লাল কাঁকড়া ও বুনোফুল

lalpipraঅফিসে আজ অলস সময় কাটছে মাহবুবের। দু-একবার বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করে আসছে। টেবিলে বসে স্থির থাকতে পারে না। পেপার ওয়েট দিয়ে কাঠের টেবিলের ওপর শব্দ করে। পাশের টেবিলের মুস্তাফিজ আজ অফিসে আসেনি। ও মনে মনে ঠিক করে, বেরিয়ে যাবে। ঢাকা শহর থেকে দেশের শেষ সীমানার এই অফিসে কাজের পরিমাণ আর কতই বা থাকতে পারে। আধা-ঢিলেমির অলস সময় ধুমধাম পার হয়ে যায়।

মাহবুব ঝিমোতে পারে না। ছেলেবেলা থেকেই ঝিমুনিতে অভ্যস্ত নয়। অনেক ভেবে দেখেছে, দুচোখে বড় করে তাকিয়ে থাকাই ওর প্রিয় অভ্যাস। হরিণঘাটায় বাস করার এই সময়ে ও আশ্চর্য মগ্নতায় নিজের অভ্যাসের দোলনায় নিজেকে ছেড়ে দেয়। অফিসের একতলা ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এলাকার বুনো ঝোপঝাড়ের চারপাশ ওর সামনে নানা আকারের ছবির মতো ফুটে থাকে। সেই ছবিতে রঙের বৈচিত্র্য থাকে, আকারের জটিল বিন্যাস থাকে—ওঠানামার চিত্রিত পাটাতন জীবন বাজি রাখার নানা আঁচড় তৈরি করে। ও মানসিক ভবঘুরে হয়ে যায়, যার পথের ধারের অজস্র মোড় যুক্তিতর্কের বাইরের এক দুরন্ত বলয়। চিন্তার এমন এক সীমান্তে দাঁড়িয়ে মাহবুব কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।

দূর থেকে দেখতে পায়, খালের পাড়ে একটি লোক বসে আছে। তার পিঠ, মাথার পেছনের অংশ দেখে বুঝতে পারে, লোকটির সঙ্গে ওর আগে দেখা হয়নি। যাকগে, যে বসে থাকে থাকুক, তাতে ওর কিছু এসে যায় না। ও পথের পাশে ছোট গাছের প্রজাপতি উড়িয়ে দিয়ে দমফাটা হাসিতে চারদিক ভরিয়ে দেয়। মাঠে কাজ করতে থাকা কেউ কেউ ওর দিকে তাকিয়ে হাতের ঘাস ছুড়ে বলে, পাগল। আরেকজন বলে, পাগল অইব ক্যান? মজার মানুষ। এমুন মানুষ মুই দেহি নাই।

একসময় হাসি থামিয়ে মাহবুব দুই হাত ওপরে তুলে নাচতে নাচতে সামনে এগোয়। এখানে বাস করার আনন্দ ওর কাছে এমন। দেখতে পায়, হরিণঘাটার খালের পানিতে জোয়ার এসেছে। দুপাশের কাদামাখা পাড় পানিতে ভরে গেছে। চারপাশ বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ভাটির টানে কাদামাটি বেরিয়ে আসে। সেটা দেখতে ভালো লাগে না মাহবুবের। তখন ওর বড় চোখ কুঁচকে যায়। মেজাজ খারাপ হয়। বিষণ্নতা পেয়ে বসে ওকে। ও মনে করে বিষণ্নতা সঙ্গী। বিষণ্ন হয়ে গেলে ও আশ্রয় খুঁজে পায়। এই মুহূর্তে ও তেমন আনন্দে ভরে ওঠে। আশ্রয় পাওয়ার আনন্দ নিয়ে ও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে লোকটিকে দেখে। ওর চোখ দেখা হয় না। নিজের ডেরায় ঢোকার আগে ও লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালে মাহবুব দেখতে পায়, তার গালের ওপর চোখের পানি গড়াচ্ছে। গালের ওপর পানি গড়াতে দেখে মাহবুব ভাবে, এটিও জোয়ারের স্রোত। কী হয়েছে লোকটির? প্রশ্ন করার আগেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে ওকে সালাম দেয়। বলে, গাঁয়ের লোকের কাছে আপনার কথা শুনেছি। ভালো আছেন?

—আমার ভালো থাকা দিয়ে আপনার কী দরকার? লোকটি এমন আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে যায়। মুহূর্তে সামলে নেয় নিজেকে। মৃদু স্বরে বলে, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। মানুষ তো একজনের খোঁজ আরেকজন এভাবেই নেয়।

—আমি মানুষ না।

—মানুষ না! বিপুল বিস্ময় লোকটির।

—আমি কচ্ছপ। আপনার নাম কী?

—আমার নাম অরূপ। আমি ঢাকায় থাকি। চাকরি করি। ছয় মাস পরে বাড়ি এসেছি। আপনার কথা আমি ঢাকা থেকেই শুনেছি। আপনি আমাদের মাহবুব ভাই।

জোরে হেসে ওঠে মাহবুব।

—আমি হরিণঘাটার কচ্ছপ ভাই, না?

—না, না, এমন কথা কেউ বলে না। আপনাকে সবাই ভালোবাসে।

—আসেন তো, এখানে বসি।

অরূপ দুই হাতে চোখ মোছে। দ্রুত নিজেকে সামলায়। চুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে এলোমেলো চুল গোছায়। ভাবে, ওর অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু করতে পারছে না। একটি লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু করার অবস্থা এই প্রথম। কারণ ওর মেয়েটিকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে। ওর কাছে মেয়েটির কোনো খোঁজ নেই। শুধু ও সন্ত্রাসীকে চেনে। ও আবার জলভরা চোখে মাহবুবের দিকে তাকায়। মাহবুব ওর হাত ধরে বলে, আসেন। এখানে বসেন।

দুজনে গাছের গুঁড়ির ওপর বসলে অরূপ জোয়ারের পানির দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মেয়ের নাম সুখপাখি।

—বাহ, সুন্দর নাম। আপনি রেখেছেন নাম, নাকি ওর মা?

—আমি রেখেছি। এই হরিণঘাটার পাখি দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি। আমি অনেক পাখির নাম নিজে নিজে রেখেছি। সেই পাখির নাম আমার নিজের বলে আমি আনন্দে বুক ভাসাতাম। কলেজে পড়ার সময় মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হলে আমি ওর নাম সুখপাখি রাখব।

—আপনি তো খুব ভাবুক মানুষ।

মাহবুব হাসতে থাকে। অরূপ দুই কান ভরে ওর হাসি শোনে। ভাবে, এই হাসির আনন্দ ওর জীবন থেকে ফুরিয়ে গেছে। হাসিতে আর সুখ নাই। যার জীবন থেকে সুখপাখি হারিয়ে যায় তার আর সুখ কী? ও দেখতে পায়, একটি পাখি এসে খালের ওপারের গাছের ডালে বসেছে।

মাহবুব হাসি থামিয়ে চেঁচিয়ে বলে, দেখেন দেখেন, একটি নতুন পাখি এসেছে। আপনি আগে দেখেছেন?

—দেখেছি। আমি অনেকবার দেখেছি।

—খুব চঞ্চল পাখি। দেখছি কোথাও স্থির বসে থাকতে পারছে না। কেবলই ওড়াউড়ি।

—হ্যাঁ, এই পাখিটা এমনই। সারা দিন ওড়াউড়ি করে। ওই দেখেন ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকরে কেমন ঘুরছে।

—নাম কী পাখিটার?

—বামন লেজকাটা টুনি। দেখেন মাথাটা বড় আর লেজটা একটুখানি। এই জন্য নামটা এমন।

—নামটা আমার পছন্দ হলো না। আমি এটাকে সুখপাখি ডাকব।

—সুখপাখি! অরূপ বিষণ্ন হয়ে যায়।

—এই পাখিকে বলব তোমার সুখপাখিকে খুঁজে বের করতে।

—আমার সুখপাখি। আমার সুখপাখি।

অরূপ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

—কেঁদো না। তুমি ঢাকায় ফিরবে কবে?

—দুদিন পরে। মেয়েকে হারিয়ে মায়ের কাছে এসেছি। কালকে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি।

—তুমি আরো পাঁচ দিন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাও।

—কেন?

—তাহলে শান্তি পাবে। মন স্থির হবে।

অরূপ চিৎকার করে বলে, না, কখনো না। এভাবে মন ঠাণ্ডা হবে না। মেয়ে চাই। মেয়ে চাই। আমার বুকের মধ্যে আমার স্বপ্নের মেয়ে চাই।

—কাঁদবে না। কারো কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। থানায় যাওনি?

—গিয়েছি। থানার যা করার তার সব করেছি।

—এখন থেকে শুরু হলো তোমার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ। মেয়েটি কত বড়?

—ষোলো বছর বয়স। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। এই সুন্দর পাখিটির মতো টুকটুকে আমার মেয়ে। ওর চোখে জাদু আছে।

—বুঝেছি। বয়স ষোলো। বুঝেছি। জাদুর দৃষ্টি। ভ্রু কুঁচকে বামন পাখিটির দিকে তাকায় মাহবুব। দেখতে পায় পাখির ডানা, ঘাড়, গলা, মাথা গাঢ় বাদামি রঙের। ডানার প্রান্ত ধূসর কালচে। অপরূপ রঙের ছোঁয়ায় পাখিটির চঞ্চলতা মিশে জাদুর পাখি হয়ে ও লাফালাফি করছে। কেন ওর ভেতরে এই দারুণ চঞ্চলতা? মাহবুব নিজেকে প্রশ্ন করে। ও জানে, এর উত্তর ওর জানা নেই। পাখিটি নিজেও উত্তর দিতে পারবে না। বনের সবখানে মায়াময় জাদুর কাঠি আছে। দরকার শুধু খুঁজে ফেরা। দুচোখ ভরে দেখা। দেখে নিজের বুক ভরিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা। কিন্তু না, সবার জন্য এমন কথা হয় না। এই অরূপ নামের লোকটির নতুন দিনকে নতুন করে দেখা শেষ। মেয়েটিকে ফিরে পেলেও ওর জীবনে দিন আর নতুন হয়ে উঠবে না। ওর সামনে অরূপ একজন ভিন্ন মানুষ। কারণ ওর বুকের ভেতর হাহাকার মাকড়সার জালের মতো সুতো ছড়াচ্ছে। ওকে যখন-তখন কাঁদতে হবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ভাসিয়ে বলবে, ভগবান, আমি আর বাঁচতে চাই না।

অরূপ দুহাতে চোখ মোছে। মাহবুব ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আমি খেয়াল করিনি যে আপনাকে আমি তুমি করে বলতে শুরু করেছি। আমার যে কী হয় বুঝি না। কাউকে বেশি আপন ভাবলে এমন হয়।

না, না, আপনি যা করেছেন ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। বরং ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে, আপনার হাত ধরে নদীর ধার দিয়ে হেঁটে দূরে কোথাও যাচ্ছি। আমার মেয়েকে খুঁজছি।

মাহবুব বিড়বিড় করে, সুখপাখি, সুখপাখি।

—আপনি বিয়ে করেছেন, মাহবুব ভাই?

—করিনি। বিয়ে আমার পছন্দ না। আমি কোনো দিন বিয়ে করব না।

—প্রেম?

—প্রেম আমি বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্নরীকে আমি ভালোবাসি। আর একসময় মনে হয়, ভালোবাসাবাসি কিছু না। বাজে ভাবনা। খারাপ আচরণ। একজন মানুষের দরকার কী আরেকজন মানুষের সঙ্গে বাস করা।

কথাগুলো অরূপের পছন্দ হয় না। ভাবে, এই লোকটির মনে বোধ হয় কোনো কষ্ট আছে, না হলে এমন কথা বলবে কেন? নাকি মাথায় গোলমাল আছে? ও দ্বিধায় পড়ে। দেখতে পায়, লোকটি পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ অরূপ ওকে মাহবুব বলে চিনেছিল। এই কথাগুলো বলার পরে অরূপের কাছে মাহবুব ‘লোকটি’ হয়ে যায়। ওর মনে হয়, লোকটির জন্য ওর এ রকম ভালোবাসা থাকবে। নিজের মেয়েকে খোঁজার যে আকুতি, সেই আকুতি ভরা ভালোবাসা। লোকটির ভেতরে ভালোবাসার আকাল আছে।

—তুমি কী ভাবছ অরূপ?

—সুখপাখি।

—চলো, সুখপাখিকে সঙ্গে রেখে আমরা ভাত খাই। আমাদের কাছ থেকে ও হারিয়ে যায়নি।

অরূপের হাত ধরে মাহবুব। হালকা করে টান দেয়। দুজন একসঙ্গে খেয়াল করে, নদীতে ভাটি শুরু হয়েছে। খালের পানি নেমে যাচ্ছে সাগরের দিকে। দুজন পেছন ফিরে তাকায়। ছেড়ে আসা পাখিটি তখনো ওড়াউড়ি করছে। ওর ঠোঁটে ছোট পোকা ধরা আছে, বোঝা যায় ভঙ্গি দেখে। নইলে এত দূর থেকে ওই খুদে পোকা চোখে পড়ার কথা নয়। মাহবুব মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, ও কী খায়, অরূপ?

—ছোট ছোট পোকামাড়ক, কীটপতঙ্গ, মাকড়সা—এই সব। লতাগুল্মের মধ্যে পোকামাকড় বেশি থাকে।

—ওরা কী দিয়ে বাসা বানায়?

—শ্যাওলা, শিকড়, ঘাস—এসব আর কি। খালের জলের লতাপাতাও নিয়ে যায়।

—ডিম পাড়ে কখন?

—এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে।

—কয়টা ডিম পাড়ে?

—তিন থেকে পাঁচটা। পনেরো দিনের মধ্যে বাচ্চা ফোটে।

—তুমি অনেক কিছু জানো দেখছি।

—আমার জন্ম হরিণঘাটায়। ছোটবেলা থেকে এসব কিছু দেখেই তো বড় হয়েছি। আমি মাকে বলেছি, আমি মরে গেলে আমাকে যেন ঢাকার শ্মশানঘাটে পোড়ানো না হয়। আমার মরদেহ এখানে আনতে হবে।

—মাকে বলেছ কেন? মা তো তোমার আগে মারা যাবে? বউকে বলো না কেন?

—মা আমাকে জন্ম দিয়েছে। মায়ের সঙ্গে আমার মৃত্যুর সম্পর্ক বেশি কাছের মনে করি। সে জন্য মায়ের কাছেই আমার মরণের পরের আবদার।

মাহবুব চোখ বস্ফািরিত করে তাকায়।

অরূপের দুই হাত আঁকড়ে ধরে বলে, আমি আমার মৃত্যুর পরের আবদার কাউকে জানাতে পারব না। আমার সব সময় মনে হয়, আমার কেউ নাই।

—কী বলছ, মাহবুব ভাই?

—তুমি আমাকে ভাই ডাকবে না। মাহবুব ডাকো। আমি তো তোমার ভাই না। কেউ না।

—তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার মধ্যে একা থাকার এমন আকুতি কেন?

—জানি না। চলো আমার ডেরায়।

—চলো। দবির কি আছে তোমার ডেরায়?

—আছে। ও আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে।

—ব্যবস্থা করে, না রান্না করে?

—ওই একই কথা।

—না, একই কথা না। ব্যবস্থা আর রান্না আলাদা শব্দ। আলাদা কাজ। আলাদা সম্পর্ক। ব্যবস্থা শুধুই কাজের শব্দ আর রান্না প্রাণের সম্পর্ক।

—ধুত, আমি এত কিছু বুঝি না। তুমি আমার সঙ্গে পণ্ডিতি দেখাচ্ছ। তোমার এই পণ্ডিতির মধ্যে মেয়ে হারানোর দুঃখ নাই।

মাহবুব একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে ফেলে। জোরে জোরে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। একসময় পেছন ফিরে দেখে অরূপ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এক পা-ও এগোয়নি। ও আবার দ্রুত হেঁটে এসে অরূপের হাত ধরে বলে, আসছ না কেন?

—তুমি যে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে।

—তুমি তো আমার পিছে পিছে আসবে। আসো না কেন?

—আমার মন ভালো নাই।

—আমারও মন ভালো নাই।

অরূপের হাত ধরে মাহবুব টান দেয়। দুজন সামনে পা বাড়ায়। অল্পক্ষণে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় বামন লেজকাটা টুনি। দুজনই ঘাড় বাঁকা করে পাখিটি দেখে। ওটি উড়ে চলে যায় দূরে। ওকে আর দেখা যায় না।

মাহবুব হাসতে হাসতে বলে, ও আমার কাছে একটি মানুষ। ঠিক তোমার মতো। খালের ধারে আমার জন্য এসেছিল। ওড়াউড়ি দেখিয়ে চলে গেছে।

অরূপ মৃদুস্বরে বলে, কী বলে গেল তোমাকে?

গানের ভাষায় বলেছে, ‘ভালো আছি, ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। ’

অরূপ কথা বলে না। এসব গানের ভাষা শোনার মতো অবস্থা তার নেই। নিজেকেই বলে, আমিও এক বামন পাখি। আমার পরানে গানের সুর নেই। জীবন টানতে টানতে বামন হয়ে গেলাম। মেয়েটার সন্ত্রাসীর হাতে বলি হওয়া আমার বামন হওয়ার শেষ উচ্চতা। ভগবান, আমার মরণ দাও।

মাহবুব ওর হাত ঝাঁকি দিয়ে বলে, তুমি আবার সুখপাখির কথা ভাবছ? তোমার ছোঁয়ায় সেই ভাবনার স্পর্শ পাচ্ছি।

—তাই নাকি?

—হ্যাঁ, তাইতো। ঠিক কি না বলো।

—ঠিক। ঠিক বলেছ। আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি কখনো ভূত, কখনো অদ্ভুত।

হা হা হা—আমি ভূত, আমি ভূত। মা আমার ভূত ছাড়াতে রাত-দিন খেটেছে। সে জন্য আমি খানিকটুকু ঠিক হয়েছি।

অরূপ আর কথা বাড়ায় না। কেবলই মনে হয়, মাহবুবের সঙ্গে সুখপাখিকে হারানোর কষ্ট চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কত কিছু এখন মাথার ভেতর। অরূপ খুব অসহায় বোধ করে। মনে হয় ও এক এতিম বালক। ওর চারপাশে কেউ নেই। ও কোনো দিন বড় হতে পারবে না। মাহবুবের ডেরার কাছে এলে মাহবুব ওর হাত ছেড়ে দেয়। দরজার সামনে থেকেই ডাকে, দবির? দবির?

বেরিয়ে আসে দবির। ওকে অরূপও চেনে। ওরা এক বামন পরিবার। চার ভাই-বোনের সবাই বামন। অথচ মা-বাবা লম্বায় ঠিক আছে। ওরা কেন এমন হলো—ওদের রিকশাচালক বাবা এর উত্তর খুঁজে পায়নি। দবির অরূপকে দেখে বলে, আপনি কবে আসলেন, দাদা?

—কালকে। সুখপাখি আর মণিদীপা কেমন আছে? অনেক দিন ওদের দেখি না। আমার…

মাহবুব ওর কথা থামিয়ে দিয়ে বলে, তোর রান্না শেষ হয়েছে?

—হ্যাঁ, শেষ করেছি। আমি তো আমার জন্য বসে আছি।

—অরূপ খাবে আমার সঙ্গে।

—ভাত খাওয়ার থালা তো একটা?

—আজ আমরা কলাপাতায় ভাত খাব। যা, কেটে নিয়ে আয়।

—হুররে, কলাপাতা কলাপাতা…

বলতে বলতে সামনে দৌড় দেয় দবির। দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ওর ছুটে যাওয়া দেখে। অরূপের মনে হয়, ওকে বানরের মতো লাগছে। কত দিন ধরে চেনে ওর মা-বাবাসহ ভাই-বোনদের। একটি বামন বোন এনজিওর লোন নিয়ে মুদির দোকান চালায়। বিয়ে হয়নি। ওরা বামন হয়ে বেশ সংসার চালাচ্ছে। ভালোই দিন কাটাচ্ছে। কাজ করছে বিভিন্নভাবে। ওদের সংসারে অভাব আছে, কিন্তু পরাজয় নেই।

—কী ভাবছ, অরূপ?

—দবিরের কথা। ওদের আমি ছোটবেলা থেকে চিনি।

—ও একটি সৎ ছেলে। কাজে ফাঁকি নেই। শুধু বুকভরা কষ্ট আছে।

—কষ্ট তো থাকবেই। ওর একটা বিয়ের কথা ভাবতে হবে।

—পারবে? হাতে কোনো চেনা মেয়ে আছে?

—আপাতত নাই। খুঁজব।

—বাহ্ বাহ্, খুঁজবে খুঁজবে…

হাতে কলাপাতা নিয়ে ফিরে আসে দবির। পাতাগুলো মাথার ওপর ধরে রেখে নাচের ভঙ্গিতে হেঁটে এসেছে। অরূপ বলে, তুই আজ বেশ খুশি আছিস রে দবির।

—আপনাকে দেখেছি যে? কত দিন পরে আসলেন, দাদা। আজ আমি আপনাকে ভাত খাওয়াব।

—কী রেঁধেছিস রে?

—টেংরা মাছ রানছি। আর চাউস্যা চিংড়ি দিয়া ডাঁটাশাক ভাজি করছি।

—ডাল রাঁধিসনি?

—মুগের ডাল।

—বাহ্, দারুণ খাওয়া জমবে!

মাহবুব হাসতে হাসতে বলে, কলাপাতায় খেলে সেদিন আমার পিকনিক হয়।

—তাহলে আজ আমারও পিকনিক। অরূপ আকস্মিকভাবে বলে উঠে হঠাৎ চুপ করে যায়। তারপর মাথার ওপর দুহাত তুলে বলে, আমার সুখপাখি ছাড়া তো আমার পিকনিক হবে না। ও মা রে, তুই কোথায়? আয়—আয়—

চিৎকার করে কাঁদতে থাকে অরূপ। কাঁদতে কাঁদতে একবার খালের পাড়ে পানির কাছে চলে যায়, আবার ডেরার কাছে ফিরে আসে।

দবির মাহবুবের হাত ধরে টেনে জিজ্ঞেস করে, স্যার, অরূপ দাদার কী হয়েছে?

—তার মেয়েটিকে সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গেছে।

—তুলে নিয়ে গেছে? হায় আল্লাহ, কী বলেন স্যার…

দবিরও কাঁদতে শুরু করে। ও মাথা চাপড়ায়, পা দাপায়, লাফায়। কান্না থামিয়ে ওর কাছে আসে অরূপ। বলে, থাম দবির। তুই কাঁদলে আমি কোথায় যাব। কাঁদিস না, ভাই আমার।

দবির গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খালপাড় দিয়ে দৌড়াতে থাকে। পেছন ফিরে তাকায় না। ব্রিজে উঠে চলে যায়। ওকে আর দেখা যায় না। অরূপের মনে হয়, ও কি হরিণঘাটায় সব মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে এই খবর পৌঁছে দেবে? বলবে কি, আসেন, আমরা সবাই মিলে সুখপাখিকে খুঁজি? সন্ত্রাসীর হাতে কেন ওর দিন কাটবে? মাহবুবের দিকে ঘুরে অরূপ বলে, ও কোথায় যাচ্ছে, মাহবুব?

—আমি তো জানি না।

—ও কি ঘটনার কথা হরিণঘাটার সব মানুষের কাছে বলবে?

—আমি তো জানি না। বলতেও পারে।

অরূপ দূরের দিকে তাকায়। দেখতে পায় বামন পাখিটিকে। উড়ে আসছে এদিকেই। হয়তো কোনো গাছের ডালে বসবে। পাখিটার লেজ এতই ছোট যে ডানা মেলে ওড়ার কারণে মনে হয় ওর বুঝি লেজই নেই। পালকের রং দূর থেকে বোঝা যায় না। পুরো পাখিটাই ওর সামনে এখন কালো। ঘন কালো। যেন ওটা পাখি নয়, একটুকরো অন্ধকার। সুখপাখিকে হারিয়ে ওর চোখের সামনে যে অন্ধকার ঘনিয়েছে, সেই অন্ধকার। মাহবুব ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আমার খিদে পেয়েছে। চলো খেতে বসি।

—আমি ভাত খাব না।

—তোমাকে কলাপাতায় খেতে দেব না। আমার থালায় তোমাকে ভাত দেব। আমি কলাপাতায় খাব। আজ কোনো পিকনিক নাই।

—মাহবুব, আমি মায়ের কাছে যেতে চাই। আমার মা ভাত নিয়ে বসে থাকবে। বাবার শরীরও ভালো নেই।

—আমি তোমাকে এখনই যেতে দেব না। আমার সঙ্গে একটু বসতে হবে। সুখপাখিকে কিভাবে নিয়ে গেল তা তো তুমি জানতে পেরেছ। আমাকে বলো।

—তোমার খিদে পেয়েছে। তুমি ভাত খাও।

—আমি যাচ্ছি। তুমি বসো।

অরূপের হাত ধরে ডেরার ভেতরে ঢোকে দুজন। অরূপ চৌকির ওপর বসে। ইচ্ছে করছিল শুয়ে পড়তে, কিন্তু পড়ে না। ঠিক হবে না ভাবে। মাহবুব ঘরের কোনার পাতিল থেকে ভাত-তরকারি থালায় নিয়ে চেয়ারে এসে বসে। এক লোকমা মুখে পুরে বলে, কোথা থেকে নিয়ে গেল সুখপাখিকে?

—সেদিন ছিল শনিবার। বিকেল সাড়ে ৫টা। মেয়েটি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আইসক্রিম কিনতে বেরিয়েছিল। আমার বাড়ি অর্থোপেডিক হাসপাতালের পেছনে। শিশু হাসপাতালের গেটের খানিকটা দূর থেকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসের চারজন মেয়েটির মুখ চেপে ধরে জোর করে গাড়িতে নিয়ে চলে যায়। আমি অফিসে ছিলাম। ফোন পেয়ে এসে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছি। অপরাধীদের আমি চিনতে পেরেছি। ছেলেটি এই হরিণঘাটা থেকেই মেয়েটির পিছে লেগেছিল। আমি ওকে ওর পিসির বাড়ি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াই। এসএসসি পাস করলে ঢাকায় নিয়ে যাই। টের পেয়েছিলাম যে ছেলেটিও ঢাকায় এসেছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। রাস্তায় যেখান থেকে ওকে গাড়িতে ওঠায়, তখন যারা ছিল তারা চারজনের কথা বলেছে। আমি বুঝে গেছি যে কারা এসেছিল। আমি ওদের সবাইকে চিনি। ছেলেটির বোনও সেদিন গাড়িতে ছিল।

মাহবুব কথা বলে না। অরূপের দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করে ভাত খেতে থাকে। থালার ভাত ফুরিয়ে গেলে আরেক থালা ভাত-তরকারি নিয়ে আসে।

অরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি গেলাম।

মাহবুব ঘাড় কাত করে। মুখে ভাত পোরে। অরূপ অবাক হয়। ও নিজেই তো ঘটনাটি শুনতে চেয়েছিল। ওর কি সব বোঝা শেষ হয়ে গেছে? সুখপাখির কথা আর জানার দরকার নেই। অরূপ জলভরা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। পেছন ফিরে তাকায় না। দেখতে পায় না যে মাহবুব তার থালার অর্ধেক ভাত চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছে। আয় আয় টি টি বলে পাখিদের ডাকছে। দু-একটা কাক উড়ে এসে মাটিতে বসেছে। আর কোনো পাখির উড়ে আসার লক্ষণ নেই। চারদিকে নীরব ভয়াবহতা নেমে এসেছে।

মাহবুব তখন চিৎকার করে বলে, সুখপাখি এমন করে হারিয়ে যাবে কেন? ওকে আমি খুঁজে পেতে চাই। কোথায় খুঁজব? জানি না। জানি না।

থালার শেষ ভাতগুলো ছুড়ে দেয় ওপরে। ভাবে, ওগুলোর পাখা নেই যে উড়ে যাবে। ওগুলোর পরান নেই যে মারা পড়বে। ওগুলোর ইচ্ছে নেই যে কিন্নরীর রান্নাঘরের ভাতের পাতিলে ঢুকে যাবে। ওগুলো একটু একটু করে পড়ে যাবে এখানে-সেখানে। মাহবুব দূরে তাকালে জেলেদের নৌকা দেখতে পায়। জেলেরা সাগর মোহনা থেকে ফিরে আসছে। নৌকা ভর্তি মাছ। চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে গাঙচিল। গাঙচিলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাহবুব উত্ফুল্ল কণ্ঠে বলে, তোমরা আমার কিন্নরীকুহু। তোমাদেরকে আমার কাছে চাই। আমার তো কেউ নাই।

বৃষ্টি নামে তখন। হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। চারদিকে জোর বাতাস নেই। সাগর মোহনার দিকে তাকালে ঝাপসা দেখায়। মনে হয় বৃষ্টি নয়, চারদিকে কুয়াশার আবরণ। এই কুয়াশার ভেতর দিয়ে কারো হাত ধরে হেঁটে যাওয়া গভীর আনন্দের। মাহবুব খালের পানির ধারে এসে দাঁড়ায়। ঘাস-লতাপাতার ভেতরে পা ডুবিয়ে নিজেকে বলে, সূর্যর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সূর্য মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়লে আমার দুঃখ হয়। বন্ধুকে না দেখার দুঃখ। এখন মনে হচ্ছে সূর্যকে কেউ নিয়ে গেছে। সুখপাখিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীদের মতো কেউ।

সুখপাখি, সুখপাখি! তোকে আমি কোথায় খুঁজব? এতটুকু বয়সে তুই বুঝে গেলি গুণ্ডামি কী, সন্ত্রাসী কী, ধর্ষণ কী, হারামিপনা কী। সুখপাখি, সুখপাখি, তোকে বুঝতে হবে প্রেম কী, ঘর কী, ঘরের ভালোবাসা কী। সন্তান কী। বেঁচে থাকা কী। ওই সন্ত্রাসীরা তোকে বেঁচে থাকা বুঝতে দিল না রে সুখপাখি। আজ তোকে যারা ধর্ষণ করছে, তাদের সন্তান তুই ডাস্টবিনে ফেলে দিস না, সুখপাখি। ওই সুখপাখি, তোকে আমি কোথায় খুঁজে পাব? তোকে তোর বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলব, বাড়ি যা, মামণি। বাড়িতে তোর মা আছে। ছোট বোনটি আছে। তোর বাবা আমাকে ওর নাম বলেনি। আমি নাম রাখলাম জাদুমণি। তোকে আমি ডাকছি সুখপাখি, আয় আয় টি টি।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চলে যায়। যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে দুম করে ফুরিয়ে যাওয়া। আকাশজুড়ে রোদের আলো ঝলকায়। মাহবুব হাঁ করে তাকিয়ে থাকে এমন অপরূপ দৃশ্যের দিকে। ভাবে, আহা, পৃথিবী কী সুন্দর!

মাহবুব খালের ধারে বসে পা ডোবায় পানিতে। ও জানে ওর চারপাশে পোকামাকড় জমবে। সব পোকা ওর চোখে পড়বে না। এতই ছোট যে ওগুলো দেখার জন্য আরো দুটো চোখের তারা জোড়া দিতে হয়। উড়ে আসবে ফড়িং, প্রজাপতি। পায়ের নিচে জমবে কুঁচোচিংড়ি। এখানে বাস করে ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, ও ঘুমের ভেতরে এক গভীর স্বপ্নের ঘোরে আছে। এখানে দুঃখ নাই, কষ্ট নাই, কান্না নাই, হাসি নাই। এ এক মগ্ন চৈতন্য ভুবন। সব আনন্দের ঊর্ধ্বে, সব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে। সমান্তরাল সহাবস্থানে কার্তিক বিহুর প্রজ্বলিত মশাল। বেঁচে থাকার আলো ছাড়া আর কিছু সঞ্চয়ে রাখে না।

মাহবুব দুহাত পেছনে রেখে ঘাড় পেছনে ঠেলে তাকিয়ে থাকে দূরে। বিশাল এক ক্যানভাস ওর সামনে। সেই ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে কিন্নরীকুহুর পূর্ণ অবয়ব। বলছে, মাহবুব, আমি এসেছি।

—তুমি আসোনি, কুহু। তুমি আর কোনো দিন আমার কাছে আসবে না।

মাহবুব ডেরায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ায়। চারদিক ভীষণ নীরব। বনে একটি হরিণও দেখা যায় না। শূকরছানাও নেই। বনবিড়ালও না। ব্রিজের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, দবির আসছে। ও ধীর পায়ে আসছে। ওর পায়ে দৌড়ানোর গতি নেই। ওর ছোট্ট অবয়বে হরিণঘাটার সবটুকু সেঁটে আছে যেন। মাহবুব দুচোখ মেলে দবিরের ফিরে আসা দেখে।

সন্ধ্যা হলে ও ঘরে হারিকেন জ্বালাবে। ওর খাবার টেবিলে দিয়ে বলবে, এখন আমার ছুটি।

—কোথায় যাবি?

—বাড়িতে।

—বাড়িতে কে আছে?

—বামনগুষ্টির সবাই আছে।

শেষ কথাগুলো বলার সময় দবিরের মুখ ভেংচি কাটার মতো হয়ে ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে মাহবুব বিড়বিড় করে, পোকা একটা।

দবির শুনতে পায় না। ও চলে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে মাহবুব। ঝিঁঝি পোকার শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলে। রাত বাড়ে। ঘুম আসে না মাহবুবের। চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে ছোট ডেরার চারদিকে। এই ডেরা একজন মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। মানুষটি যেকোনো দিন যেকোনো জায়গায় চলে যেতে প্রস্তুত। তার কোনো পিছুটান নেই।

দুই.

রাত বাড়ে কিন্নরীকুহুর ঘরেও। ও ঘুমাতে পারছে না। রাস্তার ফিকে আলো ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে পড়ে আছে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকেছে। কিন্নরী সচেতনভাবে এসব ব্যবস্থা করে না। পনেরো তলার ওপরে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে ও দিন যাপন করে। আত্মীয়-স্বজন মাঝে মাঝে রাগ করে বলে, এত ওপরে থাকিস কেন?

—আমার ইচ্ছা।

—তোর একার ইচ্ছা হলে হবে? আমাদের কথা ভাববি না?

—তোমরা তো থাকো না। তোমরা দক্ষিণা বাতাস। যাওয়া-আসা করো। তোমরা একটু সময় আমাকে দাও। তোমাদের এইটুকু সময়ের জন্য আমার পুরো সময় তোমাদের দিতে পারব না।

—হয়েছে, থাম। ধমক দেয় বড় চাচা। কেবল তর্ক শিখেছে মেয়েটা।

—কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের তর্ক ছাড়া জীবন চলে না, চাচা।

—আহ্, কুহু! বলেছি না, তুই এসব কথা বলবি না? তুই আমার ভাইয়ের মেয়ে। আমরা এটাই মনে রাখি।

কুহু দ্রুত মসিউর রহমানের পায়ের কাছে বসে যায়। হাঁটুতে মাথা ঠেকায়। মসিউর রহমান ওর মাথার ওপর হাত রেখে বলে, তোকে দোয়া করি, মা। আমার ভাই তোকে নিজের মেয়ের ভালোবাসা দিয়েছে। স্বপ্ন নিয়ে বড় করেছে।

—আমার দুর্ভাগ্য যে এখন মা-ও নাই, বাবাও নাই।

—আমরা তো আছি। তোকে ঘিরে রাখি আমরা। তোর চারপাশে কত মানুষ!

হ্যাঁ, চারপাশের কত মানুষের সঙ্গেই কিন্নরীর দিনযাপন। এই মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাহবুব। কিন্তু ওকে নিয়ে কিন্নরীর দিন কাটে না। আজ রাতে মাহবুবের কথা ভেবেই তো ঘুম আসছে না। ও বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসে। বুকের ভেতর চাপ ধরা স্তব্ধতা। মাহবুবকে যখন ভালোবাসার কথা বলে, তখন ওর ধারণা হয়েছিল যে মাহবুব একটু অন্য রকম। সম্পর্কের জায়গাটি ঠিকমতো বুঝতে পারে না। ওর চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। ও সাধারণ ছেলেদের মতো না। একটু অন্য রকম। আস্তে আস্তে জানতে পেরেছে, ও অটিস্টিক শিশু। বড় হয়েছে মায়ের যত্নের অনেক চেষ্টায়। সে জন্য ও অতিরিক্ত মাত্রায় অটিস্টিক নয়। অন্যদের কাছে ও শুনেছে, কোনো কোনো বাচ্চা বেশ শান্ত হয়। তারা নিজেদের ভেতর ডুবে থাকে। মাহবুব বোধ হয় এ রকমই।

এসব বুঝেও মাহবুবের জন্য ওর টান অনেক। ও মনে করে, মাহবুবের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার মগ্নতার জন্যই ওকে বেশি ভালো লাগে। এটুকু ভাবতেই দুহাতে চোখ মোছে কিন্নরী। রাত বেড়েছে। রাস্তায় গাড়ির শব্দ কম। নিজেকেই বলে, এর পেছনে তোমার বেঁচে থাকার স্বার্থপরতা আছে। কিন্নরী, তুমি খুব সোজা মেয়ে নও।

ও ছোট ব্যালকনিতে পায়চারি করে। দু-তিনবার ঘুরপাক খেয়ে আবার নিজের মুখোমুখি হয়।

আমি একটি জারজ সন্তান। আমার নিজের মা-বাবার খোঁজ নেই। জন্মের পরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল মা। সেখান থেকে উদ্ধার করে রাস্তার লোকেরা। পুলিশ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেখান থেকে পালক নেয় ডা. হাসিব আর ডা. জুলেখা। তাদের দুটো সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা যাওয়ার পরে আর কোনো বাচ্চা হয়নি।

মা-বাবা আমাকে খুব যত্ন করে পেলেছে। যারা জন্ম দিল, তারা ফেলে দিল। যারা লালন-পালন করল, তারা সবটুকু করল। কোনো ফাঁক রাখেনি। তার পরও বুকের কষ্ট তো বিশাল পাথর। একটুও নড়ানো যায় না।

বারান্দার রেলিং আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে কিন্নরী। কান্নায় বুক ফেটে যায়। পাশের বাসার দরজা খুলে বেরিয়ে আসে মিসেস সামাদ।

—তোমার কী হয়েছে, কুহু?

ও চোখ মুছে বলে, মন খারাপ লাগছে। মা-বাবার কথা মনে হচ্ছে। তাদের ভালোবাসা না পেলে আমি মানুষ থাকতাম না। পোকামাকড় হয়ে যেতাম।

—এভাবে ভেবো না। যাও, ঘুমাও।

—আমার ঘুম আসছে না, আন্টি।

—কিন্তু এভাবে কাঁদলে পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা জেগে যাবে। তুমি ঘরে গিয়ে কাঁদো।

—ঘরে গিয়ে? কাঁদার জন্য জায়গা খুঁজতে হবে?

—কথা বাড়িয়ো না, যাও।

মিসেস সামাদ কড়া স্বরেই কথা বলেন। কিন্নরী কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। ওর দম আটকে আসতে চায়। ও ডুকরে কাঁদে। ভেবেছিল, এমন একটি প্রতিবন্ধী ছেলের সঙ্গে প্রেম করলে ও প্রেম বুঝবে। ওর জন্মবৃত্তান্ত খুঁজবে না। কিন্তু ছেলেটি প্রেমই বুঝতে পারছে না। জন্মের খবরের বিষয় তো ওর মাথায় ঢোকেনি। ও জানে না। জানলে কী হবে? কিন্নরী কান্নার রেশ কমাতে পারে না। প্রেমহীন জীবনে জন্মের হিসাব ওর কাছে এখন বড় বিষয়। ও কোনো কিছুই মানতে পারছে না। একসময় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ওর মনোজগতে শৈশবের স্মৃতি ঘনিয়ে তোলে। তখন ওর বয়স দশ। মাকে জিজ্ঞেস করছে, মা, আমি নাকি তোমাদের মেয়ে না?

—কে বলেছে?

—ছোট খালা।

—কেন বলেছে?

—ছোট খালাকে যে আপনি বকাবকি করেছেন, সে জন্য।

—ও, আচ্ছা। ওর মা একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, আয় আমার কাছে। বোস। এ কথা শুনে কি তুই মন খারাপ করেছিস?

—প্রথমে করেছিলাম। এখন করছি না। তুমি তো আমাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছ। একজন মা তো এমনই করে। করে না?

—হ্যাঁ, এমনই করে। জুলেখা ওর মাথা বুকে চেপে ধরে কপালে চুমু দেয়। তুই আমার ছোট্ট সোনামণি। বুকের ধন। আদরের পুতুল। তুই আমার সব রে কুহু, সব।

—মা, মাগো—মামণি—

স্বপ্নের ভেতরে সেদিনের দৃশ্যটি এভাবেই এসেছিল। এমনই তো ছিল। সেই দশ বছর বয়সের পর ও সাতাশ বছর বয়সে এসে পৌঁছেছে। স্বপ্নের ভেতরে ও প্রতিদিনের পথে হাঁটতে থাকে। কখনো নিজেকে মুক্ত মানুষ মনে করে, কখনো জন্মের জাঁতাকলে সামাজিক সূত্র বিশাল হয়ে ওঠে। নিজেকে জাউরা মেয়ে বলে বকাবকি করে। নিজেকে বলে, তুই ডাস্টবিনে পড়ে চিৎকার করেছিলি কেন? তা না হলে তো তোকে কেউ তুলে আনত না। তুই মরে যেতে পারলি না? তোর বেঁচে থাকার দরকার ছিল? স্বপ্নের ঘোরে ও বিড়বিড় করে। হ্যাঁ, আমি তো বাঁচবই। কেন বাঁচব না? আমি মানুষের মুখের ওপর চিৎকার করে দুনিয়া ফাটাব। বেঁচে থাকা কেমন বুঝব না কেন? আমার বেঁচে থাকা ঠিকই আছে। মাহবুব আমার প্রেম বোঝে না, এমন কষ্ট নিয়ে দিন কাটানো, ঘুম নষ্ট হওয়া—এসবও তো এক রকম বেঁচে থাকা। ভালো কি মন্দ সে-ই বুঝবে, যে দিনটি যাপন করবে।

কিন্নরী ঘুমের মধ্যে শুনতে পায় মায়ের ডাক, মাগো, ওঠো। ভোর হয়েছে। স্কুলে যেতে হবে।

—না, আমি স্কুলে যাব না। আজ আমার ছুটি।

—কে বলেছে ছুটি? ওঠো। এসো আমার সঙ্গে।

ও তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলে না যাওয়ার বায়না করত প্রতিদিনই। মা ওকে কোলে করে ওঠাত। বলত, মানিকটাকে আজ আমি টিয়াপাখি কিনে দেব।

লাফিয়ে উঠত ও। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলত, কখন পাব টিয়াপাখি?

—যখন তুমি চাইবে। বলো কখন চাও?

মায়ের প্রশ্ন শুনে চুপ করে যেত ও। মাথা নেড়ে বলত, কাল বলব।

সেই কাল আর আসেনি। মাকে বলেনি, মামণি, আজ টিয়াপাখিটা আনো।

ও তো জানে মা ওকে একবার টিয়াপাখি কিনে দিয়েছিল। কিন্তু খাঁচায় আটকানো টিয়াপাখি, ও মানতে পারেনি। নিজেই খাঁচার দরজা খুলে ওটাকে ছেড়ে দিয়েছে। মা এসে যখন জিজ্ঞেস করেছে, পাখিটাকে ছেড়ে দিলি, কুহু?

ও হাসতে হাসতে বলেছে, টিয়াপাখির বাড়ি তো ওই খাঁচা না, মা। ওর বাড়ি ওই গাছে। টিয়াপাখি ওখানে থাকবে।

—বাহ্, সুন্দর কথা। লক্ষ্মী মা আমার।

মা ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছে। আদরে ভাসিয়ে দিয়েছে ওকে। ওর মনে হয় মায়ের আদরের সেই ছোঁয়া এখনো ওর গায়ে লেগে আছে। সেই পরশে হাত ছোঁয়ালে নতুন করে জেগে ওঠে প্রাণ। জন্মের কষ্ট মুছে গিয়ে ও নিজের আলয়ে ফিরে আসে। বিছানা থেকে নামে। বাথরুমে যায়। আকস্মিকভাবে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভিজতে থাকে কিন্নরী। মা থাকলে বলত, পানির নিচে লাফালাফি কর, কুহু। মজা লাগবে।

ও সেই শৈশববেলায় মায়ের কথায় লাফাতে লাফাতে পানি ছিটাত। সে যে কী উচ্ছ্বাস-আনন্দ ছিল সেই স্নানে! আজ আর সেই বোধ নেই। পানির নিচে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু ভাবে, শীতল হোক সময়। পানির ছোঁয়ায় জীবনের আনন্দ উপভোগ ফিরে আসুক। ও চুলের ভেতর আঙুল ঢোকায়। চারদিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মা, তুমি কি দাঁড়িয়ে আছ? এখনই বলবে, কুহু, আর ভিজতে হবে না। আয়, গা মুছিয়ে দিই।

এ কথা শুনলে ও একলাফে শাওয়ারের নিচ থেকে সরে আসত। মাকে জড়িয়ে ধরত। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মাথা মুছে দিত। মায়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কী যে আনন্দ লাগত! মাথা মোছার সময় পুরো শরীরে পানি গড়াত। কখনো মনে হয়নি, এই মা ছেড়ে অন্য কোনো মা থাকতে হবে। আশ্চর্য, আজকের রাতটি কেন ওকে এমন তছনছ করছে? ও শাওয়ার বন্ধ করে। কাপড় বদলায়। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে, কত দিন যেন দেখা হয়নি। নিজেকে দেখে ওর বেশ লাগছে। চেহারায় স্নিগ্ধ দীপ্তি আছে। সুন্দরী না, বলা যায় না, বাহ্ অপূর্ব। কিন্তু এই লাবণ্যের ছোঁয়া দৃষ্টি জুড়ায়। অনেককেই দেখেছে ভিন্নভাবে তাকাতে। কিন্তু ওর সাহস হয় না। নিজের জন্মের কারণ ওকে পিছু টেনে ধরে। ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়েকে কে ভালোবাসা দেবে? জানতে পারলে ছিটকে উঠে থুতু ছুড়বে। তার চেয়ে এই বৃত্তের মধ্যে পা ঢোকানো উচিত না।

একমাত্র ভরসা মাহবুব। ওর প্রশ্ন নেই। ওর বোঝার জায়গা কম। ওর সমস্যা অন্যত্র। জিজ্ঞেস করেছিল একদিন, তোমার কুহু নাম কে রেখেছে?

—আমার মা। তুমি আমার একটি নাম রাখবে?

—নাম? কী নাম?

—যা তোমার খুশি। যে নাম তোমার পছন্দ।

—ধুত, এসব আমি জানি না। নাম রাখারাখি আবার কী?

—তুমি জানো না?

—না, না।

চেঁচামেচি করেছিল মাহবুব।

কিন্নরী বুঝে গিয়েছিল, মাহবুবের কল্পনায় এসব নেই। বুঝেছিল, ওর দৃষ্টি ভাষাহীন। তার পরও নিজের কষ্ট আড়াল করে মাহবুবের হাত ধরেছিল। মাহবুব আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, পানি খাব।

—শুধু পানি? আর কী?

—আখের রস।

—আখের রস? কোথায় পাব?

—যেখানে খুশি সেখানে।

—কী যে পাগলামি কথা! তুমি যে কেন এমন করো, বুঝি না।

অ্যাঁ-অ্যাঁ—ভেংচি কেটে মাহবুব সরে যায় ওর সামনে থেকে।

এই মুহূর্তে কিন্নরী ভাবে, এভাবেই ওর প্রেমের জীবন। কখনো কাছে আসে। জড়িয়ে ধরে। বেশির ভাগ সময় অন্যমনস্ক থাকে। যখন যা খুশি, তখন তেমন ইচ্ছা।

কিন্নরী বুঝতে পারে, আজ রাতে ওর আর ঘুম আসবে না। নুসরাত ওকে একটি বই দিয়েছিল। ড্রয়ার খুলে সেটি বের করে। টেবিলে না বসে ফ্যানের নিচে চেয়ার টেনে বসে। বইয়ের পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে থাকে। বইটির নাম ‘দ্য নিউরোট্রাইবস : দ্য লিগেসি অব অটিজম’। বইয়ের নামটি আরো খানিকটা লম্বা। ও সবটুকু মনে রাখতে পারে না। কেবল পড়াই হয়। পড়ে নিজের দিকে তাকালে একটি ছদ্ম আবরণ পায়। চোখের সামনে থেকে জীবনের জৌলুস ফুরিয়ে যায়। বাবার কথা মনে হয়। বাবা বলতেন, বড় হয়ে কী হতে চাস, মা?

—তোমাদের মতো ডাক্তার না, বাবা। আমি রোগী দেখতে পারব না।

—তোকে রোগী দেখতে হবে না, মা। তুই কী হতে চাস বল?

—আমি কিছুই হব না, বাবা। লেখাপড়া শিখে শুধু মানুষ হব। তারপর চাকরি করব। চাকরি করে নিজের ভাত নিজে খাব। কারো বোঝা হব না।

—বাহ্, লক্ষ্মী মেয়ে। মেয়েটার বুদ্ধি অনেক। আমরা তোর জন্য যা টাকা-পয়সা রেখে যাব তাতেও তোর চলে যাবে, মা। বেঁচে থাকার জন্য তোর কোনো কষ্ট হবে না।

—বাবা, বাবা, আমার সুইট বাবা।

—আমি আর তোর মা আজ তোকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাব।

—ওহ্, বাঘ-ভাল্লুক, বাঘ-ভাল্লুক…কখন যাবা, বাবা?

—বিকেলে। রোদ পড়ুক।

—আমি বাঘ আর সিংহ দেখব। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব।

—ভয় করবে না?

—একটুও না। তুমি না বলো আমি খুব সাহসী মেয়ে?

—হ্যাঁ, বলি তো। তুই যে টিকটিকি দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে ভাসাস না, সে জন্য বলি।

বাবার কথা শুনে ও হাততালি দিয়ে লাফালাফি করতে করতে বলেছিল, আমি একটা কাঠবিড়ালি হব। কাঠবিড়ালি। কাঠবিড়ালির মতো আমার একটা লেজ থাকবে।

হি হি করে হাসতে হাসতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছিল।

আজ রাত ওর স্মৃতির রাত হয়েছে। একে একে সব কিছু সামনে চলে আসছে। মাঝে মাঝে এমনই হয়। স্মৃতি ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর মনে হয়, ও তখন মেঘের ভেলায় ভাসে। ওর কণ্ঠে গান ছড়ায়—নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা…। স্মৃতি ওর সাদা মেঘের ভেলা। গভীর আনন্দের সময়।

ওর বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল।

বাবার দিকে তাকিয়ে অনবরত নিজেকে চোখের জলে ভাসিয়েছে। বাবা ওর চোখের জল মুছিয়ে বলেছে, তোকে ছেড়ে যাওয়া আমার জন্য খুব কষ্টের রে, মা! তোর বাবা ডাক আমার বুক ভরিয়ে দেয়। তুই আমার সোনামানিক।

এই মধ্যরাতে সোনামানিক শব্দ ঝনঝন করে বাজে। বাজতে বাজতে ঘুঙুর হয়ে যায়। ছোটবেলায় বৈশাখী মেলায় গেলে ঘুঙুর কিনে দিত মা। বাড়িতে ফিরলে বাবা বলত, আয় তোর পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দিই। তুই যতক্ষণ ঘুঙুর বাজিয়ে হাঁটবি, আমি ভাবব আমার ঘরে পরি নাচছে।

ও খুব মজা পেত। ঘুঙুর পায়ে নাচতে নাচতে বলত, আমি পরি হয়েছি। পরি, পরি। বাবার ডানায় চড়ে আমি আকাশে যাব।

মা বলত, আমি কোথায় যাব?

—তুমি কোথাও যাবে না। এই ঘরে থাকবে। আমি এসে তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ব।

—পাক্কু বুড়ি একটা।

মা হাসতে হাসতে আদর করত।

এভাবে কত দিন কত রাত কেটেছে! শৈশব পেরিয়েছে, কৈশোর পেরিয়েছে। তরুণ বয়সেরও কত স্মৃতি! চাচাতো ভাই-বোনেরা ওকে হিংসা করত। এমন আদর-সোহাগে বড় হওয়া ওরা সহ্য করতে পারত না। কেউ কেউ মুখ বাঁকাত। কেউ সরাসরি খোঁচা দিয়ে কথা বলত।

—পথের মেয়ের আবার আদরের ঢং।

এসব কথা শুনলে ও চিৎকার করে কাঁদত। রেগে যেত ওর মা। ওদের বকাবকি করত। ধমক দিত। বলত, আর এক দিন এমন কথা বললে দাঁত ফেলে দেব।

মায়ের বকাবকিতে এই পর্বটি কিশোরকালেই শেষ হয়ে গেছে, কেউ ওকে আর বেশি ঘাঁটায়নি। নিজেও প্রতিজ্ঞা করেছিল, নিজের জন্ম নিয়ে ভাববে না। মনেই আনবে না। যে মেয়ের ভাগ্যে এমন মা-বাবা থাকে, তার আবার দুঃখ কী? কিন্তু মানা যায় না। জীবনগাছের শিকড়ে আটকে যাওয়া পরগাছাটি উপড়ে ফেলা কঠিন। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ ফুরায় না। কিন্নরী চেয়ারে মাথা হেলান দেয়। চোখ বুজে আসে। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।

মা-বাবা মৃত্যুর আগে বাড়ি-টাকা যা ছিল ওর নামে লিখে দিয়ে গেছে। এত কিছু পাওয়ার পরে শুধু একটি জাউরা শব্দ কেন ওকে কাঁদায়? জন্মের ওইটুকুই কি বড় হিসাব? যে কারণে প্রেমের জন্য বেছে নিল মাহবুবকে? যে মাহবুব প্রেম কী বলে প্রশ্ন করে।

ও মাথা সোজা করে হাতে রাখা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়।

ভূমিকাটা ও আগেও পড়েছে। অটিজম বর্ণনা করার বিষয়টি লেখক চমৎকারভাবে এনেছেন। অটিজম বিষয়টি তার প্রথম জানা হয় সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করার সময়। এক জায়গায় লিখেছেন, ১৯৪৩ সালে একজন ডাক্তার খেয়াল করেছিলেন যে তাঁর শিশু-রোগীদের মধ্যে এগারোজন নিজেদের মধ্যে বাস করে। তাদের চারপাশে থাকা অন্যদের তারা গুরুত্বই দেয় না। তাদের চারপাশে কেউ আছে, এটা তারা মনেই করে না। ছোট্ট একটি জিনিস নিয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেতে থাকতে পারে, কিন্তু সেসব জিনিসের সামান্য নড়চড়ে তারা অস্থির হয়ে যায়। মানতেই পারে না যে নিজের প্রিয় খেলনাটি জায়গা বদল করে রাখা হয়েছে। শিশু বিশেষজ্ঞ সেই ডাক্তার আরো অনেক কিছু বর্ণনা করেছিলেন। তার সব কিছু ধারণ করা কিন্নরীর জন্য কষ্ট হয়ে যায়। ও আবার বইয়ের পৃষ্ঠা বন্ধ করে চোখ বোজে। যে ডাক্তার তাঁর এগারোজন শিশু-রোগীকে এমন অবস্থায় দেখেছিলেন, তিনি এই অসুখের নাম দিয়েছিলেন সেলফ, অটোস। শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে নেওয়া। এর দ্বারা বুঝিয়েছিলেন, দে সিমড হ্যাপিয়েস্ট ইন আইসোলেশন।

কিন্নরী মাথা সোজা করে। ও দেখেছে, মাহবুব একা থাকতে চায়, কিন্তু মানুষকে একদম বাদ দিয়ে নয়। ওর মা কুহুকে বলেছে, ছেলেটা এই দিক থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। এর জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক দৌড়িয়েছি একে নিয়ে। ডাক্তারদের একটি কথাও মাটিতে ফেলিনি। এ জন্য ছেলেটা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছে।

মায়ের কণ্ঠস্বরের মাঝে কিন্নরী বাতি বন্ধ করে বিছানায় আসে। ওর মনে হয়, মায়ের কণ্ঠস্বর এখনো ওর দুকান দিয়ে ঢুকছে। মাঝে মাঝে ওর এমন অনুভব হয় যে ও নিজেও কি মাহবুবের মতো? পুরোটা না হোক, খানিকটুকু? নইলে কেন মনে হবে যে মায়ের কণ্ঠস্বর এই ঘরে আছে। চার দেয়ালের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর কানে ঢুকে যাচ্ছে এবং ও নিজেকে সামলাতে পারছে না! কিন্নরী কপালে হাত রাখে। খোলা জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস আসছে। জানালার পর্দা নড়ছে। ওর চোখ বুজতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেদিকে তাকাচ্ছে তার সব কিছুই এলোমেলো লাগছে। আবারও ভাবে, ওর নিজের ভেতরেও কি মদাক্রান্তা অটিজম আছে? যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া হয়? কিন্নরীর চোখের পানি গড়াতে থাকে। ও বাধা দেয় না। মোছেও না। চোখের পানিতে বালিশে একটা নদী তৈরি হয় যাক।

মাত্র গতকাল তন্বী ওকে বলেছিল, তুই নিজের জন্য যে ছক তৈরি করেছিস, এটা ঠিক হয়নি। কেন তোর মাহবুবকে পছন্দ? মনে হয় কেন তুই পর্বত অভিযানে যাচ্ছিস?

—তোর এত জিজ্ঞাসার উত্তর নেই আমার কাছে। শুধু এটুকু জানি, আমি নিজেকে আড়াল করে বেঁচে থাকার জায়গা খুঁজছি।

—বোগাস। যত্ত সব বাজে ভাবনা।

তন্বী খিস্তি করে। রাগ প্রকাশ পায়। কিন্নরী তন্বীর খিস্তি পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করে বলতে থাকে, যত দিন মা-বাবার সঙ্গে ছিলাম, তত দিন বেঁচে থাকা এক রকম ছিল। এখন মনে হয় বেঁচে থাকার জোড়াতালি দেওয়া শুরু হয়েছে।

—হবেই তো। এখন জোড় বাঁধার জন্য মানুষ খুঁজতে হবে। তুই তো খুঁজছিস। খুঁজছিস না?

কিন্নরী ওর দিকে তাকায় না। কথার উত্তর দেয় না। তন্বী নিজেই বলতে থাকে, মা-বাবার সঙ্গে আমাদের বড় হওয়া। আর বড় হয়ে বিয়ে-সংসারের মধ্যে ঘটে বিস্তার। তাই না?

—আমি জানি না।

রুক্ষ কণ্ঠ কিন্নরীর। মা-বাবা বেঁচে থাকলে আমি আর জীবন খুঁজতাম না। যে জীবন তাদের সঙ্গে, সে জীবনই কাটিয়ে দিতাম।

এটুকু ভাবতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে কিন্নরী। বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে সামলায় ও। মাথার ওপর মায়ের হাত টের পায়।

—কাঁদিস না, কুহু। তুই কাঁদলে আমাদের বুক ভেঙে যায়।

—মাগো, কাঁদা ছাড়া আমার আর কী আছে? তোমরাও কত তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। তুমি নাই, বাবা নাই, আমার আর কেউ নাই।

—আহ্ কুহু, কাঁদিস না, মা। তোর চারপাশে সবাই আছে। কেউ তোকে ছেড়ে যায়নি। শুধু মাহবুবকে নিজের সঙ্গে না জড়ালে পারতি…

—তুমি তো সবই জানো, মা। মাহবুব ছাড়া আর কেউ কি আমাকে জন্মের জন্য রেহাই দেবে? এত বড় কলজে নিয়ে কেউ জন্মায়নি, মাগো।

কিন্নরী মায়ের কণ্ঠ আর শুনতে পায় না। বুঝতে পারে, মায়ের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বড় হওয়ার পরে মা যেদিন ওকে সত্যি ঘটনাটি বলেছিল, সেদিন কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল মা। বাবাও কেঁদেছিল। তারপর চোখের পানি মুছে বলেছিল, তোর এমন জন্ম হয়েছিল বলেই তো তুই আমাদের চোখের মানিক হয়েছিস। নইলে আমরা কি তোকে পেতাম! এসব নিয়ে একটুও মন খারাপ করবি না। তোর মুখে যেন আর কোনো দিন এসব কথা না শুনি।

মা-বাবা বেঁচে থাকতে এসব কথা আর ওঠেনি। নিজে শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। চাচাতো বোন নেলি ওকে সহ্য করতে পারত না। খোঁচা মেরে বলত, ও তো একটা ডাস্টবিনের মেয়ে।

হঠাৎ করে ওর এমন ডাক শুনলে ভীষণ রেগে যেত জুলেখা। বকাবকি করে আস্ত রাখত না নেলিকে। বলত, আর এক দিন এ কথা বললে তোকে আমি আস্তাকুঁড়ের মেয়ে ডাকব।

—কেন? কেন ডাকবেন? আমি তো আস্তাকুঁড়ের মেয়ে না। আমার মা আমাকে কুড়িয়ে আনেনি। আমার হাসপাতালে জন্ম হয়েছে।

—যেখানে খুশি সেখানে তোর জন্ম হোক। তুই ছোটলোকের মতো কথা বলিস। মানুষ মানুষকে কি এমন করে কথা বলে? বল, আর বলবি না? বল?

—বলব, বলব, বলে নেলি দৌড়ে পালাত।

তার পর থেকে অবশ্য সবার সামনে না বলে আড়ালে বলত। কিন্নরীকে হেয় করার জন্য ও মুখিয়ে থাকত। প্রায়ই বলত, ডাস্টবিনের মেয়ে দালানে উঠেছে।

এসব শুনে কিন্নরী হজমই করেছে। কখনো মারামারি করেনি। এ জন্য নেলির খোঁচা বেশি দূর এগোত না। কিন্নরী রাগ দেখিয়ে রুখে দাঁড়ায়নি বলে সেটা কোনো ঝগড়ার সৃষ্টি করেনি। ও শুধু তাকিয়ে দেখেছে নেলির ক্রোধের দৃষ্টি।

একদিন প্রশ্ন করেছিল, নেলি আপু, তুমি আমার সঙ্গে এমন করো কেন?

—তুই একটা রাস্তার আবর্জনা। মরতে পারলি না?

—আমি কি বাঁচতে চেয়েছিলাম? বাঁচা-মরার আমি কিছু বুঝতাম?

—বাঁচতে তো চেয়েছিলি, নইলে চিৎকার করে কেঁদেছিলি কেন? সে জন্যই তো তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।

—নিয়ে গিয়েছিল কেন? না নিলেই তো পারত। তাহলে তো আমি মরে পড়ে থাকতাম। শিয়াল এসে আমাকে খেয়ে ফেলত।

—আবার বড় বড় কথা। চুপ কর।

—তাহলে তুমি আমাকে মেরে ফেলো।

কিন্নরী মাথা নিচু করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নেলি ওকে এক ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, ভাগ।

এভাবেও দিন গড়িয়েছে ওর। যেসব দিনের মতো ছিল না। মা-বাবার স্নেহের আড়ালে তাড়া খাওয়া দিন ছিল। সেসবও পার করেছে। নিজেকে গড়েছে। পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে। নিরিবিলি জীবনের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। এ জীবন তো এভাবেই কেটে যেতে পারে। আর কাউকে দরকার কেন?

এমন কথা মায়ের সামনে বললে মা কষে ধমক দিত।

—খবরদার, এমন চিন্তা মাথায়ও আনবি না। তোর সংসার লাগবে, সন্তান লাগবে।

—মাগো, কে আমাকে সহ্য করবে?

—তুই মা-বাবা পাসনি?

—পেয়েছি। এত আদর-সোহাগ আমাকে নিজের মাও দিতে পারত না।

—মা-বাবা যখন পেয়েছিস, তখন স্বামীও পাবি। নিজে বাড়াবাড়ি করবি না।

—দুনিয়া কি এত সোজা, মাগো? নেলি বুবুর মতো কেউ কেউ আছে না…

—আয়।

মা ওকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিত। অনেকক্ষণ ধরে রাখত বুকের মাঝে। সে যে কী রকম শান্তির জায়গা ছিল!

—কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে তোমরা?

আবার ডুকরে কাঁদে কিন্নরী। বাতি বন্ধ করে দেয়। অন্ধকার ঘুটঘুটে নয়। রাস্তার বাতির আলো আসছে ঝাপসা হয়ে। যেন আলো-আঁধারির চমৎকার বুনন। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে ও। এই মুহূর্তে বালিশটা মায়ের বুকের আশ্রয়ের মতো। আস্তে আস্তে নিঃশব্দ হয়ে যায় চারদিক। ঘুম আসে ওর।

তিন.

সকালে ঘুম ভাঙে মাহবুবের।

আজ অফিস ছুটি। প্রথমেই এমন একটি চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ভাবে, আজ লালদিয়ার চরে যাবে। সারা দিন জেলেদের সঙ্গে থাকবে। এমন ভাবনা নিয়ে বিছানা ছাড়ে। বাইরে আসে।

খোলা প্রান্তরের চারদিকে আলোর ঝলকানি। পুব আকাশ লাল হয়ে আছে।

—বাহ্, সুন্দর।

খুশিতে উচ্ছল হয়ে হাততালি দেয় মাহবুব। ঘরের চারপাশ ঘুরে বেড়ায়। পোকা খোঁজে। ফুল দেখে। কেটে যায় সময়।

অল্পক্ষণে দেখতে পায় ফুলমেহেরের হাত ধরে অরূপ আসছে। ফুলমেহের সারা দিনে একবার এসে ওকে দেখে যায়। পা খুঁড়িয়ে হাঁটে মেয়েটি। তার পরও না এসে পারে না। এসেই বলে, তুমি কী করছ, চিংড়িপোনা? ভাত খেয়েছ?

অরূপের সঙ্গে একে দেখে কয়েক পা এগিয়ে যায় মাহবুব। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, তুমি ওকে কোথায় পেলে, অরূপ?

—রাস্তার ধারে বসে কাঁদছিল। আমি বললাম, আয় আমার সঙ্গে। যখন বললাম তোমার কাছে যাব, তখন লাফিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ যাব।

—কাঁদছিলি কেন রে, ফুলমেহের?

—খিদে পেয়েছে। রাতে ভাত খাইনি।

—আয়, ভাত খাবি। হাঁড়িতে যা ভাত-তরকারি আছে সব তোর। খেয়ে নে।

মাহবুবের হাত ধরে ও ঘরে ঢোকে। মাহবুব ওর মাথায় হাত রেখে বলে, তোর যেভাবে খুশি সেভাবে খাবি। আমার কথা মনে রাখতে হবে না।

ও খুশিতে মাথা ঝাঁকায়। ওর এলোমেলো চুলে ঝড় ওঠে। ঘরের কোণ থেকে দবিরের জন্য রাখা থালাটা নিয়ে হাঁড়ি থেকে ভাত ওঠায়। পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে মনোযোগ দিয়ে ভাত খায়। মাহবুব একমুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে বাইরে আসে। অরূপ খালের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। মাহবুবের মনে হয়, ওকে একটি শুকনো মরা খেজুরগাছের মতো লাগছে। চারদিকের এত উজ্জ্বল আলোয় ও একটা…

মাহবুব কিছু ভাবার আগেই অরূপ মুখ ফেরায়। ওকে খুব বিষণ্ন ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বোঝা যায় রাতে ঘুম হয়নি।

—আমি জানি তুমি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছ।

—তোমাকে দেখছিলাম।

—সেটা আমার সবটুকু দেখা নয়।

—এখন সবটুকু দেখা হয়েছে। মুখ দেখতে পাচ্ছি।

—আমার কোনো খবর নাই, মাহবুব। আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে খুঁজছে। হদিস নাই। শয়তানের বাড়িতে লোক গেছে। ওরা বলে আমরা কিছু জানি না।

—ওরা তো এমন কথাই বলবে। শেষ ভরসা পুলিশ। ওরাই খুঁজে বের করবে।

—কে জানে সেটা কত দিন!

—হতে পারে তোমার এক জীবনের আয়ু।

হা হা করে হাসে মাহবুব। হাসির শব্দ ছোটে চারদিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফুলমেহের। অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। ছুটে এসে মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে বলে, হাসছ কেন, চিংড়িপোনা? তোমার কিসের খুশি লেগেছে?

—খুশি! মাহবুব হকচকিয়ে যায়। খুশি কোথায়? একজন মেয়ে হারানো বাবা তার সামনে; একটি মেয়ে তার সামনে, যার মা নেই, যে খুঁড়িয়ে হাঁটে—তার পরও খুশি?

ওকে চুপ থাকতে দেখে ফুলমেহের আবার বলে, তোমার কিসের খুশি, চিংড়িপোনা?

—আমার কোনো খুশি নাই।

—তাহলে তুমি হাসছ কেন?

—হাসছি না তো, কাঁদছি।

—কাঁদছ? এটা কেমন কান্না?

—পাগলের কান্না। যাদের মাথা ঠিক থাকে না তারা এমন করে কাঁদে।

—তোমার মাথা ঠিক নাই?

—আমার মা বলে ঠিক নাই। আমি নাকি আমার মাকে অনেক জ্বালা দিয়েছি। সে জন্য মা আমাকে খানিকটা ঠিক করতে পেরেছে।

ফুলমেহের আবার হাসতে হাসতে বলে, জ্বালা কী, চিংড়িপোনা?

—খিদে পেলে তোর যেমন কাঁদতে হয়, এটা হলো জ্বালা।

—আমার আর জ্বালা নাই। আমার খিদে মরে গেছে।

—মরে যায়নি। বল চলে গেছে। আবার আসবে।

—খিদেকে মেরে ফেলা যায় না, চিংড়িপোনা? ও আর কোনো দিন আমার কাছে আসবে না?

হা হা করে হাসে মাহবুব। ফুলমেহেরের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়।

—তুই আমার চোখের মণি। তোর সব কথায় আমার খুশি লাগে।

—খুশি খুশি বলে ফুলমেহের দৌড়ে যায় সামনে। ঘুরপাক খায়। দুহাত তুলে নাচে। লাফায়। ওর দিকে তাকিয়ে অরূপ চোখের পানি মুছে বলে, ও আমার মেয়ে। যেন।

—ও আমাদের সুখপাখি অরূপ। ওর পা কোনো দিন ঠিক হবে না। তাই ওকে আমাদের দেখেশুনে রাখতে হবে।

—কিভাবে? আমি তো ঢাকায় থাকি। তুমিই বা কত দিন এখানে থাকবে? একসময় তোমার এখানে থাকার আনন্দ ফুরিয়ে যাবে।

—ঠিক বলেছ। আমি তো আবার অন্য জায়গায় গিয়ে নিজের অস্তানা গাড়ব। দেখব নতুন জায়গা, নতুন মানুষ।

—ফুলমেহেরকে তুমি তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও, অরূপ।

—ঢাকায়?

—হ্যাঁ, ঢাকায়। ও তোমার পরিবারের একজন হবে।

—ও কি যেতে রাজি হবে?

—ওকে আমরা জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। যে মেয়েকে ভাতের জন্য কাঁদতে হয়, তার তো যাওয়াই দরকার।

—এত কিছু বোঝার বয়স কি ওর হয়েছে? ও এখানে প্রজাপতির সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। ঢাকায় ও এসব কোথায় পাবে?

—পাবে না, সেটা ঠিক।

এসব কথার মাঝে ফুলমেহের ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়। অরূপ ওর মাথায় হাত রেখে বলে, মা, তুই আমার সঙ্গে ঢাকায় যাবি?

—ঢাকা? ঢাকা আবার কী? ওইখানে হরিণ আছে? প্রজাপতি? জোনাকি পোকা? ফড়িং…

—থাম, থাম। থাম রে মেয়ে।

—থামব কেন? তোমাদের ঢাকায় এসব নেই?

—না, নেই।

—তাহলে আমি যাব না। ঢাকা একটা পচা জায়গা।

—ওখানে গেলে তোকে ভাতের জন্য কাঁদতে হবে না।

—আমি আর ভাতের জন্য কাঁদব না। আমি মুড়ি খেয়ে থাকব।

মাহবুব হা হা করে হাসে। ফুলমেহের চোখ বড় করে ওর হাসি শোনে। হাসিভরা চেহারা দেখে। দুহাতে তালি বাজিয়ে বলে, তোমার মনে অনেক খুশি, তাই না চিংড়িপোনা?

—তোর কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি রে, ফুলখুকি।

—খুশি খুশি। আমি পেট ভরে ভাত খেয়েছি। আমিও খুশি। খুশি খুশি। আমি বাড়িতে যাই।

ও কারো দিকে না তাকিয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে যায়। ওর ছোট্ট শরীর ঝোপের আড়ালে চলে গেলে দুজন দেখতে পায় দবির আসছে। দুজনই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বামন ছেলেটির হাতে পোঁটলা আছে। পিঠের দিকে কিছু একটা ঝোলানো। হাঁটার তালে ওটা দুলছে। ছোট আকারের পিঠে ওটা মানাচ্ছে না। অরূপের দিকে তাকিয়ে মাহবুব জিজ্ঞেস করে, ওকে বানরের মতো লাগছে, নাকি কচ্ছপের মতো, বলো তো?

—কী বলছ তুমি? ও বানরও না, কচ্ছপও না। তুমি তো জানো ওর মা-বাবা আমাদের মতো লম্বা। ওরা চার ভাই-বোন কেন এমন হয়েছে, এটা গাঁয়ের সবার বিস্ময়।

—হ্যাঁ, তাইতো। আমি তো ওর মা-বাবাকে চিনি।

—মানুষকে এভাবে দেখা ঠিক না।

—তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ?

—দিচ্ছি। নইলে তুমিও আমাকে বানর ভাববে, নইলে অন্য কিছু।

মাহবুব দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে, শুধু বানর না, শুয়োরও ভাবব।

—অবশ্যই ভাববে। ভেবো, আমার দুঃখ নাই। রাগও নাই। যে বাবা নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারে না, সে তো একটা শুয়োরই। আর কী? আর কী?

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অরূপ।

মাহবুব কিছু বলার আগে ছুটতে ছুটতে দবির এসে সামনে দাঁড়ায়।

—কী হয়েছে কাকুর?

কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেই বলে, বুঝেছি, সুখপাখির দুঃখ? কাকুর সঙ্গে আমি ঢাকা যাব সুখপাখিকে খুঁজতে।

অরূপ কান্না জড়ানো স্বরে বলে, কোথায় যাবি?

—ঢাকায়। ও হাতের পোঁটলা বুকে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

—আমার জন্য ঢাকা এখন ঢাকা না। ওইটা একটা শ্মশান।

মাহবুব আঁতকে উঠে বলে, শ্মশান? শ্মশান হবে কেন? তোমার মেয়ে এখনো বেঁচে আছে, অরূপ।

—খুঁজে না পেলে কেমন করে বুঝব যে বেঁচে আছে?

—চলো, ঘরে চলো। দবির আমাদের ডিম-পাউরুটি খাওয়াবে।

—সব এনেছিস তো, দবির?

—হ্যাঁ, সব। বোনের ঝুড়ির ডিম এনেছি।

—যা, ভেজে ফেল।

দবির ঘরে ঢুকে যায়। ও এখন কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে পাউরুটি সেঁকবে, ডিম ভাজি করবে। ওর ছোট বামন বোনটা মুরগি পালে। প্রতিদিনের ডিমটা ওর কাছ থেকে কেনে দবির। বলে, স্যার, বোনটাকে সাহায্য করি।

—করবি তো, এক শ বার করবি। ওর মাচার লাউ-কুমড়োও কিনে আনবি। কিছু টাকা জমানো থাকলে মনে শক্তি থাকে। সাহস থাকে।

কেরোসিনের চুলা দপ করে জ্বলে উঠলে দবির মাহবুবের শক্তি-সাহসের কথা মাথায় নিয়ে গুনগুনিয়ে গান গায়। নিজেকে বলে, আমার সাহস আছে। শক্তি আছে। আমি বামন হলে কী হবে, আমি বামন রাজা। আকাশিকে বিয়া করব। আকাশি আমার কথায় রাজি হয়েছে। ও বামন মেয়ে না। আমার চেয়ে দুই হাত বেশি লম্বা। হা হা হা।

ও হাসতে হাসতে গরম তেলে ডিম ছাড়ে। ডিম ভাজি হয়। নাশতা রেডি হয়। দুটো হাফপ্লেটে সাজিয়ে ঘরের বাইরে এলে দেখতে পায় দুজন গাছের নিচে বসে আছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তাকিয়ে আছে সামনে। ও কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মাহবুব বলে, হয়ে গেছে?

—হ্যাঁ। ঘরে আসেন।

—ঘরে না, এখানে নিয়ে আয়। হাঁড়িতে ভাত থাকলে বাটিতে নিয়ে আসিস। পাখিদের জন্য ছড়াব।

—যাই স্যার, নিয়ে আসি।

দবির চলে গেলে অরূপ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, কত দিন এই জীবন থাকবে?

—যত দিন সুখপাখিকে খুঁজে না পাবে।

মানে? কী বলছ?

—ঠিকই বলেছি। তুমি ঢাকায় যাও। খুঁজে তোলপাড় করো। যত জায়গায় যাওয়ার দরকার হয় তত জায়গায় যাও।

—হ্যাঁ, তা-ই করব। মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়ার আগে যেন আমার মরণ না হয়।

—এসো, আমরা বেঁচে থাকার জন্য খেয়ে নিই। এই নদীর ধারে আমি সুখপাখিকে খুঁজব।

—নদীর ধারে?

—ও আমার কাছে পাখি তো। উড়ে আসতে পারে? কিচকিচ করে আমাকে ডাকতে পারে?

অরূপ চোখের পানির সঙ্গে পাউরুটি-ডিম মুখে পোরে। মুখ নিচু করে শেষ করে প্লেটের খাবার। কলার খোসা ছাড়াতে গিয়ে দেখতে পায়, মাহবুবও প্লেটের ওপর দৃষ্টি রেখে খাচ্ছে। দুজনের আকাঙ্ক্ষাই এখন বেঁচে থাকার শক্তি খোঁজা।

দবির ছোট এক বাটি ভাত নিয়ে এলে মাহবুব বাটি নিয়ে খালের ধারে যায়। ভাত ছিটায়। উড়ে আসে শালিক। চড়াই। মাহবুব জানে, হয়তো কাক আসবে পরে। আর কোনো পাখি আসবে না। ঘাসের ভেতর থেকে পোকা বের হবে। পিঁপড়া বের হবে। ভাত খুঁজে খাবে ওরা সব খুদেরা। ভাতগুলো এক জায়গায় ঢেলে দিয়ে ফিরে আসে মাহবুব। অরূপ বলে, চলো তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাব। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে। আমার বউও।

—তোমার মা আর সুখপাখির মা—দুই মা। ঠিক আছে, চলো। আমার মাকেও আমার সঙ্গে রাখছি।

মাহবুবের হাত চেপে ধরে অরূপ বলে, তুমি আমার সত্যিকারের বন্ধু। কতজনকেই তো বন্ধু করি, কিন্তু আপন কেউ হয় না। মনের টানের দূরত্ব থাকে।

হা হা করে হাসে মাহবুব। হাসতে হাসতে বলে, দেখো বনের ভেতর হরিণ দৌড়াচ্ছে।

—ছোটবেলা থেকেই এসব আমার দেখা, বন্ধু।

—আজ অন্য রকম করে দেখতে হবে। কারণ আমি তোমার সঙ্গে হাঁটছি। এত দিন তো তুমি আমার সঙ্গে হাঁটোনি।

—তাইতো। আমার চেনা জায়গাকে আমার নতুন করে দেখতে হবে। আমার সুখপাখি নাই, তাই ঢাকা শহর তো আমার কাছে শ্মশান। হরিণঘাটায় তুমি আছ, তাই হরিণঘাটা আমার সুখের স্মৃতি।

মাহবুব হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। হাসতে হাসতে দুজন খালের সেতুর ওপরে যায়। একটু দাঁড়ায়। দেখতে পায় জোয়ার আসছে। ভরে উঠছে খাল।

—এখানে আসার পরে আমি জোয়ার-ভাটা বুঝতে শিখেছি। আর কোথাও এমন করে জোয়ার-ভাটা দেখিনি। পাখি দেখেছি অনেক জায়গায়। হরিণ-বানর দেখেছি।

—তার পরও তো এই জায়গাটা নতুন তোমার কাছে।

—হ্যাঁ, তা সত্যি।

দুজন হাঁটতে হাঁটতে ছাড়িয়ে আসে বন। লোকালয়ে ঢোকে।

—কোথাও কিছু হচ্ছে। হৈচৈ শুনতে পাচ্ছি।

—সামনে বাজার তো, কিছু হতে পারে। মানুষের স্বভাব তো কোনো ছোট ছুতো ধরে বড় গোল বাধানো।

—চলো দেখি।

ওরা একটু দূর থেকেই দেখতে পায় আমগাছের নিচে পড়ে আছে একটি ছেলে। মাথা থেঁতলানো। চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে।

—ছেলেটা না হয় একটু দুষ্টুমি করত। তাই বলে এভাবে মারতে হবে?

—আহা রে, এত ছোট একটা ছেলে!

—কাকে কী করেছিল?

—চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল হানিফ। ওর গায়ে গরম পানি ছিটিয়েছিল।

—হানিফ রেগে গিয়ে ওকে টানতে টানতে এই দিকে নিয়ে এসেছে।

—আমরা ভেবেছি দু-চারটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেবে…

—মাগো, ও একটা খুন করতে পারল? মাগো…

কেউ একজন ককিয়ে কেঁদে ওঠে।

বাজারে ঘোরাফেরা করা ছোট ছেলে-মেয়েরা চিৎকার করে কাঁদছে।

আবার কেউ উচ্চ স্বরে চেঁচায়, শুয়োরের বাচ্চা নিজে একটা শয়তান। সে আবার এইটুকু ছেলের দুষ্টামি সহ্য করে না।

—ও তো অস্ত্র মামলায় জেল খেটেছে।

—মাদক ব্যবসায় জড়িত।

—ওর গুণ্ডামির শেষ নাই।

তখন পুলিশ আসে। হুইসলের শব্দ কাঁপিয়ে তোলে এলাকা। যা যা করার সব করে। হাসপাতালে লাশ পাঠায়। ছেলেটির মা-বাবাকে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যায়। কান্নার রেশ লেগে থাকে সবার কানে।

মাহবুব বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন দূর-এলাকায় এসে এমন একটি দৃশ্য দেখা ওর জীবনের বিরল ঘটনা। অরূপ আস্তে করে বলে, চলো যাই।

—কোথায়?

—আমার মায়ের কাছে। মায়ের কাছে যাওয়ার সময় এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হতে হয় নাকি?

—হয় না। হওয়া উচিত না। তার পরও হতে হয়। আমাদের ভাগ্যই এমন।

—আমাদের সামনে আরেকটি বড় ঘটনা আছে।

—আমি কালকে ঢাকায় যাব। তোমাকে বলা হয়নি যে আমি আর আমার বউ দুজনে চাকরি করি।

—কোথায়?

—ঢাকার একটি হাসপাতালে। আমার বউ নার্স। আমি ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট।

—আমাদের সামনে আরেকটি বড় ঘটনা আছে।

—ঘটনা? কী ঘটনা?

—সুখপাখি।

—তুমি কি মনে করো আমি ওকে খুঁজে পাব?

—পাবে।

—কোথায়?

—জানি না। চলো, মায়ের কাছে যাই।

অরূপকে ছাড়িয়ে মাহবুব কয়েক পা সামনে এগিয়ে যায়। বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে অরূপ ওকে ডাকে। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে কথা বলছে। কেউ ওকে সালাম দেয়। জিজ্ঞেস করে, স্যার, ভালো আছেন?

—ভালো নেই তো। এমন খুনের ঘটনা দেখলে কেউ ভালো থাকে? আজকে তোমরা কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করবে না যে ভালো আছে কি না। আজ আমাদের সবার খারাপ থাকার দিন।

—ছেলেটা নিজেই একটা বখাটে, স্যার। পালিয়েছে। বোধ হয় বনের মধ্য দিয়ে কোথাও চলে গেছে। তবে ধরা ওকে পড়তেই হবে। কত দিন লুকিয়ে থাকবে।

—ঠিক। পুলিশের পাশাপাশি তোমরা যদি ছেলেটাকে খোঁজো…

—আমরা সবাই খুঁজব।

জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা হাত তোলে। মাহবুব নিজেও বলে, আমিও খুঁজব। আমি তো বনের ধারে থাকি। আমি ঠিকই ওকে দেখতে পাব।

—ঠিক স্যার, ঠিক। আমরা সবাই মিলে ওকে খুঁজব। একটা বোবা ছেলেকে কেউ এভাবে মারে?

—বোবা ছেলে?

—হ্যাঁ, স্যার। ও কথা বলতে পারত না। কত আর বয়স হবে? ছয়-সাত বছর। বাজারে, পথেঘাটে ঘুরে বেড়াত। দুষ্টুমি করত। ছোটদের সঙ্গে মারামারি করত।

—আহা রে, ছেলেটা! গাঁয়ের সবাই ওকে চিনত বোবা ছেলে বলে। সবাই ওকে ডাকত বোবা বিচ্ছু বলে।

—থাক, ওর কথা আমি আর শুনতে চাই না। অরূপ ওর হাত ধরে টেনে বলে, চলো।

—কোন দিকে?

—আবার পেছন দিকে গিয়ে ডানের রাস্তা।

—আগে বলোনি কেন?

—তুমি যেভাবে হাঁটছিলে, আমি বাধা দিতে চাইনি। তুমি বলেছ, তুমি বিভিন্ন রাস্তায় হাঁটতে ভালোবাসো।

—হ্যাঁ, তা বাসি। নতুন রাস্তায় যেতে আমার আনন্দ হয়।

কথা বলতে বলতে ওরা অরূপের বাড়ির সামনে আসে। বাড়ির সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অরূপের মা বিভাবতী আঁচলে চোখ মোছে। কাছে গিয়ে অরূপ বলে, মাগো, ও মাহবুব।

মাহবুব সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে বলে, ছেলে মায়ের কাছে এসেছে।

—ছেলে তো মায়ের কাছেই আসবে। আসো বাবা, ঘরে আসো। এই আমার বউমা, মায়া।

—সুখপাখির মা?

—হ্যাঁ, আমি সুখপাখির মা।

সুখপাখির নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ওঠে মায়া। আঁচলে চোখ মুছে ঘরে ঢুকে যায়। মাহবুব পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী?

—ফুলকলি।

—বাহ্, সুন্দর নাম।

বিভাবতী বলে, দুই মেয়ের নাম ওদের বাবা রেখেছে। চলো ঘরে যাই।

ঘরে ঢুকে মোড়া টেনে বসে বিভাবতী। আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আবারও চোখ মুছে বলে, আমার দুই ছেলে-মেয়ে। অরূপ বড়। কাজল ছোট। কাজলের বিয়ে হয়েছে। ও বরিশালে থাকে। ওর স্বামী প্রেসে কাজ করে। মেয়েটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। ওদের একটা ছেলে। তিন বছর বয়স হয়েছে।

মাহবুব চুপ করে বিভাবতীর কথা শোনে। ভাবে, ওর মা কি কখনো এমন করে ছেলে-মেয়েদের গল্প করে? খুঁটিনাটি সব কিছু বলে কি? বলে বলে—ও নিজেই সিদ্ধান্তে আসে।

আমার মেয়েটা ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিল। ওর নামে অনেক নালিশ আসত।

—আপনি কি ওকে মারতেন?

—সব সময় মারিনি। মাঝেমধ্যে বকাঝকা করেছি। দু-চারটে থাপ্পড় দিয়েছি।

—ও কাঁদত?

—না, একদম কাঁদত না। খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড় দিত। আমাকে ভেংচি কাটত।

—এখনো এমন দুষ্টু?

—এখন কি আর এমন থাকবে? বড় হতে হতে দুষ্টুমি কমে গিয়েছিল। পড়ালেখায় ওর মেধা ভালো ছিল।

—ভাগ্যিস ওকে কেউ মেরে ফেলেনি!

—কী বললে? বিভাবতী চোখ বড় করে তাকায়।

—দুষ্টুমির জন্য আজকের ঘটনাটি যেমন ঘটল…

অরূপ চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে, আমার সুখপাখি দুষ্টুমি করত না।

—সুখপাখির সঙ্গে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসীরা সুখপাখির সঙ্গে শয়তানি করেছে। ওরা সুখপাখিকে জ্বালিয়েছে।

বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। কাঁদে অরূপ। কাঁদে বিভাবতী। রান্নাঘরে বসে চিৎকার করে ওঠে মায়া। নিজের বিছানায় হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে ফুলকলি।

কান্নার প্রবল শব্দ বুকের ভেতর ঢুকতে থাকলে মাহবুব নিজেও চিৎকার করে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে ওর মনে হয়, কোনো দিন ও এমন করে কাঁদেনি।

ওর কান্না শুনে হকচকিয়ে যায় অরূপ। দুই হাতে চোখ মুছতে মুছতে ভাবে, ওকে থামাবে। পরে মনে করে, না থাক, ও কাঁদুক। ওর কান্নায় আপনজনের ছোঁয়া আছে।

ওকে কাঁদতে দেখে হেঁচকি তুলে থেমে যায় বিভাবতী। তাকিয়ে থাকে মাহবুবের দিকে। ও দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। ওর মাথা ভর্তি চুল কপালের ওপর নেমে আসছে। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। চুলভর্তি মাথাটা দুলছে।

ওর কান্না শুনে চোখভরা দৃষ্টিতে চুলোর আগুনের দিকে তাকায় মায়া। শুকনো কাঠ দাউদাউ জ্বলছে না! নিভু নিভু আগুনে চুলোয় বসানো চায়ের পানি ফুটছে। মায়া মাহবুবের জন্য চা বানাতে এসেছিল। ও হাঁটুর ওপর থুঁতনি রেখে মাহবুবের কান্না শোনে।

ফুলকলি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে কাঁদছিল। গড়াচ্ছিল বিছানার ওপর। মাহবুবের কান্না শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর দুকানে কান্নার শব্দ আছড়ে পড়ে। তারপর বিছানায় বসে দুহাতে কান চেপে ধরে।

একসময় ছুটে আসে মাহবুবের কাছে। ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেয়। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, কাঁদে না, সোনাবাবু। কাঁদে না।

নিজের হাতে মাহবুবের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, সুখপাখি দিদি হারিয়ে গেছে। আমরা ওকে খুঁজে পাব।

—হ্যাঁ, ঠিক। আমরা ওকে খুঁজে পাব।

—ঠিক বলেছ। ঠিক বলেছ। আমি আর কাঁদব না।

—আয় মা, আমার বুকে আয়।

অরূপ হাত বাড়িয়ে দিলে ফুলকলি বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিভাবতী নিজের মোড়াটা এনে মাহবুবের পাশে এসে বসে। ওর হাত ধরে বলে, ছেলে মায়ের কাছে এলে মায়ের খালি বুক পূরণ হয়।

—মা, মাগো।

মাহবুব মাটিতে বসে বিভাবতীর কোলে মাথা রাখে। অরূপের মনে হয়, মেয়ে হারানোর পরে এই প্রথম ও একটি সুন্দর দৃশ্য দেখল। জগৎ-সংসারে এমন সুন্দর দৃশ্য একবারই দেখা হয়।

মায়ের কোলে মাথা রেখে কতক্ষণ বসে থেকেছে, সে সময়ের হিসাব করতে চায় না মাহবুব। আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় হরিণঘাটার দিনগুলো ভরে ওঠে। এ যেন মহাকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তির সময়।

একসময় মাথা তুলে বলে, মা, আপনার চোখের পানি আমি বুকে নিলাম। আজ যাই। আমিও সুখপাখিকে খুঁজব।

অরূপ জিজ্ঞেস করে, কোথায় খুঁজবে?

—এই হরিণঘাটায়। রাস্তায়, বাজারে, বনে, খালে, নদীতে, সাগরের মোহনায়।

—সাগরের মোহনায়? অরূপ গলা খেঁকিয়ে বলে, তুমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসো। তোমার চিন্তার ঠিকানা নাই।

—আচ্ছা, আসি।

অরূপ এগিয়ে দিতে চাইলে হাত বাড়িয়ে বাধা দেয়। বলে, আমার সঙ্গে আসতে হবে না। তুমি মায়ের কাছে থাকো।

—আপনার জন্য চা বানিয়েছি। পুলি পিঠা আছে।

—পুলি পিঠা? খাব।

মায়ার হাতে ধরে রাখা পিরিচ থেকে সবগুলো পিঠা উঠিয়ে নিয়ে বলে, খেতে খেতে যাই। ছোটবেলায় আমি হাঁটতে হাঁটতে এটা-ওটা খেতাম। বসে খেতাম না বলে মায়ের অনেক বকা শুনেছি। গেলাম।

—আবার আসিস, বাবা। বিভাবতী পেছন থেকে বলে। মাহবুব পেছন ফেরে না। পিঠা মুখে পোরে। গাছের মাথায় তাকায়। প্রবল শব্দে কাক ডাকছে। নানা দিক থেকে উড়ে আসছে কাক। চারদিকে কা কা শব্দ ওর কানে মধুর সংগীতের মতো লাগছে। ও গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মহা আনন্দে পিঠা খায়। মুঠি করে ধরে রাখা পিঠাগুলো শেষ হয়ে গেলে ওর মনে হয়, কান্নার শব্দও আশ্চর্য সুন্দর। সেই শব্দও মধুর সংগীতের মতো। ও দুহাত ওপরে তুলে নাচের ভঙ্গি করে। আশপাশ দিয়ে চলে যাওয়া লোকেরা ঘুরে ঘুরে তাকায়। কেউ কেউ বিড়বিড়িয়ে বলে, লোকটা পাগল নাকি! মাহবুব কারো দিকে তাকায় না। নিজের ভেতর মগ্ন হয়ে থাকে।

একসময় হাঁটতে শুরু করলে দূর থেকেই দেখতে পায় দবিরকে। বামন ছেলেটি সেই আমগাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে গাছের চারদিকে ঘুরছে। ওর কাছাকাছি এলে মাহবুবের মনে হয়, চারদিকে কান্নার রোল, কিন্তু শব্দে কোনো সংগীত নেই। অরূপের মায়ের বাড়ি থেকে এই গাছতলা পর্যন্ত কেবলই হাহাকারের ধ্বনি। মাহবুবের চোখ ভিজে যায়। ওর মনে হয়, ও নিজেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।

মাহবুবকে দেখে দবির দৌড় দিয়ে কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, টিপু আমার চাচাতো ভাই। ও একটা বোবা।

মাহবুব ওর দুহাত ধরে। গাছের কাছ থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

—ওকে তো আমি বাজারে, রাস্তায় দেখেছি রে, দবির। ছেলেটি কখনো আমার কাছে আসেনি। ও বোধ হয় খালের ধারে যেতে পছন্দ করত না।

—ও মানুষের সঙ্গে দুষ্টামি ভালোবাসত। ছেলে-মেয়েদের নালিশ শুনে চাচি ওকে মারত। আর ও কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসত। আমি ওকে অনেক আদর করতাম। আহা রে, আমার সোনার ভাই—

দবির কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় গাছের গোড়ায়, যেখানে রক্ত জমাট হয়ে আছে। চিকন সরু রেখায় চারপাশে গড়িয়ে ঘাসের সঙ্গে মিশে গেছে। ও হাঁটুতে হাত রেখে উপুড় হয়ে থাকে সেই রক্তের ওপর। ওর ফোঁপানো কান্নার শব্দে মাহবুবের মনে হয়, বনের ভেতরের হরিণ চিৎকার করছে। ওদের পেছনে ছুটছে একটা বাঘ। ও দুহাতে ধরে দবিরকে টেনে আনে। বলে, আয়, আমরা এক কাজ করি।

—কী, স্যার?

—ইটের টুকরো দিয়ে এই রক্তের চারদিক ঘেরাও করে রাখি। এখানে যেন কেউ পা না দেয়।

—ঠিক, স্যার। আমি যাই।

ও ছোটাছুটি করে ছোট-বড় ইটের টুকরো খুঁজে আনে। দুজনে মিলে সেই টুকরোগুলো চারদিকে সাজিয়ে দেয়। গোলাকার বৃত্ত তৈরি হয়। কাজ শেষ হলে মাহবুব বলে, আরেকটা কাজ আছে, দবির।

—কী, স্যার?

—ফুল খুঁজতে হবে। ইটের পাশ দিয়ে ফুল সাজিয়ে দেব।

চারদিক থেকে ছেলে-মেয়েরা এসে জড়ো হয়েছে। বড়রাও অনেকে এসেছে। ফুলের কথা শুনে ছোটরা কলকণ্ঠে বলে, আমরা অনেক ফুল আনতে পারব। আয় সবাই।

দবির ওদের সঙ্গে যায়। অল্পক্ষণে একরাশি বুনোফুল নিয়ে হাজির হয় ওরা। ফুলে সুরভি আছে, রঙের ঔজ্জ্বল্য আছে। মাহবুব ফুল হাতে নিয়ে বলে, ছোটরা, ইটের পাশে ফুল সাজাও। আর বলো, টিপু, আমরা তোকে ভালোবাসি।

ছোটরা চারদিকে গোল হয়ে বসে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেয় টিপুর রক্ত। কেউ কেউ চোখ মুছে বলে, টিপু, তোকে আমরা মনে রাখব। তোকে আমরা ভালোবাসি।

ছোটদের কলরোলের মাঝে পুলিশের গাড়ি এসে থামে। একজন সেপাই চেঁচিয়ে বলে, এখানে সবাই জড়ো হয়েছে কেন? এখান থেকে চলে যান সবাই। এই জায়গা পুলিশের নজরদারিতে থাকবে। পুলিশের গাড়ি দেখে অনেকেই আগে সরে গেছে। ছোটরা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তখন গাড়ি থেকে নামে টিপুর বাবা আলতাফ আর মা জরিনা। কাঁদতে কাঁদতে নামছিল দুজন। ছেলের জমাট রক্তের দিকে তাকিয়ে ফুল দেখে চিৎকার করতে করতে ছুটে যায়, মোর পোলার রক্তে ফুল, ফুল। ও আল্লাহ রে…

কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে মাথা ঠোকে জরিনা।

—মা ডাহে কেডা? ও পোলা, পোলা রে…

জরিনা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়ি চলে যায় পাথরঘাটার হাসপাতালে। দবির গাড়ির পেছনে দৌড়াতে চাইলে মাহবুব ওর হাত ধরে বলে, যাস না।

ও কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে, চাচি কি মরে গেছে?

—না। অজ্ঞান হয়েছে।

—চাচিকে কোনো দিন অজ্ঞান হতে দেখিনি।

—তোর খিদে পেয়েছে, দবির?

—হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।

—আয়, তোকে চা-শিঙাড়া খাওয়াব। খাবি?

—হ্যাঁ, খাব, স্যার।

—আর কী খাবি?

—আর কিছু না।

—যদি তোর মনে হয় দোকানে যত ধরনের খাবার আছে তার থেকে…

—না না, স্যার। আমার রাক্ষসের খিদা পায়নি।

—আচ্ছা, ঠিক আছে, আয়।

দুজন চায়ের দোকানে ঢোকে। দোকানে কেউ নেই। ফাঁকা দোকানে দুজন বসে। চা বিক্রেতা ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে, কী খাইবেন, স্যার?

—ওকে জিজ্ঞেস করো।

—কী খাইবেন, দবির ভাই?

—চা আর শিঙাড়া।

—শিঙাড়া নাই। জিলাপি আছে। খাইবেন?

—স্যার জানে।

—দিমু, স্যার?

—দাও। এক প্লেট জিলাপি দাও।

—এক প্লেট না, দুইটা দাও।

—এইটুকু জিলাপি দুইটা কি খাইবেন? এক প্লেটই দিই।

—হ্যাঁ, দাও দাও। আমিও ওর সঙ্গে খাব। সঙ্গে দুকাপ চা দাও।

—স্যার, আপনি আমার সঙ্গে খাবেন?

—হ্যাঁ, খাব তো।

—আমি তো আপনার কাজ করি।

—বোকা, তাতে কী হয়েছে, আজ আমরা একজনের মৃত্যুর জমাটবাঁধা রক্তে ফুল দিয়েছি না!

আজ আমাদের রক্ত আর ফুলের দিন। আমরা সবাই এক।

দবির বেঞ্চ থেকে নেমে মাহবুবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।

—আমাকে দোয়া করেন, স্যার।

মাহবুব ওর মাথার ওপর হাত রাখে। ও তখন বলতে থাকে, রক্ত আর ফুলের দিন। রক্ত আর ফুলের দিন। স্যার, এই মাটিতে ওই শয়তানটার রক্তও ঝরবে। ওকে মরতে হবে, স্যার।

—ওর রক্তে কেউ ফুল দেবে না রে, দবির।

—থুতু দেবে।

—ঠিকই থুতু দেবে। এমনই হওয়া উচিত। কাঁদতে শুরু করে দবির।

—ও আমার বোবা ভাই, বোবা ভাই রে…

—কাঁদিস না। চোখ মুছে ফেল। আমরা পুলিশের পেছনে লেগে থাকব। যেন শয়তানটাকে ধরে। যেন ওর বিচার হয়। বিচারে ফাঁসি হয়।

—হ্যাঁ, ফাঁসি ফাঁসি।

—নে, জিলাপি খা। আর কাঁদবি না। শয়তানের ফাঁসির বিচারের জন্য কঠিন হয়ে থাকবি।

—আমাকে কাঁদতেও হবে, স্যার। টিপু তো আমার সামনে আর কোনো দিন বড় হবে না। ওইটুকু টিপু—ওইটুকু টিপু…দুষ্টামি ওর খেলা ছিল। এই বাজারে ও আর খেলবে না।

—থাম, দবির।

রেগে ওঠে মাহবুব। ধমক দিলে আকস্মিকভাবে চুপ করে যায় ও। সঙ্গে সঙ্গে একটা জিলাপি উঠিয়ে মুখে পুরে মুখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে চিবোতে থাকে। পা-ও নড়ায় না। দু-পা জড়ো করে বসে থাকে। মাহবুব নিজেও একটি জিলাপি তুলে নেয়। আস্তে আস্তে চিবোয়। দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাজারের এখানে-ওখানে মানুষের জটলা। ছোট ছেলে-মেয়েরা গাছের নিচে চুপ করে বসে আছে। গাছের ছায়ায় বসে আছে দুটো কুকুর—একটা কালো, একটা লাল রঙের। ওরা খাবার খুঁজবে কি না, এমন কোনো ভঙ্গি ওদের মধ্যে নেই। ওরা যেন এই হরিণঘাটা এলাকার বাইরে চলে গেছে। দূর থেকে দেখছে হরিণঘাটাকে। বলতে চাইছে, ভালো থাকো, হরিণঘাটা। কিন্তু বলতে পারছে না—ঘেউ করে শব্দ তুলেও না। কেমন করে বলবে, এখন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে? মাহবুবের চিৎকার করে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। উল্টো শুনতে পাচ্ছে, দবির জিলাপি চিবোতে চিবোতে গুনগুন শব্দ করছে। মনের সুখে চিবোচ্ছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। মাহবুব বুঝে যায়, গুনগুন শব্দটি ওর আনন্দের। আনন্দের ভেতর থেকে উঠে এলে শব্দের ধ্বনি এমনই অন্য রকম লাগে। প্লেটের জিলাপি শেষ হলে দবির চায়ে চুমুক দেয়। মাহবুবের চা খাওয়া শেষ হয়েছে। ও তাকিয়ে আছে দূরে। মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে বলে, ভালো থাকো, মানুষেরা। ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে, ভালো থাকো, খোকা-খুকুরা।

দবির চা শেষ করে কাপটা ঠক করে টেবিলের ওপর রাখলে দুজনই দেখতে পায়, পুলিশের গাড়ি ফিরে আসছে। জটলা করা মানুষেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। ছোটরা দৌড়াতে থাকে জিপের পেছনে পেছনে। ধুলোয় ভরে যায় ওদের শরীর। ছুটতে ছুটতে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশেছে দবিরও। গাড়ি জরিনাকে বাড়িতে নামাতে যাচ্ছে। তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে হয়নি। পথেই জ্ঞান ফিরে আসে। হাসপাতালে যাবে না বলে চেঁচামেচি করলে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে পুলিশ। মাহবুব সবার সঙ্গে মিশে জরিনার কুঁড়েঘরে আসে। তাকে ধরাধরি করে নামাতে চাইলে চেঁচিয়ে বলে, মোরে কেউ ধরবা না। মুই নিজেই নামতে পারুম। হেই পোলাডা কই, যে মোর পোলাডার রক্তে ফুল দিছে?

গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকায় জরিনা। মাহবুবকে দেখতে পায় না। ও অনেকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

আলতাফ স্ত্রীর হাত ধরে বলে, ঘরে আসো।

—পোলাডা…

—দেহি কোনহানে আছে। খুঁইজা আনুম।

—তুমি খুঁইজা আনো। মুই বারান্দায় বইয়া থাহুম।

ততক্ষণে মাহবুব এগিয়ে এসেছে। দু-চারজনকে হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে গেলে একজন বলে, আপনেরে খুঁজতাছে চাচি।

‘ও’ বলে মাহবুব শুধুই মাথা নাড়ে। সবাইকে এড়িয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, লোকের ভিড় কমলে জরিনার পাশে গিয়ে বসবে। বলবে, ভালো থেকো, মা। ভালো থাকুক তোমার উঠোন। মাটির দেয়ালের খড়ের চালের ঘর। তোমার রান্নাঘর। ছেলে হারানোর দুঃখে ভালো থেকো, মা। ভালো থেকো রক্তের ঝরনা স্রোতে। সন্ত্রাসীদের বর্বরতায়—ভালো থেকো রক্তের মাখামাখিতে—মাটির কষ্টে। গাছ-ফুল-ঘাস-ঝরাপাতার জঞ্জালে ভালো থেকো, মা।

ও তাকায় চারপাশে। একে-দুয়ে লোক কমে যাচ্ছে। জরিনা বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আলতাফ। ছোটরা উঠানে ঘোরাঘুরি করছে। একজন উঠানের লাউয়ের মাচা থেকে সাদা ফুল ছিঁড়ে এনে মাহবুবকে দিয়ে বলে, আপনের লাগি আনছি।

—কেন এনেছ?

—কানে লাগায়ে রাখো।

—কানে? কী বলছ?

হি হি করে হাসে মেয়েটি।

চারদিক থেকে ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে এসে ওকে ঘিরে ধরে বলে, চলো।

হাত ধরে টেনে বলে, চলো।

—কোথায় যাব?

—চাচিকে ফুল দেব। হাজার হাজার ফুল।

—কেন ফুল দেবে?

—জানি না।

—তাহলে আমি বলি?

—বলো, বলো।

—মাকে ফুল দিয়ে বলব, ফুলগুলো তোমার চোখের পানিতে ভিজিয়ে রাখো। মাগো, তোমার কাছে শুধু ফুলের গন্ধই থাকবে।

—আমরা যাই ফুল আনতে?

—যাও। দৌড়াও।

ছেলে-মেয়েরা চারদিকে ছুটে যায়।

মাহবুব উঠানে গিয়ে দাঁড়ালে চিৎকার করে ওঠে জরিনা।

—বাবা, মোর বাবা আইছে।

জরিনা দুহাত বাড়িয়ে বলে, আয় বাজান, মোর বুকে আয়।

মাহবুব কাছে গিয়ে বসে। জরিনার কান্নায় তখন হেঁচকি উঠছে। মাহবুব তাকে জড়িয়ে ধরে। জরিনা মাহবুবের কাঁধে মাথা ঠেকায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে, মোর বোবা পোলাডা কাউরে গালি দ্যায় নাই। খারাপ কথা কয় নাই। কার পরান এমুন পাষাণ অটল—ও আল্লাহ রে…

আবার অঝোরে চোখের পানি ঝরে। মাহবুব তাকে কাঁদতে দেয়। মনে মনে বলে, মাগো, তুমি কাঁদো। চোখের পানির ধারা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যাক।

একসময় জরিনার কান্না থামলে তার মাথা নিজের মাথার সঙ্গে চেপে ধরে বলে, মাগো, তোমার দুঃখ আমরা ফুলের মধ্যে জমা রাখব। সামনে তাকাও, মা—দেখো ওরা ফুল নিয়ে আসছে…

—ফুল? মোর কপালে কি আর ফুল থাকব…সব মরা ফুল…

—না, সব তাজা ফুল। ওই ফুলে তোমার দুঃখ চাপা দিয়ে রাখবে। খেয়াল রাখবে, দুঃখ যেন তোমাকে খেয়ে না ফেলে। দেখো, তোমার চারদিকে অনেক ফুল।

—তুমিও মোর ফুল, বাজান। তুমি মোর পোলাডারে বুকে লইয়া কবরে নামাইবা। অরে তো একটু পরে হাসপাতাল থাইকা আনব।

—মাহবুব ঘাড় নেড়ে সায় দেয়, আচ্ছা মা, আমি ওকে কবরে নামাব।

তখন ছেলে-মেয়েরা ফুল নিয়ে দৌড়ে আসে। জরিনার সামনে ফুল দিয়ে ভরিয়ে দেয়। সেই ফুলের ওপর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে জরিনা। আত্মীয়-স্বজন তাকে তুলে নিয়ে ঘরে যায়। বাতাস করে। মুখে পানির ঝাপটা দেয়। কান্নার শব্দ থেমে গেলে ঘরের চারদিক থেকে দোয়া পড়ার শব্দ শোনা যায়। বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় বসে দোয়া পড়ছে। আলতাফ মিয়া নিজে কোরআন শরিফ নিয়ে বসেছে।

মাহবুব বাইরে এসে দাঁড়ালে দেখতে পায়, পুলিশের গাড়ি আসছে। ও বুঝে যায় যে দুষ্টু বোবা ছেলের মৃতদেহ আনা হচ্ছে। ও দাঁড়িয়ে থাকলে একজন পুলিশ বলে, পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। আমরা পৌঁছে দিয়ে গেলাম।

মসজিদ থেকে খাটিয়া এনে রাখা হয়েছিল। লোকজন সেটা নিয়ে এগিয়ে এলে ছোট মানুষটিকে খাটিয়ার ওপর রাখা হয়। ওকে কাফন পরানোর জন্য বাড়ির এক কোনায় নিয়ে যায় খাটিয়া। চুলোয় গরম পানি বসানো আছে। যারা ওকে গোসল দেবে তারা আয়োজন করে।

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে মাহবুব। আকাশ দেখে। পাখি ওড়া দেখে। নিঃশ্বাসে বাতাস টানে। মনে হয় বিষখালী নদী থেকে ছুটে আসা বাতাসে কেমন একটা বাজে গন্ধ আসছে। অস্থির লাগছে ওর। বিষখালী নদীতে কি দূষণ আছে? মনে তো হয় না। তবে কেন পচা মাংসের গন্ধ আসছে? ও কান চেপে ধরে। বিড়বিড়িয়ে বলে, ভালো থাকো, বিষখালী নদী। জলের রাশি নিয়ে ছুটে যাও সাগরে। একজন এসে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার কী হয়েছে, স্যার?

—তুমি কে?

—আমি তো আপনার অফিসে চাকরি করি। আমার নাম মঈনুদ্দিন।

—তোমার নাম ছাতু! ভাগো এখান থেকে।

—আপনি রাগ করছেন কেন, স্যার?

—মারব থাপ্পড়। ভাগ।

—আপনার কি শরীর খারাপ?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ।

—কী হয়েছে?

—ক্যান্সার।

—ক্যান্সার!

অন্যরা এসে দাঁড়ায় চারপাশে। তিন-চারজন একসঙ্গে বলে, আমরা জানি আপনি সুস্থ আছেন। আপনার কী হয়েছে, স্যার? আপনি তো আমাদের এখানে ভালো আছেন।

—নদী থেকে মরা লাশের গন্ধ আসছে।

—মরা লাশ!

—লোকজন ভ্রু কুঁচকে চারদিকে তাকায়। কেউ কেউ জোরে জোরে শ্বাস টানে।

মাহবুবের মনে হয়, ওর নিজের শরীরেও পচন ধরেছে। ও এক ভয়াবহ পচন ধরা সময়ের বাতাস টেনে বেঁচে আছে। ওর বুকের ভেতর শূন্য হয়ে যায়—ওর মাথায় কিছুই নেই। মা বলেছে, শৈশবে ও এক অটিস্টিক বালক ছিল। অনেক চিকিৎসার পরে খানিকটা সুস্থ হয়েছে। কিন্নরী ওকে বলে, তুমি মাইল্ড অটিস্টিক। হা হা, আমি মাইল্ড অটিস্টিক। কিন্নরী, তুমি আসো দেশের শেষ প্রান্তে। দেখো আমাকে। আমি এখন একটি শিশুকে কবরে নামাব।

—আপনি কিছু বলছেন না যে?

—শিশুটির জানাজা হবে। চলেন, আমরা ওখানে যাই।

মাহবুব এগোলে সবাই মসজিদের দিকে যায়।

জানাজা শেষ হয়। কবর খোঁড়া হয়েছে।

দবির কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি স্যারের সাথে কবরে নামব। আমি বোবা ভাইরে কোলে নেব। ও আল্লাহ রে…

—চুপ কর, চুপ কর। বামনা পোলা একটা কবরে নামব। তোরে তুলব আবার কে?

—এভাবে কেন ওকে বকছেন? ও নামুক। সবাই মিলে ধরে ওকে ওঠাব।

—না না, একটা ঝামেলা হইব। আপনের লগে মুই নামুম।

মাহবুব আর কথা বাড়ায় না। বুঝতে পারে, যে পর্যন্ত কবরে নামতে হবে, তার অনেক নিচে দবিরের হাইট। ওকে টেনে তোলা কঠিন হবে। ও লাফ দিয়ে নামতে পারবে, কিন্তু লাফ দিয়ে তো উঠতে পারবে না। ও দবিরের মাথায় হাত রেখে বলে, দাঁড়িয়ে থাক। কাঁদিস না।

একসময় দাফনের কাজ শেষ হয়। যে যার পথে যায়। বাড়ির কাছে কবর হয়েছে। ঘরের দিকে তাকিয়ে ভাবে, যাবে কি একবার ছেলেহারা মায়ের কাছে? বোবা ছেলের মা, যে তাকে কোনো দিন মা ডাকেনি? পরক্ষণে মনে হয়, দরকার নেই। মনে মনে বলে, হরিণঘাটার নদী পচে গেছে, বাতাস পচে গেছে, তুমি আর কেমন করে ভালো থাকবে, মাগো? ও নিজেও জোরে শ্বাস টানে না। পচা লাশের দুর্গন্ধ ভরা বাতাস ও আর নিজের মধ্যে নিতে চায় না। অনেকটা পথ হেঁটে আসে ও। একা একা। এত দূরে বসতি নেই। সে জন্য ওর সঙ্গে বা আগে-পিছে কেউ নেই। ও ব্রিজের ওপর উঠে দাঁড়ায়। রেলিং ধরে ঝুঁকে থাকে পানির দিকে।

কোনো এক দিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসে ফুলমেহের। এসেই জড়িয়ে ধরে মাহবুবকে।

—চিংড়িপোনা, আমি এসেছি।

—ফুলমেহের, তুই আমার মাথার মণি।

হি হি করে হাসতে হাসতে ও বলে, মাথার মণি, মাথার মণি। আমি একটা ফুল আনি? তোমার মাথায় লাগিয়ে দেব?

—হ্যাঁ, নিয়ে আয়। ওই যে ওই বেগুনি ফুলটা খুব সুন্দর।

—হুর রে, ফুল আনতে যাই।

ফুলমেহের এক দৌড়ে বুনোফুলের লতার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। লতাসহ একটি ফুল ছেঁড়ে। ও ধরে নেয় যে লতা দিয়ে মাথায় বেঁধে না দিলে চিংড়িপোনার ছোট চুলে তো ফুল আটকানো যাবে না। ওটা মাথা থেকে টুপ করে পড়ে যাবে। ফুল নিয়ে ও আবার দৌড়ে ফিরে আসে।

—তুমি বসো, চিংড়িপোনা। আমি তোমার মাথায় আমাকে বেঁধে দেব।

—ওরে দুষ্টু মেয়ে। তোর মাথায় তো খুব বুদ্ধি। তুই আমার মাথায় ফুলমণি হয়ে থাকবি রে, সোনা।

ফুলমেহের বেগুনি ফুলের লতা মাহবুবের মাথার চারদিকে পেঁচিয়ে গিঁট বেঁধে দেয়। মাহবুবকে জিজ্ঞেস করে, এই ফুলের নাম কী, চিংড়িপোনা?

—আমি তো জানি না রে। বুনোফুলের নাম আমার শেখা হয়নি। আমি তো ছোটবেলায় বুনোফুল দেখিনি রে, ফুলমেহের।

—আমি অনেক দেখেছি। ফুলের রং সুন্দর, ফুলের সুবাস নাকে ঢুকলে মন ভরে যায়।

—তুই একটা পাক্কু মেয়ে। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে রে?

—রাজপুত্রের মতো।

—তুই তো রাজপুত্র দেখিসনি।

—রাজপুত্রের গল্প শুনেছি।

—ও, তাই।

—তাই—তাই—হি হি করে হাসতে হাসতে কাঠের ব্রিজের ওপর তাকায় ফুলমেহের। মাহবুব রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলমেহের লাফালাফি করে জিজ্ঞেস করে, চিংড়িপোনা, তুমি কী দেখছ পানিতে?

—মাছ দেখছি।

—আমিও দেখব।

—দাঁড়া আমার পাশে।

ফুলমেহের ওর পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে, পচা গন্ধ আসছে। পচা গন্ধ…

—কিসের গন্ধ পাচ্ছিস?

—জানি না কিসের গন্ধ। কিন্তু খুব খারাপ। খুব খারাপ—ওয়াক থু—আমার বমি পাচ্ছে…

মাহবুবেরও মনে হয়, নদী থেকে মানুষের লাশের গন্ধ আসছে। ও বস্ফািরিত দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকায়। মাথা ঘুরিয়ে বনের দিকে তাকালে মনে হয়, গাছের মাথা ছুঁয়ে আসা বাতাস থেকে গন্ধ আসছে। পেছন দিকে তাকালে মনে হয়, মাটি থেকে গন্ধ আসছে। ঘাস, বুনোফুল, লতাপাতা থেকে পচা গন্ধ আসছে। ও স্তব্ধ হয়ে চারদিকে তাকায়। বুঝতে পারে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। ওর মাথার ভেতরে শিরা-উপশিরা কাজ করছে না।

ফুলমেহের কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি আমার হাত ধরো, চিংড়িপোনা। আমি মরে যাচ্ছি। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ও ব্রিজের ওপর বসে পড়ে।

মাহবুব ওর হাত ধরে টেনে তুলে বলে, ওঠ।

ফুলমেহের দুই হাতে চোখ মোছে।

তোর খিদে পেয়েছে রে?

—হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে আমি কিছু খাইনি। পানিও না।

—কী খাবি, বল?

—আইসক্রিম।

—আইসক্রিম?

—আমি তো কখনো আইসক্রিম খাইনি। অন্যরা যখন খেয়েছে, তাকিয়ে দেখেছি।

—ঠিক আছে, চল তোকে আইসক্রিম কিনে দেব।

—সত্যি! ওয়াও…

—তার আগে আমাদের কাজ আছে।

—কী কাজ?

—তোর চোখের পানি বিষখালী নদীতে ভাসিয়ে দেব। চোখ মুছে নদীতে হাত ধুয়ে ফেল।

ফুলমেহের তা-ই করে।

—জোর করে শ্বাস নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দে। তোর নিঃশ্বাস বাতাসে মিশে যাক। তোর পায়ের ছোঁয়া মাটিতে রাখ।

ফুলমেহের তা-ই করে। দুই পায়ের পাতা দিয়ে মাটিতে চাপ দেয়।

তখনই মাহবুবের মনে হয়, সময়ের পচা গন্ধ খানিকটুকু কমেছে। পারবে কি ওরা সময়কে সুবাতাসে ভরিয়ে দিতে?

ফুলমেহের হাসতে হাসতে বলে, আমার চোখের পানিতে নদী থেকে ভেসে আসা গন্ধ কমেছে, চিংড়িপোনা।

বাতাস থেকে?

বাতাস থেকেও কমেছে। মাটি থেকেও।

—তোকে তো অনেক দূর যেতে হবে রে?

—আমি যাব।

—পারবি?

—এক শ বার পারব।

—আয়, আমার হাত ধর। তোকে এগিয়ে দিই।

—কোথায় যাব?

—হরিণঘাটার পথে শ্যামলী নিসর্গে।

—মানে? ফুলমেহের অবাক হয়।

হা হা করে হাসে মাহবুব।

—তোর জন্য আইসক্রিম কিনতে যাব।

—চলো, চলো।

ফুলমেহের ওর হাত ধরে টেনে লাফালাফি করে। পেছনে বনের ভেতর থেকে হরিণ দৌড়ে এসে জলের ধারে দাঁড়ায়। পানি থেকে ডাঙায় ওঠে লাল কাঁকড়া। মাথার ওপর একঝাঁক পাখি।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন