আমার প্রথম পাপ

amar prothom papপ্রত্যেকের জীবনেই ‘প্রথম পাপ’ বলে একটি গোপনতম ঘটনা তো থাকেই। কবে সেই ঘটনাটা ঘটেছিল মনে পড়ে? মনে করবার চেষ্টা করো। কোন বয়েসে প্রকৃত পাপটি তুমি করলে! শৈশবের ঘটনা নিশ্চয়। বয়েস তখন কত যেন! মনে করো, মনে করো।

হ্যাঁ, পাপ। এই যে ‘পাপ’—সেটাকে বাংলা ভাষায় অন্য কোনও শব্দে ঠিক ব্যক্ত করা যায় না। ‘অন্যায়’ শব্দটি পাপের প্রতিশব্দ নয়। ‘আমি অন্যায় করেছি’ আর ‘আমি পাপ করেছি’—কিছুতেই এক কথা নয়। ‘অন্যায়’ শব্দের জোর অনেক কম। পাপ মানুষের নির্জ্ঞান মন অবধি যায়। পাপ নিজেরই কাছে অকাট্য; তার অপরাধবোধের মাত্রা অন্ধকার গর্তের বিষধর সাপের মতো গেঁড়ে পাকিয়ে খল-অবসরে পড়ে থাকে। ওটাকে অবচেতনা থেকে নড়ানো কঠিন। যখন মনে হয়, ওটা আর নেই, মন থেকে মুছে গেছে; হঠাত্ তখনই একদিন ওটা, ওই পাপ মনের অতল থেকে নাড়া খেয়ে মনের উপরিভাগে হঠাত্ ‘ভুস’ করে ভেসে ওঠে। আমরা শিউরে উঠি।

পাপপুণ্য ধর্মীয় লব্জ। কিন্তু নাস্তিকও ‘পাপ’ কথাটা দিব্যি ব্যবহার করতে পারে। যা হোক। যদ্দুর মনে পড়ছে, তখন পাঠশালায় পড়ি। প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মাত্র। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমার বয়েস বড়জোর সাত। বা ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। বয়েস ৮। আর যদি ক্লাস ‘ফোর’ হয় তা হলে বয়েস ৯।

ওই বয়েসে এক শিশু কী পাপই বা করতে পারে! তা ছাড়া এমন এক শিশু যে কিনা একা-একলা খেলা করতে ভালোবাসত! ঠাকুমা বলত, ‘তুই একা-একা খেলা করতিস বাপ! ধুলো নিয়ে খেলতিস ভাড়ুলতলায়। নয়তো ঘোড়ানিমের নিচেয়।’

ধূলিখেলা কথাটা আমার জীবনে এক ছেলেবেলার বাস্তব। কোনও কল্পনা নয়। ছ’ বছর বয়েস পর্যন্ত আমি ছিলাম আমার জন্মগ্রামে। সেখানে ভাড়ুল গাছের তলায় নিশ্চয় ধুলোখেলা করেছি। জন্মগ্রামের নাম নতুন হাসানপুর। আর তারপর শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন (মধ্য তিরিশ পর্যন্ত) যে গ্রামে কেটেছে, তার নাম টেকা (উচ্চারণ ট্যাকা)। যে গ্রাম আমার ধাত্রী বা ধরিত্রী-গ্রাম।

কিন্তু পাপটা করলাম কবে? তখন ক্লাস থ্রি? নাকি টু? কবে?

৭ থেকে ৯-এর মধ্যে ওই গোপন গর্হিত কর্মটি করে ফেলে একেবারে আপাদমস্তক চমকে উঠলাম। বুকের ভেতরে ছলাত্ করে বয়ে গেল রক্ত। এ কী করলাম!

ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে, বলা যায় শুয়ে রয়েছে আমার ওই পাটকাঠির গাড়িটা, যার নাম জোড়া রামধনুর সাইকেল। দুটি পাটকাঠি জোড়া করে দুই মুখে বেঁধে তয়ের করতে হয়। দুইটি পাটকাঠি (শাঁসালো পাটের) মাঝারি মোটা হওয়া চাই। দুই মুখে বাঁধা হলো ফেঁসো পাকিয়ে নিয়ে। তারপর কমবেশি সোয়া হাত লম্বা আর একখানি পাটকাঠি খড়ে করে বসানো হবে ওই দুটি বাঁধা পাটকাঠিকে টেনে ধনুকের ছিলার মতো করে, তারই, ওই জোড়া পাটকাঠির প্রসারিত ফাঁকে ছিলায়, যেন খানিক তিরের মতো কেতায়।

জোড়া পাটকাঠির প্রসারিত মাঝখানে সোয়া হাত কাঠির যে তির দণ্ডটা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটার দুই মুখ হেঁসো দিয়ে চেঁছে নিতে হবে, যাতে করে দুই মুখে আঁকড়ি মতন হয়, যাতে করে ওই তির দুই মুখে জোড়া কাঠি ছ্যা ধরে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

একটা অর্ধবৃত্ত রামধনুর তলায় যদি আরও একটি অর্ধবৃত্ত রামধনু উল্টা করে জোড়া দেওয়া যায় তা হলে জোড়া পাটকাঠির চেহারা দাঁড়াচ্ছে জুড়ে যাওয়া দুটি রামধনুর (উল্টা হয়ে মিলিত হওয়ার) মতন। এটাই পাটকাঠির জোড়া রামধনু। এতে ঝোলানো হয়েছে গঁদের আঠা দিয়ে জোড়া কাগজের নানা রঙের শেকল ও ফুল।

কাঠির ইন্দ্রধনু শুয়ে আছে মণি সরকারের বাড়ির বাইরের কুয়োতলার ঘাসে। ওটা একেবারে তেমাথা রাস্তার কিনারায় বসানো। ওটা কি কোনও সরকারি কুয়ো?

তা হলে কি মণি সরকারের খচ্চায় হয়েছে কুয়োটা?

না, ওটা আসলে কারও দানে হয়েছে, কোনও এক পুণ্যবতী মৃত স্ত্রীলোকের নামে, কোনও মরহুমা (স্বর্গীয়া)’র স্মরণে। এমন কুয়ো আমার ছেলেবেলায় গ্রামে-গ্রামে দেখা যেত। তখন গ্রামে নলকূপ আসেনি। গঞ্জে হয় এসে গেছে, নতুবা আসব আসব করছে।

এই তেমাথাটা তিনটে গ্রামকে জুড়েছে। তারপর পথ গেছে গ্রামান্তরে, গেছে দিগন্ত পেরনো সুদূরতায়। চারদিকে দিকে-দিগন্তরে সবই ধূলিগ্রাম। ‘এ পৃথিবী মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি’। তেমনই তো মনে হতো ওই ছেলেবেলায়।

কিন্তু আমি একী করলাম! চৈত্রমাস। আজ জুম্মাবার। অর্থাত্ শুক্রবার। এই দুপুরে রাস্তায় লোক কম। জুম্মার নামাজ বোধহয় শেষ হয়ে গেল। লোক, যারা নামাজি, তারা মসজিদের প্রাঙ্গণ থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করবে! আমাকে তাদের যদি কেউ এখানে এই অবস্থায় দেখে ফেলে! তখন আমি অর্ধেক আস্তিক। মনে মনে খোদাকে ডেকে উঠলাম, ‘হে খোদা! আমায় যেন কেউ দেখে না ফেলে! মতি মিয়ার আমবাগানের মিছরি আম গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াই! বান্দাকে রক্ষা করো হে রব—রব্বানা!’

এই বলে ঘাসের ভিতর থেকে দ্রুত রামধনু কাঠি সাইকেলটা তুলে নিই হাতে। কুয়োকে ঘিরে যে গোলাকার পাটাতন, তার উপর পড়ে নেই ওটা। পেতলের সুদৃশ্য বালতিটা। যার ডাঁটে বাঁধা থাকে মতি বাবুর বউয়ের হাতে টাকুরে-কাটা রশি, পাটের রশি। ওই রশি সহায়ে বালতি দ্বারা ঠাণ্ডা-পেয় জল তুলে পথ চলতি তৃষ্ণার্ত তার তৃষ্ণা মেটায়। আমি সেই দড়া-বালতি কুয়োয় আচমকা ফেলে দিলাম মজাবশত! কী আশ্চর্য! এটা কি আদৌ মজার ব্যাপার! হা খোদা! কার সঙ্গে এই তোমার মজা-মজ্জাকি করলাম হা গফুর-উর রহমান, হে অনন্ত দয়াবান! হে রব!

ভয়ে ভয়ে তাকাই মণি সরকারের বাড়ির দরজার দিকে। ওটা ভেতর থেকে রুদ্ধ! কেউ যদি হঠাত্ বার হয়ে আসে! বাড়ির কোনও বউ! বা ছেলেরা কেউ! দেখবে দড়াবালতি নেই। চাষ ফেলে যে কৃষক এই পথে ঘরে ফিরবে, যার কিনা তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে, সে তো এখানে এসে কাঁধ থেকে জোয়াল নামিয়ে বলদকে ছেড়ে দিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে খেতে চাইবে!

তেষ্টায় বুক ফেটে যদি কৃষকের মৃত্যু হয়!

হঠাত্ উত্তরের মাঠ থেকে এক কৃষককে সত্যিই আসতে দেখা যায়। দূরে পথের বাঁকে তাকে দেখা গেল। হা ঈশ্বর এখন কী হবে!

আমি অর্ধশতাব্দীরও আগের কথা লিখছি এই চিড়িয়াঘরে। ৫৭-৫৮ বছর আগের গ্রামগুলি ছিল সকলই ধূলিগ্রাম। শিশুরা পথের ধুলা আর নদীর জল গায়ে মাখতে ভালোবাসত। নদীর দেশের ছেলে বলে শৈশবেই সাঁতার শিখে গিয়েছিলাম। সে কথা এখন থাক।

আমি এখন স্মৃতির কমলা রঙের আলোয় নিজেকে দেখছি মতি মিঞার বাগানে। আমার হাতে ধরা পাটকাঠির চাকাবিহীন রামধনু সাইকেল। কষ্ট হচ্ছে, বুক ফেটে যাওয়ার মতো কষ্ট হচ্ছে। আমি খোদাকে ডাকছি বসে, কিন্তু ওই বয়েসে খোদা সম্পর্কে বলতে কি স্পষ্ট অনুভূতিই তৈরি হয়নি। খোদা রাত্রির ছায়াপথের চেয়েও দুর্বোধ্য সুদূরতা। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, খোদাকে না বুঝলেও কী করে যেন মনের মধ্যে ‘পাপ’ জিনিসটাকে বুঝে গিয়েছি। কারণ, দাদিমা আমাকে বলেছেন, ‘দেখ ভাই, দুই কাঁধে দুই ফরিস্তা, আইন মতন করেন ব্যবস্থা।’

‘—বলো ভাই, দুই কাঁধে দুই ফরিস্তা আইন মতন করেন ব্যবস্থা। বলো, বলো, ভাই!’

আমার দাদিমা অর্থাত্ ঠাকুমাই আমার প্রায় সব ব্যাপারের গাইড; একজন বাস্তব ফরিস্তা। তাঁর আমি চয়নের মণি। আমাকে এক দণ্ড কাছছাড়া করতে চান না। আমাকে বাদ দিলে যেন তাঁর জীবনটাও হয়ে যায় ‘নৈরাকার’।

সেই তিনিই ‘ক্বারীমন’ বেওয়া (বিধবা) ওরফে মন বেওয়া আমাকে জীবনের একেবারে গোড়াতেই শেখালেন, দুই কাঁধে দুই ফরিস্তা। মনকির ও নকির। একজন পুণ্য ও আরেক জন পাপের দেবদূত দুই কাঁধে বসে রয়েছেন। এঁরা দুইজন সর্বক্ষণ তোমার প্রতিটি কাজ লক্ষ করছেন। তোমার পাপকাজ। তোমার পুণ্যের কাজ। তোমার ভালো। তোমার মন্দ। তুমি ঘুমিয়ে পড়লেও ওঁরা ঘুমাবেন না। জেগে থাকবেন। তুমি যদি ঘুমের মধ্যেও কোনও পাপ কর, তাঁরা টের পাবেন। বড়ই আকুল-ব্যাকুল করা কথা দাদি আম্মা!

যা হোক। খোদাকে বোঝবার অনেক আগেই আমার শিশুমনে পাপবোধের জন্ম হলো। এ এক সাংঘাতিক অকাট্য অবস্থা! দাদিমা বলছেন যখন তখন তো মনকির নকির আমার কাঁধে চেপে আমার পাপকথা/আমার পুণ্যকথা লিখে চলেছেন।

কাঁধ থেকে পাপপুণ্যের ওই দুই ফরিস্তাকে নামানোর সাধ্য কি একজন বালকের আছে? ‘রব’ বা ঈশ্বরকে রাত্রির নক্ষত্র-খচিত আকাশে হা করে চেয়ে থেকেও সত্যি বলতে কি অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু পাপবোধে পুড়ছি, পাপের দাহ সাংঘাতিক বস্তু। এই অবস্থা কি একজন হিন্দু বালকের হয়? আমার সহপাঠী বন্ধু। ঈশান কর্মকারের হয়? মধুসূদন ভাস্কর ওরফে ফড়িং ছুতারের হয়? ফড়িং কাকা আমার বাবার বন্ধু, বয়েসে বাবার ছোট। বাবাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকেন। আমার বাবা একজন শিক্ষক। তাই ফড়িং কাকা বাবাকে ‘মাস্টারদা’ বলেন। ফড়িং কাকার ডাকনাম ফড়িং; ভালো নাম মধুসূদন লিখলাম। আসল বা ভালো নামটা এই মুহূর্তে মনে এল না।

আমার নানাজি ছিলেন একজন ছুতার। বড় মামা ছুতার। মামাবাড়ির রাস্তার ওপারে ছিলেন ভিখু (সুনন্দ) ছুতার-ভিখু এবং নানাজি একসঙ্গে কাঠের কাজ করতেন। নানাজির জমিজিরেত ছিল। তার মানে তিনি চাষি এবং ভাস্কর একসঙ্গে। আমি ওই ভিখু মামার কোলে বসে অতি শৈশবে ‘গুনাই যাত্রা’ ‘রূপবান’ যাত্রা শুনেছি। ভিখু মামা হারমনিয়াম এবং তবলা দুইই বাজাতে পারতেন। তাঁর বাড়ির বাইরের উঠোনে যাত্রার রিহার্সলের আসর বসত।

আমার মামাবাড়ির গ্রাম আর আমার জন্মগ্রাম একই গ্রাম। নতুন হাসানপুর। আমার বয়েস যখন ৬ বছর, তখন বাবা ওই নিজ গ্রাম ছেড়ে অর্থাত্ নতুন হাসানপুর ছেড়ে সপরিবারে ২টি নদী পেরিয়ে ‘টেকা’ (উচ্চারণ ট্যাঁকা) গ্রামে চলে আসেন। এই গ্রামেরই ছুতার পাড়ার বাসিন্দা ফড়িং বা মধু কাকা। মনে পড়ছে, এই ফড়িং কাকারই ভাস্কর-হাতে তৈরি হয়েছিল আমার মায়ের কোরানদানি ‘রেহেল’।

যে-কাঠের কাটিং থেকে ওই রেহেলখানি কাকা বানালেন, সেটা কিন্তু কাঁঠাল বা বাবলা কাঠ ছিল না। ছিল দামি ভোলা কাঠের জিনিস। কিন্তু এ ব্যাপারে ঘটনা ঘটে নিতান্ত চমত্কার।

ফড়িং কাকা নিজে থেকেই মাকে বলেছিলেন, ‘শুনুন বউদি, রেহেল পাবেন কিন্তু সময় লাগবে। হাতে ঢের কাজ একেবারে লাইন দিয়ে আছে। রেহেলের দাম লাগবে না। কিন্তু কোরান পাঠের পর আমার নামে অন্তত এক ‘পারা’ দোয়া বক্সাবেন। কথা দেন।’

মা বলল, ‘বেশ দিলাম। কিন্তু তুমিও দিলে কথা। মনে রেখো।’—‘তুমি কি বউদি ফড়িংকে কড়ার করাচ্ছ?’ হাসতে হাসতে বললেন মধু ভাস্কর।—‘তা বইকি ফড়িং। কড়ার তো তুমিই করালে ভাই!’ বললে মা। তারপরই শুরু হলো রেহেল তৈরির গল্পটা।

কথা দিয়ে কথা-দেওয়ার কথা যেন ভুলেই গেলেন ফড়িং কাকা। সপ্তা যায়। মাস যায়। রেহেল আর আসে না। আমাদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে বস্তায়-ভরা অস্তর (হাতিয়ার) কাঁধে কাকা যাচ্ছে দেখে আমি চেঁচিয়ে মাকে ডেকে উঠি, ‘মা! ফড়িং কাকা!’

এই রকম ডাকবার কারণ হচ্ছে, রেহেলের জন্য মা আমাকে মাঝে-মাঝেই ছুতার পাড়ায় কাকার ওখানে পাঠাচ্ছে। আমি পাটকাঠির সাইকেল নিয়ে কাকার কাছে যাচ্ছি। গিয়ে পেয়ারা ডালিম-বেলতলায় দাঁড়াচ্ছি। কাজ করতে করতে থেমে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে দেখে নিয়ে ফড়িং কাকা শুধু বলে উঠলেন, ‘ওহ্ তুমি! এখনও জিনিস হয় নাই শান্তু! পরে আসিও!’ এই বলে ছোট ‘আরি’ দিয়ে ঘসর-ঘসর করে কাঠ চিরতে থাকলেন কাকা। আমাকে ‘শান্তু’ বলেই ডাকতেন কাকা। আমাকে কি তাঁর নিতান্ত শান্ত মনে হতো! বাইরে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ছিলাম খুদে একটা শয়তান। জ্বালাতুনে, দুষ্টু। কিন্তু তাই বলে কুয়োর দড়া-বালতি ওইভাবে চোরের মতো কুয়োর জলে ফেলে দেবো ? মনকির-নকির কি টের পাবেন না?

যে-আমি রেহেলের খোঁজে বার বার ছুতার, আমার বাবার বন্ধু ফড়িং কাকার কাছে গেছি, সেই কিনা এই কাজ করল! কাঠের একটি কোরানদানি একটা পবিত্র বস্তু, যা বানাবেন মধুসূদন ভাস্কর; তা থেকেও কি আমার মনে সেদিন কোনও ধর্মবোধ জাগেনি?

সওদাগর সেখের বাড়ির ওখানে পথের যে-বাঁক, কদমতলার তে-মাথার পথের পরে এই বাঁকটা, সেখানে ভেসে উঠল চমত্কার মন্ডলের পুরো অবয়ব, একজন গরিব চাষি। নিজের বিঘা ৬ জমি আছে। ওর বলদ জোড়া অত্যন্ত বলবান। নিজের জমি বাদে বাকি সময় অন্যের জমিতে ভাড়ায় হাল বেচে। কুয়োর জল নিজে খাবে। কুয়োর পাশে ছোট নাদায় জল দেবে বলদকে খেতে।

হায় দাদিমা! এখন আমি কী করব? পালাব? কিন্তু কীভাবে? চমত্কার এগিয়ে এসেছে নিতান্ত কাছে। ওর দু-চোখ পেতলের বালতিটা খুঁজছে।

চমত্কার কাকার গলার স্বর যাত্রাপালার নায়কদের মতো ভারী, আঁশযুক্ত এবং কতকাংশে নাটুকে; গরিবের এমন কণ্ঠস্বর সচরাচর শোনা যায় না। তাঁর মুখ না দেখেও বলা যায়, কে কথা বলছেন! আমার কেবলই মনে হতো কোনও বড়লোক কথা বলছেন।

ইচ্ছে করেই তিনি নাটক করতেন কিনা, নাকি আপনা থেকেই গলার স্বরে ‘নাটক’ হয়ে যেত বলা শক্ত। কখনও মনে হতো, গলায় ইচ্ছে করেই সুর খেলাচ্ছেন, স্বর ওঠা-পড়া করাচ্ছেন আর তাইতেই একটা আত্মমগ্ন সুখ পাচ্ছেন, ফের মনে হতো, না, তা নয়, আসলে ব্যাপারটা যা ঘটছে, সবটাই খাঁটি। ভগবান, চমত্কার চাচার গলাটাই দিয়েছেন অমন চমত্কার, তার উনি কী করবেন!

চমত্কার আলি মন্ডল কুয়োর গোল পাটাতনের উপর রশিবাঁধা পেতলের বালতি দেখতে না পেয়ে প্রথমে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে ধীরে ধীরে কাঁধ থেকে লাঙল কুয়োর অল্প তফাতে মাটির উপর আস্তে করে রাখলেন। তারপর কোমর সিধে করে সটান দাঁড়িয়ে উঠে বলদ জোড়ার দিকে দেখলেন। বলদজোড়া নাদার কাছে চলে গিয়ে নাদা শুঁকছে, তারপর চাটছে সেটা।

দুটি বলদই টগরফুলের পাপড়ির মতো স্নিগ্ধ-সাদা। এই চোখ জুড়নো বলদ তাদের বাচ্চাবস্থায় গোধনপাড়ার গরুর হাট থেকে নিতান্ত স্বল্পমূল্যে কিনেছেন চমত্কার চাচাজি। কাকা বুঝতে পারছিলেন, বলদ দুইটা তাঁর চেয়েও তৃষ্ণার্ত। বলদ দুইটা শিশু অপেক্ষা সরল আর অবুঝ। তবে কষ্ট পেলে ওরাও কাঁদে।

যাঁরা আপনমনে একা একা কথা বলার জন্য সংসারে বিখ্যাত তার মধ্যে জবরদস্ত নামটি যাঁর, তিনিই ওই, চমত্কার মন্ডল। চাচা অবশ্যই গরুর সঙ্গে বেবাক কথা বলে চলেন, কেউ শুনে ফেললেও তিনি হায়াবোধ করেন না।

আজ এই ৬৫ বছর বয়েসে চমত্কার কাকার একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যাচ্ছে। একা-একা বলদের সঙ্গে কথা বলছ কাকা? বললে, জবাবে চাচা মুখিয়েই থাকতেন। বলতেন, ‘কার সঙ্গে বুলব বুল দেখিনি। কুন ব্যালেস্টার আছে সংসারে! গরুর পোঁদের সাথে কথা কইতে কইতে মরে যায় যে বেচারা, তারই তো নাম চাষা, ওহে ভাইপো!’

কুয়োর গোলাকার পাটাতনের হাত দেড়েক তফাতে মাঝারি সাইজের নাদাটা বসানো। নাদার চারপাশটা ঘিরে মুথা ঘাস। ঘাসের গোড়ায় জল পাতলা পাতের মতো ছড়ানো, যেন খানিকটা কাচ পড়ে রয়েছে। নাদা ছেড়ে সেই জল খাওয়ার চেষ্টা করে বাঁ-পক্ষের ধলা বলদটা, ডান-পক্ষের যেটা, অর্থাত্ যেটা ডান-হাতি বলদ, সাইজে ও গতরে কিছুটা খাটো, সেটাও কাচ-সদৃশ জলের দিকে এগোয়, নাদা ছেড়ে।

সব সময়ই বাঁয়ের বলদটা গা-গতর ও বলশালিতায় ডাইনেরটার তুলনায় কিছুটা বেড়ে থাকে। অধিক তাকতদার হয়ে থাকে। দেখা যায় ডানহাতিকেই সব ব্যাপারে অনুসরণ করছে বাঁ-পক্ষ। যা হোক ওই জল শুষে নেওয়া অসম্ভব। ধলা শুঁকল। খাওয়ার চেষ্টা করল না। বাঁ-হাতি চিতেও শুঁকল। খেলো না। খাবে কী? খাওয়া তো যায় না।

ধলার মুখে, নাকের ডগায় ঘাসজলকাদার হালকা একটা ছোপ লেগেছে। বলদ দুটি মুখ ঘুরিয়ে তাদের মনিবের দিকে চেয়ে চাইল। তারপর ধলাটা ডেকে উঠল, ‘গোঁ’ শব্দে। একটু বাদে চিতেটাও ডাকল।

এবার চমত্কার আলি প্রায় আর্তনাদই করে উঠলেন, ‘হায় আল্লা! জমজমার পানি চাইছে ধলাচিতে! এ কেমন কাফেরের দেশ গো, জহর মিলে, পানি মিলে না!’

শান্তু চমকে উঠল ওই রকম বিস্ময়ঘন নাটুকে আর্তনাদে। অর্থাত্ যিনি আর্তনাদ করলেন, তাঁর কাছে ঘটনা তো নাটকের চেয়েও বাড়া; দড়া-বালতির এভাবে তো অদৃশ্য হওয়ার কথাই নয়। এই চৈত্রে এ জগত্ মরুময়, এখানে এই দাতব্য কুয়োর জল মরুকূপ জমজমার জলের মতোই করুণাঘন, তার থেকে অবলা জীব দুটি বঞ্চিত হবে কেন? আর গরিব চাষির তো তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে! কোন কাফের (এক্ষেত্রে নিষ্ঠুর) ওই দড়া-বালতি দয়ার্দ্র পাটাতন থেকে সরিয়ে নিয়েছে! কুয়ায় ফেলে দেয়নি তো! যদি কুয়োয় ফেলে থাকে, তা-ও তো কাফেরেরই কাজ! এ কাজ কে করল!

এ কুয়া পুণ্যতোয়া। চোরে পর্যন্ত ওই বালতি চুরি করার পর বিবেকের তাড়নায় ফেরত দিয়ে যায়। এই পরণ-কথা ২২ গ্রামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। হায় খোদা! এ কাজ কে করল! এই সবই বলে চলল চমত্কার আলি।

ওই জলজমা মুথাঘাস বলদে খাবে না। কাচ সদৃশ জলের পাত জলের ছলনা মাত্র; পেয় জল নয়। জলকাদা ঘাসের ছোপ লেগেছে গরুর নাকে—ওদের তৃষ্ণা তাতে আরও বেড়ে গেছে। ঈশ্বরের অবলা জীব দুটি তাই অল্প করে গোঙাচ্ছে। চরম তৃষ্ণার্ত চমত্কার আলি জারি গানের উদ্ধৃতি সহযোগে যেন বা মাতন (বিলাপ) শুরু করেছে। এ জগত্ হয়ে উঠেছে যেন বা কারবালা।

আমি জীবনের লোকায়তে পরণ ও পুরাণ ছাড়া মানুষ দেখিনি। হাদিস কোরান ব্যতীত নিতান্ত কম মানুষ দেখেছি। এই যে জারি দ্বারা নিজেকে এবং নিজের তৃষ্ণাকেও জাহির করছেন চমত্কার আলি মন্ডল, সেটাই ছিল জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ এবং চমত্কারের আর্তনাদ ও বিলাপ আমাকে অর্থাত্ ওই শান্তুকে করে তুলছিল গুনেহ্গার (পাপী)।

হঠাত্ শান্তুর দিকে চোখ যায় চমত্কারের। তাঁর বিলাপ থেমে যায়। আচমকাই থেমে যায়। তিনি শান্তুর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর হাতের ইশারা করে ডেকে ওঠেন, ‘আসো!’

ভয়ে এতটুকু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শান্তু। যেন তার পা দুটি মাটির সঙ্গে গেঁথে গেছে।

শান্তু নড়ছে না দেখে চমত্কার আলি অভয় দিয়ে বলে ওঠেন, ‘ভয় কী! আসো। পাকাটির সাইকেলখানা কাঁচামিটার গায়ে হেলান দিয়া রাখো বাপজি! তারপর টিনের দুয়ারের কাছে গিয়া ন’বউরে ডাকো। ন’মা বুলে গলা চড়ায়ে ডাকো। পানি দেও ন’মা! এই বুলে ডাকো। আসো বাপ! পানি বেগোরে (ব্যতীত) মানুষের কলিজা ফাট্যা যায় মা! এই বুলে চাহো দেখি পানি। আসো খুকামণি! আসো!’

চমত্কারের নরম আহ্বানে কিছুটা সাহস পেয়ে মিছরি আমগাছ তলা থেকে ধীরে ধীরে কাঁচামিঠা আমগাছ তলার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে পাটকাঠির রামধনু সাইকেল হাতে মসৃণ মাটি বা কোথাও ঘাসের উপর দিয়ে সেই সাইকেল ঠেলে নিয়ে বালক শান্তু।

তারপর চমত্কারের কথামতো সাইকেল গাছে অল্প কাত ও খাড়া করে রেখে মণি সরকারের টিনের দরজার কাছে গিয়ে কান্নাভেজা গলায় ডেকে ওঠে, ‘ন’মা। ওগো ন’মা! দুয়ার খোলো। গরু কাঁদছে মা গো!’

ন’বউ কি সরকার বাড়ির সবচেয়ে দয়ালু বউ? নাকি ন’বউ চমত্কার কাকার বেশি চেনা? যাই কেন হোক। সেই বউকে আমি কান্নামেশা গলায় কাকার নির্দেশে ডেকে উঠেই মনে হলো, ন’মা বলে ডাকতে গিয়ে কান্না চোখে উপচে পড়তে চাইছে।

—‘ডাকো খুকা! জোরে জোরে ডাকো! চেঁচায়ে চেঁচায়ে ডাকো। কও, গরুতে মানুষে একাকার করে কাঁদছে। পানি দে মা? ন’ মা! দুয়ার খুলো মা। এই বুলে দরজায় টুকা দেও বাপ!’

অর্থাত্ টিনের দরজায় টোকা দিয়ে চেঁচিয়ে ন’মাকে ডাকতে বলেন চমত্কার কাকা। সুতরাং দরজায় টোকা দিই। তারপর ডেকে উঠি, ‘ন’মা দুয়ার খুলে দেখো মা! গরুতে-মানুষে কাঁদছে, পানি চাইছে, ওগো মা!’

ভেতর থেকে এবার সাড়া মেলে; একটি নারীকণ্ঠই ঈষত্ দড় গলায় জানতে চায়, ‘কে? কে গো! কে তুমি বাছা!’ বলতে বলতে ভেতরের নারীকণ্ঠ দরজার দিকে এগিয়ে আসছে মনে হলো! তারপর ন’মাকে ডাকছি শুনে সেই কণ্ঠ, ‘ওগো নতুন বউ, কে ডাকছে দেখো! কচি গলায় ডাকছে। দেখো তো কী কহে, বেচারা!’ বলে দরজার কাছে এসেও ভেতরে ফিরে গেল।

এরপর মিনিট খানেক বাদে টিনের দরজা (এক পাল্লার) এক পাশে খুলে গেল। ন’মাকে দেখা গেল। একজন ছোটখাটো মানুষ। তার বাল্যেই বিবাহ হয়েছে। তবু কেমন একটা গিন্নি গিন্নি ভাব। বললে, ‘কী হয়েছে শান্তু!’ বলেই চমত্কার চাচার উপর চোখ পড়ল তার। চমত্কার কাকা ততক্ষণে কাঁচামিঠে আমগাছটার জড়ের উপর বসে পড়েছেন। ঘাড়ের গামছা টেনে নিয়ে ঘন ঘন মুখ মুছছেন আর অর্ধস্ফুট সুরে ‘পানি-পানি’ করছেন। বলদ জোড়া দরজার দিকেই তাকিয়ে জিভ দিয়ে মুখ চাটছে।

—‘পানি দে মা, পানি! এস্যা দেখি ইন্দারা (কুয়ো)-র বালতি নাই। এজিদের বংশের কেডা য্যানে বালতি দড়া গায়েব করেছে মা! দেখো, দেখো! বলদ দুইডা পানি চাইছে মা! ঘরের থিকে পানি আনো। খাই!’

বলে ওঠেন চমত্কার কাকা। তেষ্টায় আর্ত কাকার গলার স্বর বলে দেয় পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে বেচারির; গামছায় ঘন ঘন মুখ মুছছেন চমত্কার আলি মন্ডল। ধলা বলদটা এগিয়ে যায় ন’মায়ের কাছে।

ন’বউ ভাতশালার মেয়ে। ওর বাপত্তি পদবি সিকদার। বাপ শেফা সিকদার আধা চাষি, আধা ব্যবসায়ী। সপ্তায় খান তিনেক হাটে রেডিমেড পোশাক বেচেন। ছেলেরাও ব্যবসায়ী। এ দিকে মণি সরকার বিড়ি ব্যবসায়ী। পুরো ফ্যামিলি বিড়ি বাঁধার কাজ করে। চাষবাস তত ভালো বোঝেন না মণি। এই বাড়িতে নিয়ম হচ্ছে, ছেলেদের সঙ্গে বসে বউ এবং ঘরের মেয়েদেরও বিড়ি বাঁধতে হয়। সারাটা দিন বিড়ি বাঁধার কাজ চলে। এই বউটির নাম হাসি।

হাটবারে মণি এবং মণির ছেলেরা বিড়ি নিয়ে হাটে যায়। বাড়িতে তখন শুধু মেয়েরাই থাকে। অন্য দিনগুলোয় কেবল মণি সরকার গঞ্জের দোকানে, প্রধানত চা ও পানবিড়ির দোকানে (অন্যের দোকান) ভাজা বিড়ি দিতে যান। হাটবারে বিড়িরও বিক্রিবাটা বেশি। হাটে একটা টিনের উপর ডালা রেখে, সেই ডালায় ভাজা বিড়ি রেখে বিক্রি করে দুই ছেলে। মেঝ আর সেজ। ওদের হলো লাল সুতোর বিড়ি। গঞ্জে চাহিদা ভালো।

ন’বউ বলল, ‘আমি নববউ, তাই ন’বউ চমত্কার চাচা। যদি হিসেব ধরো তো, আমি সেজ। বুঝলা খুকা, আমাকে সেজ মা ডাকিও। তুমি কতক্ষণ ইখানে আছো? বালতি-দড়া দেখ নাই? কী গো, দেখ নাই?’

এই সব বলতে বলতে কুয়োর গোল পাটাতন চক্র দেয় নতুন এই বউটি। পুরোটা ঘুরে দেখে নেয় হাসি। দড়ি-বালতি সত্যিই গায়েব। তা সত্ত্বেও বার তিন কুয়োটা প্রদক্ষিণ করে মণি সরকারের সেজ বউমা। আমারে ডেকে নেয়।

—‘আসো। তুমিও ঘুরে দেখো বাছা!’

আমিও নতুন বউয়ের পিছু পিছু একবার পাটাতন ধরে কুয়ো প্রদক্ষিণ করি। আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। ধরা পড়ে যেতে পারি সেই ভয়ে চোখের জল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চকিতে মুছে নিই। তারপর অশ্রু দমাতে মনে মনে কঠিন হবার চেষ্টা করি।

‘—দেখ নাই?’ বলে ফের জানতে চায় হাসি।

আমি আজাজিল (ফরিস্তা থেকে শয়তান) শয়তানের মতো করে মাথা নাড়ি একটা দুর্বোধ্য ভঙ্গিমায়, যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ একসঙ্গে হতে পারে, যদিও নতুন বউ মনে করে নেয়, আমি কিছুই দেখিনি।

বউ তারপর দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়।

বড় কলসির এক কলসি জল কাঁখে করে নিয়ে আসে নতুন বউ হাসি সরকার (পূর্ব পদবি সিকদার)। নাদায় এনে গবগব করে ঢেলে দেয়।

জল নাদায় ঢালতে ঢালতে বলে, ‘কলসি নিয়া ফের যেত্তে (যেতে) হবে মহজিদ (মসজিদ) পাড়ায়। জলকাঁটা আনে (এনে) ইন্দারার পানি মথন (মন্থন) দিতে হবে বাবা রে! ওগো খুকা ইদিকে আসো। কাঁচামিঠা আমের ডালে কাগ (কাক) বস্যাছে, ঢিলাও (ঢিল মারো) তো, কেমুন পারো দেখি! বাপ, কাগে রে তাড়ায়ে দেয় সুনা (সোনা)। গাছ দুইটার পাহারা দিতে হয় বুলে ভাগা পাই, সিকি ভাগ। ৪টি আমের ৩টা মোতি মিঞার, ১টা মণি সরকারের। একটা গাছ কাঁচা মিঠা। আর একটা কোহিতুর। কাঁচামিঠা আগে আগে বোল দেয়। কাগ তাড়াও বাপ। কাকা, পানি যা দিবার দিলাম। লাও।’

শান্তু আমের ব্যাপারে সবই জানে। রাস্তার ওপারের জমি থেকে একখানা ঢিল আনে সে। নাদায় আশ্চর্যভাবে গরু আর মানুষে একসঙ্গে জল খায়। সে এক তুমুল মনোরম দৃশ্য। সেটি দেখতে দেখতে আমের ডালে কাককে লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে শান্তু। কাক পালায়, কিন্তু একটি আধাপুষ্ট কাঁচামিঠা আম ঝরিয়ে দিয়ে যায়।

—‘আহা! ফেলে দিলি! মোতি মিঞা জানলে কী বুলব!’

এই বলে মাটি থেকে আমটা হাতে তুলে নেয় নতুন বউ। আঁচলে মুছে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অপরাধী শান্তুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বউ বলে, ‘লাও, নজ্জা করিও না। খুসা (খোসা) সুদ্দো খাত্যে পারো, মিঠা নাগবে। মোতি মিঞাকে বুলে নিব, কাক তাড়াতে একটি আম খসেছে জুনাব। বাচ্চায় (বাচ্চাকে) দিয়্যাছি। মাফ করেন। মিঞা মাফ ঠিকই করবেন। তুমি ভাবিও না। যাও, কল হাজির বাড়ি গিয়া ঝাঁকড়া জলকাঁটা আনো। ঝাঁকড়া আনবা। দুই’আকড়ি কাঁটা হলে নিবা না। যাও। কুয়ার পানি ‘মথন’ করব। দেখি, দড়া-বালতি কুথা গেল! যাও, খাইতে খাইতে যাও। পাকাটির সাইকেল ধুলায় ভাসায়ে নিয়া যাও।

মণি সরকারের বাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণের পাশাপাশি আমগাছ দুটি মণি সরকারের নয়। সে কথা জল খেয়ে উঠে আশ্চর্য হয়ে বউকে শুধালেন কাকা। হাসি বলল, ‘না কাকা, গাছ মোতি মিঞার। মুই হলাম, আগলদার। আমি নামাজি জেনানা বুলে মিঞাসা’ব আমারে দেখতে দিয়েছে। আমি আগলাই।’

পাটকাঠির সাইকেল নিয়ে চলেছি কল হাজির বাড়ি জলকাঁটা আনতে। পকেটে কাঁচামিঠা আম।

আমার ছেলেবেলায় ছোট ছোট বউদের আমি অনেক দেখেছি। যাদের সাধু বাংলায় বালিকাবধূ বলা হয়, তারাই ছোট ছোট বউ। এরা বেশির ভাগই ছিল বিশুদ্ধ নিরক্ষর। কেউ কেউ ওয়ান-টু-থ্রি ক্লাস অবদি পড়েছিল। কেউ বা ছিল ইউপি (আপার প্রাইমারি) পাশ বা ফেল। আমার মা ছিল ইউ পি পাশ। আমার দাদিমা (ঠাকুমা) ছিলেন একটি কোনও দামি বৃক্ষের মতো বা ছোট নদী গোমানির মতো নিরক্ষর অথচ তাঁর মুখের বয়েত (বর্ণনীয় বিষয়) ছিল আশ্চর্য বাঙ্ময় এবং অর্থপূর্ণ।

তখনকার দিনে শতকরা ৭-৮ ভাগ মানুষ বা তারও কম লোকে মাত্র সইসবুদ করার মতো লেখাপড়া জানত। বাকিরা টিপছাপ দিত। দু’একজনকে দেখা যেত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিচ্ছে এবং ফেল করছে। বেশ দু’চার জন নন্-ম্যাট্রিক লোক দেখা যেত। সারা তল্লাটে। তল্লাট বলতে টেকা গ্রামের আশপাশের বাইশটা গ্রামকে ধরতে হবে। নন ম্যাট্রিককে (বার তিনেক পরীক্ষা দিয়েও ম্যাট্রিকুলেশানে ব্যর্থকাম) তখন প্রায় একটা ডিগ্রি ধরা হতো। ‘কদ্দুর পড়াশোনা’ জানতে চাইলে জবাব শোনা যেত, ‘খোদার মেহেরবাণী, জনাব তো নন্-ম্যাট্রিক বাবা!’

মনে রাখতে হবে, এ রিপোর্ট করা হচ্ছে, প্রধানত মুসলিম জীবনকে ভিত্তি করে। তবে এ কথা ঠিক, ওই বাইশ গ্রামে যেসব চর্মকার কর্মকার-ছুতার-কুমোর-ধীবর বা চাষি (অধিকাংশ মাহেষ্য) দেখা যেত, তাঁদের মধ্যেও শিক্ষার তেমন কোনও বিস্তার ছিল না। তাঁদের মধ্যেও বিখ্যাত নন্-ম্যাট্রিক দেখেছি। হিন্দু রমণীরাও ছিলেন নিরক্ষর। কচ্চিত্ কেউ কিছু লেখাপড়া জানতেন। এরাও ছিলেন আমার কাকি-মাসি।

এই রকম নিরক্ষর পৃথিবীতে নজরুল রবীন্দ্র-শরতের দৃষ্টান্ত অনুসরণে কোনও সাহিত্য জন্মাবে কীভাবে, সে ছিল এক মস্ত প্রশ্ন। কেনই বা সেই কারুবাসনা আজও বুঝে পাইনি। লেখালিখি জিনিসটাই আমার কাছে এক ধরনের ধাঁধোসা; আমি তো বছর চৌদ্দ বয়সে প্রথম কবিতা লিখি, কেন এই স্পৃহা আজও ঠিকঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আমার প্রথম পাপ যেমন একটা ঘটনা, কেন ঘটালাম, বলতে পারব না; কবিতা লিখে ফেলাও একটা পূর্বপ্রস্তুতিহীন ঘটনা মাত্র, কেন ওই ঘটনা ঘটালাম বলতে পারব না। ঘটে গেল, চিত্তেরই এক স্খলন থেকে কোনও একদিন ছেলেবেলায়। অবশ্য সেটা ছন্দের তাড়া থেকে ঘটে কিনা কে বলবে? গানেরই মতো আমার মধ্যে ছন্দ দুলত শৈশবে। যেভাবে শিশু অকারণ নেচে ওঠে, সেই রকম; ওই নাচ হয়তো তার প্রাণেরই প্রেরণা, প্রাণই তাকে দুলিয়ে দেয়। কিন্তু পাপ। সেটা কীভাবে ঘটে?

ঝাঁকড়া (আঁকড়ি বহুল) জলকাঁটা আনতে হবে; দু’আঁকড়ি জলকাঁটায় হবে না। কল হাজীর বাড়ি ঝাঁকড়া কাঁটা আছে। সবার বাড়ি এ জিনিস থাকে না। প্রতিটি বাড়িতে জলকাঁটাই থাকে না। এমনকি সব বাড়িতে কুয়া নেই। অনেক গরিব পরিবারই দানের কুয়ায় বাঁচে। কল হাজীর দুটি কুয়া। একটি পাতকুয়া। অন্যটি বড় কুয়া। পাতকুয়া থেকে স্খলিত জিনিস তোলা বেশ কঠিন। অনেক জিনিস ঝাঁকড়া কাঁটাতেও ওঠে না। পাতকুয়ার মুখ সরু। ওই সরু মুখের উপর ঝুঁকে দাঁড়ালে কেমন যেন ধক্ করে ওঠে বুকটা! বোধহয় কোনও মৃত্যুর অনুভূতি হয়।

কল হাজীর আসল নাম জীবন মুনসি। ওঁর জমিজিরেত যা, তাকে বলা যায় বড় জোত। গঞ্জে লোহালক্কড়ের দোকান আছে। দু’তিনটে হাল রয়েছে। আর রয়েছে দুটি আখ-মাড়াই কল। সেই কলের গায়ে আঁটা চকচকে নীল পাতে মুদ্রিত রয়েছে একটি চমত্কার বাক্য, ‘জীবন মুনসির কল কোনও দিন মাথা ধরে না’। লোকে বলে, কল হাজীর কল, কোনও দিন মাথা ধরে না। সেই কল আখের মরসুমে ভাড়ায় খাটে।

মাঘ-ফাল্গুনে আমবাগানের ফাঁকা জায়গায় কল হাজীর কল বসানো হয়। খানিকটা গর্ত করে, হাঁটুপ্রমাণ তো বটেই, গর্ত করে কল বসে। কলের সঙ্গে আঁটা তক্তা সেই গর্তের দেওয়ালে সাঁধ করিয়ে কলটাকে স্থায়িত্ব দেয়া হয়, যাতে নড়েচড়ে না যায়; কলের মাথায় চাকার মাস্তূলে বাঁশ বা কাঠের দণ্ড ‘ফিট্’ করে দেয়া হয়। সেই বাঁশ বা দণ্ড বাঁধা হয় জোয়ালে দড়িসহ। তারপর বলদে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে টানবে সেই বাঁশে ইটের ভারা ঝুলবে।—এই দণ্ডটা কলুর ঘানির দণ্ড অপেক্ষা লম্বা। ঘানির দণ্ড তো নয়, ওটা তক্তা, যাতে শুয়ে থাকে কলু-বালক। বলদে বা ঘোড়ায় সেই তক্তা ঘোরায়। তক্তার ওপর ভারী-ভারী পাথর চাপানো হয়। হাজীর কলে তক্তা নয়, বাঁশ টানে দুই বলদে জোয়ালে বাঁধা দড়ি সহকারে। ঘানিতে এক বলদ বা এক ঘোড়া। কলে দুই বলদ।

গর্তে নাদায় রস জমে। তখন তো গরুজীবন ছাড়া মানবজীবন ছিল না। গরুই আখচাষ করছে, আবার আখ মাড়ছে। তবে কল হাজীর কল গরুকে দিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে রস নিংড়ে নেয়; সেই রস থেকে তৈরি হয় গুড়। আখের পাটালি। সেই কল হাজীর কল বৈঠকখানায় পড়ে রয়েছে। রস জ্বাল করার আয়তাকার বড় তাওয়া (কড়াইয়ের কাজ দেয়) পড়ে আছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে। কল আর তাওয়া দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছে, রানি ভবানীর বাগানে মাস আড়াই আগে ঠাকমা আমাকে সঙ্গে করে এসেছিলেন, জ্বাল দেয়া রসের মধুপাক গন্ধে কেমন যেন করছিল ভেতরটা। দাদিমা বললেন, ‘চ বাবু, কল হাজীর কলের রস খেয়ে আসি। আমি এক দর্জন (ডজন) কাগজি লেবু গাছ থেকে উঠায়ে রেখেছি। বোরাকুলির মহসিনের আখ ঢেরি দিয়ে পড়েছে শুনলাম। মহসিন দূর সম্পর্কের ভাগ্না। কিন্তু মহসিন দূর মনে করে না। চ।’

এই রকমই আমার দাদিমা। দূর সম্পর্ককে দূর মনে করতেন না। তিনি সম্পর্ককে লতাপাতায় বিস্তার করতেন। এ জিনিস আবার আমার মা পছন্দ করত না। সম্পর্কের সূত্র ধরে কারও কাছে কিছু চাইতে দেখলে মা যেত খেপে। ঠাকমার সঙ্গে একটা কেমন ঝগড়া বেধে যেত। অবশ্য ওই রকম করে মানুষের কাছে চাইলে লোকে যে খুব অসন্তুষ্ট হতো, ঘটনা তেমন ছিল না মোটে। তবে দাদিমায়েরই বা দোষ কিসে! আখগুড়ের তপ্তমধুপাক গন্ধ ভেতরটা কেমন উতলা করে তুলেছে যে!

আমাদের ওই সুবিস্তৃত জনপদে দিগন্তখ্যাত ছিল তিনটি প্রধান গন্ধ। আমের গন্ধ। পাট-পচাইয়ের গন্ধ। আখগুড়ের তপ্ত গন্ধ। আর নদীতে ছিল মাছ-মাছ গন্ধ। তার সঙ্গে পুজো আর ঈদের গন্ধও তো ছিল। যা হোক। দাদিমা আমার মায়ের সব বাধা অগ্রাহ্য করে আমাকে সূর্যাস্তের আলোয় টেনে নিয়ে চললেন, হাজীর কলের ওখানে রানি ভবানীর বাগানে।

আখকলের কাছে এলে এমনিতেই বাচ্চারা অন্তত একখানা করে আখ পায়, যার আখ-মাড়াই হচ্ছে, তিনি ওই আখ না দিয়ে (দান) পারেন না। আমরা সঙ্গে এনেছি বেলজিয়াম কাচের বড় জগ, তাতে রয়েছে ১২টা কাগজি লেবু। সূর্যাস্তের আলোয় চমত্কার দেখাচ্ছে। এক বালিকা লণ্ঠনের কাচ নেকড়া দিয়ে সাফা (পরিষ্কার) করছে। টলটল করছে সেই কাচও। আকাশের কাচ আর সাঁঝ তারা মুকুতার মতো জ্বলজ্বল করছে। লণ্ঠনে আলো জ্বললে, সেটি বলদের জোয়ালে ঝুলতে ঝুলতে গোল হয়ে ঘুরবে সারারাত। ভাবতে ভাবতে আমি ডেকে উঠি, ‘বরফি চাচি, আপনাদের ঝাঁকড়া জলকাঁটা থাকলে দেন তো? মণি সরকারের নতুন বউমা চাইছে!

বরফি চাচীি পয়লা ডাকে সাড়া দিচ্ছে না দেখে দোসরা ডাক দিই মিনিট দুই বাদে। বাইরের বৈঠকখানার গোড়ায় উঁচু করে তোলা মাটি গাছের গোড়ায় থাক-করা; গাছে অত্যন্ত ছোট ছোট এঁচোড় ঝুলছে। এই গাছটা জোয়ালি কাঁঠাল গাছ নামে চেনা; জোয়ালের মতো মস্ত কাঁঠাল ধরে। কোয়াও ছুঁচোলো লম্বা, বরফের মতো খচখচে সাদা। কতকটা মিছরিমিছরি ব্যাপার। এমন কোয়া চেয়ে দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়।

কাঁঠাল এত লম্বা, এমন গাছটা ফের বেঁটে ঝাঁকড়া এবং বয়েসেও ছোট ছোট বউদের মতন নবীন, ফলে হয় কি, কাঁঠাল মাটিতে লম্বা হয়ে নেমে ঠেক নেয়—এই অবস্থায় কাঁঠাল গাছ পাকা হলে সমস্যা আছে। গন্ধে গন্ধে খ্যাঁক শেয়াল রাত্রে চলে আসে। বড় গর্ত করে খেয়ে বেটা করে কি, নাগালে পেলে ছাগলের বাচ্চা টেনে নিয়ে যায়। বড় ছাগল হলে কব্জা করতে না পেরে গলা ফুটো করে পালায়। ছাগলের আহত চিত্কারে গেরস্ত জেগে উঠে চেঁচিয়ে উঠলে পালাতে বাধ্য হয়। বকরিদের খাসিও গলা ফুটো হলে বাঁচে না।

জোঁয়ালি কাঁঠালের এটি একধরনের গল্প। ভাবতে ভাবতে শান্তু ফের ডাক দেয়, ‘বরফি চাচী!’

সাড়া আসে না দেখে কাঁঠাল গাছটার গোড়ার থাক করা ও জমাট বাঁধা মাটির উপর দাঁড়িয়ে উঠে শান্তু পায়ের গলুই তুলে দেখবার চেষ্টা করে বরফি খাতুন কী করছে। এরা ফরাজি। ইমাম শাফীর হাদিস মেনে চলে। এদের বলা যেতে পারে, শাফেয়ী গোষ্ঠী (ফরাজি)। এরা তিন চাঁদে তিন তালাক দিয়ে বউ তালাক দেয়। একসঙ্গে তিন-তালাক দেয়া, যা ইমাম আবু হানিফার ভক্তরা দিয়ে থাকে, যাদের বলা হয়, হানাফি, (এরাই মুসলিম সমাজে ৯০ শতাংশ), তাদের এই নিয়ম (একসঙ্গে তিন তালাক) মানে না। এই শাফেয়ীরা সংখ্যায় কম। এদের বরাবর পছন্দ করেছি আমি; এদের ঘরে তালাকের ঘটনা নিতান্ত নগণ্য।

আমি পায়ের গলুই তুলে দেখি, বরফি শাফেয়ী মাটির উঁচু দাওয়ায় বসে নামাজ পড়ছে। নামাজরতাকে ডাকা ঠিক নয়। আমি গাছের গোড়া থেকে নেমে বৈঠকখানার দেওয়ালে খাড়া করে রাখা পাটকাঠির রামধনু সাইকেলটা নিই। এখান থেকে ভাস্কর ফড়িং কাকার বাড়ি মাত্র একভুঁই দূরে। আমি রওনা দিই। যদি ‘রেহেল’ তৈরি হয়ে গিয়ে থাকে! এগোই।

আমার কাঁধে দুই ফরিস্তা। মনকির-নকির অথবা ওঁরা কেরামন-কাতেবিন। মনকির-নকির কি ফার্সি লব্জ? আল কোরানে কি ওঁদের নাম কেরামন ও কাতেবিন? অর্থাত্ কোরানীয় আরবি লব্জে ওই দুই ফরিস্তা কেরামন-কাতেবিন নামে কথিত? কোরানে বলা হয়েছে, ‘কেরামন কাতেবিনা ইয়া লামুনা মা-আ-লা তাফ আলুম।’ অর্থ হলো, কাঁধের দুই সম্মানীয় লেখক সবকিছুই জানেন। অর্থাত্ তুমি যা করছ তার সবই ওঁদের অবগত। ইয়া লামুনা মানে সবই জানেন। মা-আলা তাফ আলুম মানে আমরা যা করি। আশ্চর্য এই যে, কাঁধের ফরিস্তাদ্বয় ঈশ্বরের প্রত্যাদিষ্ট লেখক। তাঁরা সবই দেখছেন এবং লিখে রাখছেন। আমি যে মণি সরকারের বাড়ির বহির পালাঙ্গা (প্রাঙ্গণ)-র সীমায় পথের ধারে দানের কুয়ার দড়াবালতি কুয়োয় ফেলে দিয়েছি, সবই ওঁরা দেখেছেন, কিন্তু আমি শিশু, আমার প্রথম ওই পাপকার্য, ওই দুই লেখক কি গুনাহ্ বা বদি (মন্দকার্য) হিসেবে খাতায় লিখে নিয়েছেন, নাকি অপেক্ষা করছেন, এই ঘটনার পর আমি কী করি দেখে নিয়ে তারপর প্রথম পাপকথাটি লিখে নেবেন বলে। তা হলে এই যে জলকাঁটা নিতে কল হাজীর এখানে এলাম বা রেহেল (কোরানদানি)-এর জন্য ফড়িং কাকার কাছে যাচ্ছি, এতে কি পাপক্ষয় হচ্ছে?

তখন যা বয়েস এত স্পষ্ট করে ভাববার ক্ষমতা না জন্মালেও কিছু তো ধর্মবোধ জন্মে গিয়ে থাকবে! বা আমি দুর্বোধ্য এক পাপানুভূতির তাড়সে কল হাজীর এখানে এলাম। নতুন বউ আমাকে জলকাঁটা আনতে পাঠালো, ওই নয়া বউ নামাজি, তাই ওকে মোতি মিঞা আম গাছ দুটি পাহারা দিতে একপ্রকার আগলদার করেছে, সুতরাং বউটি ধার্মিক।

আমি এ জীবনে প্রগাঢ় পাপী অথচ জবর নামাজি বেশ কতক দেখেছি, ফের প্রকৃত খোদাভীরু নামাজি পুণ্যাত্মাও কম দেখিনি। যা হোক। ওই ৭-৮ বত্সর বয়েসে পাপের একটা অর্ধস্পষ্ট খর অনুভূতি আমাকে তাড়া করছিল। আমি তখনও খোদাকে কল্পনা করতে শিখিনি, কিন্তু কেরামন-কাতেবিন আমাকে দেখছেন বুঝে একটা মারাত্মক বুকের রক্ত শুকিয়ে দেয়ার মতো ভয় পেয়েছিলাম।

ফড়িং কাকা আমাকে দেখে বললেন, ‘যাও মাকে-ঠাকমাকে বলো গিয়ে আমি আসরের নামাজ পর যাব, বৈকালে। যাও।

ফড়িং কাকার একটি বাক্যটি লক্ষ করবার মতো। বিচিত্র ঠেকলেও, কাকা ওই রকমই বলতে পারতেন বা বলতেন। নমাজের ‘ওয়ক্ত’ (সময়) ধরে কথা বলা। বা বলতেন, পরশু দোল, দোলের পরের দিন আসিও। যা হোক। বুঝলাম, ‘রেহেল’ তৈরি হয়ে গেছে।

—‘আচ্ছা ধরো, রেহেল-কে একখানি জ্যাকেট তো দিতে হবে নাকি! মলিন দাস দর্জি বানাচ্ছে, সন্ধ্যামনি রঙের কাপড়ে। আচ্ছা, তুমি কোনদিকে চাইছ শান্তু? জল খাবে?, গীতা, অ রে জগ থেকে ঢেলে এক গেলাস জল দাও তো! বাছার মুখটা পুড়ে তামা হয়ে গেছে গো!’

গীতা কাকিকে বললেন কাকা। আমি ডালিম গাছের তলায় বেলজিয়াম কাচের জগটাকে লক্ষ করছিলাম। জগে ভর্তি জল। আমি কাকার সিঁদূরে চারা আমগাছটার খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাকার গা ছুঁয়ে একটা ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে আসছে, সেই বাতাসে জবাকুসুম আর গুঁড়া কাঠের চমত্কার গন্ধ। কিন্তু জগটা দেখে, জল দেখে, কেন যেন দাদিমায়ের সেই আখরস পান করার গল্পটা মনে পড়ে গেল।

ঠাকুমা বললেন, ‘বাবা মহসিন, দুইটা লেবু আমার আর পোতার রসে দিও নিংড়ায়ে, বাকি লেবু তুমরা খাইও। যা শান্তু জগ আগায়ে নিয়া যা। মহসিনের হাতে দে। তাওয়ার মধুপাক রস কি তুমার বাবা? নাকি…’

আসলে আখ পেড়ায় (মাড়ায়)-এর সঙ্গে লেবুকেও পিড়িয়ে নেয়া হয়, ফলে যে লেবুর রস মিশ্রিত আখরস তৈরি হয়, তার স্বাদ, তার ঘ্রাণ আশ্চর্য মিঠা ও গন্ধযুক্ত হয়ে তামাম শরীরটাকে কেমন সুন্দর রসস্থ করে তোলে, এই খাসা রসপানে আমাকে টেনে এনেছেন ঠাকুমা। কিন্তু শুধু শুধুু তো চাইতে কেমন বাধে, তাই এক দর্জন (ডজন) লেবু এনেছেন দাদিমা। দুটোর রস তাঁর পোতা আর তাঁর জন্য। বাকি দশটি লেবু আখের সঙ্গে পোড়ায় করে খাবে মহসিন ও অন্যরা। মহসিন বেশ খুশি হয়ে জগের এক দর্জন লেবু চোখের উপর তুলে ধরে দেখতে দেখতে বলল, ‘না মামি, মধুপাক রস আমার না। শচী দেবনাথের ওই গুড়ের শেষ তাওয়া নামলে, আমার রসের তাওয়া উনানে চড়বে। দেবনাথের আখ-পেড়ায় শেষ। গুড়ের ওইডে শেষ তাওয়া, জ্বাল করতে করতে মগরিব পার হবে ধরো। ওই দিকের উনানে আমার রসের তাওয়া তৈয়ার হচ্ছে মামি! দাঁড়াও তুমার আর শান্তুর রসের ব্যবস্থা করি। কই রে সুধান, এদিকে আয়!’

ফড়িং কাকা একজন ছোটখাটো মানুষ। রোগার দিকে ধাত, কিন্তু রোগা নয়। দোহারাও নয়। কাকার জীবনের একটি প্রধান সমস্যা হলো, ওঁর মাথার চুলে এই পূর্ণ দীপ্যমান যৌবনেই অল্প অল্প করে পাক ধরে গেছে। এর কারণ কী? কাকাই কারণ আবিষ্কার করেছেন এবং সেই হেতুটি বাবাকে জানিয়েছেন এবং তা হচ্ছে কাকার মাথাটা গরম, ধাতে পিত্তর ভাগ বেশি, তাইতে মাথা গরমের প্রকোপে চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে।

বাবা বলেছেন, ‘তোমার আবার মাথা গরম কিসে! তুমি তো ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ।’

—‘মাথাটা তো ভিতরের দিকে গরম কলিমদা! বাইরে কিছু না।’ এই বলে কাকা বড্ড মিঠে করে হাসেন।

নৈঃশব্দ্যমাখা ওই বকুল-ঝরা হাসি হাসলে কাকার মুখটা একপাশে একটু বেঁকে যায়, যেন হাসতেও তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। সামান্য ছুতার, অল্পই লেখাপড়া জানেন, সেই মানুষটা এমন মুকুতা-হাসি, এমনই পুণ্যময় হাসি তিনি কোথায় পেলেন, ভেবে পাইনি। তবে হাসির জন্যই যিনি দিগন্তখ্যাত, তিনি কাছারি পাড়ার আহম্মদ কাজী, যাঁকে ওই হাসির জন্য লোক আহম্মক কাজী বলে খেতাব দিয়েছে; তাঁর হাসি বিচিত্র এক গমকের নাটুকে হাসি, ওটা একটা গ্রাম্য আর্ট। আশ্চর্য দেখনদার হাসি।

বাচ্চারা ওই হাসি শুনতে শুনতে ও দেখতে দেখতে ভয় পেয়ে চমকে ওঠে, ফের মজাও পায়। অনেক সময় বাচ্চারা ওর হাসি দেখবে বলে দল বেঁধে ওর পিছু নেয়, ‘অ্যাই দাদো, হাসো তো! এক গমক হাসো, হাসো তো দেখি!’

—‘না, না। হাসব না!’

—‘হাসো হাসো! একখানি চকের লাল আইসক্রিম দিব!’

একটি চ্যাপটা বড় লাল আইসক্রিমের দাম মাত্র ২ পয়সা। সেই পয়সাটি আমরা পাটের ভালো ফেঁসোর নরির হাতা বেচে জোগাড় করতে পারি। ওই ফেঁসো লেগে থাকে পাটকাঠির গায়ে, সেই সব খুঁটে নিতে হয়। অনেক সময় হয় কি, ফেঁসো যা জোগাড় হলো, তাতে আধহাতাটাক হলো, তাই দেখে মা-ঠাকুমা বাকি আধহাত পাট ওই ফেঁসোর সঙ্গে জুড়ে দিলে, তখন ওই একহাতা পাট দালালে বা ফড়িয়ায় আদর করে নেয়। বিশুদ্ধ ফেঁসো সহজে কিনতে চায় না। দাম দেয় পাটের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র। হাতা জিনিসটি এক আঁটি কাঁচা বা গাছা পাটের জাগ (জলে পচাই) করা এবং ধোয়া ও শুকনো করা আঁটি শব্দটা মুঠি জাতীয়।

অনেক সময় ‘জাগ’ করা পাট ধোয়ার সময় ‘হাতা’ ঠিক হয়। পচাই হওয়া যতটা গাছা পাট একজন জনমুনিষ হাতের মুঠোয় নিয়ে জলে আছড়ে নিয়ে গাছের এক দেড় বা এক-সোয়া বিঘত পরিমাণ ভেঙে নিয়ে জলের মধ্যে ফেলে টানাটানি করে পাটকাঠি ছাড়িয়ে নিয়ে বাকি মুড়োর অংশ নদীর কিনারার জলে পোঁতা খেটোয় (খোঁটা) আছড়ে পাটকাঠির মুড়োর ওই অংশ ছাড়িয়ে নেয়, তারপর মুঠোয় ধরা আঁশ ভাঁজ করে ওই আঁশেরই একটি নরি দিয়ে বেঁধে কিনারায় ছুঁড়ে দেয়, ওই যে পাটের আঁশ (বস্তুত পাট) কেই ‘হাতা বলে। ৮০ হাতায় এক ‘পণ’ পাট হিসেব করা হয়। তখন অবশ্য সের আর মণ-এর হিসেব। কিলোগ্রামের ওজন আসেনি তখনও। নয়া পয়সা আসেনি।

আমার বয়োসন্ধির সঙ্গে নয়া পয়সার সম্বন্ধ আছে। আমার শৈশবে ছিল ফুটো পয়সা। যদি দু’পয়সা ফুটো হতো, তা হলে তার দাম হয়ে যেত এক পয়সার সমান। তখনকার দিনে আধ পয়সারও দাম ছিল। মুদির দোকানদারকে আধ পয়সার তেজপাতা চাইলে দোকানদার দিত একমুঠো তেজপাতা। কিন্তু আমার নিজের গল্পটা হচ্ছে, কোমরে জড়ানো পয়সার ‘জালি’কে নিয়ে।

একটা ডোর। লাল ডোর। এবং একটা সাদা সুতোর ‘জালি’ তো চাই। তা নইলে কোমর মানায় কী করে! ডোরে ফুটো পয়সার সার থাকলে শিশুর কোমর বেশ শক্ত হয়। তত নিজেকে আর গরিব গরিব লাগে না। যাদের ‘জালি’ থাকে, সেই সব শিশু নিজেদের ধনী খাঁ মনে করে!

আহম্মদ কাজী যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে ফিরে তাকালো।—‘আচ্ছা, খুদার ফরিস্তারা! আমারে লাল আইসক্রিম দিবা?’ বলে মুখের ভেতরে চমত্কার করে ‘রস’ টানার মতো শব্দ দিয়ে হেসে ওঠে আহাম্মক। এই রস টানাটা কতক ঝাল টানার মতো।

বাচ্চার দলটা দাঁড়িয়ে পড়েছে অল্প ভয়ে ভয়ে। কেউ কেউ আমার চেয়েও ছোট। কারও কারও পরনে কোনও পোশাকই নেই। সুতো নেই কোনও। পুরোপুরি উলঙ্গ। এই রকম উলঙ্গ ছেলেমেয়ে শিশু তখন গ্রামে দেখা যেত। উলঙ্গ বলে কারও কোনও লজ্জার অনুভূতিই ছিল না। না শিশুর, না শিশুর বাপমায়ের বা পড়শির চোখে ওই নগ্নতা ছিল প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা যেনবা। এর কারণ অবশ্য দারিদ্র্য। তখনকার দিনে লোকে বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া জুতোই পরত না। বর্ষায় জুতো হাতে করে বইত। বাপ যাচ্ছে বিবাহিতা মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ি দেখতে, জুতো হাতে। মেয়ের বাড়ি পৌঁছনোর এক রশি আগে একটা পুকুরে পা ধুয়ে জুতো পরে নিয়ে ওই এক রশি পথ হেঁটে গেল। ব্যাস। আশ্চর্য এই যে, দলের অর্ধেক শিশুই উলঙ্গ, কদলীবৃক্ষের মতোই সেই নগ্ন-স্বাভাবিকতা, তাদের অনেকেরই কোমর বেষ্টন করে কালো বা লাল ডোর, কিন্তু তাতে একটিও ফুটো পয়সা নেই।

আমি বললাম, ‘দাদো সাহেব, আমি দিব। আমার আছে।’—‘কই দেখা!’ বললে আহম্মক কাজী।

আহাম্মক কাজীকে ‘দাদো সাহেব’ বলাতে ভারি খুশি হয়েছে, তবে আমি তত বুঝে ওকে ‘সাহেব’ বলিনি বা হয়তো খুশি হয়ে হাসবে বলেই ওকে ‘দাদো সাহেব’ বলেছি এবং সেটা মনের অজান্তে ভেতর থেকে হয়েছে। যা হোক আমি পেট খাদো করে আমার ইজেরটাকে ঢিলে করে নিয়ে তলপেটে হাত ঢুকিয়ে জালি আর ডোরটাকে টেনে বার করি। আমার গায়ে ফুটো-ফুটো স্যান্ডো গেঞ্জি, যাকে বলে নেট-স্যান্ডো। এই পোশাকে, ওই ডোর-জালি সবই দাদিমায়ের পছন্দে করা হয়েছে। ডোরে গোটা পাঁচেক ফুটো পয়সা। জালিতে আধুলি-সিকি টাকাও আছে। রুপোর টাকা। আমি নিম্ন মধ্যবিত্তর একটু উপরের নিম্নবিত্ত হলেও মোটামুটি শিশু ধনী খাঁ। ফুটো পয়সা ফেঁসো বিক্রি করে হয়েছে।

আমাকে অবাক হয়ে দেখতে থাকে আহাম্মক কাজী। রুপোর টাকা ব্রিটিশ আমলের। ওগুলোর অনেক দাম। ওগুলো খরচ করার জন্য নয়। ওগুলো আমাকে সাজিয়ে দেবার জন্য দিয়েছেন ঠাকুমা।

আহাম্মক বলল, ‘টাকা দেখাবে না খুকা। পয়সা দেখাবে। দুষ্টু লোকে কেড়ে লিবে বাপ। ছিনায়ে লিবে। না দিবে তো, মারবে। মেরে ফেলে দিবে শান্তু। চাট্টি ফুটা পয়সা দিলেই আইসক্রিম হয়। থাক। তা-ও লাগবে না। আমি মাগনা হাসব; পয়সা নিয়া হাসব, আমি কি সার্কাসের জুকার! না না। আমি মুনের আনন্দে হাসব ফরিস্তার বাচ্চাগুলি আমার!’

গীতা কাকি জল দেয়। জল খাই। রেহেলের জ্যাকেট হচ্ছে শুনে মনে অগাধ আনন্দ হয়। পাটকাঠির সাইকেল নিয়ে কল হাজীর ওখানে ফিরে আসি। কাঁধের দুই ফরিস্তাকে মনে মনে বলি, ‘ওগো ফরিস্তা! মাফ করো! গুনাহ্ লিখো না হুজুর। আহাম্মক কাজী বাচ্চাদের ফরিস্তা বলে ডাকলে কী হয়! আমি তো মানুষের বাচ্চা! ফরিস্তা নই মনকির-নকির। কেরামন-কাতেবিন। আমি তো হুজুর কারিমন বেওয়ার পোতা। সংক্ষেপে মন বেওয়ার পোতা। আমি এখানে জলকাঁটা চাইতে এসেছি ওগো আলোর ফরিস্তা!

আবার দাঁড়ালাম এসে কল হাজীর বাড়ির বাইরের পালাঙ্গায় (প্রাঙ্গণে) হাতের পাকাঠির সাইকেলখানা রাখলাম বৈঠকখানার দেওয়ালে ঠেকা দিয়ে। এঁদের প্রধান দালানটি পাকা। যাকে বলে ইট-সিমেন্ট সুরকি দিয়ে গাঁথা এবং পেটানো ছাদের ইমারত। করগেটেড টিনের ছাদঅলা ঢেঁকিঘর, ইটের দেওয়াল, কিন্তু সিমেন্টের আস্তর পড়েনি, হোয়াইট ওয়াশ হয়নি। ভুঁসিঘর খড়ের ছাওয়া, দেওয়াল বাঁশবাতার উপর মাটি লেপা।

বৈঠকখানাটা গাঁথা ইটের উপর সিমেন্টের আস্তর অবদি করে রেখে দিয়েছেন। এঁরা চাইলেই বাড়িটা পুরো পাকা করতে পারেন; এঁদের টাকা করার দিকে যত মন, মহল করার দিকে তত নাই। বছর-বছর জমি কেনেন। সারা তল্লাটে এই রকম জমি-জিরাত করা, গঞ্জে ব্যবসা করা ফ্যামিলি কিছু অল্প সংখ্যায় দেখা যায়। আখের কল কেবল এঁদেরই আছে। এঁদের চেয়েও ‘বড়লোক’ দু’একঘর অবশ্য আছে। বাকি সব মাঝারি কিছু এবং স্বল্পবিত্ত অনেক— চাষি পরিবার আর বিশাল সংখ্যায় ক্ষেত মজুর। দু’চার জন প্রাথমিক শিক্ষক। ২২ গ্রামে একটি মাত্র ডাকঘর। ২২ গ্রামে কোনও হাই স্কুল নেই। গ্রামে কোনও বিএ পাস নেই। না, ভুল হলো। আছেন একজন। ভগীরথপুর হাইস্কুলের সংস্কৃতের টিচার। নাম কাজী ফকির মহম্মদ। ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি ফের সংস্কৃতের পণ্ডিত!

বড় নদীর ওপারে অর্থাত্ ভৈরব নদীর ওপারে আরও একজন আছেন বিএ পাস, নাম তাঁর রাহাত বাবু, রেলের চাকুরে, শোনা কথা। যখন বুদ্ধি পড়ল ভালো মতন, তখন শুনতে হয়েছে রাহাত বাবুর কথা। রেলে চাকরি করেন বলে লোকে তাঁকে ‘বাবু’ বলে ডাকে। নইলে শিক্ষিত মুসলিমকেও ‘বাবু’ বলে ডাকার নিয়ম ছিল না। ‘বাবু’ বলতে বাঙালি-হিন্দুকেই বোঝানো হতো। তবে বাঙালি-মুসলিম জনকে সম্মান দেখাতে হলে ‘সাহেব’ ডাকা নিয়ম। এখন এই বয়েসে জেনে গেছি, ‘সাহেব’ এবং ‘বাবু’ দুটিই ফার্সি লব্জ। যা হোক। আমি ছেলেবেলায় ‘বাবু’ই ছিলাম। কারণ দাদিমা ওরফে ঠাকুমা আমাকে ‘শান্তু বাবু’ বলেই তো ডাকতেন। ডাকত। এই লেখায় আমি ঠাকমাকে কখনও আপনি আজ্ঞে করে লিখব, কখনও ‘তুমি’ করে। ‘সোনাবাবু’ ডাকবার প্রধান কণ্ঠস্বরই তো মন বেওয়া, ওই দাদিমা।

শান্তুর কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছিল। বরফি চাচীর কাছ থেকে সিধা চাইতে হবে ঝাঁকড়া জলকাঁটা। তারপর তাড়াতাড়ি যেতে হবে মণি সরকারের বাড়ির বাইরের পালাঙ্গায়। মোতি মিঞার জোড়া আমতলার কাছের রাস্তার ধারের কুয়াতলার পাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে গলা তুলে জানান দিতে হবে, ‘ওগো সেজমা, ওগো হাসি সরকার, জলকাঁটা এনেছি দেখো! জিনিসে কাজ হবে মা?’

কিন্তু গল্পটা হলো অন্য রকম।

বরফি চাচী আমার প্রার্থনা শুনে বলল, ‘শোনো বাছা, ঝাঁকড়া পানিকাঁটা তো নাই। দড়ি ছিঁড়ে সে কাঁটা ইন্দারায় তলায়ে আছে। দুইচার আঁকড়িতে চলবে? চলে তো নিয়া যাও! চয়ন না এলে ঝাঁকড়া কাঁটা উঠাবে কে? চয়ন রে ডাকক্যা আনতে সরদরা কেহ যায় নাই। ছোট বড় কারু সুমায় (সময়) হয় নাই সুনা! দিব? দুই আঁকড়ির কাঁটা নিবা? দাঁড়াও আনন্যা (এনে) দিই!’

—‘তোমাদেরও দড়ি ছিঁড়ে চাচী আম্মা!’ এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করে ক্ষুদ্র শিশুটি।

—‘ক্যানে ই কথা শান্তু?’

— ‘তোমাদের অনেক পাট। অনেক দড়ি আম্মা!’

—‘দেখো কথা! কুয়ার দড়িতে পানি নেগে নেগে সহজেই পচ্ ধরে বাছা। আর আলিস্যিতে আলিস্যিতে হয় কি পচ্-দড়ি বদলায়ে লোতুন দড়ি দেওয়া হয় না। তাইতেই হয় কি, ছড়াত্ করে, ঝপাং করে দড়ি আগা কি মাঝ ছিঁড়্যা গিয়া পানিতে খসে। সুতাকারণ (সুতরাং) দড়ি ছিঁড়ে ফরাজির কুয়ায়, বুকের ভিতরি সেই আওয়াজে চমকে নাফায়ে উঠে বাবা!’

—‘দাও, তা হলে দুই আঁকড়ির কাঁটাই দাও। নতুন বউ অপেক্ষায় আছে চাচীজান!’

এই বলে অপরাধী শান্তু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল জোয়ালি কাঁঠাল গাছতলায়। ইতিমধ্যে তার পায়ের কাছে একটি নেউল এসে কী যেন খুঁটে নেয়ার চেষ্টা করে ফিরে গেল। কোথাকার ডিহিতে শান্তিমাখা এবং ঈষত্ বিষণ্ন সুরে ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘু ডাকলে মনের ভেতরে শান্তির সঙ্গে কান্না-কান্না একটা ভাব ছলছল করে ওঠে, সেই ছেলেবেলা থেকেই এইটে হয়। শান্তুর কান্না পাচ্ছিল। হয়তো সে পাপ করেছে বলে আরও কান্না পাচ্ছিল।

বাঁ হাতে অগত্যা দু’আঁকড়ির জলকাঁটা। ডান হাতের মুঠোয় ধরা পাটকাঠির সাইকেলের ফেঁসো-বাঁধা মুঠা—এই সবই আমার শৈশবের মহত্ তুচ্ছতা। এই চৈত্রেও একটা ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া কোনও দিগন্ত পার থেকে বয়ে আসছে। পাপভয়ে এক নিতান্ত বালক কাঁধে দুই ফরিস্তাকে নিয়ে একা একটি জলকাঁটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে—এই চৈত্রে ধুলার রাস্তার উপর দেখা যায় বাতাসের ঘূর্ণির পাতাখড় পাকিয়ে নিয়ে বয়ে যাওয়া খেলা। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।

পাতাখড়ের ওই ঘূর্ণিটা নাকি জিন নামে একপ্রকারের অদৃশ্যজীব চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওটাই ওর ঘূর্ণির এক্কা। ওই জিনিসটা হঠাত্ ফাঁসিতলার বাগানের ওই দিক থেকে পায়ে চলা সরুসাদা সিঁথিপথ ধরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে থাকে। যখন আমি বয়েসে বাড়ব, তখন মনে নানান প্রশ্ন দেখা দেবে। জিন আসলে কী? ফরিস্তা কী? ফরিস্তা আজাজিলকে কেন স্বর্গচ্যুত হয়ে শয়তানে পরিণত হতে হয়েছিল। মানুষই শুধু স্বর্গচ্যুত হয়নি। ফরিস্তা অবধি স্বর্গচ্যুত হয়, ধর্ম এমনই বিষম ব্যাপার। বছর বারো-চৌদ্দ বয়েস হলে ঠাকুমাকে তাঁর বলা নানান ধর্মকথা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করি। তার মধ্যে দশরথ রাজার গল্প ছিল, চাঁদ সওদাগরের গল্প ছিল। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের গল্প ছিল, রামায়ণী কথা স্কুলে পাঠ্যও তো ছিল। আরব্য রজনীর গল্পে জিনের কারবার ছিল। আমার দাদিমা একই মুখে শোনাতেন শিব আর উমার গল্প এবং শোনাতেন কারবালার যুদ্ধকথা। বিচিত্র পুরাণ ও পরণকথা দাদিমায়ের অধিকারে ছিল। আমি গল্পগুলি বিশ্বাস করতাম, ফের ঈষত্ সন্দেহমাখা প্রশ্নও তো তুলতাম।

আমার ছেলেবেলার মনটাকে তো আজকাল বেশ খানিকটা চিনতে পারি। যিশুর গল্প, মোজেসের গল্প, ইব্রাহিমের গল্প, ইসমায়েলের গল্প, দাউদ ও দাউদপুত্রের গল্প (জ্ঞানী সুলায়মানের গল্প), দৈত্যদানো পরীর গল্প, তা ছাড়া বিচিত্র লোকগল্প; বেশুমার গল্পই আমার শৈশব। এখন প্রশ্ন বিশ্বাসই যদি না করি, তা হলে উমা বিদায়ের গল্পে আমার চোখেও জল কেন দেখা দিত দুর্গার বিসর্জনের সন্ধ্যায় সদরঘাটে? ঘূর্ণির এক্কা এগিয়ে আসছে; আরব্য রজনীর জিন এগিয়ে আসছে।

আমার হাতে দু’আঁকড়ির জলকাঁটা দেখে নতুন বউ হাসি সরকার তত খুশি হতে পারল না।

ঈষত্ পানসে সুরে বলল, ‘ঝাঁকড়া কাঁটা পাও নাই?’

বললাম, ‘ঝাঁকড়া কাঁটা দড়ি ছিঁড়ে কল হাজীর বড় কুয়ায় খসে গেছে। চয়ন ছাড়া ওই কাঁটা উঠবে না।’

—‘অ। আচ্ছা দেও। আর একটু কষ্ট করতে হবে বাপ শান্তু! অবশ্যি এত খাটাচ্ছি, জানলে দাদি কারিমন আমারে ছিঁড়ে খাবে। তুমি দাদিমাকে বলে বার হয়েছ তো! নাকি আপুন মুনে পাটকাঠির সাইকেল নিয়া সফর করছ সুনা?’

শান্তু মাথা নিচু করে জলকাঁটা এগিয়ে দেয় হাসি সরকারের দিকে। আসলে সে তো দাদিমাকে বলে আসেনি। তাতে করে সমস্যাও তো কম হয় না! পোতা চোখের আড়াল হলেই কারিমন বেওয়া বড্ড উতলা হয়ে পড়েন। একখানা লাঠিতে ভর করে পোতাকে খুঁজতে বার হয়ে পড়েন। আশেপাশের গ্রামে চলে গিয়ে শান্তু মাঝেমধ্যে হারিয়েও যায়, চট করে বাড়ি ফিরতে পারে না। একেবার সে একটা বড় আকারের মাঠ-কাছিমের সঙ্গে কাছিমটাকে অনুসরণ করতে করতে মাধবপুরের মসজিদপাড়ার আমবাগান-ঘেঁষা ক্ষুদ্র বনটায় ঢুকে গিয়েছিল। সেখানে একলা দাঁড়িয়ে পিটুলির পাকা ফল খাচ্ছিল বঁইচি মনে করে। মসজিদপাড়ার এক তরুণী ওই অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে জঙ্গল থেকে টেনে আনে এবং মুখ থেকে আধগোলা পিটুলি ফল ‘থুঃ’ করিয়ে বার করে দেয়। তারপর শান্তুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। তখন শান্তুর বয়েস বছর সাতেক বড়জোর।

বঁইচি মনে করে পিটুলি ফল খেয়ে ফেলার ঘটনা বিশেষ আশ্চর্যের সন্দেহ নেই। কারণ পিটুলি গাছ চিনতে ভুল হলো কেন? গাছগুলি ছিল অত্যন্ত ঝাড়ালো, তা হলেও পিটুলিই তো বটে, চিনেও শান্তু কী মনে করে ফলগুলোকে বঁইচি ভাবল কে জানে! মুখে চারটি ফল খেয়েই মনে হয়েছিল, এ বঁইচি নয়। বঁইচি অন্য রকম ফল, আরও লাল হয় পাকলে। তার স্বাদ আর গন্ধই আলাদা।

ঠাকমা ব্যাপার শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘তুমি বঁইচি খাবে বুললেই তো পার বাবা। আচ্ছা, নিয়া যাব, শিশার মাঠে, গাছ চিনবে, ফলও খাবে বাবু! একদিন নিয়া যাব মুই। এখুন কাজীবাড়ির পাকা করমচা খাও। লাও, মুখ হাঁ করো ভাই। নুন নিবা? সময় হোক। লিচ্চয় নিয়া যাব শিশাডিহি।’

প্রথম যেদিন ঠাকমা আমাকে শিশাডিহার/ ছোট আমবাগানের নিচের জমিতে বাগানের ঢালে বঁইচি বনটায় ফলে থাকা পাকা বঁইচি ফল দেখিয়ে বললে, ‘তুলে আনো’—সেদিন আমার বিস্ময় আর আনন্দের শেষ ছিল না। বঁইচি বনটা নিতান্ত ক্ষুদ্র; এটাকে ঝোপ বলাই ভালো। ডিহির নাবালে যে জমি, তা কিন্তু শিশাপাড়ার খালের অন্তর্গত। ওটা মাধবপুরের বড়লোক কোনও এক খানেদের জমিই বুঝি হবে।

আমার ওই জনপদের সর্বত্র বাগান। আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-পেয়ারা-তাল-বহড়া-বেল, আরও কত কিসের বাগান। শস্য-প্রান্তরেও এক জায়গায় দেখা মেলে আমের বাগানের। যাকে আমরা বলতাম ফসলের মাঠ, তার বুক চিরে পায়েচলা সরুপথ, সেই পথে যেতে যেতে বাগান পড়বে মাঠের মাঝে, তার ছায়ায় বসে নিয়ে বা জিরেন নিয়ে ফের পথচলা যায়। ওই বাগানে চাষিও জিরেন নেয়।

বাগানের ঢালে রানি আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে লাঠিতে ভর রেখে দাদিমা বললে, ‘যাও, তুলে আনো। মনে রাখিও এ জমি অমুক (নাম বলল দাদি) খানের জমির বঁইচি। যাবার সময় মাধবপুর হয়্যা যাব, খানের পরিবার (স্ত্রী)-কে বলব, পোতায় খানের জমির বঁইচি তুলেছে। বাচ্চার সাধ কিনা সুফিয়া! বলি কি, দোষ ধরিও না। বাছারে আজ গাছের পাকা বঁইচি চিনালাম মা।’

এই সব কথা যখন বলছে দাদি, তখন মাঠের সাদা-সরু পথ ধরে একটা জিন-তাড়িত হাওয়ার ক্ষুদ্র গোলা (ঘূর্ণি) পাকাতে পাকাতে যাচ্ছে। তাই দেখে দাদিমা কোরানের কোনও একটি আয়াত আউড়ে উঠল, হাওয়ার গোলা ঠাকমার একেবারে পিঠের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল। বার্ধক্যবশত অর্ধ-অবনত দাদিমা জিনের এইভাবে চলে যাওয়াতে ঈষত্ সম্ভ্রমে লাঠিতে ভর দিয়ে মুহূর্তের জন্য সিধে হয়ে গেল। ঘূর্ণি চলে যেতেই ফের আগের অবস্থায় ফিরল অর্ধ-অবনত দাদির শরীর।

দাদিমায়ের লাঠি হাতে এইভাবে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাটাকে বলা যায় রুকুভঙ্গি—নামাজে দাঁড়িয়ে খোদার সামনে অর্ধপ্রণত (সিজদা হলো পূর্ণ নত হওয়া) হওয়ার নাম রুকু। দাদিমা ওয়ক্তি (ওয়ক্ত মানে সময়, তা থেকে ওয়ক্তি) নামাজি—তার মানে তিনি পাঁচবেলা বাঁধা নামাজ পড়েন। নিরক্ষর হলেও শ্রুতি মারফত নামাজের দোয়াদরুদ ইত্যাদি শিখেছেন।

অল্প কিছুক্ষণ আগে জিন-তাড়িত হাওয়ার গোলা আমার থমকে দাঁড়িয়ে পড়া দু’পায়ের একেবারে কাছে এসে থেমে গিয়ে নিতান্ত চুপ করে গেছে। তখন আমার শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠেছিল। দু’পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে বাচ্চা জিনটা (আমার কেন যেন বাচ্চাই মনে হলো তখন) যদি শরীরে ভর করে, তা হলে আমি পাগল হয়ে যাব।

আমার বড় মাকে মাঝে-মাঝেই জিনে ধরত। তার কারণটাও ছিল অদ্ভুত! বড়-মা নিরক্ষর ছিলেন, তাঁর সমস্যা হয়েছিল, তিনি কিছুতেই নামাজে ব্যবহূত আরবি আয়েত মনে রাখতে পারতেন না; আরবি ভাষাটাই তার কাছে এত জটিল ঠেকত যে সেই লব্জগুলি ঠিক করে উচ্চারণই করতে পারতেন না। উচ্চারণই জটিল, শব্দ আয়ত্ত করা সত্যি তো কঠিন। তাঁর পূর্ণ ওয়ক্তি নামাজি হওয়ার এক নিরাকুল বাসনা ছিল, মানুষের কারু বাসনা, বিত্ত বাসনার চেয়েও তা তীব্রতাযুক্ত এক মস্ত মোহ।

হা ঈশ্বর! বড়মা আয়েত কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারলেন না। আমার মায়ের কাছে তিনি নামাজ শিক্ষা করতে আসতেন, একটি খিড়কি দরজার ওপারের উঠোন থেকে। বড়মায়ের আলাদা উঠোন। মেজমা আর আমাদের একই উঠোন ছিল নতুন হাসানপুরে (আমার জন্মগ্রাম)। একটা আধ-মানুষ উচ্চতার খিড়কি দোর ঠেলে মায়ের কাছে আসতেন বড়মা। তারপর শুরু হতো নামাজ শিক্ষা। মায়ের উচ্চারণকে নিজের গলায় তুলে হুবহু আউড়ে স্মৃতিধার্য করাটা ছিল কাজ। বড় মায়ের। যেমন সুরা ‘কাল কওসর’—সবচেয়ে ছোট সুরা (অনুচ্ছেদ)। মা বলত, ‘বলো বুবু, ইন্না তোয়ায় না, কাল কওসর’! এই ‘তোয়ায়-না’ উচ্চারণ জটিল হয়ে যাচ্ছে দেখে মা সহজ করবার জন্য বলত, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, বলো ইন্না তাই না, বাংলায় ‘তাই না’ কথাটা শুনেছ তো, সেই রকম করে বলো, ইন্না তাই না, কাল মানে আগামী কালের ‘কাল’ আর ওপাড়ার কওসর শেখের কওসর। অর্থাত্ কাল কওসর। বলো বুবু। ইন্না তোয়ায় না কাল কওসর—তোমাকে খোদার কওসর দান করা হয়েছে। অর্থাত্ তোমার পাতেও সুধা দেওয়া হয়েছে, বুবু। তুমিও বঞ্চিত হও নাই।

কিন্তু না। ওই আয়েত কিছুতেই মুখস্থ হলো না বড়মায়ের। অকাট্য এক পাপভয়েই কি বড় মায়ের দেহে কালো একটা জিন ঢুকে গেল? ইয়াহিয়া মৌলানা বললেন, ওয়ক্তি হও কালোসোনা, জিনের বালাই দূর হবে। আমি হাসি সরকারকে শুধালাম, ‘আমাকে আর কী করতে হবে সেজ মা?’

সরকার বাড়ির সেজ বউ হাসি সরকারের বয়েস তখন কতই বা ছিল? যদি আমার বয়েস বছর আষ্টেক কি নয়েক হয়, ওর তা হলে পনর কি ষোল! অর্থাত্ হাসি আমার চেয়ে বছর ছয়-সাতের বড় বই তো না? কিন্তু হাসির কথাবার্তা ভঙ্গিমে ছিল ছাব্বিশ বছরের যুবতী মায়ের মতো। আমি তখনকার কালে ১৩ বছরের কিশোরীকে মা হতে দেখেছি। ১৬ বছরের কিশোর ‘জনক’ হয়েছে সে কালে। সে বাপেরও বাপ-বাপ গন্ধ থাকত। আর মায়ের তো থাকতই মা-মা গন্ধ। তাদের দেখে বুঝেছিলাম, মানুষ এই পৃথিবীতে বাপ-মা হওয়ার জন্যই জন্মায়! তার সঙ্গে সে দু’চারটি অন্য কাজও করে!

হাসি সরকারের সন্তান হয়ত এখন ওর পেটের মধ্যে রয়েছে। গর্ভে সন্তান এলে একজন কিশোরী মাতৃ-অনুভূতি হয়ত খোদার কাছ থেকে বা তার শরীরের ভেতর থেকেই পেয়ে যায়। হাসির পেট ফুলো-ফুলো ঠেকছিল। কিছুটা। বিয়ে হয়েছে ৮/৯ মাস, এখনও সে বউ হিসেবে নতুন, বাচ্চা জন্মে গেলে আর নতুন থাকবে না। নতুন সন্তান নতুন বউকে পুরাতন করে দেয়। যা হোক। সে আমাকে মায়ের সুরে আদেশ করলে। বললে, পাটকাঠির সাইকেল কোথাও হেলান দিয়ে রেখে সওদাগর মন্ডলের বাড়ি ছুটে যেতে। সেখানে কী?

এই দানের কুয়ায় সারা বছরের জলতোলার দড়ি (রশি) দান করেন সওদাগর। মণি সরকারের বাড়ি রশি পাকাবার ব্যবস্থাই নেই। এদের বাড়িতে টাকুর নেই; টাকুর হচ্ছে দড়ি পাকাবার বিশাল বড় তকলি—কারণ এটি বিড়িবাঁধা পরিবার, ব্যবসায়ী—এরা চাষি নয় মোটে। চাষির সঙ্গে এদের জীবনধারা মেলে না। এরা বস্তুত চাষবাস বোঝে না। ফসলের মাঠে নামবার এদের অভ্যেসই নেই। এরা তত ধার্মিকও নয়। পরে এ বাড়ির ছোটছেলে অবশ্য ধার্মিক হবে বেশ। সে তথ্য সুতরাং পরেই কহতব্য।

এরা এখানকার পুরাতন বাসিন্দা নয়। শোনা যায়, ঔরঙ্গাবাদ নাকি কোথাকার লোক যেন ওই মণি সরকার। হয়ত তিনি ঔরঙ্গাবাদের বিড়ি ব্যবসায়ী। চাষবাসের সঙ্গে ওই মানুষটির কোনও নাড়ির যোগ নেই। চাষি হওয়ার দিকে এদের ঝোঁকও নেই কোনও। এরা ব্যবসায়ীই থাকতে চায়। চাষবাসের মেহনত এরা শরীরে নিতে চায় না। হয়ত এরা ঔরঙ্গাবাদে গঞ্জে বাস করত। এরা স্বভাবত গ্রামের লোক নয়। এই পরিবারের আশেপাশে আমার নিতান্ত শৈশবে কোনও প্রতিবেশী পরিবার ছিল না। এরা কেমন বিচ্ছিন্ন একক একটি পরিবার হিসেবে বাস করত। এখানে এই কুয়োটা কীভাবে হয়েছিল, যখন এখানে কোনও বসত বাড়িই ছিল না? তার মানে কুয়োটা পথিক-চাষির তৃষ্ণা নিবারণে পত্তন হয়। এরা ঔরঙ্গবাদ থেকে এসে মোতি মিঞার বাবার কাছ থেকে হয়ত জমি কিনে বসত নেয় এবং কুয়োটা দানের কুয়ো হলেও, ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকে। ওই কুয়ো যেন সরকার ফ্যামিলির আপনার ইন্দারা।

এই পরিবারটি তত ধার্মিক পরিবারও নয়। এরা বহিরাগত। আমরাও বহিরাগত। আমরা দুটি নদী পেরিয়ে (নতুন হাসানপুর থেকে) এই টেঁকাগ্রামে এসেছি। মণি সরকারও দুই-তিনটি নদী পার হয়ে থাকবেন। টেঁকা (উচ্চারণ ট্যাঁকা) কথাটার মানে কী? শোনা যায় বাঁক থেকে ট্যাঁক। কিংবা ট্যাঁক মানে অঙ্কুর। ছোলা জলে ভিজিয়ে রাখলে ট্যাঁক নেয় অর্থাত্ অঙ্কুর হয়। তবে বাঁক থেকে ট্যাঁক কথাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। বাঁক মানে নদীবাঁক।

এই জায়গা অবধি পৌঁছতে পথও একটা বাঁক নিয়েছে। এই বাঁক কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। সম্ভবত তার কারণ কাজী পাড়ার মস্ত বাগানটা পথের বাঁক নেয়াটা বুঝতে দেয় না। যা হোক। আমরা বহিরাগত অর্থাত্ রিফিউজি। ভারি আশ্চর্যের কথা।

দুটি ফ্যামিলিই রিফিউজি। এই কারণেই দুই ফ্যামিলির মধ্যে আমার কৈশোরেই সদ্ভাব গড়ে ওঠে এবং আরও একটি হূদ্য কারণ ছিল এই সদ্ভাবের পিছনে। মণি সরকারের বড় ছেলের নাম কলিমউদ্দিন। আমার বাবার নামও কলিমউদ্দিন।

মণি সরকার আর ঠাকুমা মিলে একটা ছোটখাটো উত্সব করে দুই কলিমউদ্দিনের মিতে পাতানো হয়। এই কারণে দুই পরিবারে একটা বিশেষ সদ্ভাব জন্মে। শান্তু যখন আর একটু বড় হবে তখন মণি সরকারের ছোট ছেলে রুহ্ মহম্মদ হবে তার একান্ত বন্ধু।

আমরা রিফিউজি। যখন বেশ খানিকটা বুদ্ধি পড়ল, তখন ওই রিফিউজি লব্জটি শুনলে মনে মনে অত্যন্ত কষ্ট পেতাম। তবে হিসেব করে দেখেছি ওই বড় নদীটাই আসলে দুটি ছোট নদীকে জল দেয়। টেঁকার ছোট নদীর নাম গোমানি। নতুন হাসানপুর (আমার জন্মগ্রাম)-এর নদীর নাম ফের ‘ছোটনদী’—ছোটনদীই নদীটির নাম। গোমানির তুলনায় তার খাত ছোট বা সংকীর্ণ। বস্তুত আমরা এসেছি এক নদীর অববাহিকা থেকে আর এক ছোটনদীর অববাহিতায় এবং এসেছি বড় নদীটার কাছাকাছি। শুধু নদী পেরিয়েছি বলেই কি রিফিউজি? কিংবা এক নদী ফেলে আর এক নদীর কিনারায় বসত নিলেই কি মানুষ রিফিউজি হয়ে যায়? কিন্তু বড় নদী ভৈরবকে বাদ দিলে ওই দুই নদীর অস্তিত্ব কোথায়?

মাত্র ত্রিশ বত্সরে নদী ভৈরবের মৃত্যু হলো। সুতরাং ছোটনদী দুটি বাধ্য হলো মরে যেতে। তা হলে, আমার হাতে আর রইল কী? গঙ্গাও তো মরতে বসেছে। অথচ আমার যে অঞ্চল তা ওই নদীরই আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল বলে মনে হয়। পাট আর লাট নিয়ে চলত জীবন। আম আর সবজির জায়গা ওটা। ওখানেই তো চাষির নগ্ন ঊরুতে ঘষা ও পাক খেয়ে টাকুর পাক খেয়ে উঠত। ধানপাট সবজি-আমের জায়গা। টাকুর ঘুরত। তকলি ঘুরত। রাঢ়বাংলার সঙ্গে ওই অঞ্চলের কোনও মিল নেই। বা গরমিল অনেক। ওখানকার নদীর বালি রূপালী। রাঢ়ের নদীর বালি লাল। রাঙামাটি বলে কিছু নেই টেকায়। ওই জায়গার নাম হওয়া উচিত রাজশাহী-মুর্শিদাবাদ।

টাকুর। সওদাগর মন্ডল টাকুর ঘুরিয়ে পাটের দড়ি পাকাচ্ছেন। লুঙ্গি উঠে এসেছে ঊরুকে উদোম করে তাঁর উপস্থ অবধি। উপস্থ-স্থলে জড়ো হয়ে রয়েছে লুঙ্গি। শান্তু ওই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত। লুঙ্গির উপর দিয়ে তো টাকুর ঘষা খাইয়ে ঘুরন্ত করে তোলা যায় না। ঊরুকে উদোম করতেই হয়। টাকুরের চাকা খাঁজকাটা, রয়েছে টাকুরের দণ্ডটি মাঝ বরাবর। ওই খাঁজে আটকেই পাটের নর দণ্ডের উপরিভাগ জড়িয়ে ধরে ঘুরতে থাকে এবং নর দড়িতে পর্যবসিত হয়। এই নগ্নতা, ওইভাবে লুঙ্গি জড়ো করা ধর্মসম্মত নয়। হাঁটুর উপরে লুঙ্গি উঠে গেলে ধর্ম বা ওজু নষ্ট হয়। অথচ পাটের টাকুর একজন হাজী সাহেবকেও আধানাঙা করে তোলে। কী বিচিত্র ব্যাপার এই ধর্ম ও নগ্নতার চেহারায়!

বললাম, সওদার দাদো, কুয়ার রশি চাইলে হাসি বউমা! দেও।’

১০

সওদাগর মন্ডল মাঝারি চাষি। নিরক্ষর নামাজি। শোনা যায়, মানুষটি মিথ্যা কথা বলেন না। তাঁর কাছে জুবানের দাম লাখ টাকা। তাঁর নিয়ত (মনস্থ করা, অঙ্গীকার করা, কথা দেয়া ইত্যাদি) খুব পাকা। তিনি কবে যেন দশ-মজলিসে কথা দিয়েছিলেন, মণি সরকারের বাড়ির সামনের দানের কুয়ার রশি সারা বছর নিজ হাতে পাকিয়ে সরবরাহ করবেন, সেই কথা ও কাজের কখনও ব্যত্যয় হয়নি।

—‘ভাই! রশিতে কি পচ্ ধরেছে? দিন পনর আগে তোষা পাটের সুনালি (সোনালী) রশি একডা দিয়্যাছি হাসি সরকারের হাতে, সেইডেয় পচ্ ধর্যা গেল ক্যামনে ক্যাপটেন?’

বুঝলাম, পাটকাঠির চাকাবিহীন রামধনু সাইকেল পথের ধুলার উপরে দিয়ে চালিয়ে এসেছি বলে প্রথমে ভাই বলার পর আমাকে ক্যাপটেন সম্বোধন করলেন সওদাগর দাদো ঠাকুরদা।

আসলে দুটি পাটকাঠি জোড়া করে দুই প্রান্তে বেঁধে, তারপর ওই দুই পাটকাঠিকে টেনে ধনুকের ছিলার মতো প্রসারিত করে, ওই ফাঁকে পাটকাঠিরই সোয়া বা দেড় হাতের দণ্ড খাড়া করা—এটাই এই সাইকেল তৈরির কারিগরি—ভাবলাম, এ জিনিসেরও ক্যাপটেন হয়! দাদোর সম্বোধনে আমি লজ্জা পেলাম আবার আনন্দও পেলাম। পাটকাঠির চেয়ে ক্ষণভঙ্গুর জিনিস সংসারে নেই। সেই তুচ্ছতা দিয়ে আমার এই রামধনু সাইকেল।

তবে হ্যাঁ। এই পাটকাঠি নিয়ে অনেক গল্প আছে। ওই পাট নিয়ে গল্পের শেষ নেই। অবশ্য গোমানি নদী না হলে অমন সোনালী পাটের জেল্লাদার নরি হতোই না। ভৈরব নদীতে পাটের ‘জাগ’ অর্থাত্ পচাই হয় না, কারণ তার স্রোত এতই তীব্র যে, পাট জাগের বড় চাপড়া সেই তোড়ে ভেসে চলে যাবে। তা ছাড়া ভৈরবের জল বালি মিশ্রিত ঘোলা থাকে বর্ষায় এবং ভাদ্রে। ওই জল পাটের জেল্লার শত্রু। ফের সেই জলই গোমানিতে ঢুকে এসে কতকটা থিতিয়ে দেয় বালি, স্রোত হয়ে যায় বিশেষ মন্থর। গোমানি তো আসলে বিলেন নদী।

ভৈরবের খাল আর গোমানির বিল চরিত্রে নিতান্ত আলাদা। খালের পাট আর বিলের পাটের রং জেল্লা এক নয়। খালের পাট সোনালী হয় না। কতক কালচে হয়ে যায়। কারণ খালের জলে পলির থেকে বালি বেশি। ওই বালি পাটের ‘সুরত’ নষ্ট করে দেয়। আমাদের বাড়ির সামনে আমবাগান, তারপরই তো খাল।

সওদাগরের পাঁচ ছেলে। মেয়ে নেই। পাঁচ ছেলের চার জনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে ক্লাশ এইট পর্যন্ত। এইটে ওঠার পর বছরের মাঝামাঝি স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর বছর দুই বাদে ডিমের মহাজনী ব্যবসা ধরে, সদর ঘাট গঞ্জে দোকান দেয়। এখন সে সত্যিই মহাজন, তারও বিয়ে হব হব করছে। সে পাঁচবেলা বাঁধা নামাজ পড়ে।

সে প্রণামপুরের সাদ মওলানার এক সুন্দরী কন্যা (বছর চৌদ্দ বয়েস)-কে বিয়ে করবে নিয়ত (উচ্চারণ নিয়ত্) করেছে। মেয়ে শুধু যে সুন্দরী তাই নয়, সে পরমা সুন্দরী। ওয়ক্তি নামাজি এবং এই চৌদ্দতেই কোরান পড়তে পারে। সুতরাং ওই মেয়েকে পত্নীরূপে পেতে হলে ধর্মে নিদারুণ নিষ্ঠা চাই।

ছোট ছেলের নাম তেলায়ত মন্ডল। যখন তার বছর নয় বয়েস তখন সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়। যখন সে গঞ্জের হাইস্কুল এইট পর্যন্ত পৌঁছে ছেড়ে দিল, তখনই তার বয়েস ষোল প্লাস। এখন হয়ত বছর বিশেক হয়ে গেছে। ওর দাড়িগোঁফ গজিয়ে গেছে। ওর অন্তত বছর চার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যা হোক। এ বছরের পাটের টাকায় প্রচণ্ড ধুমধাম করে তার বিয়ে হবে। সাদ মওলানাও রাজি হয়েছেন।

হবেন না কেন? তেলায়ত তো জুম্মার নামাজ চকচকে হাম্বার সাইকেল চালিয়ে গিয়ে প্রণামপুরের মসজিদে সাদ মওলানার নেতৃত্বে যে নামাজ হয়, সেই সূত্রে দাঁড়িয়ে পড়ে আসে। সে গোঁফ মসৃণ করে চেঁছে রাখে, কিন্তু দাড়িতে ক্ষুর ছোঁয়ায়নি।

সাদ মওলানা তেলায়তের ক্ষুর-না ছোঁয়া দাড়ি সস্নেহে স্পর্শ করে বলেছেন, ‘এ তোমার ইশায়ী (ইশা-যিশু) নূর (দাড়ি) আব্বা! উনার তো ইহলোকে নিকাহ্ হয় নাই। বেহেস্তে হবে। এই যে দাড়ি তোমার, তার গুণে ওই বিহাতে দাওয়াত পাবে। তুমি ওই নিকাহের স্পেশাল মেহমান।’

—‘জি। কিন্তু আমি যে ইহলোকেই নিজের শাদিটা চাই বাবা!’

বলেছে তেলায়ত।

বিয়ের বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে ভেবে তেলায়ত কিছুটা উদ্বিগ্ন নিশ্চয়। তাই নিজেই তার নিকাহের তত্ত্বতালাশ করেই এগোচ্ছে, প্রণামপুরে গিয়ে সালাত অর্থাত্ নামাজ কায়েম করে আসছে। সাদ মওলানাকে প্রভাবিত করতে তার চার নরি দাড়িকেও সুন্দর করে মেলে রাখছে। তার সেই গল্প সংসারে হিরা পর্বতের সুর্মার মতো প্রসিদ্ধ হয়ে সিমুল তুলার বীজপানা ছড়িয়ে গেছে টেঁকা অঞ্চলে।

একটা শিশুও জানে তেলায়তের থুতনির নূর ফরিস্তার নূরের মতোই বেহেস্তি বিভায় অপার্থিব সুন্দর। সেই বিশে যুবক বাড়ির প্রাচীরের ঘেরের দরজা ঠেলে বাইরে এল। শিশু শান্তুকে দেখে নিয়ে বৈঠকখানায় টাকুরে পাটদড়ি তৈয়ারিতে ব্যস্ত বাপকে দেখলে এবং ত্বরিতে প্রায় লাফ দিয়ে বৈঠকখানার দাওয়ায় বাপেরই কাছে পৌঁছে গেল।

প্রায় ছোঁ মেরেই যেন বা, বাপের মাথা থেকে নামাজি গোল টুপিটা তুলে নিলে। বাপ চমকে উঠলেন। আচমকা ছেলের এই আচরণে হয়ত ভয়ই পেয়েছেন সত্তর ছুঁই ছুঁই এই বৃদ্ধ।

—এ তুমি করছ কী আব্বামিয়া! উদাম ঊরু নিয়া পাটের নরি টেঁকছ রশি বানাতে। ইদিকে মাথায় রেখেছ সালাতি টুপি। এমন না-জায়েজ (অবৈধ) কাম করছ শুনলে সাদ মওলানা তো এই মন্ডল-ফ্যামিলিতে কন্যাদান করবে না।’

সওদাগর লজ্জায় অধোমুখ ও ঈষত্ সংকুচিত হয়ে বললেন, ‘হা আল্লা! খিয়াল তো নাই, ছোট খুকা! খুব কি গুনাহ্ করলাম তিলায়ত? কও, খুব কি করলাম?’

তেলায়ত কুয়ার জলরশি দিয়ে আমাকে এক প্রকার বেঁধেই সাজালে। দুই কাঁধের উপর দিয়ে চলে যায় সেই রশি। মনে হলো, আমিও তো গুনেহ্গার, তা সওদাগরের পাপের চেয়ে বাড়া। কারণ, আমারই শিশুমন আমাকে বলল, তুমি ভুল করে এই পাপ কর নাই। সওদাগরের মাথার টুপি ভ্রমবশে হয়েছে। আমারটা বোধহয় সত্যিকারের ‘গুনাহ্’। আমি অপরাধীর মতো হেঁটে চলেছি এই পৃথিবীর পথে। আমার চোখে জল উপচে উপচে আসছে। শিশুর এই কথা কাঁধের দুই ফরিস্তা লেখক ছাড়া কেউই টের পাচ্ছে না। হা দাদিমা! এ আমি কী করলাম!

১১

আমাকে এভাবে রশি-বাঁধা অবস্থায় দেখে সরকার বাড়ির নতুন বউ হেসেই ফেললে। ‘মুন্ডলজি বাঁধলে এমনি করে, আহা বাছা রে!’ বলে মায়ের মতো ভাষায় দরদ দেখালে বউটা। আমি তখন জানালাম, মন্ডলজি নয়, তার ছোট ছেলে তেলায়ত আমাকে রশিকষা করেছে।

হাসি সরকার, ওই নতুন বউ আমার ওই কথা শুনে কেমন যেন গজগজ করতে থাকল। শান্তু তখন মোটামুটি বোঝাবার চেষ্টা করলে তেলায়ত কেন তার বাপের উপর রেগে গেল; পাট টেঁকতে গিয়ে সওদাগরের লুঙ্গি কেমন করে ঊরু উদোম করে তাঁর কোমরের দিকে সরে গেছে, ইদিকে মাথায় সালাতি (নামাজি) চুপি ছিল, সেটি নামিয়ে রাখতে ভুলে গেছে বুড়া মানুষটি, তাইতে গুনাহ্ (পাপ) হয়েছে কতকটা, সেই ভয়ে কেমন করে খেদ করলেন বৃদ্ধ, সব বলার পর বললাম, অর্থাত্ শান্তু বলল, এমন কাণ্ড সাদ মওলানা শুনতে পেলে মন্ডল ফ্যামিলিতে কন্যাদান করবেন না, এ কথা বলে তেলায়ত রেগে গিয়ে অবশেষে আমাকে রশি দিয়ে কড়া করে বেঁধে ছেড়ে দিলে!

—‘হা খুদা! কী কথা শুনালে বাছা! মরি মরি!’ এই বলে হাসি কুয়ার নতুন রশি দিয়ে জলকাঁটা জুত করে বেঁধে কুয়ায় নামিয়ে কুয়ায় অল্প ঝুঁকে সেই রশি পাকসাটা মেরে ঘোরাতে থাকল। ঘোরাতে ঘোরাতে কথাও বলে যেতে থাকল খাদের গলায় অর্ধস্ফুট সুরে।

—‘তেলা মুন্ডল গিনির সাথে শাদি বসাবে বুলে খেপে উঠেছে! সাদ মওলানার বিটি গিনি খাতুন। শুনেছি কেশবতী রূপমতী-দুধে-আলতা। কিন্তুক ব্যাপার বড্ডাই রাষ্ট্র করছে তেলা (তেলায়ত)। নারীর লোভে ধম্মের রোখ চাপলে আল্লামিঞাও তো বড় ফাঁপরে পড়ে বাবা! নারী-বাসনা কম কথা! বাপকে ধম্মের খোঁটা দেয়, ইদিকে বাচ্চাকে রশিবান্দা করে। ক্যানে রে তেলা! ওই টুকুনই বাছা কী এমন পাপ করেছে শুনি! নাহ! উঠবে বুলে মুনে হয় নে শান্তু!’ বলে ওঠে হাসি সরকার।

—‘ঘোরাও সেজ মা! ঘোরাও।’

—‘হ্যাঁ শান্তু। ধরেছে বুলে মুনে হচ্ছে, সুভান আল্লা! উঠে আয় পিত্তলের বেলচা। সওদাগরের রশি দিয়া ছিঁড়া রশি উঠায়ে দেও রসুল-আল্লা। খোয়াজা খিজির, কাঁটায় জিনিস ধরায়ে দেও, ‘ওগো ফরিস্তা!’

ফরিস্তা আসলে সবখানে। কাঁধে ফরিস্তা। জলে ফরিস্তা। আকাশে ফরিস্তা। বাতাসে ফরিস্তা। জীবনে ফরিস্তা। মরণে ফরিস্তা। শিশু যখন নিতান্ত শিশু, কথা কইতেও শেখেনি, দোলনায় কি মায়ের কোলে শুয়ে আছে, তখন তার সঙ্গে খেলা করে কে?

ফরিস্তা। কবরে মানুষ যখন একা চিরঘুমে আচ্ছন্ন, তখনও তার কাছে আসবে দেবদূত। ফরিস্তাময় মানুষ। শিশু যে ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দে আনমনা হাসে, তাকে কে হাসায়? যখন আমি লাল লোলাটাও দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে শিখিনি, তখন কে আমাকে হাসাত-কাঁদাত?

ফরিস্তা। খোয়াজা খিজির হলো জলের ফরিস্তা।

—‘হা খোয়াজা। ফেলায়ে দিস নে বাবা! আয়, আয়! বলতে বলতে হাসি কুয়ায় আরও কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। আমিও মনে মনে খোয়াজাকে ডাকতে থাকি। একটা শিশু বুঝে হোক, না বুঝে হোক, হয়ত কোনও নিষ্ঠুর আনন্দে মজা করতে কুয়ার রশি বালতি কুয়ারই জলে ফেলে দিয়েছে, তখনকার দিনে এ কত বড় পাপ কাঁধের ফরিস্তা দুটি কেরামন-কাতেবিনই হয়ত বলতে পারেন! এই পাপের কথা আর তো কেউ জানে না। ওই নাদায় কাঁদতে কাঁদতে মানুষে আর গরুতে নতুন বউয়ের দেয়া দয়ার জল পান করেছে। ওই দৃশ্য দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল শান্তুর।

শান্তু এখন পানির ফরিস্তাকে মনে মনে আকুল হয়ে ডাকছে! তার বেশি করার কোনও ক্ষমতাই তো তার নেই। সে খোয়াজাকে ডাকতে ডাকতে একটি বড্ড সুন্দর ঘটনাদৃশ্য লক্ষ করছিল। রশি ঘোরানোর তাড়ায় এবং কুয়ায় ঝুঁকে পড়ায়, কখনও সে পায়ের গলুই তুলে জলের অদৃশ্য ফরিস্তার দিকে ঝুঁকছিল। কোন ফাঁকে হাসি সরকারের তলপেটের শাড়ির কাপড় কতকটা সরে গিয়ে উঁচু হয়ে ঠেলে উঠলে ফর্সা পেট চোখে পড়ে যাচ্ছে শান্তুর।

পেটের ভেতরে একটা সজীব পিণ্ড ঘাই মারছে। তখন রশি ঘোরানো থামিয়ে নতুন বউটা কুয়োর গা-ঘেঁষা গোল পাটাতনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হেসে উঠছে। কতকটা খিলখিল করেই হাসছে। তারপর হাসি থামিয়ে আপন মনে বলছে, ‘আল্লামিঞা, তোমার দয়া আল্লামিঞা! শুদুই নাপাচ্ছে গো।’

রশিবাঁধা হয়ে ফেরবার সময় দু’চোখ ছাপিয়ে জল এসেছিল শান্তুর। হাসি সরকারের খিলখিল করা ওই হাসি শুনে আর পেটের ভেতরে কোনও একটা সজীব প্রাণের আলোড়ন দেখে দিগন্ত পারের ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো একটা ফুরফুরে সুখ এল তার মনে। বউটা আবার চেষ্টা শুরু করল।

রশি আর বালতি উঠে আসতে আসতে তা জলকাঁটা থেকে ফসকে ফের ঝপাং করে জলে পড়ে গেল। তখনও বউয়ের পেটের পিণ্ড চমকে নড়ে উঠল।

—‘হায় আল্লা! খোয়াজা খিজির পাটপিত্তল ফির পানিতে টেনে লিলে শান্তু! হবে না। চয়ন ছাড়া এ জিনিস উঠবে না। পাঁচ সিকা খচ্চা আছে। চয়নকে ডাকতে কে যায় ওহে খোয়াজা! কে যায়? আমি তো তুমারে যেতে বুলতে পারি না আব্বা! কারিমন আমারে বকবে, তা ছাড়া রমিপুর বড্ড দূর, চিনবা না পথ। পথ হারায়ে যাবা! যাও, বাড়ি যাও। কারিমন বেওয়া ফির পোতা রে খুঁজতে লাঠিহাতে বাহির না হয়। যাও, অনেক করেছ সুনা!’

এই বলে রশি গুটিয়ে জলকাঁটা কুয়ার জল থেকে তুলে নিলে হাসি সরকার। ওই রশি আর বালতি কুয়োর পাটাতনে ফেলে রেখে হাসি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। আমি হতাশ ও নির্বাক হয়ে কাঁচামিঠে আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

এমন সময় সহসা ঠাকুমার ডাক শোনা গেল দূর থেকে। দাদিমা এদিকে আসছে বোঝা গেল। এখন স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। পড়াশোনার তত তাড়া নেই। অবশ্য তখনকার দিনে জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই বিশেষ তাড়া ছিল না। পড়াশোনায় তাড়া ছিল মোলায়েম, মা না পড়লে বকত, দাদিমা বলত, অত বকবার কী আছে! আপনিই হবে! বোকো না তো! বরং ঠাকুমার আরও নানান ব্যাপারে উত্সাহ ছিল। মোলায়েম করে বলত, ‘আচ্ছা পড়ো তো শান্তু, এই ভোরে ফরিস্তা রে শুনাও। ফরিস্তারে শুনালে এই ভোরে নূরের হাওয়ায় পড়া মুখস্থ হয় বাবু!’

কুয়োর কাছে এল দাদিমা। তার সঙ্গে সুধান নাপিত। বুঝলাম এখানে আমার মাথা নেড়া করাবেন ঠাকমা। আমি চমকে উঠলাম!

১২

মাথা নেড়া করতে একটুও ভালো লাগত না। কেন যে মাথা নেড়া করতে হবে বুঝে পেতাম না। নেড়া মাথা নিয়ে স্কুলে যেতে ভারি লজ্জা করত। পাঠশালায় তবু একরকম ছিল, হাইস্কুলে গেলে সেই লজ্জা দ্বিগুণ হয়েছিল। এর কারণ কিছু অদ্ভুত। কথাটা খোলসা করে বলতে হলে দু’দশটি বাক্যি অন্তত লিখতে হয়।

টেঁকা গ্রামে হিন্দুর সংখ্যা ৫ শতাংশেরও কম। পাঠশালার সহপাঠী হিন্দু বন্ধুরা মাথা নেড়া দেখে তেমন কিছু বলত না। কারণ তারা জীবন-ঘনিষ্ঠতার সূত্রে বা জীবনে জীবন যোগ থাকার ফলে জানত, এই রকম মাথা নেড়া মুসলিমরা মাঝে মিশেলে করেই থাকে। হিন্দুরা যে কারণে করে থাকে, এই মাথা নেড়া সে রকম নয়। তা হলে এটা কী রকম?

এটা কি সুন্নাত্? অর্থাত্ মহানবী হজরত (জ্ঞানী) মুহম্মদ কি মাথা নেড়া করতেন? তাঁর কোনও ছবি বা মূর্তি নেই। চৈতন্য দেব বা গৌতম বুদ্ধের মতো তিনিও কি মুণ্ডিতমস্তক ছিলেন? কিন্তু মুণ্ডিতমস্তক মওলানা (ধর্মগুরু) আমি অনেক দেখেছি। গ্রামের অনেক ধর্মপুরুষকে বলতে শুনেছি, ‘মাথা নেড়া করাটা সুন্নাত্।’ জানি নে, মুখে দাড়ি রাখার মতোই সুন্নাত্ কি সেটা? নাকি ইসলামি আচারে আমলনামায় বৌদ্ধ প্রভাব পড়েছে? মুসলিমদের ‘নেড়ে’ বলা হয় কোন ঐতিহাসিকতায়? যা হোক। আমাকে ছেলেবেলায় মাথা নেড়া করতে হতো এবং আমার কান্না পেত।

যখন হাইস্কুলে গেলাম। চক-ইসলামপুর হিন্দু-অধ্যুষিত জায়গা। হাইস্কুলে হিন্দু ছাত্রসংখ্যা মুসলিম ছাত্রের তুলনায় বেশিই। আমাদের ওই হাইস্কুলে কোনও মুসলিম ছাত্রী ছিলই না। সম্ভবত ৬০ শতাংশ হিন্দু এবং ৪০ শতাংশ মুসলিম ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করত। পরে সেটা অর্ধেক অর্ধেক হবে। এমনকি হয়ত শতকরা হিসেব বদলে যাবে। ৭০ শতাংশ মুসলিম, ৩০ শতাংশ হিন্দু ছাত্রছাত্রী হয়ে যাবে। যা হওয়ার হবে। কিন্তু মুসলিম ছাত্রী আমার ক্লাসে ছিলই না। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমার যে ক্লাস, তার এক ক্লাস নিচে একজন পড়ত নওদাপাড়া থেকে। নাম তার হসরুবা। এর বাবাই ছিলেন রেলের চাকুরে, নাম ছিল রাহাত বাবু। ওই অঞ্চলের একমাত্র মুসলিম বাবু। পরে ওই হসরুবা হবেন বিয়ের সূত্রে আমার শ্যালিকা, আমার স্ত্রীর এক দিদি। যা হোক। গল্পটা হলো আমার মাথা নেড়া করাতে সুধান নাপিতকে সঙ্গে এনেছেন দাদিমা।

কিন্তু মাথা নেড়া অবস্থায় হাইস্কুলে গেলে কী কথা শুনতে হতো?

ক্লাসের কোনও বন্ধু হয়ত প্রশ্ন করে বসত, যে-কিনা হিন্দু, বলত, ‘কেউ কি মারা গেল, কে?’

ম্লান হেসে সলজ্জ জবাব দিতাম, ‘কেউ না। সবাই বেঁচে আছে।’

একবার কোনও এক স্যার, সব স্যারই হিন্দু, শঙ্কিত গলায় জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? কেউ কি…’!

—‘না স্যার! এমনি!’ বলে উঠলাম।

—‘এমনি আবার কী?’

—‘খুশকি হয়েছিল বলে দাদিমা নেড়া করে দিয়েছে!’

—‘তুমি ঠিক বলছ?’

—‘স্যার! আব্দুল মাঝি, যে রকম, সে রকম স্যার!’

স্যার সায়েন্সের স্যার; বললেন, ‘বলো ব্যাপারটা! ওহো, মনে পড়েছে। ভারি বুদ্ধি তো তোমার!’

—‘হ্যাঁ স্যার। আব্দুল মাঝি ছুঁচলো তার দাড়ি। গোঁফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া। … সে কবিগুরুর ফ্যামিলিতে পদ্মা থেকে এনে দিত ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম। তখন তার পিতৃবিয়োগ বা সে রকম কিছু হয়নি। হয়ে থাকলে রবীন্দ্রনাথ বলতেন।’ [তখন আমার হয়ত ক্লাস এইট, বাংলা ভাষায় হয়ত কিছু তখন আমি সড়গড় হয়েছি]।

—‘বটে তো!’

—‘হ্যাঁ স্যার! আমার বাবাও মাঝে মাঝে নেড়া করেন। আনিস মক্তবীও করেন। আমার ছোট বোনেরও মাথা নেড়া করিয়ে দিয়েছে ঠাক্মা, মানে স্যার, আমার দাদি।’

—‘নাও। অত আর মানে বলতে হবে না! বসো!’

ক্লাস নাইন থেকে কি টেন থেকে আমি আর মাথা নেড়া করিনি। ততদিনে দাদিমা মারা গেছেন।

মাথা নেড়া করলে মানুষকে খুব করুণ দেখায়। আমি এ রকম অসংখ্য নিরক্ষর গরিব মুসলমান দেখেছি এই বাংলায়। একেবারে হুবহু আব্দুল মাঝির মতো মুসলমান দেখেছি, যার নৌকো থেকে সদরঘাটে দুগিগ ঠাকুর ওরফে উমার বিসর্জন হতো, তখন তারও চোখে জল আসত, সে তখন কাঁধের গামছার খুঁটে চোখের কোণের চিকচিক করা অশ্রু মুছত। হিন্দু হোক, কিন্তু উমাও তো তার ঘরের মেয়ে!

সুধান নরসুন্দরকে দেখেই টের পেয়ে গেছিলাম আমার মাথা নেড়া হবে। আমি তখন পাটকাঠির সাইকেল ফেলে কোনও দিকে পালাবার চেষ্টা করি। পারি নে। ঠাক্মা খবরদারি গলায় চেঁচিয়ে নাপিতকে নির্দেশ দেন, ‘ওকে ধরো তো সুধান।’

সুধান লম্বা ক’ধাপ ফেলে আমার একটা হাতের কব্জির কাছেটায় ধরে ফেলে বলে ওঠেন, ‘রোক্কে খোকা, রোক্কে! আসো, চুলের জঙ্গল সাফ করি। জুলপি বেড়ে গিয়েছে।’

—‘না। আমি, মাথা নেড়া করব না।’ বলে কব্জি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করি। বারবার ‘না’ করতে থাকি। কিন্তু নিস্তার পাই না। কাঁচামিঠে আমগাছের তলায় আমাকে উবু করে বসিয়ে দিয়ে সুধান কামান শুরু করেন কাঠের ছোট্ট আয়তাকার বাকস থেকে ক্ষুর বার করে নিয়ে। আমি কাঁদতে কাঁদতে কামান নিতে থাকি। এ যেন আমার করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত চলেছে; যেন এ অপরাধীর মাথা নেড়া করে দেয়া একটা ঘটনা। এই জন্যই কি জলের দেবতা কিংবা ফরিস্তা কুয়ায় পতিত পেত্তলের বালতি উপরে উঠে আসতে দিলেন না! আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি, ‘ফড়িং কাকা রেহেল বানিয়ে ফেলে রেহেলের জ্যাকেট বানিয়ে নিচ্ছে মলিন দর্জির কাছে। আজ হয়ত বিকেলে মা ওই রেহেল (কোরানদানি) পেয়ে যাবে দাদিমা। শিলনোড়া চড়া রোদে চিঁচিঁ করছে, পানি খাওয়াব। আমাকে ছেড়ে দাও। পানি খাওয়াতে হবে না?’

ঠাক্মা বলল, ‘জরুর হবে বাবা। কিন্তুক কামানডা করুক সুধান। নেড়া মাথায় পাষাণকে পানি খাওয়ালে সোন্দর দেখাবে বাপজি। সাবধানে ক্ষুর চালাও সুধান। ঝ্যানে না কাটে। আমার পায়ের তলাডা শিরশির করছে সুধান; পাখির পালকের কেতায় ক্ষুর চালাও সুধান বাবাজীবন। আমার এডি মাত্তর একডা পোতা। একডাই। শিব রাত্তিরের সলতে জানবা।’

যত কামান এগোচ্ছে আমার করুণ মুখচ্ছবি ততই ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে বা রূপ পাচ্ছে ওহে খোয়াজা। মনে মনে ভাবতে থাকি। কামান শেষ হলে আমি সুধান কাকার কাছ থেকে চৌকোনা ছোট হাত-আয়না চেয়ে নিয়ে আমার মুখটা কত করুণাঘন হয়ে উঠেছে দেখব।

ঠিক তাই হলো। কামান শেষে আয়নায় মুখ দেখে আমি কিছুটা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। দাদিমা বলল, ‘আহা বাছা, কাঁদতে হবে না। বাড়ি চলো।

১৩

এই কাঁচামিঠে আমগাছটা তেফলা। যদি তেফলা না হয়, দোফলা তো বটে। অর্থাত্ বছরে তিনবার না হোক দু’বার অন্তত, ফল দেয়। তেফলা হলে তখন তার নাম হয়ে যায় বারোমেসে কাঁচামিঠে। আজ আর মনে পড়ে না ওটা বারমেসেই ছিল কিনা! আমার পকেটে কাক তাড়াতে গিয়ে খসে পড়া আমটা এখনও রয়েছে, বাড়ি ফিরে বোনকে দেবো।

যা হোক। মাথা নেড়া হয়ে গেল আমার। করুণা-পীড়িত আশ্চর্য এক চেহারা হয়েছে, সেই নেড়া মাথায় আমমঞ্জুরীর মধু পড়ছে রেণুরেণু। একদিকে কাঁচামিঠে আমে আঁটি আসব আসব করছে, সেই থোকাতেই ফলে রয়েছে মঞ্জুরী, ছোট বউল, তা-ও রয়েছে; সেই থোকায় গান গাইছে মৌমাছি। ঢেউ তুলে তুলে হাওয়া আসছে খলিসা পাড়ার ওই দিক থেকে উত্তরের মাঠ পেরিয়ে। কামু মণ্ডলের পাড়া ছুঁয়ে। আমার নেড়া, মধুঝরা মাথায় সেই হাওয়া এসে নেচে চলে যাচ্ছে।

হঠাত্ ক্ষুদ্র শিশু শান্তুর মনে হলো, কুয়োর ভিতরে জলের ভিতর দাঁড়িয়ে কেউ একজন দুর্বোধ্য আরবি ভাষায় কথা বলছে। বদনার ভিতরে সেঁধিয়ে কথা বললে যে রকম শব্দ হবে, সেই রকম গলায় কেউ একা-একা কথা বলছে। সন্দেহ নেই, ইনিই জলের ফরিস্তা বা জলদেবতা। উনি কিন্তু মোটেও দয়া করলেন না।

যখন আমার মাথা নেড়া করার ক্ষুর চলছে, হালকা পালকের মতো মোলায়েম, তখনই কখন যেন স্বাস্থ্যবান লম্বা চেহারার, মুখভর্তি নূর, প্রাইমারির মাস্টারমশাই মোতি খান (মিঞা) এসে সাইকেলে বসে থেকেই মাটিতে বাঁ দিককার পা নামিয়ে অল্প কাত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর শরীর থেকে আরবি আতরের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে, আমি ওই গন্ধেই বুঝে গিয়েছি, এ ঠিক মোতি মিঞাই হবেন।

—‘সুধান! দেখা কোরো তো ভাই। বাড়িতে কামান আছে! বাচ্চাদের, আমার আর রাখাল-কিষেণের কালই কামান দিবা। ঠিক আছে? জার্মানের বউ তোমার জন্যে পাটের সিক্কা বানিয়ে রেখেছে। কাল আসো। নিবা। কী হে! শুনতে পেলে, নাকি?’

বলে ওঠেন মোতি খান।

ফাইন করে হাত চালাতে চালাতে সুধান বললেন, ‘আজ্ঞে মাস্টার। যাব। কালই যাব। না, কাল না। পরশু। রোববার। বেলা হবে। কাল যাব রোমিপুর, আজ্ঞে!’

মোতি মিঞা (খান) বললেন, ‘বেশ তো, রোববারই আসো। তোমার জন্যে পাঁজা বাবদ এক-ঘানি সমান সরিষা রাখা আছে। বস্তাবাঁধা। নিয়ে যেও।’ বলেই কিছুক্ষণ আমার কামান দেখলেন মাস্টার মিঞা। ওঁর বাড়িতে দুইখানা জোত চলে। জার্মান সেখ ওঁর কিষেণ, জার্মানের বউয়ের নাম সুধা খাতুন। স্বামীস্ত্রী দু’জনই ওঁর বাড়িতে বাঁধা মেহনত দেয়। গ্রাম্য লব্জে ওরা মোতি খানের কিষেণ-বাঁদি; আগে পেটভাতা খাটত জার্মান। সুধা গ্রাম গঙ্গাপ্রসাদের গরুছাগলের এক ব্যাপারীর মেয়ে। সুধার সঙ্গে জার্মানের বিয়ে ওই মোতি মিঞাই দিয়েছেন এবং বিয়ের পর জার্মানের জন্য বিশ টাকা মাস-মাইনে ধার্য করেছেন। শান্তুর শৈশবে ‘পেটভাতায় গতর খাটত নিরক্ষর বালক। এই পৃথিবী আশ্চর্য নিরক্ষর, বোকা আর বিশুদ্ধ ছিল। তাই বিয়ের পর জার্মানের মাইনে চালু হয়েছে, এ নিতান্ত আনন্দের কথা।

যা হোক। মোতি মিঞার গলার সাড়া পেয়ে এবং শরীরের আতরের খুশবু বাতাসে বয়ে গিয়ে সরকার বাড়ির ভিতরে পৌঁছে গেলে হাসি সরকার ওই গলার আওয়াজ এবং শরীরী খুশবুর টানে বাড়ির বাইরে মাথায় আলতো করে ঘোমটা টেনে নিতে নিতে বার হয়ে আসে।

হাসিকে দেখেই মোতি খান বললেন, ‘ভালোই হলো নতুন বউমা! দেখা হয়ে গেল। তফাদারের বড় ছেলে ছালাম তফাদারি চাকরি পেয়েছে বাপের জায়গায়, বাগানটা ওর আর দেখার সময় নাই, আজ থেকে তুমিই তদারকি করিও। তুমি ওয়ক্তি মোমিনা (একনিষ্ঠ ধার্মিক)। তোমার হিফাজতে থাকলে বাগান ভালো থাকবে। এই বাগানই তো বউমা পাঁচ গাঁয়ের ঈদগাহ্। ফলে তুমিই আগলদারি করবা। কথা হয়ে গেল। আচ্ছা চলি গো শান্তু বাবা! সুন্দর কামান হয়েছে।’

এই বলে চলে গেলেন মোতি খান। আমি সুধান কাকার আয়নায় নিজের মুখ দেখে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মনে হলো, কুয়ার ভিতরে জলে দাঁড়িয়ে খোয়াজা খিজির আপন মনে কথা বলে চলেছেন।

দাদিমা আমায় আচমকা ফুঁপিয়ে উঠে দু’গাল ভাসিয়ে কাঁদতে দেখে বলে উঠল, ‘আহা বাছা! কাঁদতে হবে না। বাড়ি চলো!’

তখনই ঠাক্মার কাছে এগিয়ে এল হাসি সরকার। লাঠিতে ভর দিয়ে রুকু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা দাদিমায়ের লাঠির উপর ধরে রাখা দু’হাতের উপর একটা হাত রাখল সে।

তারপর হাসি সরকার দাদিমায়ের চোখে নরম করে তার ডাগর দুটি চোখ রেখে বলল, ‘দেখলে তো খালামা, মোতি মিঞা কেমন করে বাগানের তদারকি দিয়ে গেল। কিন্তুক তুমারে খালা একডা অন্য কথা কই। আমারে তুমি মাফ করো খালা। তুমার পোতাকে মুই খাটায়ে নিয়া বড্ডাই হয়রান কর্যাছি, কল হাজীর বাড়ি পাঠালাম, পানিকাঁটা নিয়া ফিরল। তারপর সওদাগর মুন্ডলের বাড়ি গেল কুয়ার লোতুন রশি আনতে। সবই তো করল মুখ বুজে। বড্ডাই (বড়ই) হয়রান গেল মন-খালা। তুমিও ওয়ক্তি, আমিও ওয়ক্তি। আমাকে মাফ করো। পোতা রে ডাঁটিও না খালা!’

ঠাক্মা উচ্চ গলায় আচমকা হেসে উঠে বলল, ‘আরে না না! ডাঁটব না পোতা রে। তা হ্যাঁ রে মা, জিনিস উঠল কুয়া থিকে? উঠে নাই? তা হলে কী করবি এখন?’

বলতে বলতে দাদিমা হাসি সরকারকে তাঁর লাঠিটা ধরতে দেবেন বলে লাঠির উপর থেকে দুটি হাত সরানোর চেষ্টা করাতে হাসি তার হাত দাদির হাতের উপর থেকে তুলে নেয়।

দাদিমা তার হাতের লাঠি এবার হাসির দিকে অল্প করে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘লে ধর, সুধানের কামান বাবদ এক আনা অন্তত দিতে তো হয়। আঁচলে বাঁধা আছে। খুলতে হবে।’

ঠাক্মার কথা শেষ হতে না হতে সুধান নাপিত বলে উঠলেন, ‘না মাসিমা! আঁচল খুলবেন না। দিতে হবে না।’

—‘কেন বাবা! তুমি কি পাঁজা চাইছ? আমরা তো শুদ্ধ সুবল হালদারকে ঘাটের পাঁজা দিই।’ বলে উঠল দাদি।

সুধান বললেন, ‘এ ব্যাপারে দাদার মানা আছে মাসিমা! যা নিবার কলিমদার কাছে দাদা নিবে। এখন আপনি পোতাকে নিয়ে বাড়ি যান। খোকা কাঁদছে মাসি।’

রুকু ভঙ্গিমা ছেড়ে ঠাক্মা এবার সিধে হয়ে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করতে করতে হাসির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আচ্ছা বেশ। যা ভালো বুঝো সুধান। চ, বাবু! আমরা যাই! তা হ্যাঁ রে মা! জিনিস ওঠাবার কী ব্যবস্থা!’

সুধান রাস্তার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, ‘চয়নকে ডাকো।’

১৪

ঠাক্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদিমা! ওয়ক্তি, তুমিও ওয়ক্তি, আমিও ওয়ক্তি মানে কী দাদিমা?’ শুনে দাদিমা হেসে ফেলে বললেন, ‘ওয়ক্তি মানে পাঁচ ওয়ক্তি নামাজ বাবা! পাঁচ টাইমের নামাজ। পাঁচ বেলি নামাজ! তাই থেকে ওয়ক্তি ঔরত্, বুঝলা? এই যে পরহেজগারি (পুণ্যকর্ম) তারই পুরস্কার পেল লতুন বউ, বাগানের আগলদারি এই হচ্ছে কথা!’

ঠাকুমার ওই কথায় আমার ভেতরে ফের পাপবোধ বুজকুড়ি কাটতে থাকে। কিন্তু দাদিকে বলতে পারি না, আমি একটা গাঢ় পাপ করেছি দাদিমা! রাস্তার ওই কুয়ার দড়াবালতি দুষ্টুমি করে কুয়ায় ফেলে দিয়েছি। এবং তারপর চমত্কার কাকা তাঁর বলদ জোড়া নিয়ে তৃষ্ণায় আকুল হয়ে কী করলেন; একই নাদায় বাড়ির ভেতর থেকে কলসি করে আনা জল হাসি সরকার ঢেলে দিলে গরু আর মানুষে মিলে কেমন করুণ চাউনি মেলে খেলো, সেই দৃশ্যকথাও শোনাতে পারছি না দাদিমাকে।

আমি সামনে। দাদিমা পিছনে। এইভাবে পথ চলতে দেখা যায় এই দুটি তাজ্জুব প্রাণীকে—গ্রামের লোক এই রকম একটি চলমান দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত কিন্তু হঠাত্ আজ কাজি বাগানের মুখটায় এসে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়াই। এখানে খালেদ মিরের প্রান্তিক বাড়ি। এই মানুষটি বিঘা ৭-৮ জমির মালিক। নিজের জমির চাষ বাদে অন্যের জমিতে লাঙল-বলদ ভাড়া খাটান। এঁর বলদ সব সময় দল মেলে থাকে এমনই তাজা। বলদকে তাজা রাখার জন্য ওঁর যত্নের শেষ নেই। গাভীর নতুন শাবককে রঙিন মশারি টাঙিয়ে শুতে দেন, নিজে তালপাখা দিয়ে মশা তাড়িয়ে আর সাঁজালের ধোঁয়া ছড়িয়ে রাত কাবার করেন। এর বলদের গায়ে সব সময় বিদ্যুত্ চমকায়। ওঁকে ওইভাবে রাত কাবার করতে লোকে অনেক দেখেছে।

একটি বাদামি রঙের আর একটি সাদা রঙের বলদ আপাতত বাইরের নাদায় বাঁধা। জবা খাতুন নামে একজন স্ত্রীলোক মির বাড়ির ভেতর থেকে বার হয়ে এলেন। ওর কোমরের কাঁখে ধরা একটি বেতের ধামা। দেখতে সুন্দর ধামাটা। ধামার উপরে ঢাকনা হিসেবে রয়েছে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা এক প্রস্থ লাল সালু। ধামার ভিতরে রয়েছে কাচের রেশমি চুড়ি। উনি চুড়িউলি জবা। মাঝবয়েসি বড্ড সুশ্রী মহিলা। বলদ দেখলাম তারপর জবাকে দেখলাম এবং অতঃপর ছুটে গিয়ে ঠাকুমার কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।

জবা খাতুন অবাক সুরে বলে উঠল, ‘ওমা! কাঁদে ক্যানে বাছা!’

দাদিমা আমার নেড়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, ‘মাথা নেড়া করায় কাঁদে। কাঁদে না বাপ। তুমার তো চুল জলদি বাড়ে সোনা, কাঁদিও না। সুন্নত্ নিয়া কাঁদলে রসুল-আল্লা বেজার হবে যে! চলো। শিলনোড়ায় পানি খাওয়াতে হবে। তিয়াসায় চিঁচিঁ করছে, জুম্মার নামাজ ঢের আগে শেষ হয়েছে। চলো, চলো! তা হ্যাঁ গো জবা, তুমার বাড়ি কি রোমিপুর পুঁড়ে পাড়ায়, শাফাতুল্লার বাড়ির কাছে?’

জবা মিষ্টি করে হেসে বললে, ‘জি খালা আম্মা! নিদ্দিষ্ট করে বুললে, আমার উঠান চয়নের সাথে ভাগাভাগি। চয়ন পুবে। আমি পশ্চিমে। চয়েন গানী, অন্ধ মানুষ, গান গাইতে গাইতে ইন্দারার তলা থিকে বদনাবাটি, বালতি ঘটি তুলে দেয়। সেই চয়েনের আমি দূর সম্পক্কের বহিন। ওই যে আব্দুল আলীমের ইসলামি গান করে যে চয়েন গানী, তার আমি একটু দূরের খালাত বহিন, খালা আম্মা!’

শুনতে শুনতে শান্তু চমকে উঠে ঠাকুমার বুকের থেকে মুখ তুলে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে জবার মুখের দিকে চেয়ে রইল একদণ্ড। তারপর পা বাড়াল কাজি বাগানের সরু সিঁথির মতো সাদা চিরল পথ ধরে। তার মনের মধ্যে তৈরি হলো একটা গোপন ইচ্ছা। এই চুড়িউলিকে সে খানিকটা তো চেনে। কদমতলার হোসেন ময়রার বাড়ি এসে কুটুম্বিতে করে। হোসেন ময়রা এখো গুড়ের খাজা আর গজা বেচে, মুড়কি বাতাসাও বেচে। খেজুর গাছে চাঁছ দিয়ে রস নামায়। তালরসও নামায়। প্রচণ্ড তাড়ি খায়। এক বেলাও নামাজ পড়ে না। এই লোক তাড়ি খেয়ে নানা রকম বিদ্রোহাত্মক কথা বলে বেড়ায়। এই লোককে হাজার ভয় দেখিয়েও নামাজে আসক্ত করা যায়নি।

সবচেয়ে সাংঘাতিক কথাটি হচ্ছে বোরাকুলি কদমতলার মসজিদে নামাজ পড়ার লোক জোগাড় করাই রীতিমতো দুরূহ কর্ম। মসজিদটা উঠে যাওয়ার জোগাড়। আল্লার ওই ঘর (মসজিদ) কে রক্ষা করবে এমন মোমিন তো চাই। বাবু বাগানের পর উঁচু ডিহিতে ওই মসজিদটা। তবারক মুনশি ছিল বলে তবু ওই মসজিদে আজান পড়ে, বাকি কদমতলার কারও উপরই তো ভরসা করা যায় না। এ এক আশ্চর্য জনপদ সন্দেহ নেই। মাদারিপুরের তৈমূর মওলানা ওই জনপদের নাম দিয়েছেন কুফা নগর। ওই কুফার লোকেদেরই মহানবী হজরত মুহম্মদের যুগে বলা হতো কাফের।

কুফা নগরের লোকেরা, শোনা যায়, মহানবী হজরতের সঙ্গে কেবলই ছলনা করত। মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও, নবীর সামনে কথা দিলেও, হজরত যেই কুফাত্যাগ করতেন, দেখা যেত ইসলামের আমল কুফার লোকেরা আর করত না, তারা তাদের পুরাতন ধর্মের আমলনামায় ফিরে যেত। ফের নবী চেষ্টা করতেন কুফার লোকদের হেদায়ত করতে অর্থাত্ দীক্ষা দিতে। দু’একদিন তারা ইসলামি আচার করত-টরত, তারপরই যে-কে সে-ই, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে যেত বা কোনও ধর্মই করত না। কুফা শব্দ থেকেই নিঃসৃত হয়েছে কাফের শব্দটি।

তৈমূর মওলানা আজীবন চেষ্টা করে গিয়েছেন কদমতলার মসজিদে নামাজি জোটাতে। পারেননি। ওয়ক্তি নামাজে কিছু বান্দা দু’দিন দু’এক বেলা হয়ত এল-টেল, তারপরই যে-কে সেই। এই রকম চটান বা জনপদ ও টিমটিমে মসজিদ সংসারে রয়েছে। মাটির কাছাকাছি থাকলে, তবেই এমন চটান চোখে পড়ে। ওই কুফায় যাতায়াত আছে জবা খাতুনের। কারণ হোসেনের বউ ওর ছোটবোন। মাত্র বছর দেড়ের ছোট।

জবাও সবিশেষ ওয়ক্তি ঔরত। শুধু যে সে কাচের চুড়ি গাঁওয়ালি করে তাইই তো নয়। চুড়ির সঙ্গে সুর্মা-আতর বেচে। বাচ্চাদের রাঙা নোলা, কোমরের ডোর, মাথার ফিতে, ছোট পঞ্জিকা আর পাতলা ধারাপাতও ফিরি করে। কপালের টিপ, ন্যাপথলিনের পাতাও সঙ্গে থাকে। সেফটিপিন ইত্যাদিও থাকে। তবে মূল ব্যবসা চুড়ি-সুর্মা-আতর। সুর্মা-আতর পুরোটাই নবীর জিনিস। খেজুর যেমন নবীর ফল, সেই রকম।

জবার বোন পারুল। পারুলের কাছে জবা যখন আসে এবং রাত্রিতেও থেকে যায়, তখন নামাজি-ওয়ক্তি জবার জন্য জায়নামাজ (নামাজ পড়ার আসন) ওই তাড়িখোর হোসেন ময়রাকেই জোগাড় করে আনতে হয় পঞ্জাতন মন্ডলের বাড়ি থেকে চেয়ে।

ঠাক্মার সঙ্গে জবার কথা শুরু হলো। কথায় কথায় জানা গেল, জবা আজ গাঁওয়ালি করতে গোকুলপুর পর্যন্ত যাবে। তারপর রাত হয়ে গেলে পারুলের কাছে এসে থাকবে। খুব ভোরে ফজরের নামাজ পর রোমিপুর রওনা দেবে।

আমি শুধালাম, ‘চয়ন তোমার ভাই?’

জবা বলল, ‘হ্যাঁ বাছা। ভাই। তেবে (তবে) লতাপাতায়, গুষ্টির লোক।’

১৫

জনপদ শব্দটিকে চাকলা শব্দে ব্যক্ত করা যায়। আমি একটি চাকলার কথা লিখছি। আসলে লিখছি সেই চাকলাকে ঘিরে আমার অতি শৈশবের স্মৃতিকথার একটি অতি তুচ্ছ টুকরো ছবি। আমি লিখছি চলমান ছবি, যার মূল্য হয়ত বড়জোর একটি ফুটো পয়সা। পৃথিবীতে আজ ফুটো পয়সা নেই। সেই ফুটো পয়সাটি যে-ডোরে পরানো ছিল সেই ডোরটিও নেই আমার কোমরে জড়ানো। তা হলে লিখছি কেন সেই ফুটো পয়সার কথা?

আশ্চর্য এই যে, যে-নদীগুলির ধারে ধারে আমার ছেলেবেলা ছবির মতো হেঁটে গিয়েছে, সেই নদী ভৈরব-গোমানি এবং ছোটনদী নামের ছোট নদী এরা কেউ আজ জীবিত নেই। ফুটো পয়সা নেই। নদীও নেই। নদীকে যেন এ জীবন ফুটো পয়সার মতোই তুচ্ছ করেছে। ভৈরবের মৃত্যুর পর আমার বলবার মতো আছেটাই বা কী?

ওই যে ভৈরবের মৃত্যু হয়ে গেল, তা নিয়ে আমার ওই চাকলার একটি মানুষকেও দুঃখ করতে বা কথা বলতে দেখিনি। আমার সাহিত্যের ঝুঁকি তো এখানেই যে, যা নিয়ে কেউ কথা বলে না, আমি ঠিক তাই নিয়েই কথা বলি। একটা লাল ডোর, একটি তামাটে ফুটো পয়সা, একটি অত বড় নদী—সবই সমান-সমান, তাই না? এমন মনে হয় কারও? এমনটা? কখনও?

যেমন ধরুন, পাটকাঠির সাইকেলটা। এটা লিখবার কেন দরকার হলো? জানতামই তো, এ জিনিস কেউ বুঝবেন না। ভাববেন, পাটকাঠির আবার সাইকেল হয় নাকি! না বুঝুন। তবু আমি লিখলাম। সাহিত্যে তো কতকগুলো যাকে বলা যায় সান্ধ্য প্রতীক, সেই সব রেখে যাওয়া চাই। আমার সাহিত্যে তো কিছু কিছু সন্ধ্যা-ভাষাও আছে। কী করব? নিরক্ষর সরল বিশুদ্ধ এক পৃথিবীতে আমার শৈশব পাটকাঠির সাইকেল হাতে হেঁটে গিয়েছে কামু মন্ডলের পাড়ার ভিতর দিয়ে উত্তরের মাঠ পেরিয়ে খলিসা পাড়ার গোমানি নদীর দিকে একা-একা। পুজোর ঢাকে প্রথম কাঠি পড়লে আমার রক্ত আশ্চর্য চঞ্চল হয়ে উঠত আর কেন যেন কেবলই মনে হতো, ঢাকের শব্দটা আসছে ওই খলিসা পাড়ার নদীর তলা থেকে গভীর স্নিগ্ধ আশ্বিনে। কোনও কালে আমার স্বাভাবিক বাস্তব বুদ্ধি ছিল না। মন বলত, ঢাক বাজছে নদীর তলায়। হা খোয়াজা খিজির।

আচ্ছা ধরুন, এটা কি কোনও কাজ? ঠাকুমা শান্তুকে যে কাজটা নিত্য করাতেন। যখন শান্তু পাঠশালায় পড়ে তখন, সেই শৈশবে রান্নাঘরের ফালি সরু বারান্দা, যাকে মুর্শিদাবাদী লবেজ ‘ওসরা’ বলা হতো, সেই ওসরার নিচে হেলান দেওয়া থাকত বাটনা বাটার শিলনোড়া। কারণ উঠোনের মাটির চুলা (উনান) টা ছিল ওই ওসরার নিচে হাতখানেক কি হাত দেড়েক তফাতে। চুলা (চুল্লি থেকে চুলা)য় রান্না। বাটনা বাটার জন্য রান্নাঘরের ভেতর থেকে নামিয়ে আনা হতো শিলনোড়া। বাটনা হয়ে গেলে জলধোয়া করে শিলটাকে অল্প কাত করে ওসরার গায়ে হেলান দেওয়ার পর তার মাথায় সাজিয়ে রেখে দেওয়া হতো নোড়াটা।

রান্নাঘরটা ছিল পুবমুখো। বাড়ির পশ্চিম সীমানা ছুঁয়ে। উঠোনটা ছিল পুবদিকে ছড়ানো। পুব সীমানায় ছিল ঢেঁকিঘর। প্রধান শোবার ঘরটা ছিল উত্তর সীমানায়। রান্নাঘরের পাশেই গা-লাগা একখানা ছোটঘর, তার পাশে ছোট বৈঠকখানা। দাদিমা যখন বেঁচেছিল তখন ওই বৈঠকখানাতেই দিনরাতের অধিকাংশ সময় থাকত। বাইরের কোনও লোক দেখা করতে এলে ঠাকুমাই তাকে বৈঠকখানার মেঝেয় শীতলপাটি বিছিয়ে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়ে আপ্যায়ন করত। লোকের সংখ্যা বেশি হলে পুরো বৈঠকখানা ছেড়ে দিয়ে বৈঠকখানার পাশের গা-লাগা ঘরটায় চলে আসত। প্রচণ্ড শীত পড়লে দাদিমা আর বৈঠকখানায় পড়ে না থেকে পাশের ঘরে চলে আসত। ছোট একফালি দরজা ছিল পাশের ঘরে চলে আসার। সেই দরজাও এমন কিছু মজবুত ছিল না। বাড়িতে দাদিমা থাকাকালীন, কোনও প্রাচীর ছিল না। ছিল পাটকাঠির বেড়া। বৈঠকখানা, পাশের ঘর, তার পাশের রান্নাঘর। সবই ছিল খড়ের ছাওয়া। যাকে বলতাম দক্ষিণমুখো বড়ঘর, সেটা ছিল করগেটেড টিনের ছাদ-অলা। ওই টিন প্রত্যেক বড় বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যেত বিঘা কতক দূরের চাকলায়।

সেই টিন কুড়িয়ে আনতে মুনিষ লাগিয়ে সেই মুনিষের সঙ্গে হাত লাগাতেন বাবা। বৈশাখী ঝড় তাই প্রবল হলে আমাদের মুখ শুকিয়ে যেত। পাটকাঠির বেড়াও কাত হয়ে যেত। বাড়ির আব্রু রক্ষাই ছিল মস্ত দায়।

আর আশ্চর্য! এই বাড়ির প্রহরী ছিল দাদিমা। মাঝে মাঝে রাত বাড়লে ঠাকুমার গলা রাস্তার চলমান ছায়াকে প্রশ্ন করত, চলন্ত লণ্ঠনকে প্রশ্ন করত, ‘কে যায়, ওরে কে যায়, বাবা!’

এই ঠাকুমা ছিলেন খুব সম্ভব একজন সর্বপ্রাণবাদী। তাঁর নির্দেশে প্রায়-নিত্য তপ্ত শিলনোড়া, যা ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত রোদে পুড়ত, বিশেষ করে গ্রীষ্মের কড়া রোদে তেতে উঠত প্রখর স্বভাবে, তাদের বদনা করে জল খাওয়াতে হতো।

—‘পানি দে বাপ। পানি দে। তেতে পুড়ে খাঁ-খাঁ করছে, পানি দে বাপ, চোঁ চোঁ করে খাবে। দেখ, দিয়ে দেখ, কেমন করে খায় দেখ! তেষ্টায় পাষাণের বুক ফেটে যাচ্ছে রে খোকা!’

এমনি করে ক্রমাগত কঁকাতে থাকতেন আমার দাদিমা। ছটফট করতেন। কষ্ট পাচ্ছেন বোঝা যেত। তিনি বিশ্বাস করতেন পাষাণেরও প্রাণ আছে। কখনও স্কুল থেকে এসে, কখনও স্কুলে যাওয়ার আগে জল খাওয়াতাম। চৈত্র বৈশাখে।

সদ্য-নেড়া-হওয়া শান্তুকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত করুণ। দু’হাতে ধরেছে সে জলভর্তি বদনা। নলের মুখটা অল্প নিচু করতেই ছড়ছড় শব্দে জল পড়তে থাকে তপ্ত শিলায়। সত্যিই তো চোঁ চোঁ করে জল গিলতে থাকে পাষাণটা আর ক্ষুদ্র-খণ্ড নোড়া। মনে হতে থাকে, এদের প্রাণ আছে। যখন এভাবে জল খাওয়ানো হতো, তখন ঠাকুমা বলে শোনাতে থাকতেন মরুভূমির এক তৃষ্ণার্ত সারমেয় শাবকের কাহিনী; তাকে মরুকূপ থেকে এক পতিতা নারী কীভাবে জল তুলে জল খাইয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সেই কাহিনী। ওই পতিতার নাম জহুরা। সে বসন ছিঁড়ে পায়ের জুতোয় বেঁধে সেই জুতো নামিয়ে দেয় কূপের তলায় পড়ে থাকা জলের নাগালে।

জল ওঠে। বেঁচে যায় কুকুরের বাচ্চাটা। এইভাবে না জেনেই জহুরা সঞ্চয় করে এক আশ্চর্য পুণ্য বা সওয়াব। জহুরা নামাজ-রোজা বুঝত না। সে ছিল পতিতা। ওই ছেলেবেলায় বুঝেছিলাম, পতিতা মানে খারাপ মেয়ে মানুষ বা নষ্ট স্ত্রীলোক। কীভাবে নষ্ট তা বোঝার বয়েস না হলেও, বুঝেছিলাম, ওই জহুরা ‘ওয়ক্তি’ স্ত্রীলোক নয়। তবু অবাক কাণ্ড! ওই মেয়েই পুণ্যবলে মৃত্যুর পর আকাশের একটি দারুণ উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে গেছে। যেমন কিনা ওই সাঁঝ তারাটা।

জল খাচ্ছে পাষাণ। জল খাওয়াচ্ছে সর্বপ্রাণবাদী এক মাথানেড়া বৌদ্ধ বালক। তার চোখে ছলছল করছে অশ্রু। সে তো উল্টা কাজ করেছে। পাপ করেছে। জবা খাতুন কি তাকে সঙ্গে নিয়ে চয়নের, অন্ধ চয়নের উঠানে পৌঁছে দেবে না? ফড়িং কাকা আজ রেহেল আনবে বৈকালে।

১৬

সামনে জবা খাতুন। পিছনে বেশ খানিক তফাতে আমি। উত্তরের এই মাঠের (শস্যপ্রান্তর) পুব দিগন্তে সূর্য কালো মুরগির আঙরা ডিমের লাল কুসুমের মতো লাল, কেবলই লাফিয়ে উঠে এল। আমার হাতের মুঠোয় ধরা পাটকাঠির সাইকেলটার রং-ও ঠিক আঙরা। তাতে কাগজের শিকলি আর ফুল টাঙিয়ে দিয়েছে হোসেন ময়রা। ফুল আর শিকলিও রঙিন। সেই ফুলে ও শিকলে সূর্যের সপ্রাণ আলো এসে লাগছে। এই সূর্যকে সেলাম করতে শিখিয়েছেন ঠাকুমা।

সেলাম দিলাম সূর্যকে, কপালে হাত ঠেকিয়ে। দক্ষিণের মাঠ থেকে ঝিরঝিরে হাওয়া বিচ্ছেদহীন দমকে কেবলই বয়ে আসছে, চাদ্দিকটা কেমন ঝলমল করছে। শস্যের মাঠ প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে, চৈতালি ফসল কেটে নেওয়ার ফলে। কারও কারও জমিতে পাকা গমের ঝাড় এখনও রয়েছে, সে নিতান্ত দু’একটি দাগে। কতক জমিতে অড়হর গাছ ফলবান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই ভুঁইয়ে প্রজাপতি ও নানান খুদে পতঙ্গ উড়ছে।

একটি সরষে ফুলের রঙের মতো সোনালি হলুদ প্রজাপতি কোথা থেকে উড়ে এসে পাটকাঠির সাইকেলের রামধনুর পিঠের মধ্যাংশ কাগজের ফুলের কাছটায় বসল। দেখে আমার একা-একা কীযে আনন্দ হলো! এ ঠিক বুঝবে না জবা খাতুন। তার শরীর থেকে আরবি আতরের নামাজি গন্ধ ভেসে আসছে।

আমি বার বার পিছিয়ে পড়ছিলাম দেখে জবা হঠাত্ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরে বলছিল, ‘আসো, আসো! ভয় কি, আমি ঠিক তুমারে নিয়া যাব বাবু!’

এই মাঝ বয়েসি স্ত্রীলোককে আমি তো আর আপনি-আজ্ঞে করব না। জানি নে, ওকে ‘তুমি’ করে বলাই ঠিক কিনা!

জবা বলল, ‘দাদিকে না জানিয়ে, এত দূরে আসা বোধহয় ঠিক হয় নাই শান্তু!’

সারারাত ছটফট করেছি দাদিমায়ের বুকের কাছে শুয়ে থেকে। সেই ছটফটানি টের পেয়েছে ঠাকুমা। আমার কেন যেন অদম্য এক কান্না শরীরকে কাঁপিয়ে তুলছিল, সেই কান্নাও ঠাহর করছিল দাদি। গায়ে-মাথায় বার বার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঠাকুমা বলছিল, ‘কাঁদে না। কী কষ্ট আমাকে বলো বাবা!’

আমি বলিনি ঠাকুমাকে, কেন আমি কাঁদছি। কাউকে বলিনি সেকথা। মাথা নেড়া হওয়ার দুঃখে এতটা কান্না, তা তো হতে পারে না। দাদি বুঝেছিলেন, এই কান্নার অন্য কারণ আছে; প্রসঙ্গ তার অন্যবিধ। কিন্তু দাদিমা আমার মুখ থেকে কান্না ছাড়া কিছুই বার করতে পারেনি। সেই ঠাকুমাকে চিন্তায় ফেলে আমি ফজরের নামাজের আজান পড়বার আগেই দাদির বুকের কাছ থেকে উঠে চলে আসি, রাস্তায়। তারপর বাবু বাগানের মাঠে প্রাতঃকর্ম করে গোমানী নদীর বুকের কূমে (ডোবার মতো বড় গর্ত)-তে জলশৌচ করি এবং পিটুলির দাঁতন দাঁতে ঘষতে ঘষতে যেন পাকা মুরুব্বির মতো দেখা করি জবা খাতুনের সঙ্গে—পারুল খাতুনের বাড়ি।

জবা তখন ফজর (প্রাতঃপূর্ব নামাজ)-এর জায়নামাজে অর্থাত্ নামাজের আসনে বসে গিয়েছে। পারুল তখন ‘ওজু’ (নামাজের জন্য জল-স্খালন) করছিল।

তাকে বললাম, ‘তোমার পালাঙ্গা (প্রাঙ্গণ) থেকে দুইটা পাকাঠি নিচ্ছি পারুল খালাম্মা! সাইকেল বানাব। নিই?’

পারুল ‘ওজু’ শেষ করে আমার মুখ ধোয়ার জন্য এক বদনা জল এগিয়ে দিয়ে কোনও কথা না বলে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে নামাজে গেল। পাতলা আঁধার কেটে গিয়ে ঈষত্ ফর্সা দেখাচ্ছে সংসারটাকে। যদিও সারারাত চাঁদ ছিল আকাশে। এখন নূরের হাওয়া দিয়েছে ঝিরিঝিরি ঢেউয়ে। আমি পাটকাঠির সাইকেল তয়ের করে নিয়ে পুরোটা তৈরি। হোসেন ময়রা তালরস নামায় মাঠের একটি তালগাছ থেকে। তারপর আমার কাছে এসে পাকাঠির সাইকেলে কতক কাগজের শিকলি ও ফুল ঝুলিয়ে দেয়।

নামাজ শেষ করে জায়নামাজ গোটাতে গোটাতে জবা শুধালে, ‘কী গো বাছা! এত ভোরে?’

—‘রমিপুর পুড়েপাড়া যাব জবা খালা! সঙ্গে নাও। চয়েন তোমার ভাই। তার কাছে যাব। দড়াবালতি তুলতে হবে।’

বললাম আমি। তারপর চেয়ে রইলাম হোসেন ময়রার হাতে গড়া কাগজের ফুলে ও শিকলে। জবা বললে—‘বাছা, তুমি তো এতটুকুনই ছা! তুমাকে আমার কাছে কে পাঠালে? দাদি?’

—‘না। দাদিমাকে বলি নাই।’ বললাম আমি।

—‘কাকে বুলেছ?’ শুধালে জবা খাতুন।

—‘কাউকে না। চলো, এখন।’ বলে উঠি।

আমি যে বেশ দড় আর পাকা ছেলে (নিতান্ত বালক হলেও), সে কথা ভেবে এবং আমার কথার মধ্যে সাহসের বহর দেখে আনন্দে ছলবল করে হেসে উঠল হোসেন ময়রা।

তারপর শুভেচ্ছা জানানোর কেতায় এবং আশীর্বাদ জানানোর ভঙ্গিমেয় ময়রা বার বার বলতে লাগল, ‘যাও বাচ্চা যাও। ভালো হোক। সব ভালো হোক।’

হোসেন ময়রার মতো কড়া কাফের এই সংসারে আর ক’জনই বা আছে! প্রচণ্ড তাড়িখোর, সম্ভবত সে নামাজের আয়েত-বয়েত কিছুই জানে না। তবে মজার ব্যাপার এই যে, ঈদের সময় যখন ঈদগাহ্ সাজানো হয়, তখন কাগজের শিকলি, ফুল, নিশান সবই একা হাতে বানিয়ে দেয় এই কাফের। আসলে চেষ্টা সে করেছে আয়েত মুখস্থ করার। পারেনি। ওই আরবি তার কিছুতেই আয়ত্তে আসে না।

যখন আমার কৈশোর পরিণত, তখন একবার কথায় কথায় হোসেনকে জিজ্ঞাসা করি, ‘তুমি নামাজ পড় না। তুমি কাফের?’

—‘ওই জিনিস আড়পাতে পারি না বাপ। জিভে আসে না।’

—‘কেন?’

—‘মুরুখ্য লোক। প্যাটে (পেটে) বিদ্যা নাই বাপজি! মানুষ আমি জন্মপাপী। আর এই গরিবের প্যাটের ভিতির হাবিয়া গনগন করছে বাবা গো। শুদু খিদে। কী খাই, কুথা পাই আব্বা! তাড়ি খাই আর কাঁদি। আমি কিন্তুক পয়লা ফল মসজিদে দিয়া লিজে খাই শান্তু!’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল হোসেন ময়রা, যে-কিনা বিষ্টু ময়রার কাছ থেকে সন্দেশ-মিঠাই বানাবার কেরামতি শিখেছিল। সে যাক। আমি জবার কথা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমার কোমরে জালিভর্তি পয়সা আছে জবা খালা।

তখন জবা চুড়িউলি বলল, ‘দেখাও তো!’

ইজের উপরের অংশ ঠেলে নামিয়ে জালি দেখিয়ে বললাম, পাটের ফেঁসো আর পাট বেচে করেছি খালা!’

—‘চলো!’ বলে আমাকে সঙ্গে চলল জবা। চয়নের বাড়ি পৌঁছে চয়নের পায়ের কাছে জালি রেখে দিতেই চয়ন শুধালো, ‘কে?’

১৭

কোমরের জালি চয়নের পায়ের কাছে রেখে দেওয়াতে চয়নের বউ আতরা ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। আতরা বেশ সুন্দরী বউ। জন্মান্ধ চয়নের বউ এত ঢলঢল সুন্দরী কেন, ভাবলে এক সিধা বিস্ময় রচনা করে তোলে সেই নিরক্ষর-সরল-বিশুদ্ধ গ্রাম-পৃথিবী। সেই শীতল চৈত্রের ভোরের রোদ সূচনা-ফলের মতো সজীব আর টাটকা। আতরা সুন্দরী। কিন্তু তার নাক-কানের ফুটায় কোনও অলঙ্কার নাই। পাছে ফুটা বুঁজে যায়, তাই সেই ফুটায় বাবলার কাঁটা গুঁজে রেখেছে বউ।

অমন সুন্দর মুখে বাবলাকাঁটাকে দেখাচ্ছে অলঙ্কার স্বরূপ। তেলেজলে সেই কাঁটা হয়েছে চকচকে কালো। এখানে শিক্ষা নাই, আলো নাই, বিদ্যাসাগর নাই, কলকাতার রেনেসাঁ নাই। আদিম সূর্যের সত্ আলোয় পৃথিবী ভরে আছে। পথের ধুলায় আশ্চর্য সরলতা লুকনো।

শান্তুকে চয়নের উঠোনে পৌঁছে দিয়ে জবা খাতুন নিজের উঠোনে চলে গেছে। শান্তু নিজেই বুদ্ধি করে পয়সা-ভর্তি জালিটা চয়নের পায়ের কাছে রাখল। চয়ন বসে রয়েছে ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে। এই ভোরেই কাজে বার হবে বলে তৈরি এই অন্ধ মানুষটি। সে লোকগান করতে করতে ধুলার পথ ধরে গ্রাম-গ্রামান্তরে ধাইবে। দ্রুত একটি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে পথ ভাঙবে চয়ন।

—‘কে?’

—‘আমি শান্তু। কলিম মাস্টারের ছেলে। কারিমনের পোতা। টেকা কাহারপাড়ার লোক।’

—‘লোক! তুমি লোক? বয়স কত? গলা শুনেতো মুন বুলছে সাত-দশের বেশি হবে না।’

—‘বাচ্চা!’

—‘তাই কহো। জিনিস তুলতে হবে?’

—‘জি। দড়াবালতি।’

—‘কিন্তুক, আমার পায়ের কাছে কী রাখলে ভাইপো?’

—‘পয়সার জালি, চয়ন কাকা!’

—‘কত আছে জালিতে? গোনাগুনতি আছে?’

—‘গোনা নাই কাকা।’

এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চয়ন তার বউকে বলল, ‘আতরা, পাঁচ সিকে গুণে লিয়ে জালি ফের বাচ্চার কোমরে জড়ায়ে দে। বসো বাছা। আমি ষাটী পান্তা খেয়ে পথে নামব।’

ষাটী ধান থেকে ষাটী পান্তা। ষাট থেকে ষাটী। চারা পুঁতে ৬০ দিনে যে-ধান ঘরে ওঠে তার নাম ষাটী। অন্য কোনও ধান তো মাত্র দু’মাসে ঘরে তুলবার নয়। ষাটীর বীজ আলাদা। আউশ-আমনের কারও মতো নয়। এটি ভাদ্রের গোড়ার দিকেই মরাই বা খুলানে চাষি পাকা চেহারায় এনে ফেলতে পারে। এর চালের ঘ্রাণটাও ভারি মিঠা। এই ষাটী টানের বা তীব্র অনটনের ফসল। আষাঢ়কে সেই সময় টানের মাস বলা হতো। কম জলে এই ষাটী ফলতে পারে। এই যে আষাঢ়-শ্রাবণ—এই সময় গরিব এবং মাঝারি চাষির গোলা খালি হয়ে যেত। সেই চাষিকে অনাহার থেকে বাঁচাত ষাটী।

—‘আমাকে সের দুই ষাটী দিয়েছিল রঘুনন্দনের বিবি রেবা দেবনাথ, কানের মাকড়ি উঠানের ইন্দারা থেকে তুলে দেওয়াতে। কুয়ায় পাছার ঠেস দিয়া কি কানের ওই মাকড়ি কি খুলতে যায় কেউ। আনমনা ছিল রেবা, তাই হাত ফসকে ঝরাত্ করে পড়ল কিনা কুয়ায়, লাও ঠেলা! বুজলা খুকা! তা, সেই চালের পান্তা। খাবা নাকি দুই মুঠা?’

এই বলে ষাটী ধানের বাসিপান্তা খেতে বসল চয়ন। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘আমি কিছু খাব না। দড়াবালতি তোলা হলে বাড়ি গিয়ে খাব।’

—‘কুথাকার কুয়ায় জিনিস তুলবে আমার মরদ, বাড়ির কুয়া, নাকি পথের?’

শুধালো আতরা।

বললাম, ‘পথের।’

—‘পথের কুয়া? কুথাকার পথের?’

জানতে চাইলে আতরা।

—‘মণি সরকারের বাড়ির সামনের তেমাথার কুয়া কাকি।’

—‘দানের কুয়া?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘তা হলে তুমি মজুদুরি দিবে ক্যানে? জিনিস তুলবার বাবদ, পাঁচ সিকা, তুমিই দিচ্ছ তো?’

—হ্যাঁ।’

—‘ক্যানে?’

—‘এম্নি।’ এই যে ‘এম্নি’ বলাটা, এটা উচ্চারণ করলাম দু’দণ্ড চুপ করে থাকার পর।

আতরা পাঁচসিকা পয়সা জালি থেকে হাতের মুঠায় নিয়ে থমকে গেল। আমি অমনি করে ‘এম্নি’ বলাতেই সে অবাক হয়েছে এবং ব্যাপারটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না। চয়নও ভাত খাওয়া বন্ধ করে পান্তার জলে হাত চুবিয়ে কিছুক্ষণ বেশ চুপ করে রইল।

আতরা সম্ভবত চয়নের চেয়ে এক যুগের ছোটই হবে। তবে সে অন্ধ স্বামীকে ভয় পায়, ভক্তিও করে। স্বামী অন্ধ হলেও স্বামীর প্রতি নিষ্ঠার অভাব তার নাই। স্বামীর ইচ্ছা ছাড়া সে একপা-ও কোথাও নড়ে না। তাদের জমিজিরাত নাই, লাঙল-বলদ নাই। ভিটেটুকুই তাদের স্থাবর সম্পত্তি। কাঠা তিনেক জমি। তবে এটি সবজিবাড়ি, মুর্শিদাবাদের ভড় অঞ্চলের ৯৯ শতাংশ বাড়িই এই রকম সবজিবাড়ি। যা হোক। আতরা আমার ব্যাপারখানি বুঝে উঠতেই পারছে না।

—‘আচ্ছা, পয়সা কি নিলি আতরা? দাঁড়া আগে বুঝে নি, তারপর লিবি। তা হ্যাঁ রে বাচ্চা, জিনিস তোলার পয়সা তুমি নিজের কোমরের জালি থিকে দিবা ক্যানে রে বাবা? কেহু কি বুলেছে দিতে?’

চয়নের প্রশ্নের জবাবে ছোট করে একটা ‘না’ উচ্চারণ করল শান্তু।

—‘তুমিই লিজেই দিচ্ছ?’ বলল চয়ন।

শান্তু বলল, ‘হ্যাঁ।’

—‘ক্যানে?’ বলে জানতে চাইলে চয়ন।

শান্তু চুপ করে রইল।

—‘বুল, ক্যানে পয়সা দিবা তুমি? সরকার বাড়ির কেহু বুলেছে দিতে? সাচ্চা কথাটি বুলবা। কহো। ক্যানে দিবা? না বুললে, দড়াবালতি তুলতে যাই কী করে?’ বলে ওঠে চয়ন।

এবার শান্তুর অদম্য কান্না পেয়ে যায়।

দাওয়া শান্তুর গলা অবধি উঁচু। দাওয়ায় বসে পান্তা খাচ্ছে চয়ন। দাওয়াতে বসেই জালি থেকে বার করে পয়সা গুনছিল আতরা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। দাওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলল শব্দ করে শান্তু।

হঠাত্ অত্যন্ত দড় গলায় চয়ন বলল, ‘তা হলে আতরা, জিনিস তুলতে আমি লগডাজলি যাই। মণি সরকারের তেমাথা আজ থাক। লে, সব পয়সা সুদ্দো খোকার কোমরে জালি বেঁধে দে। যা!

১৮

নিঃশব্দে আমার দু’চোখ গলে গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। আমার কোমরে আমারই পয়সার জালি বেঁধে দিচ্ছে অন্ধ চয়নের বউ আতরা। বেঁধে দেওয়া শেষ হলে ঘাড় নিচু করে আমাকে ফিরে আসতে হবে। দড়াবালতি আর কুয়ো থেকে উঠবে না। ভাববা মাত্র আমার কান্না বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম, কেমন করে আমি দানের কুয়ার দড়াবালতি কুয়ার জলে ফেলে দিয়েছি। এই বলে কিছুক্ষণ কাঁদলাম, তারপর শান্ত গলায় বললাম, ‘আমি গুনেহ্গার, চয়ন কাকা। আমার কাঁধের দুই ফরিস্তা সেই গুনাহ্ (পাপ) করতে দেখেছে। আমাকে বাঁচাও।’

প্রিয় পাঠক, এই হচ্ছে, আমার পাপের চেহারা। একজন অন্ধের কাছে আমার পাপের কবুলনামা বা স্বীকারোক্তি। আমি জানতাম, ফড়িং কাকার কাঁধে ফরিস্তা নাই, আমার পাঠশালার সহপাঠী বন্ধু ঈশান কর্মকারের কাঁধে ফরিস্তা নাই, আমার লেখক-জীবনের অভিভাবক সুধীর চক্রবর্তীর কাঁধে ফরিস্তা ছিল না, এখনও নাই। যাঁর বিচারবোধের আনুকূল্য না পেলে এই তুচ্ছ লেখক-জীবন গড়ে উঠত না সেই সাগরময় ঘোষের কাঁধেও ফরিস্তা ছিল না; কোনও ফরিস্তা ছিল না সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের কাঁধেও। সুনীলদা নাস্তিক, তাঁর কাঁধেও ফরিস্তা ছিল না, ধার্মিক শীর্ষেন্দুদা, রামকৃষ্ণপন্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধেও ফরিস্তা ছিল না, জয়ের কাঁধে ছিল একটা কাপড়ের থলে, আমার বন্ধু জয় গোস্বামী। জয় ঠাকুরপন্থী । তাঁর কাঁধেও ফরিস্তা নাই। কিন্তু মুসলমান হতে গেলে ফরিস্তা বিশ্বাস করতে হবে। না হলে তোমাকে যথাসময়ে দেখে নেওয়া যাবে কেমন তুমি বান্দা! তোমার মৃত্যুর পর তোমার লাশ দাফন না করে, যা খেলতে হয় খেলব।

চয়ন কিন্তু নামাজ পড়ত না। রোজাও করত না। বলত, ‘অন্ধের আবার ওসব লাগে নাকি চাচা!’

শুধু সে গায়ে সরষে আর নারকোল তেল মেখে, জুত করে মেখে কুয়ায় আক্ষরিকভাবে ঝাঁপ দিত। এবং ঝাঁপ দেওয়ার সময় উচ্চ গলায় হাঁক দিত, ‘ইয়া খোয়াজা খিজির, অন্ধরে বাঁচায়ে দে বাপ!’

‘অন্ধরে বাঁচায়ে দে বাপ!’ কিংবা ‘অন্ধ রে বাঁচায়ে দে খোয়াজা!’ এই কণ্ঠস্বর আজও কানে ধ্বনিত হয়। যা হোক এই বাংলায় যাদের কাঁধে ফরিস্তা নাই, তাঁরাই আমার পাঠক, অবশ্য বাংলাদেশের ঘটনা বেশ আলাদা। ওখানে যাঁদের কাঁধে ফরিস্তা রয়েছে প্রধানত তাঁরাই আমার পাঠক। ফের বাংলাদেশে আমার শত্রুও প্রচুর। যদিও এ কথা সত্য যে, ‘ফুলবউ’ উপন্যাসকে বাংলাদেশের পাঠকরাই প্রথম বরণ করেছেন। পাঠক-চিঠি এসেছে ওখান থেকেই। মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে নিবন্ধ-লেখক-লেখিকা তাঁরা আজও ফুলবউ-কে এড়িয়ে চলেন, ব্যতিক্রমও রয়েছে কিছু। যেমন নাসিম-এ-আলম কিংবা বন্ধু সদর আলি। কিন্তু সবিনয়ে বলি, মুর্শিদাবাদের ভড় (জেলার তিনভাগ রাঢ়-বাঢ়-ভঢ় বা ভড়) অঞ্চলে না জন্মালে কারও মাথায় ‘ফুলবউ’-এর প্লট গজাতে পারে না।

যদি আমি মুর্শিদাবাদের রাঢ়ে জন্মাতাম, ‘ফুলবউ’ হতো না। শহরের রাস্তায় চার হাজার তালাকপ্রাপ্ত নারী প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাচ্ছে প্রতিবাদের সুরে, ‘কথায়-কথায় তালাক দেওয়া চলবে না।’ এমন প্রতিবাদ-সমাবেশ সংসারে কোথাও হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। এ-দৃশ্য পাকিস্তানে সম্ভব। ‘খুদাকে লিয়ে’ নামের চলচ্চিত্র পাকিস্তানেই গড়ে উঠতে পারে এবং ‘মালালা’ কাণ্ডও ওই পাকিস্তানেই ঘটে। একইভাবে ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ ছাড়া অন্যত্র জন্মে না। এই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত বাঙালি কারও মুখে আমি ‘খুদাকে লিয়ে’ বা ‘মাটির ময়না’র প্রসঙ্গ শুনিনি। কে কত ভাবুক, তা আমার জানা হয়ে গেছে। মুর্শিদাবাদে চার হাজার তালাকপ্রাপ্ত নারী একত্র জুটেছে, এ তথ্য একেবারেই ভেজালহীন। আমার সহকারী বন্ধু কবি একরাম আলিও অত্যন্ত সততার সঙ্গে বলেন, ‘দেখুন বাশার, আপনার সাহিত্যের অনেক ছবি আমার দেখা জীবনের সঙ্গে কেমন যেন মেলাতেই পারি না।’

হ্যাঁ ঠিকই। মিলবে না। কারণ প্রত্যেকটি চাকলা তো আলাদা আলাদা। যেমন ধরুন, আমার চাকলার বহির্গত গ্রাম, আফরোজা খাতুনের জন্মগ্রাম। তিনি কি অন্ধ চয়নকে দেখেছেন?

আমার ধারণা দেখেননি। কারণ তাঁর গ্রামজীবন নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। এবং তিনি আমার চেয়ে বয়েসে ছোট। বহরমপুরে তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে। শৈশব থেকেই তিনি নগর-অভিমুখী! তিনি চয়নকে দেখবেন এমন ভাবাটা নিতান্ত শক্ত। তিনি হয়ত দানের কুয়া দেখেছেন, অন্ধ চয়নকে দেখেননি। দেখে থাকলে আমার এই লেখাটি উপভোগ করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। সিরাজদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আশ্চর্য নিবিড়। মহানগর কলকাতায় তিনিই আমার প্রথম গুণগ্রাহী। তাঁর সঙ্গেও আমার বিরোধ হয়েছে জীবনকে দেখার ব্যাপারে। তাঁর আমাকে লেখা দীর্ঘপত্র রয়েছে আমারই সংগ্রহে, যা যেকোনও শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের চেয়ে মূল্যবান। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, আমি একজন আলাদা লেখক এবং কারও মতো নই।

সিরাজদা বেঁচে থাকলে এই চয়নকে বুঝতেন। বেঁচে থাকলে সাগরদা বুঝতেন সবচেয়ে বেশি। সুনীলদা এই লেখা পড়ে বারংবার ফোন করতেন। আজ সিরাজ-সুনীলের মতো সমঝদার নেই। যাঁরা আছেন তাঁরা অধিকাংশই অন্তঃসারশূন্য আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণমনা কলকেত্তাইয়া আঁতেল—এঁদের জন্য দুঃখ হয় এই জন্য যে, এঁরা বাংলাসাহিত্যটা ভালো করে পড়েননি কখনও। বিধবা কেন্দ্রিক উপন্যাসের এত তোড় কেন বাংলা সাহিত্যে? শুধু বিধবার উপর লিখেই তো বঙ্কিম-শরত্-রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়। তাই না? তা হলে বিধবা বিনোদিনীকে ঘিরে কী করে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা সাহিত্যের পালাবদল ঘটে? সাহিত্য হয়ে ওঠে আধুনিক? একই জীবন বিভিন্ন স্রষ্টার হাতে কত আলাদা হয়ে যায়, তাই না?

যা হোক। চয়নকে নিয়ে আমিই লিখব, এটাই সাব্যস্ত হয়েছে হে পাঠক। বালক ঈশান কামার, আমার দু’কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘মনকির-নকির (বা কেরামন-কাতেবিন)-কে সারাটা জীবন বইবি কী করে শান্তু?’

আমি মুর্শিদাবাদী লব্জে বললাম, ‘কাজ কঠিন ঈশান।’

সামনে চয়ন, পিছনে আমি। উত্তরের মাঠ ভাঙছি। প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার কাঁধে দুইটা ফরিস্তা আছে কাকা?’

চয়ন হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেন, ‘আছে বিধিন (বোধহয়), তবে মালুম হলে হয়! ঠিক বুঝা যায় না বাপ!’

১৯

কেরামন-কাতেবিন। কাঁধের দুই ফরিস্তা। এঁদের পরিচয় হচ্ছে, এঁরা অনন্য, এঁরা দু’জন লেখক। প্রত্যেক মানুষের কাঁধেই এই ফরিস্তাদ্বয় চেপে বসে রয়েছেন; সম্ভবত মায়ের পেটে ভ্রূণপিণ্ডের কাঁধ তৈরি হওয়া মাত্রই ওঁরা চেপে বসেছেন। মানুষের মৃত্যু হলে কাঁধ ছেড়ে চলে যাবেন। এঁরা দু’জন মানুষের পাপপুণ্যের হিসেবরক্ষক লেখক। জানি নে, এঁরা দু’জন পাকিস্তানি কাসব বা পেশোয়ারের সৈনিক স্কুলে হামলাকারী পাকিস্তানি তালিবানের কাঁধে আদতে আছেন না নেই? যারা ১৩৩ জন শিশুছাত্রের প্রাণ নিমেষে খতম করে দিয়েছে সেই তালিবানদের কাঁধে ওই ফরিস্তা দিতে খোদা ভুলে গিয়েছেন? তালিবান কি কখনও মনে করে, তারা হাবিয়া দোজখের জ্বালানি মাত্র? মুর্শিদাবাদী তালিবানের কথা লেখার লোক এই বাংলায় নেই।

এক-একজন তালিবানের জন্য সত্তর জন হুরী (অপ্সরা) বেহেস্তে আগাম মোতায়েন রয়েছে, প্রত্যেক হুরীর বয়েস ১৬ বছর, এই বয়েস অনন্তকাল একই থাকবে, বেহেশত হচ্ছে তালিবানদের স্ফূর্তির জায়গা। এই যে ১৩৩ জন শিশুহত্যা করল, সেই পুণ্য তো লিখে রাখলেন কেরামন-কাতেবিন। তাই না? মোল্লা হচ্ছে সেই, যে নিজের ইচ্ছা দ্বারা পুণ্য (সওয়াব) রচনা করে নেন। তাঁদের কথায় কেরামন-কাতেবিনের কলম চলে।

এমন চমত্কার দুই লেখক সম্বন্ধে চয়নের এ কেমন ধরনের ঔদাস্য? কেরামন-কাতেবিন কাঁধে আছে না নেই, সেটাই মালুম করতে পারছেন না। বলছেন কী? বলছেন, ‘আছে বিধিন (বুঝিন)!’

হঠাত্ মাঠের মধ্যে চোখ যায়। অড়হর খেতের পাশে একটা ‘কুম’। ছোট ডোবার মতো, কিন্তু কিছু গভীর। কখনও কখনও নদীর বান এ পর্যন্ত এসে জমিকে ভাসায় এবং জমির বুকের ওই ‘কুম’-এ মাছ রেখে যায়। তার প্রধান অংশ কাঠমাছ। রুই-কাতলা-মৃগেল-পুঁটি যেমন থাকে তেমনি মাগুর-জিওল ইত্যাদিও থাকে। মাগুর-জিওল কাঠমাছ। দেখা যাচ্ছে, মাছ তোলা হয়েছে। মাহেফরাস (মুসলমান জেলে) সেই মাছ নিয়ে এই ভোরেই হাটে রওনা দিয়েছে। কুমের পাড়ে বসে রয়েছে একটি আশ্চর্য নীল পাখি এবং একটি আশ্চর্য হলুদ পাখি।

নীল পাখির ঠোঁটে একটি সাদা বাঁশপাতি মাছ। হলুদ পাখিটার ঠোঁটে ধরা তারই দেহ থেকে খসে-পড়া আশ্চর্য হলুদ পালক।

ইদানীং এই ৬৫ বছর বয়েসে পৌঁছে কেবলই মনে হয়, ওই হলুদ পাখিটা হলাম আমি, যে-তার খসেপড়া পালক ঠোঁটে ধরে চুপচাপ বসে আছে, ফেলে দিতে পারছে না, তার এই সৌন্দর্যময় আত্মকরুণার মানে কী? সে কি কাউকে তার এই সুন্দর সরষে-ফুল রঙা পালক দেখাতে চায়? পাখিটাকে দেখে তেমনটাও তো মনে হয় না কারও। তো কারও দিকে চেয়েও দেখছে না।

এই রকম এক বিরলদৃশ্যের সামনে পড়ে একেবারে বিস্ময়-ব্যাকুল, একেবারে ভেবলে গেছে শান্তু। সে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছে।

—‘কাকা! কাকা হে! একটু দাঁড়াও তো! একটা জিনিস দেখে নিই।’ বলে উঠি। তাই শুনে চয়ন কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন পথের কিনারা ধরে।

—‘লাও, দেখে লাও। কী জিনিস ভাই পো?’ শুধালেন চয়ন।

—‘পাখি। একটা হলুদপাখি কাকা’ জবাব দিই অন্ধ চয়নকে।

—‘অ। আচ্ছা!’ বলে দাঁড়িয়ে থমকে চয়ন শান্তুকে পাখি দেখার সুযোগ দেন।

তারপর চয়ন শুধালেন, ‘কী পাখি দেখছ শান্তু?’

—‘হলুদ রঙের পাখিটা। হলুদ পাখি কাকা! মাথা আর গলার কাছটা কালো।’

—‘ঠোঁট লাল?’

—‘হ্যাঁ চয়ন কাকা!’

—‘তা ওটা বেনেবউ হবে। লাও, দেখে লাও। আমিতো আর দেখতে পাব না। তুমিই দেখো।’

—‘তা হলে তুমি জানলে কী করে, ওটা বেনেবউ।’

—‘ক্যানে, তুমার দাদি, তুমাকে বুলেনি বেনেবউ দেখতে কেমুন? হলুদ পাখির গেরস্তি নাম বেনেবউ।’

—‘তুমি তো সবই জানো চয়ন কাকা! কী করে জানলে?’

—‘মোল্লার মুখে শুনে লোকে যেমুন খোদাকে জানে। আমি তেমুনি লোকের মুখে শুনে এই গাছপালা-পশুপাখি রাস্তাঘাট-নদী-খাল বিল জমিন-আসমান জানি।’

—‘চলো কাকা!’

—‘হ্যাঁ, চলো।’

আমরা ফের এগোতে থাকি। পাখি দুটির যেটি নীল সে উড়ে যায়। বেনেবউ তখনও বসে থাকে। হঠাত্ বললাম, ‘দাদিমা বলেছে, সবার কাঁধে কেরামন-কাতেবিন আছে। তুমি বলছ কাকা, আছে বোধহয়, মালুম হলে হয়! কেন বলছ এমন কথা! ফরিস্তা কি নাই?’

—‘থাকেই যদি বাছা, তা হলে সংসারে এত পাপ ক্যানে, কহো তো! খুদার খাস বান্দা এই মুসলমান, এত গুনাহ করে কিসের তাড়সে বাবা হে! কাঁধে ফরিস্তা নিয়া পাপ করতে বাহির হয় এই সোনার উম্মত। ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা!’

—‘আমি যে গুনেহ্গার কাকা! তুমি দড়াবালতি তুলে দিলে আমার পাপ খণ্ডাবে তো! বলো, খণ্ডন হবে?’

—‘হবে। আমি পানির ফরিস্তাকে বুলব। ডুব দিব। তা-পর বুলবে, হে খোয়াজা, বাচ্চাডা রে খণ্ডাও বাবা! আমার ‘দুয়া’ তেনার কানে বরাবর যায়। ক্ষ্যামা উনি দ্যান, শান্তু। তেনার দয়ায় বেঁচেবর্তে আছি। হিন্দুর যেমন দেবতা, মুসলমানের তেমনি ফরিস্তা। শিখর ফকিরের কথা বাছা। অকাট্য!’

—‘জি।’

আমাদের বাড়ি থেকে চয়নের বাড়ি সোয়া মাইল পথ। ধুলার পথ। তখন সকল গ্রামেরই নাম ধূলিগ্রাম। তখন ইউরিয়া সার জন্মে নাই। গোবর সারে চাষ চলত। গ্রামে তখন বামপন্থা বলে কিছু ছিল না। গ্রামে রবীন্দ্রনাথ নেই; নেই কার্ল মার্কস, যা কিছু সম্বল হজরত মুহম্মদ। সাহিত্য বলতে ইসলামি পুঁথি, সোনাভানের পুঁথি, কারবালার জঙ্গ (যুদ্ধ) নিয়ে লোক গায়ক গাইতেন শব্দগান। আব্বাসের ভাটিয়ালি শোনা যেত কলের গানে। রাখাল বন্ধুর পালা শোনা যেত। যাত্রাপালা চলত। বাংলাদেশি ‘রূপবান’ যাত্রা, তখন বলা হতো পূর্ববঙ্গীয় যাত্রা, আমার বালকবেলার গান।

আমার কাছে জীবনের প্রধান সমস্যা ছিল, বাংলাভাষাকে ভালোবেসে একজন পূর্ণ বাঙালি হয়ে ওঠা, শেখ মুজিবুর রহমান যে রকম বাঙালি, কাজী আব্দুল ওদুদ যে-রকম বাঙালি, সে রকম বাঙালি। মুসলমান থেকে বাঙালি। এই যে বাঙালিত্ব, এ যে কী পদার্থ, তা আজও কাউকে বুঝিয়ে উঠতেই পারিনি। বুড়া হয়ে গেলাম।

সূচনাফল, যা খোদার ঘর মসজিদে দান করতে হয়, তারই মতো টলটলে রোদের ভিতর দিয়ে এক অন্ধের পিছুপিছু চলেছি আমি। বাতাসে ফরিস্তার নিঃশ্বাস আমাকে করে তুলছে পুণ্যবান। হ্যাঁ, খোয়াজা খিজির।

২০

ধর্মের ব্যাপারে বাবা ছিলেন অব্যবস্থিতচিত্ত (fickle-minded), সাদা বাংলায় নড়বড়ে বিশ্বাস ও অনুভূতির লোক। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল ছিল; ছিল অদ্ভুত অস্থিরতা। ধর্মের আমলনামা (আচার)-এর প্রতি মাঝে মাঝে অসম্ভব অনুরক্ত হয়ে পড়তেন। এঁটেলি মাটির আঠার মতো নামাজ-রোজায় নিজেকে জুত করে মাখতেন। দেখে মনে হতো, ধর্মের খিয়ালে ও খোয়াবে আশ্চর্য দম।

এই মানুষই হঠাত্ আমল ত্যাজ্য করে একধরনের সংশয়বাদে হিল্লে নিতেন। সেটা বিদ্যাসাগরীয় সংশয়বাদ নয়, পাকাপাকি বুদ্ধি পড়লে বুঝেছিলাম, বাবার ওটা জব্বরী সংশয়বাদ। বাবা তাঁর প্রথম যৌবনে রাঢ়ের জব্বর পিরের আস্তানায় গিয়েছিলেন, কেমন এই ‘পির-বাবা’ তাই জানতে। ওই পির যথারীতি বাবার বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করেছিলেন। বাবাকে জব্বর পির কী একটা বিশেষ দুর্বোধ্য মন্ত্র দিয়ে বলেছিলেন, এইটে মন্ত্রগুপ্তি বাবা, যা দিলাম, নিজের কাছে রাখিও, কাউরে ফাঁস করিও না। বাবা কারুকে সে-কথা ফাঁস করেননি, এমনকি আমাকেও না। তবে নিতান্ত বুড়াকালে বাবা জব্বর পির প্রসঙ্গে হঠাত্ একদিন বলেন, একবার তিনি গেছেন পিরের কাছে, পির তাকে খাগড়াইয়া কাঁসার বদনায় ওজু’র জল ভরে আনতে বলেন, কাছের এক দানী কুয়া থেকে। কুয়ার কাছে গিয়ে বাবা বদনার গলায় জলতোলার দড়ার ফাঁস পরাতে গিয়ে দেখেন বদনার কানার তলায় খুব সরু করে কোঁদা রয়েছে আরবি অক্ষরে, ‘আনাল হক’। আল্লাহ হকের বদলে আনাল হক। ভারি আশ্চর্য!

আরবি অক্ষর কয়টির দিকে চেয়ে বাবা শিউরে উঠলেন। কেমন একটা কাঁপুনি দেখা দিলে সর্বাঙ্গে। বদনার গলায় দড়ার ফাঁস পরাতে পরাতে ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই দড়া ধরে বদনা নেমে গেল কুয়ার জলে। জলে বদনা পড়ার শব্দ হতেই বাবা চমকে উঠে অর্ধস্ফুট গলায় বলে উঠলেন, ‘আল্লা হক’। কিন্তু এই সবের মানে কী? ‘হক’ মানে সত্য। কিন্তু তারপর?

আল্লা হক। আল্লা সত্য। আনাল হক। আমিই সত্য। কে তোমার কাছে স্পষ্টতর সত্য হে বান্দা? মানুষ? নাকি ঈশ্বর? কাকে তুমি সহজে বুঝতে পারো?

বাবা কোন সত্যে ছিলেন? আনাল হকে, নাকি আল্লা হকে? বাবা কি জব্বরী সত্যকে ভয় পেয়েছিলেন? সারা জীবন কোন দ্বন্দ্বে কষ্ট পেয়েছেন বাবা? বাবা ছিলেন পুরোপুরি গানের মানুষ। বাবা ভালো গাইতে পারতেন সেমিক্লাসিকাল আর চমত্কার ভজন গাইতেন। গাইতেন কে মল্লিক (কাশেম মল্লিক)-এর গান। নজরুলের বাংলা ইসলামি গজল, যাতে ছিল নাস্তিক মুসলমানের আকুল আর্তনাদ, তা ছিল বাবার প্রিয় (যেমন ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’ কিংবা ‘রোজ হাসরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী’)। এই গানগুলো আজও অন্তত একবার বাংলার যে-কোনও মুসলমানের শোনা উচিত। যেন সে সব আনাল হকে বিশ্বাসী মানুষের আত্মকরুণা পীড়িত আকুল আর্তনাদ।

কিন্তু সে থাক। আনাল হকে বিশ্বাসী বাবা মাঝে-মধ্যে আল্লাহ হকে পাগলের মতো থিতু হতে চাইতেন। তখন চরম দম লাগাতেন নামাজে-রোজায়। বাবার এই আশ্চর্য দ্বন্দ্ব আমাকে ছেলেবেলায় অশেষ বিভ্রান্ত করেছে ও কষ্ট দিয়েছে। বাবার ভাষাস্নায়ু ছিল উর্বর। ইংরেজি-আরবি-উর্দু-হিন্দি এবং আরও দু’একটি ভাষা জানতেন। অজ গ্রামে এমন একজন মানুষ কী করে গেলেন আজও পুরো বুঝে পাইনি। মনে পড়ে, আমলনামার রোখে পড়ে ঘরের সূচনাফল মসজিদে দিয়ে আসার জন্য আমাকে পাঠাচ্ছেন বাবা।

আমার সামনে অন্ধ চয়ন। হঠাত্ চয়ন কাকা বললেন, ‘সংসারে লোকে দুই চক্ষু দিয়া বড় পাপ করে বাবা শান্তু। আমার চক্ষু নাই বুলে সেই কাবিরা গুনাহ (পাপ) আমারে আল্লা মিঞা করতে দেন নাই, মজার কথা এই হলো গিয়া, আমার চোখের সামনে এসে খুদা যদি খাড়া হয়, সেই খুদা রে মুই চিনব না খোকা! খাসা একখানি গল্প রে বাছা!’

—‘জি, চয়ন কাকা!’

—‘তুমার কিন্তু কবিরা গুনাহ লয় বাপজি। তুমার বড় পাপ লয়। তুমার হলো ছোট পাপ ভাইপো। তা-ও, চক্ষু দুইটা ছিল বুলেই না দড়াবালতি কুয়ায় গেল, পাপ করলা! কেমন কিনা!’

—‘হ্যাঁ, কাকা!’

বড়ই অবাক এবং খানিক বোকা করে তোলার মতো কথা। কথা কী? কথা এই যে, আমি পাপ করেছি, কারণ আমার চোখ আছে। ঠিকই তো, দড়াবালতি কুয়ার গোড়ায় ওইভাবে অরক্ষিত পড়ে থাকতে দেখেই তো আমার দু’ চোখে পাপ বুদ্ধি জেগেছিল! ওটা যে পাপ, তা আমার দু’চোখ প্রথমে বুঝতেই পারেনি।

—‘শুনেছি, বেশির ভাগ লোভের জন্ম চোখে। কিন্তু দেখো, চোখ কাকে বুলে তাই তো আমি জানি না। এদিকে দু’চোখ কানা চয়ন পুড়া চক্ষের কথা কহে! হেঁ-হেঁ!’

পয়গম্বর হজরত মুহম্মদের মতো সুন্দর নিরক্ষর পৃথিবীর পথ ধরে চলেছে শান্তু এবং অন্ধ চয়ন। এই পথ হজরতের মতোই বিশুদ্ধ নিরক্ষর ও বাঙ্ময়। একদা এমনই ছিল, যখন নিরক্ষর মানুষের গলায় খোদা কথা বলতেন। এবং এখন এমনই সময় এসেছে যখন বেশ শিক্ষিত লোকের গলায় ইবলিস কথা বলে। কিন্তু এখন সারাটা পথ নিরক্ষর শুদ্ধতায় আশ্চর্য ঝলমলে।

পথ নির্জন। শুধু দেখা গেল, পিছনে বেওয়াপানা (বিধবা মাফিক) এক মাঝবয়েসি নারী দ্রুতই হেঁটে আসছে। দেখতে দেখতে আমাদের নাগালে এসে গেল সেই সাদা থানের বেওয়া (বিধবা)।

—‘কামে বাহির হল্যা চয়েন ভাই? বাচ্চাডা কেডা?’ পিছন থেকে বলে উঠল সেই বিধবা। পায়ের গতি অবিচল রেখে বিধবার তলবদারির জবাব না দিয়ে চয়ন কাকা হাঁকলেন, ‘কেডা তুমি? খলিসা পাড়ার খুশি বেওয়া নাকি?’

—‘হ্যাঁ ভাই খুশি বেওয়া। চকের হাটে বার হল্যাম চয়েন ভাই। কাঁখে দুইটা জিনিস আছে। একখানা খেজুপাতার শীতল পাটি আর একটা পেকান্ড সুয্যি মিঠা কুমড়া। দেখি, চক কালীতলার গনাই বাবুরা যেতি (যদি) কিনে। কত টাইমে বিচতে পারব, খুদা মালুম!’

এই বলে আমাদের পেরিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল খুশি। বেশ কিছুটা দূর ওই বেওয়া চলে গেলে চয়ন কাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওই দুইটা জিনিসের খরিদদার জুটাতেই খুশির দিনমান যাবে। হা আল্লা!’

২১

সোয়া মাইল পথ আমরা পেরিয়ে এলাম। চয়নের কাজ আজ কিছু অন্য রকম হলো। কুয়োর জলে নামবার তরতিপুরী বড় জোলাটে গামছা কাঁধের ঝোলানো থলে থেকে বার করলেন চয়ন। গামছাটা পরনের লুঙ্গির উপর জড়িয়ে নিয়ে লুঙ্গিটা পায়ের নিচেয় দিয়ে খুলে বার করে নিলেন। লুঙ্গিটাকে ভাঁজ করে কাপড়ের থলেটায় ভরে রাখলেন। থলের ভিতর আরও দু’একটি বসন থেকে থাকবে। তারই সঙ্গে লুঙ্গিটাও রইল।

আকাশের সূর্যটা এখন পুবের সীমানায় এক-মানুষ প্রমাণ উঁচায় টইটই করছে। পৃথিবীর সকল পথই এখন প্রায় জনমানব-শূন্য। এই ভোরে। এই ভোরেই নিঃশব্দে কাজ শুরু করলেন অন্ধ চয়ন। কুয়ার গোড়ায় সিমেন্টের পাটার উপর তাঁর কাঁধের থলেটা রাখলেন। আজ গায়ে তেল মর্দন করলেন না চয়ন কাকা। মণি সরকারের বাড়ির কাউকে ডাকলেন না পর্যন্ত। কাজটা তিনি চুপিচুপি সাঙ্গ করতে চান বলে মনে হলো। যেন তিনি আমার পাপের ভাগীদার একজন। আমার অনুতাপ-অনুশোচনা ও ভয়ের একজন দোসর যেন বা। তিনি কারও সামনে আমাকে লজ্জিত হতে দিতে চান না। শিশু হলেও এই সবই আমি বুঝতে পারছিলাম।

আজ বড় করে হাঁক দিয়ে হাত-পা ছেড়ে কুয়োর জলে পড়লেন না চয়ন পুড়ে। অত্যন্ত চাপা ও কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, ‘হা খোয়াজা খিজির, বাচ্চাডারে পাপ-খণ্ডাও বাবা। বাচ্চাডারে দুয়া দেও দয়াবান। আমারে জিন্দা অবস্থায় সংসারে ফিরাও দানী। বালতি-দড়া দান করো অন্ধকে খোয়াজা। তুমি পড়ে যাওয়া মাল আগলায়ে রেখে দান করো বুলেই তো জিনিস হিফাজতে পায় অন্ধ এই গরিব, ওগো ফরিস্তা! আতরা রে কে দেখবে, যদি আমার কুয়ার পানিতে কবর হয় দানী। রক্ষা করো মেহেরবান।’

এই বলে কুয়ার শূন্যতায় নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন চয়ন। জলে একটি ঝপাং করে শব্দ হলো আর সেই শব্দে যেন খোদার হূিপণ্ড লাফিয়ে চমকে উঠে জলের আলোড়নে দুলতে থাকল।

তারপর ঝুপ-ঝুপ শব্দে ওঠা এবং ডুবে যাওয়া। বার দুই করলেন চয়ন। অতঃপর দেখা গেল তাঁর দাঁতে ধরা দড়া। বালতির জল কুয়োর জলে ফেলে খালি বালতি দাঁতে ধরা দড়ার টানে উপরে তুলে আনার কাজ। আমি দেখছি সেই দৃশ্য।

জল এমন এক পদার্থ, যাকে কখনও নিরক্ষর মনে হয় না। জল মৌনী হয়, কিন্তু বোবা বা নিরক্ষর হয় না। অথচ আমার শৈশবের-কৈশোরের মানুষ-পৃথিবী ছিল আশ্চর্য-প্রায় নিরক্ষর; আমি এই জগেক ভালোবেসে ছিলাম। এমনই মানুষের একজন অন্ধ চয়ন। প্রকৃতি নিসর্গ নিরক্ষর নয়। মানুষ নিরক্ষর। এখানে পাষাণ জল খেতে খেতে কথা বলে। এখানে অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ ও ফরিস্তা জেগে থাকেন। আর ওই জলকেই ঘেঁটে বেঁচে থাকেন অন্ধ চয়ন। তিনি কুয়ার জলে পৈঠায় বা কুয়োর গাত্রের গর্তে প্রসারিত দুই পা রেখে রসুলস্তুতি বিষয়ে ইসলামি গান গাইতে পারেন, তখন তাঁর কোমর অবধি নিস্তব্ধ জল, সেই নিস্তব্ধতা গানের ছোঁয়ায় বিকারবিহীন, সেই নিস্তব্ধতা আদিম শূন্যতার মতো স্থির; নিরক্ষর হজরত মুহম্মদের মতো দয়ালু।

এ বার দড়াকে কোমরে জড়িয়ে বেঁধে নিলেন চয়ন পুড়ে।

তারপর ঊর্ধ্বে মুখ তুলে বললেন, ‘এবার তুমি যাও শান্তু।’

—‘আগে জিনিস তো উঠুক কাকা!’

—‘ঠিকই উঠবে ভাইপো। আচ্ছা, আকাশে বোধহয় একটা হট্টিটি পাখি গাইতে গাইতে গেল?’

—‘তাতে কী, চয়ন কাকা?’

—‘ডাকটা খুব খারাপ। মুন বুলছে, আজ আগুন লাগবে।’

—‘হাওয়া দিচ্ছে বেগে। গোটা একখানা গ্রাম যাবে পুড়ে ছাই হয়ে! চৈত্রে তো গাঁ পুড়ে বাছা! যাও। কোন গ্রামে হল্কা দেয় ইবলিস, দেখতে হবে না!’

—‘জি! সাংঘাতিক কথা কাকা! গ্রাম পুড়লে মন খারাপ করে!’

—‘আমারও করে শান্তু! যাও, বাড়ি যাও। লে খোয়াজা, পা দুইটা ঠিকঠাক খাঁজে দে দয়াবান। ওরে দানী, আমারে বাঁচায়ে দে বাপ। আগুন নিভায়ে দে।’

আমি শিউরে উঠে কুয়ো ছেড়ে অল্প তফাতে রাস্তার উপর এসে দাঁড়াই। মনটা কেমন যেন করতে থাকে। পাটকাঠির সাইকেল তুলে নিই হাতে। ধুলো মাখা দুটো পায়ের দিকে তাকাই। মনে হলো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। দাদিমা আমাকে খুঁজতে বার হয়ে পড়বে। সালাম, কেরামন-কাতেবিন। আজ গ্রাম পুড়বে হট্টিটি পাখি রাষ্ট্র করে গেল। হা খোয়াজা খিজির!

এই একটা দৃশ্যই সুতরাং মনের মধ্যে মুদ্রিত হয়ে রইল। একজন অন্ধ মানুষ কুয়োর জলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, দু’পা প্রসারিত করে, পা দু’খানি কুয়োর গায়ের খাঁজে (পৈঠায়) আটকানো; তিনি গাইছেন রসুলস্তুতির লোকগান, তাঁর কোমরে বাঁধা দড়া (রশি), তিনি উপরে তুলে আনছেন কুয়োয় খসে পড়া বালতি—এই কাজটি ওই অন্ধ মানুষটির উপজীবিকা। তিনিই বললেন, আজ কোনও একটি গাঁয়ে আগুন লাগবে। খর বাতাসের দমকা দিচ্ছে চৈত্র।

গ্রামের ঘরগুলো খড়ো চালের ছাওয়া, মাটির দেওয়াল। খড়ো চালগুলি এত লাগালাগি করে প্রায়-ছুঁয়ে রয়েছে যে, একটি ঘরে আগুন ধরলে অন্য ঘরে ধরবেই। একটি বাড়ির চাল থেকে উপচে লতানে সবজি অন্য বাড়ির চালে নৈসর্গিক চেষ্টায় অনায়াসে চলে যায়। একটি বাড়ির মুরগি অন্য বাড়ির খুলায় সহজেই ডিম পেড়ে আসে। তখন অনেক সময় ডিমের রং দেখে ঠিক করতে হয় ডিমের আসল অধিকারী কে? এত সংসর্গ কি ভালো? এত নৈকট্য কি ঠিক? নিরক্ষর গ্রাম কিন্তু এ প্রশ্ন করতই না কখনও।

বিকেলের নামাজের সময়, নামাজ পর মা যখন ফড়িং কাকার দানের দেওয়া কোরানদানি (রেহেল)-তে খোলা কোরান রেখে একটি ফরিয়াদি টিয়ার মতো ভঙিমায় কোরান পড়ছে, তখন দৌলতপুরে আগুন লাগল। কী একটা আশ্চর্য হাহাকার মথিত করছিল হাওয়া। আমি ছুটে গেলাম কোদালকাটি দাঁড়ার কদমগাছটার কাছে।

আমার প্রায় পিছুপিছুই এসেছে ঠাকুমা।

গ্রাম পুড়ছে। ছাই আর আগুন বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। পাটকাঠি থেকেই ওই আগুন। প্রথমে ফেঁসো দপ করে জ্বলে পাটকাঠি ছোঁবে। জ্বল জ্বল পাটকাঠি ছোঁবে খড়ে চাল। গরিব আর নিরক্ষর পৃথিবী পুড়তে থাকবে।

ঠাকুমা বলল, ‘কার পাপে গ্রাম পুড়ছে এখনই বলা যাচ্ছে না শান্তু। যদি যায়ও, যাবে তো বটেই, তবু সেই পাপী, ঘরের বউটা, তার কুনো শাস্তি দিবে না গাঁ। বউটারে মারবে না, ধরবেও না কেউ-একটা।’

—‘কেন দাদিমা?’

ঠাকুমা বলল, ‘বোকা মানুষের গাঁয়ে গুনাহ্ (পাপ) ভাগ করে নেওয়া নিয়ম। বউটা কিন্তু ঘুঘু পাখির মতন করে কাঁদে বাপু হে! তুমাকে দেখিয়ে আনব বাছা!’

২২

গ্রাম পুড়ছে। জোড়াগ্রাম ঈশাননগর-দৌলতপুর ঝিরঝিরে হাওয়ার চৈত্র-বিকেলে কোথাও ছাই, কোথাও আধপোড়া হয়ে গেল। ঝিরঝিরে হাওয়া মাঝেমাঝে দমকা বেগ দিল। সারাটা উত্তর ও উত্তরপূর্ব দিগন্ত থেকে হাহাকার-বিষণ্ন-রোল; কান্নার রোল শূন্যশস্য-প্রান্তর ছুঁয়ে সুদূর অভিশাপের মতো বয়ে আসতে লাগল। থ হয়ে কোদালকাটির দাঁড়ার কদমতলায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর আমার ঠাকুমা কারিমন বেওয়া।

দাদিমা বললেন, ‘হপ্তা খানেক যাক, তারপরে তোকে নিয়া যথাস্থানে যাব। ফের বুলছি ভাই, বউডারে কেউ মারবে না, না মরদে, না মোড়লে। কারণ, কেহ সাধ কর্যা ঘর পুড়ায় না। ফেঁসা আর পাটকাঠির সংসার বাবা, আগুন ধরলে ছাড়ে না।’

হপ্তাখানেক বাদে নয়। দু’হপ্তা বাদে কারিমন বেওয়া তাঁর পোতাকে সঙ্গে করে ঈশাননগর-দৌলতপুর গেলেন। ওই গ্রামের বেশির ভাগ লোকে কারিমনকে চিনত। উঁচু ডিহির উপর মসজিদ। সেখানকার ইমাম, যিনি প্রায় সবসময়ই ওই মসজিদেই থাকেন, তাঁর কাছে নিচু গলায় আগুন লাগার বেত্তান্ত সমাচার জানতে চাইলেন দাদিমা।

অল্প একটু চমকে উঠে অহেতুক সতর্ক অপরাধীর গলায়, কিছুটা গোপন বার্তা দেওয়ার মতো করে চাপা গলায় ইমাম ঠাকুমাকে জানালেন, ‘ইবলিসের কাম আম্মা; নুকুতা খাতোনের দোষ নাই। চাহারামের ছোট বেটার স্ত্রী আম্মা। লোতুন বউ, বাচ্চা মানুষ কিনা, আটা বেলতে বেলতে হুঁশ পায় নাই, ইবলিসে ফেঁসায় আগুন এক লম্ফে ধরায়ে দিয়া পাটকাঠিতে লাগায়ে দেয়, ব্যাস!’

—‘থাক ইমাম সাহেব। বুঝেছি। চ শান্তু, চাহারামের পুড়া সংসারের সুরত (রূপ) দেখি গিয়া।’ বলে উঠলেন কারিমন।

শান্তুর মুখের দিকে সস্নেহ চোখ মেলে বছর ত্রিশের বেঁটেখাটো শ্যামবর্ণ দোহারা চেহারার ইমাম, যার মাথায় সর্বক্ষণ গোলটুপি থাকে, কপালে সিজদার দাগ থাকে, যাঁর ঠোঁট পুরু, কান খরগোশের মতো খাড়া তিনি বললেন, ‘ওগো ছেলে, দাদিরে ঈশাননগর লিয়ে যাও। নুকুতা খাতোন বাপের বাড়ি আছে। নুকুতার বাপের বাড়ি পুড়ে নাই। বলবা, মকসদ খলিফার বাড়ি, লোকে দেখায়ে দিবে। যাও আম্মা, গাঁ থেকে এখনও পুড়া গন্ধ যায় নাই। নোতুন করে ঘর বাঁধতে টাইম লাগে মা!’

মকসদ খলিফা (দর্জি)’র চার ছেলে তিন মেয়ে। বিঘা পাঁচ জমি। ছেলেদের দু’জন জমিতে খাটে। বাকি দুই ভাইয়ের একজন মুরগি হাঁসের ডিমকেনা ব্যাপারি। অন্যজন রেডিমেড জামা বিক্রি করে হাটে-হাটে। বুড়া বাবা দর্জির মোটা হাতের কাজ জানেন, তাইতে কিছু রোজগারপাতি হয়। পাঁচবিঘা জমির তিনবিঘা বিলেন। তাতে মাত্র আমন ধান আর চৈতালি ফসল বলতে খেসারি ফলে। সব মিলে দেখতে গেলে এরা সাতিশয় গরিব না হলেও, কষ্টেসৃষ্টে থাকা বিশেষ ধরনের গরিব; বানবন্যার বছরে বিলেন জমির ফসল জলের তলায় পচে যায়। দম না পেয়ে ধান নামক উদ্ভিদ মরে যায়। বাকি বিঘা দুই ডিহির ঊষর জমি। ফসল ভালো দেয় না। কিন্তু আমাদের জীবন-আখ্যানে জমিজিরেত ব্যাপারে এখন নিবিড় কোনও কথা নাই। এই মুহূর্তে নাই। আমরা এসেছি গ্রামপোড়া এক গ্রাম্য গুনেহগার মেয়েকে দেখতে। কী করে সে গ্রাম পোড়ালো, তাই জানতে। আমিই ঠাকুমায়ের কাছে এই মেয়েটিকে দেখব বলে ‘জিদ’ করেছি। দাদিমাও জেনে গেছে আমি কেন রমিপুর-নওদাপাড়ার পুড়ে পাড়ায় অন্ধ চয়নের কাছে গিয়েছিলাম।

এই ৬৫ বছরের নবীন বার্ধক্যে নুকুতা (আসলে নুকতা খাতুন)’র মুখমণ্ডলের পুরো ছাঁদ স্পষ্ট মনে আসে, কেননা বয়েস যত বাড়বে শৈশবের কিছু কিছু ঘটনাদৃশ্য ততই জ্যান্ত হয়ে স্মৃতির ঝরোখা সরিয়ে স্পষ্টতর হবে। মৃত্যু যত এগিয়ে আসবে শৈশব তত স্পষ্ট হয়ে প্রত্যুষ আলোর প্রথম রেখাটির মতো শিশিরের চোখের টলটলে আভায় চিকিয়ে উঠবে, পুব আকাশটা হবে ফরিস্তার প্রশস্ত কপালের মতো পবিত্র ধবল।

ওসরার একটি খুঁটি বাঁ হাতে কতকটা বেড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর চৌদ্দ-পনর’র বালিকাবধূ। বছর খানেকের পুরনো বউ সে। অথচ সর্বাঙ্গে তার কোনও অলংকার নাই। কোথায় গেল সোনাটুকুনই, কোথায় গেল রুপোটুকুনই হা খোদা কোথায় গেল! অনটনের সংসারে সম্ভবত বন্ধকে গিয়েছে। কিন্তু জানা যাচ্ছে না, কারা এই বন্ধক দিয়েছে। নুকতার বাপের পরিবার নাকি তার শ্বশুর পরিবার।

কারিমন শুধোলেন না, ‘হ্যাঁ, রে মেয়ে! নাকে-কানে কেনে তোর বাবলার কাঁটা! অলংকারপতি কুথা গেল!’ শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন, ‘এই তা হলে দশা হলো তোর নুকুতা খাতোন! যা হোক। আমার পোতারে শুনাও, কী করলে ইবলিসে!

কী কষ্টে আগুন লাগা ও সংসার ছাই হয়ে যাওয়ার ঘটনা ও দৃশ্যের বর্ণনা বয়ান করেছিল নুকতা খাতুন, কী কষ্টে, তার বয়েত করা নিতান্ত কঠিন। চোখের সামনে ভাসছে সেই আশ্চর্য যন্ত্রণামাখা ও করুণ মুখটা!

চুলা থেকে ফুলকি ঠিকরে পড়ল চুলা (উনান)-এর গা-লাগা ঘরের কোণে খাড়া করে রাখা পাটকাঠির গোছার গায়ে লেগে থাকা ফেঁসোর উপর। নজরেই পড়ল না বাচ্চা বউটার অর্থাত্ নুকুতার। আগুনের ফুলকিকে ওভাবে ঠিকরে দিল কে? বলা বাহুল্য, ওটা ইবলিস; গরিব ও নিরক্ষর পৃথিবীর আগুন-দেবতা ইবলিস, যার আগুন খেলা যুগে যুগে ছাই করেছে বসতি।

বলতে বলতে দু’চোখ ছলছল করে উঠল নুকুতার। শান্তু দুই চোখ বড় বড় করে দেখছিল এক নিরপরাধ গুনেহ্গার (পাপী) কিশোরী বধূর স্বীকারোক্তি। যেন তার ক্ষুদ্র বুকখানি মুচড়ে উঠে ভেঙে পড়ছিল এক সদ্য পাপমুক্ত শিশুর চোখের সামনে। এদিকে কারিমন তাঁর পোতাকে জীবন চেনাচ্ছিলেন একটি দুটি গ্রামের ভেতর দিয়ে ধূলিধূসরিত চৈত্রের অপরাহ্নে পোড়া গ্রামের পোড়া গন্ধের দম বন্ধ করা হাহাকারের ভিতর।

নুকুতা একটি দুটি কথা বলে আর নাকের বাবলা-কাঁটা খুঁচিয়ে দেয় নাকেরই ছিদ্রের ভিতর। তাই দেখে শিশু শান্তু চমকে চমকে উঠছিল। কী দুঃসহ সেই দৃশ্য। নুকুতা বলছিল, ‘পাপ করলাম দাদি, নজ্জায় পালিয়ে এলাম বাপের বাড়ি। সোয়ামি রাগে-দুঃখে আমারে ‘ঘরে চ’ বুলে ডাকতেও আসে নাই দাদি কারিমন! ঘরে কী যাব! ঘরই তো নাই। সংসারের সবাই দৌলতপুরের ডিহিতে তিরপাল (ত্রিপল)-এর তাঁবু গেঁড়ে আছে আম্মা! আহ্! নাগছে গো দাদি। নাক কানের ফুটা পাছে বুঁজে যায় মা, সুনাদানা একটা টুকরা কি নাক-কানের ফুটায় উঠবে সোয়ামি ঘর বাঁদতে পারলে! কও, দাদি! শ্বশুরেও তো ডাকতে এল না! গুনাহ্ তো হয়েছে আম্মা! তাই না! এই প্রথম পাপ করলাম। দাদি আম্মা! কী বলো?’

নুকতা এবার খুঁটি ধরে নামতে নামতে বসে পড়ল। তার নাকের ছিদ্র গলে টপটপ করে তাজা রক্ত পড়তে লাগল। নুকুতার মা ওই দৃশ্য দেখে ‘হায় আল্লা!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল; আকাশে একটি টিটি পাখি ডেকে ডেকে উড়ে কোথায় চলে যাচ্ছিল।

২৩

আত্মস্মৃতির উপাদানে গড়া এ আখ্যানে চয়নের কথাই ছিল মুখ্য। তাকে দিয়েই এই পর্ব শেষ করব। কোনও এক নবীন বসন্তের মেঘলা ভোরে পুবের দেশ থেকে এক বুড়া লোক এল তার উঠানে। বলল, ‘জরুরি তলব নিয়া এই পুড়ে পাড়ায় আসতে হলো বাছা। এইডে চয়ন পুড়ার বাড়ি তো, অন্ধ চয়ন আর আতরার ঘর এইখানা?’ জবাবে আতরা বলল, ‘জি। ঠিক উঠানেই আসেছ। তলব কিসের কহো। বদনা না গাড়ু, কী তোলাবে শুনি। তুমি মানুষটা দেখতে কেমন ঝ্যানে ঠাহর হয়। কানা বুঝিন?’

জরায়-খাওয়া, দেখতে কুিসত, একটি চোখ অন্ধ, অত্যন্ত অচেনা এক বুড়া; সমস্ত গা পোড়া-পোড়া। সারাটা মুখ বসন্তের দাগে ভরা এবং কুিসত হয়েও করুণ! এক চোখ কোনও দূষিত ক্ষারে গলে গেছে এবং বসন্তের খাদে ভরা মুখটার কপালে একটা জলভরা টসটসে আব। নাকের আকৃতি প্রায় নেই বললেই চলে, শুধু ফুটো দুটো আছে। ভাঙা গালে হাড় ঠেলে উঠেছে। লোকটা পরে রয়েছে কাফন-আকৃতির সাদা মার্কিন থানের পোশাক। বাউল-ফকিররা যে-রকম মৃতের পোশাক পরে সেই রকম। যদিও বাউলদের পোশাকের রং গেরুয়া, এই বুড়ার তা নয়, এ পোশাক সাদা থান কেটেই হয়ত কোনও এক মৃতের দেশের দর্জি বানিয়ে দিয়েছে—এ কথা ভেবে শিউরে উঠল চয়নের বউ আতরা।

বুড়া বলল, ‘আমি কানা মৌজু উর্ফে জিবরাল সেখ মেহ্তারমা! শুনো, পাঁচখান ডোল পড়েছে ফানাপুরের কুয়ায়।’

বুড়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকতেও ভয় করছে, ফের কেমন একটা ঘৃণাও করছে আতরার। মৌজু মানে তো মিথ্যা। বাপ-মা কেমন যে, এমন নাম রেখেছে ছেলের! সেই ছেলে যেন কাফন পরে কুয়া থেকে জিনিস তোলার তলবদারি করতে এসেছে।

—‘শুনো পাঁচখানা ডোল (বালতি) বাবদ বিশ টাকা পাইবা চয়ন। চলো।’ বলল মৌজু।

আতরা বিরস মুখে বলল, ‘যাবে না। তামাম আসমানে (আকাশে) ম্যাঘ টহলাচ্ছে, অতদূরের পথ। তা ছাড়া উনার শরীল খারাপ বাবা।’

তাই শুনে বুড়া বলল, ‘চিন্তা করিও না মেহ্তারমা। সদরঘাটে অখিল বরের টমটম বুলেছি। ঝুমঝুম কোরে ফানাপুর যাব। খুয়াব আলির দুকানের পাশে বড় ইন্দারায় কাম। বুঝলা?

কানা ও মিথ্যা বুড়ার গলার স্বরে ছিল আশ্চর্য তীব্র এক মাদকতা। সেই মাদকতায় আবিষ্ট হয়ে বিশেষ আহ্লাদে চয়ন বলে উঠল, দাঁড়া আতরা, মরুব্বির সাথে দু’একটি কথা কই। আচ্ছা বাবা, টমটমে ক’ঘণ্টার পথ?’

—‘অখিলের টমটম। রাস্তায় ওই একখানাই টমটম। জানোই তো চয়ন, ওই জিনিস হাওয়ার বেগে ছুটে। থামেই না। থামেই না। মাঝে মাঝে নাকি চাকা মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে ধায়। বলছি কি চয়ন, ফানাপুর যায় ওই একডাই এক্কা। আর সব যায় ধুলাউড়ি, হুড়সি, হুদহুদপুর। তাই না বাপ? চলো যাই!’ বলে উঠল পুবদেশি ফানাপুরের বুড়া।

আতরা এবার প্রবল বাধা দেবার চেষ্টা করল। এমনকি কেঁদে কঁকিয়ে উঠল পর্যন্ত। কিন্তু বউয়ের কথা পায়ে ঠেলে জিবরাল সেখের সঙ্গে রাস্তায় নেমে গেল চয়ন। মৌজু কানা পরম মোহে জন্মান্ধ চয়ন পুড়েকে নিয়ে চলল সেই এক মেঘাচ্ছন্ন আকাশের তলে যে ধুলার রেণুবৃষ্টি ভেজা পথ তার উপর দ্রুত পা ফেলে ফেলে। মেঘ আকাশে তখন হাজার বছরের পুরনো মষিনার খইলের মতো চোকলা-চোকলা। হঠাত্ হাওয়া লাগল তাতে, প্রায় স্থির পদার্থটা নড়ে উঠে পাকিয়ে-পাকিয়ে উঠতে শুরু করল।

ওরা সদরঘাটে পৌঁছাল এবং অখিলের এক্কায় চড়ে বসল। উড়ে চলল টমটম। তারপর ওরা পৌঁছাল এক জনশূন্য হাটের মধ্যে। কাছেই কোথাও মসজিদে আজান পড়ল।

বড় কুয়ায় নামিয়ে দেওয়ার আগে মৌজু কানা অন্ধ চয়নকে বলল, ‘আজান পড়ল শুনলা তো বাছা! এখন লোকে এসে দড়ার ফাঁসে বদনা নামায়ে ওজুর পানি উঠাবে। নমাজের সত্রে ইখানে ফরিস্তা আসে শুনা যায়। ওজুর পানি মানুষের সাথে ফরিস্তাতেও তুলে আব্বা। ওজুর পানি তোলা হলে তুমি নামবা। কথা হলো, এই কুয়ায় জিনিস পড়লে তুলবার ব্যবস্থা ব্যাপারে দানী মধু মজুমদারের মানা আছে। কিন্তু ইবার হজরত মোড়ল বুললে চয়ন রে ডেকে এনে নামায়ে দেও। যত জিনিস উঠবে তার আধেক চয়ন পাবে। শুধু ডোল সাতখানা মসজিদে দিবা। তাই নাফা বুঝে নাফ দেও চয়ন পুড়ে। ডর পাইও না।’

মানুষ এবং ফরিস্তা নমাজের ওজুর জল নেবার জন্য বদনা হাতে কুয়ার কাছে আসতে লাগল। দ্রুত এল। দ্রুত তারা জল নিয়ে চলেও গেল। জায়গাটা আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে এলে মৌজু বলল, ‘আমিও ওজু করলাম বাছা। তুমি তো খুদার ইবাদত করতে জানো না আব্বা! শুধু খোয়াজা খিজিরকে ডাকো শুনেছি। লাও ঝাঁপ দেও।’

চয়ন বলল, ‘আমার শুধু বিশ টাকাই লাগবে মৌজু। আগে সেই টাকা দেও। জিনিসের আধেক ভাগ লাগবে না।’

—‘শুনো হে। মধু মজুমদার সোনাদানার সিন্দুক নামায়ে রেখেছে এই ইন্দারার পানির তলে। যদি তুলতে পার তো দ্যাখো। এইডেই আসল সমাচার পুড়ে। লাও নামো। নমাজ পরে দেখা হবে। সিন্দুক যদি পাও, এই সাদা কাফনে সেডা জড়ায়ে নিবা। বিশ টাকা তো সামান্য পয়সা বাবা। আচ্ছা, নমাজ ধরতে হবে। চলি।’

চলে গেল মৌজু। কুয়োর কানা ধরে গোল হয়ে কুয়োটা প্রদক্ষিণ করল চয়ন। বুঝল, এর গায়ে খাদালো পৈঠা (গর্ত) নেই, তাই দুই পা প্রসারিত করে ওই খাঁজে দুই পা রেখে-রেখে উপরে উঠে আসা যাবে না। তা হলে উঠে আসার ব্যবস্থা কী না জেনে সে ঝাঁপ দেয় কী করে!

তাই কুয়োর পাটায় গালে হাত রেখে চুপচাপ বসে থাকে চয়ন। সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৌজু আর ফেরেই না। সন্ধ্যার অল্প আগে মৌজু আসে। চয়ন বসে আছে এবং জিনিস কিছুই ওঠেনি দেখে অবাক হয়। চয়নকে অগত্যা বুঝিয়ে বলে কীভাবে কুয়োর তলা থেকে উঠে আসতে হবে। বলে, কুয়োর গায়ে লোহার আংটা পোঁতা সিঁড়ি আছে।

কুয়োয় ঝাঁপ দেয় চয়ন। অদ্ভুত ব্যাপার জলের তলায় সে কিছুই পায় না। তখন সে বোঝে মিথ্যার ছদ্মবেশে মৃত্যুই তাকে এই মৃত্যুকূপে নামিয়ে দিয়েছে। চয়ন চিত্কার করে মৌজুর নাম ধরে ডাকে। সাড়া পায় না। লোহার আংটায় পা রেখে এবং আংটা ধরে সে উপরে উঠে আসবার চেষ্টা করে। নিদারুণ মরচে ধরা আংটা ভেঙে জলে খসে পড়ে। সে তখন জলের ফরিস্তাকে আর্ত গলায় ডেকে ওঠে, ‘আমারে আতরার কাছে ফিরায়ে দে খোয়াজা! মরণের ফাঁদে শেষটায় পড়ে গেলাম বাবা খিজির। আতরার মানা শুনি নাই হে পানির ফরিস্তা। আমারে মাফ করিস আতরা! আমার জল-কবর হইল বউ!’

রাত হলো। কুয়োর জলে ভেসে রইল চয়নের মৃতদেহ।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন