দন্ডকারণ্য

আজ প্রায় ত্রিশ বছর পর রেখার চিঠি পেয়ে আমি তো অবাক।
পাছে চিনতে ভুল করি, তাই নিজের পরিচয় দিয়েই রেখা
শুরু করেছে তার চিঠিঃ
‘আমি রেখা। জানি, আমাকে চিনতে তোমার কষ্ট হবারই কথা।
সে তো আজকের কথা নয়, সে যে হলো কতো কাল!
আমি ছিলাম তোমার ছোটবেলার খেলার সাথী,
এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে আজ পুনর্বার অনুভব করলুম,
লজ্জা নামক মেয়েলি বোধটা একেবারে উবে যায় নি তোমার এই
পোড়ামুখী বোনটার রক্ত থেকে। পাছে পোড়া-খাওয়া এই বুকে
প্রেম নিবেদনের তৃষ্ণা জেগে ওঠে, তাই শুরুতেই বলি, তুমি কবি
হয়েছো বলেই আমাদের রক্তের সম্পর্ক যায় নি ছোট হয়ে।
আমি বকুল মাসির মেয়ে যে, এবার মনে পড়লো?”
‘তুমি কবি হয়েছো, জানলাম এবং পড়লাম তোমার কবিতা কিছু।
পড়তে পড়তে বুকের ভিতর হা হা করে উঠলো হাজার তারের বীণা,
আহা, ভালোবাসা তো দূরের কথা; একটু ঘৃণাও বুঝি থাকতে নেই
আমাদের জন্য? না, আমার বিয়ে হয় নি।
দন্ডকারণ্য থেকে মানা, আর মানা থেকে দন্ডকারণ্য ছুটতে ছুটতে
ফুটতে পারে নি বিয়ের ফুল আমার, কিন্তু তার পাপড়ি গেছে ঝরে।
কংস পাড়ের এই বঙ্গ-দুহিতার বুকে বসেছে কালো মৌমাছিদের মেলা,
তাতে মিটেছে ভারতের লাম্পট্যের তৃষ্ণা-;
কিন্তু আমার ঘর জোটেনি ভাই।
এখন আর স্বপ্ন দেখি না।
কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের ঘোরে যে ভাষায় কথা বলে উঠি,
তাতে বৃদ্ধ পিতার চোখ আর্দ্র হয় বটে, কিন্তু হিন্দিতে অনুবাদ
না করে দিলে শ্রীমোরারজী দেশাই তা বুঝতেও পারেন না।
কিন্তু তোমার তো বোঝার কথা, ভাষা কি বদলে গেছে খুব?
দুঃখ কি এতই দেশজ? এতই কি নিষ্ঠুর রাজনীতি?
এতই কি প্রবল জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধানও?
ফিরতে চেয়েছিলাম জ্যোতিবাবুর রাজত্বে, কোলকাতায়,
ছোটোমামা মৃত্যু-শয্যায়, তাঁকে দেখবো, কিন্তু ফেরা হয় নি আমার।
আরো কয়েক হাজার পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পাড়ের রেখার মতোই
আমাকে নামিয়ে দেয়া হলো খড়গপুর রেল স্টেশনের চির-অন্ধকারে।
জ্যোতিবাবু গেছেন শ্রীদেশাই-এর সঙ্গে আলাপ করতে;
আমি এক শিখের গাড়িতে চড়ে বসেছি। না, আমার বিয়ে হবে না।
ভারতবর্ষের দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেনগুলি আমাদের জন্য নয়।
তোমাকে এসব কথা লিখে লাভ নেই জানি, ভারতের মতো বিশাল
দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তুমি হস্তক্ষেপ করবে কোন্ সাহসে?
কিন্তু তুমি তো কবি, না-ই বা হলে আমার ভাই তুমি, তাই বলে
তোমার কবিতা থেকে আমরাই বা বঞ্চিত হবো কোন্ অপরাধে? না হয় তোমার ছোটোবেলার রেখাকে নিয়ে লিখো একটা
যেমন তেমন কবিতা; আজকের হাজার রেখার অশ্রু
না হয় না-ই মোছালে তুমি!’