সংসার যাপন

image_1390_341747‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’_ এই কথাটি প্রচলিত আছে। কিন্তু সংসারের মূল উপাদান হলো সংসারের অংশীদার দু’জন মানব-মানবী। পরস্পরের আস্থা ও ভালোবাসায় তারা ঘর বাঁধে এবং জীবনের যাত্রা শুরু করে। আমরা এটাকেই বলি ‘সংসার’। প্রেম, ভালোবাসা ও নীড়_ এভাবেই গঠিত হয় সংসার। পরস্পরের ওপর গভীর আস্থা না থাকলে সঙ্গ হয়; কিন্তু সংসার হয় না। সংসারের জন্য দরকার নির্ভরশীলতা। একে অন্যের ওপর নির্ভর করবে নিঃস্বার্থভাবে কিংবা স্বার্থপরতাও এর মধ্যে থাকতে পারে। তবে এ স্বার্থপরতার নাম অবশ্যই হতে হবে ভালোবাসা।
ভালোবাসা অবশ্যই একটি অন্তরঙ্গ বিষয়। হৃদয়ের বিরুদ্ধে নানা রূপ, ভাব, কল্পনা, কাম ও প্রেম জড়াজড়ি করে বাস করে। এর মধ্যেই নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে প্রবল বাসনা। বাসনার অপর নাম ইচ্ছাও বলা যায়। ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত কাহিনীর সৃষ্টি করে কেচ্ছায় পরিণত হয়। আর গল্পের প্রয়োজনে স্মৃতি থেকে চরিত্র সৃষ্টি করতে গেলে আমি শব্দটাই এসে যায়। অথচ আমাকে উহ্য রাখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ভাবছি, আমাকে বিয়োগ করলে গল্প আর অবশিষ্ট থাকে না। গল্পের জন্যই এখন আমার প্রয়োজন আমাকে। আর আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সব ঘটনাই চলে যায় ঢাকার বাইরে। এত দূরে যে সব কথা এখন মনেও পড়ে না, কেবল কিছু মুখ মনে পড়ে। এত মুখের ভিড়ে আসল গল্পের কাঠামোটা বারবার এলোমেলো হয়ে যায়। অদ্ভুত সব মানুষ আমার স্মৃতিতে এসে ভিড় করে। মানুষের সব গল্প তো আর যেভাবে চাই সেভাবে অক্ষরে বিম্বিত হতে চায় না। তবু আমি গল্প বানাই এবং গল্পটির একটা কূল-কিনারা করতে চাই। মন বলছে, এক জায়গা থেকে শুরু করলে নিশ্চয়ই কাহিনী যেমন হোক তা শেষ হবে; কিন্তু আমার কাহিনী তো অশেষ। শুরু করলেই আর সীমানা মানতে চায় না। ভয়ে ভয়ে শুরু করার বিষয়টি চিন্তা করি। যেসব মুখ ভেসে ওঠে, সেসব ভাঙিয়ে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই হাতের মুঠোতে ধরা দেয় না। এখন ভাবছি, শুরুটাই আমার কাজ। শেষ করার দায় আমি নিতে পারব না।
বহু দিন আগে আমার চাচার কর্মস্থলে তাদের সঙ্গে বাস করতাম, যাদের বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম। তাদের ছিল নেশার দ্রব্য বিক্রি করার লাইসেন্স। নিজের যদিও নেশার দ্রব্য বিক্রির উপার্জনে সংসার চলত; কিন্তু নিজেরা কখনও নেশার দ্রব্য গ্রহণ করত না। সেই পরিবারটিও আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ইতিহাস জানি। অত্যন্ত বেদনাময় সেই ইতিহাস।
যখন কারও কিছু কাহিনীসূত্র আমার মনে পড়ে তখনই মনে হয় গল্পটির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা। এর পর আর সাহসে কুলোয় না। একটা কথা আগেও বলেছি, অতি দরিদ্র পরিবার থেকে আমি এসেছিলাম; সম্ভবত এ কারণেই আমার গল্পে স্বস্তিকর কিছু নেই। আবার অশ্রুজলও নেই, ধৈর্য ধারণের দৃষ্টান্ত আছে। এই দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার তো কোনো অভাবই পূরণ হলো না। আমাদের সংসারে আমার মাকে দেখেছি কী প্রবল আগ্রহ নিয়ে সামলে গিয়েছেন তার সংসার এত এত প্রতিকূলতার মধ্যেও। আমার মা ছিলেন আমার কাছে প্রায় অচেনা এক গর্ভধারিণী ও স্তন্যদায়িনী। সন্তানের চেয়ে স্বামীর প্রতিই তিনি ছিলেন বেশি মনোযোগী। বাবার প্রতি তার প্রেম ছিল দু’কূল ছাপানো। সদা সজ্জিতা, সুরুচিপূর্ণা এই মহিলা আমার মা_ এটা ভাবতে ও তাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতে আমার অহঙ্কারের সীমা ছিল না। আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভয় করতাম ও ভালোবাসতাম। তিনি ছিলেন আমার ধরার বাইরে অন্য এক জগতের বাসিন্দা। তাকে দূর থেকে দেখে শান্তি পেতাম আমি। আমার জন্য মায়ের মনের গভীর গোপন অঞ্চলে এক স্নেহ কাজ করত, যা সব সময় আড়ালে থাকত। কিন্তু প্রয়োজন হলেই সেই স্নেহের অঞ্চলে আকাশভর্তি ভালোবাসার বৃষ্টি ঝরত। এভাবেই জীবনের শুরুতে দেখেছি কী করে একটি সংসার গড়ে ওঠে প্রবল মায়া, ভালোবাসা এবং আস্থা ও বিশ্বাসে। আমার মায়ের মৃত্যুর সময় আমি পাশে থাকতে পারিনি। তিনি গত হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। তার শেষ অবস্থার আগে আমি ছিলাম ঢাকায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। খবর শুনে আমি ছুটে গিয়েছিলাম। মায়ের স্থির, নির্বাক মুখ দেখে আমি তখন কিছুই ভাবতে পারিনি।
মানুষের মধ্যে স্মৃতি আছে, স্বপ্ন আছে। এ জন্যই মানুষ ফিরে তাকায়। মানুষের প্রতি মমতায় সিক্ত হয়ে থাকে, আমরা নাম দিয়েছি মনুষ্যত্ব, কেবল মানুষই সত্যে স্বপ্নে মিলিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকে। সে নিন্দায়, প্রশংসায় উত্তেজিত হলেও দুঃখে-দারিদ্র্যে ভেঙে পড়ে। এই ভেঙে পড়ার কাহিনীই হলো মহাকাব্য। মহাকাব্য অবশ্য আর অখণ্ড নেই, তা শত খণ্ডে ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়াতেই মানুষ অমরতার স্বাদ আস্বাদন করে। এখনও হাসে, ভালোবাসে। এই অভ্যাসটি শুধু মানুষেরই আয়ত্ত হয়েছে, জগতে আর কোনো প্রাণীরই আয়ত্ত হয়নি। কারণ মানুষেরই ভাষা আছে আর কোনো প্রাণীরই ভাষা নেই; আছে চিৎকার।
আর এসবের পাশাপাশি মানুষের মনের গভীরে লুক্কায়িত থাকে প্রবল আকাঙ্ক্ষাগুলো। তখন পুরুষ কামনা করে নারীকে। নারীও পুরুষকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে বলে ওঠে_ ‘তবু আমি ভালো আছি। তোমাকে, তোমার যা কিছু অভ্যাসের অন্তর্গত; সবকিছুই আমি আত্মস্থ করে নিতে প্রস্তুত আছি। আমি যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য। তোমার একটি চুম্বন ও আলিঙ্গনের জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি এই সীমাহীন রাস্তার ওপর। এই রাস্তা চলে গেছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার হয়ে বার্ধক্য ও মৃত্যুর দিকে। কে জানে_ মৃত্যুর পর কী আছে! কেউ জানে না। মৃত্যুতে সমাপ্তি। মৃত্যুতে অবসান। মৃত্যু হলো ফিরে না আসার নাম। যারা একবার মৃত্যুকবলিত হয়েছে তারা কেউ ফিরে আসেনি। যেহেতু ফিরে আসেনি, আমরা জানি না মরণের ওপারে কী আছে।’ মৃত্যু সর্বদাই এক গোলক ধাঁধা। এই আছে, এই নাই অবস্থা। যে মানুষটি জীবিত এখন, পরমুহূর্তেই তিনি নিথর, প্রাণহীন। পৃথিবীর আলো-বাতাস শোষণ করে যে বেঁচে ছিল এতকাল, কখনও সে আর পারবে না এই রস আস্বাদন করতে।
প্রেম হলো এক স্বর্গীয় অনুভূতি। যা শুধু মানুষের মর্মে বাসা বেঁধে আছে। এ কারণেই মানুষ মৃত্যুর সামনেও মেরুদণ্ড সোজা করে চোখের ওপর চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। সবই যখন পরাজিত হয় তখনও মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ এটা পারে বলেই সে কবিতা লেখে এবং মৃত্যুতে কাতর হয় না। একই সঙ্গে আমরা বলি, এই তো মানব-মানবী জোড় বেঁধে আছে। এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে জগতের শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল কর্ম। সব শিল্পই এই পরিস্থিতির কাছে কোনো না কোনো সময় একবার নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে মানবিকতাকে, প্রেমকে একই সঙ্গে প্রেমের পরিণতিকে শ্রদ্ধা জানায়। এতে কার কী লাভ হয়, কে জানে। কিন্তু অনেক নর-নারী অমরতার স্বাদ পেয়ে আত্মদানে তুষ্ট হয়ে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে। এটা শুধু মানুষই পেরেছে; আর কেউ পারেনি।
লবণ ছাড়া কোনো খাদ্যেরই গুণ, স্বাদ, গন্ধ ঠিকমতো রসনায় লালা ঝরাতে পারে না। স্বাদ চাই রসনায়। আর এ কথার ভিত্তিতে বলা যায়, জীবনের স্বার্থপরতার নামই হলো ‘লালসা’। আর এই স্বার্থপরতার প্রাবল্যে মানুষকে সাধারণত পুরুষকে নারীর প্রতি হাত বাড়িয়ে দিতে সাহসী করে তোলে। নারী পুরুষের বাসনার তাড়না দেখে মৃদু হাসতে থাকে। একটি মাত্র আলিঙ্গনে শীতল, শান্ত ও সুস্থির করে নিদ্রাকাতর করে তোলে। পুরুষ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নারীর পদতলে ঘুমিয়ে পড়ে। আর নারী বিদ্রূপাত্মকভাবে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে_ ‘হায়রে পুরুষ, তুমি কত দুর্বল! অথচ তোমার কীর্তি কত প্রবল। তুমি আমার কাছে এসেই তোমার সব পৌরুষকে আমার পায়ের ওপর অঞ্জলি দাও। তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি। কারণ তুমি প্রবল ও পরাক্রান্ত হওয়ার উপাদান নিজের বুকের ভেতর ধরে রাখতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি কর না।
সংসারের নানা উপাদান মূলত নারী ও পুরুষের মধ্যেই রয়েছে। পাশাপাশি থেকে সুখে-দুঃখে একে অন্যের ভরসার জায়গাই হলো সংসার। নারী-পুরুষের মিলন তখনই হয় সুখের-শান্তির।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন