রাশিয়ার চিঠি -১

মস্কৌ

রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখেছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।
চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক‚ তাদেরই সংখ্যা বেশি‚ তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে‚ কম প’রে কম শিখে‚ বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম‚ সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসসন্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে‚ উপোসে মরে‚ উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে– জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত । তারা। সভ্যতার পিলসুজ‚ মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে– উপরের সবাই আলো পায়‚ তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে। আমি অনেকদিন এদের কথা ভেবেছি‚ মনে হয়েছে এর কোনো উপায় নেই। একদল তলায় না থাকলে আর-একদল উপরে থাকতেই পারে না‚ অথচ উপরে থাকার দরকার আছে। উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না। কেবলমাত্র জীবিকানির্বাহ করার জন্য তো মানুষের মনুষ্যতা নয়। একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা। সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে আকাশ রক্ষা করার দরকার আছে। তাই ভাবতুম‚ যে-সব মানুষ শুধু অবস্খার গতিকে নয়‚ শরীরের গতিকে নীচের তলায় কাজ করতে বাধ্য এবং সেই কাজেরই যোগ্য‚ যথাসম্ভব তাদের শিক্ষাস্বাস্খ্য-সুখসুবিধার জন্যে চেষ্টা করা উচিত।
মুশকিল এই‚ দয়া করে কোনো স্খায়ী জিনিস করা চলে না; বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে। সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয়। যাই হোক‚ আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাই নি‚ অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে‚ অমানুষ করে রেখে‚ তবেই সভ্যতা সমুচ্চে থাকবে এ কথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে। ভেবে দেখো-না‚ নিরন্ন ভারতবর্ষের অন্নে ইংলন্ড পরিপুষ্ট হয়েছে। ইংলন্ডের অনেক লোকেরই মনের ভাব এই যে‚ ইংলন্ডকে চিরদিন পোষণ করাই ভারতবর্ষের সার্থকতা। ইংলন্ড বড়ো হয়ে উঠে মানবসমাজে বড়ো কাজ হয়েছে‚ অতএব এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে চিরকালের মতো একটা জাতিকে দাসত্বে বদ্ধ করে রেখে দিলে দোষ নেই। এই জাতি যদি কম খায়‚ কম পরে‚ তাতে কী যায় আসে– তবুও দয়া করে তাদের অবস্খার কিছু উন্নতি করা উচিত‚ এমন কথা তাদের মনে জাগে। কিন্ত একশো বছর হয়ে গেল; না পেলুম শিক্ষা‚ না পেলুম স্বাস্খ্য‚ না পেলুম সম্পদ।
প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করার সময় হয় নি‚ কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত । এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিসিôত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়‚ তার সম্পূর্ণতায়‚ তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নি:সহায় ও নিস্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়- – মধ্য এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলছে; সায়ন্সের শেষ– ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়‚ কিন্তু যারা দেখেছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি। এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ। আমাদের দেশের জনসাধারণের তো কথাই নেই‚ ইংলন্ডের মজুর-শ্রেণীর সঙ্গে তুলনা করলে আকাশপাতাল তফাত দেখা যায়। আমরা
শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তা হলে ভারি উপকার হত। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি‚ কী হয়েছে আর কী হতে পারত। আমার আমেরিকান সঙ্গী ডাক্তার হ্যারি টির্ম্বস্ এখানকার স্বাস্খ্য বিধানের ব্যবস্খা আলোচনা করছে– তার প্রকৃষ্টতা দেখলে চমক লাগে– আর কোথায় পড়ে আছে রোগতপ্ত অভুক্ত হতভাগ্য নিরুপায় ভারতবর্ষ! কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্খার সঙ্গে এদের জনসাধারণের অবস্খার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল– এই অল্পকালের মধ্যে অদ্ভুত বেগে বদলে গেছে– আমরা পড়ে আছি জড়তার পাঁকের মধ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন। এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে‚ শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে– কিন্ত ছাঁচ-ঢালা মানুষ্যত্ব কখনো টেকে না–সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার‚ নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে‚ কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে। এখানকার ছেলেদের মধ্যে বিভাগ করে কর্মের ভার দেওয়া হয়েছে দেখলুম‚ ওদের আবাসের ব্যবস্খা সম্বন্ধে একদল স্বাস্খ্য‚ একদল ভাণ্ডার ইত্যাদি নানারকম তদারকের দায়িত্ব নেয়; কতৃত্ব সবই ওদের হাতে‚ কেবল একজন পরিদর্শক থাকে। শান্তিনিকেতনে আমি চিরকাল এই-সমস্ত নিয়ম প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছি– কেবলই নিয়মাবলী রচনা হয়েছে‚ কোনো কাজ হয় নি। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে‚
স্বভাবতই পাঠবিভাগে চরম লক্ষ্য হয়েছে পরীক্ষায় পাস করা‚ আর সব-কিছুই উপলক্ষ; অর্থাৎ হলে ভালোই‚ না হলেও ক্ষতি নেই। আমাদের অলস মন জবরদস্ত দায়িত্বের বাইরে কাজ বাড়াতে অনিচ্ছুক। তা ছাড়া শিশুকাল থেকেই আমরা পুঁথিমুখস্খ বিদ্যাতেই অভ্যস্ত। নিয়মাবলী রচনা করে কোনো লাভ নেই; নিয়ামকদের পক্ষে যেটা আন্তরিক নয় সেটা উপেক্ষিত না
হয়ে থাকতে পারে না। গ্রামের কাজ ও শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে আমি যে-সব কথা এতকাল ভেবেছি এখানে তার বেশি কিছু নেই– কেবল আছে শক্তি‚ আছে উদ্যম‚ আর কার্যকর্তাদের ব্যবস্খাবুদ্ধি। আমার মনে হয়‚ অনেকটাই নির্ভর করে গায়ের জোরের উপর– ম্যালেরিয়ায় জীর্ণ অপরিপুষ্ট দেহ নিয়ে সম্পূর্ণ বেগে কাজ করা দু:সাধ্য; এখানকার শীতের দেশের লোকেরা হাড় শক্ত বলেই কাজ এমন করে সহজে এগোয়। মাথা গুনতি করে আমাদের দেশের কর্মীদের সংখ্যা নির্ণয় করা ঠিক নয়‚ তারা পুরো একখানা মানুষ নয়।
ইতি ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৩০