আখলাকের ফিরে যাওয়া

দুই

এভাবে অনেকটা সময়ই গেল। কতটা সময়, আখলাক বলতে পারবে না। তবে ব্যাপারটা তাকে চমকে দিয়ে গেল। সে হঠাত্ই টের পেল তার দুচোখ খুলে গেছে। কী আশ্চর্য, কেন তার দুচোখ খুলে গেছে! মৃত মানুষের কি চোখ খোলা থাকে! থাকে, এটা সে বহু আগেই শুনেছিল। যদি কেউ মৃত্যুর পর চোখ বুঁজিয়ে না দেয়, চোখ খোলা থাকতে পারে। মৃত্যুর সময় মানুষের অত খেয়াল থাকে না যে নিজের চোখ নিজেই বুজিয়ে দেবে। কাউকে সে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার ক্ষেত্রে সেটা কেউ করেনি। কেইবা করবে! কেউই কি করার ছিল? অবশ্য তার আগে তার বুঝতে হবে কীভাবে আর কোথায় তার মৃত্যু হলো।

বহু চেষ্টার পর আখলাক তিন ছিনতাইকারীর কথা মনে করতে পারল। ওহ, আচ্ছা, এই ব্যাপার! তা, ওরা কি তার চোখ বুজিয়ে দিয়ে যাবে! যারা পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে যায়, তারা কি আর চোখ বুজিয়ে দিয়ে যায়! কিন্তু তার যে চোখ খোলা, এটাই-বা সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি কেন? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল। গত রাতে তার ঘুম হয়নি। ওই যে সে জেসমিনের সঙ্গে ঝগড়া করল না, তার আর ঘুম হলো না। অফিসেও এক সময় সে টের পেল ঘুমে তার দুচোখ…। হাসিব এক সময় জিজ্ঞেসই করল—রাতে চুরি করেছিস?

হুঁ। বেতনের টাকায় চলছে না। পাশাপাশি আরেকটা পেশা থাকা দরকার।

তার এই কথা শুনল অনেকে এবং তারা এই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল—বেতন কি বাড়বে না! কেন?

এই আলোচার এক ফাঁকে শায়লা নামের মেয়েটা, শায়লা নাম শুনলে মনে হয়, যার এই নাম সে বুঝি সুন্দরী, কিন্তু এই মেয়েটির দাঁত উঁচু আর দাঁতের ফাঁকে আখলাক একদিন খাবার লেগে থাকতেও দেখেছিল। যা-ই হোক, যার দাঁত তার ব্যাপার, শায়লা নামের মেয়েটা কাছে ঘেঁষে এল আর ফিসফিস করে বলল—আমি কিন্তু জানি কেন আপনার ঘুম পাইতেছে, সারা রাত ভাবিরে রেস্ট দেন নাই না? হা হা হা। আখলাক ভাই, সেই কবে থেকে বলতেছি একদিন বেড়াইতে নিয়ে যান। আপনে শুনেনই না।

অফিস ছুটির পর সে যখন বাইরে এলো এবং ভাবল এখন কী করবে, ঘুমটা তখন ছিল না। এই এখনই বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে না, কারণ জেসমিনকে সে বলে এসেছে, আজ সে বাড়িই ফিরবে না। সকালে, নাস্তা দেওয়া হয়েছে—এ কথা পরোক্ষভাবে যখন জানাল জেসমিন, সে বলল—খাব না নাস্তা। এই বাড়িতে আমার খাওয়া উঠে গেছে।

খারাপ কী! জেসমিন বলল। এখন থেকে খাওয়ার পয়সাটা বাঁচবে। সংসার চালাতে অত হিমশিম খেতে হবে না।

আর… আজ আমি বাড়ি ফিরব না।

আচ্ছা।

জেসমিন ঠিক ওভাবে ‘আচ্ছা’ বলবে, ধারণা ছিল না আখলাকের, সে একটু সময় নিল, বলল—কোনো মানে হয় না ফেরার…।

আমি বলিনি মানে হয়।

আমি না ফিরলেই বরং সুবিধা। কেউ না কেউ আসতে পারবে।

জেসমিন নাস্তার দুটো প্লেট মেঝেতে আছড়ে ভাঙল আর আখলাক বাড়ি থেকে বের হয়ে এল। অফিসের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে আখলাকের ভালো লাগল না। এরকম একটা সন্দেহ তার ভেতরে কাজ করল, এখন যারাই তাকে দেখবে, বুঝে ফেলবে—সে বাসায় ঝগড়া করেছে, বলে এসেছে সে আর ফিরবে না। সে তাই এগোল, একটু সামনে একটা বাস স্টপেজ আছে, সেখানে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আখলাক জেনে নিল কোন বাস কোনদিকে কতদূর যাবে। যেটা বেশি দূর যাবে, এবং যেদিকে আজও যায়নি আখলাক, সেখানকার একটা টিকিট কেটে সে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর যা ঘটল, ছিনতাইকারীদের হাতে পড়ার আগ পর্যন্ত, বলার মতো তেমন কিছু না। আখলাক ভাবল, ছিনতাইকারীরা তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে তাকে ফেলে যাওয়ার পর সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে মারা গেছে কিন্তু তার চোখ খোলা, সে তাকিয়ে আছে—এরকম কিছু তার ক্ষেত্রে ঘটেনি বলে তার ভালো লাগল। তার এক বন্ধুর বড় ভাই, তাদের চেয়ে বয়সে বেশ বড়, একটা ঘটনা বলেছিল তাদের। সেটা ৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকা শহরে বোমা ফেলতে শুরু করেছে, পাকিস্তানিদের দিশেহারা অবস্থা, এর মধ্যেই বন্ধুর বড় ভাইকে জরুরি কাজে বের হতে হয়েছে। বেশ কিছুটা গেছেও সে, তারপরই হঠাত্ ভারতীয় বিমান বাহিনী আকাশে, সেল আর বোমা। ছুট দিয়েছিল বন্ধুর বড় ভাই, তারপর এক ট্রেঞ্চ পেয়ে লাফিয়ে নেমেছিল তার ভেতর। উত্তেজনায় তার কিছু খেয়াল ছিল না। সে গুটিসুটি মেরে দেয়াল ঘেঁষে পড়েছিল আর দোয়া-দরুদ না জানলেও, পড়ছিল। যখন চলে গেল ভারতীয় বিমানগুলো, চারপাশ চুপচাপ, তারও কিছুক্ষণ পর সে পাশে তাকাল। ট্রেঞ্চের আরেক কোণে মৃত একজন পড়েছিল, চোখ খোলা ছিল লোকটার, মুখ একটু হাঁ, আর তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। বন্ধুর ভাইয়ের বর্ণনা এত নিখুঁত ছিল, ছবিটা আর কখনো আখলাকের মন থেকে মুছে যায়নি। এই এখন যেমন, অনায়াসে তার মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, সেও কি ওই লোকটার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল? ধারণা করা কঠিন। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু কি খুঁজছিল? আর ওই লোকটা কে ছিল? ৭১-এর শেষ দিকে ট্রেঞ্চের মধ্যে চোখ খুলে মরে পড়েছিল একা? তার স্বজনরা কি জানতে পেরেছিল কীভাবে সে মারা গেছে, খোঁজ পেয়েছিল তার?

হুমম। আখলাক হাসল। আমার নিজের নেই খবর, আমি ভাবছি অন্যের কথা! অবশ্য ফেলো ফিলিং হিসাবে ধরলে, এটায় বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। ওই লোকটাও মৃত ছিল, সেও মৃত। কিন্তু কথা একটা থেকেই যায়, মৃত্যুর মধ্যে কি ঘুমানো যায়? আখলাক বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে দেখল মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না, ফলে সে বুঝতেও পারছে না। সে বলল—এখন আর বুঝেই বা কী হবে! এর চেয়ে অনেক জরুরি ব্যাপার বোঝা বাকি পড়ে আছে।

এই যে সে মরে পড়ে আছে এখানে, এখনো একটা লোক তাকে দেখল না! জানে সে জায়গাটা নির্জন, মানে সে সময়টা খারাপ, তাই বলে একটা লোকও তাকে দেখে থামবে না! একটা-দুটো কিংবা আরও বেশি লোক কি এ পথ দিয়ে যায়নি, তারা তাকে শুধু পাশ কাটিয়েই গেছে? থাক, দোষ দেব না, আখলাক বড় করে শ্বাস ফেলল, কাউকে দোষ দেব না, আমি হলেও এমনই করতাম। তখন আমাকে কেউ দুয়ো বা দোষ দিলে বলতাম—রাখেন ভাই, বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, ঝামেলা ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। দরকার হলে ঝামেলায় আপনি জড়ান।

এ রকম যদিও ভাবল আখলাক, তার মন খারাপও হলো। এরকম অবস্থা হবে—একজন মরে পড়ে থাকবে আর কেউ ফিরেও তাকাবে না! এই তো সেদিনই সে জেসমিনের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলছিল। তাদের এলাকার এক মেয়েকে, অল্প বয়সী মেয়ে, স্কুল পার হয়নি এখনো, মাইক্রোবাসে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেল। হ্যাঁ, দিনের আলোয়, দুপুর বেলায়, দুপুর বেলায় ভিড় একটু কম থাকে, তাতে কী, এমন না ভিড় বেশি থাকলেই কাজটা সম্ভব হতো না। যারা পারার তারা সব সময়ই পারে, আর যারা দেখার তারা সব সময়ই দেখে। এই নিয়ে কথা হলো জেসমিনের সঙ্গে। সে বলল—বোঝো তা হলে, অসম্ভব বলে কি কিছু থাকল দেশে?

কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল জেসমিন—থাকল, খুব থাকল।

কী? আখলাক অবাক।

কেউ বাধা দেবে, এটাই অসম্ভব।

ঠিক বলেছ। আখলাক একমত হলো।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছ? মানুষ কিন্তু খারাপ না।

খারাপ আর কই! মেয়েটাকে উঠিয়ে নেওয়ার পর আহা উহু করল না? দেশের যে কী হলো, সে বিষয়েও আলাপ আলোচনা হলো।

হ্যাঁ, ওই পর্যন্তই। মানুষ আজ ওই পর্যন্তই পারে।

এটা কি ঠিক বলছি আমরা? আখলাক একটু সময় নিল। রানা প্লাজার ব্যাপারটা দেখো তুমি! মানুষ কীভাবে এগিয়ে গেল!

ঠিক। কিন্তু ওখানে এগিয়ে গেলে ভয় নেই।

ভয় তা হলে আমাদের বেঁধে রেখেছে।

রেখেছে নিশ্চয়। কিন্তু এই যে ঘটনাগুলো, আমরা দেখি কিংবা পাশ কাটাই, তোমার কি মনে হয় না এসব আমাদের কিছু বিনোদনও দেয়।

ভেবে, এটাও মেনে নিল আখলাক—হ্যাঁ, বাসায় যাবে, যারা দেখেনি তাদের বলবে, আহা উহু বা ছি ছি করবে, দেশটার কী হলো, মানুষের কী হলো—এসব বলবে, তারপর হালকা হয়ে বুঝতে যাবে।

আখলাক বোঝার চেষ্টা করল তাকে কেউ দেখছে কি না। বোঝা কঠিন, এমনিতেই সে ঝাপসা দেখছে, এদিকে আলো বলতেও চাঁদের আলো, আর চাঁদের আলো বললেই যে পূর্ণিমা তাও তো না, সুতরাং বোঝা মুশকিল। আখলাক তবু ঘাড় ঘোরাল, ঘোরাতে পেরে বেশ লাগল তার—আহ! ঘাড়ও আছে আবার ঘোরাতেও সে পারছে। সে তাকাল চোখ সরিয়ে সরিয়ে, একসময় তার মনে হলো, কিছুটা দূরে দুই-তিন জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। একটু একটু নড়ছে তারা, একটু এগোচ্ছে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।

আসেন না ভাই, কাছে আসেন। আখলাক বলল, আমি একজন মৃত মানুষ। মৃত মানুষকে কী ভয়, বলুন?… না, ভুল বলেছি কথাটা। আখলাক হাসল। মৃত মানুষকেই ভয় বেশি। অন্তত এখন। বুঝি, কখনো মৃত মানুষ জীবিতের চেয়ে ভয়ংকর।… তবে কথা দিচ্ছি ভাই, আপনাদের কোনোই বিপদে ফেলব না। আমার হাসিটা শুনলেন। হাসি শুনে কি মনে হলো আমি খারাপ, দিলখোলা না?… না না, আমাকে ধরতে হবে না, তুলতে হবে না, হাসপাতালে নিতে হবে না। হাসপাতাল মৃত মানুষকে শুধু মৃতই ঘোষণা করতে পারে। আপনারা শুধু এখানকার থানায় খবর দিন। যেভাবে ইচ্ছা বলুন—এক ব্যাডায় পইড়া আছে। রাস্তায় পইড়া আছে। পাবলিক নুইসেন্স। ভাই, এইভাবেই বলেন। আমার আর এভাবে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। এখানে আমার কী কাজ বলেন? এখানে আমার কোনো কাজ নেই।

আখলাক দেখল সে বেশ ক্লান্ত বোধ করছে। মৃত মানুষের ক্লান্তি, এটা তাকে অবাক করতে পারত, করল না, সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকাল এবং বুঝল তারা আসবে না। না, রাগ হলো না আখলাকের। থানায় যে যাবে, থানাদার হয়তো বলল—আপনে দেখছেন? আপনারা? সঙ্গে চলেন। এটুকু হলেও কথা ছিল। তারপর হয়তো দলের সঙ্গে একজনকে পাঠাবে তার খোঁজে, বাকিদের বলবে—বসেন। কথা তো শ্যাষ হয় নাই। লোকটা কে? চিনেন?

তার সামনে পুলিশ যদি এই প্রশ্ন করে ওই লোকদের—তাকে চেনে কি না—তাদের হয়ে আখলাক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারত। যদি সেরকম কিছু ঘটত আর কি—এই লোকগুলো যদি থানায় যেত ও পুলিশ যদি তাদের জিজ্ঞেস করত। আখলাক অবশ্য নিশ্চিত নয় এক মৃত ব্যক্তির বক্তব্য পুলিশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না। তবে বলত সে—এরা পাবলিক পুলিশ ভাই। এরা চেনে না আমাকে। আমিও চিনি না। মিল একটাই—এরাও মানুষ আমিও মানুষ, মৃত যদিও। পড়ে ছিলাম, মায়া হলো এদের, দায়িত্ব মনে হলো, খবর দিতে এল। তা মায়া দেখানোর জন্য এদের ঝামেলায় পড়া কি উচিত হবে?

আখলাক দেখল লোকগুলো চলে যাচ্ছে। সে বলল—যাও যাও, যেচে পড়ে কেন বিপদে জড়াবে। সে শুধু তাকিয়ে থাকল। হঠাত্ই তার মনে হলো একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। সে তখনই গলা তুলে ডাকল—এই যে, এই যে ভাই, একটু শুনবেন?

লোকগুলো কি একটু থামল নাকি? ঠিক বোঝা গেল না।

ভাই, আপনাদের থানায় যেতে হবে না। কোথাও খবর দেওয়ার দরকার নেই। অন্য কাজ। লোকগুলো কি ফিরে তাকাল অন্য কাজের কথা শুনে?

একজন একজন একটু মোবাইলটা দেবেন? একটু ফোন করব। বাসায় চিন্তা করছে।

আখলাক লোকগুলোকে আর দেখতে পেল না। তার মনে হলো, লোকগুলো আসলে কখনোই ছিল না। শুধু তার চোখের ভুল, মানুষ তাকে দেখতে পেয়েছে এই রকম ভাবছিল সে বারবার, এ কারণে। কিন্তু সে যা-ই হোক মোবাইল ফোনটা দরকার। জানে—নেই, তবু সে পকেটে হাত দিল। তারপর ক্লান্ত বোধ করল। ভুল হয়ে গেছে, ছিনতাইকারীদের সে বলতে পারত—একটা রিকোয়েস্ট ভাই।

চুপ শালা।

লাস্ট রিকোয়েস্ট ভাই। একজন মৃত মানুষের অনুরোধও রাখবেন না!

শালা, তুই চুপ।

বাসায় একটু খবর দিতে হবে।

আমরা তোর বাসায় গিয়ে খবর দিমু।

না না, মোবাইলটা একটু শুধু দেন।

মোবাইলটা পেলে সে ফোন করত জেসমিনকে—জেসমিন…।

অমন একটা ঝগড়ার পর জেসমিন হয়তো তার ফোন পেয়েই সহজ হতো, একটু নিশ্চয় সময় নিত সে, তারপর হয়তো বলত—হু।

রাত কি অনেক হয়েছে?

এবার জেসমিন রেগে যেত—রাত কত হয়েছে, তুমি জানো না।

আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই।

ঘড়ি কী জুয়া খেলে হারিয়েছ?

আমি জুয়া খেলি?

কে জানে শুরু করেছ কি না।

না জেসমিন, জুয়া শেষ।

কী?

জীবন যদি জুয়া হয়, জুয়া শেষ।

কী বলছ স্পষ্ট করে বলো। কোথায় তুমি?

আমি কোথায় বুঝতে পারছি না।

দেখো…।

এখন দেখার আর কিছুই নেই।

আখলাক, এসব রংঢং আমার ভালো লাগছে না। মদ খেয়েছ?

মদ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মদ।

তার কোনোদিন মদ খাওয়া হয়নি। এক চুমুকও না। এক চুমুক মদ না খেয়েই সে মারা গেল?… কী আর করা, মদের কথা জেসমিন তুলল বলে মদের কথা বলা—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খেয়ে দেখতেও ইচ্ছা করেছে তার, তবে সে আর এমন কী ইচ্ছা, এরচেয়ে তীব্র ইচ্ছা আরও কত ছিল তার, পাহাড়ে ওঠার, সমুদ্রে নামার, নির্জন ফেরিঘাটে বসে থাকার…। হলো না।

না, মদ খাইনি।

তাহলে এসব কী বলছ! ঘড়ি নেই, কোথায় আছ বুঝতে পারছ না…।

ঘড়ি যে সত্যিই নেই। ছিনতাইকারীরা নিয়ে গেল।

কী!

ছিনতাইকারীরা নিয়ে গেল। ওরা তিনজন ছিল।

কী বলছ এসব! তুমি… তুমি কোথায়?

বোঝার চেষ্টা করছি। অফিস ছুটির পর, ভালো লাগছিল না, বাসে উঠে কোথায় যে চলে এলাম! বাসে ওঠার সময় অবশ্য জায়গার নাম দেখেই টিকিট কেটেছিলাম। তারপর একটু হাঁটাহাঁটি করেছি। এখন আর মনে করতে পারছি না।

তোমার মনে করতে হবে না।

মনে করতে হবে না?

না, মনে করতে হবে না। তুমি চলে আসো, চলে আসো তুমি।

সমস্যা আরও আছে জেসমিন।

বলো কী হয়েছে বলো আমাকে।

বুঝতে পারছ না! ছিনতাইকারী। ওরা মানিব্যাগ নেবে না? নিয়েছে।

কী বোকা আমি। … তুমি ঠিক আছ তো আখলাক? হেঁটে আসতে পারবে?

হেঁটে!

এক কাজ করো, এক কাজ করো তুমি। একটা রিকশা বা সিএনজি নাও। বাসায় এসে ভাড়া দেবে।

আখলাক জানে জেসমিন এমন কিছু বললে তাকে প্রথমে চুপ করেই থাকতে হবে।

কী হলো! আমার কথা কানে গেল তোমার?

আখলাক এও জানে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকা গেলেও, অনন্তকাল চুপ করে থাকা যাবে না। সে হয়তো আরও কিছুক্ষণ কথা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে এদিক ওদিক, তারপর তাকে বলতেই হবে। এটা এমন একটা সত্য, যেটা বলতেই হয়।

আচ্ছা, সত্য ব্যাপারটা আসলে কেমন? এই এইটাই কি একমাত্র সত্য—মরে যাওয়া? তা হলে জন্ম নেয়াও কী সত্য নয়? বেশ, জন্মানো আর মরে যাওয়া—এই দুইই তবে ধ্রুব সত্য? আর এর মাঝে যা থাকে তা কিছু সত্য, অর্ধ সত্য, সামান্য সত্য, কিছু মিথ্যা, পুরো মিথ্যা কিংবা সত্য-মিথ্যা মেশানো? আখলাক, নিজেকে একটা গালি দিল, গালি দিয়ে সে দেখল ভালো লাগছে—শালা, আমি গেছি মারা, আর এই ক্রুশিয়াল মুহূর্তে আমি আছি কি-না সত্য-মিথ্যার হিসাব মেলাতে!

জেসমিন। … আরেকটা সমস্যা হয়েছে…।

আখলাক, তুমি একবারে কেন সবটা বলছ না! কেন ভেঙে ভেঙে বলছ?

না না, এটা বলব।

বলো, সিএনজি পেয়েছ?

সরাসরি বলে দেওয়া উচিত হবে? ভাবতে গিয়ে আখলাক একটু দ্বিধায় পড়ল। সরাসরি। না ঘুরিয়ে, সময় নিয়ে? তাতে কী লাভ? ঘুরিয়ে বললে খবরটা মিথ্যা হয়ে যায় না, তার ওজনও কমে না? তা হলে জীবিতরা যে একটু একটু করে বলে? যে শুনবে তাকে সইয়ে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে? কিন্তু সে জীবিত না। সে কেন ওই পথে হাঁটতে যাবে! সে বেশি হলে যা করতে পারে, মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিতে পারে। এভাবে সে বলতে পারে—ছিনতাইকারীদের কথা তুমি তো জানোই জেসমিন।

না জানার কী হলো! বাসায় আসো। তারপর শুনব।

ওদের কাছে একটা ছুরি ছিল। বড়। কিন্তু ধারালো না।

হায় আল্লাহ। আখলাক তোমার কিছু হয়নি তো?

ওদের একজন করল কী জানো? দরকার ছিল না কোনো তবু করল। ওরা তিনজন ছিল, অন্য দুজন বারণ করল, ওই ছেলে শুনল না।

আখলাক, প্লিজ তুমি বলো, কী হয়েছে?

ভোঁতা একটা ছুরি, মানে হয় বলো, আমার পেটে ঢুকিয়ে মোচড় দিল দুবার।

আখলাক, কী বলছ এসব!

তারপর কী হলো জানো? তারপর কিছুক্ষণ পর আমি মারা গেলাম।

আখলাক ক্লান্তিবোধ করল। শুয়ে থাকার ব্যাপারে তার কখনো কোনো ক্লান্তি নেই। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে এমন হয়, জেসমিন তাকে ঠেলেও তুলতে পারে না। কিংবা বিছানা ছেড়ে এই ওঠে তো সে, ওই আবার বিছানায় গিয়ে পড়ে। জেসমিন বলে—তুমি হচ্ছ যম-অলস।

আবার যমকে নিয়ে টানাটানি কেন? এখানে ওই বেচারার কী দোষ!

আহ, এখানে যম দেখি বেচারা হয়ে গেল!

আখলাক মনে মনে হাসল। যম বেচারা, না? তবে যমের আর কী দোষ! তার সময় হয়েছিল। কথা অবশ্য আছে। এত তাড়াতাড়ি কেন সময় হবে! তা হলে আসার কী দরকার ছিল? বিশেষ করে যখন সে যাওয়ার দরকারটাই বুঝতে পারছে না। মুখ খারাপ করতে ইচ্ছা করছে তার। করবে? সে ভালো রকম মুখ খারাপ করতে পারে। জেসমিন বলে—ছি ছি।

এখানে ছি ছি করার কী আছে! আশ্চর্য!

তোমাকে দেখে মনে হয় না।

আমাকে দেখে মনে হয় না আমি মুখ খারাপ করতে পারি?

তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানো না।

খাই না তো। আমি ভাজা মাছ খাই না। তাজা মাছ খাই।

কথাটা অমন চোখ সরু করে বলছ কেন! মুখে আবার হাসি। এমনি তোমাকে নোংরা বলি।

তাজা মাছ সে অবশ্য সত্যিই ভালোবাসত। মাছ মানে এখানে মাছই। মাছ আর আগের মতো পাওয়া যায় না বলে তার আক্ষেপও ছিল। তার এরকম একটা ইচ্ছা ছিল, পুকুর কাটবে সে। গ্রামের বাড়িতে বেশ কিছুটা জমি আছে এখনো। আখলাক বলেছিল—কয়েক বছর পর কী করব জানো? চাকরি ছেড়ে দেব।

চাকরি ছেড়ে দেবে? কেন? তোমাকে কি ভূতে কিলাবে তখন?

আমিই কিলাব। চাকরি হচ্ছে ভূত। আমি চাকরি কিলাব।

তুমি মাঝে মাঝে কী সব কথা বলো!

গ্রামের বাড়িটা ঠিক করব। ওখানে উঠে যাব। পুকুর কাটব একটা। মাছ ছাড়ব। মাছ বড় হবে। ধরব। খাব।

এই যে তুমি ‘খাব’ বললে, তোমার চোখ-মুখ চকচক করে উঠল।

আহা, তুমি তো জানো আমার খেতে ভালো লাগে।

একা একা মাছ ধরবে বুঝলাম, কিন্তু একা একা খেতে তোমার ভালো লাগবে?

একা একা খাব কেন! তুমি আছ না?

আমি তোমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠব? এতটা আশা করা কি তোমার উচিত হচ্ছে?

যাবে না?

নাহ। প্রশ্নই ওঠে না।

কেন?

কারণ আমাকে ভূতে কিলায় না।

ওহ, তা হলে অন্যভাবে করব।

তা তুমি যেভাবেই করো। আমি—না।

জেসমিন অবশ্য রাজি হয়েছিল। আখলাক ঠিক করেছিল, দূরের জমিটুকু সে বিক্রি করে দেবে। সে পয়সা দিয়ে ভিটেবাড়িটা কিছুটা বাগানবাড়ির মতো তৈরি করবে। না, থাকবে না, থাকার পরিকল্পনা সেও বাদ দিয়েছিল। তবে তারা মাঝে মাঝে যাবে। হয়তো তিন মাস পর গেল ৩-৪ দিনের জন্য। বাড়ির বাগানে মাচায় বসে থাকবে সে, জেসমিনের পছন্দ হ্যামাক, থাকবে; পুকুর একটা কাটবেই, দেখাশোনার জন্য অবশ্য লোক রাখতেই হবে, রাখবে, যে কটা দিন তারা থাকবে ওখানে, মাচায় বসে, হ্যামাকে শুয়ে, বড়শিতে মাছ ধরে হই হই রই রই করে কেটে যাবে। যদিও তার সে ক্ষমতা নেই। আখলাক খাতায় পেনসিল চালিয়ে অনেকগুলো নকশা করেছিল বাগানবাড়ির, হচ্ছিল না কিছু, তবে ওটা নেশার মতো, রোখও চেপেছিল কিছু, নকশাগুলো থেকে গেছে, খুঁজলে পাওয়া যাবে। আখলাক বলেছিল—এখান থেকে একটা নকশাই দেব ডিজাইনারকে, বুঝিয়েও দেব কী চাই। ব্যাস।

বাগানবাড়ি থেকে মন সরিয়ে আনল আখলাক। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো জেসমিনকে ফোন করে জানানো। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সে বলে এসেছিল, আর ফিরবে না। সে হলো রাগের মাথায় বলা, সে জানে, জেসমিনও। কিন্তু এই যে এখন সে ফিরছে না, জেসমিন ভাববে সে সকালে সত্যি কথাই বলেছিল। কেমন ব্যাপার হবে সেটা? জেসমিন কষ্ট পাবে, খুব কষ্ট পাবে। সে ভাববে, ঝগড়া হয়েছে হয়েছে, এতটা নিশ্চয় তার প্রাপ্য না যে আখলাক সত্যিই ফিরবে না। কী করবে সে তখন?

আখলাক ভেবে দেখল, এটা আসলেও একটা বড় ব্যাপার। সে যে মারা গেছে, এটা দুটো কারণে, না, দুটো না তিনটা, তিনটা কারণে জেসমিনকে জানানো দরকার।

এক. মৃত্যু সংবাদটা জানানো দরকার। নাকি?

দুই. জেসমিন বুঝবে সকালে সে যা বলেছিল, ওই যে, বাড়ি না ফেরার কথা, তা তার মনের কথা না। মারা না গেলে, একটু দেরি হয়তো হতো, কিন্তু ফিরে সে ঠিকই যেত।

তিন. সে না ফিরলে একা একা কীভাবে থাকবে জেসমিন? বিয়ের পর সে কি একা একা থেকেছে কখনো? আখলাক মনে করতে পারল না—থেকেছে। এখন সে যখন ফিরবে না, রাত বাড়বে, চিন্তায় পড়বে জেসমিন, সে বুঝতে পারবে না কী ব্যাপার, এর পাশাপাশি ভয়ও পাবে সে, চিন্তার পাশাপাশি ভয়, কী করবে সে, একা একা কীভাবে রাত পার করবে। যদি মৃত্যু সংবাদটা পৌঁছানো যেত, বন্ধ-ুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে পারত জেসমিন, চলে আসত অনেকেই, সে কোথায় এই চিন্তাটা যেমন থাকত না জেসমিনের, একা একা কীভাবে রাত পার করবে—সে চিন্তাও। এটা আসলে একটা বড় ধরনের ঝামেলাই হয়ে গেছে—খবর দিতে না পারাটা।

তার ক্ষমতায় যখন কিছুই কুলাল না, সে যখন দেখল তার কিছুই করার নেই, আসলেই নেই, আখলাক অনুমান করার চেষ্টা করল কী করতে পারে জেসমিন?

কটা পর্যন্ত খুব একটা চিন্তায় পড়বে না সে?

আকাশের দিকে তাকিয়ে আখলাক সময় অনুমান করার চেষ্টা করল। পারল না। সে যখন গ্রামে থাকত, ছোটবেলায়, তখন কিছুটা পারত। তারপর কতদিন চলে গেছে! এখন কি আর সে ইচ্ছা করলেই অমন কিছু পারে!

সাধারণত সে শোয়া ছ-টার মধ্যে বাড়ি ফিরে যায়। অফিস ছুটির পর বাসে আধাঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের পথ। বাকি সময়টুকু, বিশ-পঁচিশ মিনিট এভাবে-ওভাবে যায়। কখনো দেরি হলে মিনিট পনের-বিশ। এর মধ্যে, মনে আছে আখলাকের একদিন কেবল সাড়ে সাতটা বেজেছিল, সেদিন বাস চলাচলে কী যেন সমস্যা হয়েছিল, সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রিকশায় বাড়ি ফিরেছিল।

এখন রাত দশটা কি বেজেছে। ঘড়ি নেই, আকাশ দেখেও সে পারে না, তবু এটা ওটা মিলিয়ে অনুমান করা যায়। সে অফিস থেকে বের হলো, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, বাসে করে বেশ কিছুটা সময় লাগল এদিকটায় আসতে, তারপর এদিকটায় হাঁটতে হাঁটতে ভেতরদিকে ঢুকে পড়া—ঘটনা এর পরেও কম নয়। সব মিলিয়ে সে হিসাবে রাত দশটা তো বটেই, আরও বেশি বাজার কথা। মাঝখানে সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, এটাও একটা বড় ব্যাপার। আখলাক নিজেকে বলল—কী দশটা দশটা করছি। এখন মিনিমাম বারোটা বাজে। কিংবা আরও বেশি। ঠিক আছে, বারোটাই ধরছি। যদি বারোটাই ধরা হয়, জেসমিন কী করছে এখন?

আখলাক এমন ধারণা করল, রাত আটটা পর্যন্ত জেসমিন কিছুই করবে না। সে সকালে বলেই বেরিয়েছে, ফিরতে দেরি হবে। সুতরাং আটটা কিছুই না। নটা পর্যন্ত জেসমিন চিন্তাহীন থাকবে। মাঝে মাঝে হয়তো ঘড়ি দেখবে, ঘড়ি সে দেখতেই পারে। রাগ করেছে আখলাক, ঠিক আছে, জেসমিনও জানে আখলাকের রাগ কতদূর! সুতরাং ঘড়ি সে দেখবে, রাত নটার পর থেকে ঘড়ি দেখার পরিমাণটা বাড়বে। তারপর যখন রাত দশটা পার হয়ে যাবে? এ সময় জেসমিন নিশ্চয় তার খবর পাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। জেসমিন রাগ করবে, জেসমিন অসহায় বোধ করবে। এইরকম ভেবে আখলাকের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। জেসমিন অসহায় বোধ করুক, এটা সে কখনো চায় না। সে-ই না, মাঝে মাঝে, সুযোগ পেলেই জেসমিনকে বলে— ম্যায় হু না। অর্থাত্ আমি আছি না। সে আছে। সে থাকলে জেসমিনের চিন্তার কিছু নেই।

কিন্তু কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। আজ সে বুঝতে পারছে জেসমিন অসহায়, সে কিছুই করতে পারছে না। আখলাকের কান্না পেল। কেউই কি এখন নেই জেসমিনের পাশে?

তার দেরি দেখে জেসমিন কী করবে, এটা বোঝা দরকার। তাদের আত্মীয়-স্বজন খুব একটা বেশি নেই, না তার না জেসমিনের। যে কয়েকজন আছে তাদের সঙ্গেও মাখো মাখো সম্পর্ক নয়। তবে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের সবাই খুব ভালো, আড়ালে তাদের বিরুদ্ধে বলে না, নিন্দা করে না আখলাক—এমন দাবি করে না, তবে বিপদের সময় তাদের পাশে পাওয়া যাবে। তাদের কাউকে ফোন করতে পারে জেসমিন—মাসুদ ভাই, আখলাক কি আপনাদের ওখানে?

না তো! কেন? কী হয়েছে? এখনো ফেরেনি?

না।… এতদেরি…।

সকালে কিছু বলে বেরিয়েছিল, বা অফিস থেকে কিছু জানিয়েছিল?… দেরি হবে…?

না! … একটু ঝগড়া হয়েছিল। আপনার বন্ধুকে তো চেনেন। গজগজ করতে করতে বলল, আর ফিরব না আমি।

ধ্যাত্। ওটা কোনো ব্যাপারই না। সেদিন আমিও রুমাকে অমন বলেছিলাম। তারপর সন্ধ্যা না হতেই সুরসুর করে… হা হা হা।

মাসুদ ভাই, আমার চিন্তা হচ্ছে।

ওহ হ্যাঁ। … ফোন করেনি, তুমি ফোন করোনি?

করছি তো। ফোন বন্ধ বার বার বলছে সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে বোধ হয়। ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে এরকম। আবার চার্জ না দেওয়া পর্যন্ত…।

মাসুদ ভাই, আপনি একটু অন্য বন্ধুদের ফোন করবেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। শোনো, তুমি চিন্তা করবে না।

আমিও করছি। কোনো খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন।

চিন্তা করো না। রাগ একটু বেশি করেছে। হা হা হা…।

জেসমিন হয়তো ফোন করবে অন্য কাউকে—কবীর ভাই, আখলাকের কোনো খবর জানেন?

সুখবর বুঝি? প্রমোশন?

তার সত্যিই একটা প্রমোশন হওয়ার কথা। হব হব অবস্থা। সে যদি মারা না যেত, কিছুদিনের মধ্যে হয়ে যেত। প্রমোশনটা হলে পদের সুবিধা ছিলই, কিছু বেতনও বাড়ত। বেশি না হলেও কিছু। এই কিছুই মন্দ কী! আখলাক বলেছিল—ধ্যাত্, বেতন বাড়া নিয়ে বলবে না আমাকে, কয়টা টাকা মাত্র বাড়বে।

এই কটা টাকার কোনো দাম নেই!

এই কটা টাকার কী দাম!

বেশ, তা হলে এই কটা টাকায় তুমি হাত দিও না।

দিলাম না।

তুমি বাড়তি টাকাটা আমাকে দিয়ে দেবে আলাদা করে।

আহারে মজারে…।

শোনো আগে। আমি এক পয়সাও খরচ করব না। জমাব।

জমানো—এ বিষয়টায় আখলাকের নজর ছিল না। জেসমিন তাকে বলত মাঝে মাঝে, সে বলত—কীভাবে জমাব বলো, বেতন আর কত, সংসার চলে আর কি।

এর মধ্যেই জমাতে হয়। সবাই জমাচ্ছে না।

আমি কষ্ট করে জমাতে রাজি না।

তারপর হঠাত্ কোনো কারণে টাকার খুব দরকার হলে?

তখন দেখা যাবে।

ওইভাবেই বলত সে। তবে হঠাত্ সেদিন জেসমিনের কথা তার খুব পছন্দ হয়েছিল—জমাবে?

হুঁ। জমানো উচিত না?

বোধ হয়।

ধরো আমার একটা কঠিন অসুখ হলো। যায় যায় অবস্থা। বউয়ের চিকিত্সা করাবে না?

অসুখ-বিসুখের কথা বোলো না। অসুখ-বিসুখ আমার ভালো লাগে না।

আচ্ছা বলব না, বেড়ানোর কথা বলব?

বলো।

সমুদ্র আমার খুব প্রিয়। আমরা দল বেঁধে সমুদ্রে গিয়েছিলাম মনে আছে?

মনে থাকবে না মানে! কী যে হুল্লোড় হয়েছিল।

ভালো লাগেনি?

অসাধারণ লেগেছিল।

সেই থেকে সমুদ্র আমার কী যে প্রিয় হয়ে গেছে।

আমারও। কী যে বড়! বোঝানো যায় না।

তোমার আবার যেতে ইচ্ছা করে না?

করে না মানে! বন্ধুদের বলব?

আখলাক, সেবার ঠিক করেছিলাম এরপর আমরা শুধু দুজন আসব।

হুঁ হুঁ, শুধু আমি-তুমি। কবে?

একটা পরিকল্পনা করেছিল তারা। পরিকল্পনা করতে আখলাকের ভালো লাগে। সে বলেছিল—এবার আর কক্সবাজার না। ইনানী বা প্যাচা দ্বীপ। আমার এক পরিচিত ছেলে আছে। ও বললেই ব্যবস্থা করে দেবে। পয়সা কিছু যাবে বটে। তা যাক না, পয়সা যাওয়ার জন্যই।

আহা, কী আমার খরচ করনেওয়ালা!

আমার খরচ করতে ভালো লাগে।… ভুল বললাম, খরচ আর করতে পারি কই যে বলব খরচ করতে ভালো লাগে। আমার বলা উচিত, আমার খরচ করতে ইচ্ছা করে।

আখলাক ম্লান হাসল। হুঁ, খরচ করতে তার সত্যিই খুব ইচ্ছা করত। এমন যদি হতো তার মানিব্যাগ ভরতি থাকত টাকা… না, শুধু মানিব্যাগে হবে না, ড্রয়ার ভরতি টাকা, না না, তাও না, ব্যাংকে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট আর বেসুমার টাকা। দেখা গেল সে একটা হেলিকপ্টার কিনে ফেলল। একথা জেসমিনকে বললে জেসমিন হাসতে হাসতে বলল—তুমি…।

আমি। আমি কী?

একটা পাগল।

এরপর প্লেন কিনব।

কিনো। তার আগে যদি একটা গাড়ি কিনতে পারতে…।

জেসমিন গাড়ির কথা বলেছিল আর আখলাক কিছুটা দমে গিয়েছিল। গাড়ির কথা সে নিজে কি ভাবেনি। কিন্তু গাড়ির অনেক দাম! অত পয়সা একসঙ্গে করা…। গ্রামের জমিটুকু বিক্রি করলে অবশ্য দেড়টা গাড়ি হয়ে যায়। হোক, গাড়ির জন্য জমি বিক্রি করা উচিত হবে না। জেসমিনও তাকে বারণ করেছিল বার বার—এই কাজ কিন্তু তুমি কখনোই করবে না।

না না। বোকা নাকি আমি!

তোমাকে বিশ্বাস নেই কোনো।

গাড়ি অবশ্য এখন আর বিলাসিতা না, দরকার।

আবার!

কোথাও পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেও দারুণ লাগবে।

আখলাক, চুপ।

জেসমিন, জীবনে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে!

ঘটে।… একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম গাড়ি বাড়ির বাইরে মিটিমিটি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে? আমাদের দেখে বলল—হ্যালো, গুড মর্নিং।

হতে পারে না। কিংবা আরেকটু বেশি।… মানে একটু বেশিই বেশি।

অনেকগুলো গাড়ি।

না। আলাদীনের একটা আশ্চর্য প্রদীপ।

আখলাকের মনে আছে জেসমিন হো হো করে হাসতে আরম্ভ করেছিল।

হাসছ কেন?

তুমি না একটা…।

শুধু একবার ভেবে দেখো, আলাদীনের একটা আশ্চর্য প্রদীপ থাকলে কেমন হতো।

না, ভাবব না। একটুও ভাবব না।

কেন?

তারপর মন খারাপ হবে।

কিন্তু আমি ভাবব। আমি মাঝে মাঝে ভাবি।

ওমা, তাই! আমাকে বলোনি কখনো।

বলার কী আছে! আখলাকের গলা ছিল ক্লান্ত। বলার কী আছে। মাঝে মাঝে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের কথা ভাববই।

যাক, হেলিকপ্টার কেনার কথা ভাবতে ভাবতে এত কথা। সে ভেবেছিল, সকালে সময় হলে সে ছাদে চলে যাবে, হেলিকপ্টার গাইডেড, তাকে নিয়ে যাবে অফিসের ছাদে, সে গম্ভীর মুখে নামবে, গম্ভীর মুখে অফিস করবে, গম্ভীর মুখে বাড়ি ফিরে আসবে। এর মধ্যে একবারও সে হাসবে না। সে হাসাহাসি যা করবে, তা বাড়ি ফিরে এসে।

আর হেলিকপ্টার কেনা, আর সমুদ্র দেখতে যাওয়া, ইনানী কিংবা প্যাচা দ্বীপ, খরচ বেশি কিন্তু প্যাচা দ্বীপ ব্যাপারটা নাকি ইন্টারেস্টিং। … হলো না।

হলো না যখন, কিছু করার নেই। কোথাও কোনো অভিযোগও সে রাখতে চায় না—শুধু এভাবে এটুকু মেনে নেয়া—হওয়ার ছিল।

তবে এও ঠিক, এভাবে পড়ে থাকতে তার খুবই খারাপ লাগছে। জেসমিনের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। ও, হ্যাঁ, জেসমিন ফোন করেছিল আরেক বন্ধুকে—কবীর ভাই, আখলাকের কোনো খবর জানেন?

সুখবর বুঝি? প্রমোশন?

না না, সেরকম কিছু না।

তা হলে?… দাঁড়ান দাঁড়ান ভাবি, আপনার গলা কেমন যেন শোনাল!

কবীর ভাই, খবর ভালো না।

কী হয়েছে? … কী… কী?

আখলাকের খবর নেই।

নেই মানে!

সেই যে সকালে বেরিয়েছে, তারপর থেকে। আজ কোথাও ওর যাওয়ার কথা না। আমি কতবার ফোন করলাম, বার বার বলছে সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।…।

কী বলেন!… ভাবি, আপনি এতক্ষণে ফোন করলেন!

ভাই, আমার মাথা কাজ করছে না। তা ছাড়া বার বার মনে হচ্ছে—আরেকটু দেখি—এই বুঝি চলে এল এই বুঝি চলে এল…।

ভাবি, ভাববেন না, আমরা আসছি।

না না, আপনাদের আসতে হবে না।

আমাদের আসতে হবে না মানে!

না না, আপনারা আসুন প্লিজ।

বন্ধুরা যাবে। কেউ কেউ হয়তো বিরক্ত হবে—ওদের রাগারাগি, আমরা গিয়ে কী করব!

তাই বলে এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে? আখলাক কি এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার মানুষ! আমাদের কি একটু খোঁজ নেয়া উচিত না?

খোঁজ তো কাল সকালে নিলেও হয়। এত রাতে খোঁজ কোথায় নেব?

কোনো কোনো বন্ধু হয়তো আসবে না, অনেকেই আসবে। কিছু একটা হয়েছে—এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ থাকবে। তবে সেটা হয়তো কেউই জেসমিনকে বুঝতে দিতে চাইবে না। জেসমিনকে বুঝতে না দেওয়ার কিংবা সহজ রাখার জন্য তারা নানা মন্তব্য করবে।

ঝগড়াটা খুব কঠিন হয়েছিল, না? মনে হচ্ছে আখলাকের রাগ পড়েনি।

তোমার ধৈর্য দেখছে, বুঝেছ জেসমিন, তোমার ধৈর্য দেখছে।

বলেছে যখন ফিরবে না, আজ হয়তো সত্যিই ফিরবে না। কী যে পাগল একটা!

এসব কথা অবশ্য শেষ পর্যন্ত কারোরই মনোপুত হবে না, যারা বলেছে তাদেরও না। সবাই একটু একটু করে কথা ঘোরাতে আরম্ভ করবে।

কায়সার, তুই একটু থানায় যাবি?

আমি না। ইকরাম যাক, ওর লোকাল থানায় চেনা আছে।

শুধু লোকাল না, ওর অফিস যে থানায় সেখানেও যেতে হবে।

একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, ততক্ষণ না হলে থানা নাকি নিখোঁজ হিসেবে নেয় না।

নিখোঁজ কেন… মানে একটু খোঁজখবর নেয়া আর কী…।

হাসপাতালে যাওয়া দরকার। সবগুলো হাসপাতালে…।

ভাবি, ওর অফিসের কোনো কলিগের ফোন নাম্বার আছে আপনার কাছে?

তারপর এক এক করে সবাই বেরিয়ে যাবে। কেউ থানায় যাবে, কেউ হাসপাতালে, কেউ রাস্তায় রাস্তায় খুঁজবে হয়তো। পাবে না।

তাকে পাবে না। তাকে যে পাবে না, এটা নিয়ে, আখলাক দেখল, তার ভাবতে ভালো লাগছে না। তাকে বরং পেয়ে যাক। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে না, পরে যেসব ঘটনার কোনো ব্যাখ্যাই থাকে না। তেমন কিছু ঘটুক না। সবাই যখন তাকে খুঁজতে বের হয়ে যাবে, জেসমিন আবার যখন একা, তখন জেসমিনের সবকিছু দুলে উঠতে পারে না? হয়তো হঠাত্ই সে দেখতে পাবে, টিভিতে এরকম এক হিন্দি সিনেমা দেখেছিল আখলাক, দক্ষিণের সিনেমা, দক্ষিণের সিনেমা দেখতে ভালোই লাগে, রজনীকান্ত তো দারুণ, একবার সে দুপুরে খেতে বসার আগে, একটু আগেই রজনীকান্তর সিনেমা দেখেছে তারা, তা, সে খাবার টেবিলে বসার আগে রজনীকান্তের কায়দায় প্লেট ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ধরতে চাইল আর প্লেট নিচে পড়ে খান খান, এখন সে যে সিনেমার কথা বলছে সেটা অবশ্য রজনীকান্তের না, সেটায় নায়ক গভীর জঙ্গলে বিপদে পড়ল আর মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টা বাজাতেই চোখ খুলে গেল নায়িকার, সে দেখতে পেল নায়িকা কোথায়, তারপর কয়েক মাইল দূরের পথ মুহূর্তে পৌঁছে গেল। এরকম কিছু কি খুবই অবাস্তব, কখনোই হতে পারে না?

অনেকক্ষণ হলো একদিক হয়ে থাকতে থাকতে শরীরের এদিকটা লেগে গেছে। আখলাক শরীর বাঁকিয়ে অন্য পাশ হয়ে নিল। আহা, আরাম বোধ করল সে। একটু নাড়াচাড়া সে যখন করতেই পারছে, একদিক হয়ে এতক্ষণ পড়ে থাকার কী দরকার ছিল! মরে গেছে বলে নিজের সুখ-শান্তির কথাও ভাবা বাদ দিতে হবে? সে আরামপ্রিয়, অলসও। মাঝে মাঝে এমন আলস্য তার, সে হয়তো একপাশ হয়ে শুয়ে আছে, পাশে জেসমিন, সে জেসমিনকে বলল—আমাকে আরেক পাশ করে দাও তো।

প্রথমদিন যেদিন সে এই কথা বলল, জেসমিন কিছুই বুঝতে পারেনি—মানে?

আমাকে ধরে অন্য পাশ করে দাও।

ভয় পেয়েছিল জেসমিন—তুমি কি অন্য পাশ হতে পারছ না?

পারব না কেন! দাও।

যখন বুঝতে পেরেছিল জেসমিন, রেগে গিয়েছিল—আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

শোনো, মাঝে মাঝে এমন করে দেবে। যদি দেখো আমি একপাশ হয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছি, ঠেলে অন্য পাশ করে দেবে।

মাঝে মাঝে সত্যিই তা-ই দেয় জেসমিন। সেটা অবশ্য মজা করে। সে হয়তো মাত্র একপাশ হয়েছে, তখনই তাকে অন্য পাশ করে দিয়ে জিভ কাটল—ওহো, সময় হয়নি তো।

পায়ের কাছে কী যেন একটা কামড় দিল। সাপ? সাপ ভেবে আখলাক নিজেই নিজের ওপর রেগে গেল। সে পড়ে আছে নিথর, আর সাপের কোনো কাজ নেই তাকে কামড় দিল, যেন তার ছয় মাস অন্তর দাঁত পরীক্ষার সময় হয়েছে। একটু মাথা তোলার চেষ্টা করল আখলাক। মাথাটা ভার, বেশ ভার। তবু মাথাটা কিছুটা সে তুলল, তাকাল, কিন্তু আলো কম, পায়ের কাছে কী, তা সে বুঝতে পারল না। সে দেখতে পেল না, বোঝার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ সময় লাগল বুঝতে—পিঁপড়া। সে তার বাঁ হাতের কাছেও দেখল পিঁপড়ারা লাইন ধরেছে।

আহ হা হা, এসে গেছো তোমরা!

এলাম আর কি।

কিছুক্ষণ সময় নিলে পারতে!

লাভ?

তা বটে, কী লাভ! আখলাক হাসল। হোক পিঁপড়া, লাভ-ক্ষতি কে না বোঝে!

পিঁপড়ারা বলল—আর সময় কিন্তু একেবারে কম হয়নি।

হুঁ। … জেসমিন এসে গেলে তোমরা অবশ্য শরীরে ওঠার সুযোগ পেতে না।

জেসমিনটা কে?

আমার বউ।

তোমার বউকে দিয়ে আমরা কী করব!

পিঁপড়ার কথা শুনে মেজাজ জ্বলে গেল আখলাকের—তোরা শালা কয়েকটা পিঁপড়া মাত্র।

খেপে যাচ্ছ কেন! কাজ করতে দাও। তোমার কাজ তুমি করেছ, ছিনতাইকারীদের কাজ ছিনতাইকারীরা করেছে। এখন আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও।

না না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমার বউকে নিয়ে ওটা কী বললে!

কী বললাম!

ওই যে, বললে না—আমার বউকে নিয়ে তোমরা কী করবে?

হ্যাঁ, কী করব!

আখলাক তবু মুখ ভার করে থাকল।

তোমার বউ কী জীবিত।

হুঁ!

মৃত হলে আমাদের আরেকদল ওদিকে যেত। অন্য মানুষদের কড়া নজর এড়িয়ে নাগাল পেত কি পেত না, জানি না—যেত।

আর এদিকে আমার দিকে কারোরই নজর নেই। কী কপাল আমার।

এসব আমাদের বলে কী লাভ?

আর কাকে বলব? আর কেউ আছে এখানে?

আমাদের বোলো না। আমাদের বলা না বলা সমান। আমাদের ক্ষেত্র আলাদা।

গুষ্ঠি কিলাই।

কিল খেতে আমরা অভ্যস্ত। প্রতিদিন আমাদের কতজন মারা যায় ধারণা আছে?

তাও তো থামিস না তোরা! থামিস?

থামা আমাদের নিয়মের মধ্যে নেই।… এখন দয়া করে চুপ করো।

কী চুপ করব! তোমরা ওই কথা বলার পর আমার ঘুম হারাম।

ঘুমের সময় আছেই। কী বলেছি তোমার বউকে নিয়ে?

ভুলে গেছ!

পিপড়ার ব্রেন…

তাই তো দেখছি।

আর তোমার বউ আমাদের কাছে আরও একজন মাত্র।

কী?

আরও একজন।

তোমরা কি বুঝতে পারছ এই কথাই অনেক পুরুষ বলবে—আরও একজন আরও একজন।

তোমার এই কথার মানে!

আমি নেই তো। অনেক পুরুষের, আমার পরিমণ্ডলের কিংবা বাইরের, কাছেও আমার বউ হয়ে যাবে—আরও একজন আরও একজন।

ওহ! ধারণা নেই। যাকগে, তুমি এবার কথা থামাও।

তোমাদের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে।

হুঁ।

সমস্যা হলো, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

নিজে নিজে বলো। পিঁপড়ার সঙ্গে আবার কী কথা।

আমার অবস্থার কারণে তোমরা এখন গুরুত্বপূর্ণ, তাই বলছি। না হয় বলার কারণ ছিল না।

পিঁপড়ারা কোনো জবাব দিল না। তাদের সঙ্গে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছাও করল না আখলাকের।

সে ঠিক করল, সে অন্য কিছু ভাববে। পিঁপড়ার কথা ভাববে না। বরং আগের মতো জেসমিনের কথা ভাববে। একটু আগে সে ভাবছিল যেমন—বন্ধুরা সবাই তার খোঁজে বেরিয়ে গেলে জেসমিন আবার একা হয়ে যাবে। আর সে-সময় যদি সবকিছু দুলে ওঠে জেসমিনের… হ্যাঁ হ্যাঁ, সিনেমার মতোই। সিনেমার মতো করে ভাবা যাবে না—এমন নিষেধাজ্ঞা কোথাও নেই। ধরা যাক, সিনেমার মতো দুলে উঠল জেসমিনের মাথা, সে কতক্ষণ কপাল ধরে রাখল, তারপর তাকে দেখতে পেল—দেখল সে এই এখানে পড়ে আছে।

জেসমিন নিশ্চয় তখনই বেরিয়ে পড়বে। ছুটে আসতে আরম্ভ করবে। তার শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটাবে, কিন্তু সে থামবে না। শাবানার এমন একটা সিনেমা দেখেছিল আখলাক। ছোটবেলায় সে ছিল সিনেমার পোকা। পয়সা চুরি করত, পয়সা চুরি করতে না পারলে গোলার ধান, বাড়ির মুরগি, গাছের নারকেল সে বিক্রি করে দিত। তারপর সে পয়সায় সিনেমা দেখা। একবার পাশের বাড়ির হুরি খালার হাঁস বিক্রি করে ধরাও পড়েছিল—তুই, তুই চোর হইছস একটা!

আমি, আমি চোর! তোমার হাঁস কে নিছে তার আমি কী জানি!

হাঁস বেইচা সিনেমা দেখছস। বুঝি না? এই সিনেমা তোরে খাইব।

হুরি খালার কথা ঠিক না। ঠিক যে না, এটা আর এখন প্রমাণ করার উপায় নেই। হুরি খালা মারা গেছে সেই কবে, খুব বেশিক্ষণ না হলেও মারা গেছে সেও। হুরি খালাকে কোথায় পায় সে। পেলে বলতে পারত—দেখো, সিনেমা আছে বলেই-না জেসমিন দেখতে পেল আমাকে। ছুটেও আসছে সে।

অনেকটা পথ ছুটে এসে, প্রায় কাছে এসে তাকে আর খুঁজে পাবে না জেসমিন। সিনেমায় এরকমই হয়। সে একবার এদিক যাবে আরেকবার ওদিক যাবে, কিন্তু আখলাক ঠিক যেখানে সেখানে পরিচালক না বলা পর্যন্ত কিছুতেই আসবে না। টেনশন তৈরির চেষ্টা আর কি। টেনশন এখন আখলাকের একটুও পছন্দ হচ্ছে না। এরপর আবার শাবানার মতো মুখের কাছে হাত তুলে—’আ-খ-লা-ক’ বলে ডাকতে আরম্ভ করবে নাকি জেসমিন? কে জানে পরিচালক কীভাবে চিত্রনাট্য সাজিয়েছে! তার কি কোনো ডায়লগ আছে এই দৃশ্যে।

আখলাক মনে করতে পারল না, মনে করতে না পেরে সে খুবই বিরক্ত হলো। এত কাছে এসে জেসমিন তাকে পাবে না! মানে হয়, এর কোনো মানে হয়! এ রকম ভাবল আখলাক, আর প্রায় ঠিক তখনই সে শুনতে পেল জেসমিন ডাকছে-আ-খ-লা-ক।

প্রথমে তার বিশ্বাস হতে চাইল না, তাই সে পিপড়া বাহিনীর দিকে ফিরল—শুনেছ?

কী?

জেসমিন কি ডাকছে?

জেসমিন ডাকছে কি ডাকছে না, এটা শোনা না-শোনা আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে না।

তোরা মর।

‘তোরা মর’ বলে আখলাক পাশ ফিরল, জেসমিনকে দেখতে পেল। তার ধারণা ছিল জেসমিনের তার কাছে পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। জেসমিন অবশ্য তাকে দেখেনি। আখলাক হাত তুলল—এই যে আমি এখানে।

জেসমিন তার পাশে এসে দাঁড়াল—যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে…।

আমিও তোমার কথা ভাবছিলাম।

ছাই। ভাবলে আর এখানে থাকো!

আহা, বুঝতে হবে তো।

আমি কিছুই বুঝতে চাই না।

আচ্ছা থাক তাহলে, বুঝতে হবে না। কটা বাজে?

বাজে।

সে তো বুঝলাম। কটা?

তুমি এমন একটা নোংরা জায়গায় শুয়ে আছ কেন?

আখলাক জেসমিনের দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল।

কী হলো, কথার উত্তর দিচ্ছ না যে!

তুমি কি কিছুই জানো না?

কী জানব?

আশ্চর্য, কিছু বুঝতেও পারছ না?

তুমি যে নোংরার মধ্যে শুয়ে আছ এটা বুঝতে পারছি।

আর কিছু না?

আর কী? এমন হেঁয়ালি করছ কেন?

হেঁয়ালি না। আখলাক একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমাকে ছিনতাইকারী ধরেছিল।

ওহ, আর সেই দুঃখে তুমি নোংরার মধ্যে শুয়ে আছ!

হুঁ।

ভালো। এখন ওঠো।

উঠতে পারব না।

কেন? এবার জেসমিনের ভুরু কুঁচকে গেল।

জেসমিন, তুমি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছ না।

আহা, না বললে বুঝব কী করে।

জেসমিন, আমি মারা গেছি।

তুমি মারা গেছ মানে!

আমি মারা গেছি মানে আমি মারা গেছি।

জেসমিন অপলক আখলাকের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ছিনতাইকারীরা আমাকে মেরে ফেলেছে।

হুঁ।

আর এটাই তুমি বুঝতে পারছিলে না। আশ্চর্য!

দেখো, এমন কোরো না। ছিনতাইকারীরা কি তোমাকে আগে কখনো মেরে ফেলেছিল, নাকি এবারই প্রথম?

আগে হলে জানতে। এবারই প্রথম।

তা হলে আমি বুঝব কী করে বলো?

তা অবশ্য ঠিক। এটা তুমি ঠিকই বলেছ।

তুমি অবশ্য একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে শুতে পারতে।

না, মানে, ওরা এখানেই ছুরি চালাল। আমিও আর নড়তে পারলাম না।

ছুরি দিয়ে মেরেছে?

হ্যাঁ।… ভোঁতা একটা ছুরি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। … একটা কাজ করে দেবে।

পাশ ফেরাতে বলবে? হায়রে অলস!

না না, ফুটোটা একটু দেখব।

কিসের ফুটো?

একবার এক ক্যানভাসারকে আখলাক বলতে শুনেছিল—মানুষ হইতেছে দুই মুখা ফুটো, দুই মুখা, আপ অ্যান্ড ডাউন, কী বুঝলেন! ‘কী বুঝলেন’ কথাটা মজা দিয়েছিল আখলাককে। বহুদিন সে হঠাত্ই বলে উঠেছে—কী বুঝলেন!

এই এখনো সে হঠাত্ করে বলে ফেলল—কী বুঝলেন?

জেসমিন জিজ্ঞেস করল—কী বুঝব!

আবার কী! আখলাক আবার ভুরু কোঁচকাল। যেটা বোঝার সেটা বুঝবে।

যে স্বভাব তোমার! আর মুখতো পাস করা। বলেছিলে না একবার…।

কী বলেছিল সে, আখলাক কিছুতেই মনে করতে পারল না।

বিশাল খোলা মাঠে তোমার ওটা করতে ইচ্ছা করে। নিচে থাকবে ঘাস, ওপরে আকাশ।

ওহ। ওটা এখন না। ছিনতাইকারীরা ছুরি ঢোকাল তো, একটা ফুটো হয়ে গেছে ওখানে।

দেখতে ইচ্ছা করছিল তখন থেকেই কিন্তু একা একা সাহস হচ্ছিল না। এখন তুমি এসেছ। সাহস পাচ্ছি। দুজন মিলে যদি দেখা যায়।

জেসমিন আরেকটু কাছে সরে এল। চাঁদের সামান্য আলো এসে পড়ল তার মুখের ওপর। আখলাক বলল—তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে।

থাক!… অন্য সময় যেন ভূত ভূত লাগে।

একটু আগে লাগছিল। অন্ধকারে ছিলে যখন।

ভালো। দেখি, কোন জায়গায়?

জেসমিন…।

কী হলো আবার!

তোমার শাড়িটা খুব সুন্দর।

আমার সব শাড়িই সুন্দর।

এটা কি নতুন কিনেছ? আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

আর সব শাড়ি তুমি মুখস্থ করে বসে আছ!

না, ঠিক তা না। তবে কোনো কোনো শাড়ি খুব অচেনা মনে হয়। এটা সে রকম।

শাড়ি বিশেষজ্ঞ।

কবে কিনেছ?

আহা।

কেউ দিয়েছে?

কী বলো এসব!—আচ্ছা কেউ তো দিতেই পারে।

এখন অনেকেই দেবে।

কেন!

আমি নেই যে। এখন অনেকেই দেবে।

জানি না।

দেবে।… দিতে আসবে। হয়তো এরকম ভাববে—যাই, দেখি আখলাকের বউরে দেওয়া যায় কি না।

আখলাক, পেট দেখাও। পেট।

আর পেট। … এই যে…।

জেসমিন ঝুঁকে এল—কোথায়?

আহা, এই তো। … আমাকে একটু উঁচু করে ধরো।

তোমার পেট সমান। ফুটাফাটা কিছু নেই আখলাক।

ইয়ার্কি মারছ? অত বড় একটা চাকু। ভোঁতা…।

দেখো, তুমি নিজেই দেখো।… হাত দাও, হাত দিয়ে দেখো।

দেখতে হবে না, অমন বড় আর ভোঁতা ছুরির কথা আমি কখনো ভুলব না। একবার কী হয়েছিল জানো? ছোটবেলায় কোরবানির ঈদে যে হুজুর এসেছে আমাদের বাসায় গরু কোরবানি দিতে, তার ছুরিতে নেই ধার। আব্বা বললেন, আপনেরে শোয়াই, আপনের গলায় বসাই এইটা, বুঝবেন?

তুমি কথা ঘুরিও না। … গাঁজা খেয়েছ?

আরে না, মাকসুদরা খেত। আমরা বলতাম গাঞ্জুটি। আমি গাঁজা খাইনি। মদের কিছু ইচ্ছা ছিল। কিছু না, বেশ ইচ্ছা। বাসায় বার থাকবে। হরেক রকম বোতল থাকবে। হুইস্কি, ভদকা, জিন, রাম, ওয়াইন…। বন্ধুরা এলে বলব—কীরে, কী দেব তোকে? হলো না।

না হতেই এই! হলে কী যে হতো। … তুমি ওঠো তো, ওঠো। বলতে বলতে জেসমিন আখলাককে প্রায় টেনে তুলল। নাও, এবার দেখাও ছুরি কোথায় বসিয়েছে? নাকি ভোঁতা ছুরি বসালে দাগ হয় না, ফুটোও না। … হ্যাঁ, দেখাও।

আখলাক ঝুঁকে পড়ে পেট দেখল। একটু ভুঁড়ির মতো হয়েছে। সে বলল—সারাদিন টেবিল চেয়ারে বসে থাকলে ভুঁড়ি হবেই। অথচ এই ভুঁড়ি আমার এত অপছন্দর। … জেসমিন, তোমার ইলিয়াস সাহেবের কথা মনে আছে। আগের বাসায় আমাদের পাশে থাকত। কী যে ভুঁড়ি ছিল লোকটার, তুমি একবার বলেছিলে লোকটা বড় দুঃখী, কাপড় খুলে দাঁড়ালেও ভুঁড়ির কারণে নিচে কিছুই দেখতে পাবে না।

কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই আখলাক। সত্যি বলছি, কোনো লাভ নেই।

আখলাক আবার তার পেটের দিকে তাকাল। ছুরিটা কোথায় বসেছিল, সেখানে ব্যথা নেই এখন, তাই বলে চিহ্ন থাকবে না, তা হয় না। কিন্তু আখলাক দেখল—চিহ্ন নেই। একটুও না।

ফুটো বুজে গেছে?

তাই তো দেখছি!… জেসমিন, সুপার গ্লু-র ভালো বিজ্ঞাপন হয়।

রক্ত আছে… রক্তের দাগ?

নাহ।… আশ্চর্য!

এই যে রক্তের দাগ নেই, এটা দিয়ে কিসের বিজ্ঞাপন হয়?

ভাবতে হবে। … কিন্তু জেসমিন…।

চুপ।

আমি…।

একদম চুপ।

আচ্ছা। … তুমি বলো।

কী বলব?

কখন আবার কথা বলব।

ইয়ার্কি মারো! তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারো। বলতে বলতে জেসমিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি তোমার চিন্তায় অস্থির আর তুমি…।

জেসমিন আমি এদিকেই এসেছিলাম।

ঝগড়া হয়েছে। যদিও তুমিই শুরু করেছ। জেসমিন আবার কেঁদে উঠল। তবু মন খারাপ তোমার হতেই পারে, মন ভালো করার জন্য তুমি এদিকে আসতেই পার। তাই বলে তুমি মনে রাখবে না আমি বাসায় একা আমি তোমার জন্য চিন্তা করব…!

আমি ফিরে যেতাম। বিশ্বাস করো, ফিরে যেতাম। কিন্তু ছিনতাইকারীরা… ওরা তিনজন ছিল, ছুরি ছিল একজনের কাছে…।

আবার মিথ্যা, আখলাক, আবার মিথ্যা!

মিথ্যা না। বিশ্বাস করো।

তোমার কী হয়েছে? বলো, তোমার কী হয়েছে? জেসমিনের কান্না বেড়ে গেল।

কী হবে… মানে যা বলেছি… মানে, কী বলব…! জেসমিন, আমি মারা গেছি। সত্যি।

প্রমাণ দাও।

কিসের? আখলাক অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, জেসমিন কি তার মৃত্যুর প্রমাণ চাচ্ছে? হ্যাঁ, সেরকমই, কারণ জেসমিন বলল—দেখাও, ছুরির চিহ্ন দেখাও।

আখলাক চুপ করে থাকল।

চুপ করে থাকবে না। দেখাও।

আখলাক চুপ করে থাকল।

চুপ করে থাকলে আমি বুঝব তুমি খুব খুব বাজে একটা ইয়ার্কি মেরেছ আমার সঙ্গে।

আমি…?

তুমি… তুমি। খুব বাজে ইয়ার্কি আখলাক। তুমি এরকম পার না, তুমি সত্যিই এরকম পার না।

আমি… জেসমিন, আমি…।

আমি গেলাম। তোমার কখনো ইচ্ছা যদি হয়, এসো।

কথা শেষ করেই জেসমিন মিলিয়ে গেল। ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ সময় লাগল আখলাকের।

সে নিজেকে চিমটি কেটে দেখল। একটু জোরে কাটাই হয়ে গেছে, লাগল। আখলাক এদিক ওদিক তাকাল। তারপর নিজের দিকে—ব্যাপার কী, বলো তো?

ব্যাপার খুবই রহস্যজনক।

আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, না?

কোনটা আগা কোনটা মাথা এটাই বুঝতে পারছি না।

সমস্যা। এখন আমি কী করব?

ছুরি যে ঢুকেছিল, দেখো ওখানে।

আখলাক দেখল—নেই। সেট তো টাইলসের। মেঝের মতো চকচক করছে।

রক্ত নেই। আছে?

বাইরে দেখছি না।

তা হলে ব্যাপার কী?

কথা আমারও।

মানিব্যাগ আছে?

না, মানিব্যাগ নেই।

ঘড়ি?

না, ঘড়িও নেই।

কিন্তু তুমি আছ। না?

এতক্ষণ মনে হচ্ছিল নেই। এখন… এসব কী ভূতুড়ে কাণ্ড!

ভাবো।

মাথা কাজ করতে হবে তো।

বেশি মাথা লাগিও না। মাথা ছাড়াই ভাবো।

আখলাক ভাবতে আরম্ভ করল। বেশ অনেকক্ষণ সে ভাবল। তার মনে হলো—মানুষের জীবনে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, এমন সব ঘটনা যা মানুষকে এক ধাক্কায় এলোমেলো করে দেয়, তারপর বহুক্ষণ তার চিন্তা করার কোনো ক্ষমতাই থাকে না। সে বলল—বুঝতে পারছি, আমার সেরকম কিছু ঘটেছিল।

তোমর চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল?

তোমাকে ছিনতাইকারী ধরল না?

ধরল।

আমার কি ধারণা ছিল, ছিনতাইকারী আমাকে ধরবে?

খামোখা তেমন কোনো ধারণা থাকার কথা না।

তাছাড়া আমি ছিলাম খোশ মেজাজে।

খোশ মেজাজে! এটা বোধহয় ঠিক বলছ না। তুমি জেসমিনের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলে…।

সে ঠিক আছে। ঝগড়ার পর মন খারাপই ছিল আমার। সারাদিন ধরেই খারাপ ছিল। কিন্তু তারপর দেখো, এখানে এলাম। এই জায়গাটা সুন্দর না?

সুন্দর। আমার সন্দেহ নেই।

তখন কী হলো? আমার মন ভালো হয়ে যেতে আরম্ভ করল। তখন কতো কী ভাবতে আরম্ভ করলাম আমি। এই ভাবনাগুলো আমাকে আনন্দ দিচ্ছিল। একসময় আমার এরকমও মনে হলো, মাঝে মাঝে এমন ঝগড়ারও প্রয়োজন আছে।

সত্যি বলো তো, তুমি কি পরিকল্পনা করে ঝগড়াটা করেছিলে?

আরে না না, ওটা হঠাত্।

কিন্তু ব্যাপারটা তোমার ভেতর ছিল।

ঝগড়াটা?

কথাটা।

কথা? কোন কথা। কথা তো অনেক!

যে কথায় তোমাদের ঝগড়ার শুরু।

ওহ। … কী বলি…!

তুমিই বলবে। কথাটা ভেতরে না থাকলে হঠাত্ বেরিয়ে আসবে কেন?

ভেতরে না থাকলে বেরিয়ে আসে না? হঠাত্?

শূন্য থেকে? … স্বীকার করো আখলাক। ছিল না ভেতরে?

ধরো, তা কিছুটা ছিল বই কি।

অনেকদিন ধরে! পুষে রেখেছিলে?

আখলাক ভাবতে আরম্ভ করল। সে কি পুষে রেখেছিল? জেসমিন যেমন বলেছিল—এমন একটা বাজে চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও তো—তা সে করেনি? জেসমিনকে বলেওনি কিছু, কখনো শান্তকে দেখে গম্ভীর হয়ে থেকেছে যদিও, মাথায়ও রেখেছে সে। এই লোক, হ্যাঁ, এই লোক এত ঘনঘন কেন আসবে তার বাসায়! সে জিজ্ঞেস করেছিল—জেসমিনকে—আচ্ছা, তোমরা এত কী গল্প করো, বলো তো?

জেসমিন বলেছিল—কত তো।

এই কত তো-টা কী?

কী করে বোঝাই!

কেন, বোঝানো যায় না?

আখলাক, ভাবো একবার, ওসব আমাদের ছোটবেলার গল্প।

তো?

আমাদের ছোটবেলায় কি তুমি ছিলে?

তোমাদের ছোটবেলায় আমি কী করে থাকব?

কথা সেটাই। একবার হয়েছে কী—লিমা…।

এই লিমাটা কে…?

চিনবে না। এবার ভাবো, আমাদের ছোটবেলার গল্প তুমি বুঝবে?

না।

তুমি খামোখা রাগ করো। ছোটবেলার গল্প কত মজার, তাই না?

জেসমিন আর শান্তর ছোটবেলার যে গল্পে সে নেই, জেসমিন আর শান্ত বসে বসে সেই গল্প করে—এটাই কি তার রাগের কারণ, আখলাক এরকম কয়েকবার ভেবেছিল। তার গল্প করছে, সে অন্য ঘরে বসে টিভি দেখছে, কিংবা বারান্দায় বসে আছে, কারণ ওদের গল্পে সে ঢুকতে পারবে না, সে গেলে তাদের গল্প খেই হারিয়ে ফেলবে, এটাই তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলত? ছোটবেলার গল্প, আহারে আমার ছোটবেলার গল্প! সে একবার জেসমিনকে বলল—তোমরা যখন গল্প করো, তখন আমার কিছুই করার থাকে না।

কেন, তুমি তো টিভি দেখো, পত্রিকা পড়ো।

টিভি অন্য সময়ও দেখি, পত্রিকায়ও অন্য সময়ও পড়ি।

তা, এসে আমাদের সঙ্গে বসে গেলেই পার।

তুমিই বলেছ, আমি বুঝব না।

দেখো, ঠিক সে রকম না। সবার ছোটবেলা কি তার তার মতো না? তোমরা কাজিনরা সেদিন মিনহাজের গায়ে হলুদে তোমাদের ছোটবেলার গল্প করছিলে, আমি কি কিছু বুঝতে পারছিলাম, বলো? কে কোনজন, কে কেন কী করেছিল…।

আমি বহু ভেবে একটা ব্যাপার ঠিক করেছি।

জেসমিন শোনার জন্য একটু উত্সুক হয়ে তাকাল।

শান্ত যখন আসবে, আমি চলে যাব শান্তর বাসায়।

বুঝল না জেসমিন। বুঝল না বলে সে আরও উত্সুক হয়ে তাকাল।

তোমরা করবে ছোটবেলার গল্প…।

হু…।

আর আমরা চেষ্টা করব কিছু বড়বেলার গল্প তৈরি করার।

বুঝতে একটু সময় লাগল জেসমিনের। বোঝার পর সে গম্ভীর মুখে তেতো গলায় বলল—তুমি মাঝে মাঝে এমন নোংরা কথা বলো!

আচ্ছা! তাই?

আমি কি শান্তকে আসতে বারণ করে দেব?

আখলাক স্বীকার করল—কথাটা তার ভেতর ছিল। কথাটা সে পুষেও রেখেছিল। তবে কাল রাতের ঝগড়াটা সে পরিকল্পনা করে শুরু করেনি। সে বলল—এটা ঠিক না, দেখো, এটা ঠিক না। ওখানে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিছু কিছু ব্যাপার হঠাত্ হয়ে যায় না?

আচ্ছা, হঠাত্ই। কিন্তু কথাটা তোমার ভেতরে ছিল।

স্বীকার করেছি।

আর ভেতরে ছিল বলেই হঠাত্ বেরিয়ে এসেছিল।

অস্বীকার করছি না।

ভেতরে যা থাকে, তুমি ভেবে দেখতে পার, তার সবই কোনো না কোনো সময় বেরিয়ে আসে।

একই কথা কেন বারবার বলছ! আমার আশ্চর্য লাগে, তুমি জেসমিনের কথাটা শোনোনি কেন? শোনা মানে—রাজি হওয়া বা তোমার ইচ্ছাটা প্রকাশ করা। কেন? লজ্জায়?

তুমি কোন ইচ্ছার কথা বলছ?

জেসমিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে শান্তকে আসতে বারণ করে দেবে কি না…। তুমি তখন বলোনি কেন—বারণ করে দাও।

বারে, আমি কেন এটা বারণ করতে যাব! ওরা ছোটবেলার বন্ধু…।

এমন কি হতে পারে না, তোমার ইচ্ছা অমনই ছিল, কিন্তু তুমি লজ্জায় বলতে পারনি।

না, না, কী বলো, তা কেন হবে!… আর, ধরো… আমি ধরতে বলছি, আমার অমন ইচ্ছা থাকলে আমি এমনিই সেটা বলতে পারতাম, জেসমিন বলার পর বলতে হতো না।

বলার ইচ্ছা ছিল না তা হলে! সত্যি?

বললাম না—ওরা ছোটবেলার বন্ধু। কেন আমি অমন একটা কথা বলব!

অথচ তুমি দেখো, ব্যাপারটা তোমার ভেতর ছিল। ছিল বলেই হঠাত্ বেরিয়ে গেল। তুমি একই সঙ্গে উদার ও সন্দেহপ্রবণ। নাকি বলব উদার ভাব ধরার চেষ্টা?

প্রায় সব মানুষই কি এরকম না? আসো, এক কাজ করি বরং।

এই প্রসঙ্গ বাদ দেব?

হ্যাঁ। কারণ খোলাসা করা খুব মুশকিল। কোনটা পুরো সত্য, বোঝাতে পারব না।

বেশ। বাদ… তা, এখানে এসে তোমার ভালো লাগছিল, তোমার এমনও মনে হচ্ছিল মাঝে মাঝে ঝগড়ার প্রয়োজন আছে…।

নেই? ভালোবাসাটা বুঝতে হবে না?

বেশ। তারপর? তুমি জেসমিনের কথা ভাবছিলে?

হ্যাঁ, আমি জেসমিনের কথা ভাবছিলাম। জেসমিনের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগছিল। আমি একটা পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলাম। … নেপাল যাওয়ার।

বাহ! দেশ ছেড়ে বিদেশ।

পোখারা। পোখারা যাওয়ার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। অসাধারণ সুন্দর।

কতবার গেছ?

একবারও না। শুনেছি। শুনে-শুনে কি কিছুই বোঝা যায় না?

যায়। আমাদের অনেক কিছুতেই শোনাই সম্বল।

আমি ঠিক করলাম দরকার হলে ধার করব। … ধার তো করতেই হবে। করলাম না হয়। এমন কারও কাছ থেকে নেব, যাকে কিস্তিতে শোধ করা যাবে। তবে জেসমিনকে কিছুই বলব না।

কেন? সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল?

অমন ইচ্ছা থাকতেই পারে। না? ধার করা নিয়েও কিছু বলতাম না। জানি, কারণ শুনলে ও কিছুতেই ধার করতে দেবে না। সে গেল। যাওয়ার কথা বলতাম না। ওতো কক্সবাজার যেতে পারলেই খুশি। একবার সিলেটেও যেতে চেয়েছিল খুব, এ অবস্থায় যদি দেখে নেপাল যাচ্ছি—বোঝো কী খুশি হবে।

আচ্ছা, নেপাল তো পোর্ট এন্ট্রি না কী যেন বলে, তাই না?

নেপাল গেলে ভালো লাগত। জেসমিন খুশি হতো।

খুশি মানে! ওর মুখ কেমন ঝলমল করে উঠত, আমি জানি। আমি ভাবছিলাম পোখরার খুব সুন্দর কোনো স্পটে ওকে আমি একটা ভালোবাসার কথা বলব। ঠিক কী বলব, সেটা বুঝতে পারছিলাম না, তবে খুব ভালোবাসার কোনো কথা…। এ সময়, বুঝেছ, ঠিক এ সময় হঠাত্ সামনে তিন ছিনতাইকারী। কী ভয়ংকর ধাক্কা যে ওটা ছিল!

হুঁ, হঠাত্ একদম উল্টো একটা ব্যাপার।

ওরা আমার মানিব্যাগ নিয়ে নিল।

খুব অসহায় মনে হলো নিজেকে। তাই না?

যখন ঘড়িটা নিয়ে নিল তখন আরও বেশি।

মানিব্যাগের চেয়ে ঘড়ি বেশি হলো! খুব দামি ঘড়ি!

তুমি জানো—কেন। জানো না?

হ্যাঁ, জানি। ওটা পলির দেওয়া।

এখানে কিন্তু কোনো ব্যাপার নেই।

আমি কি বলেছি আছে।… তুমি জানো।

না, না সত্যিই নেই। দেখো, পলি যখন ফোন করল, অফিসে আসবে বলল, আমি অবাক। আমি বললাম, তুই বাসায় আয়। বলল—না, বাসায় না। তা, অফিসে এল। উঠে যাওয়ার সময় ঘড়িটা দিয়ে বলল—আমেরিকায় থাকি বলে ভাববেন না খুব বিশাল ব্যাপার। বরং উল্টোটা। খুব টেনেটুনে থাকি। পারলে আপনার জন্য রাডো বা ওমেগা আনতাম। এইটার দাম কম, এইটা এনেছি। সামনের সপ্তাহে চলে যাব। আপনার বাসায় গেলাম না। যাব না। মনে হচ্ছে—বউসহ আপনাকে দেখলে আমার ভালো লাগবে না।… আমি দেখব না যদিও, ঘড়িটা পরলে ভালো লাগবে।

বিশাল গল্প।

না না, বিশাল কোথায়!

এরকম কত গল্পই যে থাকে মানুষের।

হুঁ, তা থাকে। … আমি কি আর জানতাম…।

কী?

পলি ভেতরে ভেতরে এতটা পছন্দ করে আমাকে! কিংবা করত।

ওহ। জানার পর থেকে ঘড়ি আর খোলোনি, না?

আহা, একটা ঘড়িই তো! হাতি-ঘোড়া তো না।

না, উটও না। তা, কষ্ট পেলে ঘড়িটা নিয়ে নিল বলে? ধাক্কা?

শুধু ঘড়ির কথা বোলো না। সব মিলিয়ে … সব মিলিয়ে।

সব মিলিয়ে।… আচ্ছা, এরপর ছুরি বের করল, এই তো?

ছুরি হয়তো বের করেনি। আমার এখন মনে হচ্ছে ছুরি বের করেনি।

কিংবা বের করলেও তোমার পেটে ঢোকায়নি।

হয়েছে কী—বিশাল একটা ধাক্কা, আর এতদিন জেনে এসেছি ছিনতাইয়ের পর ওরা ছুরি মেরে দেয়। আমি ভাবলাম, অমনই কিছু হয়েছে। ওরা ছুরি ঢুকিয়েছে।

কিন্তু আসলে সবটাই তোমার কল্পনা।

কল্পনা। খুব আশ্চর্য হচ্ছি। সেই কতদূর পর্যন্ত কল্পনা করে বসে আছি! ভাবছি—মারা গেছি।

জেসমিন না এলে এই ভাবনাটা, বোকা আমি, থেকেই যেত।

আখলাক যখন বুঝল সে মারা যায়নি, সবই তার কল্পনা, সে ভাবল এখন তাহলে তার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। সে অবশ্য তখনই রওনা দিতে পারল না। সে মাটিতে বসে পড়ল এবং মাথায় হাত রেখে ভাবতে আরম্ভ করল। সে নিজেকে বলল—আগে ভেবে নিই, তারপর যাব।

এ এক অবাক ব্যাপার। সত্যিই, এ এক অবাক ব্যাপার। এই যে, কিছুই হয়নি আমার, আর আমি কি না ভেবে বসে আছি আমি মরে গেছি। মানুষের তবে এতটাই ঘোর লাগে! আখলাক তখনই ঠিক করল, সে এটা নিয়ে তার কাছের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবে। তাদের জানাবে, মানুষের জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে পারে। সে অবশ্য এটাও বুঝতে পারছে, কেউ কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। তাদের সে দোষ দেবে না, যারা বিশ্বাস করবে না তাদের, সে নিজেও হয়তো কোনো বন্ধুর মুখে অমন কিছু শুনলে বিশ্বাস করত না। সবচেয়ে ভালো হতো, তার যদি কোনো লেখক বন্ধু থাকত। লেখকরা হয় অদ্ভুত কিসিমের, সে ভার্সিটিতে পড়ার সময় কিছু লেখক দেখেছে, কখনো কাছে গিয়েও দেখেছে—এরা কী যে বলে আর কী যে করে! সুবিধা এটাই, কী বলে আর কী করে বলে তারা অদ্ভুত ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে। আর সে যদি নিজে লেখক হতো, তবে সোনায় সোহাগা হতো। সে তার এই অভিজ্ঞতাটা লিখে ফেলত। সে জানে, বিদেশে এমন হরদম হচ্ছে। কোথাও কেউ আটকা পড়ল, বিরান মরুভূমিতে, এক সপ্তাহ একা একা এক অদ্ভুত লড়াই করে লোকালয়ে ফিরেও এলো। কিংবা বাড়িতে আগুন লাগল, সেই আগুন নেভাতে গিয়ে আর চারপাশের আরও কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখে ফেলল একটা লেখা। সেরকম সেও লিখত, নাম দিত—মৃতের কথন। একটু ভাবল সে—না, নামটা তার ভালো লাগল না। একটু হাই থট হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে… হ্যাঁ, এটা হতে পারে—আখলাকের মরে যাওয়া ও ফিরে আসা! আখলাক চারদিক কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল। এতই জোরে, সে নিজেই চমকে উঠল। নিজেকে শাসন করল সে—এটা কী, এটা কী হচ্ছে! এত হাসির কী! অন্যান্য লোক বটেই, ওই ছিনতাইকারীরাও তার হাসি শুনে ফেলতে পারে। হাসি শুনে চলে আসতে পারে—ব্যাপার কী, আর এসে তাকে দেখে অবাক হয়ে যেতে পারে।

আখলাক অবশ্য সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারল না। সে আবার শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করল—ঘটনা ঘটনা, কী যে ঘটনা। তার হাসি শুনে যদি ছিনতাইকারীরা চলে আসে, আসুক। কী আর হবে, অবাক হবে তারা—কীরে, তুই মরিস নাই!

না না। হাসি চাপতে চাপতে আখলাক বলবে।

আশ্চর্য কথা! মরিস নাই ক্যান?

কারণ তোমরা ছুরি চালাও নাই।

ঠিক জানস? চালাই নাই?

না না।

তুই ক্যামনে বুঝলি, বল, তুই ক্যামনে বুঝলি!

সে কীভাবে বুঝল, এটা সে ছিনতাইকারীদের বলবে না। ওদের সঙ্গে এত কী কথা! শেষ একটা কথা যদিও বলা যায় তাদের, তারা বুঝবে না, জানে সে, তবু সে বলতে পারে—বই লিখব। মাথায় চিন্তা। তোমরা যাও দেখি।

শালা, তুই দেখি তাজ্জব জিনিস!

মানুষের জীবনই তাজ্জব।… এই, তুমি, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি। তোমার ছুরিটা ভোঁতা ছিল। মিয়া, তোমার লজ্জা করে না একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে ঘুরো।… ব্যথা পায় না মানুষ!

ছুরি! ছুরি কই পাইলি!

ওহ! … ছুরি ছিল এক সময়, এখন নাই। ওকে?

ছিনতাইকারীরা বাদ। এখন লেখার চিন্তা। আখলাকের মরে যাওয়া ও ফিরে আসা। হিট হবে, এতো বোঝাই যায়। পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এমন হতে পারে, প্রথমে কেনো পত্রিকায় তার লেখা ছাপতে চাইল না। পত্রিকা সে নিয়মিত পড়ে, পত্রিকায় যারা কাজ করে তাদের বিচার-বুদ্ধি সম্পর্কে তার ধারণা আছে। কী যে মাঝে মাঝে লেখে। কানে ধরে চটকানা দিতে ইচ্ছা করে—তোর কলমে আসলো আর তুই লিখে ফেললি!

একবার ভাববি না এটা তুই কী লিখিস!

এমন তাই হতে পারে, সে লেখা নিয়ে এক পত্রিকা থেকে আরেক পত্রিকায় গেল, সেখান থেকে আরেক পত্রিকায়। কেউ কেউ তার লেখা দেখতেই চাইল না, কেউ কেউ বিরস মুখে বলল—যান রেখে… দেখব।

কিন্তু ছাপা যখন হবে? হা হা হা।

সে জানে ছাপা হওয়ার দু-তিনদিনের মধ্যে পত্রিকা অফিস থেকে তার কাছে ফোন আসবে—ভাই, একটু আসতে পারবেন? আসেন না।

আচ্ছা, গেলাম। বলছেন যখন।

আসার সময় একটা লেখা নিয়ে আসবেন।

আর কী লেখা?

এই যে যেটা ছাপা হলো না, সেরকম।

শোনো কথা! ওরকম আরেকটা লেখা সে লিখবে কী করে? কতবার তার ভেতর এই ধারণা জন্মাবে সে মারা গেছে? একথা জানালে পত্রিকা অফিসের লোকও বুঝবে, আমতা আমতা করে বলবে—তা ঠিক তা ঠিক।

ভাই, আপনারা আমার এ লেখা ছাপতে চাচ্ছিলেন না।

কী যে বলেন, দারুণ লেখা…। আচ্ছা, এক কাজ করেন, আপনি অন্য লেখা আনেন।

অন্য কী লেখা আনব?

যেকোনো যেকোনো। লিখে ফেলেন নিয়ে আসেন। আপনে পারবেন।

সে যে পারবে, সে জানে। এটা তার ওই পত্রিকা অফিসের লোকের কাছ থেকে জানতে হবে? তবে এখনই এসব বলে ওদের রাগানো যাবে না।

ফোন অন্যান্য পত্রিকা অফিস থেকেও আসবে—ভাই, লেখাটা আপনি আমাদের দিলেন না! আমাদের পত্রিকা কি কম চলে?

গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম ভাই। আপনারা লেখাটা পড়তেও চান নাই।

কী বলেন!… কে, কে… মানে কার কাছে এসেছিলেন?… আচ্ছা, আচ্ছা… শোনেন ভাই, যার কথা বললেন সে নিজে যাবে আপনার বাসায়। আপনি লেখেন। সে নিজে আপনার বাসায় যাবে। আপনার লেখা নিয়ে আসবে।

এমন ঘটলে, লেখাটা ঠিকমতো লিখতে পারলে, সে পারবে নিশ্চয়, আখলাক জানে, সে তখনো জেসমিনকে বলবে—দেখলে?

জেসমিন বুঝবে নিশ্চয় কী সে বলতে চায়, তবু সে জিজ্ঞেস করবে—কী?

লেখক হয়েই গেলাম।

তেমনই দেখছি। এখন তোমার মেয়ে ভক্ত হবে। তোমার ফোন নাম্বার জোগাড় করবে। তোমাকে ফোন করবে। তোমার সঙ্গে কফি খেতে যেতে চাইবে।

আমি গেলে তো!

যাবে না?

কভি নেহি। … অবশ্য খুব করে ধরলে…।

শোনো। মেয়েরা বলবে না। কোনো মেয়ে যদি ভুল করে তোমাকে ফোন করেই ফেলে, তুমিই বলবে—আসেন না একদিন, কফি খাই।

ঠিক।… আমার একটা কথা ভেবে খুব ভালো লাগছে।… খুব রকিবুদ্দিনের কথা মনে পড়ছে।

এই লোক কে?

আমাদের সঙ্গে পড়ত ভার্সিটিতে। কবিতা লিখত। হায়রে অহংকার।

তোমারও কি এখন অহংকার হবে?

শোনোই না। নাম রকিবুদ্দিন। বদলিয়ে করেছে সৌম্য রাকিব। চেহারায় ফকিরনির পুত, নাম রেখেছে সৌম্য। ২৪ ঘণ্টা গাঞ্জার ওপরে থাকত। আর কী যে লিখত কবিতা—আমি নাই তুমি আছ—আরে, আমি নাই তুমি আছ, এইটা কী কবিতা! দেশে কত সমস্যা, তুই গরিবদের নিয়া লেখ, ছিনতাইকারীদের নিয়ে লেখ…।

তোমার সঙ্গে কথা বলত না?

ওইসব দুই নম্বরী কবিদের সঙ্গে কী কথা! … বাদ দাও।

আখলাক দেখল সে যদি ভাবতেই থাকে, তার ভাবনা শেষ হবে না। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যাবে, সে এই এখানেই থেকে যাবে। তার চেয়ে বাড়ি যাওয়া ভালো। জেসমিন বলে গেছে সে মরেনি, আর এখন সে নিজেও দেখছে, তাহলে কেন সে এখানে বসে থাকবে। ওদিকে জেসমিন এখান থেকে গেছেও রাগ করে। রাগ আর অভিমান। রাগ আর অভিমান যখন মিশে যায়, তখন খুব ভয়ংকর ব্যাপার হয়।

জেসমিনের শেষ কথাগুলো তার কানেও বাজছে—তুমি এরকম পার না, তুমি সত্যিই এরকম পার না।

সে যদি জেসমিনকে বোঝায়, জেসমিন বুঝবে না তার দোষ ছিল না কোনো?

আখলাককে ভাবতে হলো না, সে এরকম সিদ্ধান্ত তখন তখনই নিতে পারল—জেসমিন বুঝবে। এই এতদিনের সংসার তাদের, এর মধ্যে কি জেসমিনকে চেনা হয়নি তার? হয়তো সময় লাগবে একটু ওই যে কথা—রাগ আর অভিমান মিশে গেছে—কিন্তু বুঝবে জেসমিন। আর যখন বুঝবে, তখন তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদবে খুব কাঁদবে।

আখলাক উঠে দাঁড়াল।

আখলাক উঠে দাঁড়াবার পর চাঁদের আলো হঠাত্ই বেড়ে গেল। চারপাশ এখন আরও অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আখলাকের খুশি খুশি লাগল। এই আলোয় জেসমিনের কাছে ফিরে যেতে তার ভালো লাগবে।

সে হাঁটতে আরম্ভ করল। হাঁটতে আরম্ভ করে সে বুঝল পথ আসলে অনেক। এটা নিয়ে পরোয়া করল না। ফিরে যাওয়ার ব্যাপার যখন, অনেকটা পথ হাঁটাই যায়। এতে সমস্যার কিছু দেখল না সে। যদিও জেসমিনের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে ইচ্ছা করছে তার। এই এখনই, একটা সুইচ টিপবে আর পৌঁছে যাবে। কে জানে, ভবিষ্যতে এমন কিছু চালু হবেও বা।

সেদিন এক বন্ধু যুবরাজের সঙ্গে তার কথা হচ্ছিল এটা নিয়ে। যুবরাজ খুব ফূর্তিবাজ, প্রচুর ইয়ার্কি মারতে পারে। সে প্রায় বলে, তার জীবনে অনেক দুঃখ, প্রধান দুঃখটা হচ্ছে তার নাম, সব বন্ধুই জানে যুবরাজ এরপর কী বলবে, তবু জিজ্ঞেস করে—কেন কেন!

কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। তাই আমার নামও যুবরাজ। শালা, দুই পয়সার জীবন আমার, বাপে কিনা নাম রেখেছে যুবরাজ।

বন্ধুরা কেউ কেউ বলে—সম্রাট তো রাখেনি। সম্রাট রাখলে তুই রাগ করতে পারতি।

এখন তা হলে রাগ করব না?

নাহ। যুবরাজ শুনলে বোঝা যায় রাজা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তুই অপেক্ষা কর।

একদিন সে-ই যুবরাজকে এমন একটা কথা বলেছিল। আর যুবরাজ, সে মাঝে মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, বলেছিল—অপেক্ষা? তুই কি খেয়াল করেছিস মানুষের জীবনে শুধুই অপেক্ষা?

সেদিন এই নিয়ে তাদের অনেক কথা হয়েছিল।

সে বলেছিল—ঠিক, আমরা সবাই কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি।

কত কল্পনা আমাদের।

আমরা ভাবি, সেই কল্পনাগুলো বাস্তব হবে।

হয় না।

কখনো হয়তো হয়। কিন্তু নতুন অপেক্ষা তৈরি হয়। তুই ভেবে দেখ, সেই ছোটবেলা থেকে কত কিছুর জন্য অপেক্ষা আমাদের। কিন্তু অপেক্ষা কি আদৌ শেষ হচ্ছে? একটা শেষ হচ্ছে তো আরেকটা তৈরি হচ্ছে…।

সে বলে ফেলেছিল, খুব একটা ভেবেচিন্তে সে বলেনি, এমন হয় না—হঠাত্ একটা কথা কথার পিঠে বেরিয়ে আসে, সে রকম; সে বলেছিল—জীবনের অপর নাম তা হলে অপেক্ষা।

যুবরাজ খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল—দারুণ বললি।

সে মুচকি হেসেছিল। এমন একটা কথা বলতে পেরে তার গর্ব হচ্ছিল। তার মনে হয়েছিল, সে আসলে চিন্তাশীল। চিন্তাশীল বলে জীবনের অনেক গভীর কথা সে বলে ফেলে। সে অবশ্য এই কথা, সে যে চিন্তাশীল, কাউকে বলেনি, যুবরাজকেও না। সে ইচ্ছা করলেই এভাবে বলতে পারত—একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস যুব, কথাটা শুরু করলি তুই, কিন্তু মোদ্দা কথাটা আমিই বললাম, আমার এরকমই হয়। আমি আগেও দেখেছি।

যুবরাজ বা আর কাউকে না বললেও কথাটা সে নিজের ভেতর রেখে দিয়েছে।

তা, যুবরাজের সঙ্গে যে কথা হচ্ছিল। যুবরাজ বলল—একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? যারা পরে জন্মাবে, তাদের কপাল সব সময়ই ভালো।

সে বোঝেনি প্রথমে, জিজ্ঞেস করেছিল—কেন?

তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে।

যেমন?

আগে বাস ছিল? এই যে আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, আগে বাস ছিল?

না। একসময় ছিল না।

বাড়ি গিয়ে টিভি দেখবা? আগে টিভি ছিল?

না, ছিল না।

কী দাঁড়াল তা হলে? যারা আগে জন্মেছিল, তাদের চেয়ে আমরা ভাগ্যবান।

সে তো বলতেই হয়।

আর আমাদের পরে যারা জন্মাবে, তারা আরও ভাগ্যবান। কেন, বলো?

বলব কী, বুঝতে পারছি।

ধরো, তখন মোবাইল ফোনও লাগবে না। তুমি মনে মনে কথা বললা, যাকে বলতে চাও আর কি, কথা তার কাছে পৌঁছে গেল।

কিন্তু যা বলতে চাই না, তাও যদি পৌঁছে যায়?

না না, তা কেন হবে!

আর ধরো, মনে মনে বললাম, কারও কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে বললাম, চাই না সেই কথা পৌঁছাক, চাই সেই কথা আমার মনেই থাক, তবু যদি পৌঁছায়?

না না, তা কেন? সিস্টেম থাকবে। সিস্টেম বুঝে নেবে কোন কথা পৌঁছাতে হবে, আবার কোন কথা পৌঁছাতে হবে না।

তাহলে ঠিক আছে।

ধরো তুমি ভাবিকে মনে মনে বললা, বাস পেতে দেরি হচ্ছে তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে, এইটা পৌঁছাবে। কিন্তু তুমি যদি মনে মনে ভাবো, বললাম তো বাস পেতে দেরি হচ্ছে, কিন্তু যাব তো জুয়া খেলতে—এইটা পৌঁছাবে না।

হ্যাঁ, সিস্টেম ভালো। কিন্তু দোস্ত, এই সিস্টেম দেখে যাওয়ার উপায় নেই। তার আগে আমরা মারা যাব।

বলা যায় না। সিস্টেম চলেও আসতে পারে।

বাড়ির দিকে যেতে যেতে আখলাকের মনে হলো, এই সিস্টেমটা জরুরি, এই সিস্টেমটা চলে আসা উচিত।

যদি চলে আসত আর তার আয়ত্ত্বে থাকত, সে বার্তা পাঠাতে পারত জেসমিনকে—জেসমিন, আমি কিন্তু রওনা দিয়েছি।

এ বোঝাই যায়, প্রথমে জেসমিনের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসত না।

সে বলত—ছিনতাইকারী মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়ে ভাবল—আমি গেলাম! আরে, সিস্টেম এখন কতো ডেভলপ করেছে!

পৌঁছে যাব। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব।

জেসমিন এবারও কোনো উত্তর দেবে না।

চিন্তা কোরো না, আমি আসছি।

তোমার কি ধারণা আমি তোমার জন্য চিন্তা করি?

করো না?

না। অত সময় নেই আমার।

তাহলে বেশি সময় নেব না তোমার। কথা আসলে একটাই। আমি ফিরছি।

জেসমিন বলবে—ফেরো।

কী?

আখলাক, তাড়াতাড়ি ফেরো। প্লিজ।

আমি ফিরছি জেসমিন, আমি ফিরছি।

অপেক্ষা করতে আমার আর ভালো লাগছে না।

অপেক্ষা! আখলাক হাসল।

অপেক্ষা! না? আখলাক আবারও হাসল।

হ্যাঁ, কথা তো একটাই—অপেক্ষা। জীবনের অপর নাম অপেক্ষা।

আখলাক বেড়িবাঁধের এলাকাটুকু পার হয়ে পাকা রাস্তায় এসে উঠেছে। অপেক্ষার কথা সে ভাবতে চাইল না। কিন্তু না ভেবেও কি পারা যায়! কতরকম, কতরকম যে অপেক্ষা! তারা একটা সন্তানের জন্য সেই কতদিন অপেক্ষা করছে। সমস্যাটা তার। ডাক্তার বলেছে, এটা এমন কোনো সমস্যা না, এরজন্য আটকে থাকে না। কথা হলো, সমস্যাটা তার, আর এর জন্যই আটকে আছে।

প্রথম যেদিন ডাক্তার জানাল তাদের ব্যাপারটা, সে লজ্জা ও হতাশায় মুখ তুলতে পারছিল না।

জেসমিনের খুবই মন খারাপ। তার মধ্যেও সে তাকে খেয়াল করল—কী হয়েছে?

মন খারাপ করে আছ কেন?

কী করব? নাচব?

খেপে যাচ্ছ কেন?

তুমি আবোলতাবোল কথা বলছ, তাই।

শোনো আখলাক, মন খারাপ করবে না।

আমি মন খারাপ করিনি।

ডাক্তার কী বলল? এটা তেমন কোনো সমস্যা না।

না, এটা তেমন কোনো সমস্যা না।

এই তো বুঝতে পারছ।

এটাও বুঝতে পারছি, এটা তেমন কোনো সমস্যা না হলেও, সমস্যা।

ডাক্তার বলেছে, এরজন্য আটকে থাকে না।

আমাদের তাহলে এতদিন এমনি আটকে আছে।

আমাদের যা করতে হবে, তা হলো ওটার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।

চেষ্টা তারা কম করল না। আখলাক এমনও করল, এখন মনে হলে তার হাসি পাচ্ছে—পুরুষ মানুষের ইগো, কী যে ভয়ংকর—সে আরও তিন ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করে এল। রেজাল্ট তিন রকম বা দুই রকম হতে পারত, রেজাল্ট এক রকম হলো। তিন ডাক্তারের বক্তব্যও একই রকম— উহুঁ, এটা নিয়ে ভাববেন না, টেনশন করবেন না, এটা ব্যাপার না। এর চেয়ে কম কাউন্টেও হয়, ব্যাপার না।

একজন তো এমনভাবে বলল—যেন আখলাকের চেয়ে কম কাউন্ট নিয়ে সে দেশে দেশে বাচ্চা পয়দা করে বেড়াচ্ছে।

প্রচণ্ড যে হীনম্মন্যতা ছিল নিজের ভেতর, তা ধীরে ধীরে কমে এসেছে। জেসমিন ব্যাপারটা ধরে রাখলে সমস্যাটা তীব্র হয়ে থেকে যেতে পারত। প্রথম প্রথম যেমন নানা রকম সমস্যা হতো। এই যে তাদের বাচ্চা হচ্ছে না, এটা যেন তার না, জেসমিনের দোষ। মাঝে মাঝে সে কঠিন কোনো আচরণ করে ফেলত। আবার কখনো সে সরিও বলত। প্রতিবারই জেসমিন বলত—সরি কেন, হুঁ, সরি কেন?

তুমি তা জানো—কেন। জানো না?

না, জানি না।

মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপার মা হওয়া।

হয়েছে। কথা বন্ধ। চুপ।

তুমি সেটা হতে পারছ না। আমার কারণে।

আমাদের সময় ফুরিয়ে যায়নি আখলাক, আমাদের সময় ফুরিয়ে যায়নি।

আর সময়…।

এমন আক্ষেপ থাকেনি। আক্ষেপ থেকেছে, রোজকার ব্যাপার হয়ে থাকেনি, ফিকে হয়ে এসেছে।

একটা সন্তান দরকার। হঠাত্ কখনো সে বলে ফেলেছে।

জেসমিন সেটা মেনে নিয়েছে—হুঁ…। তুমি কি আরেকবার ডাক্তারের কাছে যাবে। … মানে, আমরা দুজনই যাব।

লাভ আছে কোনো? গেলাম না হয়। লাভ কী?

ক্ষতিও নেই কোনো।

আছে। আবার বেশি বেশি করে মন খারাপ হওয়া।

আচ্ছা থাক, বাদ। … দেখো, হবে।

আখলাক হাসত—হবে? স্বপ্নে দেখেছ?

হেসো না। স্বপ্নে পাইনি। আমার মন বলে।

আমার মন বলে না।

এভাবে বলে না আখলাক। বলতে নেই। সত্যিই আমার মন বলে।

এ ব্যাপারটা জেসমিনের মধ্যে আছে। এই যে বেশ অনেকগুলো বছর ধরে তারা বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, জেসমিন খুব একটা দমে যায়নি। এর মধ্যে নিজেকে ‘নিরাপদ দেশলাই’ ঘোষণা দিয়ে বসে আছে সে, জেসমিন বলছে—এসব ইয়ার্কি মেরো না, দেরি হচ্ছে, কিন্তু তার মানে এই না—হবে না।

জেসমিনের এই বিশ্বাসটা আখলাককে অবাক করত। বিশেষ করে জেসমিন যখন জিজ্ঞেস করত, হঠাত্ কখনো সে জিজ্ঞেস করত—বলো, সত্যি করে বলো, তোমার কি কখনো মনে হয় না—হবে? বলো।

তার এরকম মনে হতো না, আবার জেসমিনকে নিরাশ করতেও তার ইচ্ছা করত না। সে কখনো চুপ করে থাকত, কখনো হাসার চেষ্টা করত। সব সময় কি সব চেষ্টায় হাসি ফোটে মানুষের। তারও তেমন ফুটত না। জেসমিন, কী আশ্চর্য, সেটা খেয়াল করত না, বলত—এই তো তুমি বুঝতে পেরেছ।

এর উল্টোটা হতে পারত, আখলাক মানে। প্রায় সে থমথমে জেসমিনকে দেখত। প্রায় সে খিটমেটে মেজাজের জেসমিনকে দেখত। প্রায় সে বিষণ্ন মুখের জেসমিনকে দেখত, কিংবা কখনো, হতেই পারত তেমন, অস্বাভাবিক হতো না একটু, জেসমিনকে কখনো অনুচ্চ স্বরে সে বলতে শুনত—মা ডাক কি আমার শোনা হবে না?

এরকম মনে হতো তার, মনে হতো জেসমিন এরকম ভাবতেই পারে আর বলতেই পারে, এরকম ভাবতে ভাবতে, এমন না এরকম সে সব সময় ভাবত, মাঝে মাঝে, এরকম একটা ভাবনা তার ভেতর কাজ করত। আর ভাবনাটা তার ভেতর কাজ করতে করতে তার ভেতর এরকমও একটা ভাবনা কিংবা ইচ্ছাও বলা যায়, ইচ্ছা বলাই সঙ্গত হবে, এরকম ইচ্ছা—বাবা ডাক শোনার। সে মনে মনে কয়েকবার বিভিন্ন সময় ভেবেওছে—কেউ কি বাবা বলে ডাকবে না?

সে অফিস থেকে ফিরে ছুটে যাবে বিছানায় বসে থাকা তার বাচ্চার কাছে।

সে অফিস থেকে ফিরে দেখবে টলোমলো পায়ে তার বাচ্চা হাঁটছে।

কিংবা সে অফিস থেকে ফিরলে দরোজা খুলেছে তার মেয়ে—বাবা, এত দেরি করে ফিরলে যে। মা কিন্তু খুব…।

রাগ করেছে?

হুঁ। কথা বলবে না।

আহা, কথা কেন বলবে না! আমি কি ইচ্ছা করে দেরি করেছি?

সে আমি জানি না। … তুমি ফ্রেশ হও, আমি চা দিচ্ছি।

কিংবা সে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখল, তাদের মহল্লায় ছোট যে এক টুকরো খালি জায়গা সেখানে সমবয়সীদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি খেলছে তার ছেলে। সে দাঁড়িয়ে যেত, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত—আহা, তার ছেলেটা কী যে সুন্দর হয়েছে! আর সবার মধ্যে তাকে কত আলাদাভাবেই না চোখে পড়ছে।

অনেকেই তাদের দত্তক নিতে বলেছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই। তারা বলেছে—দেখো, এমন তো না, দত্তক কেউ নেয় না, এটা সারা পৃথিবীতে সেই কবে থেকেই না চালু আছে।

তোমরা যদি একদম ছোট্ট বয়সে কাউকে নাও, মনেই হবে না—সে তোমাদের না।

তোমরা চাইলে আমরা খোঁজ-খবর রাখতে পারি।

নিয়ে নাও, নিয়ে নাও। নিজের সন্তানের মতোই মানুষ হবে।

দরকার হলে দুজনকে নাও। একটা ছেলে একটা মেয়ে।

তার কিংবা জেসমিনের দত্তক নিতে ইচ্ছা হয়নি। জেসমিন বলত—আমাদেরই হবে। আর সে ভেতর থেকে সাড়া পেত না। তার মনে হতো, অন্যের, কার না কার, কে জানে, সন্তান কি কখনো আপন হয়! যতই সে বাড়ি ভরিয়ে রাখুক, তার জন্য সেই টান কি আদৌ তৈরি হবে, রক্তের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেটা হয়, তাকে কি কখনো আপন বা নিজের মনে হবে।

তার এক দূরসম্পর্কের চাচা, কালেভদ্রে দেখা হয়। একবার কী এক প্রয়োজনে আখলাক তার কাছে গিয়েছিল, তিনি প্রসঙ্গক্রমে কথা উঠলে বলেছিলেন—পৃথিবীতে কে কার আপন বলবে?

চাচা যা বলেছিলেন, তা পছন্দ হয়নি আখলাকের, একমত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সে বাড়ি ফিরে জেসমিনকে বলেছিল—পৃথিবীতে কে কার আপন, বলো তো।

জেসমিনের এই কথার পেছনের কথা বোঝার কথা না, সে বোঝেওনি—মানে!

ধরো, হাসপাতালে বাচ্চা বদল হয়ে গেল। দুই ফ্যামেলি অন্য অন্য বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরল, বাচ্চার প্রতি কারও ভালবাসা কি কম হবে?

মানে! … না, কিন্তু হঠাত্ এসব কথা কেন!

আখলাক, তার চাচার কথা বলল।

ওহ। শোনো, আমাকে বললে আমি সরাসরি বলে দিতাম—আপনার কথা আমার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি কী বলেছ?

সেভাবে কিছু বলিনি। তিনি বুঝেছেন ওনার কথা আমি নিচ্ছি না। … তবে সমস্যা হয়েছে কী জানো? আমার মধ্যে উনি একটা সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন।

জেসমিনের ভুরু কুঁচকে গেল। ভুরু কুঁচকে যাওয়া তার স্বভাব। আখলাক দেখেছে মাঝে-মধ্যে এমনিতেও জেসমিনের ভুরু কুঁচকে থাকে। তখন তাকে বেশ সুন্দর লাগে।

আমি ওনার কথা নিইনি, কিন্তু আমি ওনার কথাগুলো ভাবছি।

উনি রক্তের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেননি। এটা একটা কথা হলো!

তোমার আমার সম্পর্কও রক্তের না জেসমিন…।

জেসমিন একটু থমকাল—আহা…।

কিন্তু আমাদের সম্পর্ক রক্তের অধিক, তাই না?

আমিও সে-কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।

উনি আবার এই সম্পর্ককেও গুরুত্ব দেননি।

তাহলে ওনার কাছে কোনো সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ না।

উনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন—সম্পর্ক রক্তের হোক কিংবা রক্তের বাইরের, সব সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ আবার কোনো সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ না।… না, হলো না, উনি বলতে চেয়েছেন, এই পৃথিবীতে সম্পর্ক একটা সাময়িক ব্যাপার। যেটা সাময়িক, সেটার পেছনে রক্তের বাঁধন আছে কি নেই, তা নিয়ে ভাবাটা অর্থহীন।

সম্পর্কটা কি গুরুত্বপূর্ণ না?

আমার ধারণা ওনার কাছে সম্পর্ক যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়।

তাহলে উনি এ কারণেই বিয়ে করেননি, প্রয়োজনীয় মনে করেননি বলে?

তা-ই হবে।

একটা কথা বলি আখলাক। শোনো।

আমি কিন্তু ওনার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছি না।

না, সেটা না। আমি তোমাকে বিয়ে করেছি।

জানতাম না।

ইয়ার্কি না মেরে আমার কথা শোনো। আমার তোমার পরিচয় ছিল না, ভালোবাসা দূরের কথা। কিন্তু আমাদের ভেতর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। একটা সম্পর্ক…।

আমি বলেছিলাম ওনাকে। ঠিক এভাবে না। উনি বললেন—স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারটা ভালোবাসা না, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।

ভালোবাসা না? তুমিও তা মনে করো?

উনি বললেন—যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবেসে অজ্ঞান, তাদের পরস্পর বিয়ে না হয়ে অন্য দুজনের সঙ্গে হলেও তারা পরস্পরকে ভালোবেসে অজ্ঞান হতো।

কিন্তু যখন আমরা জীবন-যাপন করি, তখন কি এতসব ভাবি?

না। একমত হলো আখলাক।

ওনার কোনো কাজ নেই, তাই এতসব কথা। আখলাক, তোমার অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হতে পারত।

পারত। পারত না, আমি বলব না।

আমারও অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হতে পারত।

খুব পারত। তুমিই বলেছ, আমাকে নিয়ে দ্বিধায় ছিলে।

সে অন্য কারণে। কথা হলো—আমাদের বিয়ে হয়েছে। পরস্পরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা, বা তোমার চাচার ভাষায় নির্ভরশীলতা, তৈরি হয়েছে। এর মূল্য আছে?

মূল্য আছে জেসমিন। এর মূল্য সত্যিই অনেক।

আমাদের কাছে এটা মূল্যবান বলেই আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না।

না, এই সম্পর্ক আমাদের বেঁধে রাখবে।

সেই দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে আখলাকের চোখ ভিজে উঠল। আজ যদি সে মারা যেত, কী হতো তা হলে। জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলত না, তার কথা ভাবতে ভাবতে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠত না, মূর্ছা যেত না সে প্রবল শোকে, আর তাকে কি বলত না, তাকে দাঁড় করাত না আসামির কাঠগড়ায়—বলো আখলাক বলো, তুমি না কথা দিয়েছিলে!

কিছুই বলার থাকত না তার।

বলো তুমি, তুমি না বলেছিলে—এই সম্পর্ক আমাদের বেঁধে রাখবে!

তার কিছুই বলার থাকবে না।

যদি ও কথাই তোমার কথা ছিল, তবে বন্ধন ছিঁড়ে তুমি চলে গেলে কেন!

কীইবা বলত সে, কীইবা তার বলার থাকত!

হাঁটতে হাঁটতে সে অবশ্য এখন স্বস্তি বোধ করছে, ঠোঁটের কোণে হাসিও ফুটে আছে তার, বাড়ি ফিরে জেসমিনকে সে বলতে পারবে—একটা প্রশ্ন আছে আমার, উত্তর দিতে পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি।

বলো, কে আমাকে ফিরিয়ে আনল?

কে? এভাবে জেসমিন জিজ্ঞেস করতেই পারে।

তোমার ভালোবাসা তোমার ভালোবাসা।

আমি জানতাম, আমি জানতাম। আমি বলিনি তোমাকে তোমার চাচার কথা ভুল?

আমি বলিনি সম্পর্ক আমাদের বেঁধে রাখবে?

বলেছ, বলেছ।

এখন জরুরি কথা আছে তোমার সঙ্গে।

বলবে। রেস্ট নাও। তুমি কি গোসল করবে? করে নাও। ভালো লাগবে।

নেব। আগে কথাটা বলে নিই।

খেয়েছ? কী বলি, খাবে কীভাবে, পড়ে তো ছিলে নোংরার মধ্যে। যাও।

আহা…।

আখলাক, যাও প্লিজ। … একটু বসো। পানি গরম করে দিই। তুমি তারপর গোসলটা সেরে নাও। তারপর খাবে।… আমিও খাইনি কিন্তু। তারপর আমি তোমার কথা শুনব।

তার সত্যিই গোসল করতে ইচ্ছা করবে। ক্ষিধাটা মরে গেছে। যাক। গোসল সেরে নিতে না পারলে অস্বস্তি হবে। সেই কতক্ষণ সে নোংরার মধ্যে পড়েছিল। ভাবলে তখনকার কথা মনে পড়ে, এই এখনই তার হাসি পাচ্ছে, তখন নিশ্চয় আরও পাবে। আখলাক ঠিক করল, জেসমিন গোসলের কথা বললে সে বলবে—তুমিও চলো।

জেসমিন কী বলবে তখন—যাব মানে! কোথায় যাব?—এরকম কিছু?

গোসল করতে চলো।

আমি দুপুরে গোসল করেছি।

আমার সঙ্গে করনি। আমি ছিলাম না।

বাহ, আবদারের বাটখারা। … যাও।

সে হয়তো জোর করেই জেসমিনকে নিয়ে যাবে, টানতে টানতে, জেসমিন বলবে—এসবকে কী বলে জানো? এসবকে বলে অসভ্যতা।

যা-ই বলুক। আমার ভালো লাগছে। … তোমার লাগছে না?

বিচ্ছিরি।

শোনো একটা কথা বলি।

নোংরা কিছু বলবে না কিন্তু।

নোংরা মানে! … না না, ওসব কিছু না।

তোমাকে বিশ্বাস নেই। বলতে হবে না।

আহা, বললাম তো ওসব কিছুই না।

তাহলে বলো।

আখলাকের মনে হলো, এসময় সে একটু বিরতি নেবে।

কী? … কী বলবে?

জীবনটা বদলে ফেলব জেসমিন।

মানে! কী বদলাবে?

জীবন। তোমার জীবন, আমার জীবন।… এই যে আমাদের জীবন… জেসমিন, এই জীবন বদলে ফেলব।

আর একটা বাঁক ঘুরলেই বাড়ি। আখলাক দাঁড়াল। নিজের বাড়ি দেখতে তার খুব ইচ্ছা করছে, বাড়ির ভেতর আছে জেসমিন, কিন্তু দাঁড়াল আখলাক। একটু গুছিয়ে নেয়ার দরকার কি আছে? যা সে বলবে জেসমিনকে, সেই কথাগুলো? মাথা নাড়ল আখলাক, একটু ভেবে মাথা নাড়ল আখলাক, না, এ আর ভাবার কী আছে, কিছু কথাই তো, এলোমেলোভাবে বললেও অসুবিধা নেই, জেসমিন বুঝলেই হলো, জেসমিন বুঝবে। তবে সে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবে, বুঝতে চাইবে কী আসলে বলছে আখলাক। জিজ্ঞেস করুক, একবার কেন, বার বার করুক, সে বার বার বলবে, বার বার বলতে তার ভালো লাগবে, আর তার যে কথা, সে খুব সহজ কথা।

সে অবশ্য একটু ভাব নেবে, এমন—তুমি বার বার কেন এই সহজ কথাটা জিজ্ঞেস করছ!

কারণ আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

আমি খুব সহজ কথা বলেছি। এই সহজ কথা বুঝতে না পারার মতো কিছু না।

তবু। তুমি আবার বলো।

বার বার বলব?

বার বার কেন! আমি বুঝতে পারলে তোমার আর বলতে হবে না।

আমার যে বার বার বলতে ইচ্ছা করছে?

তুমি কি সেই আগেকার… ওই যে রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না… আটকে যেত প্লেয়ার, একই কথা বার বার বাজত।

আমি তোমাকে একটা সিডি করে দেব।

কী? … বাসায় সিডি প্লেয়ারই নেই। কত বলি তোমাকে।

কিনব।

আর কিনবে!

সত্যিই কিনব। তবে তোমার গান শোনার জন্য না।

সাজিয়ে রাখবে?

না, ওই যে সিডি। একটা সিডি করে দেব তোমাকে। তোমার শুনতে হবে না।

বার বার?

বার বার।

একি বার বার শোনার কথা?

এ বার বার শোনার কথা না? ভাবো তো। ভাবো।

জেসমিন ভাববে। ভাবতে ভাবতে এক সময় মাথা দোলাবে—আবার বলো।

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বিদেশ চলে যাব।

সে সত্যিই এরকম ভেবেছিল। যখন বাড়ির দিকে ফিরছিল সে, তখন। সে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিল, এই পোড়ার দেশে সে আর থাকবে না। এই দেশে ছিনতাইকারী, এই দেশে তার প্রমোশন হয় দেরিতে, এই দেশে সে বউকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারে না, এই দেশে আরও কত যে সমস্যা, আপাতত অবশ্য ছিনতাইকারীর সমস্যাই প্রধান, কী অনিশ্চয়তায় পড়ে যেতে হয়—এতসব ঝামেলা পোহানোর চেয়ে বিদেশ চলে যাওয়া ভালো না?

বিদেশ যাওয়া যে মুখের কথা না, সে জানে। তবে তার দূরসম্পর্কের ভাই আছে। সেই ভাই সেই কবে যে চলে গেছে কানাডা! এখন সেখানে তার রমরমা অবস্থা। ভাই হলেও বয়সে অনেক বড়, মুরুব্বি। আখলাক ও সমবয়সীরা একটু সমীহ করেই কথা বলত, তা, সেই ভাই, আল্লাহ মালুম কোথায় তার নম্বর পেল, একদিন ফোন করে বসল—চিনতে পারবি না আমাকে, আমি সালামাত। … হ্যাঁ সালামাত ভাই।

সালামাত ভাই একসময় বললেন—একটা কথা, তোদের পরিকল্পনাটা কী? ওই দেশেই পড়ে থাকবি? … যদি মনে করিস, বলিস আমাকে। আমি তোদের এ দেশে আনার চেষ্টা করব। বৈধভাবেই। সময় লাগবে। কিন্তু পারা যাবে।

জেসমিন বলেছিল—ধাত্, বিদেশ আমার ভালো লাগে না।

আমারও না। অচেনা একটা জায়গা।

কিন্তু তুমি ভাইকে না বললে না।

একটু ভেবে দেখতে দোষ কী! যাক না কিছু সময়।

তারপর তারা মাঝে মাঝে ভেবেছে। হঠাত্ কখনো।

কানাডা নাকি খুবই সুন্দর একটা দেশ।

শুনেছি।… আর সত্পথে পরিশ্রম করলেই পয়সা।

যাওয়া যায়, তাই না? যাওয়া মানেই তো নিজের দেশকে ভুলে যাওয়া না।

না, তা না। নিজের দেশ তো নিজের দেশই।

অনেকে যায়, টাকা-পয়সা কামিয়ে চলে আসে।

মিনহাজ ভাইয়ের কথা মনে আছে? অনেক পয়সা নিয়ে ফিরেছে।

তাছাড়া অনেকে আবার একটা ব্যবস্থা করে রাখে। ধরো এই দেশে আর থাকাই গেল না, চলে গেল কানাডা বা অন্য কোথাও।

তোমার দেখছি বেশ যাওয়ার ইচ্ছা।

মাঝে মাঝে মনে হয় তোমারও কম না। সালামাত ভাইকে বলব কি না ভাবছি।

সালামাত ভাইকে বলা হয়নি। না হোক, যেকোনো সময়ই বলা যায়। ফিরতে ফিরতে এরকম ইচ্ছা তীব্র হয়েছিল আখলাকের, বলবে। তারপর আবার উবে গেছে সে ইচ্ছা, কে জানে কেন। শুধু ইচ্ছাটা তার নেই, এটাই কথা। সে তাই জেসমিনকে বলবে—প্রথমে ভেবেছিলাম বিদেশ চলে যাব। তারপর মনে হলো, না, বিদেশে না, এই এখানেই।

সেই ভালো, আমি এখনো বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করতে পারিনি।

তুমি রাজি থাকলেও যেতাম না জেসমিন। আমার মন বলছে, এখানেই পারা যাবে।

যাবে, নিশ্চয়, তুমি যখন এত জোর দিয়ে বলছ।

কেন, তোমার নিজের কি তা মনে হয় না?

হয়।… হ্যাঁ আখলাক, হয়।

এটাই কথা। এখন থেকে জেসমিন—নতুন করে শুরু করা নতুন জীবন আমাদের।

জেসমিন বিস্তারিত জানতে চাইতে পারে নতুন করে শুরু করা নতুন জীবন বলতে সে আসলে কী বোঝাচ্ছে! জানতে চাইলে একটু ঝামেলা। কারণ এটা ঠিক বুঝিয়ে বলার মতো কিছু না। এটা অনেকটাই বুঝে নেয়ার একটা ব্যাপার। এটা নিজের ভেতরে অনুভব করার ব্যাপার—হ্যাঁ, নতুন করে শুরু করা নতুন জীবন। না হলে, বুঝিয়ে বলাটা মুশকিল। জেসমিন বুদ্ধিমান, তাকে নিশ্চয় বোঝানোর প্রয়োজন পড়বে না। যদি এমন হয়, জেসমিন ঠিক বোঝার জন্য জিজ্ঞেস করছে না, করছে কৌতূহল থেকে, সে কৌতূহল সে মেটাতে পারবে।

এই ভেবে আখলাক বড় করে শ্বাস নিয়ে বাঁক ঘুরে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পা বাড়িয়েই সে চমকে গেল। তাদের বাড়িটা পাঁচতলা। তারা থাকে তিনতলায়। এখন রাত অনেক, পুরো বাড়িই অন্ধকারে ঢেকে থাকার কথা, তা, একটা-দুটো বাড়িতে একটা দুটো ঘরে অনেক সময় সারা রাতই আলো জ্বলে, সে অন্য ব্যাপার; তবে এখনকার ব্যাপারটাও বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তাদের তিনতলায় পুরোটাই আলোয় ভরা, বাকি তলাগুলোতেও আলো জ্বলছে, আবার বাড়ির সামনে কিছু লোকের জটলাও।

আরেকটু এগিয়ে আখলাক জটলার কয়েকজনকে চিনতে পারল। তারা প্রায় সবাই তার বন্ধু, দু-একজন সহকর্মীও আছে। ব্যাপার কী? তার ভেতর—নতুন করে নতুন জীবন শুরু করা—এই যে ভাবনাটা ঘুরছে, জেসমিন কী কোনো মন্ত্রবলে জেনে গেছে? জেনে বন্ধুদের ফোন করে আনিয়েছে—এখন সে ফিরলে সবাই মিলে সেলিব্রেশন হবে। বন্ধুদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞবোধ করল সে। তার মাথায় একটা নতুন ভাবনা—এই ভাবনা উদযাপনের জন্য এত রাতে বন্ধুরা হাজির! আহা কী চমত্কার তার বন্ধুভাগ্য!

এখন এক কাজ করতে হবে। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাকে তেতলায় উঠে যেতে হবে। সেটা পারলে মজার একটা ব্যাপার হবে। কাজটা অবশ্য কঠিন। কেউ না কেউ তাকে দেখে হয়তো ফেলবেই। তাহলে কী কাজ করবে সে? একটা বুদ্ধি বের করা দরকার।

কোনো বুদ্ধি মাথায় আসার আগেই তাকে পাশ কাটিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি থামল তাদের বাড়ির সামনে। পুলিশের গাড়ি কেন?

হ্যাঁ, পুলিশের গাড়ি কেন!

আর পুলিশের গাড়িটাকে তার বন্ধুরা সবাই ঘিরেই বা ধরল কেন?

জেসমিনের কিছু হয়নি তো? তাকে যেমন ছিনতাইকারী ধরেছিল, বাসায় কি তেমন চোর বা ডাকাত পড়েছিল? খুবই চিন্তা হলো আখলাকের। সে দেখল তার অসহায়ও লাগছে খুব। পুলিশের আসার কি আর কোনো কারণ থাকতে পারে?

আখলাক ভাবল, আরেকটু এগোবে সে। এক পা সে বাড়াল, পাশ থেকে সরু অথচ সুরেলা গলায় কেউ বলে উঠল—বাবা।

আখলাক ঝট করে পাশে তাকাল। ৫/৬ বছরের একটা ছেলে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। অসম্ভব সুন্দর তারা, তবে দুজনই খুব বিষণ্ন, একটু বোধহয় কেঁদেছেও তারা, এই অল্প আলোয় যদিও সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। আখলাকের মনে হলো তারা যমজ।

কে? আখলাক জিজ্ঞেস করল।

ছেলেটা বলল—বাবা, আমি তানিম।

মেয়েটা বলল—বাবা, আমি টুম্পা।

বাবা বলছ মানে! তোমরা কারা?

তানিম আর টুম্পা পরস্পরের দিকে তাকাল, আখলাকের দিকে ফিরল—বাবা, তুমি সত্যিই আমাদের চিনতে পারছ না!

নাহ। ‘নাহ’ বলতে আখলাক অবশ্য বেশ ইতস্তত করল।

মনে করে দেখো বাবা, একটু মনে করে দেখো।

তুমি তানিম… তুমি টুম্পা?

তানিম আর টুম্পার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর আখলাকেরও মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল সে আর জেসমিন মিলে বেশ ক-বছর আগে ঠিক করেছিল, তাদের ছেলে হলে তারা নাম রাখবে তানিম, মেয়ে হলে টুম্পা।

আখলাক হেসে ফেলল—তা-ই বলো! তা, তোমরা এলে কোত্থেকে!

বাবা, আমরা আসিনি, আমরা ছিলাম।

তাও ঠিক তাও ঠিক। আখলাক ঘন ঘন মাথা দোলাল।

কিন্তু বাবা, বাসায় আর ঢুকতে পারছি না।

কোন বাসায়?

কী বলো বাবা, আমাদের বাসায়।

ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কী হয়েছে বাসায়?

বুছতে পারছি না।

তোমাদের কেউ বের করে দিল।

না তো বাবা। হঠাত্ দেখলাম আমরা বাইরে।

তারপর?

তারপর দেখলাম আমরা আর ফিরতে পারছি না।

ওহ।

তারপর আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

চিন্তায় পড়লাম।

এখন আমরা কী করব বাবা?

অপেক্ষা।

কী করব বাবা?

আসো, তোমরা দুজন আমার দু-পাশে দাঁড়াও। ভিড়টা কমুক। আমাদের বাসায় আমরা ঢুকব না মানে!

দু-পাশে তানিম আর টুম্পাকে নিয়ে আখলাক অপেক্ষা করতে লাগল।