জোছনা ও জননীর গল্প

‘ভোরের কাগজ’-এর সাহিত্য পাতায় হুমায়ূন আহমেদ ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে থাকা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। ১৭-১৮ বছর আগের কথা। হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশাল ক্যানভাসের উপন্যাসটি লেখার জন্য স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ আরো কয়েক বছর আগে তাঁকে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি খাতা উপহার দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখতে শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কয়েক কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ করে দেন। ‘নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন।’ এই লাইনটি দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়ে কিছুদূর এগোয়, তারপর আর খবর নেই। লেখা বন্ধ। পত্রিকার সম্পাদক একটু ফাঁপরে পড়েন। তারপর কিছুদিনের গ্যাপে আবার শুরু হয় লেখা। কয়েক কিস্তির পর আবার বন্ধ। ঈদ সংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক-সিনেমা_সবই লিখছেন হুমায়ূন আহমেদ, শুধু ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখছেন না।
কেন?
তাঁর লাখ লাখ পাঠকের মতো আমার মনেও প্রশ্নটি ঘুরঘুর করে। দুবারে লেখা কয়েক কিস্তি পড়ে অস্থির হয়ে আছি। কবে শেষ হবে এই উপন্যাস? কবে পুরোটা পড়া যাবে?
দেখা হলে জিজ্ঞেস করি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করেন। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। সময় কাটে সময়ের মতো। হৃদয়ে দুর্যোগ নামে লেখকের। সিঙ্গাপুরে গিয়ে বাইপাস করান। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগমুহূর্তে অ্যানেসথেশিয়ার কারণে অবচেতন হওয়ার মুহূর্তে তাঁর মনে পড়ে একটি কাজ বাকি রয়ে গেল, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লেখা। মাতৃভূমির ঋণ শোধ করা হলো না। ফিরে এসে লেখা শুরু করেন। এবার আর কিস্তি কিস্তি নয়, কোনো পত্রিকায় ধারাবাহিক নয়; সরাসরি লেখা শেষ করা, বই বের করা। এবার তিনি থামলেন না, লেখা শেষ করলেন।
হুমায়ূন আহমেদের পাঠকরা জানেন, লেখায় এক ধরনের ঘোর তৈরি করেন তিনি, এক ধরনের মায়া বিস্তার করেন। একবার তাঁর লেখার ভেতরে ঢোকার অর্থ হচ্ছে সেই মায়ার জগতে বন্দি হওয়া। পড়া শেষ হওয়ার পরও ঘোর সহজে কাটতে চায় না। পাঠক আচ্ছন্ন থাকে অনেক দিন।
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি।
তবে লেখায় শুধু যে পাঠককেই আচ্ছন্ন করেন হুমায়ূন আহমেদ তা নয়, তিনি নিজেও আচ্ছন্ন হন। লেখার সময় তাঁর নিজের মধ্যেও তৈরি হয় আশ্চর্য রকমের এক ঘোর। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লেখার সময় তাঁকে এ রকম ঘোরে পড়তে দেখেছি আমি। দিনভর মাথা নিচু করে লিখছেন, চা খাচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন, প্রুফ দেখছেন, লেখা বদলাচ্ছেন, কাটাকাটি করছেন আর পড়ছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা-ইংরেজিতে লেখা হেন বই নেই, হেন পত্রপত্রিকা নেই, যা তিনি না পড়েছেন। সন্ধ্যার পর সাধারণত লেখেন না তিনি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেন। সেই আড্ডার সময়ও লক্ষ করেছি, সবার সঙ্গে থেকেও কোন ফাঁকে তিনি যেন একা হয়ে গেছেন। তাঁর মন চলে গেছে ১৯৭১-এ। মনে মনে জোছনা ও জননীর গল্পের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো সাজাচ্ছেন তিনি। নিজের মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি না হলে তিন-চার মাসের মধ্যে ৪৯৩ পৃষ্ঠার এ রকম একটি মহৎ উপন্যাস লিখে শেষ করা যায় না। সঙ্গে আছে ছয় পৃষ্ঠার চমৎকার একটি ভূমিকা। আর ব্যাপক পড়াশোনার কথা তো আগেই বললাম।
এতক্ষণে পাঠক সংগত কারণেই আশা করবেন উপন্যাসটির ভালোমন্দ নিয়ে আমি কিছু কথা বলব, কিছু সমালোচনা করব, উপন্যাসটির দোষত্রুটি ধরব, অমুক জায়গায় তমুক হলে ভালো হতো, ওই চরিত্রটি যেন হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে, অমুক অমুক তথ্যে গণ্ডগোল আছে ইত্যাদি। সবিনয়ে বলি, ওটি আমার কাজ নয়। ওই কাজটি করবেন গবেষক-সমালোচকরা। আমি গবেষক কিংবা সমালোচক নই। যদিও জোছনা ও জননীর গল্পের পূর্বকথায় ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ : ‘জোছনা ও জননীর গল্প কোনো ইতিহাসের বই নয়, এটি একটি উপন্যাস। তার পরও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। সেখানেও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। হওয়াটা স্বাভাবিক। উপন্যাস যেহেতু কোনো আসমানি কিতাব না, এসব ভুলভ্রান্তি দূর করার উপায় আছে।
উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষজন এনেছি। এই স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় কোনো ভুল যদি করে থাকি, তার জন্যে আগেভাগেই ক্ষমা চাচ্ছি। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি_একজন লেখক যা লিখবেন, সেটাই সত্যি।
সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো
উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেওয়া। প্রকাশিত হওয়ার আগেই এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি (এই প্রজন্মের পাঠকের কথা বলছি) তারা পড়ার পর বলেছে_উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এ রকমও কি হয়?
তাদের কাছে আমার একটাই কথা_সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ংকর সুন্দর স্যুরিয়ালিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।’
খানিকটা নয়, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি প্রায় সবখানিই ধরেছেন। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখে আপনি আপনার লেখকজীবন পূর্ণ করেছেন। এ রকম একটি উপন্যাস লেখার পর একজন লেখকের আর কিছু চাওয়ার থাকে না।
হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য লেখার সঙ্গে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ একেবারেই মেলে না। এ একেবারেই অন্য ধাঁচের রচনা। অতি সরল ও আশ্চর্য রকমের নিরাসক্ত, ঘরোয়া ভাষায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন তিনি। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ_এই তিনটি কালকে কখন যে একাকার করে দিয়েছেন গল্পের ভেতর, কখন যে পাঠককে নিয়ে গেছেন স্বপ্নে, কখন ফিরিয়ে এনেছেন বাস্তবে, টেরই পাওয়া যায় না। উপন্যাস রচনার কোনো প্রচলিত রীতি তিনি মানেনইনি। যেভাবে লিখে আনন্দ পেয়েছেন, যেভাবে পাঠককে বোঝাতে পেরেছেন, গল্প সেভাবেই এগিয়ে গেছে। যেখানে যে তথ্যের প্রয়োজন নির্বিকারভাবে তা ব্যবহার করেছেন, ফুটনোটে উল্লেখ করেছেন তথ্যসূত্র। কোথাও কোথাও মুক্তিযুদ্ধের দলিল প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ যখন যেখানে যা প্রয়োজন, যেমন করে সাজালে উপন্যাসটি পূর্ণাঙ্গ হবে, তা-ই করেছেন। বহু টুকরোটাকরা গল্প, ঘটনা-চরিত্র আর ইতিহাসের উপাদানকে মহৎ শিল্পীর ভঙ্গিতে জোড়া দিয়ে দিয়ে যে সময়কে তিনি সম্পূর্ণ তুলে ধরেছেন, সেই সময়ের নাম ১৯৭১। ফলে এই উপন্যাস একাধারে আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় সময়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং মূল্যবান দলিলও। হুমায়ূন আহমেদ শুধু উপন্যাসই লেখেননি, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস লেখার মহৎ দায়িত্বটিও পালন করেছেন।
এই উপন্যাসে চরিত্র হয়ে এসেছেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, টিক্কা খান; অর্থাৎ সেই সময়কার সব শ্রদ্ধেয় ও নিন্দিত মানুষজন। ভারতীয় বাহিনীর চরিত্ররা এসেছে যে যার ভূমিকায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন, রাজাকাররা এসেছে, শর্শিনার পীর সাহেব এসেছেন আর এসেছে সমগ্র দেশের নানা স্তরের নানা রকম মানুষ। ছোটবড় ও ঐতিহাসিক এত চরিত্রের সমাহার আর কোনো বাংলা উপন্যাসে এভাবে এসেছে কি না, এত সার্থকভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
‘ইরতাজউদ্দিন তখন মাওলানা সাহেবকে চিনলেন_ইনি মওলানা ভাসানী! পত্রিকায় কত ছবি দেখেছেন। এই প্রথম সামনাসামনি দেখা।
ইরতাজউদ্দিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মওলানা ভাসানী তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ঘুম ভালো হয়েছে? যেন কতদিনের চেনা মানুষ।
ইরতাজউদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি।
আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করেছি, কিছু মনে করবেন না।
ইরতাজউদ্দিন আরো লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। এ রকম একজন বিখ্যাত মানুষের সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা যায় না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
এই ইরতাজউদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ হয় না, জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এই কারণে ক্যাপ্টেন বাসেত তাঁকে নীলগঞ্জ স্কুল ও বাজারে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় প্রদক্ষিণ করায়। বাজারে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। দরজির দোকানের এক দরজি একটা চাদর নিয়ে ছুটে এসে ইরতাজউদ্দিনকে ঢেকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল যে সঙ্গের মিলিটারিরা বাধা দেওয়ার সময় পেল না।
ইরতাজউদ্দিন ও দরজিকে মাগরেবের নামাজের পর সোহাগী নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করা হলো। মৃত্যুর আগে আগে ইরতাজউদ্দিন পরম নির্ভরতার সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে উঁচু গলায় শেষ প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহপাক, যে মানুষটা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল তুমি তার প্রতি দয়া করো। তুমি তার প্রতি তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।’
পরদিন প্রবল বৃষ্টিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব আর তাঁর পাগল স্ত্রী আসিয়া সোহাগী নদীর পাড় থেকে ইরতাজউদ্দিনের লাশ টেনে আনার সময় এলাকার কোনো বাঙালি নয়, বেলুচ রেজিমেন্টের সেপাই আসলাম খাঁ তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। কলমের সামান্য আঁচড়ে আঁকা আসলাম খাঁ চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক বোঝালেন, পাকিস্তান আর্মিতেও দু-একজন হৃদয়বান মানুষ ছিল।
‘শেখ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, তুই তো তোর গোপন কথা সবই বলে ফেললি। তুই আইবির লোক, তুই তোর পরিচয় গোপন রাখবি না?
আমি সরকারের হুকুমে আসলেও আমি ডিউটি করি আপনার। আমি খেয়াল রাখি যেন কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করতে না পারে।
আমার ডিউটি করিস কী জন্যে?
কারণ আপনিই সরকার।
শেখ মুজিব এই কথায় খুবই তৃপ্তি পেলেন। মোবারক হোসেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই আমার জন্যে কী করতে পারবি?
আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়। আমি পড়ব।
তোর নাম কী?
মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।
দেশের বাড়ি কোথায়?
কিশোরগঞ্জ।
ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ। ছেলেমেয়ে কী?
তিন মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম_মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।
কী বলিস তুই? ছেলের নাম ইয়াহিয়া?
আমার দাদিজান রেখেছেন। নবির নামে নাম।
আয় আমার সঙ্গে।
স্যার, কোথায় যাব?
তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুকুম দেব ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তামিল করতে পারিস কি না।
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার চলেন।
শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এই আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। এ হলো আমার এক ছেলে।’
্অতি সামান্য এক ঘটনায়, মাত্র কয়েক লাইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের প্রধান দিকটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুললেন হুমায়ূন আহমেদ। মানুষের প্রতি এই মহান নেতার তীব্র ভালোবাসা। অন্যদিকে তাঁর জন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। জীবন দিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।
জিয়াউর রহমানের চরিত্রটি এলো এভাবে_’তাঁর চোখ কালো চশমায় ঢাকা। গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। বসেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। বাঁ হাতের কব্জিতে পরা ঘড়ির বেল্ট সামান্য বড় হয়ে যাওয়ায় হাত নাড়ানোর সময় ঘড়ি উঠানামা করছে। এতে তিনি সামান্য বিরক্ত, তবে বিরক্তি বোঝার উপায় নেই। যে চোখ মানবিক আবেগ প্রকাশ করে, সেই চোখ তিনি বেশির ভাগ সময় কালো চশমায় ঢেকে রাখতে ভালোবাসেন। মানুষটার চারপাশে এক ধরনের রহস্য আছে।
তাঁর নাম জিয়াউর রহমান।’
‘মেজর জিয়া এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এম শফিউল্লাহ এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে এক বৈঠকেও খোলাখুলি নিজের এই মত প্রকাশ করেন। তাঁর কথা হলো, গেরিলা ধরনের এই যুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার কমান্ড কাউন্সিল। সবচে’ বড় কথা সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না।’
জোছনা ও জননীর গল্পে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কথা লেখা হয়েছে এইভাবে_’নিয়াজীর ফোঁপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তাঁর পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।
জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। তাঁদের স্তম্ভিতভাব কাটতে সময় লাগল। এক সময় নিয়াজী করমর্দনের জন্যে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে।
কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না।’
এ রকম বহু স্মরণীয় উদ্ধৃতি তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে। কত চরিত্র, কত ঘটনার কথা মনে পড়ছে! শাহেদ, আসমানী, জোহর, মোবারক, গৌরাঙ্গ, নাইমুল, মরিয়ম, শাহ কলিম, রুনি, বি হ্যাপি স্যার, ধীরেন্দ্র রায়চৌধুরী, কংকন। আর অতি ছোট্ট চরিত্র হারুন মাঝি। যে ছিল একজন ডাকাত। একটি উত্তাল সময় কিভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, কিভাবে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল মানুষ, এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে সেই কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন স্তরের মানুষ, কখনো একজন ঠেলাগাড়িঅলা, কখনো হুমায়ূন আহমেদের নিজ পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন, পাঙ্খাপুলার রশিদ, নানা স্তরের নানা মানুষ, কারো সঙ্গে কারো হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, আবার সবাই যেন সবার সঙ্গে যুক্ত। যে সুতোয় সব মানুষকে একত্রে গেঁথে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামের এই মহৎ মালাটি হুমায়ূন আহমেদ গেঁথেছেন, সেই মালার নাম ১৯৭১-এর বাংলাদেশ। এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যাবে, ক্রোধে আবেগে ঘৃণায় মমতায় এবং চোখের জলে ভাসবে মানুষ।
‘তারও অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি-গোঁফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে কি আমি চিনি? দীর্ঘকায় এই যুবক দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, মা দেখ, কে এসেছে! মাগো দেখ কে এসেছে!
মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে_আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছ কেন? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে।
নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এ রকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি।
বাস্তবের সমাপ্তি এ রকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে! আহা রে!’
হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শুধু উপন্যাস নয়, উপন্যাসের চেয়ে বেশি কিছু। এ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এক মহাকাব্য। এত সার্থক সুন্দরভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কিছু রচিত হয়নি। বাঙালির ঘরে ঘরে এই গ্রন্থ অত্যন্ত যত্নে ও মায়ায় রক্ষিত হবে। কোনো কোনো জোছনা রাতে বাংলার গ্রাম-প্রান্তরের দাওয়ায় বসে একজন তাঁর উদাত্ত গলায় পড়বেন এই উপন্যাসের একেকটি অধ্যায় আর তাঁর চারপাশ ঘিরে বসে থাকা শ্রোতারা চোখের জলে ভাসবে। এই উপন্যাস তাদের ফিরিয়ে নেবে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের সেই মিশ্র সময়ে_ ১৯৭১।