটে। এখানে ভেদ নেই বলেই ধনের চেহারা গেছে ঘুচে; দৈন্যেরও কুশ্রীতা নেই‚ আছে অকি—নতা। দেশ-জোড়া এই অধন আর কোথাও দেখি নি বলেই প্রথমে এটা আমাদের খুব চোখে পড়ে। অন্য দেশে যাদের আমরা জনসাধারণ বলি এখানে তারাই একমাত্র।
মস্কৌয়ের রাস্তা দিয়ে নানা লোক চলেছে। কেউ ফিটফাট নয়‚ দেখলেই বোঝা যায় অবকাশভোগীর দল একেবারে অন্তর্ধান করেছে। সকলকেই স্বহস্তে কাজকর্ম করে দিনপাত করতে হয়‚ বাবুগিরির পালিশ কোনো জায়গাতেই নেই। ডাক্তার পেটেন্সাভ বলে এক ভদ্রলোকের বাড়ি যেতে হয়েছিল‚ তিনি এখানকার সম্মানী লোক‚ উচ্চপদস্খ কর্মচারী। যে বাড়িতে তার আপিস সেটা সেকালের একজন বড়োলোকের বাড়ি। কিন্তু ঘরে আসবাব অতি সামান্য‚ পারিপাট্যের কোনো লক্ষণ নেই; নিüকার্পেট মেঝের এক কোণে যেমন-তেমন একখানা টেবিল; সবসুদ্ধ‚ পিতৃবিয়োগে ধোবা-নাপিত-বর্জিত অশৌচদশার মতো শয্যাসনশূন্য ভাব‚ যেন বাইরের লোকের কাছে সামাজিকতা রক্ষার কোন দায় নেই। আমার বাসায় আহারাদির যে ব্যবস্খা তা গ্র্যান্ড্ হোটেল নামধারী পান্থবাসের পক্ষে নিতান্তই অসংগত। কিন্ত এজন্যে কোনো কুণ্ঠা নেই‚ কেননা সকলেরই এক দশা।
আমাদের বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। তখনকার জীবনযাত্রা ও তার আয়োজন এখনকার তুলনায় কতই অকিঞ্চতকর‚ কিন্ত সেজন্য আমাদের কারও মনে কিছুমাত্রা সংকোচ ছিল না। তার কারণ‚ তখনকার সংসারযাত্রার আদর্শে অত্যন্ত বেশি উঁচুনিচু ছিল না। সকলেরই ঘরে একটা মোটামুটি রকমের চালচলন ছিল; তফাত যা ছিল তা বৈদগ্ধ্যের‚ অর্থাৎ গানবাজনা পড়াশুনো ইত্যাদি নিয়ে। তা ছাড়া ছিল কৌলিক রীতির পার্থক্য‚ অর্থাৎ ভাষা ভাবভঙ্গী আচার বিচার -গত বিশেষত্ব । কিন্তু তখন আমাদের আহার বিহার ও সকল -প্রকার উপকরণ যা ছিল তা দেখলে এখনকার মধ্যবিত্ত লোকদের মনেও অবজ্ঞা জাগতে পারত।
ধনগত বৈষম্যের বড়াই আমাদের দেশে এসেছে পশ্চিম মহাদেশ থেকে। এক সময়ে আমাদের দেশে যখন হাল আমলের আপিসবিহারী ও ব্যবসাদারদের ঘরে নতুন টাকার আমদানি হল তখন তারা বিলিতি বাবুগিরির চলন শুরু করে দিল। তখন থেকে আসবাবের মাপেই ভদ্রতার পরিমাপ আরম্ভ হয়েছে। তাই আমাদের দেশেও আজকাল কুলশীল রীতিনীতি বুদ্ধিবিদ্যা সমস্ত ছাপিয়ে চোখে পড়ে ধনের বিশিষ্টতা। এই বিশিষ্টতার গৌরবই মানুষের পক্ষে সব চেয়ে অগৌরব। এরই ইতরতা যাতে মঙঊার মধ্যে প্রবেশ না করে সেজন্যে বিশেষ সাবধান হওয়া উচিত।
এখানে এসে সব চেয়ে যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে‚ এই ধন গরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভুষো সকলেই আজ অসমôানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে‚ এইটে দেখে আমি যেমন বিসিôত তেমনি আনন্দিত হয়েছি। মানুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে। অনেক কথা বলবার আছে‚ বলবার চেষ্টা করব; কিন্তু এই মুহূর্তে আপাতত বিশ্রাম করার দরকার হয়েছে। অতএব জানালার সামনে লম্বা কেদারার উপর হেলান দিয়ে বসব‚ পায়ের উপর একটা কম্বল টেনে দেব– তার পর চোখ যদি বুজে আসতে চায় জোর করে টেনে রাখতে চেষ্টা করব না।
ইতি ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩০